পঞ্চম পরিচ্ছেদ
উমিচাঁদ বলিল, “রঙ্গিয়ার নিকটে শুনিলাম যে, গঙ্গা নিজে যাইতে ইতস্ততঃ করিতেছে—অথচ টাকার লোভও ছাড়িতে পারিতেছে না। আর সে রঙ্গিয়াকে বলিয়াছে, “তুই যদি আমার কাপড় পরে রাণীর গলিতে কাল রাত্রি বারটার সময়ে দেখা করিস্, তাহা হইলে তোকে খুব সন্তুষ্ট করিব। তোকে এক শত টাকা দিব। সে অন্ধকারে আমি কি তুই জানতে পারবে না, তোর হাতে দশ হাজার টাকার নোট দেবে, তুই নোট নিয়েই ছুটে পালাবি, ভয়ে সে তোকে ধরিতে পারিবে না।” রঙ্গিয়ার কাছে এই কথা শুনিয়া আমি বলিলাম, “রঙ্গিয়া, টাকাটা আমরাই পাইতে পারি। তোমায় হুজুরীমল টাকা দিলে সে টাকা গঙ্গাকে দেবার দরকার কি, আমরা টাকা নিয়ে অন্য দেশে সুখে থাকিব। হুজুরীমল নিজে পরের টাকা চুরি করিয়াছে, কিছুই প্রকাশ করিতে পারিবে না—আমাদের কেহ সন্দেহ করিবে না—আমাদের এই সুবিধা।” রঙ্গিয়া এ প্রস্তাবে খুব উৎসাহের সহিত সম্মত হইল।”
“হইবারই কথা—সব কটী সমান জুটিয়াছিল, একেবারে অষ্টবজ্র!”
“কিন্তু আমি ইতস্ততঃ করিতেছিলাম—”
“বটে, এত ধৰ্ম্মজ্ঞান!”
“এই সময়ে যমুনা টিকিট লইতে আসিল। আমার তখনই সন্দেহ হইল, টিকিট লইয়া যাইবার অনেক লোক ছিল, যমুনা কেন? সে জল খাইতে চাহিল। আমি জল আনিতে বাহিরে আসিলাম; কিন্তু সে কি করে দেখিবার জন্য দরজার ফাঁকে চোখ লাগাইয়া রহিলাম। দেখিলাম, সে সিন্দুক খুলিয়া নোটগুলি বাহির করিল। তখন আমার রাগে সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল। বুঝিলাম, ফন্দী খাটাইয়া হুজুরীমল ললিতাপ্রসাদের সম্মুখে টাকা সিন্দুকে রাখিয়াছিল, তাহার পর এই কৌশলে টাকা বাহির করিয়া লইল; বুঝিলাম, লোকে আমাকেই চোর স্থির করুক।”
“হুজুরীমলের এত বুদ্ধি থাকিতে ফেল হইল কেন?”
“জুয়াখেলায়।”
“তাহার পর বল।“
“আমি মনে মনে বলিলাম, ‘বটে? তোমার এই চালাকী, আচ্ছা থাক, কে টাকা পায় দেখ।’ আমি জল লইয়া ফিরিয়া আসিয়া যমুনাকে দিলাম—কোন কথা বলিলাম না। যমুনাও কিছু না বলিয়া টাকাগুলি লইয়া চলিয়া গেল। আমি আগে যে একটু ইতস্ততঃ করিতেছিলাম, তাহা আর করিলাম না। তখনই আমি রঙ্গিয়াকে গিয়া সকল কথা বলিলাম। সে গঙ্গার কাপড় পরিয়া রাত্রে রাণীর গলিতে হুজুরীমলের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিল। সেখানে তাহার সঙ্গে হুজুরীমলের দেখা হইলে সে গঙ্গ। ভাবিয়া রঙ্গিয়ার হাতে নোটের তাড়া দিল।”
“খুনটা করিল কে?”
“তা—তা আমি জানি না।”
“রঙ্গিয়ার কথামত আমি গঙ্গার ধারে তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছিলাম। সে ছুটিতে ছুটিতে আমার কাছে আসিয়া আমার হাতে নোটের তাড়াটা দিল। সে ভয়ে এমনই হইয়াছিল যে, তখন আমাকে কি বলিল, আমি ভাল কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; তবে এইটুকু বুঝিলাম যে, হুজুরীমল খুন হইয়াছে।”
“কে খুন করিয়াছে, শুনিলে?”
“সে সেই কথা বলিতে যাইতেছিল, এমন সময়ে কোথা হইতে একটা লোক তাহার উপর আসিয়া পড়িল। তাহার হাতে ছোরা ঝক্ ঝক্ করিয়া উঠিল। রঙ্গিয়া ভয়ে পড়িয়া গেল। আমিও প্রাণভয়ে ছুটিলাম।”
“সে তোমার পিছনে এসেছিল?”
“বলিতে পারি না। আমি একবার ফিরিয়া দেখিয়াছিলাম। দেখিলাম, লোকটা রঙ্গিয়ার নিকট
বসিয়া তাহার কাপড় অনুসন্ধান করিতেছে—নিশ্চয়ই নোট খুঁজিতেছিল।”
“তাহার পর সে তোমার পিছনে আসিয়াছিল?”
“বলিতে পারি না, আমি ছুটিয়া একটা গলির ভিতরে যাই।”
“সে লোককে এখন দেখিলে চিনিতে পার?”
“তাহাকে ভাল করিয়া দেখি নাই; তবে তাহার লম্বা কাল দাড়ি ছিল, হয়ত ছদ্মবেশে ছিল, ঠিক বলিতে পারি না।”
“গাড়োয়ানও বলিয়াছিল, লোকটার লম্বা কাল দাড়ি ছিল। রঙ্গিয়া তাহাকে নিশ্চয় চিনিত, নতুবা সে তাহার সঙ্গে গাড়ীতে উঠিবে কেন?”
“সে আমাকে বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু বলিবার সময় পায় নাই।”
অক্ষয়কুমার এক দৃষ্টে উমিচাঁদের দিকে চাহিয়া রহিলেন। ক্ষণপরে বলিলেন, “বলি রঙ্গিয়ার আর কেহ ভালবাসার লোক ছিল কি?“
উমিচাঁদ ব্যগ্রভাবে বলিয়া উঠিল, “নানা—না—
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “না থাকিলেই ভাল। তার পরে কি হল বল।”
উমিচাঁদ বলিল, “আর কিছুই বলিবার নাই—তবে ইহাও আমি বলিতে চাই যে, গুরুগোবিন্দ সিংহকে আমি টাকা ফেরৎ দিয়াছি।”
উভয়েই বিস্মিতভাবে বলিয়া উঠিলেন, “তুমি?”
উমিচাঁদ ধীরে ধীরে বলিল, “হাঁ।”