অন্ধকার ঘরে একা
খারাপ লাগছিল। খুব খারাপ। অন্ধকার ঘরে একা শুয়ে ভরতের মনে হল তার এই খারাপ লাগাটা কি মিথ্যে? কলকাতার অন্য কোনো ছেলের কি এমন অনুভূতি হয় না। আর কেউ কি খোলা চোখে চারপাশের জীবন দ্যাখে না? দেখলে তারা কি করছে? অর্ণব বসু রায় একদিন বলেছিল, সত্তর দশকে কিছু মানুষ আমাদের দেশের রাজনৈতিক সামাজিক ব্যবস্থা পাল্টে ফেলার জন্যে আন্দোলন করেছিল। জনসাধারণ তাদের পাশে না দাঁড়ানোয় সেই সেই আন্দোলন বিপ্লব হতে পারেনি। জনসাধারণ কেন সমর্থন করেনি জিজ্ঞাসা করাতে অর্ণব বসু রায় বলেছিল, ওরা বিদেশি রাষ্ট্রের চেয়ারম্যানকে নিজেদের চেয়ারম্যান বলেছিল। পরের দিকে নিজেদের মধ্যে দলাদলি করে লক্ষ্য হারিয়েছিল।
এই ব্যাপারটাও ভরতের মাথায় ঢোকেনি। আমাদের দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবেশকে বদলানোর জন্যে কেন বিদেশি রাষ্ট্রের চেয়ারম্যানকে মাথায় তুলতে হবে তা তিনি যতই আদর্শবান পুরুষ হোন না কেন? ঠিক একই ভাবে পশ্চিমবঙ্গ আর শক্তিমান রাজনৈতিক দলের নামে ব্রাকেটে এক শব্দটিকে তার অকারণ বলে মনে হয়। গোড়ার দিকে প্রয়োজন ছিল কি না সে জানে না। কিন্তু এখন ওই দল নিজস্ব নীতি অনুযায়ী পরিচালিত হয়। নামের পাশে লেজুড় রাখার কোনো যুক্তি এখন নেই।
আমি একা কিছুই করতে পারব না। একা কিছু করার চেষ্টা করলে উল্টে বোকা বনে যেতে হবে। আজ সকালে ট্রাফিক পুলিশটার অভিজ্ঞতা তাই বলে। বেল বাজল। ভরত অনুমান করল বাবা ফিরেছে। এখন মা বাবাকে তার কথা বলবে। বাবার মেজাজ ভাল থাকলে কথাগুলো উপেক্ষা করে। খারাপ থাকলে ওখান থেকেই চেঁচাবে।
সেই সকালে খেয়েছিল সে। বাড়ির ফেরার পর খাওয়ার কথা ওঠেনি। সারাদিন ধরে যেসব টেনসন গিয়েছে তাতে শরীর বেশ কাহিল। এখন জোর খিদে পাচ্ছে। অথচ এখান থেকে উঠে যাওয়ার পর মা একবারও তাকে খেতে ডাকেনি। অন্যদিনে বিকেলে জলখাবার না খেলে মা রাগারাগি করে আর আজ খাওয়ার কথাই বলেনি। বাংলা সাহিত্যে যেসব মায়ের কথা বলা হয়েছে। তারা কেউ এমন আচরণ করেনি। সেইসব মায়েরা বুক ভর্তি স্নেহ রাখত এবং সন্তানের মঙ্গ লের জন্যে অল আউট যেতে পারত। আমরা এখনও তাদের কথা উপন্যাসে পড়ি কিন্তু জীবন থেকে কখন যে তারা ঝরে গেছে সেই খবর রাখি না। এখনকার উপন্যাসের মা বিয়াল্লিশ বছরেও বন্ধু সঙ্গে সিনেমায় যায়, পঞ্চাশেও প্রেম করতে পারে। মা হওয়া মানে তার অন্যান্য সব শখ আহ্লাদের গায়ে পেরেক পোতা, এমনটা ভাবার দিন জীবনে চলে গেলেও সাহিত্যে যায়নি। মায়ের ভাবনায় আঘাত লেগেছে বলে ভরতকে খেতে ডাকা হয়নি। এখন ভরত নিজে খাবার নিয়ে খাবে কি না সেটা তার বিচার্যবিষয়।
ভরত ঠিক করল সে খাবে। বিছানায় উঠে বসতেই ঘরের আলো জ্বলল। বাবা এসে দাঁড়িয়েছে পোশাক পাল্টে, আয়। খাবি।
খুশি হল ভরত। যাক, নিজে গিয়ে নিতে হল না।
ধারে কাছে মা নেই, টেবিলে খাবার সাজানো রয়েছে। দামি হোটেলের ফিসফ্রাই বোঝা যাচ্ছে। বাবা এনেছে। চেয়ারে বসে খেতে শুরু করল ভরত। বাবা উল্টো দিকে বসে ফ্রাই ভেঙে জিজ্ঞাসা করল, টেস্ট কেমন?
ভরত মাথা নাড়ল, ঠিক আছে।
এটা কোনো উত্তর হলেও কোন টেস্টটা ঠিক তুই জানতিস? তার কোনো নির্দিষ্ট মান থাকে? বাবা হাসল, তোর ভাল লাগছে না খারাপ লাগছে সেইটে বল।
ভাল।
গুড। কলেজ কেমন লাগছে? বাবা খাওয়া শুরু করল।
হঠাৎ এই প্রশ্ন?
তুই কলেজে যাচ্ছিস, সড়গড় হয়ে গেছিস, এখন প্রশ্ন করাটা কি আচমকা হলো?
ঠিকই আছে।
তুই যে উদ্দেশ্যে কলেজে ঢুকলি সেটা পেতে গেলে একটু বেশি খাটতে হবে। এই সময় অন্য কোনো দিকে মন দেওয়া মানে আলটিমেটলি তোর নিজেরই ক্ষতি।
ভরত এক মুহূর্তের জন্যে খাওয়া থামাল, কিন্তু কিছুই বলল না। এতক্ষণে বাবা লাইনে নিয়ে আসছে আলোচনাটা তা সে বুঝতে পারল।
বাবা বলল, হাতের পাঁচটা আঙুল এক মাপের হয় না। একসঙ্গে থাকতে গেলে মতবিরোধ, ঝগড়াঝাটি হয়। কিন্তু আঙুলগুলো যেমন একটা হাতেরই অংশ তেমনি আমরা তিনজন একটি পরিবারের। এই কথাটা মনে রাখিস।
হঠাৎ এই কথা?
তোর মাথায় যেসব ভাবনাচিন্তা পাক খাচ্ছে তা তোর মাকে কষ্ট দিচ্ছে।
আমি অন্যায় বললে মা প্রতিবাদ করত।
জীবনে সবসময় ন্যায় অন্যায় এক খাতে বয় না। আজকে যেটাকে তোর অন্যায় বলে মনে হচ্ছে কাল সেটাকে তা নাও মনে হতে পারে। ধর, গাছ কাটা অন্যায়। একটা বড়সড় গাছ, যেমন ধর আম, কেটে ফেলা মানে অপরাধ করা। কিন্তু ওই আমগাছটা যদি বাড়ির গা ঘেঁষে বড় হয় তাহলে তার শেকড় বাড়িটার ক্ষতি করবে। নিজেদের নিরাপত্তার জন্যে গাছটাকে তখন কেটে ফেলতেই হবে। এটাকে আর অন্যায় বলা যাবে না।
হয় তো!
হয় তো নয়। এটা ঠিক। আজ আমরা যে যা করছি তা সবই নিজেদের নিরাপত্তার জন্যে। এই নিজেদের মানে আমি একা নই, আমি, তোর মা এবং তুই। তার চেয়ে বড় কথা আলটিমেটলি তুই হবি গেনার। আমরা যখন থাকব না তখন আমাদের যা কিছু তুই পাবি। তোকে ভালভাবে রেখে গেলে আমরা শান্তি পাব।
আমি ভালভাবে থাকব কিনা সেটা তোমরা জানো না।
তার মানে?
আমি মনে করি না প্রচুর টাকার মধ্যে বাস করলেই কেউ ভালভাবে থাকতে পারে। ভরত উঠে দাঁড়াল। বাবা চোখ কোঁচকালো। কিছু বলল না। ভরত টয়লেটে ঢুকে গেল।
ঘন্টা দুয়েক এই ফ্ল্যাট চুপচাপ ছিল। আজ মা টিভিও চালায়নি। টেবিলে বসে পড়ছিল ভরত। হঠাৎ মায়ের গলা কানে এল, না। যাবে না তুমি!
নো। আমাকে কথা বলতে হবে। হি ইজ মাই সন।
কাল সকালে কথা বলো। এখন নয়।
হোয়াই নট?
তুমি অনেকটা ড্রিঙ্ক করেছ। কী বলতে কী বলে ফেলবে।
শাট আপ। আমি ড্রাঙ্ক নই। আজ পর্যন্ত কখনও মাতাল হতে দেখেছ? আমার মনে হচ্ছে। কেউ ওর ব্রেন ওয়াশ করছে। আমি কথা বলবই।
যা ইচ্ছে তাই করো। আমার আর ভাল লাগছে না।
তারপরেই বাবার গলা কানে এল, ভরত!
ভরত তাকাল না। মুখে বলল, বলো।
তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।
আমি এখন পড়ছি।
আমাকে তুমি পড়া দেখিও না। আমিও স্কুল ফাইনালে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলাম। তখনকার পরীক্ষার সিস্টেম ছিল অনেক স্টিফ। এখনকার মতো টি দিয়েই নম্বর পাওয়া যেত না। ওয়েল। তোমার বন্ধুবান্ধব কারা? নাম বলো!
তোমার সে সব জেনে কী লাভ হবে?
সেটা আমি বুঝব!
আমার কোনো বন্ধু নেই।
মিথ্যে কথা?
আমি মিথ্যে কথা বলতে যাব কেন? তাহলে ওইসব আহাম্মকি কে তোমার ঢোকাচ্ছে? হাউ ডু ইউ নো যে টাকা থাকলেই ভাল থাকা যায় না? কী অভিজ্ঞতা আছে তোমার?
ভরত এবার ঘুরে বসল, তোমার টাকা আছে?
হ্যাঁ। ইয়েস। আছে। যা আছে তাতে ভালভাবে চলে যাবে।
তুমি কি ভাল আছ?
হোয়াট ডু ইউ মিন? আমি খারাপ আছি? আমার মতো ভাল কটা মানুষ আছে?
তাহলে তোমার সঙ্গে মায়ের প্রতিটি স্টেপে ঝগড়া হয় কেন? কেন ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে হাত করতে একটা বাজে লোককে তেল দিতে হয়? এত রাত্রে মদ খেয়ে এই ঘরে এসেছে নিশ্চয়ই কোনো যন্ত্রণা থেকে, কেন আসতে হয়?
বিকজ, বিকজ–। বাবা দুহাত ছড়িয়ে কিছু বলতে গিয়েও শব্দ খুঁজে পেল না। তারপর বলল, তোমাদের জন্যে। তোমার আমাকে ডিস্টার্ব করছ। তোমার আমাকে ভাল থাকতে দিচ্ছ না। ইটস ইওর ফল্ট!
যার ফল্টই হোক, টাকা থাকা সত্ত্বেও তুমি ভাল থাকছ না, এটাই সত্যি।
তুমি কি চাও আমি সন্ন্যাসী হয়ে যাব? জঙ্গলে গেলেও ফল কিনতে টাকা লাগে!
তোমার রোজ রাত্রে স্কচ খাওয়ার কী দরকার?
ইটস্ মাই হ্যাবিট। ইন্ডিয়ান হুইস্কি খেতে পারি না আমি।
তোমার যদি বাড়তি টাকা না আসত–।
যদি মাসির গোঁফ বের হত! রাবিশ। আমি যা পেয়েছি তা অনেক কষ্ট করে অ্যাচিভ করেছি। এব্যাপারে কারও কোনও উপদেশ আমার কানে ঢুকবে না।
তাহলে তো কথা বলে লাভ নেই।
দ্যাখো ভরত, মানুষকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে অনেক কিছু মনে নিতে হয়। লুক, তোমার মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কে আর যাই থাক প্রেম নেই। এইভাবে একসঙ্গে বাস করে আমি নিজেকে সে ব্যাপারে বঞ্চিত রাখছি। তেমন কোনো মহিলা যিনি আমাকে প্রেম দিতে পারেন, এগিয়ে এলেও আমি রেসপন্স করি না বিকজ আমি এখনও স্বামী। আমি যদি তাকে ডিভোর্স করতে চাই সে মেনে নেবে না। আমি যদি কোর্টে গিয়ে বলি, আই অ্যাম নট হ্যাপি উইদ হার কোর্ট আমার কথা শুনবে না, যতক্ষণ সে ওই একই কথা বলছে। অতএব তাকে মেনে নিতে হবে। জড়িয়ে মিশিয়ে থাকতে হবে। শুধু আমরা কেন, এই কলকাতা শহরে কয়েক লক্ষ স্বামী স্ত্রীর সামনে কোনো উপায় নেই বলে পরস্পরকে সহ্য করে একসঙ্গে আছে। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? বাবা সোজা হয়ে দাঁড়াল, আমি তোমার মাকেও যেমন অস্বীকার করতে পারি না তেমনি তোমাকেও। তোমার এই সব কথাবার্তা, অ্যাটিচ্যুড আমার কাছে অসহ্য বলে মনে হলেও গিলতে হচ্ছে কারণ তুমি আমাদের ছেলে এটা চিরকালের জন্যে সত্যি হয়ে গেছে। তোমাকে খাওয়াতে পরাতে হবে, পড়াশুনা করাতে হবে আমার তোমার কাছে দুর্ব্যবহার পেলে সহ্য করতে হবে। এটাই জীবনের ট্র্যাজিডি, বুঝলে! তাই একটু অ্যাডজাস্ট করতে শেখো। বাবা টলতে টলতে বেরিয়ে গেল।
ভরত ভেবেছিল ওপাশের ঘর থেকে মায়ের গলা এবার সরব হবে। মা সম্পর্কে বাবা যে সব কথা বলে গেল তাই নিয়ে আবার দুজনের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হবে। কিন্তু কোনো কিছুই। হলো না। মা অদ্ভুতভাবে চুপ করে আছে। বাবারও গলা শোনা গেল না।
অনেক রাত্রে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে ভরত আবিষ্কার করল তার খাবার হট বক্সে রাখা আছে। মা-বাবার ঘরে দরজা বন্ধ। একা বসে খাবার খেল সে। খেতে খেতে তার মনে হলো অ্যাডজাস্ট কথাটার অন্য একটা ব্যাখা আছে। যে যার নিজের মতো যদি থাকে, কেউ কারও ব্যাপারে নাক গলায়, মন্তব্য না করে তাহলে বাড়িতে একটা আপাত শান্তির আবহাওয়া তৈরি হবে। এইভাবে বাস করাটাকে হয়তো অ্যাডজাস্ট করে থাকা বলা যেতে দরকার আর একটা চাবি। তাহলে বেল বাজিয়ে দরজা খোলানোর জন্যে কারও ওপর নির্ভর করতেও হবে না। কিন্তু বাবার কথাটা খেয়াল হলো। তোমাকে খাওয়াতে পরাতে হবে, পড়াশুনাও করাতে হবে। মাথা নাড়ল ভরত। সে যদি নিজের রোজগার করতে পারে তাহলে বাবার আর কোনো দায় থাকল না। ভরত মাথায়। হাত বোলালো, কত টাকা লাগবে আর কিভাবে সেই টাকাটা রোজগার করা যায়? তাকে রাস্তাটা বের করতেই হবে।
.
অভিজিত বলল, টাকার দরকার কেন? তোমার বাবা কী রকম আয় করেন?
বাবা ভাল রোজগার করেন। কিন্তু আমি স্বাবলম্বী হতে চাই।
মাইগড! কেন?
এটা আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার!
আচ্ছা! কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি তুমি একটা ইমোশনাল ফুল। যতদিন পার বাবার ওপর নির্ভর করে নিজের কেরিয়ার গুছিয়ে নাও। তুমি যদি এখন থেকেই টাকা রোজগারে নেমে পড় তাহলে কখনও বড় কেরিয়ার তৈরি করতে পারবে না। অভিজিত চোখ কোঁচকাল, বাবার সঙ্গে ফাইটিং হয়েছে?
হ্যাঁ, ওই রকমই।
একপা পিছোও, দু-পা এগোও। এমন ভান কর যে তিনিই ঠিক, দেখবে ভদ্রলোক গলে গিয়েছেন। তখন নিজের কাজ হাসিল করো। আর ভাই-বোন আছে?
না।
ইডিয়ট। চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খেতে যাচ্ছ!
তাহলে তুমি কোনো উপায়—
পারি। বাবাকে বললে যে কোনো অফিসে ঢুকিয়ে দেবে। তখন কলেজ করবে কী করে? তার চেয়ে বিনা পরিশ্রমে নিজের বাবার চাকরি করা ভাল নয় কি? অভিজিত হাসল।
অর্ণব বসু রায় সব কথা চুপচাপ শুনে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি রাজনীতি করতে চাইছ?
না। একথা মনে হচ্ছে কেন?
এর পরের স্টেপ তথাকথিত উগ্ররাজনীতি করা যায় যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
না। আমি কোন রাজনৈতিক ভাবনা ভাবিনি।
তাহলে টিউশনি করো। তুমি ইংলিশ মিডিয়াম থেকে এসেছ। প্রচুর ছাত্রছাত্রী পাবে। তিনচারশো টাকা মিনিমাম পাবে এক-একজনকে পড়িয়ে।
কিন্তু তাদের কোথায় পাবো?
ভাল করে একটা কাগজে লিখে যে কোনো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দাও। রেসপন্স পাবে।
অর্ণব বসু রায়ের এই বুদ্ধিটাকে কাজে লাগাল। ও নিজে যে স্কুল থেকে পাশ করেছে সেখানকার সবাই পরিচিত। কাগজে লিখে নোটিস বোর্ডের টাঙিয়ে দিতে তাই খুব একটা অসুবিধে হল না। টেলিফোন নম্বর দিয়েছিল। পর দিন শনিবার গোটা ছয়েক টেলিফোন এসে গেল। সবাই ক্লাস সেভেন এইটের ছাত্রকে পড়াতে বলছে। সপ্তাহে দুদিন বিকেলে পড়াবে চারশো টাকার বিনিময়ে এমন তিনজন অভিভাবককে সে কথা দিয়ে দিল। এত সহজে বারোশ টাকা মাসে পাওয়া। যাবে ভাবতে পারেনি ভরত।
কয়েকটা দিন কেটে যাওয়ার পর ভরত বুঝতে পারল এই বাড়িতে থেকে ইচ্ছে করলেও বাইরে খাওয়া যাবে না। ঘুম থেকে উঠেই চা খাওয়ার জন্যে সিকি মাইল ছোটা সম্ভব নয়। রাত্রেও ওই একই সমস্যা। একমাত্র দুপুর এবং বিকেলের খাবার বাইরে খেয়ে নিতে পারে সে। অতএব ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেতে হলো। সকাল অথবা রাতের খাবারে জন্যে সে টাকা দিতে পারে কিন্তু দেওয়ার মধ্যে যে অস্বস্তি সেটাকে কাটাতে পারল না ভরত। রাত্রে সে খায় সবার খাওয়া শেষ হবার পর। হট বক্সের ঢাকনা খুলে যখন সে খেতে বসে তখন বাড়িটা নিঃঝুম।
এক রাত্রে খাওয়ার টেবিল থেকে তার ডাক এল। বাধ্য হয়ে গেল ভরত। বাবা-মা খাবার নিয়ে বসেছিল। ভরত দেখল তার থালাও দেওয়া হয়েছে।
বাবা বলল, বোসো।
আমি পরে খাব।
এখন রাত দশটা। এইটাই ডিনারের সময়। বোসো।
প্রতিবাদ করা যেত। কিন্তু ওই খাবারই যখন একটু বাদে খেতে হবে তখন একটা বেলার জন্যে প্রতিবাদ করে কী লাভ। ভরত বসল।
খাওয়া শুরু করতেই বাবা বলল, তোমার কী বলার আছে ওকে বলো।
মা নির্লিপ্ত মুখে খাচ্ছিল। বাবার কথা শুনে বলল, আমি আগ বাড়িয়ে চড় খেতে চাই না।
বাবা মাথা নাড়ল, চড়ের কথা উঠছে কেন? বলো।
মা এবার ভরতের দিকে তাকাল, কয়েকদিন হল লক্ষ্য করছি তুই দুপুরে খাচ্ছিস না।
ভরত কথা না বলে খেতে লাগল।
বিকেলের জলখাবারও পড়ে থাকছে। মায়ের গলার স্বর পালটালো না।
আমি না খেয়ে থাকছি না। ভরত জবাব দিল শান্ত গলায়।
বাড়ির খাবার খাচ্ছ না কেন?
আমি যেটা নিজে পারি তা কারও ওপর চাপাতে আরও রাজি নই।
চাপানো মানে? বাবা জিজ্ঞসা করল।
আমি কলেজে গিয়ে খেয়ে নিই। তখন খেতে ভাল লাগে। খাওয়ার খরচ আমি নিজেই দিতে পারি এখন। তোমরা নিশ্চয়ই জানো, আমি টিউশনি করছি।
তুমি আমাদের জানিয়েছ?
মা টেলিফোন বাজলেই ছুটে যায় আগে, মায়ের অজানা থাকার কথা নয়।
তুমি সেটা বলার প্রয়োজন মনে করো না?
এটা আমার ব্যাপার। হো
য়াট ডু ইউ মিন?
আমরা যে যার মতো থাকলেই তো ভাল।
আচ্ছা। এরপর শুনব সকালে খাচ্ছ না, ডিনার বাইরে খাচ্ছ?
এ বাড়িতে যতদিন থাকছি ততদিন সেটা সম্ভব নয়।
তাহলে তুমি আমার কাছ থেকে সামনের মাস থেকে টাকা-পয়সা নিচ্ছ না?
ভরত মাথা নাড়ল, মনে হয় দরকার হবে না।
মা বলল, কলেজে গিয়ে একেবারে পাল্টে গেছে। টিউশনি করে তুমি বাঁচতে পারবে?
চেষ্টা করব
তোমার পড়াশুনার বারোটা বাজবে না?
দেখি।
আমাদের ছেলে হয়ে তুমি টিউশনি করছ, এতে সম্মানে বাড়বে?
কেন? তোমরা তো শ্রমিক নেতার মেয়েকে ইংরেজি শেখাতে পাঠাচ্ছিলে।
সেটা টিউশনি নয়, এমনই দেখিয়ে দেবার জন্যে?
এমনই কেন বলছ? আমি পরিশ্রম করতাম আর তোমরা ওর ফেভার পেতে।
বাবা মাথা নাড়ল, তোমার সঙ্গে কথা বলার কোনও মানে হয় না।
মা বলল, ও যদি শিবপুর বা খড়াপুরে যেত তাহলে এমন ভাবে স্পয়েলড হত না। ওর জেদ মেনে নিয়ে কী ভুল করেছ এখন দ্যাখো।
আমি একা মানিনি, তুমিও মেনেছে।
খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। ভরত উঠে দাঁড়াল, যাচ্ছি।
টিউশনি করে তুমি কত টাকা রোজগার করছ?
বারোশ। বেসিনের দিকে এগিয়ে গেল ভরত।
আমার ড্রাইভারের মাইনে কত জানো?
জানার কী দরকার? যে যার নিজেরটা নিয়ে থাকলেই তো ভাল হয়। ভরত চলে এল নিজের ঘরে। ও বুঝতে পারছিল বাবা-মা একটা জায়গা এসে থমকে যেতে বাধ্য হচ্ছে। যতই রেগে যাক তাকে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলছে না। ঠিক কথা হল বলতে পারছে না। তবে তাকে কেন্দ্র করে দুজনে এখন এক হয়ে গেছে। এই ব্যাপারটা এখন খুব স্বাভাবিক। পরস্পরকে সহ্য করতে পারে না এমন দুই রাজনৈতিক দলও তৃতীয় শক্তির বিরুদ্ধে এক হয়ে যায় সাময়িকভাবে।
.
টিউশনি করতে কলকাতার চার সম্পন্ন বাড়িতে গিয়ে ভরতের নতুন অভিজ্ঞতা হলো। স্কুলে থাকতে মা কারও বাড়িতে যেতে দিত না। একমাত্র তাদের হাউসিং-এর দুতিনজনের বাড়িতে সে কয়েকবার গিয়েছে মাত্র। এই চারটি বাড়িতে প্রথম দিন যাওয়ার সময় ছাত্রের মা-বাবা এসে কথা বলেছিলেন। খুব ভদ্র ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু তারপর চার সপ্তাহ শেষ হয়ে গেল সে ওঁদের দর্শন পায়নি। বেল বাজালে কাজের লোক দরজা খোলে, বসতে বলে। ছাত্র আসে। পড়ানো হয়ে গেলে সে বেরিয়ে আসে। কোনও ছাত্র ঠিক মনোযোগী নয় অথবা কিছুটা অবাধ্য বলে তার গার্জেনকে অভিযোগ করার কথা ভেবেছে ভরত। নিজে তাঁদের ডাকিয়ে না এনে দেখা পেলে বলবে ঠিক করেছিল কিন্তু তারা সামনে আসেননি। বাড়ির ছেলেকে একজন টিউটারের সঙ্গে জুতে দিয়েছে, আর কোনো চিন্তা করার নেই, এমন যেন ভাব তাঁদের।
একমাসের পর প্রথম যে বাড়িতে গেল সেই বাড়ির ছাত্রটির বাবা জাহাজে চাকরি করেন। বছরের বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকেন।
পড়ানো হয়ে গেলে ছাত্রটির মা বেরিয়ে এলেন পাশের ঘর থেকে। ছেলেকে বললেন, যাও, এবার তুমি টি ভি দেখতে পার।
ছেলেটি দৌড়াল। ভদ্রমহিলা সামনে বসলেন, ওঁকে দেখে নিজের মায়ের কথা মনে পড়ল ভরতের। একই রকম ভাবভঙ্গি। ক্লাস সেভেনের ছেলের মা বলে একেও মনে হয় না। বেশ নায়িকা নায়িকা ভাবভঙ্গি।
ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার ছাত্র কী রকম পড়ছে?
একটু অমনোযোগী।
হ্যাঁ। বাবার ধাত পেয়েছে। ওই জন্যে তো আপনাকে রাখলাম। এখানে যার পড়ায় কারও ইংলিশ মিডিয়াম ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। ফলে পড়ালেও সেটা ওর কানে লাগছিল না। কোনোমতে স্কুলটা পার হলে স্টেটসে পাঠিয়ে দেব। আমার সব আত্মীয়-স্বজন ওখানে।
ভরত কিছু বলল না।
আপনি যেন কোথায় থাকেন?
ভদ্রমহিলা কখনও প্রশ্নটা করেননি যে যেন শব্দটা ব্যবহার করতে হবে। তবু ভরত সঠিক জবাব দিল। ভদ্রমহিলা চোখ বড় করলেন, তাই?
মানে?
শুনেছি ওই হাউসিং-এর ফ্ল্যাটে খুব কস্টলি। আমার এক বন্ধু ওখানে থাকে।
কী নাম?
বিজন। বিজন বসু। ব্যবসা করে। ব্যাচেলার।
ভরত লোকটাকে চিনতে পারল। বাবা দু চক্ষে দেখতে পারে না। হাউসিং-এর পুজোর প্যান্ডেলেও ভদ্রলোক আসেন না। ওঁর ওখানে অনেক মহিলা যান।
যাক গে! আপনার বাবা কী করেন?
কেন বলুন তো? ভরতের মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে এল।
না, ওই ফ্ল্যাটে যখন থাকেন তখন নিশ্চয়ই বড় সড় কিছু।
হবে।
তাহলে আপনি টিউশনি করছেন?
এটা আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার।
ও বুঝেছি। ক্ল্যাশ হয়েছে। আমি কিন্তু তুমি বলব।
ঠিক আছে। এবার উঠি।
আরে টাকাটা নিয়ে যাও। ভদ্রমহিলা উঠে ভেতরে গেলেন। ফিরে এলেন চারটে একশ টাকার নোট আর একটা আমেরিকান সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে, নাও। রাখো। তোমার মত গম্ভীর ছেলেকে আমার খুব ভাল লাগল।
এটা কেন?
রেখে দাও। ও তো জাহাজে আছে! প্রচুর ফরেন জিনিস আনে প্রত্যেক বার। আমার বন্ধুরা তো সারা বছর স্কচ খায় এখানে এসে। তুমি আর একটু বড় হলে তোমাকে খাওয়াতাম।
টাকাটা নিয়ে সিগারেট টেবিলে রেখে দিল ভরত, আমি স্মোক করি না। এলাম।
বাইরে বেরিয়ে তার মনে প্রথম টাকা পাওয়া আনন্দ উথলে উঠছিল না। তার মনে হচ্ছিল এই ভদ্রমহিলা অসৎ। ছেলের পড়াশুনার খবর সারাক্ষণ রাখেন না অথচ তাকে আমেরিকায় পাঠাতে চান। তাঁর আত্মীয়রা সেখানে থাকেন ওই খবর গর্বের সঙ্গে দেন। স্বামীর আনা বিদেশি জিনিস বন্ধুদের নিয়ে উপভোগ করেন। স্বামীর অবর্তমানে সময় কাটানোর যথেষ্ট ব্যবস্থা তিনি করে নিয়েছেন। এঁর ছেলেকে পড়িয়ে টাকা নিতে হবে তাকে প্রত্যেক মাসে। সে কি একটা অসৎলোকের কাছে টাকা নিচ্ছে না?
কথাটা সে অর্ণব বসু রায়কে বলেছিল। অর্ণব বসু রায় বলেছিল, তুমি তাহলে পাগল হয়ে যাবে। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। তুমি একটি ছেলেকে পড়াচ্ছ, শ্রম দিচ্ছ এবং বদলে টাকা নিচ্ছ। এইটের মধ্যে কোনও গোলমাল নেই। সে কি ভাবে টাকা রোজগার করে তোমায় দিচ্ছে তাতে তোমার কী দরকার?
ভরতের মনে খুঁত থেকে গেলেও সে যুক্তিটা মানল। কোন বারবনিতার সন্তানকে সে যদি পড়ায় তাহলে কি টাকা নেবে না?
দ্বিতীয় বাড়িটিতে টাকা নেবার সময় অন্য সময় অন্য অভিজ্ঞতা। ছেলেটির বাবা নিজেই এলেন, মাস্টারমশাই, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লে কলেজে ভর্তি হবার সময় অসুবিধে হয় নাকি?
ভাল রেজাল্ট করলে হয় না।
তাহলে ওর ভাল রেজাল্টের দায়িত্ব নিতে হবে।
আমি চেষ্টা করছি, ও যদি পরিশ্রম করে তাহলে হতে পারে।
আমাদের বংশে কেউ কখনও পরিশ্রম করেনি কিন্তু তাই বলে আটকেও যায়নি। এই যে আমি ইনকামট্যাক্সের অফিসার, এর জন্যে তো কিছুই পরিশ্রম করিনি।
ভরত টাকা নিল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনি অফিসার হিসেবে কী রকম?
তার মানে? ভদ্রলোক অবাক।
যাঁরা আপনার কাছে কাজের সুবাদে যান তাঁদের সাহায্য করেন?
নিশ্চয়ই। সেটাকে আমার ডিউটি। ভদ্রলোক হাসলেন, আপনার কাছে চেনাশোনা কারও কেস আছে নাকি? আচ্ছা, লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। পরের দিন যখন যাবে তখন যেন বলে আপনার ছেলের মাস্টার পাঠিয়েছে।
যদি না বলে?
না বলে মানে? অ্যাকাউন্টে গোলমাল থাকলে ছেড়ে দেব না। লোকে আমার বদনাম দেয় না। বলে মধুসূদন। গোলমালটা সহজ করে দিই আমি। ভদ্রলোক হা হা করে হাসলেন, তবে এক্ষেত্রে কোনো খরচ করতে হবে না।
আমি এক মাস পড়িয়েছি এসব না জেনে, তাই টাকাটা নিচ্ছি। কিন্তু আপনার ছেলেকে আর পড়াতে পারব না। আমি যতই পড়াই ও আপনার মতো বিনা পরিশ্রমে টাকা রোজগার করতে ঠিক শিখে যাবে। আচ্ছা, নমস্কার। ভরত বেরিয়ে এসেছিল।
.
বিকেলগুলো চমৎকার কেটে যাচ্ছিল ছাত্র পড়িয়ে। যদিও তিনশো টাকা কমে গেল প্রথম মাসের পর তবু নিজেকে বড়লোক বলে মনে হত ভরতের। রোজ দুপুরে বিকেলে যা ইচ্ছে তাই খেতে পারছে এবং তার পরেও টাকা থেকে যাচ্ছে পকেটে। কলেজে নিয়মিত ক্লাস করছে সে। তারপর লাইব্রেরিতে অনেকক্ষণ কাটাচ্ছে আর পাঁচটা সিরিয়াস ছাত্রের মতো। ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে তার তেমন কোনও সম্পর্ক নেই। যা কথা হয় অভিজিতের সঙ্গে। অভিজিতের কথা শুনে মনে হয় কী কথা বলতে হবে তা যেন কেউ ওকে শিখিয়ে দিয়েছে।
লাইব্রেরিতে নিজের কোর্সের বই-এর চাইতে বাইরের বই পড়ার আগ্রহ ওর ক্রমশ বাড়ল। ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইউ এস আই এস এবং ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যাতায়াত শুরু করল সে। আর এই করতে করতে ও ভারতবর্ষের একটা ছবি তৈরি করে নিল। ছবিটা এইরকম, সিপাহি বিদ্রোহ ভারতবাসীর প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়। বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে যে ক্ষোভ সিপাইদের মনে জেগেছিল তা ধর্মীয় সংস্কারকে আহত করে উস্কে দেওয়ায় ব্রিটিশরা বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছিল। তা নাহলে পরবর্তী বছরগুলোতে অবিরাম শান্তি বিরাজ করত না। কংগ্রেস যে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে তা অনেকটা বাধ্য হয়েই, নিজেদের অস্তিত্ব রাখতে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর যেসব সংগঠন অস্ত্র-বিপ্লবের চেষ্টা করেছিল তাদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত সীমিত এবং দেশের অধিকাংশ মানুষ ছিল দর্শকমাত্র। একমাত্র বিয়াল্লিশ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনই ব্রিটিশ বিরোধিতার তুঙ্গে উঠেছিল। তবু এই সময়টায় গরিষ্ঠসংখ্যক ভারতীয় ওই আন্দোলনে নিজেদের জড়ায়নি। ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার আগে কোনও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়নি। ভারতবাসীর হয়ে কংগ্রেসের নেতারা ক্ষমতা হাতে নিয়েছিল দেশকে দুটো ভাগে বিভক্ত করে। পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক পরিমন্ডল প্রতিষ্ঠিত হলেও অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রবল হওয়ায় কিছু মানুষ আরও গরিব হলো আর কয়েকটি পরিবার চূড়ান্ত বড়লোক হয়ে গেল। এই পরিবারগুলোই দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করত। গরিব মানুষগুলোর চাওয়ার ক্ষমতা ছিল না। পরবর্তীকালে তাদের হয়ে কথা বলতে এল বামপন্থীদলগুলো। পাইয়ে দেবার রাজনীতি শুরু হয়ে গেল। কোনও কোনও অঞ্চলে এরা সফল হলো। কিন্তু পর্দার আড়ালে এদের সঙ্গে ওই পরিবারগুলোর যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে রয়েছে। তা প্রকাশ পেল যদিও দলগুলো তা স্বীকার করে না। মুশকিলে পড়ল মধ্যবিত্ত। এরাই চিরকাল দেশের সংস্কৃতি, সাহিত্য শিল্পকে লালন করেছে, বুদ্ধিজীবীরাও এদের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছে। স্বাধীনতার বছর পনেরো কুড়ি পর্যন্ত অর্থনৈতিক স্থিতিহীনতার সঙ্গে এরা পাল্লা দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে চেষ্টা করেছিল, পরে বেঁচে থাকার তাগিদে চরিত্র হারালো। এই মধ্যবিত্ত, শ্রেণির অন্য নাম দাঁড়িয়ে গেল সুবিধেবাদী, যাদের চরিত্র বলে কিছু অবশিষ্ট রইল না। একই মানুষ অফিসে বামপন্থী ইউনিয়নের সদস্য হিসেব, দিতে হবের আন্দোলনের শরিক আবার বাড়ি ফিরে তিনিই সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করেন। এইসব মানুষের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়ার কারণে গত কুড়ি বছরে একজন সুস্থ প্রতিভাবান শিল্পী খেলোয়াড় লেখক অথবা বুদ্ধিজীবীর আবির্ভাব হল না। বাঙালি মধ্যবিত্ত যদুবংশের মতো নিজেরাই জানে না তাদের আগামীকাল কী ভাবে আসবে।
কলেজ থেকে বেরিয়ে কলেজস্কোয়ারে এল ভরত। এখন বিকেল এবং আজ ছাত্র পড়ানো নেই। বাঙালির কোন ইতিহাস নাই, কোন ভবিষ্যৎ নাই তবু ইহারা এমন আস্ফালন করে যেন পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার আর কেহ নাই। ইহাদের কি বর্তমান আছে? আছে। প্রভাতে শয্যাত্যাগ করিয়া দুধ বাজার ইত্যাদি কর্ম সম্পন্ন করিয়া যে বর্তমান শুরু করে রাত্রিতে পুনরায় শয্যার ফিরিয়া যাওয়া পর্যন্ত তাহা শুধু অন্যের সমালোচনায় ব্যস্ত থাকে। অনেককাল আগে লেখা এক প্রবীণ লেখকের এই লাইনগুলো আজও সত্যি। লেখাটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কলেজ স্কোয়ারে ঢুকছিল ভরত সময় কাটাতে।
এখন মাত্র চারটে বাজে। ভরত যে চাতালে বসেছিল তার একপাশে কয়েকজন বৃদ্ধ বসে আছেন। জলের চারপাশে কিছু মানুষের ভিড়, এখন সাঁতারের সময় নয়। খানিকটা দুরে তিনজোড়া ছেলে-মেয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন। পৃথিবীতে আর কেউ আছে বলে ওদের বোধ নেই। ওরা কী কথা বলছে? একেই কি প্রেম করা বলে? তিনটে মেয়েই তেমন কিছু দেখতে নয়। ওরা এইরকম প্রেম করে বিয়ে করবে? ছেলেগুলো এখন এই সময়ে যখন প্রেম করছে তখন ধরে নেওয়া যায় চাকরিবাকরি করে না। যদি তার মতো টিউশনি করে ওরা তাহলে কী করে খরচ চালাবে? এই সব প্রশ্নের জবাব জানতে খুব ইচ্ছে করছিল ওর। এমন সময় আর একজন বৃদ্ধ। লাঠি হাতে এগিয়ে এলেন পাশে বসা বৃদ্ধের দিকে, খবর শুনেছেন মুখার্জি মশাই!
কোন খবর? রোগামতন বৃদ্ধ জবাব দিলেন।
জ্যোতি বাসুজি বিদেশ চললেন আবার।
এবার কোথায়?
লন্ডন, জেনেভা।
যাক, আমেরিকা নয়। রোগা বৃদ্ধ হাসলেন, এবার আর এন আর আই ধরতে যাচ্ছেন না।
বক্তৃতা দিতে। ওদেশের লোক ওঁর বক্তৃতা খুব শুনতে চায়।
মুখ্যমন্ত্রী হবার পর কতবার বিদেশে গেলেন?
কলেজস্কোয়ারে কতলোক রোজ আসে?
দুর মশাই, তা কি বলা যায়?
আমার কাছে ওঁর বাইরে যাওয়াও তাই।
জেনেভা। মানে সুইজারল্যান্ড। আচ্ছা মশাই এত ঘন ঘন সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার কী মানে বলুন তো? বিরাশি বছর বয়সে ওখানে গিয়ে কী লাভ?
বিরাশি। আমি এই আটাত্তরে জবুথবু হয়ে গেছি আর উনি বিরাশিতে পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছেন। এলেম আছে স্বীকার করতে হবে। ছবি দেখে মনে আমার ছেলের বয়সী। বাঙালির পলিটিক্যাল লিডার মাত্র তিনজন, সুভাষ বোস, বিধান রায়, আর জ্যোতি বাসুজি। এটা তো মানবেন?
পলিটিক্স! জ্যোতিবাবুর সঙ্গে পলিটিক্যাল পার্টির কোনো সম্পর্ক নেই।
এ্যাঁ? একি কথা! পশ্চিমবাংলায় বসে এই কথা বলছেন?
আজ্ঞে। ক্যুনিস্ট নেতা হলে তিনি চিনে যেতেন, কিউবায় যেতেন নিদেনপক্ষে রাশিয়ার। আমেরিকা বা সুইজারল্যান্ডে বাৎসরিক ভ্রমণে যেতেন না। আরে মশাই, কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী টিকে আছে ওঁর জন্যই।
তবু এই ঘন ঘন বাইরে যাওয়া খুব দৃষ্টিকটু।
এরকম হয়েই থাকে।
এটা তো উনি বানতলা নিয়ে বলেছিলেন।
মানছেন? বিদেশে যাওয়া তো বানতলার চেয়ে বড় অপরাধ নয়? পঁচিশ বছর আগে যে লোটা খেলোয়াড় ছিল তাকে যদি সরকার টাকা খরচ করে ওয়ার্ল্ড কাপ দেখাতে পাঠাতে পারে তাহলে জ্যোতিবাবুর বিদেশে যাওয়ার রাইট হাজারবার আছে। হ্যাঁ।
ভরত এইসব কথা চুপচাপ শুনছিল। হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল। পায়ে পায়ে বৃদ্ধদের সামনে পৌঁছে নমস্কার করল। একটি অল্পবয়সী ছেলেকে ওরকম ভদ্রভঙ্গি করতে দেখে বৃদ্ধরা একটু হকচকিয়ে গেলেন।
ভরত জিজ্ঞসা করল, আপনারা যদি কিছু মনে না করেন তাহলে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি? আমি এতক্ষণ আপনাদের আলোচনা শুনছিলাম।
একজন বৃদ্ধি জিজ্ঞাসা করলেন, কোন পার্টি কর ভাই?
আমি কিছুই করি না।
অ। তাহলে বলো।
আপনারা কেউ রাজনীতি করেন বা করেছেন?
বৃদ্ধরা মুখ চাওয়াচায়ি করলেন। দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ বললেন, না।
আপনারা কি সবাই চাকরি করতেন?
হ্যাঁ। শুধু উনি ব্যবসা করতেন। এখন ছেলেরা দ্যাখে।
ও। আপনারা সারাজীবন দেশের জন্যে কিছু করেছেন? এমন কিছু যাতে দেশের মানুষের উপকার হয়। এদেশে বাস করে যা পেয়েছেন তার বদলে কিছু কি ফিরিয়ে দিয়েছেন?
হঠাৎ এই প্রশ্ন?
আমার মনে হয় করেননি। ব্যাপারটা কি জানেন, আমি জ্যোতি বসুর সমর্থক নই। কিন্তু তিনি দীর্ঘকাল ধরে দেশের মানুষের জন্যে কাজ করছেন, এই বয়স পর্যন্ত করে যাচ্ছেন। তাই ওঁর সমালোচনা করার আগে নিজেদের দিকে তাকান। এখনও এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ ওঁর ওপর ভরসা রাখে। কোনও কারণ ছাড়াই তো সেটা সম্ভব নয়। ভরত নমস্কার করে হাঁটতে শুরু করল। একজন বৃদ্ধের মন্তব্য কানে এল, পার্টির সাপোর্টার।
আর একজন মন্তব্য করলেন, নিতম্বপক্ক।
ভরত হেসে ফেলল। ঝগড়া করে কোনও লাভ নেই। ওদের বলা যেত আপনাদের জন্যেই আমাদের এই অবস্থা। আপনাদের দেশ সম্পর্কে, মানুষ সম্পর্কে নিস্পৃহতা, উদাসীনতার খেসারত আমাদের দিতে হচ্ছে। আমি আলাদা আর দেশ আলাদা এই মানসিকতাই এখন ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু এরা স্বীকার করবেন না। এঁরা রাজনৈতিক দলগুলোকে দোষ দেবেন। কিন্তু জনসাধারণ সুযোগ দিচ্ছে বলেই রাজনৈতিক দলগুলো করে খাচ্ছে। অবস্থা এমন, সুযোগ না দিয়েও উপায় নেই। পেটে খাবার দিনের পর দিন না পড়লে অশক্ত বাবা হয় আত্মহত্যা করে নয় মেয়ের অসৎপথে রোজগার করা টাকায় খেতে আপত্তি করে না।
অসৎ শব্দটি মনে আসতে হেসে ফেলল ভরত। সৎ এবং অসৎ-এর সংজ্ঞা নিয়ে যখন কেউ একমত হবে না তখন শেষ রায় কে দেবে? ভরত কলেজ স্কোয়ারের এক পাশে একটু নির্জনে একজোড়া মানবমানবীকে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখল। সে দাঁড়াল। ছেলেটির বয়স বছর তেইশের বেশি হবে না, মেয়েটি কুড়ি একুশ। ছেলেটিকে খুব সচ্ছল পরিবারের বলে মনে হচ্ছে না, মেয়েটির শরীরে উগ্রভাব আছে এবং নিম্নবিত্তচিহ্ন স্পষ্ট। ভরত ওদের সামনে এগিয়ে গেল।
ওরা তন্ময় হয়ে কথা বলছিল। হঠাৎ সামনে কাউকে দেখে ছেলেটি সচেতন হয়ে বলল,, না, আমাদের কিছু দরকার নেই, অন্য জায়গায় দেখুন।
ভরত অবাক হয়ে গেল, তার মানে?
আপনি তো কিছু বিক্রি করতে এসেছেন? ছেলেটি জানতে চাইল।
না তো!
ও! তাহলে?
আপনারা যদি কিছু মনে না করেন তাহলে কয়েকটা কথা বলতে চাই। ভরত হাসল।
কী ব্যাপার?
আগে বলুন ডিস্টার্ব করছি না তো!
ছেলেটি মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটির মুখচোখে কৌতূহল।
ঠিক আছে! ছেলেটি যেন বাধ্য হল শব্দদুটো উচ্চারণ করতে।
ভরত ওদের সামনে ঘাসে বসে পড়ল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনারা কি পরস্পরের আত্মীয়?
আত্মীয়? না তো!
তাহলে।
বন্ধু।
ও। আপনারা খুব মগ্ন হয়ে কথা বলছিলেন। শুধু আপনারাই নন, আপনাদের মতো যেসব ছেলেমেয়ে এখানে আলাদা হয়ে বসে আছে তাদের সবাইকে আমি একই ভঙ্গিতে কথা বলতে দেখেছি। আচ্ছা, আপনারা এতক্ষণ ধরে কী কথা বলেন? ভরত সরল গলায় জিজ্ঞাসা করল।
আপনি কে? ছেলেটা শক্ত হল, খবরের কাগজের রিপোর্টার?
শোনামাত্রই মেয়েটা বলে উঠল, দয়া করে আমাদের কথা কাগজে লিখবেন না।
বিশ্বাস করুন, আমি রিপোর্টার নই। কোথাও লিখি না।
তাহলে নিশ্চয়ই সার্ভে করতে এসেছেন কোনও কোম্পানির থেকে। কেটে পড়ুন।
না, সার্ভে করতে আসিনি। আমি প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র।
ও। ছেলেটা বেশ অবাক হল, কী প্রশ্ন আছে?
আপনারা আত্মীয় নন, বন্ধু নন আবার ওইরকম, আপনারা কি প্রেমিক-প্রেমিকা?
প্রশ্ন শুনে ছেলেটি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে একগাল হাসল। মেয়েটা যেন লজ্জা পেয়েছে এমন ভাব দেখিয়ে একবার মাথা নিচু করে আড়চোখে তাকাল।
ছেলেটি বলল, হ্যাঁ। আমরা লাভার।
কতদিন ধরে আপনারা এভাবে দেখা করে কথা বলছেন?
ছেলেটি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল, একবছর হয়ে গেল, না?
মেয়েটি চুপচাপ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
আপনারা কি পরস্পরের পরিবারকে চেনেন?
আলাপ নেই। তবে আমরা কে কোথায় থাকি তা জানা হয়ে গেছে।
কীভাবে আলাপ?
সিনেমা দেখতে গিয়ে। ও বন্ধুদের সঙ্গে এসেছিল।
ও। আপনাদের পরের স্টেপ কী?
স্টেপ মানে?
একবছর তো হয়ে গেল, এরপর আপনারা কী করবেন?
ছেলেটি হাসল, লোকে যা করে, বিয়ে করে একসঙ্গে থাকব।
বিয়ে কবে করছেন?
আগে একটা চাকরি পাই তবে তো বিয়ে। চাকরির বাজার তো জানেন। বি.এ পাশ করে বসে আছি। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকেও কল আসছে না।
ধরুন যদি কল না আসে, যদি চাকরি না পান!
তা কী হয়, পেয়ে যাব।
ধরুন পেলেন। কিন্তু মাইনে এত কম যে একজনেরই ভাল করে চলবে না।
তাহলে অপেক্ষা করব।
এইভাবে দেখা করবেন?
হ্যাঁ। তা তো নিশ্চয়ই।
কতদিন?
যতদিন না একটা ব্যবস্থা হচ্ছে।
তদ্দিনে যদি ওঁর বয়স বেড়ে যায়!
এইসময় মেয়েটি ফোঁস করে উঠল, অসম্ভব। আমি আর একবছর অপেক্ষা করতে পারি। বাড়ি থেকে একটার পর একটা সম্বন্ধ দেখছে। চাপ দিচ্ছে খুব। তুমি সত্যি কথাটা বলছ না কেন? মেয়েটি ছেলেটির হাতে চাপ দিল।
কোন কথাটা?
ওই যে দুর্গাপুরে তোমার যে মামা থাকেন, তিনি চাকরি দেবেন!
হ্যাঁ। আমার মামা আমাকে চাকরি পাইয়ে দেবেন বলে কথা দিয়েছেন।
ভরত জিজ্ঞাসা করল, ওঁর কি চাকরি দেবার ক্ষমতা আছে?
ঠিক ওঁর নেই, তবে ওঁর জানাশোনা লোকের আছে।
কিন্তু ধরুন, উনি পারলেন না, তখন?
আমি তো নিজেও চেষ্টা করছি।
এবার মেয়েটি খেপে গেল, তুমি বলেছিলে দুর্গাপুরে চাকরি হবেই। এখন আবার উল্টো গাইছ কেন? মিথ্যে বলেছ নাকি?
ছেলেটি রেগে গেল, আপনি কাটুন তো! আমাদের মধ্যে ঝামেলা বাধাচ্ছেন!
ভরত বলল, এক মিনিট। যদি উনি এক দেড় বছরের মধ্যে চাকরি না পান তাহলে বাড়ির ঠিক করা পাত্রকে মেনে নেবেন?
কী করব! চিরকাল তো আইবুড়ো হয়ে বসে থাকতে পারব না। বাবারও বয়স হচ্ছে।
তাহলে আপনাদের প্রেম?
মেয়েটি মাথা ঝাঁকাল, ও যদি দায়িত্ব নিতে না পারে তাহলে। থেমে গেল সে। ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কিন্তু এখন সন্দেহ হচ্ছে তুমি খালি গুল মেরে গেছ আমাকে।
সন্দেহ হচ্ছে! একটা অচেনা লোক এসে কী বলল আর সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহ হলো? এই তুমি আমাকে বলেছ দরকার হলে গাছের তলায় একসঙ্গে থাকবে সারাজীবন। ছেলেটি খেঁকিয়ে উঠল।
মরে যাই। তাই বলে কি সারাজীবন এখানে বসে ঘাস ছিঁড়ব? মেয়েটি উঠে দাঁড়াল।
আরে যাচ্ছ কোথায়? মেয়েটিকে হাঁটতে দেখে ছেলেটি ব্যস্ত হয়ে তাকে অনুসরণ করল।
কীরকম হয়ে গেল। কয়েকটা স্বাভাবিক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ওদের দুজনের মুখোশ আচমকা খসে গেল। ঘাসে বসে ভরত ভাবতে লাগল। ওদের দুজনের কেউ শিশু নয় কিন্তু ওরা কি নিজেদের আসল চেহারা দেখতে পায়নি? ছেলেটির পক্ষে এখনই চাকরি পাওয়া মানে লটারির টাকা পাওয়ার মতো ঘটনা। সেই চাকরি না পেলে ও বিয়ে করতে পারবে না। ওর বাড়িতে নানা অভাব থাকতে পারে কিন্তু প্রেম করার কারণে তাকে চাকরি পেলে বিয়েটাকেই প্রায়রিটি দিতে হবে সবাইকে বঞ্চিত করে। আর চাকরি না পেলে সবসময় অনিশ্চয়তা আর তা সত্ত্বেও ও একবছর ধরে প্রেম করছে। এদিকে মেয়েটি অপেক্ষা করছে কিছুটা সময়ের জন্যে। তার মধ্যে ছেলেটি যদি চাকরি পেয়ে বিয়ে না করে তাহলে প্রেমের ইতি ঘটিয়ে দেবে সে। অথচ প্রেমপর্ব চলাকালীন দুজন দুজনকে আকাশচুম্বী প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। তাহলে কি মানুষ মানুষী প্রেমে পড়লে একগাদা মিথ্যে কথা বলে যায়?
এক্সকিউজ মি!
গলা পেয়ে ভরত দেখল আর একজোড়া ছেলে মেয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এদের পোশাক, মুখের চেহারা বলে দেয় বিত্তবান পরিবারে বাস করে।
ভরত বলল, বলুন।
আপনি কি এখানে অনেকক্ষণ বসে থাকবেন? ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল।
কেন বলুন তো?
আসলে আজ এখানে বড্ড ভিড়। বসার জায়গা পাচ্ছি না। আপনি যদি কারও জন্যে এখানে অপেক্ষা না করেন তাহলে আমরা বসতে পারি।
বসুন। ভরত উঠে দাঁড়াল।
আপনাকে কিন্তু আমরা যেতে বলিনি।
আমি থাকলে আপনাদের কথা বলতে অসুবিধে হবে। ভরত হেসে হাঁটা শুরু করতেই শুনতে পেলে মেয়েটি বলছে, দ্যাখো, তোমার চেয়ে অনেক বেশি প্রাকটিক্যাল!
.
বাস স্টপে এসে দাঁড়িয়েছিল ভরত। তার মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিক-প্রেমিকাকে যদি কেউ এরকম ইন্টারভিউ করত তাহলে যে ছবিটা কমন হত তা অনিশ্চয়তার। হয়তো প্রেম প্রকাশের পরের দিন থেকেই সবাই একটা না একটা সমস্যার শিকার হয়। তাই নিয়ে বিব্রত হয়ে থাকে। এর ওপর পরস্পরের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন এসে গেলে তো কথাই নেই। তবু প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ প্রেমে পড়ছে। রাধা কৃষ্ণের মত দুজনে আলাদা থেকে প্রেম করতে কেউ কি এখন চায়?
দার্শনিক মশাই-এর খবর কি! দার্শনিক বলব না বিপ্লবী?
মুখ ঘুরিয়ে সুদেষ্ণাকে হাসতে দেখল ভরত। সুদেষ্ণা একা।
তুমি?
কেন? আমি এখানে আসতে পারি না?
গাড়ি এবং বন্ধুবিহীন অবস্থায় তোমাকে ঠিক মানায় না।
ওয়েল ভরত, আমাকে কিসে মানায় তা দেখছি আমার চেয়ে তুমি বেশি জানো।
অস্বীকার করতে পার?
নিশ্চয়ই। কারণ এই মুহূর্তে আমি একা এবং সঙ্গে গাড়ি নেই। সুদেষ্ণা হাসল।
কোথায় চললে?
ইউনিভার্সিটিতে এসেছিলাম। এবার ফিরব। তুমি?
কলেজ স্কোয়ারে সময় কাটাতে গিয়েছিলাম। প্রথমে বুড়োদের আলোচনা শুনলাম, তারপরে দুজন প্রেমিক-প্রেমিকাকে ইন্টারভিউ করলাম।
ফ্যান্টাস্টিক। এরকম তো কখনও শুনিনি। কী মনে হলো?
প্রেম একটা নেশার মতো। জর্দা সিগারেট মদ এবং প্রেম একই বস্তু। ইফ ইউ কল প্রেম একটা বস্তু! খেতে ভাল লাগে, মৌজ হয় হয়তো কিন্তু আলটিমেটলি ক্ষতি করে। ভরতের মনে হলো ঠিকঠাক বোঝাতে পেরেছে।
মাইগড! সাহিত্যিকরা এত লিখেও যেটা বোঝাতে পারছেন না তুমি একটা ইন্টারভিউ করে তা বুঝে গেলে! সুদেষ্ণা চোখ বড় করল।
আমি আমার মতো বুঝেছি।
তোমার বোঝাটাই সঠিক?
যতক্ষণ বেঠিক কিছু না পাচ্ছি। নিজের সঙ্গে খেলা করার নাম প্রেম।
বাঃ। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা। তুমি কখনও প্রেমে পড়নি?
না। আগে চালাক ছিলাম না এখন চোখ খুলে গেছে।
তোমার বাড়িতে নাকি গোলমেলে আবহাওয়া?
হ্যাঁ। আমি বাড়ি থাকি কিন্তু নিজের মতো থাকি। ভরত বলল, চলি।
খুব জরুরি কাজ আছে?
না। আজ টিউশনিও নেই। বেকার।
তুমি টিউশনিও কর?
হ্যাঁ। বাবার দুনম্বরি টাকা যত কম নিতে পারি তত নিজেকে নির্মল মনে হয়।
সুদেষ্ণা অবাক হয়ে ভরতের মুখ দেখল। তাকে কি রকম বিচলিত দেখাচ্ছিল। সে বলল, তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমাদের বাড়িতে আসবে?
কেন?
কেন যাবে? মানুষ মানুষের বাড়িতে কেন যায়?
তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?
আশ্চর্য। কারা আছেন জানার ওপর তোমার যাওয়া নির্ভর করবে?
তা ঠিক নয়। ঠিক আছে, চলো। তোমার গাড়ি কোথায়?
আজ গাড়ি আনিনি।
ওরা বাসে উঠল। উল্টো পথ বলে বাসে ভিড় কম ছিল। সুদেষ্ণা বসার জায়গা পেলেও বসল না। ভরত জিজ্ঞাসা করল, বসবে না?
সুদেষ্ণা হাসল, না। ছারপোকা আছে।
কী?
প্রাইভেট বাসগুলোতে প্রচুর ছারপোকা ঘুরে বেড়ায়। ওগুলোকে বাড়িতে বয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। সুদেষ্ণা আবার হাসল, আমি তোমার চেয়ে দুর্বল নই। তুমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে আমি পারব না কেন? মহিলা না উঠলে কোনো দুর্বল পুরুষ ওখানে বসুক।
বাস থেকে নেমে ওরা হাঁটছিল। জায়গাটায় ভাল ভিড়। স্কুলের বাচ্চারা যাচ্ছে। হঠাৎ একটা অ্যাম্বাসাডার গাড়িকে দ্রুতগতিতে আসতে দেখল সে। গাড়ির শরীর থেকে গলগল করে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। বাচ্চাগুলো নাকমুখ চেপে কুঁকড়ে গেল সেই ধোঁয়ায়। এই দৃশ্য কলকাতার রাস্তায় অত্যন্ত স্বাভাবিক। ট্যাক্সি, মিনিবাস এবং বাসের ড্রাইভাররা এইভাবে কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে যাচ্ছে শহরে কিন্তু কেউ কিছু বলে না। হঠাৎ মাথার ভেতর সেই আগুনটা জ্বলে উঠতেই ভরত তাকিয়ে রাস্তায় নেমে দুহাত ছড়িয়ে গাড়িটাকে থামতে বলল। গাড়ি গতিতে ছিল, ফলে ড্রাইভারকে আচমকা ব্রেক কষতে হলো। গাড়ি থামিয়ে লোকটা গালগাল দিল।
ভরত ছুটে গেল পাশে, কী বললেন আপনি?
এইভাবে লাফিয়ে পড়লেন কেন? অ্যাকসিডেন্ট হলে তো লোকে আমাকে ছাড়ত না।
আপনি গাড়ি থেকে নামুন।
কেন? নামব কেন?
আপনার গাড়ি থেকে যে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে তা ওই বাচ্চাদের ফুসফুস নষ্ট করছে, শহরটারও বারোটা বাজাচ্ছে। একথা আপনি জানেন?
ও এই কথা! ডিজেল গাড়ি থেকে ধোঁয়া বের হবেই।
তার মানে? সব ডিজেল গাড়ি থেকে এইরকম ধোঁয়া বের হয়?
নতুন ইঞ্জিন, ভাল ইঞ্জিন হলে বের হয় না। পুরনো হয়ে গেলে হবে।
তাহলে ইঞ্জিন সারান না কেন?
মালিককে গিয়ে বলুন সেকথা। আমি ড্রাইভার!
বাঃ, আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন, আপনি বলবেন না?
মালিক অন্ধ নন। তিনি জানেন। আরে মশাই, সমস্ত কলকাতার লোক ডিজেলের ধোঁয়া মেনে নিয়েছে আর আপনি এসে নাটক করছেন!
ঠিক আছে। ব্যাপারটার ফয়সালা থানায় গিয়ে হবে। থানায় চলুন।
ইয়ার্কি! থানায় যাব কেন?
ভিড় জমে গিয়েছিল। ভরত খুশি হল জনতা তাকে সমর্থন করছে দেখে। কলকাতার আবহাওয়া বিষাক্ত করার জন্য মোটরওয়ালাদের বড় অংশ দায়ী একথা অনেকেই বলতে লাগল ড্রাইভার বেশ ঘাবড়ে গেল কথাবার্তা শুনে। বলল, দাদা, আমার কোনও দোষ নেই। আমি মাইনে নিয়ে গাড়ি চালাই। মালিক যদি গাড়ি না সারায় তাহলে আমি কী করব?
আপনি থানায় চলুন। ভদ্রভাবে বলছি।
এইসময় একটা পুলিশ ভ্যান হাজির হলো। একজন সাবইন্সপেক্ট এগিয়ে এলেন, কী হয়েছে এখানে, ভীড় কেন?
ভরত উৎসাহিত হলো, এই লোকটির গাড়ি থেকে অবিরত কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। দূষণ করার অপরাধে আপনি এর বিরুদ্ধে স্টেপ নিন।
ড্রাইভার বলল, সার, আমার কোনও দোষ নেই।
কার গাড়ি? অফিসার জানতে চাইলেন।
হরিরাম মেহতা।
চলুন থানায়। গাড়ি রেখে মালিককে ডেকে পাঠাবেন।
স্যার!
কথা বাড়াবেন না। এঁরা যখন বলছেন তখন থানায় যেতে হবেই। পশন ফ্রি সার্টিফিকেট আছে? কবে চেক-আপ করেছেন?
গত সপ্তাহে। ড্রাইভারের খেয়াল হতে দ্রুত গাড়ির ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ বের করে অফিসারের হাতে তুলে দিল। অফিসার সেটাকে পরীক্ষা করে মাথা নাড়লেন, নো৷
ভরত জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?
অফিসার বললেন, এই সার্টিফিকেট অনুযায়ী ওই গাড়ির বিরুদ্ধে অমি কোনও ব্যবস্থা নিতে পারি না। ওকে বলতে পারি আর একবার গ্যারেজে নিয়ে যেতে। কিন্তু এই সার্টিফিকেট এখনও অনেকদিন গাড়িটাকে নির্দোষ বলছে। বুঝতেই পারছেন সাত দিন আগে যদি পরীক্ষা করা হত তাহলে এই সার্টিফিকেট কেউ দিত না। অথচ এরা সাত দিন আগেই সার্টিফিকেট পেয়েছে। সম্ভবত গাড়ি পরীক্ষা না করিয়েই পেয়েছে। কলকাতায় এখন এটা হচ্ছে।
ভরত বলল, আপনি ওকে স্টার্ট নিতে বলুন দেখবেন গলগল করে ধোঁয়া বের হচ্ছে।
আমার কিছু করার নেই ভাই। সার্টিফিকেট ফিরিয়ে দিয়ে ভ্যানে উঠে বসলেন অফিসার। ভ্যান চলতে শুরু করতেই ড্রাইভার চেঁচিয়ে উঠল, ওই দেখুন, পুলিশের ভ্যান থেকেই ধোঁয়া বের হচ্ছে। ধরতে হলে ওদেরও ধরুন।
পুলিশ ভ্যান থেকেও ধোঁয়া বের হচ্ছিল কিন্তু অল্প বেরিয়েই বন্ধ হয়ে গেল। ওই দিকে সবার মনোযোগ থাকায় ড্রাইভার গাড়ি চালু করে এগোতেই বলব বলব করেও কেউ কিছু বলতে পারল না। আবার ধোঁয়ায় কলুষিত হল কলকাতা।
এই গাড়িকে যারা দূষণমুক্ত সার্টিফিকেট দিয়েছে তারা কলকাতার হত্যাকারী। ভরত ভেবে পাচ্ছিল না টাকা দিয়ে যদি সার্টিফিকেট কেনা যায় তাহলে ওই নিয়মটা রাখার কী দরকার? সে মাথা নিচু করে ফিরে এল সুদেষ্ণার কাছে।
সুদেষ্ণা এতক্ষণ চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। ভরত বলল, দেখলে?
ওর গলায় এমন কিছু ছিল যে সুদেষ্ণার খারাপ লাগল, আমি তোমার আগে কাউকে এভাবে প্রতিবাদ করতে দেখিনি।
কী লাভ হল। সবাই একটা না একটা অজুহাত পকেটে পুরে রাস্তায় বের হয়। যদি গভর্নমেন্ট কিছু না করে তাহলে সাধারণ মানুষ এইভাবে খতম হয়ে যাবে। ভরত বলল, দেখেশুনে আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়।
হাঁটতে হাঁটতে সুদেষ্ণা বলল, এই যে তুমি প্রতিবাদ করলে এর নিশ্চয়ই দাম আছে।
দাম আছে? লোকটা আবার ধোঁয়া ছড়াল?
হ্যাঁ। কিন্তু অতগুলো লোক জানল এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যায়। এরপর এদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই সেটা করবে। পাড়ায় গিয়ে গল্প করবে আজকের ঘটনা নিয়ে। আর ওই ড্রাইভার তার মালিককে নিশ্চয়ই রিপোর্ট করবে। লোকটা ভাববে গাড়িটাকে সারাবার কথা।
এসব আশাবাদের কথা।
আমি এখনও আশাবাদী।
.
গেটওয়ালা বাড়ির ভেতরে বাঁধানো চাতাল। ভরত দেখল এবং বুঝল সুদেষ্ণারা বেশ অবস্থাপন্ন। দোতলায় যে হলঘরটিতে তাকে বসানো হলো সেটি মূল্যবান আসবাবে সাজানো। এই ঘরের সঙ্গে ফ্ল্যাটবাড়ির বড়লোকি ড্রইংরুমের তফাত অনেক। এই ঘরের আসবাবের কিউরিও ভ্যালু প্রচুর। অভিজাত বাড়ির আবহাওয়া সর্বত্র।
সুদেষ্ণা বলল, আগে বাবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই এসো।
আমি যাব?
হ্যাঁ। বাবা এখন তার স্টাডিতে। খুব কুঁড়ে, এখানে আসবে না। সুদেষ্ণা বলল, নাকি চা খেয়ে তারপর যাবে?
ভরত গম্ভীর মুখে বলল, আমার বাবাদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
ওমা, কেন?
আমার দেখা বাবাশ্রেণির মানুষগুলো হিপোক্রিট হয়।
অর্থাৎ।
নিজেরা যা করেনি, নিজে যা বিশ্বাস করে না তাই করতে জ্ঞান দেয় ওরা।
বেশ তো! এই নিয়েই কথা বলা যেতে পারে। এসো।
সুদেষ্ণা যে ঘরে নিয়ে গেল সেই ঘরে প্রচুর বই। আলমারির বাইরে মেঝের ওপরও তারা স্কুপ হয়ে পড়ে আছে। একজন প্রৌঢ় মোটাসোটা ফরসা মানুষ, চোখে চশমা, পরনে গেঞ্জি আর পাজামা, বাবু হয়ে বসে একটা বই-এর পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। সুদেষ্ণা ডাকতেই মুখ না ফিরিয়ে বললেন, আজকের মতো অভিযান শেষ?
হ্যাঁ।
গাড়ি নিয়ে যাওনি?
না।
গুড। তোমার মাতৃদেবী কোর্ট মার্শাল করবেন। তৈরি থেকো।
বাবা, এর নাম ভরত।
ভদ্রলোক মুখ ফেরালেন, ইন্টারেস্টিং। হাঁটু মুড়ে বসতে পারবে? তাহলে ওখানে বসে পড়। পড়। ভরত। বঙ্গসন্তান?
হ্যাঁ ভরত বসে পড়েছিল।
এই নামটি বাঙালিদের পছন্দ নয়। ইন ফ্যাক্ট রামায়ণের পুরুষ চরিত্রের নামগুলো বাঙালি কোনওকালে গ্রহণ করেনি। এককালে রামচন্দ্রকে সামান্য নিয়েছিল কিন্তু দশরথ, লক্ষণ, শত্রুঘ্ন বা বিশ্বামিত্র তো নয়ই। গত তিরিশ বছরে রামচন্দ্রকেও বাতিল করেছে। তাদের ঝোঁক মহাভারতের পুরুষচরিত্রের প্রতি। মেয়েদের বেলাতে অতটা নয়, যেমন সরমা ঊর্মিলা তো আছেই, একসময় সীতা খুব চালু ছিল। কিন্তু মহাভারতের মেয়েরা বাঙালি পরিবারে ছড়িয়ে আছে। ভদ্রলোক বললেন, রামায়ণের পুরুষের নামগুলো ইউ পি বিহারে খুব চালু তাই তুমি বঙ্গসন্তান কি না। প্রশ্ন করেছিলাম। নিজেকে ভরত ভাবতে তোমার কেমন লাগে?
ভাল। কারণ আমার নাম ভরত।
আমি রামায়ণের ভরতের কথা বলছি!
তার কথা আমোক ভাবতে যাব কেন? জ্ঞান হবার পর শুনে আসছি আমার নাম ভরত। অন্য কিছু শুনলে সেটাকে মেনে নিতাম, ভাল লাগাতাম।
তার মানে তোমার নিজস্ব কোনো ভাবনা নেই?
ভরত প্রৌঢ়ের দিকে তাকাল, আপনি শুনতে চান বলতে পারি।
নিশ্চয়ই।
দেখুন আমি নিজের ইচ্ছেতে পৃথিবীতে আসিনি, বাবা-মাকে পছন্দ করার কোনও সুযোগ আমি পাইনি। কোনও মানুষই পায় না। এটা মেনে নিতে হয়। শৈশব এবং বাল্যকালে স্কুলে এবং বাড়িতে আমাকে যা পড়তে বলা হয়েছিল আমি পড়েছি, মেনে নিয়েই পড়েছি। করার পর বাবা-মা চেয়েছিলেন আমি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হই, ওই প্রথম আমি মেনে নিইনি। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে দেখলাম আমি এক দারুণ সুবিধেবাদী স্বার্থপর মানবসমাজে বাস করছি যা চারপাশে মানুষেরা চুপচাপ মেনে নিয়েছে। এই ধান্দাবাজ জীবনযাপনের বিরুদ্ধে একা লড়াই করতে গেলে প্রতি পায়ে ঠোকর খেতে হবে। কিছু কিছু জায়গায় প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমি হাস্যাস্পদ হয়েছি। আমার নিজস্ব ভাবনা এক্ষেত্রে শুধু দুঃখ বাড়াচ্ছে।
যেমন?
কোনটে বাদ দিয়ে কোনটে বলব? ধরুন, একটি রাজনৈতিক দল তাদের আদর্শের কথা বলে কংগ্রেস বিরোধিতা করে দেশের মানুষের কাছে ভোট চাইল। মানুষ তাদের সমর্থন করল। সেই দলের কাছে কংগ্রেস থেকে সরে আসা এক সুবিধেবাদী সমর্থন চাইল রাজ্যসভায় যাবে বলে। অবাক হয়ে দেখলাম গণতান্ত্রিক দলটি লোকটাকে সমর্থন করল। নির্বাচিত হবার কিছুদিন পরে ওই সুবিধেবাদী আবার কংগ্রেসে ঢুকে গেল। দেশের মানুষের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার নেই কেন তোমরা ওই সুবিধেবাদীর চরিত্র জেনেও সমর্থন করলে। তোমাদের সমর্থন কি আমাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা নয়?
তুমি কি রাজনীতি কর?
না। ধান্দাবাজ ছাড়া এদেশে কেউ রাজনীতি করতে পারে না।
তাহলে দেশের দায়িত্ব ধান্দাবাজদের হাতে ছেড়ে দিতে চাও তুমি?
আমি চাই বা না চাই সেটাই হচ্ছে।
তোমার কথার উত্তরে বলছি, সত্যিকারের ভাল ছেলে, যারা দেশের মঙ্গল চায় তারা যদি রাজনীতি করে তাহলে ধান্দাবাজরা সরে যেতে বাধ্য হবে।
ভরত ভদ্রলোকের দিকে তাকাল। সুদেষ্ণার বাবা হাসলেন, বিধানচন্দ্র রায়কে কেউ ধান্দাবাজ বলতে পারত না। এমন কি জ্যোতি বসুর বিরুদ্ধে যে অভিযোগই থাকুক না কেন তাকে ধান্দাবাজ বলা চলবে না। তুমি পরের সারির অথবা নিচের দিকের কিছু নেতা সম্পর্কে ওই কথা বলতে পার। কংগ্রেসিদের যে চেহারা আমরা কাগজে দেখতে পাই তা যদি সত্যি হয় তাহলে ওই গালাগাল তাদের প্রাপ্য। কিন্তু কিছু ভাল মানুষ কংগ্রেসেও আছেন। বলতে পার সংখ্যায় কম।
ভরত বলল, তারা কিছুই করতে পারবেন না। দল তাদের জগন্নাথ করে রেখে দিয়েছে। এদেশে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। যার হাতে টাকা আছে সে সব কিছু দখল করে বসে আছে। একজন কৃষকের জমি কেড়ে নিলে সে আদালতে যেতে পারবে না টাকার অভাবে। শাসক দলের সদস্য না হলে পার্টি অফিস তাকে সমর্থন করবে না। এই গণতান্ত্রিক দেশের ভোটার ওই কৃষক।
তাহলে তোমার সমস্ত ক্রোধ শাসক রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে?
না। মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ রাজনৈতিক দলগুলো। যদি আজ পশ্চিমবাংলার সবকটা বিধানসভার আসনে প্রকৃত দেশপ্রেমিক প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে কোনও নতুন দল সুস্থ পরিবেশ তৈরি করতে চায় তাহলে জনসাধারণ তাদের সমর্থন করবে না। কারণ তারাও জেনে গিয়েছে ভালমানুষির স্থান রাজনীতিতে নেই। আদর্শবাদী দল ক্ষমতায় এলে তাদের নিজেদেরই অসুবিধে হবে।
যেমন?
ধরুন, কলকাতার একটি লোকের রেশন কার্ড আছে। কিন্তু সে চাল নেবে না কিন্তু রেশন থেকে চিনি নেবে। কারণ রেশনের চাল খেতে তার ভাল লাগে না তাই বেশি দামে বাজার থেকে ভাল চাল কিনবে। কিন্তু বাজার থেকে চিনি কিনবে না কারণ রেশনে একই চিনি সস্তায় পাওয়া যায়। ওই যে সুবিধেবাদী চরিত্র সর্বত্র। কোন সরকার যদি বলে কার্ডে যা যা পাওয়া যায় তাই নিতে হবে নইলে চিনি দেওয়া হবে না তাহলে সেই সরকারকে অত্যন্ত অপছন্দ করবে মানুষ।
তুমি এসব নিয়ে খুব ভাবো?
খুব ভাবি না। তবে চোখ খুললেই যা দেখি তাতে এসব ভাবনা আপনা-আপনি আসে। আমাদের সঙ্গে একটি ছেলে পড়ে। সে মাঝারি ছাত্র ছিল। পঞ্চাশ বাহান্ন পেত। পরীক্ষার সময় একটি রাজনৈতিক দলের সৌজন্যে ওদের পরীক্ষাকেন্দ্রে গণটোকাটুকি হল। ছেলেটি আশি নম্বর পেয়ে গেছে অনায়াসে। সারাবছর খেটে ওর চেয়ে ভাল ছাত্র ওই নম্বর পায়নি। একে সবাই মেনে নিচ্ছে। আমার মানতে কষ্ট হয় কিন্তু কিছুই করার উপায় নেই।
এসবের জন্যে দায়ী কে?
ভরত ভদ্রলোককে দেখল, আপনারা।
কী রকম? একটুও অবাক হলেন না সুদেষ্ণার বাবা।
আপনাদের মেরুদণ্ডহীনতায় স্বাধীনতা সম্পর্কে উদাসীনতাই দেশটাকে এরকম ধান্দাবাজ করে তুলেছে। আপনারাই বাধ্য করেছেন আমাদের বেঁচে থাকতে হলে ধান্দাবাজ হতে। নিজের স্বার্থ ছাড়া আপনারা কোন চিন্তাই করেননি। তারই পরিণতিতে আজ এই অবস্থা। মুশকিল হলো, আশেপাশের কাউকেই আমরা এখন শ্রদ্ধা করতে পারি না। কেউ ভাল কিছু করছে দেখলে ভাবি এর পেছনে মতলব আছে।
তুমি ঠিকই বলেছ। আমরাই দায়ী। তোমাদের সামনে আমরা কোনও ভাল ছবি রাখতে পারিনি। আমরা ছেলেবেলায় অনেক বড়বড় কথা বইতে পড়তাম। গুরুজনরা বলতেন আদর্শবান হতে। অন্যায়কে অন্যায় বলতে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে ঈশ্বর। বাপ ঠাকুর্দা যখন বলতেন বাঙালির ঐতিহ্য আছে, সংস্কৃতি আছে তখন সেটাকে বিশ্বাস করতাম। বয়স্করা অন্যায় কিছু বললে তার মুখের ওপর প্রতিবাদ করতাম না কারণ তাতে তাকে অপমান করা হত। আমরা কুষ্ঠি বিচার করে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতাম, তাদের কোয়ালিটি বিচার করতাম না। আমার ছেলের হাঁপানি থাকলেও বিয়ে দেবার সময় সুস্থ সুলক্ষণা মেয়ে খুঁজতাম যার ভাগ্য আমার ছেলের অসুখ সারাবে। তার পরিণতিতে যা হবার তাই হয়েছে। কিন্তু, এই দেশ আমাদের দেশ। এখানেই আমাদের বাস করতে হবে। আমি তুমি যা করতে পারব না সময় তা পারবে। অন্যায়ের ছুরির কোনও বাঁট থাকে না, যাকে মারে সে যেমন আহত হয় যে মারে তার হাতও রক্তাক্ত হয়। এই ব্যবস্থা তাই চিরদিন চলতে পারে না।
আপনি আশার কথা বলছেন।
হ্যাঁ। কারণ আশা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। সুদেষ্ণার বাবা হাসলেন, তোমার সঙ্গে কথা বলে আমার ভাল লাগল। তোমাকে কি মাঝে মাঝে আশা করতে পারি?
ভরতের খেয়াল হলো, এই প্রথম কোন বয়স্ক লোক তার সান্নিধ্য চাইছেন, এই প্রথম কোনও অভিভাবক তার ক্রোধের কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন।
সে বলল, আসব। আচ্ছা, সুদেষ্ণাকে আপনার কী রকম মনে হয়?
সুদেষ্ণা এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল, চমকে উঠে বলল, আরে। আবার আমাকে কেন?
তোমার কীরকম মনে হয়? সুদেষ্ণার বাবা জিজ্ঞাসা করলেন।
ওর সম্পর্কে আমার ভাল ধারণা ছিল না। বড়লোকের মেয়ে, গাড়িতে করে যাতায়াত করে, একগাদা ছেলে বন্ধু, জীবন সম্পর্কে উদাসীন বলেই মনে হত।
মনে হত? এখন হচ্ছে না?
পুরোটা নয়।
ভদ্রলোক হাসলেন, বড়লোকের মেয়ে হওয়া কারও ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে না। আমার পারিবারিক সূত্রে প্রচুর সম্পত্তি আছে। কিন্তু একটাই খরচ আমার, সেটা এই বইপত্তর কেনা। ফলে টাকা রয়েই যাচ্ছে। ওর মা অবশ্য ওসব দ্যাখেন। সুদেষ্ণা আমাদের মেয়ে এটা ওর অপরাধ নয়। আমাদের দুটো গাড়ি আছে। তার একটা নিয়ে সে যেতেই পারে। বাড়িতে গাড়ি থাকতে ভিড় বাসে কলেজে যাওয়ার মধ্যে বৈপ্লবিক কিছু দেখানোর চেষ্টা থাকতে পারে কিন্তু সেটা নিছকই বোকামি। আর ছেলে বন্ধু? কলেজে পড়ছে ও। একগাদা মেয়ের সঙ্গে যেমন বন্ধুত্ব হতে পারে তেমনি এক রাশ ছেলের সঙ্গেও। তাদের কথা আমি ওর মুখে শুনেছি কিন্তু কাউকেই চোখে দেখিনি। একমাত্র তোমাকেই ও প্রথম আমার কাছে নিয়ে এল।
সুদেষ্ণা বলল, তুমি এতক্ষণ যেসব প্রতিবাদের কথা বললে তার সঙ্গে এই মন্তব্যটা মিলছে না।
কোনটা? ভরত জিজ্ঞাসা করল।
তোমার মতো ছেলে ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব খারাপ চোখে দেখবে কেন?
আমি দেখিনি। তোমার কথা মাকে বলেছিলাম, তিনি বিরূপ মন্তব্য করেছেন। ছেলেদের সঙ্গে তোমার মেলামেশা নিয়ে কলেজে অনেকেই বাজে কথা বলে।
সুদেষ্ণা বলল, এদেশে বঞ্চিতরাই চিরকাল নিন্দুক হয়।
বঞ্চিত?
হ্যাঁ। যেসব ছেলের সঙ্গে আমি কথা বলি না তারা যেমন আমাকে অপছন্দ করে তেমনি যেসব মেয়ে ছেলেদের সঙ্গে মিশতে পারে না তারাও ওই একই গোত্রের। তুমি কি ওদের দলে?
না। আমি প্রচলিত ধারণার কথা বলেছি এবং এ জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী।
তুমি আর একদিন আমাকে অপমান করেছিলে!
সেদিন আমার মেজাজ ঠিক ছিল না। পরে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ হয়নি।
এখন চাও।
বেশ। ক্ষমা চাইছি।
সুদেষ্ণা এবং তার বাবা একইসঙ্গে হেসে উঠলেন।
সুদেষ্ণার বাবা বললেন, দ্যাখো ভরত, এইসব যা তুমি বললে তা তোমার মনে থাক, সেইমত নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করো কিন্তু এর কারণে হতাশায় ভেঙে পড়ো না। খোঁজ নিলে দেখবে তোমার মতো ভাবছে এমন অনেক মানুষ দেশে আছে। সংখ্যা বাড়লে দেশেরই মঙ্গল। হ্যাঁরে, ওকে চা দিয়েছিস?
না। আসামাত্রই এখানে এসেছি। চলো। সুদেষ্ণা ইশারা করল।
ওরা বাইরের ঘরে ফিরে এল।
সুদেষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, আমার বাবাকে কি তোমার হিপোক্রিট বলে মনে হলো?
বুঝতে পারলাম না। এককথায় হ্যাঁ বা না বলতে পারছি না।
খারাপ দেখে দেখে তুমি আর সহজ নেই।
কি জানি। হয়তো। মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে তাই ফাঁপরে পড়ি খুব।
চেষ্টা করো, দেখবে সহজ হয়ে যাবে।
চেষ্টা করে সহজ হওয়া যায়?
সুদেষ্ণা মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেল। সম্ভবত খাবার আনতে গেল। ভরত ওর বাবার কথা ভাবল। একটা মানুষ শুধু বইপত্র নিয়ে গোটাজীবন পড়ে আছেন। আশ্চর্য! নিজের বাবার সঙ্গে ওই মানুষটার পার্থক্যগুলো সে চিন্তা করছিল।
আপনি?
মহিলা কণ্ঠ শুনে সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। একজন সুন্দরী মধ্যবয়সিনী সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। বিদেশি সুগন্ধে ছেয়ে আছেন তিনি। পরনের পোশাক অত্যন্ত রুচিসম্মত। কিন্তু তাতে বয়সের ছাপ বিন্দুমাত্র নেই।
আমি সুদেষ্ণার সঙ্গে পড়ি।
আচ্ছা! ওর সঙ্গে এসেছেন?
হ্যাঁ।
কই, কেউ বলেনি তো আমাকে! ভদ্রমহিলা চারপাশে এমন ভঙ্গিতে তাকালেন যেন চারপাশে দাঁড়ানো অনুগতদের অনুযোগ জানাচ্ছেন। যদিও এঘরে কেউ নেই।
একথার কী জবাব হয় না বুঝে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতো ভরত।
বসুন। সুদেষ্ণা আমার মেয়ে।
ও। নমস্কার। হাতজোড় করল ভরত।
মাথা নাড়লেন ভদ্রমহিলা। ভরত বসলে উল্টোদিকের সোফায় বসলেন।
কতক্ষণ এসেছেন?
এই আপনি সম্বোধন কানে লাগছিল কিন্তু প্রতিবাদ করল না ভরত, অনেকক্ষণ। ওর বাবার সঙ্গে কথা বলছিলাম।
উনি এখানে এসেছিলেন?
না। ওঁর স্টাডিরুমে গিয়েছিলাম।
তাই? ভদ্রমহিলাকে একটু আনমনা দেখাল, কোথায় থাকো?
ভরত জবাব দিল।
বাবা কী করেন?
চাকরি।
মা?
বাড়িতেই আছেন।
নিজের বাড়ি?
না। ফ্ল্যাট।
এইসময় সুদেষ্ণা এল ঘরে, তোমাদের আলাপ হয়ে গেছে দেখছি। মা, ভরত একটু অন্য ধরনের ছেলে। টিউশনি করে নিজের খরচ চালায়। বাড়ি থেকে টাকা নেয় না।
সেকি? কেন? ভদ্রমহিলা আঁতকে উঠলেন।
ভরত হাসল, কোনও জবাব দিল না। কথা বলতে গেলে তো অনেক কথা বলতে হয়!
তোমার বাবা নিশ্চয়ই ভাল অবস্থায় আছেন?
অবশ্যই।
তিনি আপত্তি করেন না?
করেছিলেন। আমি বুঝিয়ে বলতে মেনে নিয়েছেন।
টাকা না নেবার পক্ষে কী যুক্তি দিয়েছিলে?
যেহেতু ওঁর কাজকর্ম আমি সমর্থন করি না তাই ওঁর টাকা আমি নিতে পারি না।
কী কাজকর্ম?
এইসময় সুদেষ্ণা বলে উঠল, ওমা! তুমি ভরতের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলছ। লিভ ইট! তুমি কি কোথাও বেরুচ্ছ?
ভদ্রমহিলা একদৃষ্টিতে ভরতের দিকে তাকিয়েছিলেন। যেন অদ্ভুত কিছু দেখতে পেয়েছে। নীরবে মাথা নেড়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি নিশ্চয়ই রাজনীতি কর?
আজ্ঞে না।
ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন, আমি তোমাকে বুঝতে পারছি না। হয়তো সুদেষ্ণার বাবা ভাল বুঝবেন। মেয়ের দিকে তাকালেন, মিসেস বোসের বাড়িতে যাচ্ছি। নটার মধ্যে ফিরব।
ভরতকে তোমার পছন্দ হয়নি, না?
পছন্দ? কী ব্যাপারে পছন্দ?
আমার বন্ধু হিসেবে।
তুমি কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে সেটা এখন তুমিই ঠিক করবে। তবে এই বয়সে বাপমাপের অবাধ্য হওয়া আমি সহ্য করতে পারি না। ভদ্রমহিলা বেরিয়ে গেলেন। সুদেষ্ণা বলে ফেলল, মায়ের ধারণা তুমি এখনও বালক।
তোমারও কি একই ধারণা?
এখনও পর্যন্ত তোমার সম্পর্কে কোনও ধারণাই তৈরি হয়নি।
খাবার এল। সঙ্গে চা। খিদে পেয়েছিল বেশ। ভরত মুখ চালালো, তুমি খাবে না?
না।
কেন?
আমি এসময় খাই না। মোটা হয়ে যাচ্ছিলাম বলে কতগুলো নিয়ম মানতে হচ্ছে।
তুমি মোটা? হাঁ হয়ে গেল ভরত। সুদেষ্ণার শরীরের গড়ন চোখে পড়ার মতো।
কোমরে সামান্য ফ্যাট জমছিল। তুমি বুঝবে না। বলেই হেসে ফেলল, দয়া করে আবার লেকচার শুরু করো না, এদেশের নব্বই ভাগ মানুষ দুবেলা খেতে পায় না আর আমি বিলাসিতা করে খাই না! ওটা খুব বাড়াবাড়ি হবে।
ভরত তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। তার মনে হল সে যে মনের কথাগুলোকে সুযোগ পেলেই বলে ফেলে সেটা সুদেষ্ণার কাছেও লেকচার বলেই মনে হয়। আসলে আমরা চারপাশে এত সাজানো দেখানো প্রতিবাদের কথা শুনি যে প্রতিবাদ ব্যাপারটাই ক্রমশ খেলো হয়ে এসেছে।
চায়ে চুমুক দিয়ে ভরত জিজ্ঞাসা করল, সুদেষ্ণা, তোমার বাবা-মায়ের সম্পর্ক কী রকম?
হঠাৎ এই প্রশ্ন?
দুজনকে আমার দুরকম মনে হল।
মা মায়ের মতন থাকে, বাবা বাবার মতন। তবে মা-ই এই সংসারের বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা করে থাকে। মা-ই সব। সুদেষ্ণা বলল।
কে তোমার বেশি প্রিয়।
দুজন দুরকমভাবে আমার প্রিয়। কম-বেশি মাপিনি। সুদেষ্ণা হাসল, ভরত, তোমাকে একটা কথা বলব। কিছু মনে করবে না তো?
স্বচ্ছন্দে বলে ফেল।
চারপাশের পৃথিবীর নিয়ে এই যে ভাবনাচিন্তা করে মন খারাপ করছ এতে তোমারই ক্ষতি হচ্ছে। তুমি একা কিছুই বদলাতে পারবে না।
আমি জানি।
বাবা যা বললেন, পৃথিবীতে তুমি খুব ভাল বন্ধু পেতে পার।
হুঁ। ভরত উঠে দাঁড়াল, আমি চললাম।
সুদেষ্ণা তাকে এগিয়ে দিল গেট পর্যন্ত, কাল দেখা হবে।
কাল ছুটি। বলেই তার খেয়াল হল, জানো এটাও একটা অদ্ভুত ব্যাপার।
কোনটা?
সেদিন একটা কাগজে পড়ছিলাম। এদেশে সরকারি ছুটি থাকে বছরে ষোলো দিন। একজন কর্মচারী তার সঙ্গে বারো দিন ক্যাজুয়াল এবং তিরিশ দিন আর্ন লিভ নিতে পারেন। অর্থাৎ ষোল বারো তিরিশ মিলে আটান্ন দিন ছুটি। প্রতি দিন এবং রবিবার ছুটির দিন মানে বছরে একশ চার তার সঙ্গে যোগ করলে দাঁড়াচ্ছে একশ বাষট্টি দিন। অর্থাৎ আউট অফ তিনশ পঁয়ষট্টি দিনের একশ বাষট্টি দিন ছুটি। তার মানে বারো মাসের পাঁচ মাস এদেশে কাজ করতে হয় না কর্মচারীদের। তার ওপর বন্ধ আছে। নেতাদের মৃত্যু হলে ছুটি আছে। মাথা নাড়ল ভরত, জাপান, চিন, আমেরিকা অথবা রাশিয়ায় এ ব্যাপারটা কেউ চিন্তাও করতে পারে না। আমাদের দেশে যেখানে বেশি কাজ করা দরকার সেখানেই এই আলস্য।
সত্যি তো। তুমি এসব নিয়ে ভাবো?
ভাবি না। চোখের সামনের এলে তোমরা যে উদাসীনতায় উপেক্ষা কর আমি তা পারি না। কোন লাভ নেই তবু–।
আবার এসো।
হ্যাঁ।
রাস্তায় পা দিয়ে ভরতের মনে হলো অনেক দিন পরে সন্ধেটা ভাল কাটাল। সুদেষ্ণার মা যা বললেন সেটা ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ওর বাবা একেবারে আলাদা মানুষ। তারপরেই সুদেষ্ণার কথা মনে হল। কলেজে দেখা সুদেষ্ণার সঙ্গে এই সুদেষ্ণার অনেক পার্থক্য। কলেজে ওকে অন্য গ্রহের মানুষ বলে মনে হয়, বাড়িতে এসে বন্ধু বলে ভাবতে ইচ্ছে করল।