তরুণ সাংবাদিক (Stopper)
০১.
এসে গেছেন! আচ্ছা এক মিনিট, আপনি বরং এখানেই বসুন।
অনুরোধ নয়, যেন নির্দেশ। তরুণ সাংবাদিক ঢোঁক গিলে ঘাড় নাড়ল এবং নড়বড়ে লোহার চেয়ারটায় বসে সপ্রতিভ হবার জন্য রুমাল দিয়ে ঘাড় গলা মুছে, পায়ের উপর পা তুলে প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করল, তারপর কী ভেবে সিগারেটটা আবার প্যাকেটে ভরে রাখল।
তার দশ গজ দূরেই ছড়িয়ে রয়েছে হাফপ্যান্ট পরা, কতকগুলো আদুড় দেহ। তারা ঘাসের উপর চিত হয়ে, উপুড় হয়ে বা পা ছড়িয়ে বসে। ঘাম শুকিয়ে এখন ওদের চামড়ার রং ঝামা ইটের মতো বিবর্ণ, খসখসে। সন্তর্পণে তারা শ্রান্ত হাত পা বা মাথা নাড়ছে। চোখের চাহনি ভাবলেশহীন এবং স্থির।
ওদের একজন গভীর মনোযোগে পায়ের গোছে বরফ ঘষছে; ধুতি পাঞ্জাবি পরা স্থূলকায় এক মাঝবয়সী লোক তার সামনে উবু হয়ে দুবার কী বলল, মাথা নিচু করে ছেলেটি বরফ ঘষেই যাচ্ছে, জবাব দিল না।
উপুড় হয়ে দুই বাহুর মধ্যে মাথা গুঁজে এতক্ষণ শুয়েছিল যে ছেলেটি, সে হঠাৎ উঠে বসে কর্কশস্বরে চিৎকার করল, কেষ্ট, কতক্ষণ বলেছি জল দিয়ে যেতে।
তাঁবুর পিছন দিক থেকে একটা চাপা গজগজানি এর জবাবে ভেসে এল।
তরুণ সাংবাদিক তাঁবুর ভিতরে তাকাল। তাঁবুর মাঝখানে সিমেন্টের একফালি চত্বর। পাতলা কাঠের পাল্লা দেওয়া স্প্রিং-এর দরজা দুধারে। দরজাগুলো ঝাপট দিচ্ছে ব্যস্ত মানুষের আনাগোনায়, চত্বরটার পিছনটা খোলা। সেখান দিয়ে পাশের তাঁবু এবং একটা টিউবওয়েল দেখা যাচ্ছে। একটা গোল স্টিলের টেবিল চত্বরের মাঝখানে, সেটা ঘিরে সাত-আটজন লোেক বসে এবং গলা চড়িয়ে তারা তর্ক করছে। কয়েকটা চায়ের কাপ টেবিলে। একজন চোখ বুজে টোস্ট চিবোচ্ছে। পাখা ঘুরছে। বাইরে থেকে বোঝা যায় তাঁবুর ভিতরটায় ভ্যাপসা গুমোট।
আপনার চা।
সাংবাদিক চমকে তাকাল। গেঞ্জি পরা একটা ছেলে, হাতে ময়লা কাপ। দুটি বিস্কুট কোনওক্রমে কাপের কিনারে পিরিচে জায়গা করে রয়েছে।
আমার! আমি তো
কমলবাবু পাঠিয়ে দিলেন।
সাংবাদিক হাত বাড়িয়ে পিরিচটা ধরল, আর চা খেতে খেতে মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে লাগল গত দুদিন ধরে তৈরি করে রাখা প্রশ্নগুলো।
তোকে পইপই বললাম, ডানদিকটা চেপে থাক, তবু ভেতরে চলে আসছিলিস।
আমি কী করব, শম্ভুটা বার বার বলছে রাখতে পাচ্ছি না, রাখতে পাচ্ছি না, বলাই একটু এধারে এসে আগলা। সাইড আর মিডল দুটো ম্যানেজ করব কী করে?
সলিলটা যদি চোট না পেত! ভালই খেলছিল। সুকল্যাণের ওই শট গোললাইনে বুক দিয়ে আটকানো, বাক্স। আমি তো ভাবলাম বুকটা ফেটে গেল বুঝি।
সলিলের লেগেছে কেমন?
কে জানে, কমলদা তো ভেতরে নিয়ে গিয়ে কী সব ওষুধ টষুধ দিচ্ছে।
পুষ্যিপুত্তুর কিনা, তাই ওর বেলা ওষুধ আর আমাদের বেলা বরফ ঘষো।
ট্যালেন্ট। ওর মধ্যে ট্যালেন্ট আছে আর আমাদের মধ্যে গোবর। যাকগে, ছোটমুখে বড় কথা বলে লাভ নেই; বলাই, মনে থাকে যেন কাল ঠিক সাড়ে পাঁচটায়। বসুশ্রীর গেটে।
এখনও তোর কাছে চার আনা পাই।
কীসের চার আনা?
ভুলে মেরে দিচ্ছ বাবা, দিলকো-দেখোর টিকিট কাটার সময় ধার নিয়েছিলি না?
উঃ, কবেকার কথা ঠিক মনে রেখে দিয়েছিস তো। চার আনা আবার পয়সা নাকি!
সাংবাদিক কান খাড়া করে ওদের কথা শুনছে। ডিগডিগে লম্বা যে ছেলেটি এতক্ষণ চিত হয়ে দুহাতে চোখ ঢেকে শুয়েছিল, অস্ফুট একটা শব্দ করে হাত নামিয়ে তাকাতেই সাংবাদিকের সঙ্গে চোখাচোখি হল।
রেজাল্ট? সাংবাদিক চাপা গলায় জানতে চাইল।
পাঁচ।
সাংবাদিক সমবেদনা জানাতে চোখ মুখে যথাসম্ভব দুঃখের ভাব ফুটিয়ে তুলল। ছেলেটি শুকনো হেসে বলল, ডজন দিতে পারত, দেয়নি।
সিজনের প্রথম খেলা এটা?
ছেলেটি ঘাড় নেড়ে উঠে বসল। ঢোঁক গিলল, শুকনো ঠোঁট চাটল, জিরজিরে বুক। কাঁধে উঁচু হয়ে রয়েছে হাড়। কোমর থেকে পাতা পর্যন্ত পা দুটো সমান। পেশির ওঠানামা কোথাও ঘটেনি। সাংবাদিকের মনে হল ছেলেটিকে গোল পোস্টের মাঝখানে ছাড়া মাঠের আর কোথাও ভাবা যায় না।
সরি, অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। চা দিয়ে গেছে তো?
একটা চেয়ার টানতে টানতে কমল গুহ সাংবাদিকের পাশে এনে রাখল।
আর এক কাপ হোক।
না না, আমি বেশি চা খাই না।
ভাল। বেশি চা খেলে স্বাস্থ্য থাকে না। গত পঁচিশ বছরে আমি ককাপ চা খেয়েছি বলে দিতে পারি। ফুটবলারের সব থেকে আগে দেখা উচিত নিজের শরীরটাকে। নয়তো বেশিদিন খেলা সম্ভব নয়। ফার্স্ট ডিভিশনেই কুড়ি বছর, হ্যাঁ, প্রায় কুড়ি বছরই খেলছি।
সাংবাদিক ইতিমধ্যে তার নোটবই খুলে বল পেনের আঁচড়ে দুচার কথা লিখে ফেলেছে।
আপনার বয়স কত এখন?
আপনিই বলুন।
কুড়ি বছর যদি ফাস্ট ডিভিশনে হয় তা হলে অন্তত চল্লিশ।
কমলের চোখে আশাভঙ্গের ছাপ ফুটে উঠল। আপনি আমার কেরিয়ার থেকে হিসেব করে বললেন। কিন্তু আমায় দেখে বলুন তো বয়স কত?
ভ্রূ কুঁচকে সাংবাদিক বোর্ডে দুরূহ কোনও অঙ্কের দিকে তাকানো মেধাবী ছাত্রের মতো ওর দিকে তাকাল। চুলগুলো কোঁকড়া, মোটা, ছোট করে ছাঁটা। দুকানের উপরে অনেক চুল পাকা। কপালে রেখা পড়েছে তিন-চারটি। সাংবাদিকের মনে পড়ল একটা বইয়ে পাতাজোড়া স্ট্যানলি ম্যাথুজের মুখের ছবি সে দেখেছিল। তলায় লেখা—দি ফেস অফ থারটিফাইভ ইয়ারস অফ টেনশন ইন ফুটবল। ম্যাথুজের কপালে পাঁচটি রেখা; ঠোঁটের কোলে একটি, তার পরেই আর একটু বড় আকারের টানাপোড়েনে থরথর দুটি ঢেউ যেন আছড়ে পড়েছে। এরপর চোখের কোণ পর্যন্ত সারা গাল বেলাভূমির মতো কুঞ্চিত। কিন্তু কমল গুহর চোখ ম্যাথুজের মতন বিশ্রামপ্রত্যাশী অবসন্ন নয়। পাথরের মতো ঝকঝকে, কোটরের মধ্যে বসানো। অসন্তুষ্ট, বিক্ষুব্ধ এবং চ্যালেঞ্জ জানায়।
সাংবাদিক নোটবইটা কাত করে, কমল গুহর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায়ই পাতার কোনায় চট করে লিখল—রাগী ভোঁতা, সেন্টিমেন্টাল।
বেশি দুধ দেওয়া চায়ের মতন গায়ের রং কিংবা মেদহীন মধ্যমাকৃতি এই বাঙালি ফুটবলারের চেহারার মধ্যে সাংবাদিক কোনও বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেল না। গলার স্বর ঈষৎ ভারী ও কর্কশ। শুধু চোখে পড়ে হাঁটার সময় দেহটি বাহিত হয় শহিদ মিনারের মতো খাড়া মেরুদণ্ড দ্বারা। হাঁটার মধ্যে ব্যস্ততা নেই।
আটাশ, বড়জোর তিরিশ। সাংবাদিক ইতস্তত করে বলল।
আচমকা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল কমল গুহ। সাংবাদিকের অস্বস্তি দেখে হাসিটা আরও বেড়ে গেল। তাঁবুর সামনে দিয়ে দুটো ঘোড়সওয়ার পুলিশ ডিউটি সেরে ফিরছিল। তারা বাধ্য হল ঘোড়ার রাশ টেনে ফিরে তাকাতে।
বড্ড কমালেন কিন্তু। আমার অফিসের বয়স কমাননা আছে বটে, কিন্তু এতটা কমাতে সাহস হয়নি। কিছু মনে করবেন না, আপনার বয়স কত?
সাংবাদিক গলা খাঁকারি দিয়ে খুব গম্ভীর হতে হতে বলল, পঁচিশ।
কমল গুহ ভুরু নাচিয়ে বলল, আসুন মাঠটা দশ পাক দৌড়ে আসি।
তা কী করে সম্ভব? সাংবাদিক প্রতিবাদ করল। একজন ফুটবলারের সঙ্গে আমি পারব কেন। আপনাকে যদি বলি এক পাতা লিখতে, পারবেন কি আমার মতন?
কমল গুহর মুখ থেকে মজার ভাবটা আস্তে আস্তে উবে গেল।
ঠিক। বলেছেন ঠিকই। আমি পারব না এক পাতা লিখতে। কিন্তু আপনি আমার বয়স জানতে চাইলেন কেন? আমার শরীরের ক্ষমতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাবার জন্যই তো? যদি বলি পঁচিশ তা হলে ভেবে নেবেন, অন্তত এগারো সেকেন্ডে আমি একশো মিটার দৌড়োতে পারি। যদি বলি চল্লিশ তা হলে সেটা পনেরো সেকেন্ড হয়ে যাবে। কিন্তু যদি আমরা দুজনে দৌড়োই এবং আপনাকে হারিয়ে দিই, তা হলে কি আমার বয়স পঁচিশ বছর বলে আপনি মেনে নেবেন না? সন তারিখ দিয়ে কি বয়স ঠিক করা যায়, শরীরের ক্ষমতাই হচ্ছে বয়স। বুঝলেন, এখন আমার বয়স সাতাশ।
সাংবাদিক টুক করে তার নোটবইয়ে হামবাগ কথাটা লিখে প্রশ্ন করল, আপনার লাস্ট ম্যাচ কোনটা যেটা খেলে রিটায়ার করেন?
রিটায়ার, আমি? লাস্ট ইয়ারেও দুটো ম্যাচ খেলেছি হাফ টাইমের পর। দরকার হলে এ বছরও খেলব। সলিলটা আজ হাঁটুতে চোট পেয়েছে, সারতে মাসখানেক লাগবে। হয়তো আমাকে নামতে হতে পারে। স্টপারে খেলা, ছোট একটা জায়গা নিয়ে, খুব একটা অসুবিধে হয় না।
স্ট্যানলি ম্যাথুজ তো প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত ফাস্ট ডিভিশন ফুটবল খেলে গেছেন। ইংল্যান্ডের হয়েই তো খেলেছেন তেইশ বছর।
মহাপুরুষ ওঁরা। তাও উইং ফরোয়ার্ডে। অত বয়সে ওই পজিশনে খেলা ভাবতে পারি না। আমি প্রথম যখন ফাস্ট ডিভিশনে শুরু করি, রাইট ইনে খেলতাম।
কোন ক্লাবে?
এখানে শোভাবাজার স্পোর্টিংয়েই প্রথম দুবছর, তারপর ভবানীপুর, দুবছর পর এরিয়ানে, সেখানে এক বছর কাটিয়ে যুগের যাত্রীতে চার বছর, মোহনবাগানে এক বছর, আবার যুগের যাত্রীতে দুবছর, তারপর আবার শোভাবাজারে। টু ব্যাক সিস্টেমে খেলা শুরু করে, থ্রি ব্যাক পার করে, ফোর ব্যাকে পৌঁছে গেছি। রাইট ইন থেকে পল্টুদা আমাকে স্টপারে আনেন।
কে পল্টুদা? সাংবাদিক বল-পেন উঁচিয়ে প্রশ্ন করল।
চিনবেন না আপনি। পল্টু মুখার্জি, আমার গুরু। থার্টি ফাইভে উনি খেলা ছেড়েছেন। দুখিরাম বাবুর হাতে তৈরি, খেলতেনও এরিয়ানে। ওঁর আজ্ঞা ছিল এই শোভাবাজার টেন্টে তাস খেলার। জুয়া, রেস, নেশাভাঙ করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কিন্তু তৈরি করেছেন অনেক ফুটবলার। ফুটবলের যতটুকু শিখেছি বা যতটুকু খ্যাতি পেয়েছি সবই ওঁর জন্য। গুরুর ঋণ আমি কোনওদিনই শুধতে পারব না। বলতে গেলে, রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আমাকে মানুষ করেছেন। কতদিন ওর বাড়িতেই খেয়েছি, থেকেছি। উনিই আমাকে ম্যাট্রিক পাশ করিয়েছেন।
কমল গুহ হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে জামা খুলতে শুরু করল। সাংবাদিক অবাক হয়ে থাকার মধ্যেই চট করে নোটবইয়ে লিখে ফেলল, গুরুবাদী।
জামাটা গলা পর্যন্ত তুলে কমল গুহ পিছন ফিরে বলল, দেখছেন ঘাড়ের নীচে শিরদাঁড়ার কাছে?
একটা বহু পুরনো, প্রায় দুইঞ্চি দাগ দেখতে পেল সাংবাদিক। হ্যাঁ, বুটের দাগ।
বুটের নয়, কাঁসার বগিথালা দিয়ে পিটিয়েছিলেন।
থালা দিয়ে!
কথাটা কে বলল দেখার জন্য সাংবাদিক পিছন ফিরে তাকাতেই তার শরীর সিরসিরিয়ে উঠল। একটা বনমানুষ যেন জামা প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে। নিকষ কালো রং, ভুরুর এক ইঞ্চি উপর থেকে শুরু মাথার চুল, চোখ দুটো কুতকুতে গর্তে ঢোকানো। নীচের ঠোঁট এত পুরু যে ঝুলে পড়েছে।
কমল গুহ সামনে ফিরে, দুহাতে মাথার চুলগুলোকে দুধারে টেনে বলল, এখানে। আছে একটা। খড়ম পরতেন তারই প্রমাণ রেখে দিয়েছেন।
এইভাবে মার খেয়েছেন, কই, কখনও তো বলেননি! ছেলেটির মুখ দেখে বোঝা যায় না তার মনে ভয় শ্রদ্ধার উদয় হয়েছে! কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত মুখের জমি প্রায় সমান। যেন ভূমিষ্ঠ হবার সময়ই মুখে প্রচণ্ড থাবড়া খেয়েছে। কণ্ঠস্বর ওর মনের ভাব প্রকাশ করে।
খেলা শেখার মাশুল; দস্তুর মতো মার খেয়ে শিখেছি। থালাটা পিঠে পড়েছিল আমাকে সিনেমা হল থেকে বেরোতে দেখে, খড়মটা মাথায় পড়ে টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে। বলতে বলতে কমল গুহর গলার স্বর ভারী হয়ে এল। চিকচিক করে উঠল চোখের সাদা অংশ। গুরু হতে গেলে যা হয়, তাই ছিলেন। এখন এভাবে খেলা শেখার কথা ভাবাই যায় না। শট মারতেও শিখল না, বলে কত টাকা দেবেন? যদি বলো ট্রেনিংয়ে আসনি কেন, অমনি চোখ রাঙিয়ে বলবে, আমি কি ক্লাবের চাকর? ওই জন্য কিছু আর বলি না। পচা পচা, সব পচা। যে হতে চায় তাকে তাগিদ দিতে হয় না।
কমল গুহ কথাগুলো বলল ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে। মুখ নামিয়ে ছেলেটি দাঁড়িয়ে।
আজই ডাক্তারের কাছে যাবি। হাঁটু খুব বিশ্রী ব্যাপার, কোনওরকম গাফিলতি করবি না। বহু ভাল ফুটবলারকে শেষ করে দিয়েছে এই হাঁটু। ট্যাক্সিতে যা, টাকা আছে তো?
ছেলেটি ঘাড় নাড়ল।
কমল গুহ সন্দিহান হয়ে বলল, কই, টাকা দেখি?
ঠিক চলে যাবখন। ছেলেটি ব্যস্ত হয়ে বলল। কমল গুহ পকেট থেকে একটা পাঁচটাকার নোট বার করে এগিয়ে ধরল।
না, না, বাসেই চলে যেতে পারব।
যা বলছি তাই কর।
ছেলেটিই শুধু নয়, সাংবাদিকও সেই গম্ভীর আদেশ শুনে কুঁকড়ে গেল। নোটটা নিয়ে ছেলেটি কমল গুহকে প্রণাম করল। কমল গুহ আলতো হাত রাখল পিঠে, তারপর ও চলে গেল বাঁ পা টেনে টেনে।
ছেলেটা সিরিয়াস। গুড মেটিরিয়াল। পড়াশুনা হয়নি, বুদ্ধি কম, কিন্তু খাঁটি সোলজার। যা হুকুম হবে তাই পালন করবে। প্রাণ দিতে বললে দেবে। এমন প্লেয়ারও দরকার হয়। দেখি কতখানি তৈরি করা যায়। কমল গুহর স্বর এই প্রথম কোমল শোনা গেল।
আপনি কি ওর কোচ? সাংবাদিক বলপেন বাগিয়ে ধরল।
কোচ? ওহনা, ক্লাবে এন আই এস থেকে পাশ করা কোচ একজন আছে। তবে। সলিলকে আমি নিজের হাতে গড়ছি। বস্তিতে থাকে, নটা ভাই বোন, যতটুকু পারি সাহায্য করি। বেঁচে থাকার লোভ তো সকলের মধ্যেই আছে, কিন্তু একটা সময় আসে যখন মানুষকে মরতেই হয়। তখন সে বেঁচে থাকে বংশধরের মধ্য দিয়ে। ফুটবলারকেও একসময় মাঠ ছাড়তে হয়। কিন্তু সে বাঁচতে পারে ফুটবলার তৈরি করে। সলিলই আমার বংশধর।
আপনার ছেলেমেয়ে কটি?
কমল গুহর মুখের উপর দিয়ে ক্ষণেকের জন্য বেদনা ও হতাশার মেঘ ভেসে চলে গেল। একটি মাত্র ছেলে। বয়স সতেরো, প্রি-ইউ পড়ে। আমার বিয়ে হয়েছিল খুবই অল্প বয়সে।
কোথায় খেলে এখন?
কোথাও না। জীবনে কোনওদিন ফুটবলে পা দেয়নি। হি হেটস্ ফুটবল। এমনকী খেলা পর্যন্ত দেখে না। আমার খেলাও দেখেনি কখনও। ভাবতে খুব অবাকই লাগে, তাই নয়?
আপনার স্ত্রীর ইন্টারেস্ট নেই আপনার খেলা সম্পর্কে?
কমল গুহ মাথা নাড়ল ক্লান্ত ভঙ্গিতে। নেই নয়, ছিল না। দশ বছর আগে মারা গেছে, আমার খেলার জীবনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেনি একদিনও। অমিতাভ তার মার কাছ থেকেই ফুটবলকে ঘৃণা করতে শিখেছে। পলিটিক্সের কথা বলে, তাই নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক করে, গান গায়, কবিতা লেখার চেষ্টা করে, কিন্তু ফুটবল সম্পর্কে একদিনও একটি কথা বলেনি।
স্ট্রেঞ্জ! সাংবাদিক তারপর নোটবইয়ে লিখল, স্যাড লাইফ।
কমল গুহ আনমনা হয়ে স্থির চোখে বহুদূরে এসপ্ল্যানেডের একটা নিওন বিজ্ঞাপনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সাংবাদিক অপেক্ষা করতে লাগল। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। যে সব ফুটবলার খালি গায়ে শুয়ে বসে ছিল, তারা স্নান সেরে ফিটফাট হয়ে এখন পাঁউরুটি আর মাংসের স্টু খাওয়ায় ব্যস্ত। তাঁবুর মধ্য থেকে ভেসে আসা টুকরো টুকরো কথা শোনা যাচ্ছে।
কালীঘাটের খেলার রেজাল্ট কী হল রে…
চলে না দাদা, চলে না, ওসব প্লেয়ার কলকাতা মাঠে সাতদিন খেলবে। বৃষ্টি নামুক, দেখবেন তখন কীরকম মাল ছড়াবে…
একশো টাকা হারব যদি কখনও নিমু হেড করে গোল দেয়…
আমাদের নেক্সট ম্যাচ কার সঙ্গে রে…
তুই বলটা শ্রীধরকে না দিয়ে গোপালকে চিপ করলি কেন, এয়ারে নায়িমের সঙ্গে কি ও পারে?
আপনার আর কি প্রশ্ন আছে?
সাংবাদিক ইতস্তত করে বলল, বহু প্রশ্ন ছিল।
যেমন? কমল গুহ নিরুৎসুক স্বরে জানতে চাইল।
আপনি ফিফটি সিক্স ওলিম্পিকে যাবেন বলেই সবাই ধরে নিয়েছিল কিন্তু যেতে পারেননি। কী তার কারণ? আপনি চারবার সন্তোষ ট্রফিতে খেলেছেন, রাশিয়ান টিমের সঙ্গে দুটো ম্যাচ খেলেছেন, ইন্ডিয়ার সেরা স্টপার হিসেবে আপনার নাম ছিল। অথচ কত আজেবাজে প্লেয়ার এশিয়ান গেমসে বা মারডেকায় খেলতে গেল আর আপনি একবারও ইন্ডিয়ার বাইরে যেতে পারেননি, কেন?
আর কী প্রশ্ন?
কমল গুহর নিরুৎসুক স্বর একটুও বদলায়নি। সাংবাদিক তাইতে গম্ভীর হয়ে ওঠা উচিত মনে করল। কলকাতার মাঠে আপনাদের মতো ফুটবলার আর পাওয়া যাচ্ছে না, তার কারণ কী? নব্বই মিনিটের ফুটবল আমাদের পক্ষে খেলা সম্ভব কি না? ফুটবল সিজন শীতকালে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলে খেলা আরও ভাল হবে কিনা…
সাংবাদিক থেমে গেল। তাঁবুর মধ্যে ফোন বাজছিল। একজন চিৎকার করে ডাকল, কমলদা, আপনার ফোন।
কমল গুহ চেঁচিয়ে তাকে বলল, আসছি, এক মিনিট ধরতে বল।
তারপর দ্রুত সাংবাদিককে বলল, আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে গেলে অনেকক্ষণ সময় লাগবে, আপনি বরং আর একদিন আসুন।
যদি আপনার বাড়িতে যাই?
তাঁবুর দিকে যেতে যেতে কমল গুহ বলল, তাও পারেন। ছুটির দিনে আসবেন। সকালে।
সাংবাদিক তার নোটবইটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কিছু একটা হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করল এবং গভীর বিরক্তিতে ভ্রূ কুঞ্চিত অবস্থায় শোভাবাজার স্পোর্টিংয়ের বেড়ার দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে একবার পিছু ফিরে তাকাল। তাঁবুর একটা জানলার মধ্যে দিয়ে কমল গুহকে দেখা যাচ্ছে, ঘাড় নিচু করে ফোনে কথা বলছে।
অরু! অরুণা? কী ব্যাপার, হঠাৎ যে…আঁ! পল্টুদা পড়ে গেছেন? ব্লাডপ্রেশার আবার…ডাক্তার কী বলেন!…দেখানো হয়নি! হ্যাঁ হ্যাঁ যাচ্ছি, এখুনি রওনা হচ্ছি। টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে, তুমি ডাক্তার আনো। ফোন রেখে কমল ঘরের একমাত্র লোক শোভাবাজারের সহ সম্পাদক অবনী মণ্ডলকে বলল, কিছু টাকা এখুনি চাই, শখানেক অন্তত।
অ্যাক—শো! এখন কোথায় পাব?
যেখান থেকে হোক, যেভাবে হোক এখনি।
চাই বললেই এখন কোথায় পাই, শোভাবাজারের ক্যাশে কত টাকা তা তো আপনাকে বলার দরকার নেই।
কমল একটা অসহায় রাগে আচ্ছন্ন হয়ে কথা বলতে পারল না কিছুক্ষণ। অবনী যা বলল তা সত্যি। কিন্তু এখনি টাকাও চাই। এই তাঁবুতে যারা গল্প করছে বা তাস খেলছে তারা কেউ একশো টাকা পকেটে নিয়ে ঘোরে না।
পল্টুদার স্ট্রোক হয়েছে, এই নিয়ে তিনবার। ওর বড় মেয়েই ফোন করেছে। কিন্তু কী করে এই মুহূর্তে টাকা পাওয়া যায় বলুন তো? বাড়িতে আছে কিন্তু এখন বাগবাজারে গিয়ে আবার নাকতলায় যেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে।
তাই তো, গড়ের মাঠে এই সময় একশো টাকা অবনী মণ্ডলের চিন্তিত গলা থেমে গেল। কমল ফোনটা তুলে দ্রুত ডায়াল করছে।
রথীন মজুমদার আছে? আমি কমল, কমল গুহ শোভাবাজার টেন্ট থেকে বলছি। খুব দরকার…হ্যাঁ ধরছি।
মিনিট দুয়েক অধৈর্য প্রতীক্ষার পর ওদিক থেকে সাড়া পেয়ে কমল বলল, কমল বলছি। সংক্ষেপে একশো টাকা চাওয়ার কারণটা জানিয়ে বলল, যদি পারিস তো দে, চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব তোর কাছে। অনেক তো করেছিস আমার জন্যে, এটাও কর। গুরুদক্ষিণা তো জীবনে দেওয়া হল না, চিকিৎসাটুকুও যদি করতে পারি। কালই অফিসে নিশ্চয়ই টাকাটা দিয়ে দেব।
ওধার থেকে জবাব শোনার জন্য অপেক্ষা করে কমল বলল, যুগের যাত্রী টেন্টে? এখনি? হ্যাঁ, হ্যাঁ, দশ মিনিটেই পৌঁছোচ্ছি।
কমল রিসিভারটা ছুড়েই ক্রেড়লের উপর ফেলল। তাঁবু থেকে দ্রুত বেরিয়ে বেড়ার দরজা পার হয়ে ময়দানের অন্ধকারে ঢোকার পর সে প্রায় ছুটতে শুরু করল। যুগের যাত্রীর তাঁবুর দিকে।
.
০২.
গত পনেরো বছরে কমল দুবার চাকরি, ছয় বার বাসা এবং ছয় বার ক্লাব বদল করেছে। শোভাবাজার স্পোর্টিং, ভবানীপুর, এরিয়ান, যুগের যাত্রী, মোহনবাগান, এবং আবার যুগের যাত্রী হয়ে এখন শোভাবাজারে আছে। এই সময়ে সে দর্জিপাড়া, আহিরিটোলা, শ্যামপুকুর, কুমারটুলি, আবার শ্যামপুকুর হয়ে এখন বাগবাজারে বাসা নিয়েছে। ক্লাবের জন্ম শোভাবাজারে এবং নাম শোভাবাজার স্পোর্টিং হলেও তার কোনও অস্তিত্ব জন্মস্থানে এখন আর নেই, যেমন কমলের জন্ম ফরিদপুরে হলেও, তিন বছর বয়স সেখান থেকে চলে আসার পর আর সে দেশের মুখ দেখেনি। শোভাবাজার স্পোর্টিং এখন ময়দানের তাঁবুতে আর বেলেঘাটায় কেষ্টদার অর্থাৎ কৃষ্ণপ্রসাদ মাইতির বাড়িতেই বিদ্যমান।
কমল যুগের যাত্রীর তাঁবুতে শেষ বার পা দিয়েছিল সাত বছর আগে। মোহনবাগান থেকে যাত্রীতে আসার জন্য ট্রান্সফার ফর্মে সে সই করে এক হাজার টাকা আগাম নিয়ে। কথা ছিল পাঁচ হাজার টাকা যাত্রী তাকে দেবে।
বছর শেষে সে মোট পায় চার হাজার টাকা। দিল্লিতে ডুরান্ডে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে আসার পরই সে গুলোদার কাছে বাকি টাকাটা চায়। যুগের যাত্রীর সব থেকে ক্ষমতাশালী গুলোদা অর্থাৎ ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রতাপ ভাদুড়ি। সকালে প্র্যাকটিসের পর প্লেয়াররা কী খাবে, কোন ম্যাচে কোন প্লেয়ার খেলবে, কোন প্লেয়ারকে যাত্রীতে নেওয়া হবে, এবং কত টাকায়, এসব স্থির করা ছাড়াও গুলোদা এবং তার উপদলের নির্দেশেই নির্বাচিত হয় ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, ফুটবল সম্পাদক, এমনকী প্রেসিডেন্টও। ফুটবল চ্যারিটি ম্যাচের বা ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচের টিকিট গুলোদার হাতেই প্রথমে আসে, তারপর মেম্বারদের বিক্রি করা হয়। আই এফ এ এবং সি এ বি-র তিন-চারটি সাব কমিটিতে গুলোেদা আছে। একটি ছোট্ট প্রেসের মালিক গুলোদা গত বছরে দুটি বাড়ি করেছে ভবানীপুরে ও কসবায়।
গুলোদা নম্রম্বরে বিনীতে ভঙ্গিতে কথা বলে।
সে কী, তুই টাকা পাসনি এখনও! গুলোদার বিস্ময়ে কমল অভিভূত হয়ে যায়।
ছি ছি, অন্যায়, খুব অন্যায়। আমি এখুনি তপেনকে বলছি।
গুলোদা অ্যাকাউন্ট্যান্ট তপেন রায়কে ডেকে পাঠাল। সে আসতেই ঈষৎ রুষ্টস্বরে বলল, একী, কমলের টাকা পাওনা আছে যে? না না, যত শিগগির পারো দিয়ে দাও, কমল আমাদের ডিফেন্সের মূল খুঁটি, ওকে কমজোরি করলে যাত্রী শক্ত হয়ে দাঁড়াবে কী করে!
কমল সতর্ক হয়ে বলে, গুলোদা, টাকাটা রোভার্সে যাবার আগেই পাচ্ছি তো?
তুই ভাই তপেনের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নে।বলতে বলতে গুলোদা ফোন তুলে ডায়াল করতে শুরু করে দেয়।
তপেন তিন দিন ঘুরিয়ে টাকা দেয়নি। কমলও রোভার্সে যায়নি। ফুটবল সেক্রেটারির কাছে খবর পাঠায়, হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে। তাই শুনে গুলো শুধু বলেছিল, বটে।
পরের মরশুমের জন্য ফুটবল ট্রান্সফার শুরু হবার আগে গুলোদা ডেকে পাঠায় কমলকে। ও আসা মাত্র ড্রয়ার থেকে একশো টাকার দশটি নোট বার করে একগাল হেসে গুলোদা বলে, গুনে নে। তোরা যদি রাগ করিস, তা হলে যাত্রী চলবে কী করে বলতে পারিস? না না কমল, ছেলেমানুষি করা তোর পক্ষে শোভা পায় না। দশ বছরের ওপর তুই ফাস্ট ডিভিশনে খেলছিস। ইন্ডিয়া কালার, বেঙ্গল কালার পরেছিস। চ্যাংড়া ফুটবলারদের মতো তুইও যদি টাকা নিয়ে…না না, তোকে দেখেই তো ওরা শিখবে, ক্লাবকে ভালবাসবে। ইউ মাস্ট বি ডিগনিফায়েড়। এবার ভাল করে গুছিয়ে টিম কর। কাকে কাকে নিতে হবে সে সম্পর্কে ভেবেছিস?
গুলোদা সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বসতে ইশারা করল। কমল হাতের নোটগুলো প্যান্টের পকেটে রেখে চেয়ারে বসতেই গুলোদা আবার শুরু করে, প্লেয়ার কোথায়? একটু আগে দেবু টাকা চাইতে এসেছিল। বললুম, টাকা তো দেব, কাগজ পেনসিল নিয়ে বসে একবার হিসেব কর, কমিনিট খেলেছিস, কত গজ দৌড়েছিস, কটা ভুল পাশ দিয়েছিস, কটা বল রিসিভ করতে পারিসনি, কটা ওপেন নেট পেয়ে বাইরে মেরেছিস।…মেম্বাররা লিগ চায়, শিল্ড চায়, আরে বাবা, যে কটা প্লেয়ার, সবই তো মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল নিয়ে বসে আছে। প্লেয়ার না হলে ট্রফি আনবে কে? একা কমল গুহ যা খেলে তার সিকিও যদি দুটো ব্যাক খেলতে পারত, তা হলে ইন্ডিয়ার সব ট্রফি আমরা পেতাম। ক্লাস—ক্লাস, ক্লাসের তফাত। তোর ক্লাসের। প্লেয়ার কলকাতা মাঠে এখন কটা আছে আঙুলে গুনে বলা যায়। তুই কিন্তু ট্রান্সফারের প্রথম দিনেই উইথড্র করবি।
কমল বলতে শুরু করে, কিন্তু টাকার কথাটা তো…
আহ্, ওসব নিয়ে তোর সঙ্গে কি দর কষাকষি করতে হবে। গত বছর যা পেয়েছিস এবারও তাই পাবি।
কমল ট্রান্সফারের প্রথম দিনেই ওল্ড ফ্রেন্ডসে সই করেই উইথড্র করে। লিগে সাতটি ম্যাচে তাকে ড্রেস করিয়ে সাইড লাইনের ধারে বসিয়ে রাখা হয়। অষ্টম ম্যাচ স্পোর্টিং ইউনিয়নের সঙ্গে পাঁচ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় খেলা শেষের দশ মিনিট আগে কোচ বিভাস সেন এসে বলে, কমল নামতে হবে, ওয়ারম্ আপ করো।
শোনা মাত্রই ঝাঁঝিয়ে ওঠে কমলের মাথা। দিনের পর দিন হাজার হাজার লোকের সামনে আনকোরা প্লেয়ারের মতো সেজেগুজে লাইনের ধারে বসে থাকার লজ্জা আর অপমানের ক্ষতে যেন নুনের ছিটে এই দশ মিনিটের জন্য খেলতে নামানো।
এতদিনে হঠাৎ মনে পড়ল যে? কমল অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা স্বরে বলে।
রাগ করিসনি ভাই, বুঝিসই তো, আমার কোনও হাত নেই। সবই একজনের ইচ্ছেতেই তো হয় এখানে। বিভাস চোরের মতো এধার-ওধার তাকিয়ে বলে, খেলার আগেই গুলোদা বলে দেয় কমলকে দশ মিনিট আগে নামিও।
কমল বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে গ্যালারির দিকে তাকায়। একেবারে উপরে গুলোদা তার নির্দিষ্ট জায়গাটিতে বসে। কমল সটান উঠে এসে গুলোদার সামনে দাঁড়াল। জার্সিটা গা থেকে খুলে হাতে ধরে বলল, বয়স হয়েছে, খেলাও পড়ে এসেছে। কিন্তু কমল গুহ যতদিন বল নিয়ে ময়দানে নামবে, ততদিন এই জার্সিকে সে ভয়ে কাঁপাবে।
জার্সিটা হতবাক গুলোদার কোলে ছুড়ে দিয়ে, খালি গায়ে কমল শত শত লোকের কৌতূহলী দৃষ্টির ভিড় কাটিয়ে গ্যালারি থেকে নেমে আসে। তাঁবুতে এসে জামা প্যান্ট পরে, নিজের বুট এবং অন্যান্য জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে যখন সে বেরোচ্ছে, তখন খেলা শেষের বাঁশির সঙ্গে সঙ্গে হাউইয়ের মতো একটা উল্লাস আকাশে উঠে প্রচণ্ড শব্দে ফেটে পড়ল। কমল থমকে পিছন ফিরে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে অফুটে বলল, এই শব্দকে কাতরানিতে বদলে দেব।
যুগের যাত্রী তাঁবুর চৌহদ্দিতে কমল আর পা দেয়নি। পরের বছর ট্রান্সফারের প্রথম দিনেই সে সই করে আসে শোভাবাজার স্পোর্টিংয়ে খেলার জন্য। লিগ তালিকায় শেষের পাঁচ-ছটি দল প্রথম ডিভিশনে টিকে থাকার জন্য জোট পাকায় আর পয়েন্ট ছাড়াছাড়ি করে, শোভাবাজার তাদেরই একজন। তিনটি খেলায় এগারো গোল খেয়ে সে বছর ওদের খেলা পড়ে যায় যাত্রীর সঙ্গে। কমল খেলতে নেমেছিল এবং শুধু তারই জন্য যাত্রীর ফরোয়ার্ডরা পেনাল্টি বক্সের মাথা থেকেই বার বার ফিরে যায়। খেলা ০–০ শেষ হয়। শেষ বাঁশির সঙ্গে মাঠে থমথমে গাম্ভীর্য নেমে আসে। কমল শোভাবাজারের দুজন প্লেয়ারের কাঁধে ভর দিয়ে টলতে টলতে মাঠ থেকে বেরোবার সময় বলে শরীরে আর একবিন্দুও শক্তি নেই রে, নইলে এখন। আমি একটা দারুণ চিৎকার করতুম।
ফিরতি লিগে শোভাবাজারের যখন পঁচিশটা খেলায় চোদ্দো পয়েন্ট, তখন পড়ল। যাত্রীর সামনে। লিগ তালিকায় যাত্রী তখন মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডান আর এরিয়ান্সের পরে, বি এন আরের ঠিক উপরে। চ্যাম্পিয়ান হওয়ার কোনও আশা তো। নেই—এটা শুধু ছিল মানরক্ষার খেলা।
হাফ টাইমে যাত্রীর মেম্বাররা কুৎসিত গালিগালাজ করতে করতে গুলোদার দিকে জুতো, ইট, কাঠের টুকরো ছুড়তে শুরু করে। তাদের চিৎকারের মধ্যে একটা গলা শোনা গেল, কমলকে কেন ছেড়ে দেওয়া হল? খেলার ফল তখন ০-০।
এরপর গুলোদার এক পার্শ্বচর দ্রুত গ্যালারি থেকে নেমে গিয়ে শোভাবাজারের সম্পাদক কৃষ্ণ মাইতির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে এল।
হাফ টাইমের পর মাঠে নামতে গিয়ে কমল অবাক হয়ে দেখল, যে সিধু এতক্ষণ দারুণ খেলে অন্তত তিনটি অবধারিত গোল বাঁচাল, তাকে বসিয়ে নতুন ছেলে ভরতকে গোলে নামানো হচ্ছে। খেলা শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই যাত্রীর লেফট হাফ প্রায় তিরিশ গজ থেকে একটি অতি সাধারণ শট গোলে নিল। কমল শিউরে উঠে দেখল, বলটা ধরতে ভরত সামনে এগিয়ে এসে হঠাৎ থমকে গেল, তার সামনেই ড্রপ পড়ে মাথা ডিঙিয়ে বল গোলে ঢুকল।…মিনিট দশেক পর কমলের পায়ে আবার বল। যাত্রীর দুটো ফরোয়ার্ড দুপাশ থেকে এসে পড়েছে। ওদের আড়াল করে কমল ফাঁকায় দাঁড়ানো রাইট ব্যাককে বলটা দিতেই ছেলেটি কিছু না দেখে এবং না ভেবে আবার কমলকেই বলটা ফিরিয়ে দিল। যাত্রীর লেফট ইন ছুটে এল বল ধরার জন্য। পরিস্থিতিটা এমনই দাঁড়াল যে, কর্নার করা অথবা গোলকিপারকে বলটা ঠেলে দেওয়া ছাড়া কমলের আর কোনও পথ নেই। সে গোলের দিকে বলটা ঠেলে দিয়ে দেখল, ভরত অযথা একটা লোকদেখানো ডাইভ দিল এবং বল তার আঙুলে লেগে গোলে ঢুকল। ০-২ গোলে শোভাবাজার হেরে গেল। গ্যালারির মধ্যেকার সরু পথটা দিয়ে যখন মাথা নিচু করে বেরোচ্ছে, উপর থেকে চিৎকার করে একজন বলল, কী রে কমল, যুগের যাত্রীকে কাঁপাবি না?
তিনদিন পর ভরতকে আড়ালে ডেকে কমল জিজ্ঞাসা করেছিল, এরকম করলি কেন?
ভরতের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তর্ক করার ব্যর্থ চেষ্টা করে অবশেষে স্বীকার করে, কেষ্টদা বলল, রেগুলার খেলতে চাস যদি তা হলে দুটো গোল আজ ছাড়তে হবে। রাজি থাকিস তো নামাব। আমি লোভ সামলাতে পারলুম না কমলদা। দুবছর রিজার্ভেই কাটালুম, মাত্র চারটে পুরো ম্যাচ খেলেছি। তারপরেই সে ঝুঁকে কমলের পা দুহাতে চেপে ধরল। আমাকে মাপ করুন কমলদা, এমন কাজ আর করব না। কমল তখন আপন মনে নিজেকে উদ্দেশ করেই বলে, স্টপার, কোন দিকের আক্রমণ তুমি সামলাবে!
পরের বছর যাত্রীর সঙ্গে লিগের প্রথম খেলায়, শুরু সাত মিনিটেই কমল পেনাল্টি বক্সের একগজ বাইরে নিরুপায় হয়ে একজনকে ল্যাং দিয়ে ফেলে দেয়। বাঁশি বাজাতে বাজাতে রেফারি রাধাকান্ত ঘোষ ছুটে এল পেনাল্টি স্পটের দিকে আঙুল দেখিয়ে।
তাজ্জব হয়ে কমল জিজ্ঞাসা করল, পেনাল্টি কীসের জন্য?
নো নো, ইটস পেনাল্টি। রাধাকান্ত বলটা হাতে নিয়ে দাগের উপর বসাল।
বক্সের অনেক বাইরে ফাউল হয়েছে। কমল নাছোড়বান্দার মতো তর্ক করতে গেল।
নো আরগুমেন্ট। আই অ্যাম কোয়ায়েট সিওর অফ ইট।
বুঝেছি। কমল তির্যককণ্ঠে বলল। রাধাকান্ত না শোনার ভান করে বাঁশি বাজাল। কমল চোখ বন্ধ করে দুকানের পাশে তালু চেপে ধরল। এখনি সেই মর্মান্তিক চিৎকারটা উঠবে।
একটা প্রবল দীর্ঘশ্বাস মাঠের উপর গড়িয়ে পড়ল। কমল অবাক হয়ে চোখ খুলে দেখল, ভরত বলটা দুহাতে বুকের কাছে আঁকড়ে উপুড় হয়ে। এরপর শোভাবাজার দ্বিগুণ বিক্রমে যাত্রীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাফ টাইমের আগের মিনিটে রাইট উইং বল নিয়ে টাচ লাইন ধরে তরতরিয়ে ছুটে চমৎকার সেন্টার করে। বলটা পেনাল্টি বক্সের মাথায় দাঁড়ানো রাইট ইন বুক দিয়ে ধরেই সামনে বাড়িয়ে দেয়। লেফট উইং যাত্রীর দুই ব্যাকের মধ্যে দিয়ে ছিটকে ঢুকে এসে বলটা গোলে প্লেস করা মাত্র রাধাকান্ত বাঁশি বাজিয়ে ছুটে আসে। অফসাইড। তখন কমল মনে মনে বলে, আক্রমণ, স্টপার কী করে এই আক্রমণ রুখবে!
যুগের যাত্রী খেলাটা ১০ জিতেছিল। প্রায় শেষ মিনিটে ফ্রি কিক থেকে শোভাবাজার গোলের মুখে বল পড়েছিল। ভরত এগিয়ে পাঞ্চ করতেই যাত্রীর রাইট উইংয়ের মাথায় বল আসে। সে হেড করে গোলের দিকে পাঠাতেই ভরত পিছু হটে বলটা ধরতে গিয়ে আটকে যায়। যাত্রীর লেফট ইন তার প্যান্ট ধরে আছে। বিনা বাধায় বল গোলে ঢোকে।
খেলা শেষে মাঠের মধ্যে শোভাবাজার প্লেয়াররা ভিড় কমার জন্য অপেক্ষা করছিল। এমন সময় রথীনকে দেখতে পেয়ে কমল হেসে এগিয়ে এসে বলল, আজ আমরা এক গোলে জিতেছি!
রথীন শুকনো হেসে বলল, এ বছর আমি যাত্রীর ফুটবল সেক্রেটারি।
ওহ, তাই তো। মনেই ছিল না। সরি, আমার বরং বলা উচিত, রেফারি আজ জিতেছে। এভাবে না জিতে ভাল করে টিম কর। খেলার মতো খেলে জেত।
কথাটা গায়ে না মেখে রথীন বলল, এভাবে কদ্দিন তুই আমাদের জ্বালাবি বল তো?
আমি জ্বালাচ্ছি! তুই তা হলে ফুটবলের ফ-ও বুঝিস না। তোদের গুলোদাকে জিজ্ঞেস কর, তিনি বোঝেন বলেই আমাকে দুবছর আগেই ড্রেস করিয়ে সাইড লাইনের বাইরে বসিয়ে রাখতেন।
তোকে দেখলে হিংসে হয়, এখনও দিব্যি খেলাটা রেখেছিস, আর আমরা কেমন বুড়িয়ে গেলুম।
তার বদলে তুই আখেরটা গুছিয়ে নিতে পেরেছিস। শুনেছি প্রগ্রেসিভ ব্যাঙ্কে এখন বেশ বড় পোস্টে আছিস। একটা চাকরি বাকরি দে না। হাসতে হাসতে কমল বলল, তা হলে আর যাত্রীকে জ্বালাব না। খেলে কি আর তোদের মতো বড় ক্লাবের সঙ্গে পারা যায়!
আর ইউ সিরিয়াস, চাকরি সম্পর্কে? তা হলে টেন্টে আয়, কথা বলা যাবে।
সরি রথীন। কঠিন হয়ে উঠল কমলের মুখ। চাকরি আমার দরকার, দুমাস ধরে বেকার। কিন্তু যাত্রীর টেন্টে যাব না।
আর কথা না বলে কমল সরে আসে রথীনের কাছ থেকে। এসব পাঁচ বছর আগের ঘটনা।
.
০৩.
যুগের যাত্রীর টেন্টের সামনে রাস্তায় একটা সবুজ পুরনো ফিয়াট মোটর দাঁড়িয়ে। কমল দেখা মাত্র চিনল, এটি রথীনের। মাস ছয়েক আগে রথীনের পদোন্নতি হয়ে ডিপার্টমেন্টাল ইনচার্জ হয়েছে। এখন মাইনে সতেরো শো। ব্যাঙ্কে রীতিমতো ক্ষমতাবান। চলাফেরা কথাবার্তায় সেটা সে সর্বদা বুঝিয়েও দিতে চায়। তা ছাড়া রথীন সুদর্শন, যদিও এখন ভুঁড়ি হয়ে আগের মতো আর ততটা কমবয়সী দেখায় না।
পাঁচ বছর আগে সেদিন রথীনকে নিছকই ঠাট্টা করে কমল চাকরির কথা বলেছিল। পরের দিনই রথীন শোভাবাজার টেন্টে ফোন করে তাকে দেখা করতে বলে। কমল খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিল। গোঁয়ারের মতো এক কথায় বেঙ্গল জুট মিলের চারশো টাকার চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে দুমাস ধরে অবস্থাটা শোচনীয় হয়ে আসছিল। কমল ব্যাঙ্কে গিয়ে রথীনের সঙ্গে দেখা করে। রথীন বলে, আমাদের অফিস টিমে তোকে খেলতে হবে। অফিস স্পোর্টস ক্লাবের সেক্রেটারির সঙ্গে কথা হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি পারিস দরখাস্ত দিয়ে যা। ডেসপ্যাচ সেকশনে লোক নেওয়া হবে।
মাইনে কত? কমল প্রশ্ন করে।
রথীন ওর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে, যদি বলি একশো টাকা! দুমাস বেকার আছিস, মাইনে যদি পঞ্চাশ টাকাও হয়, সেটাও তো তোর লাভ।
কমল আর কথা বাড়ায়নি। পরদিনই দরখাস্ত নিয়ে হাজির হয় এবং যে চাকরিটি পায় তার বেতন এই পাঁচ বছরে ৪৬১ টাকায় পৌঁছেছে। কমল জানে, তার যা শিক্ষাগত যোগ্যতা তাতে এই চাকরি কোনও ভাবেই তার পক্ষে পাওয়া সম্ভব হত না, যদি না রথীন পাইয়ে দিত। পঞ্চান্ন থেকে ষাট সাল নাগাদ কমল গুহর যে নাম ছিল, এখন তার অর্ধেকও নেই। ফুটবল ভাঙিয়ে চাকরি পাওয়ার দিন তার উতরে গেছে। তবু পেয়েছে একমাত্র রথীনের জন্যই।
সাত বছর পর যাত্রীর টেন্টে আবার ঢুকতে গিয়ে কমলের মনে হল, তাকে দেখে সবাই নিশ্চয়ই অবাক হবে। কিন্তু কেউ যদি অপমান করার চেষ্টা করে? অবশ্য নিজের জন্য টাকা চাইতে নয় এবং ফুটবল সেক্রেটারি আসতে বলেছে বলেই এসেছি, সুতরাং, কমল মনে মনে বলল—আমার মনে গ্লানি থাকার কোনও কারণ নেই।
টেন্টের বাইরে ইতস্তত ছড়ানো বেঞ্চে যাত্রীর প্রবীণ মেম্বাররা গল্পে ব্যস্ত। তারা কেউ কমলকে লক্ষ করল না। টেন্টের মধ্যে ঢুকে কমলের সঙ্গে প্রথম চোখাচোখি হল যুগের যাত্রীর অ্যাকাউন্ট্যান্ট তপেন রায়ের। টেবিলে আরও দুজন লোক বসে। একজনকে কমল চেনে। গুললাদার চামচা হিসাবে খ্যাতি আছে তার।
আরে, কমল যে, কী ব্যাপার!
রথীন কোথায়? এইমাত্র ফোনে আমায় এখানে আসতে বলল।
হ্যাঁ, আমার কাছে একশো টাকা চেয়েছিল তোমাকে দেবার জন্য।
বলতে বলতে তপেন বুকপকেট থেকে একটি নোট বার করে এগিয়ে ধরল। কমলের মনে হল টাকা নিয়ে তপেন যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছে।
গুলোদার চামচাটি ব্যস্ত হয়ে বলল, ভাউচারে সই করাতে হবে না?
তপেন তাচ্ছিল্যভরে বলল, না, এটা ক্লাবের টাকা নয়। কমল তো যাত্রীর টাকা ছোঁবে না, আমার পকেট থেকেই দিচ্ছি।
কমল গম্ভীর গলায় বলল, টাকাটা কালই রথীনের হাতে দিয়ে দেব। ও এখন কোথায়?
ঘরে কথা বলছে প্লেয়ারদের সঙ্গে। কাল কুমারটুলির সঙ্গে খেলা।
কমল ইতস্তত করল। রথীনকে একবার বলে যাওয়া উচিত। কিন্তু প্লেয়ারদের সঙ্গে হয়তো কালকের খেলা সম্পর্কে আলোচনা করছে, তা হলে যাওয়াটা উচিত হবে না বাইরের লোকের।
কমল এ বছর খেলছ তো? তপেন রায় হাই চাপার জন্য মুখের সামনে হাত তুলে রেখে বলল। তারপর স্বগতোক্তির মতো মন্তব্য করল, আর কত দিন চালাবে!
কমল হাসল মাত্র।
তপেনদা, কমলের বডিটা দেখেছেন! চামচা বলল। এখনকার একটা ছেলেরও এমন ফিট বডি নেই।
তপেন কথাগুলো না শোনার ভান করে তার আগের কথার জের ধরে বলল, চার ব্যাক হয়ে বয়স্ক ডিফেন্সের প্লেয়ারদের সুবিধেই হয়েছে। কেরিয়ারটার সঙ্গে সঙ্গে রোজগারটাও বাড়াতে পেরেছে। শোভাবাজার থেকে এখন পাচ্ছ কত?
একটা আধলাও নয়।
তপেনের ভ্রূ কুঞ্চিত হল কয়েক সেকেন্ডের জন্য।
ফ্রি সার্ভিস এই বাজারে! চামচা অবাক হল। অবশ্য কমল লিগে দুটো ছাড়া তো ম্যাচই খেলে না।
শুধু দুটো ম্যাচ! কেন, আর খেলে না? তপেন প্রশ্ন করল চামচাকে।
লাস্ট টু ইয়ার্স তো কমল শুধু আমাদের এগেস্টেই খেলেছে। চামচা চোখ পিটপিট করল। যাত্রীকে কিন্তু কাঁপাতে পারেনি কমল। আমরা ফুল পয়েন্ট তুলেছি। যাত্রীর জার্সি সকলের সামনে খুলে ছুড়ে ফেলেছিল বটে, কিন্তু দম্ভ রাখতে পারেনি। ফুটবল কি একজনের খেলা!
কমলের বলতে ইচ্ছে হল, প্লেয়ার, অফিসিয়াল, রেফারি, সবকিছু ম্যানেজ করেই তো ফুল পয়েন্ট তুলেছ। কিন্তু বলতে পারল না। রথীন স্প্রিংয়ের পাল্লা ঠেলে এই সময় ঘর থেকে বেরোল। সঙ্গে চারটি ছেলে। কমলকে দেখে সে বলল, অঃ, কখন এলি? তপেনদা দিয়ে দিয়েছেন?
তপেন ঘাড় নাড়তেই রথীন বলল, আমি টালিগঞ্জের দিকেই এখন যাব। কমল, তুই তো নাকতলায় যাবি, যদি মিনিট কয়েক অপেক্ষা করিস, তা হলে আমার সঙ্গে যেতে পারিস।
কমল বলল, আমি তোর গাড়িতে গিয়ে বসছি। তুই তাড়াতাড়ি কর।
তপেন মৃদুস্বরে বলল, টাকাটা ফেরত দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হতে হবে না, কমল।
কেন?
যখন দরকাব হবে আমি চেয়ে নেব। তোমার প্রয়োজনের সময় দিতে পেরেছি, শুধু এইটুকু মনে রাখলেই আমি খুশি হব। তুমি বিপদে পড়ে যাত্রীর কাছেই এসেছ এটা ভাবতে আমার ভালই লাগছে।
শুনতে শুনতে কমলের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এল। সে বলল, আমি টাকা চেয়েছি রথীনের কাছে, যাত্রীর কাছে নয়। চেয়েছি অন্যের জন্য, নিজের জন্য নয়।
কমল বলতে যাচ্ছিল, এ টাকা যদি যাত্রীর হয় তা হলে এখনি ফিরিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু পল্টুদার মুখটা ভেসে উঠতেই আর বলতে পারল না। তার মনে হচ্ছে, অদ্ভুত একটা খাঁচার মধ্যে সে ঢুকে পড়েছে, যার চারদিকটাই খোলা অথচ বেরোনো যাচ্ছে না।
তপেন তার স্মিত হাসিটা কমলের মুখের উপর অনেকক্ষণ ধরে রেখে বলল, যদি আরও টাকার দরকার হয় আমাকে বাড়িতে ফোন কোরো। পল্টু মুখার্জির চিকিৎসায় আমাদেরও সাহায্য করা কর্তব্য। এ টাকা ধার নয় কমল, পল্টুদাকে আমার…যুগের যাত্রীর প্রণামী।
কমল শুনতে শুনতে হঠাৎ নিজেকে অসহায় বোধ করল। তার মনে হচ্ছে, পেনাল্টি বক্সের মধ্যে বল নিয়ে দুটো ফরোয়ার্ড এগিয়ে আসছে। সে একা তাদের মুখোমুখি। ব্যাকেরা কোথায় দেখার জন্য চোখ সরাবার সময়ও নেই।
.
গাড়িতে দুজনের কেউই অনেকক্ষণ কথা বলল না। রেড রোড ধরে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের পশ্চিম দিয়ে যখন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের কাছে পৌঁছেছে তখন রথীন মুখ ফিরিয়ে বলল, অফিসের দুটো খেলায় তুই খেলিসনি!
এসব খেলা অর্থহীন, আমার ভাল লাগে না খেলতে। তা ছাড়া শোভাবাজারের প্র্যাকটিস ম্যাচ ছিল। কতকগুলো নতুন ছেলে কেমন খেলে দেখার জন্যই গেছলুম।
কিন্তু ব্যাঙ্ক চাকরি দিয়েছে তার হয়ে খেলার জন্য।
কমল চুপ করে রইল।
এই নিয়ে কথা উঠেছে। তা ছাড়া রোজই তুই কাজ ফেলে সাড়ে তিনটে-চারটেয় বেরিয়ে যাস।
কে বলল, নিশ্চয় রণেন দাস?
যেই বলুক, সেটা কোনও কথা নয়। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি তারা মিথ্যে বলেনি।
পুলিশ হাত তুলেছে। রথীন ব্রেক কষল। ডানদিকে মোড় ফিরে হরিশ মুখার্জি রোডে এবার গাড়ি ঢুকবে। কমল পুলিশটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। রথীন মোড় ঘুরে গিয়ার বদল করে শান্ত মৃদু স্বরে বলল, বুঝিস না কেন, তোর আর আগের মতো নাম নেই, খেলা নেই। এখনকার উঠতি নামী প্লেয়াররা যে অ্যাডভান্টেজ অফিসে পায় বা নেয়, তোর পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তোকে এখন চাকরিটাকেই বড় করে দেখতে হবে। তার জন্য যে সব নিয়ম মানতে হয় মেনে চলতে হবে। অন্য পাঁচজনের থেকে তুই এখন আর আলাদা নোস।
আমি আর পাঁচজনের মতো—কোনও তফাতই নেই? কমল প্রায় ফিসফিস করে বলল।
রথীনের মুখে অস্বস্তিকর বেদনার ছাপ মুহূর্তের জন্য পড়ে মিলিয়ে গিয়েই কঠিন হয়ে উঠল।
বিপুল ঘোষ, রণেন দাস কি সতু সাহার মতো কেরানিদের সঙ্গে আমার তফাত নেই, রথীন এ তুই কী বলছিস! আমি ইন্ডিয়া টিমে খেলেছি, দেশের জন্য আমার কন্ট্রিবিউশন আছে। জীবনের সেরা সময়ে দিনের পর দিন পরিশ্রম করেছি, কষ্ট করেছি, লেখাপড়া করার সময় পাইনি, জীবনের নিরাপত্তার কথা ভাবিনি, সংসারের দিকে তাকাইনি। কী স্যাক্রিফাইস ওরা করেছে, বল? ওরা আর আমি সমান হয়ে যাব কোন যুক্তিতে?
রথীন চুপ করে থাকল। গাড়ি চালানোয় ওর মনোযোগটাও বেড়ে গেল হঠাৎ
আমি এখনও ফুটবলের জন্য কিছু করতে চাই। প্লেয়ার তৈরি করতে চাই। তাই অফিস থেকে আগে বেরোই। আর অফিস লিগে খেলাটা তো এলেবেলে।
কমল, আমাদের দেশে খেলোয়াড়কে ততদিনই মনে রাখে যতদিন সে মাঠে নামে। তারপর স্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। নতুন হিরো আসে, তাকে নিয়ে নাচানাচি করে। দ্যাখ না, যাত্রীতে এখন প্রসূন ভটচাজকে নিয়ে কী কাণ্ড চলছে, অথচ ওর বাবাকেই একদিন সাপোর্টাররা মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল ঘুষ খেয়েছে বলে। তোকে মনে রাখবে এমন একটা কিছু কর।
রথীন, আমার বয়স হয়ে গেছে। এখন আর কিছু করার মতো সামর্থ্য নেই। ফুটবলারের সামর্থ্য তো শরীর।
তা হলে মন দিয়ে চাকরিটা কর। তোকে চাকরি দেওয়ায় ইউনিয়ন থেকে পর্যন্ত অপোজিশন এসেছিল। সবাই বলেছিল উঠতি নামী অল্প বয়সীকে চাকরি দিতে। তুই তো জানিস, সেকেন্ড ডিভিশনে খেলে অপূর্ব ছেলেটাকে চাকরি দেওয়া হবে বলে গত বছর আটটা ম্যাচ খেলানো হয়। ভালই খেলে কিন্তু এখনও চাকরি পায়নি। কমিটি মেম্বাররা বড় বড় নাম চায়। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের চার জনের নাম উঠেছিল। আমি তর্ক করে বলি, অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, অফিসের খেলায় এইসব বড় ক্লাবের নামী প্লেয়াররা একদমই খেটে খেলে না। ওরা থেকেও টিম হারে। এতে অফিসের কোনও লাভ হয় না। বরং পড়তি প্লেয়াররা ভাল সার্ভিস দেয়। তোর জন্য এ জি এম পর্যন্ত ধরাধরি করেছি। এখন তুই যদি অফিসের হয়ে না খেলিস তা হলে আমার মুখ থাকে কোথায়? অফিসে নানা দিকে নানা কথা উঠছে, এরকম ফাঁকি দিলে তো আমাকে তোর এগেস্টে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নিতে হবে।
কিন্তু আমার পক্ষে শোভাবাজারের ম্যাচের দিন পাঁচটা পর্যন্ত অফিসে থাকা কিংবা অফিসের হয়ে খেলা সম্ভব নয়।
কমল গোঁয়ারের মতো গোঁজ হয়ে বসল। রথীনের মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল।
অনেকগুলো চাকরি তো ছেড়েছিস। এই বয়সে এই চাকরিটা যদি হারাস, তা হলে কী হবে ভেবে দেখিস। আমার তো মনে হয় না, আর কোথাও পাবি। দেশের লেখাপড়া জানা বেকার ছেলেদের সংখ্যাটা কত জানিস?
না, জানি না, জানার ইচ্ছেও নেই। এখানে থামা।
কমল অধৈর্য ভঙ্গিতে প্রায় চিৎকার করে উঠল। রথীন একটু অবাক হয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ব্রেক কষে গাড়ি থামাল।
আরও এগিয়ে তোকে নামিয়ে দিতে পারি।
না, এখানেই নামব আর টাকাটা কাল তোকে অফিসেই দিয়ে দেব।
কমল গাড়ি থেকে নেমে অনাবশ্যক জোরে দরজাটা বন্ধ করে হনহনিয়ে পিছন দিকে হাঁটতে শুরু করল বাস স্টপের দিকে।
.
০৪.
বাসে উঠে দমবন্ধ করা ভিড়ে কমল মাথার উপরের রড ধরে মনে করতে চেষ্টা করল পুরনো কথা। তেরো বছর আগে প্রথমবার যুগের যাত্রীতে খেলার সময় রথীন ছিল রাইট ব্যাক, কমল স্টপার। রথীন সে বছর ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ক্যাপ্টেন হয়ে লখনৌ থেকে স্যার আশুতোষ ট্রফি এনেছে। মোটামুটি কাজ চালাবার মতো খেলত। তখন ডাকত কমলদা। রথীন ছিল গুলোদার খুবই প্রিয়পাত্র। মালয়েশিয়ায় নতুন টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছে মারডেকা নামে। ইন্ডিয়া টিম খেলতে যাবে। বোেম্বাইয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে বাংলা থেকে বারো জন গিয়েছিল। যাত্রী থেকে তিনজন রথীন, আমিরুল্লা আর সুনীত। বলা হয়েছিল, কমলের হাঁটুতে চোট আছে তাই ট্রায়ালে পাঠানো হয়নি, তা ছাড়া চোখেও নাকি কম দেখছে। দুটোই ডাহা মিথ্যে কথা।
কমল সামান্য একটু চোট পেয়েছিল ইস্টার্ন রেলের সঙ্গে খেলায়। পরের ম্যাচে কমল বসে, রথীন স্টপারে খেলে কালীঘাটের বিরুদ্ধে।
ভালই খেলেছিল। তার পরের ম্যাচে এরিয়ান্সের কাছে এক গোলে যাত্রী হারে। কমল একটা হাই ক্রসের ফ্লাইট বুঝতে না পেরে হেড করতে গিয়ে ফসকায়। সেন্টার ফরোয়ার্ড পিছনে ছিল, বলটা ধরেই গোল করে। খেলার পর ক্লাবে কানাঘুষাে শোনা যায়, কমল চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছে না।
কমল ছুটে গেছল পল্টু মুখার্জির কাছে।
পল্টুদা, এরা আমায় বসিয়ে দিল একেবারে।
সে কী রে, একেবারে বসে গেছিস! পল্টদা সদর দরজার বাইরে একচিলতে সিমেন্টের দাওয়ায় ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে কাগজ পড়ছিলেন। খুব একচোট প্রথমে হো হো করে হাসলেন।
বসে গেছিস? কই দেখছি না তো, দিব্বি তো দাঁড়িয়ে আছিস।
না পল্টুদা, ঠাট্টা নয়। আর ভাল লাগছে না কিছু। আমি খেলা ছেড়ে দেব।
ভাল লাগছেনা বুঝি! আচ্ছা, ভাল লাগার ব্যবস্থা করছি। এখান থেকে একদৌড়ে যাদবপুর স্টেশন যাবি আর একদৌড়ে আসবি। এখুনি।
কমল কথাটাকে আমল না দিয়ে বলল, আমি সত্যিই খেলা ছেড়ে দেব। এমন জঘন্য অন্যায়, নখের যুগ্যি নয় রথীন, সে- বলতে বলতে কমল থেমে গেল।
পল্টুদা ইজিচেয়ারে খাড়া হয়ে বসেছেন। নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। দুচোখে ঘনিয়ে উঠেছে রাগ।
অরু! পল্টুদা ঘরের দিকে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর গলায় ডাকলেন, অরু, শুনে যা।
পল্টুদার বড় মেয়ে অরুণা ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই পল্টুদা বললেন, আমার লাঠিটা নিয়ে আয়।
কমল শোনা মাত্র অজান্তে এক পা পিছিয়ে গেল। অরুণা অবাক হয়ে বলল, এখন আবার কোথায় বেরোবে?
লাঠিটা নিয়ে আয় বলছি। পল্টুদা হুঙ্কার দিলেন।
বাচ্চা ছেলের মতো কমলের সন্ত্রস্ত মুখটা দেখে অরুণা আঁচ করতে পারল যে, লাঠি আনার কাজটা উচিত হবে না। এরকম দৃশ্য সে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। শুধু মজা করার জন্য বলল, মোটা লাঠিটা আনব বাবা?
পল্টুদা উত্তর দিলেন না। অরুণা ঘরের দিকে পা বাড়ানো মাত্র কমল আর একটিও কথা না বলে ঘুরেই দ্রুত ছুটতে শুরু করল। যতক্ষণ দেখা যায় অপসৃয়মাণ ছুটন্ত কমলকে দেখতে দেখতে পল্টুদা এগিয়ে গেলেন। রাস্তার ধারে এসে থুতনি তুলে চেষ্টা করলেন কমলকে দেখার।
অবাক হয়ে রাস্তার লোকেরা তাকিয়ে। বহু লোক কমলকে চেনে। এত বড় এক নামকরা ফুটবলারকে জুতো, জামা আর ফুলপ্যান্ট পরা অবস্থায় সকাল আটটার সময় গিজগিজে ভিড়ের রাস্তা দিয়ে ছুটতে দেখবে, এমন দৃশ্য কল্পনাও করতে পারে না।
পল্টুদা অবসন্নের মতো ফিরে এসে ইজিচেয়ারে বসলেন। বাঁ হাতটা চোখের উপর রাখলেন। অরুণা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বাবার কপালে সে হাত রাখতেই পল্টুদা চোখ থেকে বাঁ হাতটা নামালেন। জলের শীর্ণ ধারা দুটি গাল বেয়ে নেমে আসছে।
মনে বড় দাগা পেয়েছে ছেলেটা। দুঃখ তো জীবনে আছেই, কিন্তু এমন অন্যায় পথ ধরে দুঃখগুলো কেন যে আসে! পল্টুদা আবার চোখের উপর হাত রাখলেন।
অনেকক্ষণ পর পল্টুদার রান্নাঘরের জানলায় উঁকি দিল দরদর ঘাম ঝরা আর পরিশ্রমে লাল হয়ে ওঠা কমলের মুখ।
অরু।
অরুণা মুখ তুলল বাটনা বাটা বন্ধ করে।
কমলদা? এখনও তো।
অ্যাাঁ, এখনও?
হ্যাঁ, লাঠিটা তো হাতেই রেখেছে দেখলাম। তুমি যাদবপুর স্টেশন পর্যন্ত ঠিক গেছ তো?
ফুটবলের দিব্যি।
দাঁড়াও দেখে আসি।
আধ মিনিট পরেই অরুণা ফিরে এসে বলল, সদর দরজা দিয়ে এসো। না, হাতে। লাঠি নেই আর।
পল্টুদা তখন চুঁচ-সুতো নিয়ে জামায় বোতাম লাগাতে ব্যস্ত। কমলকে একনজর দেখে বললেন, খেয়ে এসেছিস?
হ্যাঁ।
ছেলে কেমন আছে? বয়স কত হল?
ভাল, পাঁচ বছর পূর্ণ হবে এই সেপ্টেম্বরে।
প্র্যাকটিসটা আরও ভাল করে কর। হতাশা আসবে, তাকে জয় করতেও হবে। ইন্ডিয়া টিমে খেললেই কি বড় প্লেয়ার হয়? বড় তখনই হয়, যখন সে নিজে অনুভব করে মনের মধ্যে আলাদা এক ধরনের সুখ, প্রশান্তি। সেখানে হতাশা পৌঁছোয় না। তুই খেলা ছেড়ে দিবি বলছিস, তার মানে তুই বড় খেলোয়াড় হতে পারিসনি।
কমল মাথা নিচু করে কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। একটা অদ্ভুত ক্ষোভ আর কান্না মিলেমিশে তখন তার বুকের মধ্যে দুলে উঠেছিল।
.
আর এখন, তেরো বছর আগের ওই সব কথা মনে করতে করতে যখন সে বাস থেকে নেমে মিনিট চারেক হেঁটে পল্টুদার বাড়িতে ঢুকল, তখন একটা অদ্ভুত মমতা আর বেদনা কমলের বুকের মধ্যে কেঁপে উঠছিল। থাক দেওয়া তিনটে বালিশের উপর হেলান দিয়ে পল্টুদা আধশোয়া। ওকে দেখে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন।
ভালই আছি। মৃদুস্বরে পল্টুদা বললেন।
কথা বলা একদম বারণ। অরুণা কথাটা বলল কমলকে লক্ষ্য করে।
কমল তাকাল অরুণার দিকে। সাদা থান পরনে। পাঁচ বছর আগে বিধবা হয়ে একটি ছেলে নিয়ে বাপের বাড়িতেই রয়েছে। এখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। পল্টুদা
আরও তিনটি মেয়ের বিয়ে দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। স্ত্রী দুবছর আগে মারা গেছেন। সংসারে ছোট মেয়ে করুণা ছাড়াও আছে এক বিধবা বোন। শুকনো মুখে তারা খাটের ধারে দাঁড়িয়ে। অরুণার ছেলে পিন্টু দাদুর খাটের একধারে বসে।
কেমন আছেন? কমল ফিসফিস করে অরুণাকে জিজ্ঞেস করল। ডাক্তার দেখানো হয়েছে?
হ্যাঁ, বললেন কিছু করার নেই।
ওষুধ?
দিয়েছেন লিখে। আনা হয়নি। বাবাই বারণ করলেন।
প্রেসক্রিপশনটা দাও। কমল হাত বাড়াল।
পল্টুদা ওদের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। ক্লান্ত এবং গম্ভীর স্বরে বললেন, আমার জন্য আর টাকা নষ্ট করার দরকার নেই।
বাড়ানো হাতটা কমল সন্তর্পণে নামিয়ে নিল।
আর কেউ আসেনি? কমলের প্রশ্নে অরুণা মাথা নাড়ল। পল্টুদার হাতে গড়া চার জন প্লেয়ার ইন্ডিয়া টিমে খেলেছে, পনেরো জন বেঙ্গল টিমে।
ব্যালান্স, কমল, ব্যালান্স কখনও হারাসনি। আমি ব্যালান্স রাখতে পারিনি তাই কিছুই রেখে যেতে পারছি না, একমাত্র তোকে ছাড়া। পল্টুদা ডান হাতটা পিন্টুর মাথায় রেখে চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন, এই পৃথিবীটা ঘুরছে ব্যালান্সের ওপর। মানুষ হাঁটে ব্যালান্সে, দৌড়োয়, ড্রিবল করে, এমনকী মানুষের মনও রয়েছে ব্যালান্সের ওপর। চালচলনে, ব্যবহারে ও চিন্তাধারায় কখনও ব্যালান্স হারাসনি। কে আমায় দেখতে এল কি এল না, তাই নিয়ে আমার আর কিছু যায়-আসে না। তুই এসেছিস, জানতুম তুই আসবি। এক মুহূর্ত থেমে বললেন, এদের তুই একটু দেখিস। আজ তোর কাছে এইটেই আমার শেষ চাওয়া।
পল্টুদা, আমি থাকলে আপনি কথা বলেই যাবেন, তার থেকে আমি বরং চলে যাই।
পারবি যেতে? মুচকি হাসলেন পল্টুদা, যদি বলি আমার সামনে তুই শুধু দাঁড়িয়ে থাক। আমি তোকে দেখব আর সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠবে তোর বল কন্ট্রোল, মুখ তুলে বলটাকে পায়ে স্ট্রোক দিতে দিতে এগিয়ে যাওয়া, এধার-ওধার তাকানো। আমার তখন কেন জানি না অভিমন্যুর কথা মনে পড়ত। শুটিংয়ের পর ফলো থ্র-র ভঙ্গিটা, আর সেই ডজটা। ডান দিকে হেলে, বাঁ দিকে ঝুঁকেই আবার ডান দিকে— একটুও স্পিড় না কমিয়ে। পারিস এখনও?
না। আমার বয়স হয়ে গেছে পলুদা।
না, হয়নি। চেষ্টা করলেই পারবি। করবি?
কমল বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল পল্টুদার মুখের দিকে। শীর্ণ মুখে দুটি চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। কিন্তু কী অদ্ভুত জ্বলজ্বল করছে। প্রায় কুড়ি বছর আগে অমন করে তাকাতেন।
তুই আমার কাছ থেকে যা শিক্ষা পেয়েছিস সেটা দেখাবি? পল্টুদার সেই হুকুমের গলা নয়, মিনতি।
কমলের হাত অদৃশ্য সুতোর টানে পুতুলের মতো মাথায় উঠে গেল। চুলগুলো ফাঁক করে মাথা হেঁট করল পল্টুদাকে দেখাবার জন্য। তারপর আস্তে আস্তে মাথাটা হেলিয়ে অস্ফুটে বলল, হ্যাঁ করব।
তার চোখে পড়ল খাটের নীচে একটা রবারের বল, সম্ভবত পিন্টুর। কমল বলটা পা দিয়ে টেনে আনল। চেটোর তলা দিয়ে বলটাকে ডাইনে বাঁয়ে খেলাল। তাই দেখে পিন্টু খাট থেকে নেমে গুটিগুটি কমলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎ কচি পা-টা বাড়িয়ে দিল। বলটা ছিটকে দেয়ালে গিয়ে লাগল। ঘরে একমাত্র পিন্টু ছাড়া আর কেউ হেসে উঠল না।
ছিলে টানা ধনুকের মতো কমল কুঁজো হয়ে গেল নিজের অজান্তেই। সামনে যেন একজন প্রতিদ্বন্দ্বী বল কেড়ে নিতে অপেক্ষা করছে। কমল একদৃষ্টে পিন্টুর দিকে তাকিয়ে বলটাকে চেটো দিয়ে ডাইনে বাঁয়ে, সামনে-পিছনে গড়িয়ে গড়িয়ে সারা ঘরটা ঘুরতে লাগল, পিন্টু এলোপাথাড়ি লাথি ছুড়ছে, বলে পা লাগাতে পারছে না। কমল হঠাৎ একটা পাক দিয়ে পিন্টুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোমর থেকে শরীরের উপরটা ডাইনে ঝাঁকিয়ে, বাঁয়ে হেলেই সিধে হয়ে গেল। পিন্টু ব্যালান্স হারিয়ে মেঝেয় পড়ে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে সকলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর লাফ দিয়ে উঠে অরুণাকে জড়িয়ে ধরল লজ্জা লুকোবার জন্য।
কমলের কোনও খেয়াল নেই। আস্তে আস্তে সে ভুলে গেল ঘরটাকে, ঘরের মানুষদের, মৃত্যুপথযাত্রী পল্টুদাকেও। তার মনে হচ্ছে সে মাঠেই নেমে খেলছে। গ্যালারি ভরা দর্শক তাকে তুমুল উচ্ছ্বাসে তারিফ জানাচ্ছে। প্রমত্ত নটরাজের মতো কমল কুঁদ হয়ে আপন মনে বলটাকে নিয়ে দুলে দুলে সারা ঘর ঘুরছে। কাল্পনিক প্রতিপক্ষকে একের পর এক কাটাচ্ছে। বলটাকে পায়ের পাতার উপর তুলে নাচাতে নাচাতে উরুর উপর, সেখান থেকে কপালে আবার ঊরু, আবার পাতা—কমলের সর্বাঙ্গে বল খেলা করছে।
পল্টুদা নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুখ হাসিতে ভরে রয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে চোখ বুজলেন।
কিছুক্ষণ পর মৃদুস্বরে অরুণা বলল, কমলদা, বাবা বোধ হয় মারা গেলেন!
.
০৫.
সকাল নটায় অফিসে বেরিয়ে পরদিন রাত নটায়, ছত্রিশ ঘণ্টা পর কমল বাড়ি ফিরল। চোখ দুটি লাল, চুল এলোমেলো, ক্লান্তিতে নুয়ে পড়েছে সটান শরীরটা।
একতলায় দুটি ঘর নিয়ে কমল থাকে। একটিতে সে, অপরটিতে অমিতাভ। দুটি লোকের এই সংসারের যাবতীয় কাজ ও রান্না করে দিয়ে কালোর মা রাতে চলে যায়। দশ বছর আগে শিখা মারা যাবার পরই সাত বছরের অমিতাভকে তার দিদিমা গৌহাটিতে নিয়ে চলে যান। দুবছর আগে সে বাবার কাছে ফিরেছে। প্রথমে দুজনের সম্পর্কটা ছিল স্কুলে ভর্তি হওয়া নতুন দুটি ছেলের মতো।
দুবছরেও কিন্তু ওদের মধ্যে ভাব হয়নি। ওরা কথা কমই বলে, দুজনে দুজনকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে। কেউ কারোর ঘরে পর্যন্ত ঢোকে না। তবে একবার রেজেস্ট্রি চিঠি সই করে নেবার জন্য অমিতাভর ঘরে কমল ঢুকেছিল কলমের খোঁজে। একটা খাতার মধ্যে কলম পায়। তখন দেখেছিল, খাতাটা কবিতায় অর্ধেক ভরা আর টেবিলের উপর থাক দিয়ে রাখা বইয়ের ফাঁকে অমিতাভর মায়ের ফোটো। ছবিটা কমলের ঘরে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে ছিল। কমল দুঃখ পেয়েছিল। অমিতাভ তার মার ছবিটা চুরি না করে যদি চেয়ে নিত তা হলে সে খুশিই হত। মেধাবী গম্ভীর মৃদুভাষী ছেলেকে কমল ভালবাসে। শুধু অস্বস্তি বোধ করে তার দুর্বল পাতলা শরীর ও পুরু লেন্সের চশমাটার দিকে তাকালেই। অমিতাভ তার বাবাকে আপনি বলে। কমলের ইচ্ছে ও তুমি বলুক।
অমিতাভর ঘরে আরও দুটি ছেলে বসে কথা বলছে। কমল একবার সেদিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল। ইজিচেয়ারটা পাতাই ছিল, তাতে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। একে একে তার মনে ভেসে উঠতে লাগল গত চব্বিশ ঘণ্টার ব্যাপারগুলো। কান্না, ছোটাছুটি, টেলিফোন করা, শ্মশান যাওয়া, আবার পল্টুদার নাকতলার বাড়ি। পল্টুদার জামাইরা এসেছিল, তাদের আর্থিক সঙ্গতিও ভাল নয়। একশোটা টাকা খুবই কাজে লেগেছে।
পায়ের শব্দে কমল চোখ খুলল। অমিতাভ, তার পিছনে ছেলে দুটি।
এরা আমার কলেজের বন্ধু, আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছে। অমিতাভর বিব্রত স্বর কমলের কানে বিশ্রী লাগল। ক্লান্ত ভঙ্গিতে সে বলল, আজ থাক, অন্য আর একদিন এসো। আজ আমার শরীর মন দুটোই খারাপ।
কথা না বলে ওরা চলে গেল। কমল আবার চোখ বন্ধ করল এবং মিনিট দশেকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।
প্রতিদিনের মতো ঠিক পাঁচটায় ওর ঘুম ভাঙল। ঘরের আলোটা পর্যন্ত নেভাননা হয়নি, জামা প্যান্টও বদলানো হয়নি। কমল তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই সে হিটারে চায়ের জল বসিয়ে, প্রতিদিনের মতো অমিতাভর ঘরের দরজায় কয়েকটা টোকা দিয়ে, খাওয়ার টেবিলে এসে অপেক্ষা করতে লাগল। অমিতাভ এসে যখন চেয়ার টেনে বসল তখন চা তৈরি হয়ে গেছে।
পরশু আমার গুরু মারা গেলেন, তাই বাড়ি ফেরা হয়নি।
অমিতাভ ভ্রূ কুঞ্চিত করে বলল, কে?
পল্টু মুখার্জি। কমল আর কিছু না বলে অমিতাভর একমনে রুটিতে জেলি মাখানো দেখতে লাগল।
তুমি অবশ্য ওঁর নাম নিশ্চয় শোননি।
না। খেলার আমি কিছুই জানি না।
পল্টুদা হচ্ছেন, কমল উৎসাহ দেখিয়ে বলে উঠল, সাহিত্যে যেমন ধরো…
অমিতাভর পুরু লেন্সের ওধারে চোখ দুটোকে কৌতূহলভরে তাকিয়ে থাকতে দেখে কমল ঘাবড়ে গেল।
যেমন রবীন্দ্রনাথ?
না না, অত বড় নয়! কমল অপ্রতিভ হয়ে পড়ল। এবং অবস্থাটা কাটিয়ে ওঠার জন্য মরিয়া হয়ে বলল, কিন্তু আমার জীবনে উনি রবীন্দ্রনাথের মতোই।
তা হলে আপনি খুবই আঘাত পেয়েছেন।
কমল চুপ করে রইল।
মা মারা যেতে আঘাত পেয়েছিলেন কি?
কমল তীব্র দৃষ্টিতে অমিতাভর দিকে তাকাল। সে মাথা নামিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল।
তোমার মা মানিয়ে নিতে পারেনি আমার জীবনকে, আকাঙক্ষাকে। একজন ফুটবলারের স্ত্রী হতে গেলে তাকে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়, সহ্য করতে হয়। তা করার মতো মনের জোর তার ছিল না। ট্রেনিং ক্যাম্পে গিয়ে থেকেছি, টুর্নামেন্ট খেলতে বাইরে গেছি—এসব সে পছন্দ করত না। তাই নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া হত। ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই যাত্রীর সঙ্গে রোভার্সে খেলতে যাই। তখনই ঘটনাটা ঘটে।
মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর আপনাকে টেলিগ্রাম করা হয়েছিল। কিন্তু আপনি আসেননি। অমিতাভ কঠিন ঠাণ্ডা গলায় অভিযুক্ত করল কমলকে। আসেননির পর নিঃশব্দে একটি কেনআপনা থেকেই ধ্বনিত হল কমলের কানে। সঙ্গে সঙ্গে রাগে পুড়ে গেল তার মুখের কোমল বিষাদটুকু।
আগেও বলেছি তোমায়, সেই টেলিগ্রাম আমাদের ম্যানেজার গুলোদার হাতে পড়ে। সেটাকে তিনি চেপে রাখেন, কেননা পরদিনই ছিল হায়দ্রাবাদ পুলিশের সঙ্গে সেমি ফাইনাল খেলা। আমাকে বাদ দিয়ে যাত্রীর পক্ষে খেলতে নামা সম্ভব ছিল না। কথাগুলো বলতে বলতে কমল তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল অমিতাভর দিকে।
বাঁকানো ঠোঁটের কোলে মোটা দাগে আগের মতোই অবিশ্বাস ফুটে রয়েছে। আজও ওকে বোঝানো গেল না, টেলিগ্রামটা পেলে সে অবশ্যই খেলা ফেলে মুম্বই থেকে ছুটে আসত।
কমল খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে পড়ল। ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়িতে হাত বোলাল। বেশ বড় হয়েছে। কিন্তু অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না। দাড়ি
কামালেও চলে। গালে কয়েকটা পাকা চুল। কমল কাঁচি দিয়ে সেগুলো সাবধানে কাটতে বসল।
সদর দরজা খোলার শব্দ হল। কালোর মা বোধ হয়, কিংবা খবরের কাগজওলা। কমল কাঁচি রেখে প্যান্টের পকেট থেকে টাকা বার করতে লাগল। বাজার করে কালোর মা। টাকা পেতে দেরি করলে গজগজ শুরু করে।
কমলদা!
সলিল ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছে।
কী রে, এত সকালে?
মাঠ থেকে আসছি। প্র্যাকটিস করতে গেছলুম।
তোর না পায়ে চোট!
ডাক্তারবাবু বললেন কিছু নয়, রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। সলিল খাটের উপর বসল। কমলের মনে হল ও যেন অন্য কিছু বলতে এসেছে।
পল্টুদা মারা গেলেন!
হুঁ। তিয়াত্তর বছর বয়স হয়েছিল। কমল দাড়ি কাটতে কাটতে আয়নার মধ্যে দিয়ে সলিলকে লক্ষ করতে লাগল।
কিছু বলবি আমায়?
সলিল মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙুলটা মেঝেয় কিছুক্ষণ ঘষাঘষি করে ধরা গলায় বলল, কমলদা, দুদিন আমাদের কিছু খাওয়া হয়নি। আমাদের সংসারে আটটা লোক।
কমল ভেবে পেল না এখন সে কী বলবে! এ রকম কথা প্রায়ই সে শোনে ময়দানে। প্রথম প্রথম একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের মধ্যে কেঁপে উঠত, এখন শুধু তার চোয়ালটা শক্ত হয়ে যায়।
একটা কার্ডবোর্ড কারখানায় কাজ পেয়েছি, হপ্তায় আঠারো টাকা। আজ থেকেই কাজে লাগতে হবে।
ফুটবল?
সলিল আবার মাথা নামিয়ে চুপ করে রইল। কমল দেখল, টসটস করে ওর চোখ বেয়ে জল পড়ছে। তারপর নিঃসাড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওকে ডাকবে ভেবেও কমল ডাকল না।
জীবনে প্রথম বড় সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে ছেলেটা। এখন ওর মধ্যে লড়াই শুরু হয়েছে ফুটবলের সঙ্গে সংসারের। আকাঙক্ষার সঙ্গে মায়া-মমতা-ভালবাসার। যদি ফুটবলকে ভালবাসে, বড় খেলোয়াড় হবার তীব্র আকাঙক্ষা যদি থাকে, তা হলে ওকে নিষ্ঠুর হতে হবে। সংসারের সুখ-দুঃখ থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। বাঙালিরা বড় কোমল। বেশির ভাগ ছেলেরাই তা পারে না। সংসারের সর্বগ্রাসী হাঁ-এর মধ্যে ঢুকে যায়। ও নিজেই সিদ্ধান্ত নিক। দু-চারটে টাকা দিয়ে করুণা করে ওকে ফুটবলার হয়ে ওঠায় সাহায্য করা যাবে না।
কমলের নিজের কথা মনে পড়ে গেল। মা মারা যাওয়ার পর সংসার দেখাশুনোর জন্য জোর করে বাবা তার বিয়ে দেয়। তখন বয়স মাত্র কুড়ি। তারপর অদ্ভুত একটা লড়াই তাকে করে যেতে হয় অমিতাভর মায়ের সঙ্গে। কিন্তু ছেলে সেসব কথা বুঝবে না। ওর বন্ধুরা আগ্রহ নিয়ে আলাপ করতে আসে অথচ অমিতাভ তার বাবার খেলা সম্পর্কে উদাসীন। একদিনও বলেনি, টিকিট দেবেন—খেলা দেখতে যাব! কমলের বহু দিনের সাধ ছেলে তার খেলা দেখতে আসুক।
বাবা, দর্জির দোকান থেকে আজ প্যান্টটা আনার তারিখ।
আজকেই,কমল ব্যস্ত হয়ে চাবি নিয়ে দেরাজের দিকে এগোল। কত টাকা?
কুড়ি।
স্ট পা র।
টাকাটা অমিতাভর হাতে দেবার সময় কমলের মুহুর্তের জন্য মনে পড়ল, সলিল হপ্তায় মাত্র আঠারো টাকা মাইনের একটা চাকরি নিচ্ছে। অমিতাভ আর সলিল প্রায়। এক বয়সী হবে।