দশম পরিচ্ছেদ
নগেন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমার বড়বাজারে আসিয়া জানিতে পারিলেন যে, ললিতাপ্রসাদের পিতা গদিতে আছেন। উভয়ে গদিতে প্রবেশ করিলেন।
অক্ষয়কুমার দেখিলেন, তিনি এক স্থবির মাড়োয়ারি—বুদ্ধিমান্ ব্যবসাদার, চতুর মাড়োয়ারীর যেরূপ হওয়া উচিত, তিনি ঠিক সেইরূপ মাড়োয়ারী। তাঁহাকে দেখিয়া অক্ষয়কুমার বুঝিলেন যে, তাঁহার নিকটে কোন কথা বাহির করা সহজ নহে।
অক্ষয়কুমারকে দেখিয়া তিনি জিজ্ঞাসিলেন, “আপনার কি দরকার?”
অক্ষয়কুমার নিজ পরিচয় বলিলেন। তখন তিনি উঠিয়া বলিলেন, “এইদিকে আসুন।”
উভয়কে এক নিৰ্জ্জন গৃহে লইয়া গিয়া বলিলেন, “আপনি এখনও খুনের কিছুই সন্ধান করিতে পারেন নাই?”
“খুনী ধরিতে পারি নাই—তবে কতক সন্ধান পাইয়াছি।”
“কি পাইয়াছেন?”
“আপনাকে বলিতে পারি না। আমাদের সেরূপ রীতিও নহে।”
“আমার কাছে কি প্রয়োজনে আসিয়াছেন?”
“দুই-একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে। আপনি হুজুরীমলবাবুকে কি খুব ভাল লোক বলিয়া জানিতেন?”
“নিশ্চয়—সকলেই তাহা জানিত।”
“তাঁহার কি কোন দোষ ছিল না?”
“সংসারে কাহার না দোষ আছে?”
“তাহা হইলে অনুগ্রহ করিয়া বলুন, তাঁহার কি দোষ ছিল।”
“আপনি কি তাঁহার দোষ অনুসন্ধানের জন্য আমার নিকটে আসিয়াছেন? কোন্ সাহসে আপনি
এ কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন?”
“কর্তব্যের অনুরোধে জিজ্ঞাসা করিতেছি। কিজন্য তিনি খুন হইয়াছেন, তাহা জানিতে না পারিলে খুনীকে কখনও ধরা যায় না। তিনি জুয়াড়ী ছিলেন।”
“মিথ্যাকথা।”
“জুয়া খেলিয়া তিনি সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়াছিলেন।”
“আপনি কোন্ সাহসে হুজুরীমলকে এ কথা বলেন?”
“সাহস—প্রমাণ। তিনি বাঁচিয়া থাকিলে দেউলিয়া হইতেন।”
“আপনি কি আমাদের গদির বদনাম রটাইতে এখানে আসিয়াছেন?”
“সত্যকথা অনেক জানিয়াছি; সেজন্য অনুরোধ করিতেছি যে, আপনি হুজুরীমল সম্বন্ধে যাহা জানেন, আমাকে খুলিয়া বলুন।”
রাগে বৃদ্ধের মুখ লাল হইয়া গেল। তিনি ক্রোধ-কম্পিতস্বরে বলিলেন, “মহাশয়, আপনি পুলিসের লোক—কি বলিব? যাহাই হউক আমি আপনাকে আর একটি কথাও বলিব না।”
অক্ষয়কুমার উঠিলেন। গম্ভীরভাবে বলিলেন, “তবে আমিই বলি, হুজুরীমল জুয়া খেলিয়া সর্ব্বস্বান্ত হইয়াছিলেন। তাহার উপরে আরও গুণ ছিল—তিনি গঙ্গাকে লইয়া এ-দেশ ছাড়িয়া পলাইবার বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন। গুরুগোবিন্দ সিংহ দশ হাজার টাকা তাঁহার নিকটে জমা রাখিয়াছিলেন; তিনি সেই টাকা লইয়া পলাইতেছিলেন। সেদিন খুন না হইলে পলাইতেনও।”
বৃদ্ধ মাড়োয়ারী আরও রুষ্ট হইয়া বলিলেন, “সব মিথ্যাকথা—”
অক্ষয়কুমার দেখিলেন, এই কঠিন মাড়োয়ারীর নিকট হইতে কোন কথাই জানিবার উপায় নাই; সুতরাং তিনি নিতান্ত বিরক্ত হইয়া তথা হইতে বিদায় লইলেন।
বাহিরে আসিয়া অক্ষয়কুমার নগেন্দ্রনাথকে বলিলেন, “এ বেটাও হুজুরীমলের মত বদমাইস। কে জানে, বেটারা হয়ত পাওনাদারকে ফাঁকী দেবার জন্য হুজুরীমলকে ইহজীবনের মত সরিয়েছে।”
নগেন্দ্রনাথের মনে এ কথা একবারও উদয় হয় নাই। তিনি নিতান্ত বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “বলেন কি—ইহাও সম্ভব?”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “সকলই সম্ভব। এখন ইহাদের বিস্তর দেনা হইয়াছে; হুজুরীমল বড় অংশীদার, তারই নামে সমস্ত লোকের পাওনা; তাহার বেঁচে থাকিলে রক্ষা নাই, আজ হউক কাল হউক, দুইদিন পরে সকল কথা প্রকাশ হইয়া পড়িত; তখন হুজুরীমলকে জেলে যাইতে হইত। এ অবস্থায় হাজার লোকে প্রত্যহ আত্মহত্যা করিতেছে, খুনও হইতেছে। এই বুড়ো মাড়োয়ারী যেরূপ বদমাইস, তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তবে কি এই বুড়োই লোক দিয়া নিজের অংশীদারকে খুন করিয়াছে। তাহা হইলে আমরা যাহা কিছু ভাবিতেছিলাম সকলই আমাদের ভুল?”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “তাহাই যে ঠিক, তাহা বলি না, তবে সম্ভব—খুব সম্ভব। বুড়ো মাড়োয়ারী যেরূপ চতুর, তাহাতে সে নিজেকে বাঁচাইবার জন্য এও পারে—তবে প্রমাণ নাই—ঐ হল মুস্কিল।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এটা খুব সম্ভব বটে, সন্ধান করা উচিত।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “তাহা না করিয়া সহজে ছাড়িব কি?”