চতুর্থ পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমার সব কাজ ফেলিয়া তাড়াতাড়ি ললিতাপ্রসাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চলিলেন। প্রথমে অক্ষয়কুমারকে দেখিয়া ললিতাপ্রসাদ যেন চমকিত হইয়া উঠিলেন; তাঁহার মুখ যেন শুকাইয়া গেল; কিন্তু তিনি মুহূৰ্ত্ত মধ্যে নিজ হৃদয়ভাব গোপন করিয়া বলিলেন, “আসুন, আজ কি জন্য আসিয়াছেন?” অক্ষয়কুমার বসিলেন। ধীরে ধীরে বলিলেন, “হুজুরীমলবাবুর স্ত্রীর সহিত আমার দেখা হইয়াছে।” এই কথা শুনিয়া ললিতাপ্রসাদ স্পষ্টতঃ বিচলিত হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, “এই ঘরে আসুন।” উভয়ে পার্শ্ববর্ত্তী গৃহে যাইয়া বসিলেন। ললিতাপ্রসাদ জিজ্ঞাসমান নেত্রে তাঁহার মুখের দিকে চাহিলেন। তখন অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “হুজুরীমলবাবুর স্ত্রীর সহিত আমার দেখা হইয়াছে।” ললিতাপ্রসাদ কথা কহিলেন না। অক্ষয়কুমার বলিলেন, “তাঁহার কাছে জানিলাম, হুজুরীমল সাহেব বৃদ্ধ হইলেও তাঁহার অনেক গুণ ছিল।”
“কি জানিলেন?”
“জানিলাম, তিনি গঙ্গার জন্য পাগল হইয়াছিলেন।”
“মিথ্যাকথা!” বলিয়া তিনি লাফাইয়া উঠিলেন। তৎপরে আত্মসংযম করিয়া বসিয়া বলিলেন, “হুজুরীমলের স্ত্রী ঈর্যাবশে এইরূপ বলিয়াছেন—তাঁহার একটা কথাও সত্য নয়।”
“আরও জানিলাম, সেই গঙ্গা আবার আপনার জন্য পাগল।”
ললিতাপ্রসাদের মুখ রাগে লাল হইয়া গেল—তিনি ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন, “মহাশয় কি আজ আমাকে অপমান করিতে এখানে আসিয়াছেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “ইহাতে আমার লাভ কি? আমি ইহাও জানিয়াছি যে, যমুনাদাসবাবুর সঙ্গে তাহার বিবাহ হইবার কথা হইয়াছে?”
ললিতাপ্রসাদ এবার অব্যক্ত শব্দ করিলেন। তিনি কি বলিতে যাইতেছিলেন—কিন্তু বলিলেন না। অক্ষয়কুমার তাঁহার মুখের দিকে কিয়ৎক্ষণ এক দৃষ্টে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, “আপনি কি গঙ্গাকে ভালবাসেন?”
এবার ললিতাপ্রসাদ আর ক্রোধ সম্বরণ করিতে পারিলেন না। বলিলেন, “আপনি এখনই এখান হইতে উঠুন। আমার সহিত আপনার কোন কথা নাই।”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “না থাকিলে উঠিতাম, সময় নষ্ট করিতাম না। আমার বিশ্বাস যে গঙ্গা এই খুনে জড়িত।”
“মিথ্যাকথা!”
“বটে? সেইজন্য সে লুকাইয়া লুকাইয়া রাত্রে হুজুরীমলের সহিত দেখা করিত।”
ললিতাপ্রসাদ কি করিবে না জানিবার পূর্ব্বেই সহসা অক্ষয়কুমারকে ক্ষিপ্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় আক্রমণ করিলেন। সবলে তাঁহার কন্ঠদেশ টানিয়া ধরিলেন।
অক্ষয়কুমার দুর্বল ছিলেন না—তাঁহার শরীরেও অসীম বল ছিল; তিনি নিমেষ মধ্যে নিজেকে মুক্ত করিলেন। তৎপরে সবলে ললিতাপ্রসাদকে ধরিয়া বসাইয়া দিলেন। ললিতাপ্রসাদ সশব্দে হাঁপাইতে লাগিলেন।
অক্ষয়কুমার মৃদুহাস্য করিয়া শ্লেষপূর্ণ স্বরে বলিলেন, “ললিতাপ্রসাদ বাবু, শরীরের বল স্থান বুঝিয়া ব্যবহার করিবেন। যাহা হউক, আপনি কিছু না বলা সত্ত্বেও আমার যাহা জানিবার, তাহা জানিয়াছি। আপনি গঙ্গাকে বড় ভালবাসেন।”
ললিতাপ্রসাদ বলিলেন, “হাঁ, আমি তাহাকে ভালবাসি। সে হুজুরীমলকে প্রাণের সঙ্গে ঘৃণা করিত, সেখ্যমুনাদাসকেও ভালবাসে না।”
“সেই কথাই আমি বলিতেছিলাম। তবে সে আপনাকেও ভালবাসে না—”
“মিথ্যাকথা।”
“মিথ্যা হউক, সত্য হউক আপনিই জানেন। উপস্থিত এই খুন সম্বন্ধে তাহার কি হাত আছে, তাহাই জানা আমার কর্তব্য ও প্রয়োজন।
“আপনি তাহার সঙ্গে দেখা করিবেন?”
“নিশ্চয়ই।”
এই বলিয়া অক্ষয়কুমার সে স্থান পরিত্যাগ করিলেন।
ললিতাপ্রসাদও তাঁহার পশ্চাতে যাইতে উদ্যত হইলেন; কিন্তু আত্মসংযম করিলেন। তৎপরে সত্বর একখানি পত্র লিখিয়া এক ব্যক্তিকে ডাকিলেন। তাহাকে কানে কানে কি বলিয়া পত্রখানি দিয়া বিদায় করিলেন।
অক্ষয়কুমার রাস্তায় আসিয়া বলিলেন, “একে সময় দেওয়া উচিত নহে। আমাকে এখনই একবার চন্দননগর যাইতে হইবে।”
তিনি তৎক্ষণাৎ একখানা গাড়ী ভাড়া করিয়া হাওড়া ষ্টেশনের দিকে চলিলেন। আধ ঘন্টার মধ্যেই একখানি ট্রেন ছাড়িবে।