মোহনবাগানের সঙ্গে খেলা
১১.
মোহনবাগানের সঙ্গে খেলাটার জন্য ছটফটিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আনোয়ার-নিমাইকে আমি জানিয়ে দিয়েছি, সামনের বছর ক্লাব বদল করবই। ওরা আমাকে অনেক বুঝিয়েছে, কিন্তু আমি ঘাড় নেড়ে গেছি গোঁয়ারের মতন। আমি বলেছি, বড় প্লেয়ার হতে চাই, আর কিছু নয়। সেজন্য যত ঝুঁকি নিতে হয়, নেব। ওরা শুনে চুপ করে থেকেছে।
শনিবার মোহনবাগানের সঙ্গে খেলা আমার জীবনের প্রথম বড় ম্যাচ। প্রথম খেলা। বছরে দু-তিনবার মাত্র আমাদের মতন ছোট ক্লাবের জীবনে এত লোকের সামনে খেলার, চোখে পড়ার, খবরের কাগজে দু-এক লাইন উল্লেখ পাওয়ার সুযোগ আসে। আগের ম্যাচে জর্জ টেলিগ্রাফ দু গোলে হেরেছে, দুটোই আমার দেওয়া গোল।
শুক্রবার ক্লাবে এসে নোটিশ বোর্ডে তাকালাম। প্লেয়ারস্ লিস্ট টাঙানো রয়েছে। সোজা দশ নম্বরে চোখ রাখলাম। এ কী! এস দত্ত কেন? সাধন দত্ত কেন? সাধন, সেই লম্বা সাধন, যে বলে কি করলেই মাটির চাপড়া ওঠে, কেউ চার্জ করতে এলে বল জমা দিয়ে দেয়। আমার নাম কোথায়? লিস্টের গোড়া থেকে চোখ বুলিয়ে আস্তে আস্তে পাথর হয়ে গেলাম। নিমাই আর আনোয়ারের নাম আছে।
বিপিনদার কাছে গেলাম। গম্ভীর মুখে উনি বললেন, ওরা আমার রিকোয়েস্ট রাখবে বলেছে। ওরা নেমকহারাম নয়।
শোভাবাজার টেন্টটা আমার পায়ের নীচে কাঁপতে শুরু করেছে। আঘাত এসেছে। বুকের মধ্যে কে বলে উঠল, প্রসূন, এইবার তুমি মাঠে নেমেছ। প্রথম গোল খেয়েছ। স্ট্রাইকার, বি রেডি, শোধ দিতে হবে। তার পরেও উইনিং গোল দেওয়া চাই, চাই-ই!
পরদিন আমরা ৬–০ গোলে হারলাম। গ্যালারিতে বসে ছিলাম। খেলা শেষে নিমাই আর আনোয়ার আমায় দেখে ফ্যাকাশে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল।
তার পর শোভাবাজার ইউনিয়ন টেন্টে আর যাইনি।
ভি আই পি রোডে হর্ষদার এক বন্ধুর বিরাট মোটর সারভিসিং ও পেট্রল ফিলিং স্টেশন। সেখানে তিনি আমাকে কাজ ঠিক করে দিলেন। সারভিসিং-এর জন্য নানান যন্ত্রপাতি—এয়ার কমপ্রেশার, নুম্যাটিক গ্রিজ ও মোবিল পাম্প, হাইড্রলিক লিফট, ওয়াটার কমপ্রেশার, গ্রিজ ও ওয়াটার গান ইত্যাদি নিয়ে আলাদা বিভাগ। দৈনিক আড়াই টাকা মজুরিতে আমি মেট নিযুক্ত হলাম।
আমার কাজ সকাল আটটায় শুরু। H আকৃতির লিফটের উপর মোটরটা প্রথমে ওঠানো হত। তার তলায় দাঁড়িয়ে একটা লোহার খুন্তি দিয়ে মাড-গারড় আর শ্যাশি থেকে শুকনো কাদা চেঁছে ফেলে ওয়াটার গান দিয়ে ধুয়ে দেওয়ার কাজ আমাকে দেওয়া হয়। হেড মেকানিক মধু সাহা খুঁটিয়ে আমার কাজ লক্ষ করে তফাতে দাঁড়িয়ে। মাথায় একটা নীল টুপি আর নাকে ন্যাকড়া বেঁধে বেশ ভয়ে ভয়েই কাজ করি। মাঝে মাঝে মধু সাহা আঙুল তুলে হুঙ্কার দেয়, ওই যে, ওই যে রয়ে গেছে, ডিফারেনশিয়াল বক্সের তলাতে…দ্যাখ, চোখ দিয়ে টাই রডটার জয়েন্টটা দ্যাখ।
এখন সকালের প্র্যাকটিস প্রায় বন্ধই। আমার ছটফটানি শুরু হয়ে গেল। ভোরে উঠে পাঁচ মাইল দৌড়ে আর আধ ঘণ্টা বল নিয়ে কসরত করে কাজে যাই। কিন্তু এইটুকুতে ভাল প্র্যাকটিস তো হয়ই না, উপরন্তু কাজের সময় ক্লান্তি লাগে। মধু সাহার দাঁতখিচুনি শুনতে হয়। পাঁচটায় ছুটির পর বলে তো আর পা দিতে ইচ্ছে করে না। আমি রীতিমতো ভাবনায় পড়ে গেলাম। এখানে চাকরি করলে আমার ফুটবল খেলা উচ্ছন্নে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে গাড়িতে পাল্প থেকে ডিজেল বা পেট্রল ভরে দেবার কাজটায় অনেক খাটুনি কম। যদি ওই কাজে বদলি করে দেয়, আর রাতের শিফটে, তা হলে সারা দিন সময় পাব। রাতে শুনেছি ঘুমোনোও যায়। যার তেল দরকার সে হাঁকাহাঁকি করে ডেকে তোলে।
হর্ষদাকে অসুবিধার কথা বললাম। শুনে বললেন, আচ্ছা। দুদিন পরে মালিক শিশিরবাবু তাঁর ঘরে ডেকে পাঠালেন।
তুমি ফুটবল খেলো?
আজ্ঞে হ্যাঁ। তটস্থ হয়ে বললাম।
তোমার অসুবিধে হচ্ছে খেলায়?
খেলায় নয়, প্র্যাকটিসে। খেলা এখন বন্ধ রেখেছি।
কেন বন্ধ? ভ্রূ তুলে উনি জানতে চাইলেন। আমি ওঁকে সব বললাম। আই সি, আই সি! বলে কলমটা দিয়ে কপালে টোকা দিতে দিতে কী ভাবলেন। তার পর বললেন, তুমি রাতেই যখন কাজ করতে চাও, তাই করো কাল থেকে।
আমি হাঁফ ছাড়লাম।
আই এফ এ শিল্ডের খেলা আরম্ভ হয়ে গেছে। শোভাবাজারের খেলা প্রথম। রাউন্ডে বার্নপুর ইউনাইটেডের সঙ্গে। টিকিট কেটে মোহনবাগান মাঠের গ্রিন গ্যালারিতে বসে খেলা দেখলাম। আর একজন মাত্র ছিল পুব দিকের প্রায় বারো হাজার লোক বসার সেই গ্যালারিগুলোয়। খুব অবাক লেগেছিল লোকটিকে দেখে। টিকিট কেটে এই খেলা দেখতেও কেউ আসে! আমার কাছে প্লেয়ারস কার্ড ছিল, কিন্তু আমি চাই না নিমাই বা আনোয়ারের মুখোমুখি হতে। এখনও আমার কাছে ব্যাপারটা ধাঁধার মতন। প্রসূন-নিমাই-আনোয়ার মানেই থ্রি মাসকেটিয়ারস্। বহু টুনামেন্টে আমরা ওই নামেই পরিচিত হয়েছিলাম। এক সঙ্গে খেলতাম, বেড়াতাম, আড্ডা দিতাম। গত ছসাত বছরে মনে পড়ে না এমন কোনও দিন যে, আমাদের রোজ না দেখা হয়েছে।
অথচ আমি আলাদা হয়ে গেলাম ওদের থেকে। ছটফট করেছি দেখা করার জন্য, আবার সঙ্গে সঙ্গে ভেবেছি, ওরা আমাকে না জানিয়ে চুপি চুপি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার মানে ওরা আমাকে আর চায় না। আমাদের মধ্যে তফাত ঘটে গেছে। আমার পথে ওরা ফুটবল নিয়ে এগোতে রাজি নয়। এক এক বার মনে হয় ওরাই ঠিক করেছে। উপরে ওঠার মই কেউ এগিয়ে দিলে, তাতে উঠে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আমি চাই নিজে মই বানাতে। তফাতটা শুধু এই—আমি পরিশ্রম করতে চাই ওদের থেকে বেশি।
নিমাই বা আনোয়ারও আমার সঙ্গে দেখা করেনি। বোধ হয় ওরা নিজেদের অপরাধী ভাবছে। আমাকে শোভাবাজার ইউনিয়ন বসিয়ে দিল, অথচ ওরা তার প্রতিবাদ করল না! ভাবতেই মনে হল, ভালই করেছে ওরা আমার সঙ্গে দেখা না করে। যদি জিজ্ঞাসা করি, কেন তোরা আমার পক্ষ নিলি না, কেন খেললি, তখন কী জবাব দেবে? তবু মনে মনে আমি আজও কষ্ট পাই ওদের অভাবে। কাজটা পেয়ে তবু কিছুটা ভুলে থাকতে পেরেছি। সকালে চার ঘণ্টা টানা মাঠে আর রাস্তায় খাটবার পর দুপুরে খানিকটা ঘুমোই। বিকেলে একটা ক্লাবে যাই একসারসাইজ করতে। রাতে বারোটার পর কদাচিৎ কোনও গাড়ি আসে। ঘুমোবার জন্য অনেক সময় পাওয়া যায়।
.
১২.
বার্নপুর ৩-১ গোলে জিতল। নিমাই চমৎকার খেলছিল। এখন আর ও থু বাড়ায় না। বুঝে গেছে সেগুলো শুধু নষ্টই হবে। নিজেই বল নিয়ে এগোয়, গোলে মারে। দুজন ওকে পাহারায় রেখেছে, তবুও নিমাই মাঝে মাঝে বেরিয়েছে। একটা গোলও দিয়েছে। কিন্তু ঝরঝরে একটা টিমকে একজন-দুজন কি সামাল দিতে পারে? গোল খেয়েই বানপুর শোভাবাজারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে টুটি টিপে ধরল। আনোয়ার পর্যন্ত তিনটে ফাউল করল নিরুপায় হয়ে। হাফ টাইমে বার্নপুর ২-১ গোলে জিতছে।
এর পর বলটা একবার বার্নপুরের লেফট হাফের মিস-কিক্ থেকে উড়ে এসে গ্যালারিতে পড়ে ড্রপ খেতে খেতে গ্যালারির নীচে ঢুকে গেল। বার করার জন্য অগত্যা আমাকেই গ্যালারির ফাঁক দিয়ে গলে নীচে নামতে হল। বলটা কিক করে মাঠে পাঠাব বলে তুলে ধরেছি, দেখি, নিমাই এগিয়ে আসছে বলটা নিতে। আমি বল হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম। ও আমাকে চিনতে পারা মাত্র দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি বলটা ছুড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, ভাল করে খেল। ওর মুখে একটা যন্ত্রণা ঝিলিক দিয়েই শুকনো হাসিতে রূপান্তরিত হল। এর পর লক্ষ করলাম, নিমাই আর খেলতে পারল না, বা ওর মধ্যে খেলার কোনও ইচ্ছা দেখতে পেলাম না। খেলা শেষ হবার আগেই আমি মাঠ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।
অরুণা গ্লাস ফ্যাক্টরির লক আউট সমানে চলেছে। খুব ভোরে কাজ থেকে বাড়ি ফিরি দৌড়ে মাইল পাঁচেক ঘুরে। রাস্তার লোকেরা আমার হাফ প্যান্ট গেঞ্জি কেডস্ পরা চেহারাটার সঙ্গে এখন যথেষ্ট পরিচিত, কেউ আর তাকায় না। বাড়িতে ঢুকি প্রায় চোরের মতন। বাবা ঘরে বসে পিন্টু আর পুতুলকে পড়ান এই সময়। আমার খুপরিতে ঢুকে ঢাকা খুলে চটপট রুটি কখানা শেষ করেই, বলটা নিয়ে বেরিয়ে যাবার পথে রান্নাঘরে মাকে একটা টাকা দিই। আমার নিজের রোজগারের টাকা। দেবার সময় দারুণ একটা আনন্দ হয়। বাকি দেড়টা টাকায় আমি বেছে বেছে এমন জিনিস কিনে খাই, যাতে বেশি ক্যালরি পাওয়া যায়। আমি সিনেমা দেখা বন্ধ করে দিয়েছি। টেরিলিনের জামা প্যান্টের বয়স প্রায় দেড় বছর হল, সেলাই করে চালাচ্ছি। একজোড়া বুট না কিনলেই নয়। দু-তিনজন এসেছিল টুনামেন্টে খেলবার জন্য ডাকতে, রাজি হলে বুট কেন, জামা প্যান্টের সমস্যাও মিটে যেত। আমি রাজি হইনি। সকালে যখন বল হাতে মাঠের দিকে যাই, তখন বই খাতা হাতে মেয়েরা স্কুলে কলেজে যায়, বাচ্চা ছেলেরা প্রাইমারি স্কুলে। তখন নীলিমার কথাটা মনে পড়ে আর নিজের মনেই বলি : আমিও তো স্কুলে যাচ্ছি। আমার স্কুল মাঠে, আমার বই খাতা এই বলটা।
বাবাকে একদিন সকালে দেখলাম মাথা নিচু করে অন্যমনস্কের মতন কোথায় চলেছেন। আমি আর পাড়ারই কয়েকটি ছেলে, কারখানার মাঠে তখন হেডিং প্র্যাকটিস করছিলাম। একটি ছেলে বলল, প্রসুনদা, আপনার বাবা যুগের যাত্রীতে খেলতেন?
হ্যাঁ, কোথায় শুনলি?
মেজকাকা কাল বলছিলেন, দারুণ নাকি খেলতেন। দু পায়ে টেরিফিক শট!
বাবার খেলা আমি দেখিনি। আমি জন্মাবার এক বছর পরই খেলা ছেড়ে দেন।
লক্ষ করলাম আমার কথা শোনামাত্র দু-তিনজন নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মুখ টিপে হাসল। প্রথমে বুঝতে পারিনি এর কারণ।
আপনার বাবা শিন্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলেছিলেন, তাই না? একজন বলল।
ওইটেই তো ওঁর জীবনের শেষ খেলা। আর একজন বলল।
কাকা বললেন, একবারে ফাঁকা একটা গোল মিস না করলে, ইস্টবেঙ্গল নাকি হেরে যেত। ও রকম গোল নাকি অন্ধেও দিতে পারে।
হ্যাঁ, পারে। আমি বললাম রাগ চাপতে চাপতে ঠাণ্ডা গলায়, তোমার কাকা জীবনে কখনও ফুটবল খেলেছেন কি?
ছেলেটি থতমত হল।
সম্ভবত খেলেননি।
আপনি জানলেন কী করে? উদ্ধত চোয়াড়ে ভঙ্গিতে ছেলেটি বলল।
খেললে কখনও বলতে পারতেন না যে, অন্ধেও গোল দিতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রে পারে, কিন্তু ঘুষ খেলে পারে না।
তার মানে? থরথর করে উত্তেজনায় আমি কাঁপছি। মাথার মধ্যে গলানো বাষ্প উড়ছে। আমি কিছু আর দেখতে পাচ্ছি না।
তার মানে আবার কী! সবাই জানে ব্যাপারটা। ছেলেটি ঠোঁট মুচড়ে দিতেই বাকিরা মুখ টিপে হাসল।
এর পর আমি আবিষ্কার করলাম আমি হাঁটছি। ছেলেটি পেট চেপে ধরে মাটিতে পড়ে বোধ হয় এখনও কাতরাচ্ছে। ফাটা ঠোঁট দিয়ে রক্ত ঝরতে দেখেছি। লাথি মেরেছি না ঘুষি, এখন আর মনে নেই। আমি হনহনিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
ঘণ্টাখানেক পর বাড়ি ফিরছি, দেখি আমাদের সরু গলিটায় ভিড়। একটা লোক—চেহারায় স্বচ্ছলতা, মাথায় টাক, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি—আমাদের দরজায় দাঁড়িয়ে মুঠো তুলে চিৎকার করছে, আলবাৎ বলব, ঘুষখোর! ঘুষখোর! ঘুষখোর! আমিও সেদিন মাঠে ছিলাম, আমি নিজে চোখে দেখেছি। সেদিন লোকটির গলা ধরে এল, সেদিন সেই চান্স! দেখলাম লোকটি সিল্কের পাঞ্জাবির হাতায় চোখ ঘষল, তার পর ফাঁসফেঁসে স্বরে বলল, আজও আমরা শিল্ড পাইনি।
আমি পায়ে পায়ে পিছু হটে গলি থেকে বেরিয়ে এলাম। আবার রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বাড়ি ফেরা মাত্র মা ছুটে এসে উঠোনের উপরই আমার চুল মুঠোয় ধরে ঠাস ঠাস করে চড় কষাতে শুরু করলেন।
কেন, কেন তুই পরের ছেলেকে মেরেছিস! বাড়ি বয়ে তোর বাবাকে অপমান করে গেল। তুই, তুই, তোর জন্যই
মা হাঁফিয়ে পড়লেন। ছোট্ট নরম ঠাণ্ডা স্বল্পবাক হাসিখুশি মা। মার হাতে ব্যথা লাগছে। দুচোখ বেয়ে দরদর জল পড়ছে। পিন্টু, পুতুল গম্ভীর মুখে দূরে দাঁড়িয়ে। বাবার ঘরের দরজার পাল্লা ভেজানো। বিশুবাবুর মেয়েরা উপর থেকে দেখছে। পাশের বাড়ির জানলাগুলোয় অনেক মুখ। নীলিমা এসে মার হাত চেপে ধরতেই দ্বিগুণ জোরে মা চেঁচিয়ে উঠলেন, কুলাঙ্গার! কুলাঙ্গার! বাপের মান যে নষ্ট করে, তেমন ছেলের মুখ দেখাও পাপ।
নীলিমা মাকে টেনে রেখেছে। আমি ভেজানো পাল্লা দুটো দড়াম করে খুলে ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। বাবা চিত হয়ে শুয়ে, চোখের উপর বাঁ হাত আড়াআড়ি রাখা। শব্দ হতেই হাত সরিয়ে একবার মাত্র তাকালেন।
বাবা, তুমি ঘুষ নিয়েছিলে? আমি উত্তেজিত স্বরে প্রশ্ন করলাম।
বাবা কথা বললেন না, শুধু দেখলাম ওঁর গালের চামড়াটা একবার কেঁপে গেল।
আমার জানা দরকার।
আমি তোমায় জানানোর কোনও প্রয়োজন বোধ করছি না। যদি তোমার লজ্জা হয়, তা হলে পিতৃ-পরিচয় দিয়ো না।
ওরা যা বলে আমি তা বিশ্বাস করি না।
বাবা চুপ করে রইলেন। আমার দিকে একবারও তাকাননি। ওঁর শায়িত দেহটাকে হঠাৎ মনে হল ভাঙা একটা গাছের ডাল। শুকননা, মরা।
আমার অনুরোধ, তুমি আর আমার জন্য কারও সঙ্গে ঝগড়া করবে না। গায়ে হাত দেবে না। হাজার হাজার লোককে মারধোর করে তো তোমার বিশ্বাসকে তাদের মধ্যে সঞ্চার করতে পারবে না। তার থেকে আমি যেমন আছি, তেমনই থাকতে দাও।
বাবা চোখ থেকে হাত নামিয়ে আমার দিকে তাকালেন। কপালের মাঝখানে মসৃণ চামড়ার বাদামি টিপটা চকচক করছে। বড় বেশি চকচকে, চোখ ধাঁধিয়ে। যায়। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
পরদিন মা রান্নাঘরে বসে উনুনে বাতাস দিচ্ছিলেন। আমি টাকাটা চৌকাঠে রেখে বেরিয়ে যাচ্ছি বল হাতে। মা ডাকলেন, কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বাচ্চা মেয়ের মতো মুখ উঁচু করে বললেন, আমার হাতে কাল খুব লেগেছে।
আমি হেসে ফেললাম। লাগবেই তো। অত জোরে জোরে কখনও মারে?
তুই ভাল করে খেলবি? বল, খেলবি?।
আমি একদৃষ্টে মায়ের অপূর্ব মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তার পর আমি মায়ের গলা জড়িয়ে বুকে মুখ চেপে ধরে বললাম, খেলব।
মা আমার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বললেন, তোর বাবার মতন বড় হতে পারবি?
হঠাৎ আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। মাথায় মায়ের স্পর্শ, ঘ্রাণ পাচ্ছি মায়ের দেহের, মনে হচ্ছে মখমলের মতন সবুজ দূর্বা বিছানো মাঠে, হালকা সাদা-কালো ফুটকি দেওয়া বল নিয়ে ড্রিবল করছি। একের পর এক কাটাচ্ছি, দুলে দুলে এগোচ্ছি। ডাইনে ভাঙছি বাঁয়ে হেলছি, শূন্যে উঠছি কখনও হরিণ, কখনও চিতা, কখনও চিলের মতন। নিজেকে বললাম—প্রসূন, সুন্দর খেলার আনন্দ বোধ হয় এই রকম। বড় প্লেয়ার হও, তা হলে মাঠেও তুমি মায়ের বুকে থাকবে। তুমি কি তাই চাও?
হ্যাঁ, আমি তাই চাই। আচ্ছন্ন গলায় মাকে উত্তর দিলাম।
.
১৩.
বছর ঘুরে গেল। আমার এক বছর বয়স বাড়ল। মাথায় লম্বা হয়েছি পাঁচ ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চি, ওজন তুলনায় কমই, পঁয়ষট্টি কিলোগ্রাম। নীলিমা স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। আমি এখন দিনে সাড়ে তিন টাকা পাচ্ছি, অবশ্য কাজটা রাতেই। অরুণা গ্লাস ফ্যাক্টরি এখনও খোলেনি, চোদ্দো মাস বন্ধ হয়ে রয়েছে। বাবা যথারীতি রোজ দুপুরে বেরোন। আরও শুকিয়ে গেছেন, আরও কম কথা বলেন। আমাদের রাত্রের রুটির বরাদ্দ একই রয়েছে, আমিষ খাদ্য বোধ হয় বছরখানেক রান্না করার সুযোগ মা পাননি। দোতলায় বাড়িওয়ালার রান্নাঘর থেকে যে দিন মাংস কষার গন্ধ আসে, পিন্টু আর পুতুল সে দিন প্রাণপণে পড়ার মধ্যে ডুবে যাবার চেষ্টা করে। হর্ষদা আমায় কয়েকবার বলেছিলেন—প্রসূন, এত যে খাটছ, এতে শরীরে ক্ষয় হচ্ছে—সেই ক্ষয় পূরণ করে খাদ্য। ফুটবলারের ভীষণ দরকার প্রোটিন। মাংস, দুধ, ডিম তোমায় খেতেই হবে, নয়তো বিপদে পড়বে। শুনে আমার ভয় হয়েছিল। শরীর ক্ষয়ে গেলে আমার আর রইল কী! কিন্তু মাংস আমি খাব, পয়সা কোথায়?
কাগজে দেখেছিলাম, বি সি রায় ট্রফি খেলার জন্য জুনিয়ার বেঙ্গল টিমের নাম ঘোষিত হয়েছে। এক দিন ভোররাত্রে হাঁকাহাঁকি করে একটা লোক ঘুম ভাঙাল। পেট্রল চাই দশ লিটার, এখনই ভোরের ফ্লাইট ধরতে হবে। মোটরের ভিতর তাকিয়ে আমার চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেল। পিছনের সিটে নিমাই আর আনোয়ার, সামনে বিপিনদা বসে। ওরা আমায় দেখে অবাক! বিপিনদা বললেন, কী রে প্রসূন, খেলা ছেড়ে এখন এই কচ্ছিস? ভাল, ভাল! একটু তাড়াতাড়ি দে বাবা, দিল্লির ফ্লাইটে এদের তুলে দিতে হবে।
আমি হাসলাম মাত্র। মোটরে পেট্রল ঢালছি মিটারের দিকে তাকিয়ে। বিপিনদা চেঁচিয়ে গাড়ি থেকে মুখ বার করে বললেন, আমার কথা তো বিশ্বাস করলি না, এই দ্যাখ নিমাই, আনোয়ার জুনিয়ার ন্যাশনালে খেলতে যাচ্ছে। তুই থাকলে তুইও যেতিস। তোর এত পসিবিলিটি ছিল।
বিপিনদা জিভটা টাকরায় লাগিয়ে চুকচুক শব্দ করলেন আক্ষেপের। টাকার ভাঙানি ফেরত দেবার সময় আমার মাথাটা মুখের কাছে টেনে এনে চাপা স্বরে উনি বললেন, সামনের বছর আয়, দেড় হাজার দেব, এদের থেকেও বেশি। নিজেকে এভাবে নষ্ট করিস না। এবার রেলিগেশন-প্রোমোশন আছে।
আমি আবার হাসলাম। ওরা দুজন জড়ভরতের মতন বসে। আনোয়ার বাইরে তাকিয়ে, কিন্তু নিমাই একদৃষ্টে আমার মুখের দিকে। গাড়িটা চলে যাবার পর আমার সত্যিই হিংসা হল। শোভাবাজারে থাকলে আজ আমিও এই মোটরে চেপে দিল্লির প্লেন ধরতে যেতাম। তার পর পরিমল ভটচাজ ঢুকিয়ে দিত জুনিয়ার ইন্ডিয়া টিমে, তার পর ব্যাংকক, সিওল কি টোকিওয়। শুধু একটা বছর যদি থাকি।
নিজের উপর রাগ হল। বোধ হয় বোকামিই করেছি, ক্ষতি করলাম নিজেরই। মুহ্যমান হয়ে খাটিয়ার উপর বসে যখন এই সব ভাবছি, তখন ফিসফিস করে বুকের মধ্যে কে কথা বলে উঠল : কী ক্ষতি করেছ, প্রসূন? পূরণ করে নেবার সময় অনেক পাবে। যাও যাও, প্র্যাকটিসে নামো। খাটো, আরও খাটো। কিচ্ছু বোকামি করোনি। মনে রেখো, কদর পাবে একমাত্র খেলা দিয়েই, বেঙ্গল বা ইন্ডিয়ার ছাপ দিয়ে নয়।
ভি আই পি রোড ধরে যখন দৌড়োচ্ছি, একটা প্লেন মাথার উপর দিয়ে নিচু হয়ে পশ্চিমে চলে গেল। আমি দাঁতে দাঁত চেপে ঊর্ধ্বশ্বাসে হঠাৎ পাগলের মতন ছুটতে শুরু করলাম।
.
১৪.
তোমার কথা রতন আমাকে বলছিল। সাদা চুলে ভরা মাথাটা ডাইনে বাঁয়ে নেড়ে পঁয়ষট্টি বছরের দাসুদা অথাৎ দাসু গুহ গম্ভীরভাবে আমার আপাদমস্তক দেখলেন। তার পর চেয়ার থেকে উঠে এসে ধাঁ করে বুকে ঘুষি মারলেন। আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। লেগেছে ভালই, কিন্তু মুখে যন্ত্রণা ফোটালাম না। উনি আমার পিছনে গেলেন। বুঝতে পারছি না, এবার কী করবেন। হঠাৎ একটা ধাক্কা খেলাম। হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে টাল সামলে নিলাম।
দাসুদার মুখে হাসি ফুটল। স্ট্রাইকার?
আমি মাথা হেলালাম। উনি চেঁচিয়ে ডাকলেন, কমল, কমল!
বেঁটে ফরসা কমল পণ্ডিত ছুটে এল। দাসুদা বললেন, ছেলেটাকে পঁচিশ পাক দৌড় করা।
কমলদা সোনালি সংঘের ট্রেনার। ইন্ডিয়া টিমে ব্যাক খেলেছেন বছর দশেক আগে। অসম্ভব দম আছে শুনেছি।
প্যান্ট এনেছ?
না।
কমলদা প্যান্ট জোগাড় করে দিলেন। মাঠে হকি খেলা হচ্ছে। কিছু দর্শক ছড়ানো ছেটানো। লক্ষ করলাম, ফুটবল বুট পায়ে খালি গায়ে তিন-চারটি ছেলে টেন্টের বাইরে গান করছে। মনে হল, ওরা প্র্যাকটিসে নামবে হকি খেলাটা শেষ হলেই। ওরা কৌতূহলে আমার দিকে তাকাল। ওদের মধ্যে গোলকিপার রুনুকে মাত্র চিনলাম। দু-একবার শোভাবাজার টেন্ট-এ দেখেছি রতনের সঙ্গে। তবে আলাপ নেই।
কমলদা আমাকে নিয়ে দৌড়োতে শুরু করলেন মাঠের বাইরে দিয়ে। জোরে হাঁটার থেকে কিছু জোরে। পাঁচ পাকের পর দেখি, কমলদা আমার সামনে এবং গতি ক্রমশই বাড়াচ্ছেন। আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। আঠার মতন সঙ্গে লেগে রইলাম। সতেরো পাকের সময় হকি খেলা শেষ হতে দেখলাম, ফুটবল নিয়ে ওরা মাঠে নেমে পড়েছে। কুড়ি পাকের মাথায় কমলদাকে পিছনে ফেলে এগোতে শুরু করলাম। দাসুদা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওদের দিয়ে পাসিং ও ইনটার-পাসিং করাচ্ছেন, এখন তিনি আমাদের দৌড়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে। দম আমার বুক ভর্তি রয়েছে। কমলদা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছেন। শেষ পাকটা প্রিন্ট করলাম। কমলদাকে পুরো দেড় পাক পিছনে রেখে থামতেই দাসুদা হাত নেড়ে মাঠের মধ্যে ডাকলেন।
তোর নামটা যেন কী?
প্রসূন।
বুট আনিসনি কেন?
শুনেছি দাসুদা যাদের বুট আনতে বলেন, তারাই ফার্স্ট টিমে খেলার যোগ্যতা পেয়েছে ধরে নিতে হয়। খুশিতে আমি মাথা চুলকোতে লাগলাম। কমলদা তখন এসে আমায় জড়িয়ে ধরেছেন। হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, এই প্রথম আমি হারলাম, দাসুদা।
ছোঁড়ার দম আছে। এই বলে, দাসুদা আবার প্র্যাকটিস করানোয় মন দিলেন। মাঠের বাইরে এসে আমি ওদের প্র্যাকটিস দেখতে লাগলাম। ডান দিক থেকে উঁচু ক্রস পেনালটি বক্সে ফেলছে একজন, আর তিনজন ছুটে যাচ্ছে বলটা হেড বা ভলি করতে। ফসকাচ্ছে বা বারের অনেক উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।
আমি গুটিগুটি মাঠের মধ্যে দাসুদার পাশে দাঁড়ালাম।
আমি একবার চেষ্টা করব?
দাসুদা মাথা দোলালেন। আমি এগিয়ে গেলাম।
একসঙ্গে দুজন ছুটেছি; বল নিয়ে ডাইনের সাইড লাইন ধরে ছুটে সেন্টার করল একজন। সেন্টারটা ভাল হয়নি, আমাদের দুজনের পিছনে বল পড়ছে। আমি ঘুরে গেলাম গোলের দিকে পিছন ফিরে। বলটা পড়ার আগেই ইনস্টেপ দিয়ে শূন্যে থামিয়ে টুক করে উপরে তুলেই সঙ্গে সঙ্গে পিছনে হেলে মাথার উপর দিয়ে বাইসাইকেল কিক করলাম। মাথা ঘুরিয়ে দেখি, বারের তলায় লেগে বলটা গোলে ঢুকল, আর গোলকিপার হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। নীলিমাকে এই কিই দেখিয়েছিলাম আন্দাজে মেরে। কিন্তু এখন দশটার আটটাই গোলে পাঠাতে পারি।
দাসুদা আর কমলদা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন, অন্য ছেলেরা আমাকে সপ্রশংস চোখে দেখছে। একজন বলল, আর একবার করো তো!
করতে পারলাম না। বলটা পেলাম বুকের উপর, বুক থেকে উরুতে নিলাম, তুললাম ধাক্কা দিয়ে কিন্তু শরীর থেকে বাঁ ধারে বলটা একটু সরে গেল। বাইসাইকেল কিকের চেষ্টা না করে আধ পাক ঘুরে ডান পায়ে ভলি মারলাম। গোলকিপার দুহাত বাড়িয়ে ডান দিকে ঝাঁপাবার আগেই বল গোলে ঢুকে গেছে।
দাসুদা হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। কাছে যাওয়া মাত্র জানতে চাইলেন, বাড়িতে কে কে আছেন, বাবা কী করেন, আমি কী করি, কত দূর লেখাপড়া করেছি…ইত্যাদি।
কাজটা ছেড়ে দে! দাসুদা বললেন, তার পর আমার বিস্ময় লক্ষ করে যোগ করলেন, ও টাকা আমরা দিয়ে দেব তোকে মাসে মাসে, আর কিছু দিতে পারব না।
আমি রাজি হয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গেই। ছোট টিমগুলোর মধ্যে সোনালি সংঘের নাম আছে ছক বাঁধা আধুনিক পদ্ধতিতে খেলার। এখানকার ছেলেরা সিরিয়াস, মন দিয়ে প্র্যাকটিস করে দাসুদার চোখের সামনে। কমলদা মাঠের মধ্যে ওদের স্কিল রপ্ত করান। সোনালির নিয়ম-শৃঙ্খলা অত্যন্ত কড়া, সেটা শুধু মাঠেই নয়, বাড়িতেও প্রত্যেক প্লেয়ারকে পালন করতে হয়। দাসুদা প্রায়ই এক এক জনের বাড়িতে হঠাৎ হাজির হয়ে খোঁজ নেন, কী খাচ্ছে, কখন ফিরছে, কখন ঘুমোচ্ছে।
সামনের হপ্তা থেকে ট্রান্সফার শুরু হবে, কমলের সঙ্গে আই এফ এ অফিসে গিয়ে সই করে আসবি। কাল ভোর থেকেই প্র্যাকটিসে আয়।
ফেরার সময় শ্যামবাজারের বাসের দম বন্ধ করা ভিড়ের মধ্যে একবার আমার মনে পড়ল, দাসুদা যখন জিজ্ঞাসা করলেন বংশে কেউ কখনও ফুটবল খেলেছে কি
, তখন আমি না বলেছিলাম।
.
১৫.
আই এফ এ অফিসে সই করতে গিয়ে বিপিনদার সঙ্গে দেখা। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিন্যু থেকে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিস পর্যন্ত সুতারকিন স্ট্রিটে হাজারখানেক লোকের জটলা। তার মধ্যে বিপিনদা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। আমাকে দেখে হাত তুলে থামতে ইশারা করলেন। আমি অস্বস্তি বোধ করলাম।
সোনালিতে সই কচ্ছিস খবর পেয়েছি।
আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কেন? আমি প্রশ্ন করলাম।
উইথড্র করাব আজ নিমাই, আনোয়ারকে। ওরা দুটোর সময় আসবে। বিপিনদা ঘড়ি দেখলেন। তুই তা হলে আমার কথাটা ভেবে দেখলি না? এরা কত দেবে?
এক পয়সাও নয়।
বিপিনদা অবাক হয়ে, অ বলেই সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেলেন। ঠিক দুটোর সময় আনন্দবাজারের গেটের সামনে কমলদার থাকার কথা। আমি সে দিকে এগিয়ে গেলাম। একদল ছেলে খুব উত্তেজিত হয়ে তর্কাতর্কি করছে। বিষয় নঈম, অরুণ ঘোষ, অসীম মৌলিক, পাপান্না, হাবিব, ধীরেন দে, জ্যোতিষ গুহ, মান্না। হঠাৎ কী যেন হল, ওরা ছুটে গেল আই এফ এ অফিসের দিকে নঈম নঈম বলে। একটু পরেই ফিরে এল, যত্তোসব উড়ো গুজব বলতে বলতে। আমি ভাবলাম, আমার জন্য এরাও একদিন এখানে এইভাবে অপেক্ষা করবে। আমি দল বদলাতে আসছি শুনে ছুটে যাবে। অথচ এরা জানে না, আমি এখন এদের পাশেই দাঁড়িয়ে। ভাবতেই আমার খুব হাসি পেয়ে গেল।
কমলদার সঙ্গে যখন আই এফ এ অফিসের সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, তখন নিমাই আর আনোয়ার বিপিনদার পিছনে নামছে। আমি দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পথ দিলাম। নিমাই চমৎকার ঘিয়ে রঙের একটা প্যান্ট পরেছে। ভীষণ টাইট, কোমরের অনেক নীচে নামানো। জুতোর মুখটা ছুঁচলো। চুল আঁচড়াবার টঙটাও বদলেছে, কপালের আধখানা জুড়ে চুল নামানো। আনোয়ার পরেছে একটা নীল নায়লনের স্পোর্টস্ গেঞ্জি, ফরসা রঙের সঙ্গে সুন্দর মানিয়েছে।
কেমন আছিস? আমি বললাম।
ওরা থতমত হল, আশা করেনি আমি কথা বলব।
নিমাই তাড়াতাড়ি বলল, তুই রোগা হয়ে গেছিস প্রসূন।
আমি হাসলাম।
পরে কথা বলব, এখন চলি। আনোয়ার মৃদু স্বরে বলল। আমি মাথা কাত করলাম।
পরদিন সন্ধ্যায় মাঠ থেকে ফিরতেই মা দারুণ উত্তেজিত হয়ে বললেন, এ ঘরে আয় শিগগিরই, একটা জিনিস দেখাব। আমি ছুটে গেলাম। মার হাতে পাঁচটি একশো টাকার নোট।
কোথেকে পেলে? প্রশ্ন করলাম অবাক হয়ে। মা একটা চিঠি হাতে দিলেন। চিঠিতে লেখা :প্রসূন, কাল ঠিক দুটোর সময় আমি অপেক্ষা করব আই এফ এ অফিসের কাছে, যেখানে তার সঙ্গে গতকাল দেখা হয়েছিল। ইতি, বিপিনদা।
মার হাত থেকে নোটগুলো নেবার জন্য হাত বাড়ালাম।
এ টাকা এখুনি ফেরত দিতে হবে। এটা ঘুষ।
মার হাত থেকে নোটগুলো পড়ে গেল। মনে হল যেন ফেলে দিলেন। ফ্যাকাশে মুখে শুধু বললেন, ঘুষের টাকা!
বিপিনদার বাড়ি পৌঁছোলাম রাত দশটায়। অবাক হয়ে বললেন, এত রাতে, ব্যাপার কী রে?
নোটগুলো ওঁর টেবিলে নামিয়ে রেখে বেরিয়ে আসার সময় বললাম, কয়েক ঘন্টার জন্য টাকাটা আমার কাছে থেকে গেছিল। সে জন্য সুদ আপনার প্রাপ্য। শশাভাবাজারের সঙ্গে যে দিন খেলা থাকবে, সে দিন সেটা শোধ দেব। বলে দরজা পেরোচ্ছি, পিছনে বলতে শুনলাম, বটে!