দ্বিতীয় খণ্ড : রহস্য গভীর হইল – প্রথম পরিচ্ছেদ
যমুনাকে দেখা পর্যন্ত নগেন্দ্রনাথের হৃদয় বড়ই চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার সুন্দর মুখ তাঁহার হৃদয়ে সুস্পষ্ট অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল। তিনি তাহার কথা ভাবিবেন না মনে করা স্বত্ত্বেও সর্ব্বদাই তাহার মুখ তাঁহার হৃদয়ে উদিত হইতে লাগিল। তিনি গৃহমধ্যে বসিয়া নিজ মনে সুন্দরী যমুনার কথাই ভাবিতেছিলেন। এই সময়ে কাহার পদশব্দে তিনি চমকিত হইয়া ফিরিলেন। দেখিলেন, যমুনাদাস।
তিনি তাঁহাকে বাড়ীর ঠিকানা দিয়া আসিয়াছিলেন। যমুনাদাস তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে কালবিলম্ব করেন নাই। তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “দেখ্ছ, আমি তোমার সঙ্গে দেখা করিতে একদিনও দেরী করি নাই—এস; সেই ছেলেবেলার কথা কহা যাক্।”
নগেন্দ্রনাথের মন ভাল ছিল না—নানা চিন্তায় তাঁহার হৃদয় পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। কেন এরূপ হইয়াছে, তিনি তাহা বুঝিতে পারিতেছিলেন না। তিনি প্রথমে যমুনাদাসের বাচালতা ও উচ্চ হাস্যে কিছু বিরক্তি বোধ করিলেন; কিন্তু ক্রমে দেখিলেন, তাঁহার সহিত কথোপকথনে নিজের হৃদয় অনেকখানি আনন্দানুভব করিতে লাগিল। ক্রমে দুই বন্ধুতে অনেক হাস্য-পরিহাস চলিল। কৌতুকামোদে অৰ্দ্ধ ঘন্টা অতিবাহিত হইলে নগেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন কি করিতেছ?”
যমুনাদাস হাসিয়া বলিলেন, “এখন ভবঘুরে হয়েছি। বাবার যাহা ছিল, তাহা ফুঁকে দিতে অধিকদিন লাগে নাই। তারপর মা মরে গেলেন, আমিও ভেসে পড়লাম– “
“কাজ-কর্ম্ম কিছুই করিতেছ না?”
“ভগবান্ আমাকে কাজের জন্য বানান নাই। পরিশ্রম? বাপ্–সে আমার যম।”
“তবে চলবে কেমন করে?”
“চলে যায়—ভালই যায়। আবার দেখিতেছ না, শীঘ্রই বিবাহ করিয়া সংসারী হইয়া পড়িতেছি। এইবার ভ্রমণ বন্ধ হইল আর কি—”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তুমি তাহা হইলে অনেক দেশ বেড়াইয়াছ?”
“অনেক দেশ! জগৎ-জুড়ে বলিলে হয়।”
“পঞ্জাবে গিয়াছ?”
“পঞ্জাবে? গ্রামে গ্রামে—পঞ্জাবের কোথায় না গিয়াছি!”
“অমৃতসহরে?”
‘সেখানে একাধিক্রমে ছয়মাস ছিলাম।”
“তাহা হইলে পঞ্জাবের তুমি সব দেখেছ?”
“যাহা দেখা উচিত তাহাও দেখিয়াছি যাহা দেখা অনুচিত তাহাও দেখিয়াছি।”
নগেন্দ্রনাথ শিবলিঙ্গটি টেবিল হইতে বাহির করিয়া যমুনাদাসের সম্মুখে ধরিয়া বলিলেন, “এটা কি বলিতে পার?”
“বাপ্!” বলিয়া যমুনাদাস লাফাইয়া উঠিলেন—চারি পদ সরিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার মুখ মলিন হইয়া গেল; তিনি বিস্ফারিতনয়নে নগেন্দ্রনাথের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
নগেন্দ্রনাথ তাঁহার ভাব দেখিয়া অত্যন্ত বিস্মিত হইয়াছিলেন। তিনি ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “ব্যাপার কি?”
যমুনাদাস প্রায় রুদ্ধকণ্ঠে বলিলেন, “কি সৰ্ব্বনাশ! তুমি এটা কোথায় পাইলে?”
উমিচাঁদ এই শিবলিঙ্গ দেখিয়া মূৰ্চ্ছা গিয়াছিল। যমুনাও মূৰ্চ্ছা গিয়াছিল। যমুনাদাস মূৰ্চ্ছা না গেলেও অনেকটা সেই রকমই হইলেন। তাঁহার কপালে ঘাম ছুটিল। তিনি কম্পিতকণ্ঠে বলিলেন, “তুমি—তুমি—তুমি কি সেই সম্প্রদায়ের লোক?”
যমুনাদাসের নিকটে এই সম্প্রদায়ের বিষয়ে আরও কিছু জানিবার জন্য নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “কোন্ সম্প্রদায়?”
যমুনাদাস কম্পিতহস্তে সিন্দূররঞ্জিত শিবলিঙ্গটি দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, “এই এটা যাহাদের চিহ্ন?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি তোমায় সত্যই বলিতেছি, আমি এই সম্প্রদায়ের কিছুই জানি না।” এই কথায় যমুনাদাস কতকটা প্রকৃতিস্থ হইলেন। বলিলেন, “আমি মনে করিয়াছিলাম, আমার দফা আজ রফা হল। এখনও দিনকতক বাঁচবার ইচ্ছা আছে।”
“এটা দেখে এমন ভয় করিবার কি আছে?”
“আছে, আমি মনে করিয়াছিলাম, তুমি আমাকে এখনই খুন করিবে। ও দেখলেই লোকে খুন হয়—খুনের চিহ্ন।”
“সত্যই কি তাই?”
“হাঁ, আমি আশ্চৰ্য্য হইতেছি, কেন তুমি এখনও খুন হও নাই। ভাল চাও ত এখনই ওটাকে গঙ্গার জলে ফেলে দিয়ে এস, নতুবা রক্ষা নাই—আমি বলছি, একেবারে রক্ষা নাই।”
যমুনাদাসের কথায় নগেন্দ্রনাথ বিশেষ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। এই শিবলিঙ্গ সম্বন্ধে বিবরণ বিশেষ অবগত হইবার জন্য ব্যগ্র হইলেন; কিন্তু পাছে তিনি কৌতূহল প্রকাশ করিলে যমুনাদাস কোন কথা না বলে, এইজন্য তিনি প্রথমটা নীরবে রহিলেন।
যমুনাদাস তাঁহার দিকে কিয়ৎক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, “তুমি এটা কোথায় পাইলে?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “হুজুরীমল যেখানে খুন হইয়াছিলেন, সেইখানেই এটা পাওয়া গিয়াছে, তাঁহার মৃতদেহের কাছেই পড়িয়াছিল।”
যমুনাদাস তাঁহার কথা শুনিয়া অতি অস্পষ্টস্বরে বলিলেন, “এতেই বুঝিতে পারা যাইতেছে, সেই সম্প্রদায়ই তাহাকে খুন করিয়াছে।”
“সম্প্রদায় তাহাকে খুন করিবে কেন?
“কেমন করিয়া জানিব? নিশ্চয়ই কোন কারণে তাহার উপর তাহাদের রাগ হইয়াছিল।”
“এ সম্প্রদায়টা কি? এরা কেন মানুষ খুন করিয়া বেড়ায়?”
যমুনাদাস বলিলেন, “এ সম্প্রদায় সম্বন্ধে যাহা জানি, বলিতেছি।”
এই বলিয়া যমুনাদাস উঠিয়া জানালাটা দেখিয়া আসিলেন। দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলেন। তাঁহার সেই সশঙ্ক ভাব দেখিয়া নগেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিলেন, “ভয় নাই, এখানে তোমার সম্প্রদায় কিছু করিতে পারিবে না।“
যমুনাদাস বলিলেন, “হুজুরীমলকে এই সহরেই খুন করিয়াছে।”
এই কথায় কেমন আপনা-আপনি নগেন্দ্রনাথেরও প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল।