সপ্তম পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমার সহজে রাগিতেন না। কিন্তু আজ এই বালিকার দৃঢ়তা দেখিয়া তিনি না রাগিয়া থাকিতে পারিলেন না। বলিলেন, “এখনও আপনাকে ভাবিবার সময় দিলাম। আমি আবার আপনার সঙ্গে দেখা করিব—এখনও বলিতেছি, বলুন।
যমুনা অতি দৃঢ়ভাবে বলিল, “প্রাণ থাকিতে বলিব না।”
“আচ্ছা আবার দেখা করিব,” বলিয়া অক্ষয়কুমার ক্ষুব্ধভাবে সে গৃহ পরিত্যাগ করিলেন। বাহিরে আসিয়া বলিলেন, “এরকম বদ্ মেয়ে আমি কখনও দেখি নাই। এ নিজে খুনের ভিতরে না থাকিলেও খুনের সব কথা জানে। দেখিতেছি, যত বদমাইসের গোড়া হইতেছে এই গঙ্গাটি। সংসারে মানুষ চেনা দায়। যাহা হউক, এখন অনেক বিষয় জানিতে পারা গিয়াছে, ক্রমে বাকীটুকুও জানা যাইবে।”
তিনি মনকে এইরূপ প্রবোধ দিলেন বটে; কিন্তু এতদিনে এই খুনের কিনারা করিতে পারিলেন না, বলিয়া মনে মনে বড়ই বিরক্ত হইলেন। মনটা বড় উষ্ণ হইয়া উঠিল। তিনি অতি বিরক্তভাবে গাড়ীতে আসিয়া উঠিলেন।
কলিকাতায় আসিয়া তিনি প্রথমে নগেন্দ্রনাথের সহিত দেখা করিতে চলিলেন। কয়েকদিন তিনি তাঁহার সহিত দেখা করিবার সময় পান নাই। নগেন্দ্রনাথও একটু উদ্বিগ্নভাবে তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। তিনি অক্ষয়কুমারকে দেখিয়া সত্বর অগ্রবর্ত্তী হইলেন। অক্ষয়কুমারের মেজাজটা তখনও অতিশয় বিগড়াইয়া ছিল; তিনি বিরক্তভাবে একখানি চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার ভাব দেখিয়া নগেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “ব্যাপার কি—নূতন কিছু জানিতে পারিলেন?”
অক্ষয়কুমার চক্ষু মুদিত করিয়া বসিয়াছিলেন। নিমীলিতনেত্রেই বলিলেন, “সব নূতন।” নগেন্দ্রনাথ আরও বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “আপনার কথা আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।”
অক্ষয়বাবু গম্ভীরভাবে বলিলেন, “না পারিবারই কথা।”
“খুলিয়া সব বলুন! “
“খুলিয়া বলিব আমার মাথা।”
“এত রাগিলেন—কাহার উপর?”
“নিজের উপর।”
“তা হইলে এ খুনের বিষয় কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না। দেখিতেছি, আপনিই হার মানিলেন।”
অক্ষয়কুমার উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন, “মশাই গো, এই এত ডিটেক্টিভ উপন্যাস লিখিতেছেন—এই খুনের যে পর্য্যন্ত হয়েছে, মনে করুন, ইহাই আপনার অর্দ্ধ লিখিত উপন্যাস—এই পৰ্য্যন্ত লেখা হইয়াছে, তাহার পর কি লিখিবেন—কিরূপে উপসংহারটা করিবেন, বলুন দেখি। দেখি বিধাতার উপন্যাসের সঙ্গে শেষে আপনার উপন্যাসের কতখানি মিল হয়।”
নগেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিলেন, “আপনার ন্যায় সুদক্ষ ডিটেটিভ যখন হার মানিলেন, তখন এ খুনের রহস্য কখনও প্রকাশ হইবে না।”
অক্ষয়বাবু বলিলেন, “তবে কি আপনার উপন্যাসেরও ঐ পর্য্যন্ত?”
নগেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিলেন, “আমি ত অনেকদিনই হার মানিয়াছি।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আপনার সখ—আমার দায়। আমি হার মানিলে আমাকে ছাড়ে কে?”
“আর কতদূর কি করিলেন?”
“ললিতাপ্রসাদ আর উমিচাঁদের সঙ্গে আবার দেখা করিয়াছি।”
“তাহাদের নিকটে নূতন কিছু জানিতে পারিয়াছেন?”
“ব্যস্ত হইবেন না—সব শুনিতে চান যদি, চুপ করিয়া শুনুন। গঙ্গা আর যমুনার সঙ্গে আমি দেখা করিয়াছি।” নগেন্দ্রনাথ নড়িয়া উঠিলেন—ব্যগ্রভাবে কি বলিতে যাইতেছিলেন; কিন্তু তাঁহার এই ভাব দেখিয়া অক্ষয়কুমার চেয়ারে ঠেস দিয়া বসিলেন, চক্ষু মুদিত করিলেন। কোন কথা কহিলেন না।
অক্ষয়কুমারের হঠাৎ এরূপ নিদ্রাকর্ষণ দেখিয়া নগেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “আমি ত কোন কথা কহি নাই।”
অক্ষয়কুমার চক্ষু খুলিলেন না—সেই অবস্থায় থাকিয়া বলিতে লাগিলেন, “গোড়ায় আমরা কিছুই জানিতাম না। কেবল জানিতাম, এই সহরে একরাত্রে প্রায় এক সময়ে একটি স্ত্রীলোক আর একটি পুরুষ খুন হইয়াছে। ক্রমে জানিলাম, তাহাদের একজন হুজুরীমল—অপরে তাহারই দাসী রঙ্গিয়া। আর কি দেখিলাম—”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সিঁদুরমাখা শিব।”
অক্ষয়কুমার বিরক্তভাবে বলিলেন, “চুপ করুন।”
নগেন্দ্রনাথ নীরব রহিলেন। তখন অক্ষয়কুমার সেইরূপভাবে বলিলেন, “তাহার পর দেখিলাম, হুজুরীমলের বাড়ীতে চারিটি স্ত্রীলোকের ব্যাপার; একটি হুজুরীমলের স্ত্রী, অপর একটি যমুনা, আর একটি গঙ্গা, আর একটি দাসী রঙ্গিয়া। শেষের তিনটি যুবতী। আরও দেখিলাম, হুজুরীমলের এই খুনের মামলায় আরও চারিটি লোককে আনা যায়, একটি ললিতাপ্রসাদ, একটি উমিচাঁদ, একটি গুরুগোবিন্দ সিং আর একটি যমুনাদাস।”
নগেন্দ্রনাথ কি বলিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু নিরস্ত হইলেন, অক্ষয়কুমার বলিলেন, “এই ব্যাপারের মধ্যে তাহা হইলে পাইলাম, চারিটি স্ত্রীলোক—চারিটি পুরুষ—আর পাইলাম, তিনটি জিনিষ।” নগেন্দ্রনাথ এবার আর নীরবে থাকিতে পারিলেন না—বলিয়া ফেলিলেন, “কি জিনিষ?” অক্ষয়কুমার ভ্রূকুটি করিলেন, তাঁহার কথায় কোন উত্তর না দিয়া বলিলেন, “আর পাইলাম, তিনটি জিনিষ; প্রথমতঃ সিঁদুরমাখা শিব—দুটো। দ্বিতীয়তঃ টাকা—দশ হাজার টাকার দশখানা নোট। তৃতীয়তঃ ভালবাসা, দ্বেষ, ঈর্ষা, প্রতিহিংসা—ব্যস্।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সিঁদুরমাখা শিবই এ খুনের কারণ স্পষ্ট দেখাইয়া দিতেছে। পঞ্জাবের সেই সম্প্রদায়ের লোক যে এ খুন করিয়াছে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।”
অক্ষয়কুমার এবার উঠিয়া ভাল হইয়া বসিলেন। পরে নগেন্দ্রনাথের দিকে ভ্রূকুটি করিয়া চাহিয়া বলিলেন, “কেন?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমরা জানিতে পারিয়াছি যে, পঞ্জাবে এইরকম একটা সম্প্রদায় আছে।”
“ভাল।”
“সেই সম্প্রদায়ের চিহ্ন এই সিঁদুরমাখা শিব।”
“খুব ভাল।”
“কেহ যদি এই সম্প্রদায়ের বিরাগভাজন হয়, তাহা হইলে তাহাকে এই সম্প্রদায়ের লোকে খুন করিয়া থাকে। এইরূপ খুন হইলে লাসের কাছে এইরকম সিঁদুরমাখা শিব তাহারা রাখিয়া যায়।”
“স্বীকার করিলাম।”
“দুই লাসেই সিঁদুরমাখা শিব পাওয়া গিয়াছে, সুতরাং বুঝিতে হইবে, এ খুন সেই সম্প্রদায়ের কাজ।”
“তা হলে আপনার মতে গুরুগোবিন্দ সিং দুই খুনই করিয়াছে।”
“হাঁ, হুজুরীমল সম্প্রদায়ের টাকা লইয়া পলাইতেছে, সংবাদ পাইয়া গুরুগোবিন্দ সিং তাহার পশ্চাতে যায়। সেই রাগে সম্প্রদায়ের হুকুমে হুজুরীমলকে খুন করে, কিন্তু তাহার নিকটে টাকা দেখিতে পায় নাই।”
অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “কেন?”
“হুজুরীমল গঙ্গাকে লইয়া পলাইবার বন্দোবস্ত করিয়াছিল, সে তাহার নিকট টাকা দিয়াছিল, কাজেই গুরুগোবিন্দ সিং টাকা না পাইয়া গঙ্গার কাপড় পরা রঙ্গিয়া দাসীর পশ্চাতে যায়। তাহার পর হুজুরীমলকেও খুন করিয়া টাকা লইয়া চলিয়া যায়।”
অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “তাহার পর রঙ্গিয়া খুন হইল কেন?”
“সে টাকা লইয়াছিল বলিয়া।”
“বটে? তবে গুরুগোবিন্দ সিং টাকা হারাইয়াছে বলিয়া এমন তম্বি করিবে কেন?”
লোকের চোখে ধূলি দিবার জন্য।”
“আর যদি আমি বলি, গুরুগোবিন্দ সিং আবার টাকা ফেরৎ পাইয়াছে?”
নগেন্দ্ৰনাথ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া অক্ষয়কুমারের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। অক্ষয়কুমার হাসিতে লাগিলেন।