সেই অজানার খোঁজে – প্রথম খণ্ড : 02
কলকাতায় এসে আমাদের তিন জনেরই মন অনেকটা সুস্থ। বিদায় নেবার আগে অবধূত আমার স্ত্রীকে বলেছিলেন, মা, আপনার প্রাণের জিনিসই তো জমা দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন—এবার দুঃখটুকুও জমা দিতে চেষ্টা করুন, তাতে আত্মা বলে যদি কিছু থাকে, তিনি বন্ধন মুক্ত হবেন।
দিন পনেরো বাদে স্ত্রীকে বললাম, একবার কোন্নগর থেকে ঘুরে আসি, মনটা বড় টানছে।
স্ত্রী তক্ষুণি সায় দিলেন।
দিনটা রবিবার। ড্রাইভারের ছুটি। নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ছুটির দিনে রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা থাকবে আশা করা যায়। স্নান সেরে সকাল ন’টায় বেরিয়েছি। অবধূত বলে দিয়েছিলেন, যে-দিন আসবেন সকালেই চলে আসবেন—খেয়ে আসার অজুহাত শুনব না।
না খেয়েই বেরিয়েছি। তাঁর কাছে অন্তত এ ব্যাপারে আর কোনো সংকোচ নেই। কোন্নগর স্টেশনের পথ থেকে তাঁর ডিরেকশন ধরে মিনিট পাঁচ-ছয় ড্রাইভ করতে একজন বাড়ি দেখিয়ে দিল।
বেশ পুরনো ছাতল। পড়া একতলা বাড়ি। এক-নজর তাকালেই বোঝা যায় অনেক দিন সংস্কার হয়নি। ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কামরায় যার সঙ্গে পরিচয়, যাঁর অমন পয়সাঅলা সব শিষ্য—এক দেড় দিনে ই’আড়াই হাজার টাকা প্রণামী পড়তে দেখেছি—শিষ্যের ডাকে যিনি দেরাদুনমুসৌরি যাতায়াত করেন—হরিদ্বারে ত্রিপাঠীর বিলাসবহুল ঘরে যাঁর সঙ্গে থেকে এসেছি—তাঁর নিজের এমন বাড়ি ভাবতে পারিনি।
ছোট্ট আঙিনার মধ্যে বাড়িটা। সামনে কোমর উঁচু বাঁশের গেট তারের খাঁজে আটকানো। গেটের দু‘পাশে দুটো শ্বেত করবী আর লাল করবীর গাছ। এক দিকে ফুলবাগান, তাতে কিছু বুনো ফুল ফুটে আছে। অন্য দিকে দুটো জবা গাছ, ছোট বড় কয়েকটা কলা গাছ, মাঝারি সাইজের দুটো নারকেল গাছ আর একটা আম গাছ।
গেটের সামনে গাড়ি থামিয়ে হর্ন দিলাম। দরজা খুলে যিনি সোজা গাড়ির দিকে তাকালেন, এমন এক সুদর্শনার অবস্থান এখানে আশা করিনি। কেউ আমাকে ভুল বাড়ি দেখিয়ে দিল কিনা এমন সন্দেহও হল। আমাকে দ্বিধান্বিত দেখে মহিলা দরজা ছেড়ে সামনের দাওয়ায় এসে দাঁড়ালেন। অগত্যা গাড়ি থেকে নেমে বাঁশের গেট সরিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম। চোখে ধাঁধাই লাগছে।
—এটা কালীকিংকর অবধূতের বাড়ি?
—হ্যাঁ আসুন···তিনি একটু বেরিয়েছেন, আপনি আজ আসতে পারেন বলে গেছেন—এখুনি ফিরবেন মনে হয়।
আবার একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আমি আজ আসতে পারি অবধূত সেটা অনুমান করতেও পারেন কিন্তু আমিই যে সেই লোক তা এই মহিলার আঁচ করা সম্ভব কি করে! তাছাড়া আমার আসা একেবারে হঠাৎ। সকালে চা খেতে খেতে ঠিক করেছি।
দাওয়ায় দরজার দু‘দিকে দু‘জোড়া বেতের চেয়ার পাতা। একদিকের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বসুন। একটু ব্যস্ত পায়েই ভিতরে চলে গেলেন।
আমি বিমূঢ়ের মতো বসে। খুব সাদাসিধে বেশবাসে এ আমি কোন দিব্যাঙ্গনাকে দেখলাম! মহিলা বলছি, মুখের অচপল গম্ভীর অভিব্যক্তি দেখে, নইলে বয়েস বড় জোর বছর ত্রিশেক হতে পারে, পরনে চওড়া লাল পেড়ে চকচকে কোরা শাড়ি—মুখের রঙ গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে গেছে। গায়ে শেমিজ, টিকালো নাক, আয়ত-গভীর কালো চোখ, কপালে সিকি সাইজের টকটকে লাল সিঁদুর টিপ, সিঁথিতে মোটা করে টানা সিঁদুর, হাতে গলায় বা কানে গহনা নেই, বাঁ হাতে লোহা-বাঁধানো গোছের কিছু। দীর্ঘাঙ্গী, নিটোল স্বাস্থ্য, সুডোল বাহু—সব থেকে বাহারের বোধহয় চুল, পিঠে ছড়ানো চুল কোমর ছাড়িয়ে হাঁটুর কাছাকাছি। চলে যাবার সময় পায়ের দিকে চোখ গেছে, আলতা-পরা এমন দু‘খানি পা-ও যে রমণীর এক বিশেষ রূপ—কলকাতায় থেকে তা ভুলেই গেছি। …অবধূতের ঘরে এমন দিব্যাঙ্গনাটি কে? দিব্যাঙ্গনা ছাড়া অন্য শব্দ আমার মনে আসছে না। অবধূতের বয়েস যদি ষাট হয়, তাঁর মেয়ে হওয়াই সম্ভব। কিন্তু অবধূতের গায়ের রং বড় জোর উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলা যেতে পারে। এ যদি মেয়ে হয় তো মা-টি অতি রূপসীই হবেন সন্দেহ নেই। আবার সচকিত আমি। মেয়েটির হাতে ( মেয়েটিই বলি ) পাথরের ডিসের ওপর বসানো বড় একটা পাথরের গেলাস। সামনে ধরতে মনে হল, গেলাসে গুড়ের সরবত। ব্যস্ত হয়ে বললাম, এক্ষুণি এর কি দরকার ছিল …অবধূতজী আসুন—
—রোদের মধ্যে ড্রাইভ করে এসেছেন, ভালো লাগবে।
গেলাসটা তুলে নিলাম। আঁখি গুড়ের সরবতই বটে, কিন্তু তাতে সুগন্ধ লেবু আর কিছু মশলার গুঁড়ো মেশানো। ভারী সুস্বাদু লাগল।
যাঃ। গলা দিয়ে আপনিই বেরিয়ে এলো।
ঠোঁটের ফাঁকে সামান্য হাসির আভাস।
বললাম, অববৃতমশাই হয়তো আমি আসব ভাবেন নি…আর কারো কথা বলে গিয়ে থাকবেন—
চাউনিটা স্পষ্ট, সোজা। আপনার কথাই বলেছেন… কলকাতা থেকে আসছেন তো?
মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
—দেরাদুন যাবার সময় আপনার সঙ্গেই তো ট্রেনে পরিচয়?
আর কোনো সন্দেহ থাকল না যে অবধূত আমিই আসতে পারি আশা করেছেন। জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করল, উনি আশা করলেও তুমি জানলে কি করে যে আমিই সেই লোক। কিন্তু জিগ্যেস করা গেল না, বয়েস যা-ই হোক, রূপের সঙ্গে এমন এক শান্ত ব্যক্তিত্ব মিশে আছে যে চট করে তুমি বলতেও বাধে৷ দু‘চুমুকে সরবত খেয়ে জিগ্যেস করলাম, উনি কে হন?
ঠোঁটের হাসি আবার একটু স্পষ্ট।আপনাদের অবধূত?
পাল্টা প্রশ্নটা কি-রকম যেন লাগল। মাথা নাড়লাম।
—হন্ কেউ একজন বলতে বলতে বাঁশের গেটের দিকে চোখ। আমিও দেখলাম। পেটো কার্তিক। হাতে বাজারের থলে। আমাকে দেখে ছোট-খাটো একটু হাঁ করে ফেলল। তারপরেই উল্লাসে ছুটে এলো।-আপনি এসে গেছেন সার! দাওয়ায় উঠেই ডান হাতের ব্যাগ বাঁ-হাতে নিয়ে ঝুঁকে একটা প্রণাম ঠুকে ফেলল।—বাবা তো ঠিকই বলেছেন মাতাজী উনি আজ আসতে পারেন, আমিই বরং ভাবছিলাম মাংস আনব কি আনব না—ভাগ্যিস এনেছি।
পেটো কার্তিকের মুখে মাতাজী শুনে আমি বিমূঢ় হঠাৎ। স্থান-কাল ভুলে রমণীর দিকে তাকালাম। থলেটা কার্তিকের হাত থেকে নিয়ে উনি বলছেন ( মাতাজী শোনার পর উনি ছাড়া আর কি বলব! ), যা তো বাবা, বোসেদের ছেলের অসুখ, ওঁকে সেখানে ডেকে নিয়ে গেছে—কোথাও গিয়ে বসলে তো আর ওঠার নাম নেই—একটা খবর দে।
পেটো কার্তিক তক্ষুণি ছুট লাগালো।
পাথরের গেলাস মাটিতে নামিয়ে রাখতে যেতে মহিলা নিঃসংকোচে হাত বাড়ালেন। দ্বিধাগ্রস্ত মুখে গেলাস এগিয়ে দিলাম।
—এবারে একটু চা করে আনি?
ব্যস্ত হয়ে জবাব দিলাম, উনি আসুন—
চলে গেলেন। আমার মনে হল চোখের গভীরে একটু কৌতুকের আভাস দেখলাম।…আমার মুখের অবস্থা দেখেই কি?
…হরিদ্বারে রাতে ত্রিপাঠীর বাড়িতে বোতল-গেলাস নিয়ে বসে উনি যে কথাগুলো বলেছিলেন মনে পড়ল।…বলেছিলেন, কেউ বেঁধে ফেলছে মনে হলেই তাঁর পালানোর ঝোঁক-বন্ধন কাটানোর তাগিদ। আমি জিগ্যেস করেছিলাম, কিসের বন্ধন থেকে? গেলাসে চুমুক দিয়ে মুচকি হেসে জবাব দিয়েছিলেন, রমণীর বাহুবন্ধন থেকে।…আর বলেছিলেন, তাঁর অদৃষ্টে এই শেকল যে কি শেকল তা যদি জানতেন—সেটা ছেঁড়ার তাগিদে মাঝে মাঝে আমার মাথায় ভূত চাপত—পালাতাম! …এখন বুঝতে পারছি কি অমোঘ শেকলের কথা তিনি বলেছিলেন। কিন্তু আমার ভেতরটা একটু বিরূপ হয়ে উঠল। হতে পারে অবধূতের প্রতি এই মহিলার আকৃষ্ট হবার মতো মতিভ্রমই হয়েছিল, এ-লাইনের লোকদের বশ করার ক্ষমতা তো কিছু আছেই—তাই মহিলার চোখে বয়েসের তফাৎটা বড় বাধা না-ও হতে পারে। কিন্তু মেয়ের বয়সী একজনের বাহুবন্ধনে শেষ পর্যন্ত ধরা দিয়ে অবধূত পাষণ্ডের মতোই কাজ করেছেন।
পেটো কার্তিকের সঙ্গে অবধূত মিনিট দশেকের মধ্যেই ফিরলেন। একমুখ হাসি।—-একলা যে, মা এলেন না?
হেসে জবাব দিলাম, সবে তো শুরু।
—ড্রাইভার দেখছি না, নিজে ড্রাইভ করে নাকি?
—ড্রাইভারের রোববারে ছুটি থাকে।
হাসছেন।—সকাল থেকেই কি-রকম মনে হচ্ছিল আপনি আসতে পারেন। হাঁক দিলেন, কই গো!
—বসুন, ব্যস্ত হবেন না, ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে, আসার সঙ্গে সঙ্গে চমৎকার সরবত খাইয়েছেন!
পেটো কার্তিক ভিতরে চলে গেছে। বেতের চেয়ারটা মুখোমুখি টেনে নিয়ে বসলেন। এক চোখ টিপে জিগ্যেস করলেন, সরবত বেশি মিষ্টি লাগল না ওঁকে?
হাঁকের জবাবে মহিলা এসে উপস্থিত। অবধূতের রসালো প্রশ্ন কানে গেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু লাজ-লজ্জার অভিব্যক্তি চোখে পড়ল না। অবধূতই আরো সরস হয়ে উঠলেন। স্ত্রীর দিকে চেয়ে বললেন, এসো, লেখককে জিগ্যেস করছিলাম, সরবত বেশি মিষ্টি লাগল না সরবতদাত্রীকে?
বুড়ীকে নিয়ে এই এক ঢঙের কথা আর কতবার কত জনকে বলবে? আমার দিকে ফিরলেন, এবারে চা দিই?
তা তো দেবেই। অবধূতের কড়া মেজাজের গলা।—আমার চিরযৌবনা স্ত্রীকে তুমি বুড়ী বলো কোন্ সাহসে? উনি আমারও পঞ্চাশের নিচে বয়েস ভেবেছিলেন সে ভিন্ন কথাতা বলে তোমার বেলায়ও ভুল হবে নাকি? আচ্ছা, আপনি তো মশাই একজন নামী লেখক…বেশ করে ওঁর মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে বলুন তো, খুব বেশি হলে ওঁর বয়েস কত হতে পারে—আমি যে লোকের কাছে পঞ্চম পক্ষের স্ত্রী বলে পরিচয় দিই— সেটা খুব বেশি বলি কিনা? দেখুন না, লজ্জা কি, পাসপোর্ট তো পেয়ে গেছেন!
প্রথম দর্শনে কোনো রূপসী মহিলাকে সোজাসুজি দেখতে যাওয়ার নানা বিড়ম্বনা। অনুমতি পেয়ে হাসি মুখে একটু ভালো করেই দেখলাম। ফলে মনে হল তিরিশের কিছু বেশিই হবে। অবধূতের কথায় আরো একটু গার্ড নিয়ে বললাম, মহিলারা এই প্রসঙ্গ সব থেকে অপছন্দ করেন শুনেছি— তবু ধরুন ওকে নিয়ে যদি আপনার লিখতে হয়, কত লিখবেন?
—বছর পঁয়ত্রিশ।
অবধূত হ-হা করে হেসে উঠলেন, আমার কথা শুনেই বাড়িয়ে বললেন তো? তেত্রিশ…
ছদ্ম কোপে মহিলা বললেন, এরপর তোমার কাছে কেউ এলে আমি আর বাইরে আসব না। আমার দিকে ফিরলেন, শুনুন, আরো একত্রিশ বছর আগে আমার কুড়ি আর ওঁর ঊনত্রিশ বছর বয়সে আমাদের বিয়ে হয়েছে —তাহলে বুঝুন আমার বয়স কত— সকলের কাছে আমাকে ডেকে এনে এই ব্যাপার করা চাই।
অবধূত বলে উঠলেন, বুঝুন ঠেলা, বিশ্বাস করবেন কিনা আপনিই বলুন। আমি বিমূঢ় একেবারে। একত্রিশ বছর আগে কুড়ি বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে মানে এঁর বয়েস এখন একান্ন। বয়েস বেঁধে রাখারও কোনো জাদু আছে নাকি! হতভম্বের মতো খানিক চেয়ে থেকে মহিলাকে বললাম, আপনার কথা সত্যি হলে অবধূত মশাইয়ের কোনো দোষ নেই—এই দেশের সব মেয়েদের ডেকে ডেকে এনে আপনাকে দেখানো উচিত।
অবধূত গম্ভীর মন্তব্য করলেন, ঢোকতে হয় না, আপনিই আসে—তবে মেয়েরা নয়, বেশিরভাগই ছেলে। হরিদ্বারে আপনি আমার বাড়ি আসবেন বলতে আপনাকে এই জন্যেই বলেছিলাম, এলে ভালো লাগবে—অনেকের লাগে।
হালছাড়া রাগে মহিলা বলে উঠলেন, আচ্ছা, যারা এখানে আসে সকলে আমাকে মাতাজী বলে ডাকে—এভাবে বলতে তোমার মুখে আটকায় না?
—মাতাজী বলে তাতে কি হলো, মাতাজীকে ভালো লাগতে পারে না? আচ্ছা মশাই আপনিই বলুন, একে দেখে আপনারও যে ভালো লেগেছে এ-তো চোখ-মুখ দেখেই বুঝতে পারছি—ভালো লাগাটা কি দোষের— এরপর আমার এখানে আসতে আপনার কি আরো ভালো লাগবে না? আমার হাঁসফাঁস মুখ দেখে ভদ্রমহিলা দ্রুত চলে গেলেন। অবধূত হাসছেন।
আমি বললাম, কংগ্র্যাচুলেশনস—থাউজেণ্ড কংগ্র্যাচুলেশনস।… আপনি এই শিকল ছিঁড়ে পালাতে চেষ্টা করেছেন?
—অনেকবার। শেষের বারে বিহারে টানা তিন বছর।
—উনি জানতেনও না আপনি কোথায় আছেন?
—নাঃ।
—আপনি যত বড় অবধূতই হোন, আপনাকে নরাধম বলতে ইচ্ছে করছে। তিন বছর ধরে আপনি ওঁকে যন্ত্রণার মধ্যে রেখেছেন!
নিঃশব্দ হাসিতে মুখখানা ভরাট শুধু নয়, সুন্দরও হয়ে উঠল। বললেন, আপনি তাহলে ওকে খুব বুঝেছেন।…আরে মশাই যন্ত্রণার মধ্যে আছে জানলে তো আমার পালানো সার্থক ভাবতাম! যন্ত্রণা দূরে থাক, একটু তাপ-উত্তাপও যদি দেখতাম। যেখানে যত দূরেই যাই, শেকলটা যে আমার গলায় পরানোই আছে সেটা উনি খুব ভালো করেই জানতেন। সেবারে ছাড়া পেয়েছি বিকেল চারটের পরে। সঙ্গে ড্রাইভার থাকলে রাতের আগে ছাড়া পেতাম না।
সেই থেকে আমার কোন্নগরে যাতায়াত শুরু। পনেরো দিন বা তিন সপ্তাহে একবার করে যাই-ই। অবধূত নিজেই বলেছিলেন উনি ঘটনা দেখেন। আমি চরিত্র দেখে বেড়াই। সদ্য বর্তমানে এই একটি চরিত্র নিয়ে আমার আগ্রহের সীমা-পরিসীমা নেই। একটি নয়, আগ্রহ তাঁর স্ত্রীকে নিয়েও। দু‘জনেরই বিশেষ একটা অতীত আছে যার আভাস এখনো আমার কাছে খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। হবে, আশা রাখি। কোন্নগরের এই বাড়িতে লোকের আনাগোনা লেগেই আছে। যে রবিবারে আমি প্রথম গেছলাম, বিকেল চারটের মধ্যে কম করে পনেরো-ষোলজন লোককে অবধূত ফিরিয়ে দিয়ে হতাশ করেছিলেন। সেটা আমার খাতিরে। পেটো কার্তিক আমাকে টিপ দিয়ে রেখেছিল। এর পরে এলে বুধবারে আসবেন, ওই একদিন বাবা অনেকটা ফাঁকা থাকেন, লোকের চিঠিপত্রের জবাব দেন, বা ওষুধ—টম্বুধ তৈরি করেন।
লক্ষ্য করেছি অবধূতের কাছে বেশির ভাগ লোক কিছু না কিছু সংকট ত্রাণের আশা নিয়ে আসে। অবশ্য সংকটের রকমফের আছে। এদের ভিতর দিয়ে অবধূতকে বোঝার জন্য বুধবার ছেড়ে এক-একদিন অন্য বারেও এসে হাজির হয়েছি। সত্যিকারের সংকটে পড়েই অনেকে আসে বটে। কিন্তু ব্যতিক্রমের মধ্যেও অন্য যে আসে তার সংকট তার কাছে অন্তত বিষম। একবার এক মহিলাকে দেখলাম, অবধূতের সামনে বসে খুব কান্নাকাটি করছেন। ব্যাপার সাংঘাতিক বইকি। তাঁর বড় আদরের বেড়ালটি হারিয়ে গেছে। তাকে ফিরে না পেলে তিনি প্রাণে বাঁচবেন না।
অবধূত গম্ভীর। চেষ্টা করে বিষণ্নও। —আপনার ছেলেপুলে নেই তো? —না বাবা, ওই পুষিই আমার সব।
খুব দুঃখের কথা।…কিন্তু আপনাকে তাহলে কিছু ক্রিয়া করতে হবে। মহিলা আশায় উন্মুখ।—আমি সব করব, কি করতে হবে বলুন বাবা? —খুব গরিব দুঃখী একটা বা দুটো বাচ্চা ছেলে-মেয়ে আপনার চেনা—
জানার মধ্যে আছে?
ভাবলেন একটু।—আছে বাবা, আমাদের যে ঘর ঝাড়-মোছ করে ঠিকে ঝি-টা, তার গেদা বাচ্চা দু‘টো ছেলে মেয়ে আছে—স্বামীটা অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে বউটা কাজে বেরিয়েছে— দু‘বেলা খাওয়া জোটে না।
—তাহলে ওই দুটো বাচ্চাকে আপনাকে পুষির মতো—না, পুষির থেকেও বেশি ভালো বাসতে হবে—আপনার ভালবাসা যত খাঁটি হবে—পুষির ফিরে আসার চান্স ততো বেশি।
—কিন্তু বাবা পুষি গেল কোথায়? সে বেঁচে আছে তো, না কেউ মেরে—টেরে ফেলল?
—বেঁচে না থাকলে আপনার কাছে আর ফিরছে কি করে? যান, যা বললাম, মনে-প্রাণে তাই করুন। পুষি ফিরে এলে আমাকে একটা খবর দেবেন।
পায়ের কাছে দশটা টাকা রেখে প্রণাম করে চোখ মুছতে মুছতে ভদ্রমহিলা চলে গেলেন।
আমি হেসে বলেছি, বেশ, পুষি যদি আজ-কালের মধ্যেই ফিরে আসে? অম্লানবদনে জবাব দিলেন, ওই জন্যেই ফিরে এলে খবর দিতে বললাম। ফিরে এলে উনি জানবেন, আমার অব্যর্থ ক্রিয়ার ফল, তখন ওই মানুষের বাচ্চা দুটোকে আরো বেশি ভালবাসতে বলতে হবে—নইলে পুষি আবার একদিন বরাবরকার মতো হারিয়ে যাবে।
কথা শেষ হতে না হতে একটি বছর তেইশ-চব্বিশের ছেলে আর বছর উনিশের মেয়ে এসে উপস্থিত। দেখে আমার মনে হলো এই প্রথম আসছে। লাল চেলি দেখে চিনল, ভক্তিভরে প্রণাম করল।
সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর মুখে অবধূত জিগ্যেস করলেন, দু’ জনেরই গার্জেনের আপত্তি!
ওরা হকচকিয়ে গেল একটু। ছেলেটি বলল, আজ্ঞে ..?
—বলছি, তোমাদের বিয়ের ইচ্ছেয় দু‘জনেরই গার্জেনের আপত্তি হয়েছে বা হবে?
দু‘জনেই বিস্মিত এবং মুগ্ধ। ইতস্তত করে ছেলেটি একবার আমার দিকে তাকালো। অবধূত বললেন, উনিও একজন যোগীপুরুষ, ওইভাবে থাকেন —বেশি সময় দিতে পারব না, চটপট বলো—
ছেলেটি বলল, আজ্ঞে আপনি ঠিকই বলেছেন— দু‘জনেরই বাবা-মায়ের আপত্তি। বিশেষ করে আমার বাবার —আপত্তি কেন? জাতে-বর্ণে তো মিল আছে দেখছি?
তারা আরো মুগ্ধ—তোমার বাবা কি করেন?
—উকিল।
—তুমি এক ছেলে?
— আজ্ঞে হ্যাঁ, তিনটি বোন আছে। আমার ছোট।
—তুমি চাকরি-বাকরি করো?
বাবার সঙ্গে প্র্যাকটিস শুরু করেছি।
—তোমার বাবার কি ইচ্ছে, তোমার বিয়েতে অনেক টাকা পেয়ে তোমার পরের বোনের বিয়ের টাকা কিছুটা যোগাড় করে রাখবেন?
মেয়ে উন্মুখ। ছেলেটি শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ছে।—আপনি ঠিকই বলেছেন… এখন একটা উপায় করে দিন।
—উপায় তোমাদের হাতে। তোমাদের মতি স্থির থাকলে তবেই তোমাদের বাবা-মায়েদের মতি ফেরা সম্ভব। দু‘তিনটে বছর এই কঠিন পরীক্ষার মধ্যে কাটাতে হবে তোমাদের।… তোমরা এখানে এসেছ কাউকে না জানিয়ে, কোনো আত্মীয় বা তোমার বাবার কোনো বন্ধুর মারফৎ তোমার বাবাকে একবার আমার কাছে পাঠাতে চেষ্টা করো—তোমরা আমার খবর পেলে কি করে?
ছেলেটি জানালো, এক মামা আমাকে খুব ভালবাসে—সে বলেছে আপনি কিছু করে বাবার মত ফেরাতে পারেন।
তোমরা আমার কাছে এসেছ মামা জানেন?
—না… তিনি কারোর কাছে আপনার ক্ষমতার কথা শুনে আমাকে বলেছিলেন।
তোমরা এখানে এসেছ তাঁকেও বলবে না। গিয়ে তাঁকেই একবার আমার কাছে আসার জন্য ধরে পড়ো—সেটা পারলে তোমার বাবাকে এখানে আনাবার ব্যবস্থা আমি করতে পারব।
ইতস্ততঃ করে ছেলেটি বলল, আপনি যদি কিছু ক্রিয়া করেন…
—সেটি করতে হলে তোমার বাবাকে দরকার—ক্রিয়াটা তাঁর ওপর দিয়ে হবে। আর আবারও বলছি, সব নির্ভর করছে তোমাদের মতির ওপর—আপনি কি বলেন?
আচমকা শেষের প্রশ্ন আমাকে। কোনোরকমে মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
এ ছাড়া আর কি করার আছে…।
ওরাও একটা দশ টাকার নোট রেখে প্রণাম করে চলে গেল। ছেলেটি তার নাম ঠিকানা আর মামার নাম রেখে গেছে। তার আশা মামাকে পাঠাতে পারবে।
অবধূত হেসে বললেন, কত রকমের কেস আমার জোটে দেখছেন?… তবে এই ছেলের বাবাকে একবার নাগালের মধ্যে পেলে এ কেস জলভাত— এই বিয়ে দিয়ে সে তার নিজের ফাঁড়া কাটিয়ে বাঁচাবে। ছেলের মতি ফেরানোর নাম করে মামাকে দিয়ে এই বাপটিকে একবার এখানে আনাতে হবে। আমার মন বলছে এই বিয়ে হবে, ছেলে-মেয়ে দু‘জনেরই কপালের লক্ষণ ভালো।
মাতাজীর নাম কল্যাণী। তাঁর কাছে যারা আসে তাদের মধ্যে নানা বয়সের পুরুষের সংখ্যাই বেশি। মেয়ে ভক্তও অবশ্য কম নয় একেবারে। সকলেরই তিনি মাতাজী। তাদের শ্রদ্ধাভক্তিতে ভেজাল আছে মনে হয় না। কারো ওষুধ-বিদুধের দরকার হলে মাতাজী তাকে অবদূতের কাছে পাঠান। আর কেউ দীক্ষা নিতে চাইলে অবধূত তাকে মাতাজীর কাছে পাঠান। অবধূত নিজে কাউকে দীক্ষা দেন না। কল্যাণী দেবী আমাকে বলেছেন, এই জন্যেই আমার কাছে পুরুষের ভিড় বেশি, কারো মনে ডাক দিলেই সে দীক্ষা নেবার জন্য ব্যস্ত হয়, আর আপনাদের অবধূত তখন তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে খালাস। দায় উদ্ধারের আশায় প্রথমে সকলেই আসে ওঁর কাছে, শেষে বিপাকে পড়ি আমি।
অবধূত হেসে বলেন, বিশ্বাস করবেন না মশাই, আমার আসল শক্তি যে উনি এটা সকলেই টের পেয়ে যায়।
অবধূতও আমার কলকাতার বাড়িতে বার কয়েক এসেছেন। আমি স্ত্রীকে আর মেয়েকে নিয়েও গেছি। অবধূতকে তাদের জানতে বুঝতে বাকি নেই। কল্যাণী দেবীকে দেখে দুজনেই মুগ্ধ। মেয়ে তাঁকে দেখে বলে উঠেছিল, আপ—নাকে তো আমি অনায়াসে আমার বড় বোন বলে চালিয়ে দিতে পারি। তাঁর সম্পর্কে আমার মুখে আগেই শুনেছিল। কল্যাণী হেসে বলেছেন, তুমিও আর ওই এক রা তুলো না—আমার ছেলেপুলে থাকলে তোমার থেকে বড় বই ছোট হত না।
—কিন্তু এ বয়সেও আপনি এরকম স্বাস্থ্য আর শ্রী রাখলেন কি করে—আমাকে এটুকুই শিখিয়ে দিন।
তিনি হেসে জিগ্যেস করেছেন, তুমি স্বাস্থ্য চর্চা মনের চর্চা করো?
—না তো!
—তাহলে কি করে হবে?
—আপনি এক্সারসাইজ করেন নাকি?
—করি বইকি…তবে আমার এক্সারসাইজ একটু অন্য রকমের। আচ্ছা এসো মাঝে মাঝে, যতটা পারি শিখিয়ে দেব।
খুশি হবার মতো কথা আমার স্ত্রীকে বলেছিলেন নাকি। বলেছেন, মুখুজ্জে মশাই এলে ( অর্থাৎ আমি এলে ) উনি সব থেকে বেশি খুশি হন! কেন জানেন? এখানে স্বার্থ ছাড়া, বিপদ বা দায় উদ্ধারের আশা নিয়ে ছাড়া একজনও আসে না। কোনো স্বার্থ নেই এমন কেবল উনিই আসেন। কত লোকের কাছে ওঁর কথা বলেন উনি।
তাঁর শুনে মনে মনে হেসেছি। স্বার্থশূন্য আমিও নই। আর আমার স্বার্থটা কি অবধূত তা একটুও আঁচ করতে পারেন না এমন মনে হয় না। তবু অন্তরঙ্গতাটুকু অকৃত্রিম।
অন্তরঙ্গতার ফাঁক দিয়েই এই দম্পতীর অতীতের আভাস আমি মোটামুটি পেয়েছি।