সেঁজুতি সিনড্রোম
ঢাকা থেকে লন্ডন হিথ্রো পর্যন্ত ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইট নিয়েছে ওরা। লন্ডন থেকে আমেরিকার পথে একই ফ্লাইটে দু’জনের সিট মিলেনি। লন্ডন থেকে তাই ওরা আলাদা আলাদা এয়ারলাইন্সে যার যার ক্যাম্পাসে চলে যাবে। লন্ডনে দু’জনের লম্বা স্টপ ওভার। ঠিক হয়েছে এই সময়টা ডিউটি ফ্রি শপে ও তার আশেপাশে ঘুরাঘুরি করবে। পকেটে মাপা পয়সা । আপাততঃ পরিকল্পনা উইন্ডো শপিং । সেঁজুতি বলেছিল বাংলাদেশ বিমানে যাবে। নিজের দেশের এয়ার লাইন্স। ভাড়াও তুলনামূলকভাবে কম। নাকচ করে দিয়ে নাফিস বলেছে,
– কেনা কাটার বাজারে ইমোশনাল ডিসিশন নিতে নেই। বিমানের যা রেকর্ড! টিকিট কেনার পরও নির্দিষ্ট দিনে সঠিক সময়ে উড়ান যাবে কিনা সেই অনিশ্চয়তাটুকু থেকেই যায়। ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়ে গেলে ক্যাম্পাসে ওরিয়েন্টেশন মিস করবে।
আজকাল এয়ারলাইন্সগুলোর বিপণশৈলী বেশ পরিপাটি নিটোল নিখুঁত। কাস্টমার সার্ভিসে এথনিক দিকগুলোর প্রতি বেশ খেয়াল রাখা হয়। ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজের ঢাকা-লন্ডন ফ্লাইটের সব উড়ানেই দু-একজন বাঙালি বিমান সেবিকা থাকেই। ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও ফ্লাইট অ্যানাউন্সমেন্ট হয়। নাফিস বরাবরই খেয়াল করেছে সম্মানিত যাত্রীগণ আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি জাতীয় সাধারণ কথাগুলো বিমানবালারা অনর্থক ইনিয়ে বিনিয়ে বলে থাকেন। মিষ্টি ছটফটে মেয়ে মৃদুলা বিশ্বাস সেঁজুতির আইলে সার্ভ করছিল। দেখে মনে হচ্ছে কোলকাতার মেয়ে। কোলকাতার মেয়েদের চলাফেরার ছন্দে একটা আলাদা ভাবসাব থাকে। বডি ল্যাগুয়েজ পড়েই ঢাকা আর কোলকাতার মেয়েদের আলাদা করে চেনা যায়। মৃদুলা বিশ্বাস নাফিস সেঁজুতিকে একটু এক্সট্রা খাতিরই দিচ্ছে মনে হলো। খাবার সার্ভ করার সময় মাথা কাত করে মিষ্টি হেসেছে। জানতে চেয়েছে আর কিছু চাই কিনা। চাইলে যেন নির্দ্বিধায় ওকে বলা হয়। মৃদুলার হাসিটি বিমান বালাদের রিহার্স করা সাজানো হাসি নয়, বরং জেনুইন বলেই মনে হয়েছে নাফিসের। সাধারণত এয়ার হোস্টেসদের হাসিটুকুর বেশির ভাগই নকল এবং দায়বদ্ধ রুটিনের মধ্যে পড়ে। সামনে পড়লে প্রশিক্ষিত মাপজোকের হাসি আড়ালে যেতে না যেতেই মিলিয়ে যায়। সেঁজুতিকে কনুই দিয়ে একটা গুঁতোো দিল নাফিস।
– শি শিউর থিঙ্কস ওই আর আ হানিমুন কাপল।
– ইশ্। শখ! সেঁজুতির থেকে প্রত্যাশিত প্রশ্রয়টুকু মিস করল নাফিস।
মৃদুলা একবার কাছে আসতেই মুখ বাড়িয়ে সেঁজুতি বলল,
– এই মেয়ে! তুমি যা ভেবেছ আমরা কিন্তু তা নই।
বিশ্বাস হলো না মেয়ের। যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে মিষ্টি হেসে শটব্যাক, –
– ঠাকুর ঘরে কেরে, আমি কলা খাইনা, না? মৃদুলা একটু দূরে আড়াল হতেই নাফিস বলল,
– তুমি জিনস্ আর টি-শার্ট পরা থাকলে এ ধারণাটি ওর মোটেও হতো না। সালোয়ার কামিজও নয়, একেবারে শাড়ি শাড়ি ব্লাউজ গহনায় ভর-ভরতি সাজ। কপালে জ্বলজ্বলে লালটিপ। শুধু টিকলিটাই বাদ গেছে। মৃদুলা নির্দোষ!
নাফিস মৃদুলার বরাবরে ইতিবাচক রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে চলমান প্রসঙ্গটির একটা লাগসই ব্যাখ্যা খাড়া করার চেষ্টা করল। সেঁজুতি ঠোঁট টিপে হাসলো।
নাফিসের আরো একটু কাছে সরে এলো।
– তোমার সাথে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। একটু বউ বউ লাগলোইবা। এনগেজমেন্টের পরে তো মেয়েরা এমনিতেই আধা বউ হয়ে যায়। ছেলেরাও তো তখন আধা জামাই। মেয়েদের এই সময়টাই সবচেয়ে বেশি মজার তা জান ?
– কিভাবে ? নিবিড় ঔৎসুক্যে ঘুরে বসল নাফিস।
এই সময়টাতেই ছেলেদের বেশি বেশি ভেড়া বানানো যায়। এ সময় তোমরা নতুন পাওয়া মঙ্গিতার মোহে এমনই মোহিত থাকে যে আকাশের চাঁদ চাইলেও এনে দিতে পার।
– তাহলে ব্যাপারটা তো এমন দাঁড়ালো যে এক সময় ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে প্রথম স্থান অধিকারী এক চৌকস হ্যান্ডসাম যুবক কালান্তরে বৈবাহিক সূত্রে সেঁজুতি বিনতে রহমান নামী এক মিষ্টি বালিকার পালিত ভেড়া।
হি হি করে হেসে দিলো সেঁজুতি।
– পালিত ভেড়া। সুন্দর নাম তো!
কাজের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকবার এসে দেখা করে গেছে মৃদুলা। এখন একেবারে আত্মীয় স্বজনের মতো আচরণ শুরু করেছে। একবারে এসে জানতে চাইল,
– কতদিন হলো বিয়ে হয়েছে গো তোমাদের? নাফিস মৃদুলাকে লুকিয়ে সেঁজুতির দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো।
– দু’বছর হলো । যেন খুব লজ্জা পেয়েছে এমনি নরোম মিনমিনে স্বরে বলল সেঁজুতি।
– ছেলে পুলে হয়নি বুঝি? মৃদুলা ক্রমশঃ বড় বেশি ইনকুইসিটিভ হয়ে উঠছে।
– এখনো হয়নি, তবে – – – সেঁজুতি কিছু বলার আগেই নাফিস কথা বলে উঠল।
– এ মা! হাউ সুইট! কয় মাস চলছে গো?
মৃদুলা এক নিমেষে অনুমান করে ফেলল সেঁজুতি অন্তঃসত্তা।
– দেড় মাস! লাজ নম্র কন্ঠে সেঁজুতির জবাব। বলতে গিয়ে সেঁজুতি প্রায় গলগলিয়ে হেসেই দিয়েছিল। নাফিস সেঁজুতির হাত চেপে ধরে থামিয়ে দিলো।
হিথ্রো এয়ারপোর্টে ফ্লাইট ভিড়েছে। প্যাসেঞ্জাররা তড়িঘড়ি যার যার হ্যান্ড ব্যাগেজ নিয়ে বিমান থেকে নেমে যাওয়ার প্রস্তুত নিচ্ছে। আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে নাফিস বললো তাড়াতাড়ি এগোও সেঁজুতি। বিমানের দরজা গলিয়ে লাইন ধরে নেমে যাচ্ছে যাত্রীরা। দরজায় দাঁড়িয়ে যাত্রীদের মিষ্টি হেঁসে বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছে মৃদুলা। বাই। থ্যাংকিউ। সি ইউ নেক্স টাইম। সেঁজুতিকে দেখতেই মৃদুলা বলল,
– ভালো থেকো সেঁজুতি। এ সময়টা একটু সাবধানে থেকো মেয়ে।
সেঁজুতি হেসে ফেলল। ঘাড় কাত করে বলল,
– থাকব। থ্যাংকস মৃদুলা।
যেতে যেতে পেছন ফিরে চাইল সেঁজুতি। হেসে হেসে হাত নাড়ছে মৃদুলা। সেঁজুতির একবার মনে হলো ইনোসেন্ট মেয়েটিকে ভীষণ ঠকিয়ে আসা হলো। ফিরে গিয়ে বলবে নাকি তুমি যা ভেবেছ তা ঠিক না। আই অ্যাম নট প্রেগন্যান্ট!
হার্ভার্ডে দু’টি সেমিষ্টার দেখতে দেখতে কেমন করে কেটে গেল টেরই পাওয়া গেল না। সেঁজুতি নাফিসের সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। মাঝখান থেকে সমস্যা বাঁধালো সিমি। সিমিটা যে আমেরিকায় এসেও এমন জ্বালাবে সেঁজুতি কি তা ভাবতে পেরেছিল ? প্রথম থেকেই ভেবে নিয়েছিল নাফিসের সাথে সিমির খোলামেলা সম্পর্ক ওদের স্বাভাবিক বন্ধুত্বের বাইরে কিছু নয়। ভার্সিটি জীবনের শুরু থেকেই তো ওরা খুব কাছের বন্ধু। একটু-আধটু অন্তরঙ্গতা থাকতেই পারে। সেঁজুতি অমন মিন মাইন্ডেড হতে যাবে কেন? নাফিসকে ভালো করেই জানে সে। সেদিন যখন গুলবদনী অনেকটা গায়ে পড়েই কিছু উপদেশ বিলিয়ে গেল ওই প্রথম একটু যেন নড়ে চড়ে বসল সেঁজুতির মন। ক্যাম্পাসের ক্যাফেটেরিয়ায় এক টেবিলে বসে লাঞ্চ করছিল। বার্গারে কামড় দিতে দিতে কোন প্রসঙ্গ ছাড়াই গুলবদনী বলল,
– নাফিস আর তুই না এনগেজড্ সেঁজুতি ?
– সে আর নতুন কথা কী! সবাই জানে আমরা এনগেজড্ ।
– আমিও তো তাই জানতাম রে সেঁজু। কন্ঠে অন্তরঙ্গতা ঢেলে গুলবদনী সেঁজুতির আরো কাছে ঘেঁষে আসে।
ইদানিং নাফিস আর সিমির বন্ধুত্বের ধরন দেখে তো মনে হয়, কী জানি! ক্যাম্পাসের সবাই কিন্তু তাই ভাবে ।
– তেমন কিছু ভাববার মতো কী দেখলি তুই?
– না, মানে সেদিন কিছু না বলে হঠাৎ সিমির রুমে ঢুকে পড়ে ছিলাম। দেখি সিমি নাফিসকে এক বিশাল ইমেইল লিখছে। আমাকে দেখেই নেট অফ করে দিলো। একটা লাইন শুধু পড়তে পেরেছিলাম। সুইটহার্ট টুইটহার্ট কী সব লিখেছে দেখলাম। সিমি নাফিসের ব্যাপারে তোর একটু সাবধান হওয়া দরকার সেঁজু। ছেলেদের অতো বিশ্বাস করতে নেই রে!
সেজুঁতি জানে গুলবদনীর মতো নষ্ট মেয়েরা ছুঁচোর মতো স্ক্যান্ডালের গন্ধ শুঁকে বেড়ায়। এ্যাফেয়ারের সন্ধান পেলে আর তা যদি হয় বাংলাদেশী ছেলে মেয়েদের নিয়ে সে ক্যাম্পাস গুলজার করতে উঠে পড়ে লেগে যায়। গুলবদনীর কথাগুলো সহ্য হচ্ছিল না সেঁজুতির। ভাবল কুত্তিটাকে টেবিল থেকে ভাগানো দরকার। এই মাত্র সেমিষ্টারের রেজাল্ট বেরিয়েছে। সেঁজুতি গুলবদনীর পড়াশোনার লেজে গোবরে অবস্থাটার কথা জানে। খুব যেন ভাবিত এমন কন্ঠে সেঁজুতি বলল,
– ভাল কথা গুল। এই সেমিষ্টারে রেজাল্ট কেমন রে তোর ? শুনলাম কী একটা ট্রাবল নাকি যাচ্ছে?
এবার লেজ গুটালো গুলবদনী। ব্যাকপ্যাক গোছাতে গোছাতে আধ-খাওয়া বার্গার প্লেটে ফেলে রেখেই তড়িঘড়ি ফিরে যাচ্ছে। সেঁজুতি পেছন থেকে চেঁচালো,
– সবগুলো র্কোসে সি পেয়ে নাকি প্রবেশনে গেছিস ? ইশ!
গুলবদনী আর পেছন ফিরে চাইল না। দ্রুত হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল।গুলবদনীকে তো সেন্ড অফ করা গেল । কিন্তু ওর কথাগুলো সারাদিন মনের ভিতরটায় সমানে খুঁচিয়ে যাচ্ছিল।গুলবদনী যা বলে গেল তা কী ঠিক? সিমি আর নাফিস কি? যাহ্। তা কী করে হয়? মোবাইলে সিমির নাম্বারে ডায়াল করলো সেঁজুতি।
ফোন ধরেই সিমি বলল,
– হোয়াটস্ আপ্ সেঁজু ডার্লিং? হঠাৎ যে? নাফিসের খবর চাই তাই না? গুলবদনী আমাকে সব বলেছে। সিমির জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠ শুনে মনে হলো সে ড্রাঙ্ক।
– নাফিসের খবর আমি তোর কাছ থেকে নিতে যাবো কেন? সেঁজুতির কন্ঠে বিরক্তি।
– নিবি রে সেঁজু ডার্লিং, নিবি। এর পর থেকে নাফিসের সব খবর আমার কাছ থেকেই তো নিবি। জানিস তো উই আর ফলিং। মোর প্রিসাইজলি, আই অ্যাম ফলিং ফর হিম!
সেঁজুতি এতক্ষণ সহজ থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এবার বলতে গিয়ে কথার খেই হারিয়ে ফেলল।
– আমি থাকতে নাফিস তোকে নেবে কেন ?
খিল খিল হাসিতে ভেঙেচুড়ে সিমি সিরহান বলতে থাকে,
– ইকোনোমিক্সের ছাত্রী তুই। চাহিদা আর সরবরাহের থিওরিটা কিন্তু তোর জানা থাকার কথা সেঁজু ডার্লিং। বিয়ে শাদি ভালো লাগা ভালোবাসার ক্ষেত্রেও থিওরিটা কিন্তু ঠিকঠাক খাটে। সরবরাহে টান পড়লে বাজার চুপসে যায়। চাহিদার টানা পোড়েনে বেচা-বিক্রির গ্রাফ নুইয়ে পড়ে। সুন্দরী আমি তোর চেয়ে কম নাকি? কোমর দোলাতে জানি। বুক নাচাতে জানি। সাজানো ঠোঁটে খেলাতে পারি শুঁয়ো পোকার ঢেউ। আর তুই যেটা জানিস না সেঁজুতি, দারুন এক তুরুপের তাস আছে আমার বুক পকেটে। টেস্ট মার্কেটিংও করে নিয়েছি দুই-একবার। একেবারে মোক্ষম অ্যামুনিশন বুঝলি? টার্গেট মিস হয় না আমার। মুহূর্তে গলে গিয়ে ঢলে যায় পুরুষ। কতক্ষণ মুখ ফিরিয়ে থাকবে নাফিস মিয়া? আমিও দেখব কতদিন তুই ধরে রাখতে পারিস নাফিসকে।
সিমির দুর্বিনীত স্পর্ধা সেঁজুতিকে অবশ করে দেয়। কন্ঠের সব শক্তি যেন নিমেষে নিঃশেষিত।
– তুই জানিস না সিমি আমরা এনগেজড?
সেঁজুতির কথাগুলো এখন প্রার্থনার মতো শোনায়। সিমির ঔদ্ধত্য তাতে এক বিন্দুও টলে না। খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সিমি। না জানি কী এক বোকাটে কথা বলে ফেলেছে সেঁজুতি।
– তো তাতে হলোটা কী ? বিয়ে তো আর হয়ে যায়নি তোদের ? আর, হলেই বা কী ? জুড়ে রাখা বিয়েও কি ভাঙে না?
– নাফিস আমাকে ভালোবাসে। ও কোন দিনও আমাকে ছেড়ে তোকে নেবে না! সেঁজুতির কন্ঠে নিবিড় বিশ্বাসের দৃঢ়তা।
– ওরে মোর মূঢ় মেয়ে। কে রে তুই কোথা হতে কী শকতি পেয়ে কহিলি এমন কথা এত স্পর্ধা ভরে ?
দুর্বিনীত অবজ্ঞায় রবীন্দ্রনাথ আওড়ায় সিমি।
– প্রগাঢ় প্রেমও কি যায় না অকাল বিচ্ছেদে ? বিয়ের পরেও কি ডিভোর্স হয় না ?
এমনি কত কী! ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকেই নাফিসকে চাইতাম আমি। নাফিসকে তুই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিস রাক্ষুসী!
সিমির নেশাগ্রস্থ কন্ঠ উদ্যত-ফনা গোখরোর মতো ফোঁসতে থাকে।
গ্রে হাউন্ড বাসের রিটার্ন টিকিট ব্যাগে পুরতে পুরতে আয়নায় আরেকবার নিজেকে দেখে নেয় সিমি। নাফিস বশীকরণের যাবতীয় অস্ত্রপাতি পরিপাটি গোছানো আছে যথাস্থানে। দেখবে এবার নাফিস বধ ওর কে আটকায়। এই সেক্সি ! ইউ লুক ফ্যাব্যুলাস। নিজেকে নিজেই উইশ করে,
– অল দ্য বেস্ট সিমি সিরহান। হ্যাপি হান্টিং!
সিমিকে বাস স্টেশনে বিদায় দিয়ে সেঁজুতিকে ফোন করলো গুলবদনী।
– তোর জন্য ছোট একটা খবর ছিল সেঁজু।
– কী খবর?
– সিমি এখন কোথায় জানিস ?
– আমি জানব কেমন করে ?
– সে কি লো ? এমন ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা তুই জানবি না তো কে জানবে রে?
– কোথায় সিমি ?
– অভিসারে গো ! তোর হবু বরের সাথে । নাফিসের ডর্মে। লাইন কেটে দিল গুলবদনী।
সিমিটা যে এমন বিনা নোটিশে হুট করে ডর্ম পর্যন্ত চলে আসবে নাফিস এতোটা ভাবেনি। মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলতে পারছেনা। সিমির মধ্যে কিছু পাগলামি আছে। মাঝে মধ্যে ওর ছেলেমানুষিটা স্বাভাবিকের সীমা পেরিয়ে অনেক দূর চলে যায়। এই মেয়েটাকে কিছু বলাও যায় না। রাগারাগি করলে মন খারাপ করে ফেলে। কী যে মুশকিল!
– তুই যে হঠাৎ করে চলে এলি আমাকে একবার জানাবি তো ?
নাফিসের কণ্ঠে বিরক্তি।
– জানালে কী করতিস? তোর হবু বউয়ের পারমিশন নিতিস ? তোকে খুব মিস করছিলাম সোনা । খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তোকে ।
সিমির কথায় আমল দেয় না নাফিস।এমনি এলেবেলে কথা সিমি প্রায়ই বলে থাকে। পাত্তা না দিলেই হলো । প্রসঙ্গ ঘুরাবার জন্য নাফিস বলল,
– তুই যে এলি এখন রাতে কোথায় থাকবি ?
– কেন ? তোর বিছানায়।
আহ্লাদি কণ্ঠে ঘাড় কাত করে সিমি।
– ইউ মাস্ট বি জোকিং !
– আই অ্যাম নট। তোর বিছানায় ঘুমাতে কী যে লোভ আমার, নাফিস!
– ইউ আর ক্রেজি !
– ইয়েস। তোর জন্য নাফিস। ভার্সিটি জীবনের দিনগুলো থেকেই তো । কোথা থেকে সেঁজুতি এসে তোকে কেড়ে নিয়ে গেল।
– ধ্যাৎ! কী যে যা তা বলিস সিমি।
নাফিস এবার সত্যি সত্যি বিরক্তি প্রকাশ করে। নাফিস ওর টেবিলে বসে কী একটা নোট করছিল। সিমি হঠাৎ নাফিসের চেয়ারের হাতলে গিয়ে বসে পড়ে। নাফিসের কাঁধে হাত রেখে ঘাড় কাত করে আদুরে গলায় বলে-
– এত মনোযোগ দিয়ে কী করছিস, হ্যাঁ ?
– সোফায় গিয়ে বোস সিমি।
আমাকে একটু পড়াশোনা করতে দে প্লিজ।
– সেমিষ্টার শেষ । এখন আবার কিসের এত পড়ালেখা তোর ? সেই দুপুরে এসেছি। একটু ভালো করে কথাও বলছিস না। ভালো না লাগলে বল ? চলে যাই। সিমির কন্ঠে অভিমান ঝড়ে পড়ে।
নাফিস হেসে ঘুরে বসে।
– আমার অবস্থা খুব ভালোনারে সিমি। স্কলারশিপটা যায় যায়। সেমিষ্টারের রেজাল্ট ভালো হয়নি। আমার কিউমুলেটিভ জিপিএ নট এনাফ টু কিপ দ্য স্কলারশিপ। প্রফেসরের হাতে পায়ে ধরে একটা সাপ্লিমেন্টারি এক্জাম পেয়েছি। একটা ‘এ’ না পেলে ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। সটান স্ট্যানফোর্ড থেকে সদর ঘাট।
– রিলাক্স নাফিস। কিসসু হবেনা তোর লক্ষ্মী!
নাফিসের চুলের মুঠি নেড়ে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসে পড়ে সিমি। আঙুলের চিরুনীতে অবাধ্য চুলের গোছায় আঁচড় বুলায়। শার্টের বোতামে অকারণে খেলা করে নিশপিশে হাতের আঙুল। হচ্ছে না। চালে ভুল হচ্ছে নাকি ? তাস চলে যাচ্ছে একটার পর একটা। দান মিলছে না একটাও। সিমি ভাবছে নাফিসগামী ট্রেন জার্নি কি তোমার বেপথু হলো মেয়ে ? খেলা কি তোমার এখানেই থুবড়ে পড়বে সিমি সিরহান? হাতের কার্ড তো প্রায় সবই খেলে দিয়েছো। সিমির ঠোঁটের ভাঁজে ঢেউ তোলে দোল খেয়ে যায় ঊর্বশী হাসি। এবার অবলীলায় ঢেলে দাও শেষের তুরুপের তাস। এক্ষুণি ! হ্যান্ডব্যাগ থেকে প্রসাধনী বের করে নাফিসের ড্রেসিং টেবিলে সাজতে বসে সিমি।
– এ সময় সাজুগুজু কেন রে ? বেরোবি নাকি কোথাও ? ক্যাজুয়ালি জানতে চায় নাফিস ।
– তোর জন্যই তো সাজছি। দেখবি না আমাকে সাজলে কেমন লাগে?
কোন কথা না বলে নিজের কাজে মন দেয় নাফিস।
তিল তিল করে নিজেকে সাজায় সিমি। তারপর একটু একটু করে শরীরের সব আবরণ খুলে ফেলে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ঢেউ তুলে ভেসে ওঠে অবারিত সিমি সিরহান।
– নপুংসক তো নোস্ তুই। তাকিয়ে দ্যাখ্ ভীরু কোথাকার।
চকিতে মুখ ফেরায় নাফিস। বিস্মিত বিস্ফারিত চোখ। ফেরাতে গিয়েও চোখ ফেরাতে পারেনা। নাফিসের চোখ কি মুগ্ধতায় ভরে ওঠছে ? গলছে পুরুষ ? কামড়ে ধরা ঠোঁটের ভাঁজে ঝকমকে হাসি ঢালে সিমি। ব্যাগ্র আমন্ত্রনের দুই হাত মেলে ধরে সামনে।
– অল ইয়োর্স, নাফিস। নিবি না ?
উঠে দাঁড়ায় নাফিস! ধীর পায়ে এগোতে থাকে সিমির দিকে। প্রবল ব্যাগ্রতায় সিমিও।
নাফিসের ডর্মিটারীর সিঁড়ি ভেঙে দোতালায় উঠে যাচ্ছিল সেঁজুতি। করিডর দিয়ে একটি পরিচিত মেয়ে হেঁটে আসছিল। সেঁজুতিকে দেখে বলে,
– নাফিসের কাছে এসেছো তো ? এখন যেয়ো না ওর ঘরে। গার্লফ্রেন্ড আছে।
– মেয়েটিকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত নাফিসের রুমের দিকে এগিয়ে যায় সেঁজুতি।
নাফিসের ঘরের দরজা ভেজানো। প্রথমে ভাবল নক করবে। পরে কী ভেবে দরজা ফাঁক করে ভেতরে তাকায় ।
অস্ফুটে শিউরে ওঠে সেঁজুতি। সেঁজুতির হবু বর নাফিস নওয়াজ পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে নিবিড় প্রসাধন চর্চিতা নিরাভরণ সিমি সিরহানের দিকে। প্রবল ব্যাগ্রতায় সিমিও।
ডর্মিটারীর লম্বা করিডর দিয়ে দৌঁড়াতে থাকে সেঁজুতি। পরিচিত মেয়েটি করিডরে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সেঁজুতিকেই দেখছিল। পাশ দিয়ে যেতে হেসে বলে-
– বললাম না নাফিসের ঘরে ওর গার্লফ্রেন্ড আছে ?
মেয়েটিকে কিছু না বলে দ্রুত সিঁড়ি ভাঙতে থাকে সেঁজুতি। হাত ব্যাগটি বুকে চেপে পাগলের মতো দৌড়াতে থাকে বাস স্ট্যান্ডের দিকে। নিজের ডর্মিটরীতে ফিরেই বাবাকে ফোন করে সেঁজুতি।
– আব্বু !
– সেঁজু ! কেমন আছিস মামনি ?
আব্বুর চিরদিনের আদর ঢালা সম্বোধন। সেঁজুতির টেলিফোন পেলেই বাচ্চা ছেলের মতো খুশি হয়ে ওঠেন।
– ভালো আছি আব্বু। তুমি কেমন আছো ? চেষ্টা করেও লুকানো গেল না। গলা কেঁপে গেল সেঁজুতির। গলার কাছে আটকে থাকা কান্নার দলাটাকে সরানো যাচ্ছিল না কিছুতেই।
বাবার মন। মেয়ের কন্ঠ শুনেই আঁচ করে ফেলেছেন সিরিয়াস কিছু একটা হয়েছে। একটু চুপ থেকে বললেন-
– ইজ এনিথিং রং সেঁজু ?
– নো পাপ্পা !
আর রেসিস্ট করা হলো না। ডুকরে কেঁদে উঠল সেঁজুতি।
– নাফিসের সাথে ঝগড়া করেছিস ?
– ডোন্ট টক অ্যাবাউট হিম আব্বু!
– কী হয়েছে বলবি তো ?
এসে সব বলবো আব্বু। আমি ঢাকায় চলে আসছি।
ঢাকায় চলে আসবি ? তোর না সামারে কী কী কোর্স করার কথা ?
সেঁজুতি চুপ করে রইল।
বাবা বুঝে নিলেন মেয়ে তার কিছু একটা মানসিক ক্রাইসিসে রয়েছে। নাফিসের সাথে মারাত্মক কিছু একটা ঘটেছে। এখন চলে আসুক সেঁজুতি। সামারের পরে নাহয় আবার ফিরে যাবে। এর মধ্যে নাফিসের সাথে কথা বলে নেবে। স্নেহার্দ্র কন্ঠে বললেন,
– তাই কর মা। তুই আমার কাছেই চলে আয়।
মোবাইল বেজে চলেছে অনেকক্ষণ। দু’বার বেজে থেমে গিয়ে আবার বাজছে। সেঁজুতির ইচ্ছে হচ্ছিলনা ফোন নিতে। আরেকবার বেজে উঠতেই দেখলো সিমির নাম্বার। প্রথমে ভাবল কল নেবে না। তারপর ভাবল ওই কুকুরীটার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর তো কিছু নেই। ফোন তুললো।
– হ্যালো।
– কী করছিস লো সেঁজু ডার্লিং ? তোর তো এখন শোক দিবস চলছে, তাই না?
– ফোন করেছিস কেন ?
ওমা! সুখবরটা দেবোনা তোকে? নষ্ট করে দিয়েছি তোর নাফিসকে। চেটেপুটে এঁটো করে দিয়েছি তোর সাধের হবু বরকে। এবার তুই বসে বসে সিমি সিরহানের এঁটো ঘাটিস।
– তুই একটা বেশ্যা ! সেঁজুতি ফেটে পড়ল।
– আর তোর নাফিস কী ,হ্যাঁ। পিম্প ? হা হা হি হি হাসির মিলিত শব্দ ভেসে এলো। একটা সিমি অন্যটা গুলবদনীর।
– লাইন কেটে দিলো সেঁজুতি।
বোস্টন এয়ারপোর্টের রানওয়ে দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে বিশাল বিমান পাখা মেলল আকাশে। জানালায় চোখ রাখতেই দু’চোখ জুড়িয়ে গেল সেঁজুতির। শুভ্র বরফে ঢেকে গেছে নিচের পৃথিবী। যত দূর চোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ। আদিগন্ত প্রসারিত বরফের চাতাল জুড়ে সোনা রোদের ঝিকিমিকি।। সেঁজুতি ভাবল তাই তো! এই শুভ্র বরফের নিচেই না চাপা পরে আছে শত শতাব্দীর কালিমা ! বিক্ষত ভূপৃষ্ঠের কত না ফাঁক ফোকরের শূন্যতা যতনে আড়াল করেছে এই মহান শুভ্র বরফ। ঠিক এই ভাবে। হ্যাঁ। ঠিক এই বরফের মতোই ঢেকে দিতে হবে সব দুর্বহ কষ্টের পাহাড়। সব দুঃসহ ব্যর্থতা। আর তার সাথে নাফিস নামের এক কলুষিত আবর্জনাকে তো বটেই। বাইরে থেকে পৃথিবী দেখবে সেঁজুতি বিনতে রহমানকে। ঠিক যেন এই অমলিন বরফরাজির মতোই এক অমল ধরল ঝিলিমিলি।
(এই গল্পটি ছিল আর একটি গল্পের সিকুয়েল। গল্পটির নাম ছিল “জলকেলি”।ভাবছি, “সেঁজুতি সিনড্রোম” এরও একটি সিকুয়েল লিখবো। সেঁজুতি আর নাফিসকে মিলিয়ে দিতে হবে তো! তার আগে পড়ে নিন এই গল্পের প্রথম উপাখ্যান “জলকেলি” যা আগামীতে প্রকাশিতব্য।)