চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ
যমুনাদাস গঙ্গার সহিত গোপনে দেখা করিত। সে হুজুরীমলের সকল কথাই তাহাকে বলিয়া দিল। যমুনা গঙ্গাকে বড় বিশ্বাস করিত; তাহার নিকটে সে কোন কথা গোপন করিত না। যমুনা যে সিন্দুক হইতে টাকা আনিয়া হুজুরীমলকে দিয়াছিল, তাহাও যমুনার মুখে গঙ্গা শুনিয়াছিল। সুতরাং এমন সুবিধা আর হয় না। দশ হাজার টাকা অনায়াসেই পাওয়া যাইতে পারে। হুজুরীমলের নিকট হইতে এ টাকা ফাকী দিয়া লইলে কেহই তাহাদিগকে সন্দেহ করিতে পারিবে না।
সেইরূপই বন্দোবস্ত হইয়াছিল। গঙ্গা হুজুরীমলের সঙ্গে যাইবে বলিয়া স্বীকার করিয়াছে। রাত্রি বারটার সময়ে গঙ্গা তাহার সহিত রাণীর গলিতে গোপনে দেখা করিবে। যমুনাদাস ছদ্মবেশে নিকটে লুকাইয়া থাকিবে। হুজুরীমল তাহার হাতে টাকা দিবামাত্র যমুনাদাস হঠাৎ তাহার হাত হইতে টাকা কাড়িয়া লইবা পলাইবে। হুজুরীমল লোকলজ্জার ভয়ে, আর নিজে এইরূপভাবে ধরা পড়িবার ভয়ে কোন গোলযোগ করিতে পারিবে না। সে গঙ্গাকেও সন্দেহ করিতে পারিবে না। ভাবিবে বড়বাজারের কোন গুণ্ডা টাকা ছিনাইয়া লইয়া গিয়াছে।
সকলই এইরূপ স্থির হইয়াছিল, কিন্তু যে গঙ্গা গভীর রাত্রে গোপনে নানা স্থানে যাইত, সে আজ ভয় পাইল কেন, সে জানে না—একেবারে যাইতে তাহার সাহস হইল না। যমুনাদাস গোপনে তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলে তাহাকে গঙ্গা বলিল, “ভাই, আমার কেমন ভয় করিতেছে, আমি যাইতে পারিব না।”
গঙ্গা উপহাস করিতেছে ভাবিয়া যমুনাদাস হাসিয়া বলিল, “দশ হাজার টাকায় অনেকদিন বেশ চলিবে—কেমন গঙ্গা?”
গঙ্গা বলিল, “ঠাট্টা নয়—যথার্থই আমি যাব না; আমার কেমন ভয় করিতেছে।”
“সে কি! তোমার ভয়?”
“হাঁ, আমি যাইতে পারিব না।”
“সে কি কাজের কথা! এমন সুযোগ আর হইবে না। দশ হাজার টাকা—সহজে মিলে না।”
“না, তুমি যতই বল না কেন, আমি যাইব না।”
“সে কি! তবে উপায়! ইচ্ছা করিয়া হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলিবে; দশ হাজার টাকা আর কি’ মিলিবে?”
“ভয় নাই, আমি একটা মতলব স্থির করিয়াছি।”
“কি, শীঘ্র বল। তুমি যে আমাকে একেবারে হতাশ করিয়া দিয়াছ।”
“আমি স্থির করিয়াছি, আমার কাপড় পরাইয়া গঙ্গিয়াকে পাঠাইব। অন্ধকারে হুজুরীমল তাহাকে চিনিতে পারিবে না। আমাকে ভাবিয়া তাহার হাতে টাকা দিবে।”
“রঙ্গিয়া রাজি হইবে?”
“হাঁ, সে আমার কথা খুব শুনে—তাহাকে সব বলিয়াছি।”
“অন্য লোককে এসব কথা বলা কি ভাল হইয়াছে?”
“টাকায় অনেকের মুখ বন্ধ হয়। আমি তাহাকে পাঁচ শত টাকা দিব বলিয়াছি। দশ হাজার টাকা পাইলে পাঁচ শত দিতে আপত্তি কি? টাকা ঠিক পাওয়া যাইবে। অন্ধকারে আমার কাপড়-পরা রঙ্গি য়াকে দেখিয়া হুজুরীমল ভাবিবে আমিই গিয়াছি, কোন সন্দেহ করিবে না। টাকা তাহার হাতে দিবে। এখন তোমার কাজ তুমি কর।”
“আমি টাকা ছিনাইয়া লইয়া পলাইলে তখন ত হুজুরীমল তাহাকে চিনিতে পারিবে?”
“ক্ষতি কি, আমি তাহাকে পরে ঠিক করিয়া লইতে পারিব।”
নর-রাক্ষস যমুনাদাস হাসিয়া বলিল, “এ টাকা গেলে তাহাকে আর এদেশে আসিতে হইবে না। সে হয় দেশ ছাড়িয়া পলাইবে—নতুবা আত্মহত্যা করিবে।”
গঙ্গা হাসিয়া বলিল, “তাহাতে আমাদের ক্ষতি কি, বরং বুড়ো বাইসের উপযুক্ত সাজা হইবে।”রঙ্গিয়া যাইতে রাজি হইয়াছে ত?”
“বলিলাম কি? পাঁচশো টাকা—কম নয়। ওর মত একটা গরীবের পাঁচশো টাকার লোভ সাম্লান সহজ নয়।”
“তবে সব ঠিক?”
“সব ঠিক।”
“তুমি একখানি রত্ন, তোমায় না পাইলে আমার কি দশা হইত?”
“আবার জেলে বাস করিতে।”
যমুনাদাস ভ্রূকুটি করিল। হৃদয়ের ভাব গোপন করিয়া হাসিয়া বলিল, “তোমার মত রত্নলাভ অনেক পুণ্যের ফল।”
গঙ্গা কোন কথা না কহিয়া মুখ ফিরাইল। উভয়ে উভয়কে হৃদয়ের সহিত ঘৃণা করিত; কেবল উভয়ে উভয়ের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভালবাসার ভাণ দেখাইত মাত্ৰ।