ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমার নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “তবে সে স্ত্রীলোক তুমি!”
যমুনা কোন উত্তর দিতে পারিল না—তাহার আপাদমস্তক কাঁপিতে লাগিল! সে পড়িয়া যাইবার মত হইল। গঙ্গা তাড়াতাড়ি তাহাকে ধরিয়া ফেলিল; এবং অন্য গৃহে লইয়া যাইবার উপক্রম করিল। যেমন তাহারা দ্বারের নিকটে গিয়াছে, অক্ষয়কুমার কঠোরভাবে বলিলেন, “দাঁড়াও।”
উভয়ে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দাঁড়াইল। এবং ফিরিয়া আসিয়া কৌচের উপর বসিল। গঙ্গা বলিল, ‘দেখিতেছেন, আপনার কি বিষম ভুল, আমার হাতে এ আংটী ছিল না, আমি কলিকাতায় গিয়া হুজুরীমলবাবুর সঙ্গে দেখা করি নাই।”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “আপনি ললিতাপ্রসাদের নিকট হইতে এইমাত্র যে পত্ৰ পাইয়াছেন, তাহা আমি দেখিতে চাই।”
গঙ্গা বিস্মিতভাবে তাঁহার দিকে চাহিল। ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া বিরক্তভাবে বলিল, “আপনি কেমন করিয়া জানিলেন যে, তিনি আমাকে পত্র লিখিয়াছেন?”
অক্ষয়কুমার মৃদুহাস্য করিয়া বলিলেন, “পুলিসে কাজ করিতে হইলে আমাদিগকে অনেক সংবাদ রাখিতে হয়। যে লোককে চিঠী দিয়া ললিতাপ্রসাদবাবু পাঠাইয়াছিলেন, সে আমার সঙ্গে এক গাড়ীতেই চন্দননগরে আসিয়াছে।”
গঙ্গার মুখ লাল হইয়া গেল—সে ভ্রূকুটিকুটিল মুখে গ্রীবা বাঁকাইয়া তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিল, “হাঁ, আমি পত্র পাইয়াছি।”
“আমি সে পত্র দেখিতে চাই।”
“সে পত্র আমি তখনই ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছি।”
“কোথায় ফেলিয়াছেন—চলুন দেখি।”
“সে পত্র আমি পুড়াইয়া ফেলিয়াছি।”
“দেখুন—গোল করিবেন না। সে পত্র আমি দেখিতে চাই—দেখিবই।”
“সে পত্র আমি কিছুতেই দেখাইব না।”
“বুঝিলাম, খুনের ব্যাপার কিছু তাহাতে আছে।”
“আপনি কি মনে করেন, আমি খুন করিয়াছি?”
“অতদূর এখনও মনে করি নাই—তবে আপনি জানেন, কে খুন করিয়াছে।”
“মিথ্যাকথা।”
এতক্ষণ যমুনা নতনেত্রে নীরবে বসিয়াছিল—সহসা কোথা হইতে তাহার দেহে কি অমানুষিকী শক্তির সঞ্চার হইল; সে সগৰ্ব্বে মস্তক তুলিল। অতি দৃঢ়ভাবে বলিল, “না—মিথ্যাকথা নয়।”
অক্ষয়কুমার বিস্মিত হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিলেন। চাহিয়া গঙ্গার মুখের দিকে চাহিলেন। মুখ দেখিয়া বুঝিলেন, যমুনার কথায় গঙ্গা প্রথমে আশ্চর্যান্বিত হইল; পরক্ষণে তাহার বিশালায়ত নেত্রদ্বয় একবার দীপ্তিশীল উল্কাপিণ্ডের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল; এবং ক্রোধে মুখখানা আরক্ত হইয়া উঠিল—সর্ব্বশরীর কাঁপিতে লাগিল। গঙ্গা ওষ্ঠে ওষ্ঠ পেষিত করিয়া ক্রোধ দমন করিবার চেষ্টা করিল। এবং যমুনার মাথাটা একদিকে ঠেলিয়া দিয়া কহিল, “যমুনা, তোর মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে।”
যমুনা মুখ না তুলিয়া নিজের পায়ের দিকে চাহিয়া কহিল, “তোমার জন্য লোকে ভবিতেছে যে, আমিই খুন করিয়াছি। তোমাকে আমি বড় ভালবাসিতাম, তাহাই কোন কথা বলি নাই। এখন দেখিতেছি, আমার মাসী তোমার বিষয় যাহা বলিয়াছেন, তাহাই ঠিক।”
গঙ্গা ক্রোধে গৰ্জ্জিয়া কহিল, “কি ঠিক?”
এই দৃশ্যে অক্ষয়কুমার মনে মনে ভারী সন্তুষ্ট হইলেন। মনে মনে হাসিয়া বলিলেন, এইবার কিছু আসল কথা জানিতে পারা যাইবে।
যমুনা এবারও মুখ তুলিয়া চাহিল না—চাহিলে সে নিশ্চয়ই ভয় পাইত। যমুনা সেইরূপভাবে মৃদুকণ্ঠে বলিল, “মাসী-মা তোমাকে অনেকদিন জেনেছিলেন। মেসো মহাশয় তোমার বাপের বয়সী, তুমি তাঁহার সঙ্গে—“
গঙ্গা আর ক্রোধ সম্বরণ করিতে পারিল না। বলিল, “যমুনা মুখ সাম্লাইয়া কথা কহিয়ো।” এবার যমুনা সবেগে উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, “গঙ্গা, তোমাকে আমি বড় ভালবাসিতাম বলিয়া এত সহ্য করিয়াছি; আর নয়, আমি আগে জানিতাম না যে, তুমি এমন–“
গঙ্গা চোখ রাঙাইয়া তীব্রকন্ঠে বলিয়া উঠিল, “আমি কলিকাতায় রাত্রে হুজুরীমলের সঙ্গে দেখা করিতে যাই নাই।”
যমুনা অতি সংযতভাবে বলিল, “হাঁ, যাও নাই—সেদিন যাও নাই—মধ্যে মধ্যে বরাবর যাইতে। পাছে কেহ আংটী দেখিয়া তোমায় চিনিতে পারে বলিয়া ছল করিয়া আংটী হারাইয়াছিলে, আমি বুঝিতে পারি নাই, তুমি ইচ্ছা করিয়া আংটী আমার হাতে রাখিয়াছিলে।”
গঙ্গা বলিল, “তোমার মাথা খারাপ হইয়া-“
“না মাথা বড় খারাপ হয় নাই। তুমি সেদিন মেসো মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করিতে যাও নাই—কিন্তু তুমিই দাসী রঙ্গিয়াকে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিবার জন্য রাত্রে পাঠাইয়াছিলে।”
“মিথ্যাকথা।”
এই বলিয়া গঙ্গা, অক্ষয়কুমার তাহাকে বাধা দিবার পূর্ব্বেই গৃহ পরিত্যাগ করিয়া গেল। অক্ষয়কুমার তাহার অনুসরণ করিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু দাঁড়াইলেন।
কিয়ৎক্ষণ যমুনার দিকে চাহিয়া থাকিয়া তিনি বলিলেন, “রঙ্গিয়াকে যে, গঙ্গা হুজুরীমলের সহিত দেখা করিতে পাঠাইয়াছিলেন, তাহা আপনি কিরূপে জানিলেন?”
যমুনা ধীরে ধীরে বলিল, “যে কাপড়খানা তাহার পরা ছিল; সেখানা গঙ্গার। সেদিনও তাহার সে কাপড় পরা ছিল, নিশ্চয়ই সে তাহার নিজের কাপড় পরাইয়া তাহাকে মেসো মহাশয়ের সহিত দেখা করিতে পাঠাইয়াছিল।”
অক্ষয়কুমার বলিয়া উঠিলেন, “ঠিক কথা—তাই ত–বুঝিয়াছি।”
যমুনা তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “এখন বুঝিয়াছি, হুজুরীমলের সঙ্গে রাত্রে রাণীর গলিতে গঙ্গারই দেখা করিবার কথা ছিল। হুজুরীমল তাহাকে লইয়া বোম্বে যাইবার জন্য দু-খানা টিকিট কিনিয়াছিল; কিন্তু কোন কারণে গঙ্গা তাহার সঙ্গে দেখা করিতে যায় নাই, দাসী রঙ্গিয়াকে নিজের কাপড় পরাইয়া পাঠাইয়া দিয়াছিল। নিশ্চয়ই ইহাতে বুঝিতে পারা যাইতেছে যে, তাহার মতলব ছিল, হুজুরীমল রঙ্গি য়াকে তাহার কাপড় পরা দেখিয়া ভাবিবে, সেই আসিয়াছে—”
অক্ষয়কুমার নিজ মনেই এই সকল বলিয়া যাইতেছিলেন, যমুনা নীরবে দাঁড়াইয়াছিল। সহসা অক্ষয়কুমার থামিলেন, ভাবিলেন, এরূপ উচ্চৈঃস্বরে চিন্তা করা উচিত নহে।
তিনি যমুনাকে বলিলেন, “আমি আপনাকে আরও দুই-একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই।” যমুনা মৃদুস্বরে বলিল, “বলুন।”
অক্ষয়কুমার তাহার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া অতি গম্ভীরভাবে বলিলেন, “আপনি স্বীকার করিয়াছেন, আপনি সে রাত্রে হুজুরীমলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন?”
যমুনা স্পষ্টভাবে বলিল, “হ্যাঁ।”
“কেন গিয়াছিলেন, আমায় বলুন।”
যমুনা উত্তর দিল না।
অক্ষয়কুমার আবার বলিলেন, “না বলিলে আপনি বিপদে পড়িবেন।“
এবারও যমুনা উত্তর দিল না।
অক্ষয়বাবু কঠোরভাবে বলিলেন, “সব কথা খুলিয়া না বলিলে আমি এই খুনের জন্য আপনাকে গ্রেপ্তার করিব।”
যমুনা অতি মৃদুস্বরে বলিল, “আমি খুনের কিছুই জানি না।”
“আপনি কি জন্য সে রাত্রে হুজুরীমলের সহিত দেখা করিয়াছিলেন, তাহাই বলুন।”
“কিছুতেই বলিব না।”
“আমি এখনও আপনাকে বলিতেছি, না বলিলে আপনি ভয়ানক বিপদে পড়িবেন।”
“বিপদ্ যেমনই ভয়ানক হউক, কিছুতেই আমি বলিব না—প্রাণ থাকিতে বলিব না।”