Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » স্টপার || Moti Nandi » Page 4

স্টপার || Moti Nandi

কাঁসর, শাঁখ, পটকা নিয়ে

১৬.

কাঁসর, শাঁখ, পটকা নিয়ে যাত্রীর সমর্থকরা ইস্টবেঙ্গল মাঠের সবুজ গ্যালারি ছেয়ে রয়েছে। দশ গজ পর পর হাতে উড়ছে যাত্রীর পতাকা। যুগের যাত্রী আজ লিগ চ্যামপিয়ন হবে। যাত্রীর ইতিহাসে প্রথম। আর দুটি পয়েন্ট তাদের দরকার। যাত্রীর সমান খেলে ইস্টবেঙ্গল এক পয়েন্টে পিছিয়ে, মোহনবাগান তিন পয়েন্ট, মহমেডান ছয় পয়েন্ট। প্রত্যেকেরই একটি করে খেলা বাকি। যাত্রীকে আর ধরা যাবে না। যদি আজ যাত্রী ড্র করে এক পয়েন্ট খোয়ায়, তা হলে ইস্টবেঙ্গল সমান সমান হবার সুযোগ পাবে, কেননা তাদের শেষ ম্যাচ জর্জ টেলিগ্রাফের সঙ্গে। প্রথম খেলায় টেলিগ্রাফকে চার গোলে হারিয়েছে ইস্টবেঙ্গল।

গ্যালারিতে একজন দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলল, যাত্রী আজ যদি হেরে যায়! খেলার কথা তো কিছুই বলা যায় না।

অবশ্য লোকটি কয়েক মুহূর্ত পরেই বুদ্ধিমান হয়ে গেল এবং সবাইকে শুনিয়ে বলল, পি সি সরকার কিংবা পেলে ছাড়া যাত্রীকে আজ হারাবার ক্ষমতা কার আছে! আগের ম্যাচে কী ভাবে শোভাবাজার পাঁচ গোল খেয়েছিল মনে পড়ে?

শোভাবাজারের সেই টিমই খেলবে। খুব বোদ্ধার মতো আর একজন বলল, সিজন যত শেষ হয়ে আসে, বর্ষা নামে, ছোট টিম ততই টায়ার্ড হয়, খারাপ খেলে। আমার তো মনে হয়, রেকর্ড গোল দিয়ে যাত্রীর লিগ চ্যামপিয়ন হওয়ার আজই সুযোগ।

দাদা, আগের ম্যাচে তো কমল গুহ খেলেছিল, আজও খেলবে কি?

কে জানে? অনেকদিন তো কাগজে নামটাম চোখে পড়েনি? আর খেললেই বা কী আসে যায়?

জানেন তো যাত্রী ছেড়ে যাবার সময় কমল গুহ কী বলেছিল?

আরে রাখুন ওসব বলাবলি। অনুপম আর প্রসূন আজ ওর পিণ্ডি চটকে ছাড়বে। দম্ভ নিয়ে মশাই কজন তা রাখতে পেরেছে? রাবণ পারেনি, দুর্যোধন পারেনি, হিটলার পারেনি, আর কমল গুহ পারবে?

আজ শোভাবাজারের সমর্থক শুধু ইস্টবেঙ্গল মেম্বার-গ্যালারিতে। তাদের মনে একটা ক্ষীণ আশা—যদি যাত্রী হারে। হারলে, ইস্টবেঙ্গলের চ্যামপিয়ন হওয়া ওই পেলে বা পি সি সরকারও বন্ধ করতে পারবে না।

অসম্ভব, হতি পারে না। যাত্রীর হার হতি পারে না। শোভাবাজারের আছে কে? লিগটা লইয়াই গেল শ্যাস পর্যন্ত। কপালে করাঘাত হল।

চ্যাঁচাইয়া যদি জেতান যায় তো আজ কলজে ফাটাইয়া দিমু। কী কস্?

তাই দে।

নিশ্চয়, আজ যেমন কইরা হোক জেতাইতে হইবই। ক্যান, স্পোর্টিং ইউনিয়নের দিন জেতাই নাই ইস্টবেঙ্গলেরে।

আরে মশাই, চেঁচিয়ে জেতাবেন শবাজার সে টিম নয়। পহাকড়ি দিয়ে দু-চারটে প্লেয়ারকে যাত্রী ঠিক ম্যানেজ করে রেখেছে। ষােল বচ্চর তো খেলা দেখছি।

ছারপোকা! আমাগো গ্যালারিতে?

ছাইড়া দে। অগো আর আমাগো আজ কম ইন্টারেস্ট। ইংরাজি বোঝোস তো?

চার বছছর আই এছছি পড়ছি। ইন্টারেস্ট মানে সুদ তা আর জানি না?

পাশেই এরিয়ানের গ্যালারির অংশে রয়েছে যুগের যাত্রীর মেম্বাররা। সেখানে হইহই পড়ে গেছে বিপুল কলেবর ফিল্ডমার্শালকে দেখে। বিরাট গোঁফওলা লোকটি, চারটি সিগারেট মুঠো করে রাখা পাঁচ আঙুলের ফাঁকে। এক একটি টান দিচ্ছে আর মুখ থেকে পাটকলের চিমনির মতো ধোঁয়া বার করছে। যাত্রী ম্যাচ জেতার পর ফিল্ডমার্শাল এই ভাবে সিগারেট খায়। আজ খেলা শুরুর আগেই খাচ্ছে।

ফিল্ডমার্শালের পিছন পিছন দুটি চাকর বিরাট এক হাণ্ডা নিয়ে গ্যালারিতে এসেছে। এতে আছে পনেরো কিলো রান্না করা মাংস। খেলা শেষে ভাঁড়ে বিতরণ করা হবে। হুটোপুটি পড়ে গেল হাণ্ডার কাছাকাছি থাকার জন্য।

বড় খিদে পেয়েছে দাদা, ব্যাপারটা অ্যাডভান্সই চুকিয়ে ফেলুন না। রেজাল্ট তো জানাই আছে, তবে আর আমাদের কষ্ট দেওয়া কেন?

নৌ নৌ। এখন নয়। ফিল্ডমার্শাল দুহাত তুলল। অফিসিয়াল ভিকট্রির পর।

মাঠের এক কোনায় গ্যালারিতে রয়েছে শোভাবাজার স্পোর্টিংয়ের ডে-স্লিপ নিয়ে যারা এসেছে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই অবশ্য মনে মনে যাত্রীর সমর্থক। বিপুল ঘোষ আজ প্রথম মাঠে এসেছে কমলের কাছ থেকে স্লিপ নিয়ে। তার পাশেই বসেছে অমিতাভ। চুপচাপ একা। সলিল তাকে স্লিপ দিয়েছে। ফুটবল মাঠে আজই প্রথম আসা। ওদের পিছনে বসে অরুণা আর পিন্টু। গতকাল কমল গেছল ওদের বাড়িতে; পল্টু মুখার্জির ছবির সামনে চোখ বুজে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, ছবিতে মাথা ঠেকিয়ে সে বিড়বিড় করে কিছু বলে। পিন্টুও তার দেখাদেখি প্রণাম জানায়। পিন্টুই বায়না ধরে, কমলমামার খেলা সে দেখবে।

গ্যালারিতে পিন্টু অধৈর্য হয়ে ছটফট করে, কখন টিম নামবে। অরুণা ছোটবেলায়, পিন্টুরই বয়সে, বাবার সঙ্গে মাঠে এসে দেখেছে কমলের খেলা, শুধু মনে আছে, সারা মাঠ উচ্ছ্বসিত হয়েছিল কমলকে নিয়ে। আজ তারও প্রচণ্ড কৌতূহল। বিপুল ঘোষ ঘড়ি দেখে পাশের অমিতাভকে বলল, খেলা কটায় আরম্ভ বলতে পারেন?

অমিতাভ মাথা নাড়ল। শোভাবাজারকে কতকটা বিদ্রপ জানাতেই প্রচণ্ড শব্দে মাঠের মধ্যে পটকা পড়ল, তারপর পিন্টু প্রবল উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ওই যে কমলমামা।

.

কয়েক দিন ধরে কমল বারোটি ছেলেকে নিয়ে রীতিমতো ক্লাস করেছে তার শোবার ঘরে। মেঝেয় খড়ি দিয়ে মাঠ এঁকে, তার মধ্যে ঢিল সাজিয়ে (ঢিলগুলি প্লেয়ার) সে যাত্রীর এক একটা মুভ দেখিয়ে কী ভাবে সেগুলো প্রতিহত করতে হবে বুঝিয়েছে। ওরা গোল হয়ে ঘিরে বসে গভীর মনোযোগে শুনেছে। যাত্রীর অ্যাটাক প্রধানত কাকে ঘিরে, কোথা থেকে বল আসে, কী কী ফন্দি এঁটে ওরা স্যুটিং স্পেস তৈরি করে, পাহারা দেওয়া ডিফেন্ডারকে সরাবার জন্য কী ভাবে ওরা বল-ছাড়া দৌড়োদৌড়ি করে, ওভারল্যাপ করে ওদের ব্যাক কী ভাবে ওঠে, কমল ওদের দেখিয়েছে ঢিলগুলি নাড়াচাড়া করে। তারপর বুঝিয়েছে কার কী কর্তব্য। যাত্রীর প্রতিটি প্লেয়ারের গুণ এবং ত্রুটি এবং শোভাবাজারের কোন প্লেয়ারকে কী কাজ করতে হবে বার বার বলেছে। খেলার দিন সকালেও সে সকলকে ডেকে এনে শেষবারের মতো বলে, চারজন ব্যাকের পিছনে থাকব আমি। যখনই দরকার তখনই প্রত্যেক ডিফেন্ডারকে কভার দেব। ডিফেন্ডাররা নিজের নিজের লোককে ধরে রাখবে। মুহূর্ত দেরি না করে ট্যাকল করবে। বল ওরা কন্ট্রোলে আনার আগেই চ্যালেঞ্জ করবে। বিশেষ করে প্রসূনকে। যেখানে ও যাবে সলিল ছায়ার মতো সঙ্গে থাকবে। অনুপমকে দেখবে স্বপন। চারজন ব্যাকের সামনে থাকবে শম্ভু। প্রত্যেকটা পাস মাঝপথে ধরার চেষ্টা করবে, যেন যাত্রীর কোনও ফরোয়ার্ডের কাছে বল পৌঁছতে না পারে। অ্যাটাক কোথাও থেকে শুরু হচ্ছে দেখা মাত্র গিয়ে চ্যালেঞ্জ করবে। শম্ভুর সামনে তিনজন হাফ ব্যাক থাকবে। যাত্রীর অ্যাটাক শুরু হবার মুখেই ঝাঁপিয়ে পড়বে, আবার দরকার হলে নেমে এসে হেলপ করবে, আবার কাউন্টার-অ্যাটাকে বল নিয়ে এগিয়ে যাবে। আর যাত্রীর পেনাল্টি বক্সের কাছে। থাকবে গোপাল। মোট কথা, আমাদের ছকটা হবে ১৪–১৩-১।

কমলদা, আমি কিন্তু ওদের দু-একটাকে বার করবই। শম্ভু গোঁয়ারের মতো বলেছিল।

কমল কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলে, ওদের একজনকে বার করার সঙ্গে সঙ্গে তোমাকেও বেরিয়ে যেতে হবে। তাতে ক্ষতি হবে শোভাবাজারেরই। শম্ভু, আজ সব থেকে দায়িত্বের কাজ তোমার উপর। তুমি কি দায়িত্বের ভয়ে পালিয়ে যেতে চাও?

কে বলল? শম্ভু লাফিয়ে উঠল। চোখ দিয়ে রাগ ঠিকরে পড়ল। দেয়ালে ঘুষি মেরে সে বলল, আমি পালাব, আমি পালিয়ে যেতে চাই? আমার বাপ দেশ ভাগ হতে পালিয়ে এসেছিল। শেয়ালদার প্ল্যাটফর্মে আমি জন্মেছি কমলদা, আমার মা মরেছে উপোস দিয়ে, বড় ভাই মরেছে খাদ্য আন্দোলনে গুলি খেয়ে। আমি চুরিচামারি অনেক করেছি। আজ ছিঁড়ে খাব সবাইকে।

কমল পর পর সকলের মুখের দিকে তাকায়, তারপর ফিসফিসে গলায় বলে, আজ শোভাবাজার লড়বে।

ওরা চুপ করে শুধু কমলের দিকে তাকিয়ে থেকেছিল।

.

১৭.

তারপর শোভাবাজার লড়াই শুরু করল।

কিক অফের সঙ্গে সঙ্গে অনুপম ছুটতে শুরু করল আর প্রসূন ডান টাচ লাইনে লম্বা শটে বল পাঠাল, ছোটবার মাথায় অনুপম বলে পা দেওয়া মাত্র স্বপন বুলডোজারের। মতো এগিয়ে এসে ধাক্কা মারল। ফাউল। গ্যালারিতে বিশ্রী কথাবার্তা আর চিৎকার শুরু হয়ে গেল। যাত্রীর রাইট ব্যাক ফ্রি কিক করে পেনাল্টি এরিয়ার মধ্যে বল ফেলা মাত্র প্রাণবন্ধু হেড দিয়ে ক্লিয়ার করার জন্য উঠল, আর প্রায় পনেরো গজ ছুটে এসে ভরত তার মাথার উপর থেকে বলটা তুলে নিয়ে একগাল হাসল।

ভরত, হচ্ছে কী, গোলে দাঁড়া। কমল ধমক দিল।

কিক করে বলটা মাঝমাঠে পাঠিয়ে ভরত বলল, কমলদা, পেনাল্টি এরিয়ার মধ্যে কাউকে আজ মাথায় বল লাগাতে দেব না।

যাত্রী শুরুতেই ধাক্কা দিয়ে তারপর ক্রমশ এগিয়ে এসে শোভাবাজারের পেনাল্টি এরিয়াকে ছয়জনে ঘিরে ধৱল এবং দুই উইং ব্যাকও উঠে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিল। শোভাবাজারের গোপাল ছাড়া আর সবাই গোলের মুখে নেমে এসেছে। কমল বিপদের গন্ধ পেল। আঠারো জন লোক একটা ছোট জায়গার মধ্যে গুঁতোগুঁতি করতে করতে হঠাৎ কখন কে ফাঁক পেয়ে গোলে বল মেরে দেবে এবং এই রকম অবস্থায় সাধারণত ভিড়ের জন্য গোলকিপারের দৃষ্টিপথ আড়াল থাকে। তা ছাড়া ট্যাকল করার আগে কোনও রকম বিচারবোধ ব্যবহার না করায় এবং যথেষ্ট স্কিল না থাকায় শোভাবাজারের ডিফেন্ডাররাও বেসামাল হতে শুরু করেছে।

এতটা ডিফেন্সিভ হওয়া উচিত হয়নি। কমল দ্রুত চিন্তা করে যেতে লাগল। শুধু গোঁয়ার্তুমি সাহস বা দমের জোরে একটা স্কিল্ড অ্যাটাককে ঠেকানো যায় না। কাউন্টার-অ্যাটাক চাই। বল নিয়ে উঠতে হবে। গোপাল উঠে আছে কিন্তু ওকে বল দিয়ে কাজ হবে না। একা বল নিয়ে দুটো স্টপারকে কাটিয়ে বেরোবার ক্ষমতা ওর নেই। বল আবার ফিরে আসবে।

প্রাণবন্ধুর একটা মিসকিক কমল ধরে ফেলল। সামনেই যাত্রীর আব্রাহাম। কোমর থেকে একটা ঝাঁকুনির দোলা কমলের শরীরের উপর দিয়ে উঠে যেতেই আব্রাহাম টলে পড়ল। বল নিয়ে কমল পেনাল্টি এরিয়া পার হল।

ওঠ সলিল।

কমলের পিছনে প্রসূন, অনুসরণ করছে সলিল। কমলের ডাকে সে এগিয়ে এল। যাত্রীর হাফ ব্যাক অমিয় এগিয়ে আসতেই কমল বলটা ঠেলে দিল সলিলকে। দ্রুত শোভাবাজারের চারজন উঠছে। বল ডান থেকে বাঁ দিকে, আবার ঘুরে ডান দিকে এল। শেষ পর্যন্ত যাত্রীর কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে রুদ্রর কাছ থেকে বল কেড়ে নিল আনোয়ার।

কমল এগিয়ে এসেছে। প্রায় দশ মিনিট যাত্রীর চাপ তারা ধরে রেখেছিল। খেলাটাকে মাঝমাঠে আটকে রেখে যাত্রীর গতি মন্থর করাতে হবে। কমল বল ধরে পায়ে রাখতে শুরু করল। রুদ্র, সত্য আর দেবীদাস মাঠের মাঝখানে, শম্ভু ঠিক ওদের পিছনে। তার কাছে বল পাঠিয়ে কমল চার ব্যাকের পিছনে পেনাল্টি এরিয়া লাইনের উপর দাঁড়িয়ে লক্ষ করতে লাগল যাত্রীর কে কোথায় কী ভাবে নড়াচড়া করছে।

আঠার মতো লেগে আছে শোভাবাজারের চারটি ব্যাক যাত্রীর চার ফরোয়ার্ডের সঙ্গে। অনুপমের কাছে চার বার বল এসেছে এবং প্রতিবার সে বলে পা লাগাবার আগেই স্বপন ছিনিয়ে নিয়েছে। বল যখন যাত্রীর বাম কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে, অনুপম তখন শোভাবাজারের রাইট হাফের কাছাকাছি ডান টাচ লাইন ঘেঁষে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। ওর পাঁচ হাত দূরে স্বপন। অনুপম হাঁটতে লাগল সেন্টার লাইনের দিকে, ওর পাশাপাশি চলল স্বপনও। অনুপম হঠাৎ ঘুরে আবার আগের জায়গায় ফিরে এল, স্বপনও ওর সঙ্গে ফিরে এল। গ্যালারিতে যাত্রীর সমর্থকরা পর্যন্ত ব্যাপারটা দেখে হেসে উঠল। অনুপম ডান দিক থেকে বাঁ দিকে নিমাইয়ের জায়গায় ছুটে গেল, স্বপনও। যতবার বল তার দিকে আসে, স্বপন হয় টাচ লাইনের বাইরে ঠেলে দেয়, নয়তো মাঠের যেখানে খুশি কি করে পাঠায়। অনুপম দুবার স্বপনকে কাটিয়েই দেখে, কমল স্বপনকে কভার করে এগিয়ে এসে তার পথ জুড়ে আছে। কী করবে ভেবে ঠিক করার আগে স্বপনই ঘুরে এসে ছোঁ মেরে বলটা নিয়ে গেল।

শম্ভু পাগলের মতো মাঝমাঠটাকে ফালা ফালা করে দিচ্ছে যাত্রীর ফরোয়ার্ডদের উদ্দেশ্যে পিছন থেকে পাঠানো বল ধরার জন্য, ডাইনে বামে যেখান থেকেই আক্রমণ তৈরি হয়ে ওঠার গন্ধ পেয়েছে, ছুটে যাচ্ছে বুলডগের মতো। সব সময়ই যে সফল। হচ্ছে তা নয়, কিন্তু ওর জন্য বল নিয়ে যাত্রীর কেউ সহজে উঠে আসতে পারছে না। যদিও বা ওয়াল-পাস করে উঠে আসে, প্রাণবন্ধু নয় তো সলিল এগিয়ে আসে চ্যালেঞ্জ করতে।

প্রসূন পিছিয়ে নেমে এসেছে। সলিলও তার সঙ্গে যাচ্ছিল, কমল বারণ করল।

মাঝমাঠে যত ইচ্ছে প্রসূন খেলুক, তুই এখানে থাক! যখনই উঠে আসবে আবার লেগে থাকবি।

তারপরই যাত্রীর দুই উইং ব্যাক দুদিক থেকে উঠতে শুরু করল। কমল বিপদ দেখতে পেল। নিমাই, আব্রাহাম আর অনুপম ছোটাছুটি করে ছড়িয়ে যাচ্ছে বলাই, প্রাণবন্ধু আর স্বপনকে নিয়ে। প্রসূন বল নিয়ে উঠছে, দুপাশ থেকে উইং ব্যাক দুজন। কমল দুদিকে নজর রাখতে লাগল কোন দিকে প্রসূন বল বাড়িয়ে দেয়।

চার ব্যাকের পিছনে মাঝামাঝি জায়গায় কমল দাঁড়াল। প্রসূন দেবীদাসকে কাটাল, শম্ভুর স্লাইডিং ট্যাকল ব্যর্থ হল। সলিল এগোচ্ছে। প্রসূনের বাঁ কাঁধ সামান্য ঘুরেছে। গোলের দিকে, এবার ডানদিকে বল বাড়াবে। কমল তার বাঁ দিক চেপে সরে গিয়ে উঠে আসা রাইট ব্যাকের দিকে নজর দিল আর প্রসূন অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় শরীর মুচড়ে তার বাঁ দিকে বল পাঠাল, যেখানে লেফট ব্যাক বাঁ দিক থেকে ফাঁকায় উঠে এসেছে।

প্রায় পঁচিশ হাজার কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল—গো-ও-ল গো-ও-ল। সেই প্রচণ্ড শব্দের মধ্যে জ্বালা ধরানো কোনও খবর ছিল যা কমলের স্নায়ুকেন্দ্রে মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটাল। বাঁ দিকে ঝোঁকা দেহভারকে সে চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতায় ডান দিকে ঘুরিয়ে ছুটে এল লেফট ব্যাকের সামনে। প্রায় ১২ গজ দূরত্ব গোল থেকে। শট নিলে নিশ্চিত গোল। হঠাৎ সামনে কমলকে দেখে সে শট নিতে গিয়েও নিতে পারল না। পলকের মধ্যে কমল বলটা কেড়ে নিয়ে যখন রুদ্রর কাছে পাঠাল তখন গ্যালারির চিৎকার চাপা হতাশায় কাতরে উঠেছে। প্রায় ত্রিশ মিনিট খেলা হয়ে গেল, এখনও গোল হল না। শোভাবাজার একবারও যাত্রীর গোলের দিকে যায়নি।

কিন্তু হাফ টাইমের কয়েক সেকেন্ড আগে শম্ভুর পা থেকে ছিটকে যাওয়া বল পেয়ে গোপাল অভাবিত যাত্রীর গোলের দিকে ঊ, খাসে ছুটে যায় আনোয়ার ও অমিয়কে পিছনে ফেলে। গোলকিপার শ্যাম এগিয়ে এসেছে। গোপাল প্রায় চোখ বুজেই শট নেয়। শ্যামের ঝাঁপানো হাতের নাগাল পেরিয়ে বল ক্রসবারে লেগে মাঠে ফিরে এল।

সারা মাঠ বিস্ময়ে নির্বাক। অকল্পনীয় ব্যাপার, শোভাবাজার গোল দিয়ে ফেলেছিল প্রায়। বিস্ময়ের ঘোর কাটল রেফারির হাফ টাইমের বাঁশিতে। মাঠের সীমানার বাইরে এসে শোভাবাজারের ছেলেরা একে একে বসে পড়ল। কৃষ্ণ মাইতি জলের গ্লাস আর তোয়ালে নিয়ে ব্যস্ত। প্লেয়াররা কেউ কথা বলছে না। পরিশ্রান্ত দেহগুলো ধুকছে। অবসন্নতায় পিঠগুলো বেঁকে গেছে।

কৃষ্ণ মাইতি হাত নেড়ে বক্তৃতা দেওয়ার ঢঙে বলল, এবার লং পাসে খেলে যা, শর্ট পাস বন্ধ কর! সত্য, তুই অত নেমে খেলছিস কেন, উঠে খেল। সলিল, আরও রোবাস্টলি খেলতে হবে, বার কয়েক পা চালা, আব্রাহমটা দারুণ ভিতু।

কমল হাত তুলে কৃষ্ণ মাইতিকে চুপ করতে ইশারা করল, এখন ওদের কিছু বলবেন না।

সলিল বলল, কমলদা, ওটা আমারই দোষ ছিল। প্রসূন পাসটা অত আগেই দেবে বুঝতে পারিনি, নয়তো আগেই ট্যাক্স করতুম। আপনি না থাকলে গোল হয়ে যেত।

কমল কথাগুলো না শোনার ভান করে গ্যালারির শেষ প্রান্তে তাকাল। চেষ্টা করল একটা মুখ খুঁজে বার করতে ব্যর্থ হয়ে বলল, অমিতাভ এসেছে কি?

সলিল বলল, হ্যাঁ, ওই তো। ওই যে একজন মেয়েছেলে বসে আছে—ঠিক তার সামনে। বল আনতে গিয়ে আমি দেখেছি।

কমল আবার তাকাল।

যাত্রীর মেম্বারদের মধ্যে থমথমে ভাব। কেউ কেউ উত্তেজিত। অনুপমের এ কী খেলা! ডিফেন্স যখন ক্রাউডেড করেছে তা হলে ওদের টেনে বার করে ফাঁকা করুক!প্রসূন নিজে গোলে না মেরে পাস দিতে গেল কেন?

শম্ভুর ট্যাকলিং প্রত্যেকটা ফাউল, রেফারি দেখেও দেখছে না। আব্রাহামকে যে অফসাইডটা দিল দেখেছেন তো?একবার বল এনেছে তাতেই গোল হয়ে যাচ্ছিল; চলে না, আনোয়ার ফানোয়ার আর চলে না।

কমল উঠে দাঁড়িয়ে তাকাল। কানে এল কচি গলায় পিন্টু ডাকছে, কমলমামা, কমলমামা, এই যে আমরা এখানে।

.

১৮.

রেফারি বাঁশি বাজাল।

মনে আছে তো, শোভাবাজার আজ লড়বে! মাঠে নামার সময় কমল মনে করিয়ে দিল। ওরা কথা বলল না।

কমল আশা করেছিল যাত্রী ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু সাবধানে ওরা মাঝমাঠে বল রেখে খেলছে। মিনিট পাঁচেক কেটে যাবার পর অনুপম বল পেয়ে কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে ছুটে থমকে স্বপনকে কাটিয়ে নিয়ে ঢুকতে গিয়ে কমলের কাছে বাধা পেল। সেন্টার করল সে। ভরত সহজেই আব্রাহামের মাথা থেকে বল তুলে নিল।

স্বপন, কী ব্যাপার! অনুপম বিট করে গেল? কমল কথাগুলো বলতে বলতে এগিয়ে গেল। আবার অনুপম এগোচ্ছে বল নিয়ে।

স্বপন এবারও পিছনে পড়ে ঘুরে এসে আর চ্যালেঞ্জ করল না। কমল বুঝে গেল স্বপন আর পারছে না। এবং লক্ষ করল, বলাই এবং প্রাণবন্ধুও মন্থর হয়ে এসেছে। সলিলের মধ্যে ক্লান্তির ছাপ এখনও দেখা দেয়নি। শম্ভু মাঝমাঠে দোর্দণ্ড হয়ে রয়েছে। যেখানে বল সেখানেই ছুটে যাচ্ছে। দেবীদাস আর সত্য বল দেওয়া-নেওয়া করে যাত্রীর হাফ লাইন পর্যন্ত বার কয়েক পৌঁছতে পেরেছে।

ফাউল করেছে শম্ভু। যাত্রীর রাইট ব্যাকের বুকে পা তুলে দিয়েছে। সে কলার ধরেছে শম্ভুর। গ্যালারি থেকে কাঠের টুকরো আর ইট পড়ছে মাঠে শম্ভুকে লক্ষ্য করে। এর এক মিনিট পরেই শম্ভুকে মাঠের বাইরে যেতে হল। আব্রাহাম, অমিয় আর শম্ভু এক সঙ্গে বলের উদ্দেশ্যে ছুটে গিয়ে এক সঙ্গেই মাটিতে পড়ে গেল। দুজন উঠে দাঁড়াল, শম্ভুকে ধরাধরি করে বাইরে আনা হল। এবং মিনিট তিনেক পর যখন সে। মাঠে এল তখন খোঁড়াচ্ছে।

মাঝমাঠে এখন যাত্রীর রাজত্ব। শম্ভু ছুটতে যায় আর যন্ত্রণায় কাতরে ওঠে।

কমলদা, আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। আমাকে শেষ করে দিয়েছে। ওদের একটাকে নিয়ে বরং আমি বেরিয়ে যাই।

না। তুই বোস। রতনকে নামতে বল।

আমি বরং প্রসূনকে নিয়েও ভাল খেলছে।

খেলুক। খেলতে হবে ওকে। কমলের রগের শিরা দপদপ করে উঠল। না খেললে কমল গুহকে টপকানো যাবে না।

শম্ভু বসল এবং তৃতীয় ডিভিশন থেকে এই বছরেই আসা নতুন ছেলে রতন নামল। তখন গ্যালারিতে পটকা ফাটল। যাত্রীর আক্রমণে আট জন উঠে এল এবং ক্লান্ত শোভাবাজার সময় গুনতে লাগল কখন গোল হয়। এবং

একটা প্রাচীন অশ্বথ গাছের মতো কমল গুহ তখন শোভাবাজারের পেনাল্টি এরিয়ার মধ্যে শাখা বিস্তার করে দিল। কখনও সে বন্য মহিষ কখনও বনবিড়াল, কখনও গোখরো সাপ। শোভাবাজার পেনাল্টি এলাকাটা ভয়ংকর করে তুলল কমল তার ক্রুদ্ধ চতুর হিংস্র বিচরণে। একটার পর একটা আক্রমণ আসছে, প্রধানত সলিলকে নিয়ে কমল সেগুলো রুখে যাচ্ছে। আর গ্যালারিতে অশ্রান্ত গর্জন ক্রুদ্ধ-হতাশায় আর্তনাদে পরিণত হচ্ছে।

এইবার, এইবার যাত্রী, আমি শোধ নেব। কমল নিজের সঙ্গে কথা বলে চলে। আমার মাথা নোয়াতে পারোনি, আজও উঁচু করে বেরোব মাঠ থেকে। গুলোদা, রথীন, এদের সব ব্যঙ্গ সব বিদ্রুপ আজ ফিরিয়ে দেব। বল আনছে প্রসূন, এগোক, এগোক, সলিল আছে। ওর পিছনে আমি। আহ্ লেফট উইং নিমাইকে দিল, বলাই চেজ করছে, ওর পিছনে আমি আছি।

কমলের সামনে বল নিয়ে নিমাই থমকে দাঁড়াল। ডাইনে ঝুঁকল, বাঁয়ে হেলল। কমল নিস্পৃন্দের মতো, চোখ দুটি বলের দিকে স্থির। নিমাই কাকে বলটা দেওয়া যায় দেখার জন্য মুহূর্তের জন্য চোখ সরাতেই ছোবল দেবার মতো কমলের ডান পা নিমাইয়ের হেফাজত থেকে বলটা সরিয়ে নিল।

কমল বল নিয়ে উঠছে। আয়, আয় কে আসবি, গুলোদা, সরোজ, রথীন, রণেন দাস—কোথায় অনুপমের ভক্তরা—আয় কমল গুহর পায়ে বল, আয় দেখি কেড়ে নে।

রাইট হাফকে কাটিয়ে কমল দাঁড়িয়ে পড়ল। সাইড লাইনের ধারের বেঞ্চে রথীন। ওর সুশ্রী মুখটা যন্ত্রণায় মুচড়ে রয়েছে। কমল একবার মুখ ফিরিয়ে রথীনের দিকে তাকিয়ে হাসল। আজও জ্বালাচ্ছি তোদের। বছরের পর বছর আমি জ্বলেছি রে। আমাকে বঞ্চিত করে যাত্রী তোকে ইন্ডিয়ার জার্সি পরিয়েছে, আমাকে প্রাপ্য টাকা থেকে বঞ্চিত করেছে যাত্রী, আমাকে সাধারণ প্লেয়ারের মতো বসিয়ে রেখে অপমান করেছিল…কমল মাঠের মধ্যে সরে আসতেই, দুজন এগিয়ে এল চ্যালেঞ্জ করতে। হঠাৎ গতি বাড়িয়ে কমল দুজনের মধ্যে দিয়ে পিছলে এগিয়ে গেল, বলটা আঠার মতো পায়ে লেগে রয়েছে—অমিতাভর মায়ের মৃত্যুর খবরটা যাত্রী আমাকে দেয়নি রে রথীন। ট্রফি জিততে কমল গুহকে দরকার, তাই খবরটা চেপে গেছল।…আর একজন সামনে এগিয়ে এল কমলের। ডান দিকে সরে যেতে লাগল কমল। বল নিয়ে দাঁড়াল। গোল প্রায় তিরিশ গজ। বলটা আর একটু এগিয়ে নিয়ে কমল শট নিল। নিখুঁত মাপা শট। বার ও পোস্টের জোড় লক্ষ্য করে বলটা জমি থেকে উঠে যাচ্ছে। গ্যালারিতে হাজার হাজার হৃদস্পন্দনের শব্দ মুহূর্তের জন্য তখন বন্ধ হয়ে গেল। শ্যাম লাফিয়ে উঠে চমৎকার ভাবে আঙুলের ডগা দিয়ে বলটা বারের উপর তুলে দিতেই মাঠের চারধারে আবার নিশ্বাস পড়ল।

কর্নার। শোভাবাজারের আজ প্রথম। যাত্রী পেয়েছে আটটা। তার মধ্যে সাতটাই ভরত লুফে নিয়েছে। বল বসাচ্ছিল দেবীদাস। সত্য ছুটে এসে তাকে সরিয়ে দিল। যাত্রীর ছজন গোলের মুখে। শোভাবাজারের পাঁচজনকে তারা আগলে রেখে দাঁড়াল।

সত্য কিক নিল। মসৃণ গতিতে বলটা রামধনুর মতো বক্রতায় গোলমুখে পড়ছিল। গোপাল লাফাল। তার মাথার উপর থেকে পাঞ্চ করল শ্যাম। প্রায় পনেরো গজ দূরে। গিয়ে বল পড়ছে। সেখানে দেবীদাস। দুজন তার দিকে ছিটকে এগোল।

দেবী!

বাঁ পাশ থেকে ডাকটা শুনেই দেবীদাস বলটা বাঁ দিকে ঠেলে সরে গেল। পিছন থেকে ঝলসে বেরিয়ে এল একটা চেহারা। তার বাঁ পা-টা উঠল এবং বলে আঘাত করল। বাম পোস্ট ঘেঁষে বলটা যাত্রীর গোলের মধ্যে ঢুকল। এমন অতর্কিত ব্যাপারটা ঘটে গেল যে খেলোয়াড়রা শুধু অবিশ্বাসভরে আঘাতকারীর দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কয়েক সেকেন্ড চোখ সরাতে পারল না।

যাত্রীর মেম্বারদের মধ্যে কথা নেই। শুধু একটি ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল মাত্র, অত মাংস খাবে কে এবার!

বিপুল ঘোষ হতভম্ব হয়ে অমিতাভকে বলল, য়্যাঁ, যুগের যাত্রী গোল খেয়ে গেল! কে গোলটা দিল?

অমিতাভ গলার কাছে জমে ওঠা বাষ্প ভেদ করে অস্ফুটে শব্দগুলো বার করে আনল, কমল গুহ। তারপর লাজুক স্বরে যোগ করল, আমার বাবা।

ঝাঁপিয়ে পড়ল যাত্রী শশাভাবাজারের গোলে। চার মিনিট বাকি। পর পর তিনটি কর্নার, দুটি ফ্রি কিক যাত্রী পেল। আব্রাহামের চোরা ঘুষিতে বলাইয়ের ঠোঁট ফাটল। কিন্তু সেই বৃহৎ প্রাচীন অশ্বত্থ গাছটি সব ঝড়ঝাপটা থেকে আড়াল করে রাখল তার পিছনের গোলটিকে।

শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে মাঠের মধ্যে দৌড়ে এল শম্ভু। আমি সেরে গেছি, আমি সেরে গেছি কমলদা। আমার আর ব্যথা নেই।

প্রথম কমলের দুই হাঁটু জড়িয়ে তাকে উপরে তুলল সত্য। তারপর কী ভাবে যেন চারটে কাঁধ চেয়ার হয়ে কমলকে বসিয়ে নিল। ইস্টবেঙ্গল মেম্বার-গ্যালারি উত্তেজনায় বিস্ময়ে টগবগ করছে।

কাঁধের উপর কমলকে তুলে ওরা মাঠের বাইরে এল। কৃষ্ণ মাইতির গলা ধরে গেছে চিৎকার করে। কমল, বল বল, আমি প্লেয়ার চিনি কি না বল। নিজের রিকে সব অপোজিশন অগ্রাহ্য করে তোকে খেলিয়েছিলুম আগের ম্যাচে, বল ঠিক বলছি কি না।

কমলের মস্তিষ্ক ঘিরে এখন যেন একটা কালো পরদা টাঙানো। কী ঘটছে, কে কী বলছে তার মাথার মধ্যে ঢুকছে না, কোনও আবেগ বেরোতেও পারছে না। ক্লান্তিতে দুচোখ ঝাপসা। তার শুধু মনে হচ্ছে, কিছু অর্থহীন শব্দ আর কিছু মানুষ তার চারপাশে কিলবিল করছে। কমল ভারবাহী একটা ক্রেনের মতো নিজের শরীরটা নামিয়ে দিল ভূমিতে। দুহাতে মুখ ঢেকে সে উপুড় হয়ে শুয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর টপটপ করে তার চোখ থেকে জল ঝরে পড়ল ঘাসের উপর। কেন পড়ছে তা সে জানে না।

অতি যত্নে তার পা থেকে বুট খুলে দিচ্ছে কে! কমল মাথা ফিরিয়ে দেখল, সলিল। গ্যালারির দিকে কমল তাকাল। একটা পটকাও ফাটেনি। পতাকা ওড়েনি। উৎসব করতে আসা মানুষগুলো নিঃশব্দে বিবর্ণ অপমানিত মুখগুলোয় শ্মশানের বিষণ্ণতা নিয়ে মাঠ থেকে চলে যাচ্ছে। গ্যালারি ক্রমশ শূন্য হয়ে এল। বেদনায় মুচড়ে উঠল কমলের বুক। আর কখনও সে মাঠের মধ্যে থেকে ভরা-গ্যালারি দেখতে পাবে না। কমল গুহ আজ জীবনের শেষ খেলা খেলেছে।

কমল উঠে দাঁড়াল। কোনও দিকে না তাকিয়ে মুখ নিচু করে সে মাঠের মাঝে সেন্টার সার্কেলের মধ্যে এসে দাঁড়াল। আকাশের দিকে মুখ তুলল। অস্ফুটে বলল, আমি যেন কখনও ব্যালান্স না হারাই। আমার ফুটবল যেন সারা জীবন আমাকে নিয়ে খেলা করে।

কমল নিচু হয়ে মাটি তুলল। কপালে সেই মাটি লাগিয়ে মন্ত্রোচ্চারণের মতো বলল, অনেক দিয়েছ, অনেক নিয়েছও। আজ আমি বরাবরের জন্য তোমার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। জ্ঞানত তোমার অসম্মান করিনি। নতুন নতুন ছেলেরা আসবে তোমাকে গৌরব দিতে। দয়া করে আমাকে একটু মনে রেখো।

কমলদা, চলুন এবার। মাঠের বাইরে থেকে ভরত চেঁচিয়ে ডাকল। ওরা অপেক্ষা করছে তার জন্য।

মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার সময় কমল দেখল, সেই সাংবাদিকটিকে খুব উত্তেজিত স্বরে কৃষ্ণ মাইতি বলছে, আমিই তো কমলকে, বলতে গেলে, আবিষ্কার করি; ফুটবলের অ আ ক খ প্রথম শেখে আমার কাছেই।

শুনে কমল হাসল। তারপরই চোখে পড়ল অমিতাভ দূরে দাঁড়িয়ে। কমল অবাক হল, বুকটা উৎকণ্ঠা আর প্রত্যাশায় দুলে উঠল।

এগিয়ে এসে প্রায় চুপিচুপিই বলল, আজ জীবনের শেষ খেলা খেললাম, কেমন লাগল তোমার?

অমিতাভ উত্তেজনায় থরথর স্বরে বলল, তোমার জন্য আমার গর্ব হচ্ছিল বাবা।

সত্যি! কমলের বিস্ময় হাউয়ের মতো ফেটে পড়ল চোখেমুখে। তার মনে হল গ্যালারিগুলো আবার ভরে গেল।

সত্যিই।

যদি আমার দশ বছর আগের খেলা তুই দেখতিস! কমল হাসতে শুরু করল।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress