শহরের ছিনতাই
শহরের ছিনতাই আর গুণ্ডাদের বিদায় দিয়ে, শ্যামাচরণ অশোককে ঘরে ডাকল আবার। অশোক এসে বসতেই, গম্ভীর হয়ে বলল, যার তার সামনে বাজে কথাটা একটু কমাও। এর মধ্যেই কোনওদিন একটা কাণ্ড হয়ে যাবে।
অশোক সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে, চেয়ারে বসে সিগারেট ধরাল তারপর বলল, কী বলবার আছে বলুন, আমাকে বাড়ি যেতে হবে।
বলছি বলছি, চা খাবে নাকি?
শ্যামাচরণের গলা একটু নরম। অশোক বলল, না।
শ্যামাচরণ একটু ভেবে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি তো মোটামুটি চেন সবাইকেই এই এলাকায়। একটা হদিস আমাকে দিতে পার?
কী।
এই দাঙ্গায় যতগুলো স্টাবিং-এর কেস দেখলাম, প্রত্যেকটাই খুব নিপুণ হাতের ছুরি দিয়ে মারা। এটা নেহাত লাঠিসোটা নিয়ে দাঙ্গা করা নয়। বাঙালি অবাঙালি, উভয় ক্ষেত্রেই দেখছি ছুরি দিয়ে মারার ধরনটা প্রায় এক। জানি না, ছুরিটা এক হাতেই চলছে কি না। দু হাতেও হতে পারে। তবে যারা ছুরি চালাচ্ছে, তারা একেবারে মাস্টার লোক এ ব্যাপারে।
অশোক বলল, ভাড়াটে লোক হলে, সে দু দলকেই মারতে পারে, দুজন লোকও থাকতে পারে। তবে আমার মনে হয়, তারা ভাড়াটে।
তা ভাড়াটে হোক, এরা কারা, বুঝতে পার?
না।
শ্যামাচরণ সন্দিগ্ধ চোখে অশোককে দেখল। বলল, কিন্তু কাদের ভাড়াটেই বা হতে পারে?
শ্যামাচরণ স্ট্রাইক ভাঙবার জন্যে, দাঙ্গাটা লাগিয়েছে।
শ্যামাচরণ বিরক্ত হয়ে বলল, তোমার মুখ থেকে আমি রাজনীতির কথা শুনতে চাই না।
এতে রাজনীতির কী আছে, যা সত্যি তাই বলছি। এদের বাদ দিয়ে, গুণ্ডাদের ধরলে কী হবে। সরষের মধ্যেই তো ভূত, আগে পালের গোদাগুলোকে ধরুন, যাদের হুকুমে এ সব হচ্ছে।
শ্যামাচরণ ভুরু কোঁচকাল, তারা কারা?
অশোক সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, দেখুন হয়তো, এখন থানাতে বসেই কোনও ঘরে বড় বড় বুলি ঝাড়ছে। শহরের গণ্যমান্যরাই কেউ কেউ থাকতে পারে।
কিন্তু প্রমাণ?
অনেক আছে, ইচ্ছে করলেই পাওয়া যায়। কিন্তু আপনি তাদের ধরতে পারবেন কি?
প্রমাণ থাকলে নিশ্চয়ই পারব।
অশোক হেসে উঠল। বলল, পারবেন না। এমন সব লোক আছে, যাদের একটা কথায় আপনার চাকরি নট হয়ে যাবে।
শ্যামাচরণের থলথলে মুখ কঠিন আর ভয়ংকর হয়ে উঠল, তার মানে?
অশোক নির্বিকার ভাবে বলল, তার মানে, আপনিও যে তাদের চেনেন না, তা নয়। জানেনও সবই, কিন্তু করতে পারেন না কিছুই।
শ্যামাচরণ চিৎকার করে উঠল, থাক তোমাকে আর কমিউনিস্টগিরি করতে হবে না।
বাঃ, এতে আবার কমিউনিস্টের কী আছে।
আছে, তোমার কথাবার্তা সেইরকম। তুমি সেই ছুরিচালানো গুণ্ডার কথা বলতে পার কিনা জানিয়ে দাও, তা হলেই হবে।
তাদের কথা বলতে পারি না, তবে তারা কাদের লোক তা বলতে পারি।
বেরোও, বেরিয়ে যাও তুমি আমার ঘর থেকে।
ক্রুদ্ধ চিৎকারে ফেটে পড়ল শ্যামাচরণ। তারপরে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তারপরে তোমাকে আমি দেখে নেব একবার। চান্স আমি পাবই, জেনে রেখো।
অশোক নির্বিকার মুখে উঠতে যাচ্ছিল, এমন সময় ডাক্তার প্রদ্যোৎ রায় ঢুকল, আসতে পারি?
শ্যামাচরণ চোখ তুলে, তাড়াতাড়ি মুখের ভাব বদলে বলল, আরে আসুন আসুন ডাক্তারবাবু, নতুন কোনও খবর আছে নাকি?
ডঃ প্রদ্যোৎ নিঃশব্দে মাথা নাড়তে নাড়তে এসে ঘরে ঢুকল। অশোকই একটা চেয়ার ঠেলে দিয়ে বলল, বসুন প্রদ্যোৎদা। অমিতাদি বাড়ি ফিরেছেন তো কাল রাত্রে?
প্রদ্যোৎ মাথা নেড়ে বলল, না, সেইজন্যই তো থানায় এলাম, এঁরা যদি কিছু বলতে পারেন।
অশোক মনে মনে উৎকণ্ঠা আর বিস্ময় বোধ করল। গতকাল রাত্রি নটা নাগাদ শুনেছিল, প্রদ্যোতের স্ত্রী অমিতা, বিকালবেলা বেরিয়ে, আর বাড়ি ফেরেনি। এইরকম দাঙ্গার পরিস্থিতিতে, কোথায় আর যেতে পারে? কাছে পিঠে কারুর বাড়িতে, অথবা বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার মধ্যেই, যে সিনেমা হল আছে, বড়জোর তা-ই দেখতে যেতে পারে। তাও অমিতাদি যেরকম ধরনের মহিলা, এরকম পরিস্থিতিতে না বলে কয়ে সিনেমায় যাবার পাত্রী নয়।
প্রদ্যোৎ অমিতা, দুজনেই এই শহরের ছেলেমেয়ে। সেই সুবাদেই, অশোকের কাছে দুজনেই প্রদ্যোৎদা এবং অমিতাদি। দুজনেই অশোকের থেকে বড়। অমিতাদির সঙ্গে প্রদ্যোৎদার প্রেম করে বিয়ে হয়েছিল। তাও যেমন তেমন না, লুকিয়ে বিয়ে করতে হয়েছিল। অমিতাদিদের বাড়ি থেকেই বিশেষভাবে আপত্তি ছিল।
কিন্তু সে সব পুরনো কথা ভেবে লাভ নেই। প্রদ্যোৎ এই ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বছর বয়সেই, রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার, শহরে যথেষ্ট নাম ডাক। বাড়ি গাড়ি, দুই-ই করেছে। জনপ্রিয়ও বটে। ডাক্তারদের ক্ষেত্রে যেটা প্রায় দুর্লভ। ডাক্তারদের পক্ষে জনপ্রিয় হওয়া বড় কঠিন। কারণ, পসার বাড়বার এবং জনপ্রিয় হবার আগে, ডাক্তাররা যতখানি উদার আর অমায়িক থাকে, আস্তে আস্তে তা স্বাভাবিক ভাবেই কেটে যায়। একলা মানুষ এত ব্যস্ত হয়ে পড়ে, অথচ অর্থের পিপাসা ক্রমে বলবৎ হয়ে উঠতে থাকে, দুয়ের চাপে আপনা থেকেই ডাক্তাররা অপ্রিয় হয়ে ওঠে। ডঃ প্রদ্যোৎ রায়ের বেলায় সেটা হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হয়নি। কারণ, ওঁর ব্যবহারটা এখনও যথেষ্ট অমায়িক। সামাজিক সব রকম কাজেই উনি থাকবার চেষ্টা করেন। বারোয়ারি পূজার প্রেসিডেন্টের পদ থেকে শহরের খেলাধূলা, পৌরসভার নির্বাচনে প্রগতিশীল প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ, সবকিছুতেই আছেন। তথাপি, চিকিৎসার ক্ষেত্রে, দাঁতব্য বা বদান্যতা, আগের মতো আর নেই। দুর্নাম যারা করার, তারা করে। কিন্তু তাতে প্রদ্যোৎ রায়ের ক্ষতি কিছু হয়নি। জনপ্রিয়তা কিছু ম্লান হয়নি।
শ্যামাচরণের থলথলে মুখে দুশ্চিন্তা আর বিস্ময়ের ছায়া পড়ল। বলল, থানায় তো কোনও খবরই আসেনি। আজ সকালে কি আপনি কোনও টেলিফোন করেছিলেন?
প্রদ্যোৎ একটা চেয়ারে বসে, খানিকটা অন্যমনস্কের মতো মাথা নাড়ল। বলল, কাল সারা রাত অপেক্ষা করার পর নিজেই আসব ভাবলাম। আমি তো মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। কোথায় যেতে পারে অমিতা। ও তো এ ভাবে কোথাও যাবার মেয়ে নয়।
অশোক জিজ্ঞেস করল, অমিতাদি বাপের বাড়ি যাননি তো?
প্রদ্যোৎ মাথা নেড়ে বলল, না, আমার শাশুড়ি শালি সকলেই তো ভোরবেলা থেকে আমার বাড়িতে রয়েছে। কাল সারারাত্রি ওর বাপের বাড়িতেও সকলের উদ্বেগে কেটেছে। ভোরবেলাই আমার কাছে চলে এসেছে। আমি তো কাল রাত্রি আটটায় চেম্বার থেকে বেরিয়ে, বাড়িতে খোঁজ করেছি। লোকালিটির যত বাড়ির সঙ্গে অমিতার আলাপ পরিচয়, সব বাড়িতে গিয়েছি। সে সব কোনও বাড়িতেই যায়নি।
শ্যামাচরণ জিজ্ঞেস করল, সিনেমা হলের লোকদের জিজ্ঞেস করলে হত, ওরা দেখেছে কি না।
তাও জিজ্ঞেস করেছি। অমিতাকে ওরা সবাই চেনে। বুকিং অফিস থেকে শুরু করে, গেটম্যান দরোয়ান, সবাই বললে, মিসেস রায়কে ওরা কেউ সিনেমা হলে দেখতে পায়নি।
শ্যামাচরণের থলথলে মুখটা যেন ক্রমে ফানুসের মতো ফুলে উঠতে লাগল। বলল, তার মানে সিনেমায় যাননি, বাপের বাড়ি যাননি, চেনাশোনা কোনও বাড়িতে যাননি। শহরের যা পরিস্থিতি তাতে নিশ্চয়, অবাঙালি এলাকার ভিতর দিয়ে দূরে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়।
অশোক বলল, দুরে কোথাও গেলে, বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়েই বেরোবেন নিশ্চয়।
শ্যামাচরণ ঈষৎ বিরক্ত চোখে অশোকের দিকে তাকাল। এ বিষয়ে অশোকের কথা বলা তার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু প্রদ্যোৎ বলে উঠল, তা তো নিশ্চয়ই। দুরের মধ্যে, শ্যামপুরের কালীবাড়ি। ইদানীং মাঝে মাঝে ও কালীবাড়ি যেত। অবাঙালি এলাকার মধ্য দিয়ে যাওয়ার একমাত্র জায়গা ওর শ্যামপুরেই। কিন্তু সেটাও আমাকে না বলে যাবার কোনও প্রশ্নই নেই। তা ছাড়া, এরকম সিচুয়েশনে ও কোথাও বেরুবে, এটা ভাবাই যায় না।
অশোক আবার জিজ্ঞেস করল, রেল স্টেশনে খোঁজ করেছিলেন নাকি?
প্রদ্যোৎ যেন একটু চকিত আশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, না তো!
অশোক বলল, যদি ট্রেনে কোথাও গিয়ে থাকেন।
শ্যামাচরণ প্রায় ধমক দিয়েই উঠল, কী যা তা বাজে বাজে বকছ। শুনছ শহরের এ পরিস্থিতিতে উনি বাড়ি থেকে বেরুবারই তোক নন। কাউকে না বলে ট্রেনের টিকিট কেটে কোথাও যেতে পারেন?
প্রদ্যোৎ বলল,সেটাও ঠিক। আর কোথায়ই বা যেতে পারে? যাবেই বা কেন? ট্রেনে করে একমাত্র কলকাতাতেই যেতে পারে, কিন্তু তাই বা যাবে কেন। না না, এ সব অর্থহীন চিন্তা। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
প্রদ্যোৎ অসহায় ভাবে কয়েকবার মাথা নেড়ে, চেয়ারটার মধ্যে যেন, অসহায় দুশ্চিন্তায় একেবারে কুঁকড়ে গেল। মাটির দিকে চেয়ে, পাথরের মতো বসে রইল। চোখ তার ঈষৎ আরক্ত, কোল বসা। চুল অবিন্যস্ত। জামার বোতামগুলো ভাল করে লাগানো নেই। পায়ে জুতো নেই, বাড়িতে ঘোরাফেরা করবার শ্লিপার জোড়াই রয়েছে। বোঝা যায়, গতকাল সারারাত ঘুমোয়নি।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও শ্যামাচরণের সঙ্গে অশোকের এক বার চোখাচোখি হল। শ্যামাচরণ তৎক্ষণাৎ চোখ ফিরিয়ে নিল। মুখটা বিকৃত হয়ে উঠল তার। অশোক জানে, তার ওপর শ্যামাচরণের রাগ হচ্ছে এখন। তা হোক, কিন্তু ওর মনটা উদ্বেগে ভরে উঠতে লাগল। কোথায় যেতে পারে অমিতাদি। গতকাল বিকেল থেকে, আজ সকাল, নটা বাজতে চলেছে, কোনও পাত্তা নেই, এ তো অসম্ভব। প্রদ্যোৎদাকে দেখে এবং কথা শুনে, আরও বেশি করে কথাটা মনে হচ্ছে। প্রদ্যোৎদা যেন নিজের মনের ভিতরটা হাতড়ে হাতড়ে খামচে খামচে অমিতাদিকে খুঁজছে, কোথায় যেতে পারে, কোথায়, কোথায়।
শ্যামাচরণ খানিকটা সান্ত্বনার সুরে বলল, শুনুন ডঃ রায়, অতটা একেবারে ইয়ে হয়ে পড়বেন না, একটা খোঁজ পাওয়া যাবেই। শহরের গোলমালে, এখনও পর্যন্ত কোনও মেয়ের দুর্ঘটনার সংবাদ থানায় আসেনি। আমি আমার সাধ্যমতো, সবরকম খোঁজ খবরের চেষ্টা করছি। আপনিও একটু দেখুন সবাইকে বলে, কেউ কিছু জানে কি না।
অশোক বলল, খবর হয় তো একটা পাওয়া যাবে। কিন্তু সেটা কী রকম খবর, সেটাই হচ্ছে ভাবনার।
শ্যামাচরণ জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলল, সেটাতো আর হাত গুনে এখনই বলা যাচ্ছে না। আর এ সব তোমাদের রোমান্টিক কল্পনার ব্যাপারও নয়।
প্রদ্যোৎ বলল, দেখুন ইনস্পেক্টর, আমার যা খোঁজ করার করেছি, যাকে যা জিজ্ঞেস করবার করেছি, আর আমার কিছু করবার নেই। আমি কিছুতেই কিছু ভেবে উঠতে পারছি না। আমি একটা অ্যাবসার্ড ভাবনার মধ্যে রয়েছি।
শ্যামাচরণ বলল, সেটা বুঝতে পারছি ডাক্তারবাবু।
তার বলার মাঝখানেই, অশোক বলে ওঠে, আচ্ছা প্রদ্যোৎদা, অমিতাদি যখন বেরিয়েছিলেন, তখন তো আপনি চেম্বারে চলে গেছেন?
হ্যাঁ, আমি তো সাড়ে চারটেয় যেমন বেরিয়ে যাই, সেই রকমই গিয়েছি।
তা হলে অমিতাদি বাড়ি থেকে বেরোবার সময়, ঝি আর ঠাকুর নিশ্চয়ই ছিল। ওরা কী বলে?
প্রদ্যোৎ বলল, ঠাকুর কিছুই জানে না, সুভদ্রা, আমাদের যে ঝি আছে, তার মুখে শুনলাম, অমিতা পাঁচটার একটু পরে, জামাকাপড় বদলে, বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। যাবার সময়, তাকেই বলে গেছে, আমি একটু বেরুচ্ছি, সাতটার মধ্যেই ফিরব।।
কোথায় যাচ্ছেন, তা কিছু বলেছিলেন?
না। যেরকম মাঝে মাঝে বেরোয়, সেরকমই বেরিয়েছে, সুভদ্রা তাই ভেবেছে। অমিতা কিছু বলেনি। সুভদ্রাও কিছু জিজ্ঞাসা করেনি।
শ্যামাচরণের চোখ মুখ ভীষণ হয়ে উঠেছিল ইতিমধ্যে! তার সামনে বসে, অশোকের এরকম জিজ্ঞাসাবাদ, সে সহ্য করতে পারছিল না। তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, অশোকের গালে সে এখুনি বিরাশি সিক্কা ওজনের একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেবে। কিন্তু সে ভাব দমন করে, গম্ভীর গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তুমি এবার যেতে পার অশোক।
অশোকও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ, আমি চলি। তবে রেললাইন বা গঙ্গায় একবার দেখলে হত। বলা তো যায় না।
সে সব তোমাকে বলতে হবে না। নিজের চরকায় তেল দাও গে যাও। তবে তোমাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি, শহরের হাঙ্গামায়, তোমাদের বন্ধুবান্ধব কাউকে আমি বিশ্বাস করি না। কোনওরকম ডাউটফুল কিছু যদি আমি পাই, তোমাদের সব কটাকে আমি চালান করে দেব।
অশোক ততক্ষণে দরজার কাছে, সেখান থেকে ফিরে একবার বলল, সে তো আপনি এখনই পারেন। গুণ্ডা আইনে, পি. ডি. অ্যাক্ট-এ, যা খুশিতেই তুলে নিয়ে গেলেই হল।
শ্যামাচরণের মুখে হঠাৎ কোনও কথা জোগাল না। সে চোয়াল শক্ত করে, জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে রইল। অশোক মুখ ঘুরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ওর মুখে তখন হাসি ফুটে উঠেছে। শ্যামাচরণের ক্রুদ্ধ মুখটা দেখেই ওর হাসি পেয়ে গিয়েছে। এবং এ কথা ও জানে, এখনি শ্যামাচরণ রেললাইন এবং গঙ্গায়, স্ত্রীলোকের মৃতদেহের সন্ধানে লোক পাঠাবে।
অশোক একটু লজ্জিত আর বিষণ্ণ হয়ে উঠল মনে মনে। প্রদ্যোৎদার সামনে কথাটা এভাবে না বললেই বোধ হয় ভাল হত। এতক্ষণ পর্যন্ত, অমিতাদির অন্তর্ধান বিষয়ে, কোনও কথাতেই, মৃত্যুর সম্ভাবনার কথা কেউ বলেনি। অশোকের মুখ দিয়েই কথাটা বেরিয়ে এল প্রথম।
কথাটা নিতান্ত ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে বলেই বলেছে। কিন্তু, অমিতাদির বেলায়, এরকম অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণই বা কী থাকতে পারে। এরকম মৃত্যু মানেই, হয় অমিতাকে কেউ খুন করেছে, অথবা আত্মহত্যা করেছে। সেটা রেললাইনে গলা দেওয়া বা গঙ্গায় ডুবে মরাও হতে পারে। তথাপি এ চিন্তার কোনও কারণই নেই। অমিতাদির সম্পর্কে আজে বাজে কথা এ শহরের কারুর জানা নেই।
অমিতাদি-প্রদ্যোৎদা, মোটামুটি সুখী দম্পতিই বলা যায়। ভিতরের খবর কে আর কতটা জানে। তবু পাড়া ঘরে, মোটামুটি, এ বাড়ির ওবাড়ির খবর কিছু না কিছু জানা যায়ই। যদি, সেরকম গোলমাল কিছু থাকে। অমিতা প্রদ্যোতের সেরকম কথা কেউ কিছু শোনেনি। দুজনের মাঝখানে, একটা ট্রাজেডি আছে, সেটা সবাই জানে। এত দিন বিয়ে হয়েছে, প্রায় সাত বছর, কিন্তু অমিতাদির কোনও ছেলেমেয়ে হয়নি। সকলেরই এখন ধারণা, অমিতাদির আর ছেলেমেয়ে হবে না বোধ হয়। এ বিষয়ে, প্রদ্যোৎদাকে কেউ কখনও দুঃখ প্রকাশ করতে শোনেনি। সন্তানের আকাঙ্ক্ষায়, অমিতার প্রতি প্রদ্যোতের কোনও বিরূপতার কথাও কেউ জানে না। হয়তো একটা খেদ, একটা দুঃখ, মনে মনেই দুজনে অনুভব করে। প্রদ্যোৎ ডাক্তার মানুষ, সন্তান না হওয়ার বৈজ্ঞানিক কার্যকারণও নিশ্চয় জানে, পরীক্ষা করেছে। আর হয় তো, এই কারণেই, ইদানীং শ্যামপুরের কালী বাড়িতে যাবার ঝোঁকটা অমিতাদির বেড়েছিল। অসহায় মানুষ মাত্রেরই মনের একটা এ ধরনের অবলম্বন দরকার হয়ে পড়ে। স্বামী থাকলেও, আর অন্য কিছুর প্রতি বিশ্বাস আসে, যা বস্তুজগতের বাইরে, অলৌকিক কোনও কিছুর একটা আশ্রয় মন আপনা থেকেই চায়। কারণ, বস্তুবিজ্ঞান জগৎ যা দিতে পারে না, সেই পাওয়ার আশাটা তখন অন্যত্র কেন্দ্রিত হয়। অমিতার কালীবাড়ি যাতায়াত হয় তো সেই কারণেই।
পারিবারিক অন্য কোনও জটিলতাও না থাকবারই কথা। প্রদ্যোৎ তার বাপ মা ভাইয়ের সঙ্গে থাকে না। সবাই জানে, সেটা অমিতাদির জন্য নয়, পৈতৃক বাড়ি ও পরিবারের পরিবেশ, প্রদ্যোতের নিজেরই ভাল লাগে না। তাই নিজে বাড়ি করে, প্রদ্যোৎ চলে এসেছে। সেদিক দিয়ে, নির্ঞ্ঝাট পরিবার।
তারপরে আসে, দুজনের চরিত্রের কথা। দুজনেই খুব মিশুকে, সকলের সঙ্গেই ব্যবহার খুব ভাল। অমিতা সুন্দরী, ছেলেপিলে না হওয়াতে, শহরের যুবকদের চোখে ও মনে, অমিতা সেই অমিতাই রয়ে গিয়েছে। সকলেই মেলামেশা করে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। অমিতা সেদিক থেকে নেহাত অনুদারও নয়। প্রদ্যোৎও এ ব্যাপারে যথেষ্ট উদার। কেউ কোনওদিন শোনেনি বা জানেনি, অমিতার মেলামেশায়, সে কখনও আপত্তি করেছে। কিন্তু এ কথাও আজ পর্যন্ত কেউ কখনও শোনেনি, অমিতার সঙ্গে কারুর, প্রেম বা প্রেমের খেলাও চলছে। তার কোনও দুর্নাম নেই। অথচ হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর ছিল। শহরের যুবকেরা হয় তো অমিতাকে নিয়ে অনেক কথা বলে, বলতে ভালবাসে। কখনও কখনও বা সীমাও ছাড়ায় হয় তো। তথাপি আজ পর্যন্ত কেউ মন্দ বা সন্দেহজনক কিছু দেখেনি, শোনেনি। তারপরেও যদি কোনও লুকানো গোপন প্রেম থেকে থাকে, সে কথা আলাদা।
সংসারে কিছুই অসম্ভব নয়। প্রদ্যোৎকে ভালবেসে বিয়ে করেও, মনোজগতে আর কাউকে নিয়ে একটা বিপর্যয় ঘটে যাওয়া কিছুমাত্র আশ্চর্যের নয়। এ ক্ষেত্রে, স্বামী ও প্রেমিকদের ঈর্ষা, একটা সর্বনাশ ঘটাতে পারে। অথবা প্রেমিকা নিজেই আত্মবিসর্জন দিতে পারে। কিন্তু অমিতাদির ক্ষেত্রে, এ সব বিশ্বাস করতে মন চায় না।
অন্যদিকে, প্রদ্যোৎ নিজেও, সুপুরুষ, অমায়িক, মেয়েদের কাছে প্রিয় ডাক্তার। প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার তো বটেই। তার বিষয়ে, শহরের মেয়েদের ঔৎসুক্য কম নয়। কিন্তু প্রদ্যোৎ মেয়েদের সম্পর্কে খুব দুর্বল, এরকম কেউ কিছু শোনেনি। মেয়েদের উৎসাহ, ঔৎসুক্যের জন্য প্রদ্যোৎ শহরের যুবকদের কিছুটা ঈর্ষারই পাত্র। যে কারণে, তার নামে, ছেলেরা অনেক সময়েই, অনেক ইতর কথাবার্তা বলে থাকে। কোনও মেয়ের সঙ্গে নাম জড়িয়ে, বাজারে একটু গল্প ছেড়ে দিতে পারলে, কেউ কেউ বেশ খুশি। কিন্তু সে সবই, ভেজাল গল্প এবং প্রমাণহীন।
প্রদ্যোতের বিষয়ে, অমিতার কাছ থেকেও কেউ কখনও বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ শোনেনি। এমন কোনও মেয়েঘটিত ব্যাপার ঘটেনি বা জানাজানি হয়নি, যে কারণে, অমিতা আত্মহত্যা করে, মনের এবং জীবনের জ্বালা জুড়োতে পারে। এ ক্ষেত্রে, হারাবার থেকে মেয়েদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা, আর কমপ্লেকস অনেক সময় বেশি মানসিক যন্ত্রণা সৃষ্টি করে। ঈর্ষা তো থাকেই। তার যন্ত্রণাও কম নয়। অথবা, স্বামীও, পথের কাঁটা সরাবার জন্যে, স্ত্রীকে খুন করতে পারে। প্রদ্যোতের দিক থেকে, সেরকম প্রেমের ঘটনা থাকলে, কিছুটা কানাঘুষা নিশ্চয়ই হত। কিছু না কিছু আগেই জানাজানি হত। বিশেষত যার নামে, ছেলেরা কিছু বলতে পারলেই খুশি।
অনেক মেয়ের সম্পর্কেই, অনেক কিছু শোনা যায় প্রদ্যোতের নামে। স্কুল মিস্ট্রেস থেকে, অনেক পরিবারে মেয়ে বউদের সম্পর্কেও। যে সব মেয়েরা, কোনও না কোনও ভাবে, প্রদ্যোতের চিকিৎসাধীনে এসেছে, তাদের অনেককে নিয়েই কিছু কিছু রটনা শহরে আছে। সে সব রটনার কোনও মূল্য দিতে গেলে চলে না।
প্রথমত, অমিতার কাছ থেকে কেউ কখনও কোনও অভিযোগ শোনেনি। দ্বিতীয়ত, অভিযোগ কিছু থাকলে, অমিতার পিত্রালয়ে, সে সংবাদ গোপন থাকত না, এবং তারাই ব্যাপারটা প্রকাশ করে ফেলত। তৃতীয়ত, প্রদ্যোতের জীবনযাপনের মধ্যে, বিশেষ কোনও অস্বাভাবিকতা বা অসংলগ্নতা লক্ষিত হয়নি। তা হলে কী ঘটতে পারে?
অশোক থানা থেকে বেরিয়ে পথ চলতে চলতে, এ সবই ভাবছিল। ওর মনের মধ্যে, ইতিমধ্যে একটা দৃঢ় সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছে, এটা আত্মহত্যার ঘটনা নয়। বিকেল পাঁচটায় অমিতাদির মতো মেয়ে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে, রেলে মাথা দিতে যাবে বা গঙ্গায় ডুবতে যাবে, ভাবতে অসুবিধা লাগে। এত বেশি পরিচিত লোকের এবং প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে যে, চুপি চুপি নিঃসাড়ে কাজ সারা সম্ভবই নয়। ইতিমধ্যেই অনেকেই তা হলে বলত, তারা অমিতাকে দেখেছে কি না। কিন্তু এখন পর্যন্ত, এই ষোলো ঘণ্টার মধ্যে এমন একজনকে পাওয়া যায়নি, যে তাকে দেখেছে। ডাক্তারের স্ত্রী অমিতাদি। আত্মহত্যা করার ইচ্ছা থাকলে, বাড়িতেই বিষ সংগ্রহ করা কিছু কঠিন ব্যাপার ছিল না। বোকা সোকা অশিক্ষিত মেয়েও না। কোনটা প্রাণঘাতী বিষ, তা বেছে নেওয়া কষ্টকর নয়।
আত্মহত্যা করলে, হয় নিজের বাড়িতে, না হয়, বাপের বাড়িতে গিয়ে করত। বিষ না খেয়ে, গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যাও, বাইরে গিয়ে হয় না। কিন্তু অমিতা বাইরে গিয়েছিল, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ঝি তাই বলেছে। ঝিয়ের কথা কতখানি বিশ্বাসযোগ্য, সেটা বিবেচ্য, সন্দেহ নেই। কিন্তু কোথাও কিছু নেই, সে হঠাৎ মিথ্যে কথাই বা বলতে যাবে কেন।
তবে এটাও ঠিক, ষোলো ঘণ্টা নিখোঁজ থাকা, কোনও কাজের কথাই নয়। বিশেষ, সারারাত্রি বাড়িতে অনুপস্থিত থাকা, একটা সংকেতকেই স্পষ্ট করে তোলে, অমিতা বেঁচে নেই। থাকলেও, বিস্ময়করভাবে কোথাও আত্মগোপন করে আছে।
প্রেমিকের সঙ্গে, গোপনে গৃহত্যাগের কথা ভাবা যায় কি? অশোকের হাসি পেয়ে গেল। অসম্ভব। অমিতাদিকে দিয়ে এটা যেন ঠিক ভাবা যায় না। তা হলে, শহরের কোনও যুবকেরও নিখোঁজ হবার সংবাদ পাওয়া যেত। তাও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। যে দু চারজনের নিখোঁজ হবার সংবাদ রয়েছে, তারা সবাই কলকারখানার শ্রমিক। ধরে নেওয়া যেতে পারে, শহরের দাঙ্গায় তারা হয় তো নিহত হয়েছে। তাদের লাশ হয়তো, কোথাও এদিকে ওদিকে জলা জংলা, গভীর নর্দমা বা গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেগুলো খুঁজে বের করা যাবে। গঙ্গায় মৃতদেহ ভেসে উঠবেই। অন্যত্র, দুর্গন্ধেই খোঁজ পাওয়া যাবে। কিন্তু, তাঁরা কেউই অমিতার প্রেমের পাত্র হবার মতো মানুষ নয়। অমিতাও তাদের প্রেমিকা হবার কথা চিন্তা করতে পারে না।
মনের এমন ভারসাম্য হারানোর অবস্থা হয়েছিল কি, যাতে একটা প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে, বিমূঢ় বিভ্রান্ত হয়ে, কোথাও বেরিয়ে গিয়েছে? সেরকম ঘটনাও বিরল নয়। কিন্তু তা হলেও লোকের চোখে পড়ত। মফস্বলের এই ঘিঞ্জি শহরে, রাস্তায় বা পাড়ায়, কারুর না কারুর চোখে পড়তেই হবে। রাত্রির অন্ধকার হলেও একটা কথা ছিল। বেলা পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটায় সবখানে লোকের ভিড়। বিশেষ, শহরের দাঙ্গার পরিস্থিতি নিয়ে এখন তো মোড়ে মোড়ে জটলা। অতএব
অশোক।
অশোক দাঁড়াল। ফিরে দেখল, ওদেরই পাড়ার একটি ছেলে, চায়ের দোকান থেকে ডাকছে। কিন্তু চা খাবার মতো মনের অবস্থা এখন ওর নয়। চায়ের দোকানে বসে, আড্ডা দিতেও ভাল লাগছে না। বন্ধু জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছিস?
এমনি একটু ঘুরছি।
বন্ধু বেরিয়ে এল, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ঘুরছিস, তা তো বুঝতে পারছি, এদিকে কোথায় যাচ্ছিস? এদিকে গোলমাল জানিস না?
অশোক যেন এতক্ষণে চোখ তুলে দেখল, ও কোথায় এসে পড়েছে। ওদের বাড়ির ঠিক উলটো দিকে এসে পড়েছে। সামনে একটা রেলওয়ে সাইডিং। সেটা পেরিয়ে গেলেই, সম্পূর্ণ অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকা। অশোক দেখল, সাইডিং-এর সামনেই, একটা পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক হাত দূরে দূরেই, সশস্ত্র পুলিশ টহল দিচ্ছে। এই দিনের বেলায় আর কোনও ভয়ই প্রায়ই নেই।
তথাপি, কী আশ্চর্য, কারখানার রেলওয়ে সাইডিং লাইন যেন, দুটো শত্রু রাজ্যের সীমানা হয়ে উঠেছে। এদিকের লোক ওদিকে যাচ্ছে না। ওদিকের লোক এদিকে আসছে না। অথচ দুদিন আগেও এটা কোনও সীমারেখাই ছিল না। দুদিন বাদে, আর থাকবেও না। কিন্তু মাঝখান থেকে, কিছু নিরীহ মানুষের প্রাণ গেল। আর তার জন্য, কাউকেই কোনও জবাবদিহি করতে হবে না। আবার সবই ঠিক হয়ে যাবে। যাতায়াত শুরু হবে। কলকারখানা পূর্ণোদ্যমে চলবে। কতদিন আর মানুষ রুজিরোজগার ছেড়ে থাকবে।
অশোকের মনে হল, সাইডিং পেরিয়ে গিয়েই দেখা যাক না, কী হয়। বড় রাস্তা, ভিতরের অলিগলিতে লোক চলাচল আছে, যদিও সীমারেখা একটা আছে। তথাপি, ভিতর দিকে, এমন জায়গাও আছে, যেখানে গরিব বাঙালি অবাঙালি পাশাপাশি বস্তিতে রয়েছে। কিছু কিছু গোলমাল সে সব জায়গায় যে ঘটেনি, তা নয়। তবু তারা বাস করছে। আর এখন দিনের বেলা, কয়েক হাত অন্তর অন্তর সশস্ত্র পুলিশ, এর মধ্যে আর কী ঘটতে পারে। নিশ্চয়ই তাকে এসে কেউ, পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেবে না। দেবেই বা কে, সবই তো প্রায় চেনা মুখ। একমাত্র বাইরের ভাড়াটে লোক যারা এসেছে, তারাই চোরাগোপ্তা ছুরি চালাবার ফিকিরে আছে। তবে সেটা দিনের বেলা সম্ভব নয়।
অশোক একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, যাই, ওদিকটা দেখে আসি একটু।
বন্ধু অবাক আর উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, একটা বিপদ আপদ ঘটাবি দেখছি।
অশোক হাত তুলে, বন্ধুকে নিরস্ত করে আর সান্ত্বনা দিয়ে, সাইডিং পেরিয়ে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই, দুপাশের দোকানদার, রকে বসে থাকা লোকেরা ওর দিকে তাকিয়ে দেখল। সকলের চোখেই একটা সন্দেহ আর অবিশ্বাস। কিন্তু অশোক পরিচিত অবাঙালি দু-একজনকে ডেকে কথাও বলল। তারাও জবাব দিল। মিশির পানওয়ালা বলল, গোলমালের ভিতরে কেনো বাবা আবার ইধার এসেছ। শালা খুনি বদমাইশরা কী একটা গোলমাল করিয়ে দেবে, ঘর লৌট যাও।
অশোক বলল, তোমরা আছ কী করতে? বাঁচাতে পারবে না?
মিশির বলল, আরে শালা ডাকুলোগ, হামলোগকো জানে খতম করনে সাকতা হ্যায়। উ বদমাশ লোগকো উপর কুছ ভরসা হ্যায়?
একজন টহলদার সশস্ত্র সেপাই, ওদের দুজনের দিকেই তাকিয়ে দেখল। তারপর রাইফেলটা দেখিয়ে বলল, কুছ গোলমাল হোেগা তো, গোলি চালয়েগা। এয়সা অর্ডার হ্যায় হামে পর।
অশোক একটু হেসে এগিয়ে গেল। কেন এল ও এদিকে? একেবারেই উদ্দেশ্যহীন ভাবে কি? তা নয়। যদি এ তল্লাটে, অমিতাদির সম্পর্কে কোনও কথাবার্তা শোনা যায়। হয়তো, এই সীমানার কেউ অমিতাদিকে দেখে থাকতে পারে। যদিও, একেবারেই অসম্ভব। এ পরিস্থিতিতে, অমিতাকে এ তল্লাটে ভাবাই যায় না। স্বাভাবিক অবস্থাতেই যাকে, এ অঞ্চলে কেউ প্রায় দেখতে পায় না, সে যে হেঁটে বা সাইকেল রিকশায় এদিকে আসবে সেটাও সম্ভব নয়। আসার কোনও কারণ নেই।
কিন্তু কিছুই বলা যায় না। সন্ধ্যা সাতটার পরে, প্রদ্যোৎ রোজ এই তল্লাটে আসে। সাড়ে আটটা অবধি, বিরিজের ওষুধের দোকানে রুগি দেখে। কোনও কারণে, অমিতাদি কি, বিরিজের দোকানে প্রদ্যোৎদার সঙ্গে দেখা করতে আসতে চেয়েছিল? সম্ভব বলে মনে হয় না। এ পরিস্থিতিতে, নিশ্চয়ই আসত না। ৬৬২
আচ্ছা, এমনও হতে পারে, অমিতা গঙ্গার ধারে গিয়েছিল। নির্জন গঙ্গার ধার। সেখান থেকে অপহৃত হয়েছে হয়তো। গঙ্গার ধারে, একটা অংশে, অবাঙালিদের আস্তানা। মুণ্ডেশ্বরের নিরালা ঘাট থেকে, সন্ধ্যার ঝোঁকে একটি সুন্দরী যুবতাঁকে যদি কেউ বা কেউ কেউ মুখে চাপা দিয়ে তুলে নিয়ে যায়, টের নাও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু, সেই তো ঘুরে ফিরে এক কথা। গঙ্গার ধারে অমিতাদি গিয়েছিল কি? গেলে, কেউ কি দেখতে পেত না? এই ছোট মফস্বল শহর, প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। মুখটাও অন্তত চেনে।
বিরিজের ওষুধের দোকানের কাছে আসতেই, বিরিজ একেবারে ধমক দিয়ে ওঠেন অশোককে, কেয়া বাত অশোক, তুম ইধার কাঁহা যা রহে?
বিরিজমোহন গুপ্ত, পুরনোদিনের লোক। অশোকদের ছেলেবেলা থেকেই দেখছেন। নিজেদেরও দু তিন পুরুষের বাস এখানে। অশোকরা বিরিজ চাচা বলে। বিরিজমোহনও চাচার মতোই সব ছেলেদের দেখেন।
অশোক বলল, এই একটু ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম।
বিরিজ পরিষ্কার বাংলায় বলেন, ইয়ার্কি! জান না, কী হচ্ছে? যাও, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাও।
রাস্তায় এত পুলিশ রয়েছে তো।
থাক, পুলিশ সব করবে। তুমি বাড়ি যাও তো।
অশোক বলল, জানেন তো, প্রদ্যোৎদার স্ত্রী অমিতাদিকে কাল বিকেল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।
বিরিজ চমকে উঠে, নিজের ভাষায় বলে উঠলেন, কেয়া বাত কাল রাত মে সাড়ে আট বাজেতো প্রদ্যোৎ হিয়াঁসে ঘর গয়া। কুছ তো নহি বাতায়া?
প্রদ্যোৎদা তখনও জানতেন না। অমিতাদি পাঁচটার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। এখান থেকে ফিরে গিয়ে, বাড়ি থেকে পুলিশকে টেলিফোন করে জানিয়েছেন।
বিরিজের মুখ উদ্বেগে অন্ধকার হয়ে উঠল। বললেন, এ তো বড় তাজ্জব ব্যাপার। এখন পর্যন্ত কোনও খবর পাওয়া যায়নি? দেখি তো।
বলেই তিনি প্রদ্যোতের বাড়ি টেলিফোন করলেন। টেলিফোনের কথা শুনে বোঝা গেল, অমিতাদির মায়ের সঙ্গে, বিরিজের কথা হল। প্রদ্যোৎদা থানা থেকে বাড়ি ফেরেননি। অমিতার কোনও সংবাদই নেই। রিসিভার রেখে দিয়ে, বিরিজ বলে ওঠেন, রাম রাম, এ কেয়া মুসিবৎ! লেড়কি কাঁহা যা সাকতি? সায়েদ ডাক্তার তো পাগল হো গয়া ইস টাইম মে।
অশোক বিরিজের দোকানের সামনে থেকে পা বাড়াবার আগেই, বিরিজ আবার ধমকে ওঠেন, এই অশোক, ফির কোথায় যাচ্ছ? ঘরে যাও জলদি।
অশোক বলল, এবার চলে যাব চাচা।
তোমার কী কাজ এখন এখানে? তুমি ফিরে না গেলে, তোমার ঘাড় ধরে দিয়ে আসব।
অশোক দেখল, আর উপায় নেই। ও হেসে আবার ফিরে চলল। যদিও, এত সশস্ত্র পুলিশ রয়েছে, দুর্ঘটনার কোনও সম্ভাবনাই নেই। তথাপি, সকলের উদ্বেগের একটা মূল্য আছে। অবাধ্য না হওয়াই উচিত।
খানিকটা যেতেই, চায়ের দোকান থেকে কাল্লু বেরিয়ে এল। কাল্লু গুণ্ডা, যে কিছুক্ষণ আগেই থানায় ছিল, সে এগিয়ে এল অশোকের দিকে, বলল, কাঁহা আয়া অশোকবাবু?
এদিকেই এসেছিলাম। কেন বাবা, মারবে টারবে নাকি?
কাল্লু কপালে হাত ঠেকিয়ে হেসে বলল, হায় রাম, ক্যা বাতাতে অশোকবাবু। আপ লোগকো সাথ উসব কুছ নহি। হামলোগ ইসমে নেই। ইয়ে দাঙ্গা বড়া বড়া রহিস্ আদমিলোেগকো কাম হ্যায়, আপ তো জানতেই হ্যায়। পয়সা মিলনে সে কাম করে গা মগর আপলোগকো বদন পর হাত নহি উঠায়েগা।
অশোক বলল, জান তো, ডাক্তার প্রদ্যোৎ রায়ের বউকে কাল বিকেল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।
কাল্লুর মুখের পরিবর্তন হল। ধূর্ত শিয়ালের মতো সে একবার এদিক ওদিক তাকাল। অশোক যেন মাংসের গন্ধ পাওয়া বাঘের মতো, চকিতে উৎকর্ণ আর সচেতন হয়ে উঠল। ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কাল্লুর দিকে তাকাল। কাল্লু চুপিচুপি বলল, উসি বাত তো আপকো বাতানে মাঙতা। মগর, খবরদার, হাম সে কুছ শুনা, মত কহিয়ে, নাহি তো হামকো পুলিশ পাকাড় লেগা।
অশোকের দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ হল। রক্তে উত্তেজনা। জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?
কাল্লু বলল, আপ তো জানতে হ্যায়, হাম কুছ খবর বাতায়েঙ্গে, পুলিশ সমঝেগা, উ মেরা কাম।
অশোক অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি বলো না, কী বলতে যাচ্ছিলে?
মগর মেরা নাম কভি নহি বাতাইয়েগা?
না। তুমি বলো কী বলতে যাচ্ছিলে।
কাল্লু একবার পিছন ফিরে চায়ের দোকানের দিক দেখে নিল। তারপরে বলল, সামনে যো চটকল হ্যায়, যিসকো বগল সে গঙ্গা কিনারমে রাস্তা চলা গয়া, উসি রাস্তাকে গহেরা মুহরি মে, এক অওরত কো হম দেখা।
অশোক চমকে উঠল। চটকলের ধার দিয়ে গঙ্গার ধারে যাবার রাস্তায়, গভীর নর্দমায় মেয়েমানুষ? তার বুকের মধ্যে কী রকম ধক ধক করতে লাগল। জিজ্ঞেস করল, মরে গেছে?
কাল্লু অবাক হয়ে বলল, কেয়া তাজ্জব বাত করতে আপ অশোকবাবু। উতনা গহেরা মুহরি মে অওরত কভি জিন্দা রহনে সকতি? উ এক অওরত কি ডেড বডি। কৌন জানে, কেয়া বাত হ্যায়, কৌন উসকো মারা। মুঝে মালুম হোতা, অওরত বাঙালি হ্যায়। দেখনে সে ওইসাই মালুম হোতা।
অশোক আর এক মুহূর্ত দাঁড়াতে পারল না। কিন্তু এটা কী রকম আশ্চর্য ব্যাপার, তার কানেই কথাটা এল? সে নিজের কাছেই যেন ব্যাখ্যা করতে পারে না, কেন সে এই তল্লাটে এসেছিল। কী ভেবে, একটা দৈব বিপদের ঝুঁকি নিয়ে, এরকম উত্তেজিত থমথমে দাঙ্গার পরিবেশে এসে পড়েছিল। এখনও পর্যন্ত যেন সে নিজের কাছে, নিজেই কোনও যুক্তি দাঁড় করাতে পারে না। ওর ভিতরে একটা অবুঝ অব্যক্ত মন ওকে টেনে নিয়ে এসেছিল।
কিন্তু কাল্লু কার মৃতদেহ দেখেছে মিলের রাস্তায়? বলছে, মৃতদেহ দেখে তার বাঙালি মেয়ে বলে সন্দেহ হয়েছে। অমিতাদির মৃতদেহ কি? অশোকের দৃঢ় বিশ্বাস, বাঙালি মেয়ের মৃতদেহ হলে, অমিতাদিরই নিশ্চয়। তার মনটা বারে বারেই বলছিল, অমিতাদির অন্তর্ধান এমন অস্বাভাবিক আর আশ্চর্যজনক, গতকাল বিকেল পাঁচটা থেকে এ পর্যন্ত কোনও সংবাদ না দিয়ে, একেবারে চুপ করে থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। হয় জীবিত না হয় মৃত, যে কোনও অবস্থাতেই, অমিতাদিকে গুম করা হয়েছে। কে করেছে, কী ভাবে করা হয়েছে, সেটা পরে বিচার্য। শহরের এই বর্তমান পরিস্থিতিতে, কিছুই অসম্ভব নয়।
তথাপি, মনের মধ্যে একটা, বাঁকা ধরনের কাঁটা যেন অশোকের মনের মধ্যে বিধে রইল। খচখচ করতে লাগল। কারণ যেখানে কাল্লু বাঙালি মেয়ের মৃতদেহ দেখেছে, সেই রাস্তা বেশ খানিকটা নির্জন। দু পাশেই জেলখানার মতো কারখানার পাঁচিল একেবারে গঙ্গার ধার অবধি চলে গিয়েছে। রাস্তাটায় কোনও দোকান বা গৃহস্থের বাড়ি ঘর নেই। একমাত্র গঙ্গার ধারে কারখানার কুঠিতে যাবার জন্য রাস্তাটা সাহেব অফিসারদেরই বলা চলে। তাও পায়ে হেঁটে নয়। মোটরের যাতায়াতই বেশি।
কিন্তু রাস্তাটা অবাঙালি এলাকার মধ্যেই পড়ে। রাস্তাটার পরে, একটা গোটা চটকল ডিঙিয়ে, রেলওয়ে সাইডিং-এর ওপারে বাঙালি এলাকা। এমন রাস্তায় অমিতা কি শহরের এই পরিস্থিতিতে আসতে পারে! মৃতদেহ যদি অমিতাদির নাও হয়, অন্য বাঙালি মেয়েরও হয়, তার পক্ষেই বা এ এলাকায় হঠাৎ আসা সম্ভব কী করে। বাঙালি পুরুষরাই যে তল্লাটে আসছে না, সেখানে কোনও মেয়ের পক্ষে আসা একেবারেই অসম্ভব।
তা হলে কি এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল?
কিছুই বলা যায় না। আগে দেখা যাক মৃতদেহ সত্যি আছে কি না, এবং এমনি চোখে দেখে চেনা যায় কি না, কার মৃতদেহ। অবিশ্যি কাল্লুর মতো গুণ্ডাদের বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। এরকম একটা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে, কাছাকাছি কোথাও থেকে, সুযোগ বুঝে, একটা মেয়েকে ধরে নিয়ে এসেছে, রাত্রের অন্ধকারে এই নির্জন রাস্তায়। যা ইচ্ছে তা-ই করে, নর্দমায় ফেলে দেওয়া কিছুমাত্র অসম্ভব নয়। তার ওপরে, সেই মেয়েটির গায়ে যদি থাকে কিছু সোনার অলংকার, তা হলে তো কথাই নেই।
কাল্লুর বলে দেবার পিছনে, ওদের দলগত প্রতিশোধের ব্যাপার থাকতে পারে। পাওয়ানা গণ্ডার ব্যাপারে বিবাদ হতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে, যেচে এসে একটা মৃতদেহের সংবাদ দেবার মতো সততা কি ওদের আছে। কে জানে, বিশ্বাস হয় না।
রাস্তায় দিনের বেলা কারফিউ নেই। সন্ধে ছটা থেকে আছে। তবু জনসন রোডের নিরালায় ঢুকতে অশোকেরও একটু দ্বিধা হল। মিলেরই কোনও সাহেবের নামে রাস্তাটার নামকরণ হয়েছে। হয়তো জনসন সাহেব, এখানকার পৌরসভার কোনও একসময় চেয়ারম্যান হয়েছিল। আগের যুগে, এইসব চটকল শহরে, পৌরপ্রধান, সাহেবরাই হত। এবং এইসব চটকল কারখানা না থাকলে, এত আগে এরকম জায়গায় পৌরসভা স্থাপিত হত না।
রাস্তাটাকে দেখলেই মনে হয় হঠাৎ কোনও বিদেশের নিরালা রাস্তায় এসে পড়েছি। দু পাশের উঁচু পাঁচিলের জন্য একটা বদ্ধভাবও আছে। তবু নির্জন। ধারে ধারে গোটা কয়েক গাছ, একপাশে গভীর নর্দমা। নর্দমাটা বাঁধানো, এবং লোকজন না থাকায়, কোনওরকমে নোংরা করতে পারে না।
গভীর নর্দমার ধার ঘেঁষে ঘেঁষেই অশোক এগিয়ে চলল। কোনও গাছের আড়ালে, কেউ যদি লুকিয়ে থাকে, তা হলে, কোথাও ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়বার কোনও জায়গা নেই। নর্মদার গায়ে এবং অন্যদিকে, উঁচু পাঁচিলে মাথা কুটতে হবে। চিৎকার করলেও কেউ শুনতে পাবে না। পাঁচিলের ভিতরে কারখানা। সেখানে আজ সবই নীরব। কেউ কাজে আসেনি। কাজে এলেও, যন্ত্র চললে, কিছুই শোনা যায় না।
রাস্তাটা গঙ্গার ধারে যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে রাস্তার দু দিকেই দুটো বড় বড় গেট। গঙ্গার ধার জুড়ে সুন্দর বাগান, বড় চাকুরেদের কুঠি, মনোরম পরিবেশ। সেখানে গেটে দরোয়ান আছে। কিন্তু বড় রাস্তা থেকে গঙ্গার ধারের দূরত্ব প্রায় আধ মাইল। অর্থাৎ জনসন রোড দৈর্ঘ্যে প্রায় আধ মাইল।
তথাপি, কানে যখন একবার শুনেছে, অশোক একবার শেষ পর্যন্ত যাবে নর্দমা দেখতে দেখতে। তার মন বলছে, কাল্লু মিথ্যে কথা বলেনি। তার মন, এমনি ভাবেই বলেছিল, এ তল্লাটে একবার আসা উচিত। হয়তো অমিতাদির কোনও খবর পাওয়া যেতে পারে। কারণ দুটো সীমানা এতই আলাদা হয়ে গিয়েছে এখন, এপার ওপারের কোনও সংবাদই পাওয়া যাচ্ছে না।
জনসন রোডের প্রায় মাঝামাঝি গিয়ে, অশোকের নাকে একটা দুর্গন্ধ ঢুকল। কোনও কিছু মরা পচারই গন্ধ। আরও কয়েক পা গিয়েই, থমকে দাঁড়াল সে। কাল্লু মিথ্যে বলেনি, নর্দমায় মৃতদেহ। জল খুব বেশি নেই। ধুলো পড়ে পড়ে, কাদাও কিছুটা জমেছে। হয়তো, মৃতদেহ বড় রাস্তার আরও কাছের থেকেই ফেলা হয়েছিল। ময়লা জলের চাপে, আরও এদিকে এগিয়ে এসেছে। বর্ষাকাল হলে, এ মৃতদেহ এতক্ষণে হয় তো গঙ্গায় গিয়ে পড়ত। কারণ নর্দমাটা গঙ্গায় গিয়ে পড়েছে।
প্রায় মানুষ ভোবা নর্দমা। অশোক উঁকি দিল। কোনও মেয়েরই মৃতদেহ, সন্দেহ নেই। ফুলে ওঠা লাল মুখে ময়লা লাগলেও, রংটা যে ফরসা ছিল বোঝা যায়। এবং এ আর কেউ নয়, অমিতাদি। দেখা মাত্রই চিনতে পারল অশোক, অমিতাদি। যতই ফুলে উঠুক, এ মুখ ভোলবার নয়। ছেলেবেলা থেকে দেখা। মাথার চুল এলোমেলো জলে কাদায় ভেজা হলেও, সিথির সামনের দিকে সিদুরের দাগ রয়েছে। হঠাৎ মনে হয়, দাঁত দিয়ে যেন নীচের ঠোঁট চেপে রয়েছে। আসলে তা নয়। ঠোঁট দুটো খোলা, মুখও খোলা। হাঁ করা নেই, সামনের দাঁতগুলোই কেবল দেখা যাচ্ছে। সামনের পাটির দাঁতের গঠন দেখলেই চেনা যায়, এ অমিতা রায়, ডক্টর প্রদ্যোৎ রায়ের স্ত্রী।
কাল বিকেল পাঁচটা থেকে, অমিতার মতো মেয়ের বাড়ি থেকে অন্তর্ধান মানেই, এ পরিণতি ছাড়া, আর কিছু ঘটা সম্ভব ছিল না। এবং এটা একটা খুন। এ খুন ছাড়া আর কিছু না। যে ভাবেই হোক, যে-ই করুক।
অমিতাদির গায়ে রয়েছে, আকাশি রঙের টেরিকটের কাঁধের কাছে লুজ হাতা জামা। ঢাকাই শাড়িটা অনেকখানিই ভোলা। লেস লাগানো সায়া, অনেকখানিই তোলা, প্রায় জঙ্ঘার কাছাকাছি। জামাটা বুকের কাছে, দু-এক জায়গায় ছেঁড়া, বিশেষ করে বোতামের কাছে। বোতামও একটার বেশি লাগানো নেই। ব্রেসিয়ারটা জামার তলা দিয়ে, নাভিস্থলের কাছে পড়েছে। মনে হয়, একদিকের কাঁধে এখনও ব্রেসিয়ারের একটা দিক আটকানো, আর একটা দিক একদম টেনে খুলে ফেলা হয়েছে। দু পাশের বুক সবটাই প্রায় খোলা। দুটো হাত, দুদিকে এলিয়ে পড়ে আছে, একটা পা একটু বাঁকানো। শরীরে কোনও অলংকার নেই। এমনকী, সধবার লোহাও নেই।
মেয়েদের কেন সন্তান হয় না, এ সব অশোকের কিছু জানা নেই। কিন্তু অমিতাদি বরাবরই স্বাস্থ্যবতী এবং সুন্দর। ফুলে ওঠা শরীরটা দেখলে, এখনও তা বোঝা যায়। একেবারে বিকৃত হয়ে যায়নি। এখন, ঘোলা চোখের চাহনি দেখলে, গায়ে কাঁটা লাগে। স্থির, অপলক, একটা যেন বিস্ময়ের ভাব। কিন্তু চোখ দুটি আয়ত, চাউনি সুন্দর ছিল। নাক চোখ মুখ বেশ ভালই ছিল।
অশোক যা দেখবার, দেখে ফিরে চলল। কী করে অমিতাদি এখানে এল? শহরের এ পরিস্থিতিতে কি তার পক্ষে এ তল্লাটে আসা সম্ভব ছিল? ছিল না। একেবারেই ছিল না। জীবিত বা মৃত, তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল। কে বা কারা নিয়ে এল? কেমন করে? উদ্দেশ্য?
একটা সহজ উদ্দেশ্য, একজন সুন্দরী যুবতাঁকে জোর করে ভোগ করা। তারপরে, ধরা পড়ার ভয়ে, খুন করা। করে, এমন কোনও জায়গায় ফেলে দেওয়া, যাতে হঠাৎ লোকের চোখে না পড়ে। এবং এই দাঙ্গার পরিস্থিতিতে, কোনও এক জায়গা থেকে হয়তো, অমিতাদিকে কেউ বা কেউ কেউ জোর করে কোথাও ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
যেখানে মুখোমুখি দাঙ্গা হচ্ছে না, চোরাগোপ্তা খুন চলছে, সেখানে খুনি দাঙ্গাবাজদের পক্ষে, এরকম করাটা খুব আশ্চর্যের নয়। কিন্তু কোথা থেকে ধরে নিয়ে আসতে পারে অমিতাদিকে? কিংবা, অমিতাদির প্রেমিক প্রতিদ্বন্দ্বীরাই, কেউ সুযোগ গ্রহণ করেছে? অনেকেই তো, অমিতার জন্য পাগল ছিল। শহরের অনেক যুবকের কাছেই, অমিতাদি ছিল, প্রার্থিতা। তাদের মধ্যে কোনওরকম গোপন রেষারেষির ফল কি এই বিনাশ?
কে জানে। বড় রাস্তায় এসে, প্রথমেই অশোকের মনে হল, থানায় শ্যামাচরণকে একটা খবর এখনই দেওয়া দরকার। কিন্তু লোকটা একে গোঁয়ার, তায় বোকা। ঘটনা শুনে এমন সব আজেবাজে কথা বলতে আরম্ভ করে দেবে, অশোকের মেজাজটাই যাবে খারাপ হয়ে।
তা হোক, তবু খবর একটা এখুনি দেওয়া দরকার। সামনেই রয়েছে আগরওয়ালার কাপড়ের দোকান। সেখানে টেলিফোন আছে। কিন্তু সেখান থেকে টেলিফোন করাটা বোধ হয় ঠিক হবে না। ওরা ভুল বুঝতে পারে অশোককে। ভাবতে পারে, অবাঙালিদের বিরুদ্ধে সে একটা গোলমাল বাধাবার চেষ্টা করছে। কুণ্ডুদের রঙের দোকানের আধখানা খোলা আছে, পুরোটা নয়। ওদেরও টেলিফোন আছে, ওখানেই বরং যাওয়া যাক। ওরাও অবিশ্যি খানিকটা ভয় পাবে, একটু টেনশনও হতে পারে। তা হোক, অশোককে ভুল বোঝবার কোনও কারণ থাকবে না।
অশোক কুণ্ডুদের দোকানেই গেল। বুড়ো কর্তা একলা বসে। দুজন কুলি চুপচাপ শুয়ে আছে, এক পাশের মেঝেয়। তাদের কিছুই করবার নেই। দোকানদারি ব্যবসা সবই বন্ধ। অশোক বলল, থানায়। একটা টেলিফোন করব?
কুণ্ডু কর্তা ভয় পেয়ে বললেন, কেন, কী হয়েছে?
অশোক বলল, অমিতাদি, ডাক্তার প্রদ্যোৎ রায় প্রদ্যোৎদার বউয়ের ডেডবডি জনসন রোডের নর্দমায় দেখে এলাম, তাই একটা খবর দিয়ে দিই।
সর্বনাশ! তাই নাকি? কবে হল, কারা করল?
তা জানি না। গতকাল বিকেলে পাঁচটায় অমিতাদি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। তারপরে আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ফোনের রিসিভারটা তুলে, ম্যানুয়েল লাইনে, অশোক থানার নম্বর বলল। রিং হল। কথা শোনা গেল, থানা।
ও. সি. আছেন?
বলছি। কে আপনি?
আমি স্মার্তপাড়ার ঠাকুরবাড়ির
যথেষ্ট হয়েছে। হুমকানি ভেসে এল, কী বলছ বলো।
অমিতাদির ডেডবডিটা দেখলাম।
হোয়াট?
এটাই আশা করেছিল অশোক। একটা প্রচণ্ড সন্দিগ্ধ গলায় চিৎকার। কিন্তু ও শান্ত ভাবেই বলল, অমিতাদি, মানে প্রদ্যোৎদার।
কোথায় দেখলে?
জনসন রোডের নর্দমায়।
কে কে দেখেছে?
আমি–মানে, আমি একলাই।
তুমি একলা?
সন্দেহের কুটিলতা টেলিফোনের তারেও ভেসে এল, কেন গিয়েছিলে তুমি জনসন রোডে।
অশোক একবার একটু ঢোক গিলল, বলল, মানে, এমনি।
এমনি?
বাঘের গর গর গর্জনের মতো শোনাল শ্যামাচরণের গলা। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, এমনি এমনি জনসন রোডে গেলে? থানা থেকে শুনে গেলে, অমিতা রায় বাড়ি পৌঁছয়নি রাত্রে, আর নর্দমায় তুমিই একমাত্র দেখতে পেলে, সে সেখানে মরে পড়ে আছে, না?
অশোক জিজ্ঞাসা করল, তার মানে?
মনে হল, শ্যামাচরণ দাঁতে দাঁত পিষছে। জবাব এল, তার মানে, চিড়িয়া রোজ রোজই ছোলা খেয়ে খেয়ে পালায়। কিন্তু সে ঘুঘু দেখেছে, ফাঁদ দেখেনি। এবার আমি সেই ফাঁদটা দেখিয়ে ছাড়ছি।
অশোক জানত, লোকটা ঠিক এইরকম ভাবে কথা বলবে। হাসিও পায়, বিরক্তিও লাগে। বলল, কী যে ছাই বলছেন, কিছুই বুঝতে পারছি না।
বোঝাব আমি তোমাকে সেটা। তুমি এই দাঙ্গার মধ্যে ও তল্লাটে গেলে কেন?
শ্যামাচরণ আবার হুমকে উঠল! অশোক বলল, এমনি ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছিলাম।
কোথায় থেকে ফোন করছ?
কুণ্ডু পেন্টিং শপ।
তুমি ওখানেই থাকবে, কোথাও যাবে না, আমি এখুনি যাচ্ছি।
কিন্তু আমাকে এখন বাড়ি।
কোনও কথা নয়, যা বলছি, তাই করো। আমি গিয়ে যেন তোমাকে দেখতে পাই, তা নইলে মুশকিল হবে।
হুকুম দিয়েই লাইন কেটে দিল শ্যামাচরণ। অশোক মুখ বিকৃত করে, রিসিভারটাকেই ভেংচাল। বলল, বুদু কোথাকার!
বুড়ো কুণ্ডু মশাই, উৎকণ্ঠিত উত্তেজিত গলায় নিচু স্বরে বললেন, এ আর দেখতে হবে না, বুঝলে? এদেরই কীর্তি। বাংলাদেশে বসে, বাঙালি মেয়েকে এরা খুন করতে সাহস করে। বাঙালির আর কিছু রইল না।
অশোক চুপচাপ বসে রইল। কুণ্ডু মশাইয়ের কথা যে তার কানে গিয়েছে এমন মনে হল না। তিনি বকবক করে যেতে লাগলেন। অশোক হুঁ হুঁ করতে লাগল। এমনকী শ্যামাচরণের হুমকিও ওর মাথায় নেই। অমিতা রায়ের কথাই ভাবছে সে।
অমিতাদিকে এমন নিষ্ঠুর ভাবে কে খুন করতে পারে। এটা খুন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। একি কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিণতি? প্রদ্যোতদার কোনও হাত আছে কি এতে? বিশ্বাস হয় না। এদের সুখী দম্পতিই বলা যায়। দুজনে তো প্রায়ই একসঙ্গে বেরুত, বেড়াত। এদের দাম্পত্য সুখই কি কাল করল? এ সুখ কার সহ্য হচ্ছিল না? এমন কে থাকতে পারে?
এমন কি হতে পারে, অমিতাদির সঙ্গে আততায়ীর আগেই কথাবার্তা হয়েছিল, বিশেষ কোনও জায়গায় সাক্ষাৎ করার? এবং সেখানেই হয়তো ঘটনা ঘটেছে। আততায়ী খুন করবার মনস্থ করেই হয় তো ডেকে নিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু সে জায়গা কোথায়? আততায়ীর বাড়ি অথবা অন্য কোনও নিভৃত স্থান?
এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই, শ্যামাচরণের জিপটা একটা গর্জন করে এসে থামল। সঙ্গে একজন সাব ইনস্পেক্টর আর ফটোগ্রাফার। পিছনে পিছনেই এল পুলিশের ভ্যান। রাস্তায় প্রহরারত সশস্ত্র পুলিশেরা সচকিত হল। আশেপাশেও একটা উত্তেজনা দেখা দিল।
শ্যামাচরণের চোখ রীতিমতো জ্বলছে। মুখটা ভীষণ দেখাচ্ছে। আঙুল তুলে অশোককে ডাকল, কাম অন।
আবার ইংরেজি বলা হচ্ছে। অশোকের রীতিমতো বিদ্রূপ করতে ইচ্ছে করে। ও গিয়ে জিপের পিছনে বসল। সঙ্গে সঙ্গে জিপ ছেড়ে দিল। জনসন রোড়ে পড়ে, অশোক দেখিয়ে দিল কোথায় মৃতদেহ পড়ে আছে। ফটোগ্রাফার কয়েকটা ফটো তুলল। কয়েকজন সেপাই নেমে গিয়ে, অমিতার দেহ তুলে নিয়ে এল।
ইতিমধ্যে, শ্যামাচরণ বারে বারেই অশোকের মুখের দিকে, সন্দিগ্ধ কুটিল চোখে দেখছিল। বলল, হঠাৎ জনসন রোডে এসেছিলে, কোনও দরকার ছিল এদিকে?
অশোক পরিষ্কার মিথ্যে কথা বলল, হ্যাঁ, একবার মিল কোয়াটার্সে যাব ভেবেছিলাম।
হঠাৎ কী প্রয়োজনে?
এই বেকার বসে আছি, চটকলে একটা চাকরি যদি পেয়ে যাই, তাই ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলাম।
বটে!
বিদ্রুপে নিষ্ঠুর হয়ে উঠল শ্যামাচরণের মুখ। বলল, আর দেখতে পেলে, অমিতা রায়ের লাশ এখানে পড়ে আছে। চলো থানায় চলো, তোমাকে আমি দেখাচ্ছি।
আমাকে আর দেখাদেখির কী আছে বলুন। থানায় কথাটা শুনলাম। হঠাৎ চোখে পড়ে গেল, তাই আপনাকে খবরটা দিয়ে দিলাম।
হুম, খুব সহজ আর সরল ব্যাপার।
শ্যামাচরণ গরগরিয়ে উঠল। অশোক বলল, ব্যাপারটা খুব গুরুতর সন্দেহ নেই। তবে, আপনি একটু ভুল করছেন। আপনি যা ভাবছেন, ব্যাপারটা তা নয়।
শাট আপ। আমার ভাবনা আমাকেই ভাবতে দাও।
অশোক তেমনি নির্বিকার গলাতেই বলল, তা তো বটেই। তবে আপনিই সমস্ত ব্যাপারটা সহজ আর সরল করে ফেলছেন তো, কিন্তু তা নয়।
যথেষ্ট হয়েছে, ওঠো এখন গাড়িতে।
ইতিমধ্যে রাস্তায় কিছু ভিড় হয়েছিল। দাঙ্গার পরিস্থিতি না থাকলে, গোটা শহরটাই বোধ হয় ভেঙে পড়ত।
.
পুলিশ ভ্যানে তুলে, থানায় অমিতার মৃতদেহ এলে, আগেই প্রদ্যোৎ রায়কে খবর দেওয়া হল। প্রদ্যোৎ রায়, অমিতার মা ভাই বোন সবাই থানায় এল। কান্নাকাটি পড়ে গেল। শহরের এই এলাকায় নতুন করে একটা উত্তেজনা দেখা দিল।
অশোক এখন সামনে থেকে মৃতদেহ ভাল করে দেখল। গলা টিপে মারা হয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু বুকে, উরুতে কিছু কিছু আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সায়া ব্লাউজ যেভাবে ছেঁড়া, ব্রেসিয়ারটা যেভাবে টেনে নামানো হয়েছে, তাতে একটা দিকেই ইঙ্গিত করে, ধর্ষণ, ধর্ষণের পরে হত্যা, হত্যার পরে, গায়ের থেকে সমস্ত অলংকার খুলে নেওয়া হয়েছে। বাইরে বেরিয়েছিল, নিশ্চয় হাতে ঘড়িও ছিল। এখন কিছুই নেই। এর থেকে মনে হয়, আততায়ীর বা আততায়ীদের দুটো উদ্দেশ্য ছিল। ধর্ষণ এবং অলংকার অপহরণ। দাঙ্গার পরিস্থিতির সঙ্গে, এরকম উদ্দেশ্যগত খুনের সম্ভাবনা থাকতে পারে।
তথাপি একটা সন্দেহ থেকে যায়। সে সন্দেহটা হল, অমিতাদির মতো মেয়ের জন্য। শহরের এরকম পরিস্থিতিতে, নিশ্চয় সে এমন কোনও জায়গায় যেতে পারে না, যেখানে দাঙ্গাবাজ গুণ্ডারা তাকে আক্রমণ করতে পারে। প্রথমত, অমিতাদি মোটেই সেরকম বোকা মেয়ে ছিল না। দ্বিতীয়ত, নিজের সম্পর্কে অমিতাদি অচেতন ছিল না। কোনও মেয়েই, নিজের সম্পর্কে, প্রায় অচেতন হয় না। এই পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েরা একটা বস্তুকে সব সময়েই আগলে নিয়ে বেড়ায়, সেটা হল তাদের দেহ। দেহটা তাদের কাছে এত বড় মূলধন, সামাজিক প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে, জীবিকা পর্যন্ত কাজে লাগে। আর শুদ্ধতার বিষয় তো আছেই।
অতএব অমিতার মতো মেয়েরাও, এ চিন্তার উর্ধ্বে গিয়ে, কোনও রকমেই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে যেতে পারে না। তা হলে কি, আগের চিন্তাটাই ঠিক? অর্থাৎ, আততায়ী, চেনা লোক, বিশেষ কোনও জায়গায় অমিতাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে, সেখানেই খুন করেছে। তারপরে জনসন রোডের নর্দমায় নিয়ে ফেলেছে? আততায়ী নিজেকে বাঁচাবার জন্যেই হয় তো, এই দাঙ্গার পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে। যাতে সবাই ভাবে, ঘটনাটা নিতান্তই একটা দাঙ্গাজনিত দুর্ঘটনা।
ময়না তদন্তে যাই প্রকাশ পাক, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, একটা যৌন পীড়নের ব্যাপার এর মধ্যে আছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখে তা-ই মনে হচ্ছে সেটাই হয়তো আসল উদ্দেশ্য। তারপরে, গায়ের অলংকার লোপাট করাটাও নিতান্তই চোখে ধূলো দেওয়ার ব্যাপার হয় তো। যেন সবাই মনে করে, খুনটা করেছে, সাধারণ গুণ্ডা শ্রেণীর লুঠেরারা। এ কথাটা অশোকের মনে হচ্ছে কেন? এই জন্যে যে, সাধারণ দাঙ্গাবাজ গুণ্ডাদের পাল্লায় পড়ার মতো অমিতা ছিল না। তবে, কিছুই বলা যায় না, যতক্ষণ পর্যন্ত একটা বিশেষ কোনও ধরতাইনা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কাল্লুর মতো গুণ্ডা যে এর মধ্যে নেই, সে বিষয়ে অশোক প্রায় নিশ্চিত।