Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ভূতের চেয়ে অদ্ভুত

একটা মজার শব্দছককে কেনই বা কর্নেল ধাঁধা বললেন এবং গুপ্তযুগের মন্দির স্থাপত্যের স্বস্তিকা চিহ্নকে তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন, উপরন্তু অনিলকুমার সাঁতরার কথাগুলি নিয়ে মাথা ঘামালেন, উনিই জানেন। তবে ব্যাপারটা আমাকে চিন্তিত করেছিল। তার কারণ এই বর্ষা-বাদলার মরশুমে কোনও রহস্যটহস্যের পেছনে ছোটাছুটি করে বেড়াবেন কর্নেল এবং আমাকেও বেশ ভোগাবেন মনে হচ্ছিল।

তাহলে কি ময়ূরের পেখমের মতো ফুলফোঁটানো অর্কিড দেখতে যাওয়া ওঁর নেহাত একটা ছুতো? ভীমের গদা নামক টিলার সুদৃশ্য বন বাংলোয় পৌঁছে অবশ্য উদ্বেগটা কেটে গিয়েছিল। সেখানে থেকে একটা সুবিস্তীর্ণ সংরক্ষিত জঙ্গল শুরু। সমৃদ্ধ পুরনো জনপদ ভীমগড় মোটামুটি সমতল একটা পাহাড়ি উপত্যকায় অবস্থিত। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটা ছোট্ট নদী। কিন্তু এই বর্ষায় সত্যিই যে ভীমা ভয়ঙ্করী। ফরেস্ট বাংলোর দূরত্ব ভীমগড় থেকে প্রায় এক কিমি। তবে কর্নেলের স্নেহভাজন বন দফতরের অফিসার হরদেব সিংহের একটি জিপ আমাদের সেবার জন্য তৈরি থাকায় কোনও অসুবিধে হয়নি। জিপচালক রহমতের গোঁফ এবং তাগড়াই চেহারা আপাতদৃষ্টি ভীতিপ্রদ হলেও সে খুব অমায়িক এবং সজ্জন লোক। একসময় প্রতিরক্ষা দফতরে চাকরি করত। কাশ্মীরের লাদাখ অঞ্চলে দুর্গম তুষারঢাকা পথে সামরিক যানবাহন চালানোর অভিজ্ঞতা তার আছে। কর্নেলকে সে বেজায় সমীহ করে এবং দেখামাত্র সামরিক সেলাম ঠোকে।

বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ রহমত কর্নেলের নির্দেশে জঙ্গলের পথে জিপ ছুটিয়েছিল। সে সাংঘাতিক পথের বর্ণনা দিচ্ছি না। দেওয়া যায় না বলেই। তাছাড়া সেটাকে পথও বলা যায় না। টুকরো টুকরো পাথরের চাই এবং হঠাৎ হঠাৎ বাঁক। কখনও বর্ষার ধস ছেড়ে পড়া গাছপালা ঝোপঝাড় জিপের গতি রোধ করছিল। রহমত জিপ থামিয়ে সেগুলো সরিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু কর্নেলের বা আমার একাজে সাহায্য নেওয়ার পাত্র নয় সে। তার কথা, আরামসে বৈঠিয়ে সাব! ইয়ে তো মামুলি কাম হ্যাঁয়। সেইসঙ্গে লাদাখে বড় বড় তুষারঢাকা পাথর সরিয়ে তার জিপ চালানোর অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিল সে।

অবশেষে একটা মাঝারি গড়নের প্রপাতের কাছে জিপ থেমেছিল এবং কর্নেল উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। বুঝেছিলাম সেই অর্কিডের খোঁজেই গেলেন। আকাশ কখনও নিজেকে ঘন মেঘে ঢাকছে। কখনও মেঘ সরিয়ে ঝলমলে রোদ্দুর ছড়াচ্ছে। বৃষ্টি ছিল না। রহমত খৈনি ডলতে ডলতে তার সামরিক জীবনের গল্প শোনাচ্ছিল। তাতে রঙ চড়ানো স্বাভাবিক। আমি কখনও শুনছিলাম, কখনও অন্যমনস্ক। শব্দছকের তিনটি শব্দ মকর, কচ্ছপ এবং রপট, গুপ্তযুগের মন্দির স্থাপত্যে স্বস্তিকা চিহ্ন এবং পোস্টমাস্টার অনিল কুমার সাঁতরা আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। শেষে ভাবলাম, ব্যাপারটা আমাকে নিয়ে কর্নেলের একটা কৌতুক ছাড়া কিছু নয়।

প্রপাতের গর্জনে রহমতের কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না। তাতে আমি হিন্দি, উর্দু তত বুঝি না। সে কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছিল। একসময় সে ঈষৎ উদ্বেগে বলল, এই জঙ্গলে জন্তু জানোয়ার আছে। তবে তার ভয় বুনো হাতির পাল সম্পর্কে। হাতিদের সর্দার নাকি খামখেয়ালি হয়। কার্নিলসাব কি কোথাও তার পাল্লায় পড়ে আটকে গেছেন? না কর্নিলসাব মিলিটারির লোক। তিনি হাতির সর্দারকে ফাঁকি দিতে পারবেন। লেকিন বহত দের হো জায়েগা। বৃষ্টি এসে গেলে ধস্ ছাড়ারও ভয় আছে।

প্রায় দেড়টা নাগাদ কর্নেল ফিরলেন। হাতে কয়েকটা অর্কিডের চারা। বললেন, ফুল দেখলে তুমি অবাক হতে জয়ন্ত। কিন্তু তুমি তো জানো, আমি কখনও ফুল ছিড়ি না। সেটা পাপ গণ্য করি। হুঁ, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতাম। নিয়ে যাইনি তার কারণ জায়গাটা ভীষণ দুর্গম। তোমাকে নিয়ে সমস্যা হত।

আমাদের ভাগ্য ভাল। বৃষ্টি নামল বাংলোয় ফেরার পর। রহমত বৃষ্টির মধ্যে জিপ নিয়ে ভীমগড়ে ফিরে গেল। বলে গেল, সে খেয়েদেয়েই ফিরবে। বাং লোর প্রবীণ চৌকিদারকামরাঁধুনি কিরপানাথ কৃপানাথ চমৎকার বাঁধে। দেরিতে হলেও বৃষ্টির পরিবেশে এবং খিদের দরুন খাওয়াটা ছিল তৃপ্তিদায়ক। খেতে খেতে কর্নেল হিন্দিতে কৃপানাথকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো ভীমগড়ের পুরনো লোক। তুমি পোস্টমাস্টার অনিলবাবুকে চেনো?

কৃপানাথ বলল, হ্যাঁ স্যার। চিনব না কেন? ওঁকে সবাই চেনে। আজকাল চিঠি লেখার খুব রেওয়াজ হয়েছে। আগের দিনে এত বেশি ছিল না। যে লেখাপড়া জানে না, সে-ও নানা জায়গায় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে চিঠি পাঠায়। চিঠি লিখে দেওয়ার লোকও পোস্টাপিসে আছে। মানিঅর্ডার ফরম লেখা, ইংরেজিতে টাইপ করে দরখাস্ত পাঠানোর জন্যও লোক আছে। তবে পোস্টমাস্টারের কথা বলেছেন। ওঁরা ভীমগড়ের বড় ব্যবসায়ী পরিবার। বাঙালি বাজারের একচেটিয়া কারবারি। অনিলবাবু ব্যবসা ছেড়ে কেন যে চাকরিতে ঢুকলেন বুঝি না।

জিজ্ঞেস করলাম, বাঙালিবাজার নামে আলাদা বাজার আছে নাকি?

আছে স্যার। আমার ছোটবেলায় বাঙালি জমিদার ছিলেন। তিনিই ভীমগতে বাজার, হাইস্কুল, লাইব্রেরি, দেব-দেবীর মন্দির কত কি করেছিলেন। এখন ওঁরা কলকাতা চলে গেছে। একটু দ্বিধার সঙ্গে কৃপানাথ ফের বলল, সাঁতরাবাবুদের অত্যাচারেই চলে গিয়েছিলেন জমিদার রায়বাবুরা। কি নিয়ে মামলা-মোকর্দমা হয়েছিল শুনেছি।

কর্নেল বললেন, তুমি তাহলে প্রসন্নকুমার রায়কে দেখেছ নিশ্চয়?

দেখেছি। তা বছর বিশেক আগে। উনি জমিদারবাড়ির ছোটহুজুর ছিলেন। বড় হুজুর নাকি সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে গিয়েছিলেন।

জমিদারবাড়িটা তো এখনও আছে?

জঙ্গল আর খণ্ডহর হয়ে গেছে। এমন জঙ্গলে জায়গা যে, কেউ কিনতে রাজি হয় না। ছোটবেলায় শুনেছি লোকে বলত কেল্লাবাড়ি। তিনদিক গড়খাই, একদিক নদী। গড়খাইয়ের ওপর একটা কাঠের সাঁকো ছিল। কবে ভেঙে গেছে। গড়খাইয়ের একখানে কারা পাথর ফেলেছিল। সেই পাথরের ওপর দিয়ে খণ্ডহরে যাওয়া যায়। কিন্তু যাবেই বা কে? কেনই বা যাবে? যদি যায় কেউ,

সে মুসহরবস্তির লোকেরা। ওরা শিকারি।

কর্নেল নিজেই বলেন, খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই। কিন্তু খেতে খেতে এইসব কথাবার্তা দিব্যি চালিয়ে গেলেন। খাওয়া শেষ হতে হতে বৃষ্টিটা থেমে গেল। মেঘ সরে রোদ্দুর ফুটল। রহমত জিপ নিয়ে এসে গেল। আমার ভাতঘুমের অভ্যাস আছে। কিন্তু কর্নেল বাধ সাধলেন। প্রায় চারটে বাজে। ওঁর সঙ্গে বেরুতে হবে এবং চোখে হেসে বললেন, এবার অর্কিড নয় ডার্লিং। রহস্য।

জিপ ভীমগড়ের দিকে উত্রাইয়ের চিকন বৃষ্টিধোয়া পথে ছুটে চলল। কর্নেল বসতির কাছে পৌঁছে বললেন, রহমত, পোস্টঅফিসে যাব।

কৌতূহল চেপে রাখলাম। অফিস আদালত এলাকায় বড় রাস্তার ধারে ছিমছাম একতলা সাব পোস্ট অফিস। ইংরেজি এল প্যাটার্ন নতুন বাড়ি। বারান্দার এক কোণে একজন পেশাদার টাইপিস্ট আপন মনে টাইপ করে চলেছেন। ভিড় নেই। থাকারও কথা নয় এখন। কর্নেল কাউন্টারে এক কর্মচারীকে নিচু গলায় কিছু বললেন, সে মুখ ঘুরিয়ে ইশারায় কিছু দেখাল। কর্নেল ঢুকে গেলেন। আমিও ওঁকে অনুসরণ করলাম।

ভেতরে কোনার দিকে দেয়াল ঘেঁষে একটা চেয়ার টেবিল। চেয়ারে আন্দাজ পঁচিশ বছর বয়সী গাঁট্টাগোট্টা চেহারার এক যুবক বসে ফাঁইলে কিছু লিখছিলেন। কর্নেলকে দেখে ইংরেজিতে বললেন, দয়া করে বসুন মহাশয়। আপনাকে সাহায্য করতে পারি কি?

বাংলা অনুবাদে এই বাক্যদুটি দাঁড়ায়। তো বুঝলাম, কর্নেলকে উনি সায়েব। ভেবেছেন। কর্নেল বাংলায় বললেন, আপনিই কি পোস্টমাস্টার?

উনি একটু অবাক হয়ে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনারা কোথা থেকে আসছেন?

কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছি। আপনার নাম কি অনিলকুমার সাঁতরা?

হ্যাঁ। আপনি–

এখন আমিই অবাক এবং হতবাক। হাওড়া স্টেশনের সেই ভদ্রলোক ইনি নন।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, মিসেস দয়াময়ী সাঁতরা আপনার আত্মীয়া?

অনিবাবু ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর ফেস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, জেঠিমা তাহলে তলে তলে পুলিশকে অ্যাপ্রোচ করেছেন। কোনও মানে হয়?

কর্নেল পকেট থেকে তার নেমকার্ড বের করে দিয়ে বললেন, না অনিলবাবু। আমরা পুলিশের লোক নই। আপনার জেঠিমার সঙ্গে কলকাতায় এক ভদ্রলোকের বাড়িতে আলাপ হয়েছিল। তো আপনার পদবি সাঁতরা বলেই কথাটা মাথায় এল। আপনার নাম অবশ্য এখানে বেড়াতে এসে জানতে পেরেছি। দৈবাৎ একটা যোগাযোগ আর কি!

অনিলবাবু কার্ডটা দেখছিলেন। নার্ভাস মুখে হেসে বললেন, ভীমগড়ে সাঁতরা ফ্যামিলি একটাই। জ্যাঠামশাই মারা যাওয়ার পর জেঠিমা কলকাতার বাড়িতে গিয়ে আছেন। খুলেই বলি। জেঠিমার একটু সন্দেহবাতিক আছে। সব সময় ওঁর সন্দেহ, আমরা ওঁকে প্রপার্টির ন্যায্য শেয়ার থেকে বঞ্চিত করেছি। সন্তানাদি না থাকায় পোষ্যপুত্র নিয়েছেন। যত অশান্তির মূলে এই গুণ্ডাটা। তা চা-ফা বলি কর্নেলসায়েব?

ধন্যবাদ। কর্নেল অমায়িক কণ্ঠস্বরে বললেন, আপনার জেঠিমার পোষ্যপুত্রের নাম কি?

অচিন্ত্য। ভীমগড়েই ওদের বাড়ি ছিল। ওর বাবা ছিলেন জমিদারবাবুদের কর্মচারী। বলে অনিলবাবু আবার সেইরকম ভুরু কুঁচকে তাকালেন। অচিন্তাকে চেনেন নাকি?

না। সে কোথায় থাকে?

কলকাতায় জেঠিমার কাছেই থাকে। কালেভদ্রে জেঠিমা এখানে এলে সঙ্গে আসে। জ্যাঠামশাইয়ের জীবদ্দশায় বাড়ির একটা অংশ পার্টিশন করা হয়েছিল। এলে সেখানেই ওঠেন। অনিলবাবু হাসবার চেষ্টা করে বিকৃত মুখে ফের বললেন, গত মাসে এসে হঠাৎ হইচই বাধিয়েছিলেন। তালা ভেঙে কি কি সব চুরি গিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার দেখুন–চুরি যদি হবে, পুলিশকে জানাক। তা নয়, খামোকা চাঁচামেচি। শাসানি। আসলে অচিন্ত্য ওঁকে সামনে। রেখে আমাদের সঙ্গে ঝামেলা বাধাতে চায়। তা বাধাক। উই আর রেডি টু ফেস–

উঠি অনিলবাবু। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে বললেন, কাল সন্ধ্যায় হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। রোগা, বেঁটে মতো। লম্বা নাক। বলছিলেন, তাঁর নাম নাকি অনিলকুমার সাঁতরা। ভীমগড়ের পোস্টমাস্টার। তো দেখছি, উনি মিথ্যা বলছিলেন।

অনিলবাবু উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, অ্যাঁ? সে কি কথা!

কর্নেল হাসলেন। কত লোক কত ধান্দায় থাকে।

অনিলবাবুকে উত্তেজিত মনে হল। ডাকলেন, শচীন। ও শচীন। আবার সেই কেলোর কীর্তি। বটকেষ্ট এঁদের কাছেও আমার নাম ভাড়িয়ে কি সব বলেছে।

এক তরুণ কর্মী চিঠির তাড়া বাঁধছিলেন। ফিক করে হেসে বললেন, কত টাকা ধার নিয়েছে বটোদা?

পোস্টমাস্টার কিছু বলার আগেই কর্নেল বললেন, নাহ। টাকা ধার নেননি। নেহাত নিজের পরিচয় দিয়েছেন। ধার চাইলেই বা দেব কেন? কিন্তু কে এই ভদ্রলোক?

অনিলবাবু খাপ্পা হয়ে বললেন, ওকে ভদ্রলোক বলছেন? নাম্বার ওয়ান ঠক। আমার নাম ভঁড়িয়ে কত লোককে ঠকিয়েছে জানেন? এই অফিসেই একসময় পোস্টম্যান ছিল বটকেষ্ট। এর চিঠি তাকে, তার চিঠি ওকে করে গণ্ডগোল বাধাত। শেষে মানিঅর্ডারের টাকা মেরে ধরা পড়ল। ছমাস জেল হয়েছিল। জানেন?

এখন কোথায় থাকেন উনি?

অনিলবাবু খাক শব্দ হাসলেন, ও শচীন। বটকেষ্ট কোথায় থাকে জানো?

শচীনবাবু বললেন, পাটোয়ারজির গদিতে খাতা লেখে। গদির লাগোয়া একটা ঘরে থাকে। পাটোয়ারিজি ঘুঘু লোক।

বলো কি! জেনেশুনেও পাটোয়ারিজি ওকে কাজ দিয়েছেন?

রতনে রতন চেনে। বলে শচীনবাবু খি খি করে হেসে উঠলেন।

কর্নেল পোস্টমাস্টারকে নমস্কার করে বেরিয়ে এলেন। জিপের কাছে গিয়ে অলোম, বাপস! কত কি বেরিয়ে এল ঝুলি থেকে। মাথা ভো ভো করছে। কিন্তু দয়াময়ী সাঁতরা কি আপনার মক্কেল?

নাহ্। মকেল-টক্কেল নন। আমারই নেহাত কৌতূহল। অনুসন্ধিৎসা বলতে পারে।

শব্দছক ও স্বস্তিকা–

কর্নেল হাসলেন। এতদিনে বুঝলাম তৎকালীন পোস্টম্যান বটকৃষ্ণবাবু ইচ্ছে করেই রং ডেলিভারি দিয়েছিলেন দয়াময়ীকে। খামের মধ্যে একটা কাগজে স্বস্তিকা চিহ্নের তলায় ওই মকর, কচ্ছপ এবং রপট শব্দছক আঁকা ছিল।

বুঝলাম। কিন্তু খামের ওপর নাম-ঠিকানা ছিল তো?

ছিল। প্রসন্নকুমার রায়। অথচ বাংলোর চৌকিদার কৃপানাথ যা বলল, তাতে মনে হয়, প্রসন্নবাবু বছর আগে ভীমগড় ছেড়ে কলকাতাবাসী হয়েছিলেন। জিপে উঠে কর্নেল রহমতকে বললেন, পাটোয়ারিজির গদি চেনো রহমত?

রহমত স্টার্ট দিয়ে বলল, জরুর কর্নিলসাব। সুন্দর সিং পাটোয়ারিজিকে এ মুলুকে সবাই চেনে। এখন নয়া টাউনশিপে কারবারি অফিস খুলেছেন। লেকিন তার গদি পুরানা বাজারে।

গদিতেই চলো আগে।

রহমত বিনীতভাবে বলল, পুরানা বাজারে ঘিঞ্জি গলি। গাড়ি ঢুকবে না। কর্নিলসাবকে একটু কষ্ট করে কয়েককদম হাঁটতে হবে।

ঠিক আছে।

জিপ সংকীর্ণ আঁকাবাঁকা রাস্তায় মিনিট পনের চলার পর ভিড়ভাট্টায় ভরা জরাজীর্ণ চেহারার একটা বাজার এলাকায় গিয়ে থামল। রহমত গদির হদিস দিল। কর্নেলকে অনুসরণ করলাম। সত্যিই ঘিঞ্জি গলি এবং খানাখন্দে ভরা পথ। জলকাদায় পাথরের ইট পিচ্ছিল হয়ে আছে। কিছুটা চলার পর একটা ফাঁকা চত্বর দেখা গেল। তার চারদিকে একতলা-দোতলা বাড়ি। দোকানপাটে ভিড় গিজ গিজ করছে। চত্বরে একদঙ্গল গরু-মোষ এবং ঘোড়া এখনই রাতের খাওয়া সেরে নিচ্ছে। যে গাড়িগুলো তারা টেনে এনেছে, সেগুলো কোন্ পথে ঢুকেছে খুঁজে পেলাম না। সবে বিদ্যুতের আলো জ্বলে উঠেছে। কারণ আকাশে ঘন মেঘ নীচের নৈসর্গিক আলো শুষে নিয়েছে।– পাটোয়ারিজির গদি খুঁজে পাওয়া গেল। গদিতে যে অবাঙালি ভদ্রলোক দোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বসেছিলেন, তিনি পাটোয়ারিজির এক ভাতিজা। তার কাছে জানা গেল, বটকৃষ্ণবাবু কারবারি কাজে কলকাতা গেছেন। এখনও ফেরেননি।

পাটোয়ারিজির ভাতিজা ভদ্রলোক কেমন যেন নির্লিপ্ত উদাসীন প্রকৃতির মানুষ। কর্নেলকে পাত্তা দিলেন না, জিজ্ঞেসও করলেন না কিছু।

ফিরে আসতে আসতে বললাম, লোকটা বড় অভদ্র তো!

কর্নেল আনমনে বললেন, কেন?

কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। গ্রাহ্যও করলেন না।

কর্নেল হাসলেন। টিপিক্যাল ঝানু ব্যবসায়ীরা লোক চেনেন। দেখেই আঁচ করেছেন, আমরা কারবারি কাজে আসিনি। সন্দেহও হয়ে থাকবে সরকারি লোক কি না। পাত্তা দেওয়া মানে পয়সা খরচ। যদি আমরা কিছু চার্জ করি, তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে। এই হল এখানকার কারবারিদের বাঁধা ছক।

বটকৃষ্ণবাবুর কীর্তিকলাপ সত্যিই রহস্যজনক। তবে আপনার আচরণও কম রহস্যজনক নয়! আমাকে খুলে বললেই পারেন, কলকাতার দয়াময়ী দেবী আপনাকে একটা কেস দিয়েছেন।

না জয়ন্ত। কেস উনি দেননি। আমিই নিয়েছি। নিছক অনুসন্ধিৎসা। তবে বটকৃষ্ণবাবুর কথা দয়াময়ী আমাকে বলেননি। লেটারবক্সে বছর তিনেক আগে খামটা পেয়েছিলেন। কৌতূহলবশত খুলে দেখে অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারেননি। তবে বুদ্ধিমতী মহিলা। জমিদার রায়বাবুদের সঙ্গে ওঁর স্বামীর ফ্যামিলির বিবাদ ছিল জমি-জায়গা নিয়ে। তাই খামটা লুকিয়ে রেখেছিলেন, কোনও দিন কাজে লাগবে ভেবেই।

ওঁর পোষ্যপুত্রকে জানাননি?

পোষ্যপুত্রের কথা আমাকে দয়াময়ী বলেননি। তবে ওঁর কথায় আঁচ করেছি, এই খামের কথা উনি ঘুণাক্ষরে কাকেও বলেননি। কদিন আগে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে ওঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তো আমার পরিচয় পেয়ে। উনি–

ভিড়ে ঠাসা ঘিঞ্জি গলিতে পিচ্ছিল পাথুরে ইটের ওপর হাঁটতে হাঁটতে বাক্যালাপের বিপদ আছে। বার দুই পা হড়কে পড়তে পড়তে টাল খেয়েছিলাম। তৃতীয়বার পড়েই পেলাম। নোংরায় প্যান্টের অবস্থা শোচনীয় হল। দুটো হাতে কাদা মেখে গেল। কিন্তু ভাগ্যিস আঘাত পেলাম না। ভিড়ের কেউ আমাকে সাহায্য করার আগেই উঠে দাঁড়ালাম। কেউ কেউ জলের কল দেখিয়ে দিল সমবেদনায়।

কিন্তু কর্নেল কোথায়?

একটু পরে তাকে আবিষ্কার করলাম। গলির বাঁকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে চুরুট ধরাচ্ছেন। কাছে গেলে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ফলপট্টির ভেতর হাঁটার সময় সতর্ক থাকা উচিত। বিশেষ করে যদি দুধারে পাকা কলার কাদি দেখা যায়। যাই হোক, তোমার জন্য এই ট্যাপের কাছে অপেক্ষা করাই উচিত মনে করেছিলাম। ধুয়ে নাও। বাংলোয় ফিরে পোশাক বদলাবে।

অগত্যা ট্যাপের জলে যতটা পারা যায় ধুয়ে পেলে বললাম, যত বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি জায়গায় আপনার যাতায়াত। এই নোংরা কাদার দুর্গন্ধ ছ্যাঃ।

কনেল পা বাড়িয়ে বললেন, তোমার চেয়ে বটকৃষ্ণবাবুর অবস্থা শোচনীয়। বেচারা ভিড় ঠেলে পালাতে গিয়ে একবারে ড্রেনে পড়লেন। আমি ওঁকেই ওঠাতে গেলাম। কিন্তু উনি কাদায় ভূত হয়ে ভূতের মতোই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। একেই বলে ভূতের চেয়ে অদ্ভুত।

বলেন কি! বটকৃষ্ণবাবুকে দেখেছেন? চোখের ভুল নয় তো?

নাহ্। আপন মনে উনি আসছিলেন। হাতে অবশ্য ব্রিফকেস ছিল না। আমাকে দেখামাত্র গা ঢাকা দিতে গিয়ে কেলেঙ্কারি। কর্নেল স্বভাবসিদ্ধ অট্টহাসি হাসলেন। তারপর জিপের কাছাকাছি পৌঁছে আপনমনে বললেন, বটকৃষ্ণবাবু একটা ভাইট্যাল পয়েন্ট। ওঁকে না পেলে খড়ের গাদায় সুচ খুঁজে হন্যে হব।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress