দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
ক্ষণপরে নগেন্দ্রনাথ নিজ মনোভাব গোপন করিয়া বলিলেন, “এ সম্প্রদায়ের কাজ কি?”
“যা জানি বলিতেছি, এটা একটা ধৰ্ম্মসম্প্রদায়—অন্ততঃ ইহাই লোকে জানে।”
“এ সম্প্রদায়ে কাহারা আছে?”
“ইহাদের সব কাজ গোপনে হয়; এরা কি করে তাহা এরাই জানে। সম্প্রদায়ভুক্ত না হইলে কিছুই জানিবার উপায় নাই।”
“ইহাদের উদ্দেশ্য কি?”
“আমার সব শোনা কথা। ইহারা নাকি কি কার্য্যকলাপ করে, তাহাতে নানা আশ্চর্য্য আশ্চৰ্য্য ক্ষমতা জন্মে।”
“তুমি এদের বিষয় কিরূপে জানিলে?”
“তাহাই বলিতেছি। আমি তখন অমৃতসহরে। একদিন অনেক রাত্রে এক বন্ধুর বাড়ী থেকে বাইনাচ দেখে আমি বাড়ী ফিরিতেছি। পথে তখন জনমানব নাই—চারিদিকে খুব অন্ধকার। এই সময়ে সম্মুখে কাহার আর্তনাদ শুনিলাম; কে কাহাকে যেন মারিতেছে। আমি ছুটিয়া সেইদিকে অগ্রসর হইলাম। আমি দূর হইতে বুঝিলাম, আমার পায়ের শব্দ শুনিয়া দুইজন লোক যেন ছুটিয়া পলাইল।”
“তারপর?”
“তারপর আমি দেখি, একজন লোক রাস্তায় পড়িয়া আছে। লোকটার বুকে কে ছোরা মারিয়াছে—রক্তে তাহার কাপড় ভিজিয়া গিয়াছে। তাহার পাশে দেখি, এইরকম একটা সিঁদুরমাখা শিব।”
“ঠিক এইরকম?”
“ঠিক এইরকম।”
“তারপর আমি সেই শিব কুড়াইয়া লইয়া দেখি, লোকটা ভয়ে অজ্ঞান হইয়াছে। এরূপ অবস্থায় একে পথে ফেলিয়া যাওয়া উচিত নয় ভাবিয়া আমি তাহাকে বাসায় আনিলাম। আমার বাসা সেখান হইতে নিকটেই ছিল।”
“তুমি তখনই পুলিসে খবর দিলে না কেন?”
“সেই লোকটির কাকুতি-মিনতিতে। সে কিছুতেই আমাকে পুলিসে খবর দিতে দিল না। তাহার পরম সৌভাগ্য যে, গায়ে একটা তুলাপোরা জামা ছিল, সেজন্য ছুরি বুকে বসে নাই—কেবল মাংস একটু কাটিয়া গিয়াছিল।”
“তাহার পর সে লোক এ সম্বন্ধে তোমায় কিছু বলিয়াছিল?”
“কিছু কেন? সব। সে এই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল, কোন কারণে দল ছাড়িয়া চলিয়া আসে। তাহাতে সেই দলের লোক ইহার উপর ক্রুদ্ধ হয়। দলের নিকট কোন অপরাধ করিলে তাহার একমাত্র দণ্ড হইতেছে—প্রাণদণ্ড।”
“কে খুন করে?”
“তাহা কেহ জানে না—যাহার উপর ভার পড়ে, তাহাকেই খুন করিতে হয়; না বলিবার যো নাই, তাহা হইলে তাহারও প্রাণদণ্ড।”
“কি ভয়ানক! তারপর?”
“এ লোকটা জানিত যে, তাহার উপর প্রাণদণ্ডের আজ্ঞা হইয়াছে।”
“কেমন করিয়া জানিল?”
“এরূপ প্রাণদণ্ডের হুকুম হইলে সেই লোকের কাছে যেমন করিয়া হউক, এইরূপ একটা শিব আসে। এই শিব আসিলেই সে লোক নিশ্চয়ই বুঝিতে পারে যে, তাহার দিন শেষ হইয়াছে—সমিতির লোক নিশ্চয়ই তাহাকে হত্যা করিবে।”
“কি ভয়ানক!”
“খুন হইলে মৃত ব্যক্তির কাছেও এইরূপ একটা শিব তাহারা রাখিয়া যায়; তাহাতেই সকলে বুঝিতে পারে যে, লোকটা সেই গুপ্ত সমিতির কোন লোকের দ্বারা খুন হইয়াছে।”
“পুলিস ইহাদিগে ধরে না কেন?”
“পুলিস কি করিবে? এ সম্প্রদায়ে কে আছে, এ সম্প্রদায় কোথায়, তাহার কিছুই কেহ জানে না। যাহারা দলে আছে, তাহারা প্রাণ থাকিতে কোন কথা বলে না। পুলিস কিছুই করিতে পারে না।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তারপর কি হইল? সে লোক কোথায় গেল?”
যমুনাদাস বলিলেন, “সে আমার বাড়ীতে কয়েকদিন লুকাইয়া ছিল; কিছুতেই আমাকে তাহার পরিচয় দিল না। শেষে একদিন আমাকে না বলিয়া কোথায় চলিয়া গেল, আর তাহাকে খুঁজিয়া পাইলাম না।”
“এ সম্প্রদায় সম্বন্ধে আর কিছু সন্ধান লইলে না কেন?”
“সন্ধান লওয়া। আমি অমৃতসহর ছাড়িয়া পলাইতে পথ পাই না।”
“কেন হে?”
“সেই শিবটা আমার কাছে ছিল। পরে জানিলাম, যে ইহাদের সম্প্রদায়ের লোক নয়, এমন কোন লোকের কাছে ইহারা এ শিবলিঙ্গ থাকিতে দেয় না। অথচ তাহার সম্মুখে আসিয়া চাহিয়া ও লইতে পারে না——তাহা হইলে সম্প্রদায়ভুক্ত বলিয়া ধরা পড়িবে।”
“তোমার কাছে ছিল বলিয়া তাহারা কি করিল?”
“চার-পাঁচদিন রাত্রে আমাকে খুন করিবার চেষ্টা পাইয়াছিল, তাহার পর বাড়ীতে থাকা অসম্ভব হইয়া উঠিল।”
“কেন?”
“অনেক রাত্রে ক্রমাগত ঢিল পড়ে—হঠাৎ দরজা খুলে যায়—রাত্রে ঘুমাইয়া আছি, কে খাট ধরিয়া নাড়া দেয়—নানারকম উপদ্রব।”
“তাহার পর তুমি কি করিলে?”
“একটি পঞ্জাবের ভদ্রলোক এই ব্যাপার আমার কাছে শুনিয়া আমাকে বলিলেন, “মহাশয়, যদি প্রাণে বাঁচিতে চান, তবে শীঘ্র এটাকে বিদায় করুন। জানেন নাকি, তাহারা সহজে এটা না পাইলে এই সম্প্রদায়ের লোক তাহাকে খুন করিয়া এটা লইয়া যায়।”
এ কথা শুনিয়া নগেন্দ্রনাথের হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল, যথার্থই তাঁহার ভয় হইল—নিজ দুর্ব্বলতার জন্য তিনি লজ্জিত হইলেন। বলিলেন, “তুমি সেটা কি করিলে?”
“এ কথা শুনিয়া আমি রাত্রে সেটাকে আমার দরজার পার্শ্বে রাখিয়া দিলাম। সকালে দেখি কে লইয়া গিয়াছে।”
“তাহার পর আর কোন সন্ধান পাইলে?”
“এইসকল ব্যাপারে—সত্য কথা বলিতে কি, আমার মেজাজটা বড় খারাপ হইয়া গিয়াছিল। আমি একেবারে পঞ্জাব থেকে পলাইলাম। প্রাণের মায়া বড় মায়া!”
“এই সম্প্রদায়ের কি অনেক টাকা আছে?”
“শুনেছি, অনেক টাকা আছে। এই টাকা আর কোনখানে জমা রাখে না, একজনের কাছেও রাখে না। সম্প্রদায়ভুক্ত ভিন্ন ভিন্ন লোকের কাছে রাখে।”
“গুরুগোবিন্দ সিং কি এই সম্প্রদায়ভুক্ত একজন??”
কেমন করিয়া জানিব? খুব সম্ভব।”
“এই সম্প্রদায়ের কোন টাকা কি তাহার কাছে আছে?”
“তাহাই বা আমি কিরূপে জানিব? তাহার সঙ্গে আমার আলাপ হুজুরীমলের বাড়ীতে। তবে ভাগবতিকে বোধ হয়, তাহার কাছে সম্প্রদায়ের কিছু টাকা থাকিলেও থাকিতে পারে।”
নগেন্দ্রনাথ, এইবার অক্ষয়কুমারের গাম্ভীর্য্য অনুকরণ করিয়া বলিলেন, “সম্প্রদায়ের দশ হাজার টাকা তাঁহার কাছে ছিল।”
যমুনাদাস নিতান্ত বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “তুমি কেমন করিয়া জানিলে?”
নগেন্দ্রনাথ সেইরূপ গম্ভীরভাবেই বলিলেন, “এই দশ হাজার টাকা গুরুগোবিন্দ সিং হুজুরীমলের নিকটে রাখিতে দিয়াছিল। তিনি এই টাকা তাঁহার সিন্দুকে রাখিয়াছিলেন—সে টাকা চুরি গিয়াছে?”
“কি ভয়ানক! কে চুরি করিল?”
“কেমন করিয়া বলিব? তাহারই সন্ধান হইতেছে, খুনের সঙ্গে চুরির নিশ্চয়ই সম্বন্ধ আছে। তাহাই অক্ষয়বাবু তদন্ত করিতেছেন, তিনি অনুগ্রহ করিয়া আমাকে সঙ্গে লইয়াছেন। তোমার কথা তাঁহাকে বলিয়াছিলাম।”
যমুনাদাস অতিশয় ব্যগ্র হইয়া বলিলেন, “তিনি—তিনি—কি বলিলেন?”
“তিনি তোমাকে দলে লইতে সম্মত হইয়াছেন।”
“দেখিতেছি, তিনি অতি ভদ্রলোক।”
“আমরা যতদূর যাহা জানিয়াছি, তাহা তোমার শোনা উচিত; নতুবা আমাদের কাজে যোগ দিতে পারিবে না।”
“বল—সব আমার শোনা চাই।”
নগেন্দ্রনাথ খুন সম্বন্ধে অক্ষয়কুমার ও তিনি যাহা কিছু সন্ধান করিয়া জানিতে পারিয়াছিলেন, সমস্তই একে একে যমুনাদাসকে বলিলেন। কেবল গঙ্গার হাতে যে অঙ্গুরীয় ছিল এবং গঙ্গা যে গোপনে রাত্রে হুজুরীমলের সহিত দেখা করিত, খুনের দিনও দেখা করিয়াছিল, তাহা বলিলেন না। তিনি জানিতেন, এ কথা তাঁহাকে বলিলে তিনি বিশ্বাস করিবেন না—হাসিয়া উড়াইয়া দিবেন। তিনি গঙ্গার প্রেমাকাঙক্ষী।
সকল কথা যমুনাদাস নীরবে শুনিলেন। নগেন্দ্রনাথের কথা শেষ হইলে তিনি বলিলেন, “এখন এ খুন কে করিয়াছে, তাহা বলা বড় কঠিন নহে।”
তাঁহার কথায় নগেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “কে খুন করিয়াছে—তুমি মনে কর?” যমুনাদাস বলিলেন, “দুই খুনের লাসের কাছেই শিবলিঙ্গ পাওয়া গিয়াছে—সুতরাং পঞ্জাবের সম্প্রদায় কর্তৃক দুই খুন হইয়াছে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। গুরুগোবিন্দ সিং এই সম্প্রদায়ের লোক। তিনি সম্প্রদায়ের টাকা হুজুরীমলের নিকটে রাখিয়াছিলেন; সেই টাকা চুরি গিয়াছে—এ খুন কে করিয়াছে, তাহা কি আর স্পষ্ট করিয়া বলিতে হইবে?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তুমি কাহাকে সন্দেহ কর?”
যমুনাদাস উত্তর করিলেন, “সন্দেহ নয়—নিশ্চিত। খুন করিয়াছে—গুরুগোবিন্দ সিং।”