ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “টাকা ফেরৎ দিলে কেন?”
“রঙ্গিয়া মরিয়া যাওয়ায় আমার টাকার দরকার নাই—আমি কোনরকমে নিজেকে চালাইতে পারিব; কেবল তাহারই জন্য টাকার লোভ হইয়াছিল—আমি যদি তাকে পাই, তবে একবার দেখিয়া লই।”
উমিচাঁদের চক্ষু দিয়া অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতে লাগিল। অক্ষয়কুমার জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাহাকে দেখিয়া লইতে চাও?”
উমিচাঁদ দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করিয়া বলিলেন, “যে আমার রঙ্গিয়াকে খুন করিয়াছে।”
“কে সে মনে কর?”
“জানিতে পারিলে তাহাকে দেখিতাম।”
“কাহারও উপর সন্দেহ হয়?”
“না, তাহা হইলে তাহাকে সন্ধান করিয়া বাহির করিতাম।”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরমুখে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন উমিচাঁদবাবু, এসকল কথা পূৰ্ব্বে আমাদিগকে বল নাই কেন?”
“পাছে আপনারা আমাকে সন্দেহ করেন।”
“এমন মহা মূর্খ আর দুনিয়ায় নাই। যাহাই হউক, উপস্থিত আমি তোমার কথা বিশ্বাস করিলাম। তুমি নোটগুলি লইয়াছিলে, আবার ফেরৎ দিয়াছ—ভালই করিয়াছ। আমি এ ওয়ারেন্ট চাপিয়া রাখিলাম, তবে আমাদের কথার অবাধ্য হইলে –”
“আপনারা আমাকে যাহা বলিবেন, তাহাই করিব।”
“খুব ভাল কথা—উপস্থিত তুমি এসব কথা আর কাহাকেও বলিয়ো না।”
“কাহাকেও বলিব না।”
“তাহা হইলে এখন যাইতে পার।”
উমিচাঁদকে আর অধিক কথা বলিতে হইল না। সে তৎক্ষণাৎ সেখান হইতে পলাইল। উমিচাঁদ চলিয়া গেল। নগেন্দ্রনাথ এতক্ষণ নীরবে ছিলেন, এখন তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ যাহা বলিল, বিশ্বাস করিলেন কি?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “কতক করিয়াছি।”
“কিন্তু লোকটা যে বদমাইস, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।”
“সকলগুলিই সমান, তবে এর দুই-দুইটা খুন করিবার সাহস নাই। এখন আবার নূতন একজন খুনী বাহির হইল।”
“কে?”
“উমিচাঁদ যাহাকে দেখিয়াছিল।”
‘কে সে মনে করেন?”
“যে-ই হউক, তাহার সঙ্গে রঙ্গিয়ার পরিচয় ছিল।”
“তাহা ত নিশ্চয়—নতুবা সে তাহার সঙ্গে গাড়ীতে যাইবে কেন?”
“আপনি কাহাকে মনে করেন?”
“আমার মনে হয়, শান্তপ্রসাদ।”
“বাজে কথা—শান্তপ্রসাদ বলিয়া কেহ নাই।”
নগেন্দ্রনাথ কোন কথা কহিলেন না। অক্ষয়কুমার উঠিলেন। বলিলেন, “দেখা যাক্? কতদূর কি হয়। যেখান থেকে রওনা হওয়া গিয়াছিল, এ পৰ্য্যন্ত সেইখানেই থাকা গিয়াছে—কাজ কিছুই হয় নাই।”
অক্ষয়কুমার চলিয়া গেলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে যমুনাদাস আসিয়া উপস্থিত হইলেন। খুনের তদন্তের কতদূর কি হইল জিজ্ঞাসা করিলেন। নগেন্দ্রনাথ তাঁহাকে সকল কথা বলিলেন। শুনিয়া তিনি বলিলেন, “উমিচাঁদের কাছে টাকা আছে? বেটা চুরির জন্য নিশ্চয়ই জেলে যাইবে।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “গঙ্গা রঙ্গিয়াকে পাঠাইয়াছিল, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।”
যমুনাদাস ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন, “আমি তাহাকে একথা জিজ্ঞাসা করিব। তাহার উপরে আমার বিশ্বাস আছে।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “যদি রাগ না কর, একটা কথা বলি।”
“বল না, তুমি বলিবে–তাহাতে রাগ করিব কেন?”
“সত্যকথা বলিতে কি, গঙ্গাকে আমার খুব ভাল বলিয়া বোধ হয় না।” যমুনাদাস ভ্রূকুটি করিলেন। বলিলেন, “আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিব।”
তিনি আর কোন কথা না কহিয়া চলিয়া গেলেন। নগেন্দ্রনাথ ভাবিলেন, “ভালবাসায় লোক কতদূর অন্ধ হয়, যমুনাদাসই তাহার প্রমাণ। গঙ্গার সকল বিষয় যমুনাদাস জানিতে পারিলে বুঝিতে পারে, সে কি মহাভ্রমের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। স্ত্রীলোকের চরিত্র দেবতাও বুঝিতে পারে না।”