সুবাসী (Subasi)
ধরে নিতে পারো, আমি একটি কবিতা লিখতে বসেছি। যদিও, ভাষার আমার সেই তীব্রতা নেই, অনুভূতির সেই অরূপ রূপের সঙ্গে আমার অবচেতন মনের কখনও মিলন হয়নি।
ভাবছিলাম, কী নাম দেব এই কবিতার। শূন্য বাগানের কান্না? না, কান্নার ব্যাপারটা কেমন আমার অগোচরেই থেকে গেছে, ওটা আসলে আমাকে কল্পনা করে নিতে হচ্ছে। সুতরাং, কল্পনাটা থাক, কবিতাটাই লিখি।
কান্নাটা যদি তবু কোনও ফাঁকে শোনা যায়, তবে আমার কবিখ্যাতির মার নেই।
আসলে, শূন্য বাগানের বেদনা কিংবা কান্না কথাগুলি কোথায় পড়েছিলাম, নয়তো শুনেছিলাম। সে জন্যে অসঙ্কোচে বলে ফেলেছি কথাটি।
যাক সে সব কথা।
বাসা ছিল আমার, মফস্বলের সেই গ্রামটার বাগদিপাড়ার মুখে। ধরো, পাড়াটা লম্বা পুবে-পশ্চিমে। আমি ছিলাম পশ্চিম মুখে, যেখান থেকে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা পাড়াটার নাম সদগোপপাড়া। মনে হচ্ছে, পুব থেকে পশ্চিমে এসে একটু যেন জাতে ওঠা যাচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা খুবই গণ্ডগোলে। বাগদিপাড়ায় আসলে বাগদি আছে সাতঘর। বাকি সবাই যশোরের কুণ্ডু থেকে কোটালিপাড়া সমাজের ভটচায পর্যন্ত। আর সদগোপপাড়াটাও তাই।
সুতরাং, আমি দুটি জাতের পাড়ার মাঝখানে ছিলাম না সজাত অজাতের সাক্ষী হয়ে। আর দশজনের মতো, নিতান্ত এক বাসাড়ে। তবে দুটি রাস্তার মাঝখানে থেকে আমার সঙ্গে আত্মীয়তা হয়েছিল দুটি পাড়ার সঙ্গেই। কাজের মধ্যে সারাদিন বাড়ি বসে থাকা আর পুলিশের লোক এলে জানান দেওয়া, আমি এখনও মৃত্যুবাণ নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাইনি। কেন না, দিনে একবার অন্তত সে সময়টা, পুলিশের লোক আসত। সরকার বিরোধী ব্যাপারে আমি কতদূর এগিয়েছি, জানতে।
যাক, সে সবও আলাদা কথা। যদিও পুলিশের কাছে তা আলাদা ছিল না। যে ঘরটায় বসে থাকতাম সারাদিন, সেটা ছিল রাস্তার দিকে দরজা। বলা বাহুল্য, দরজাটা বাগদিপাড়ার মুখে যে যাবে ওই রাস্তা দিয়ে, তার সঙ্গে একবার চোখাচোখি, একটু হাসি, কিংবা দুটি কথা এ সব হবেই।
বুড়ো গোপাল বাগদি। গাছে উঠে নারকেল পাড়া আর গাছ ঝাড়ানোটাই ওর পেশা। বুড়ো যদি দেখত, বসে আছি গালে হাত দিয়ে, তবে অসঙ্কোচে ঘরে ঢুকে, গাল থেকে হাতখানি নামিয়ে দিয়ে চলে যেত। বাইরে গিয়ে বলত, কদ্দিন বারণ করিচি অমনটি করোনি বাপু, তা ছেলের দেখছি কথা কানে যায় না ওকী, ছিঃ! ওটা অলক্ষণ যে।
বলে চলে যেত। এ আত্মীয়তাটুকু ছিল আমার গোটা পাড়া, গোটা প্রায় পুরো গ্রামটির সঙ্গেই। বামুন, কায়েত, বদ্যি, জেলে, মালো, বাগদি, মুচি সব মিলিয়ে ছিল প্রায় শদেড়েক ঘরের বাস। এখন সেখানে হাজার ঘরের বাস হয়েছে পূর্ববঙ্গের লোক নিয়ে।
আমি অনেকদিনের বাসাড়ে। সম্পর্কটা হয়েছিল অনেকের সঙ্গে।
বিলে ঘরামির দিদিমা এসে বলত, নাওগো ছেলে, তোমার জন্যে আজ একপো দুধ এনেছি।
তারপর বাড়িয়ে দিত একখানি ফুলস্ক্যাপ কাগজ। নাতি বিলে থাকে চন্দননগরে, বাড়ি আসে না। কিন্তু দিদিমার সপ্তাহে একটি করে চিঠি দেওয়া চাই। এ-ও আজ নাগাড় তিন বছরের ঘটনা।
দশ সপ্তাহের চিঠির পরে, একপো দুধ আসে। সেটুকুও নির্জলা নয়। কিন্তু, ওটুকুও বুড়িকে দিতে হয়েছে কোনও খদ্দেরকে না দিয়ে। ওটুকু ওর ভরণ-পোষণের একমাত্র মূলধন। যদি দুধ না নিতে চাই, তবে কান্নাকাটি শুধু বাড়াবে না। বুড়ি হলপ করে বলবে, তার এ সব নেকাপড়া জানা গুণধর ছেলেকে সে জল মিশিয়ে দুধ দেয়নি। আর চিঠির বক্তব্য যদি লিখতে যাই, সে আর এক কাহিনী। সেটা এখন মুলতুবি রাখলাম।
আর একজনকে আমার চিঠি লিখে দিতে হত। তিনি ছিলেন এক ব্রাহ্মণ ঘরের বিধবা যুবতী। এখানে থাকেন দেওরের কাছে। দেওরটি চটকলের ডিপার্টমেন্ট ক্লার্ক। মেয়েটি দেখতে ভাল, শুনতেও ভাল। কোনও দুর্নাম তো ছিলই না, মুখের কথাগুলি শোনাত করুণ আর মিষ্টি। বাপের বাড়ি বরিশালে। সেখানে চিঠি লেখবার জন্যে আমার কাছে আসতেন। লেখাপড়া নিজে জানেন না একেবারেই। দেওরের প্রতিও মন প্রসন্ন ছিল না। আর প্রতিটি চিঠির মধ্যেই একটি ভীষণ আকুতি থাকত, আমাকে এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি পারো, নিয়ে যাও। নইলে আমাকে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে হবে।
চিঠিতে এই সব কথা লিখে দিতে গিয়ে স্বভাবতই আমি বলতাম, সত্যি আপনার তো বড় মুশকিল। সে রকম যদি বোঝেন, আপনার দেওর তো আপনাকে পৌঁছে দিতে পারেন।
বলতেন, দেবে না।
আমি, কেন?
বলতেন, কী জানি! ঠাকুরপো বলে, কে আমাকে রেঁধেবেড়ে খাওয়াবে।
সহসা একটি অসহায় মেয়ের দারুণ ভয়াবহ ও অপমানকর জীবনের ছবি ভেসে উঠত আমার চোখে। কিন্তু তিনি যদি এর বেশি আমাকে কিছু না বলেন, আমার বলাও সাজে না। সুতরাং নীরব থাকতে হত। অথচ, ওঁর দেওরকে দেখে যে খুব সাংঘাতিক একটা কিছু মনে হত, তা নয়। আর সত্যি, বউদি থাকতে কেনই বা সে হোটেলে-মেসে খেতে যাবে।
অবশ্য যদি, এর মধ্যে আর কোনও অন্ধকার কাহিনী না থেকে থাকে।
যাক সে সব কথা। এ-ও আমার বিষয়বস্তু নয়।
একদিন সকালবেলা ঘরে বসে, একটি তীব্র কান্নার চিৎকার শুনতে পেলাম। কোনও মেয়ে গলার কান্না। বাগদিপাড়া থেকে শোনা গেল।
রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল কেতু মুচি। জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কী? কাঁদে কে?
দুলালের বউ।
দুলালের বউ? হা। দুলালটা যে মল এখুনি।
ছোকরা মিস্তিরি দুলাল। এই তো সেদিন বিয়ে করেছে। এক বছরও হয়নি। জানতাম অবশ্য অসুখ করেছে। কিন্তু একেবারে মৃত্যু, ভাবতে পারিনি। এই তো সেদিন চন্দননগর থেকে বিয়ে করে নিয়ে এল। ভারী ভাব ছিল তার আমার সঙ্গে। যেমন ছিল কাজে দড়ো, তেমনি পারত হাসতে। বড় হেঁকোডেকো ছিল।
কারখানায় কাজ করাকে ও বলত কল ঠ্যাঙানো। আট ঘণ্টা কল ঠেঙিয়ে এসেও, দুলালকে দেখছি গাছে উঠে ডাব পেড়ে খেতে, চিৎকার করে গান করতে, পুকুরে মাতামাতি করতে। পাড়াটার বুড়ো-জোয়ান, সবাই মনে মনে ওকে একটু হিংসেই করত। একজন ছাড়া, সে দুলালেরই বন্ধু বিপিন। কারখানায় দুলালের বয় অর্থাৎ হেপার হিসাবে কাজ করত। বয়সে প্রায় সমান সমান, দুজনের ভারী বন্ধুত্ব!
দুলাল বলত, কথা শুনে মনে হয়, দাদাবাবু তোমরা আমার জন্যে লড়ো।
শুনে আমার মনের মধ্যে উঠত কেঁপে। বলতাম, ছিঃ ছিঃ দুলাল , কেউ কারওর জন্য লড়ে না ভাই। আমরা সবাই লড়ি নিজেদের জন্যে। যে শুধু পরের জন্যে লড়ে আর লড়িয়ে হয়, তেমন বীরদের আমার বড় ভয় হয়।
আরও নানান কথা বলত। সে সবও থাক। পাড়া ছেড়ে গ্রামে, দুলালকে চিনত সবাই। ও যে সব কিছুতেই আগে বেড়ে আছে।
কিন্তু সেই দুলাল, এই কদিনের অসুখে মারা গেল। সেই কালো কুচকুচে মুখ, এক মাথা কালো কোঁচকানো চুল, আর এক মুখ শাদা ঝকঝকে হাসি।
বিয়ে করে কতদিন বউ নিয়ে গেছে এখান দিয়ে। সে তখন নতুন বউ। আমি বসে কী লিখছিলাম। হঠাৎ দুলালের খ্যাঁকানি শুনলাম, আয় না। আহা হা, তোর আবার বেশি লজ্জা। জানিস আমাদের কত আপন মানুষ।
অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। কত আর বয়স হবে। বছর যোলো সতেরো। ওদের ঘরে একটু বেশি বয়স বইকী। বললাম, কী দুলাল?
এই দেখো না, বলছি, তোমাকে একটা পেন্নাম করে যাক, তা লজ্জায় বাঁচছেন না। সাধে আর মেয়েমানুষের উপরে মেজাজ বিগড়ে যায়।
ছিঃ ছিঃ, বোধ হয় দশদিনও বিয়ে হয়নি। এর মধ্যেই কী রকম করছে দুলালটা। বললাম, কেন তুমি ওকে শুধু শুধু ধমকাচ্ছ। যাও, নমস্কার করতে হবে না
আমার কথা শেষ হবার আগেই, একরাশ শস্তা সিলকের শাড়ি আমার পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ল।
সময়ও পেলাম না বাধা দেবার। দেখলাম একটি পুষ্টবলিষ্ঠ দীর্ঘাঙ্গী কালো মেয়ের মুখ দেখা যাচ্ছে ঘোমটার আড়ালে। এমনকী লজ্জাচকিত দুটি বড় বড় চোখও। দুলাল হাতের সিগারেটটি নিয়ে যে কী করবে আমার সামনে, ভেবেই পাচ্ছে না। বিড়ি ও হরদম-ই খায় আমার সামনে। সিগারেট কিনা! সিগারেট খাওয়ার মতো করেই, লজ্জিত হেসে (দুলালের আবার লজ্জা, সে যে কী অদ্ভুত) বলল, একটু বাইস্কোপে যাচ্ছি দাদাবাবু।
এ রকম কয়েকবারই যেতে দেখেছি। বায়স্কোপে, সাকাসে, মেলায়, সব বিশেষ বিশেষ ব্যাপারে।
পাড়ার মেয়েরা (রিপোর্ট পেতাম বেশি বিলে ঘরামির দিদিমার কাছেই) বলত, দুলাল নাকি বেহায়ার মতো বউয়ের সোহাগ করে। কারওর কি বউ নেই ঘরে, না, সোহাগ করে না বউ নিয়ে। দুজনের পিরিতের জ্বালায় নাকি গোটা পাড়াটার গায়ে বিছুটির ছপটি পড়ছে। হাসাহাসি, ঢলাঢলি, ছি! আর কী বউ বাবা! সোয়ামি না হয় একটু বেয়াড়া, তুই কী বলে পাল্লা দিস ওই মিনসের সঙ্গে। যে মিনসের নাম পাড়া ফাটানে দুলাল!
কেন জানিনে, দুলালের উপর ছিল আমার একটু পক্ষপাতিত্ব। মনে হত, প্রথম যৌবনের উচ্ছাসটাই তো হবে একটু বেহিসেবি। সেটুকু যেমন না হলে নয়, পাড়ার এই কলঙ্ক রটনাটুকুও পড়ে গিয়ে যেন ওই বেহিসেবি রসের মধ্যেই। এটা ওটা দুটোই হবে, হয়তো হতেই থাকবে। বিশ বছর বাদে স্বয়ং দুলালই বলবে কোনও পাড়ার ছেলেকে, ছোঁড়া বড় বেয়াড়া।
সেই দুলাল হঠাৎ মারা গেল। বেচারির মা বাবাও নেই। মা মারা গেছে বিয়ের বছর তিনেক আগে।
জামাটি গায়ে চাপিয়ে গেলাম। সেই মাটির দেয়াল, খোলার চাল। জানালাহীন সুড়ঙের মতো অন্ধকার ঘর। দরজার সামনে দুলাল। সেই মুখ, সেই চুল, তেমনি ঋজু শরীরটি। বুকে মুখ দিয়ে পড়ে আছে বউ সুবাসী। সেই ঘোমটা নেই, লজ্জা নেই। আঠারো বছরের মেয়েটা, কালো চুল এলিয়ে মাথা কুটছে দুলালের শক্ত কালো বুকে। পাড়ার মেয়েমানুষেরাও এসেছে সবাই। বোধহয় অনেকেই ভাবছিল, তাদেরই শাপমন্যিতে জলজ্যান্ত ছেলেটার এ রকম হল কিনা।
সুবাসী একবার আমার দিকে ফিরে তাকাল। তারপর দুলালের থুতনিটি নেড়ে বলল, শুনছ, ওগো, তোমার সেই দাদাবাবু এয়েছেন।
মনে হল, আমার বুকের ভিতরে একটা ফানুস ফুলতে লাগল ফাটবার জন্যে। সুবাসী তেমনি করেই বলল, এবার তুমি কার সামনে দিয়ে আমায় নে যাবে, আর বলবে, আমাদের দাদাবাবু, বউ পেন্নাম কর।
তারপর চিৎকার করে উঠল, আমি আর কলের বাঁশি শুনব না গো!
কলের বাঁশি! ওই বাঁশি দুলালকে ডেকে নিয়ে যেত, আবার দিয়ে যেত ফিরিয়ে। সত্যি, আর ও সেই বাঁশি শুনবে কেমন করে।
জামরুল তলায় বিপিনকে বললাম, কী হয়েছিল বিপিন।
বন্ধুর শোকে ওর স্বর ফুটছে না। বলল, কী জানি, বুঝলাম না দাদাবাবু। তিনদিন ধরে বলল খালি বুকে ব্যথা। কাল রাত্রে ডাক্তারবাবু এসে বললেন, বুঝতে পারছিনে। বুকের একটা ফটো তুলাতে হবে। তারপরে, রাত না পোহাতেই, এই।
আশ্চর্য! দুলালের মতো শক্ত ছেলের এমন মৃত্যু।
হঠাৎ বিপিন বলল, কিন্তু দাদাবাবু, এদিকে যে কিছুই নেই।
কিছুই নেই মানে?
পোড়াবার টাকাও নেই।
সে কী?
ওই, বলে কে। বউ বলছে, কার কাছে টাকা রেখে দিত। শচারেক নাকি ছিল। মরবার আগে বলে যেতে পারেনি। কোনওদিন কাউকে বলেওনি।
ভয়ে এতটুকু হয়ে গেলাম। তবে, এই মেয়েটার কী হবে।
যাক, সে সব পরের ভাবনা। পাড়ায় সবাই মিলে কিছু টাকা সংগ্রহ করা গেল। তারপর শোনা গেল, দুলাল বাগদি নয়, হাঁড়ি।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত শ্মশান যাত্রা আটকাল না। ইতিমধ্যে চন্দননগর থেকে এসেছে সুবাসীর এক পিসি। শ্মশানেও গিয়েছিলাম। সেখানেই পিসির কান্নার মধ্যে শুনতে পেলাম।
এই ভরা বয়সে আমার এ কী হল গো। আমি এখন কত খাব, পরব, দেখব
আমি’র এই প্রথম পুরুষ আসলে ভাইঝি সুবাসী। দেখলাম, সুবাসী চিৎকার করে কেঁদে উঠে, আঘাত করতে উদ্যত হয়েছে পিসিকে। রাক্ষুসী, যা তুই আমার সামনে থেকে। যা…!
গতিক দেখে সত্যি পিসি সরে গেল।
ফোলা ফোলা লালচোখ সুবাসীর। পিঠময় ছড়ানো চুল। ওর এত অসহায় কান্নার চারপাশেও যেন কী এক দুর্দৈব আসছে ঘিরে। তাই আগুন জ্বলছে ধিকিধিকি, সুবাসীর জলে ভেজা চোখে।
ব্যাপারটা তখনও বুঝিনি পরিষ্কার। চিতার জলে সব সাঙ্গ হল। সুবাসী সিঁদুর মুছে থান পরল। পরে যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল চিতাটার দিকে।
তারপর বাড়ি ফেরার সময়, পিসি বলে উঠল, আর ওপাড়ার দিকে যাওয়া কেন? গঙ্গা পার হয়ে ওপারেই চল। এপারে আর তোর কে আছে?
বটতলাটিতে দাঁড়িয়ে, আঠারো বছরের সদ্য বিধবা সুবাসী বলল, পিসি, পিসেকে নিয়ে কত বছর ঘর করেছিলি, তবু কি তুই বুঝিসনি? না বুঝেছিস তো পালা, নইলে মুখ বুজে সঙ্গে চল। থাকবি আমার সঙ্গে, যেমন করে হোক তোকে দুটো খাওয়াব।
এই জলে ভেজা কথাগুলির মধ্যে কী এক অসাধারণ তীক্ষ্ণতা ছিল। পিসি তো দূরের কথা, সুবাসীকে নতুন করে দেখলাম আমি। দেখলাম, নতুন করে দুলালের সেই হেঁকোডেকো ভালবাসা।
এবার আমাকে বললে সুবাসী, দাদাবাবু, পেটভাতায় একটা কাজ জোগাড় করে দাও, আর মাস গেলে দশটা টাকা। ঘরভাড়া, পিসি, সবই তো আছে।
কিছুদিন বাদে, কাজ হল। এক জায়গায় নয়, তিনটি বাড়িতে ঠিকা কাজ। মাস গেলে গোটা তিরিশ পাবে।
দুলালের মৃত্যুর পর, সেই বিধবা মহিলা চিঠি লেখাতে এসে, প্রথমেই বললেন, আপনি অনেক করলেন মেয়েটির জন্যে। আহা! ওইটুকু মেয়ে।
উনিও অবশ্য সুবাসিনীর চেয়ে খুব বেশি বড় হবেন না। যাই হোক, পরমুহূর্তেই বললেন, লিখে দিন, ছিচরণেষু, বাবা, বুঝলাম, আমার মা-বাপ নেই, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। এই দেওরও ততদিন আছে, যতদিন বিয়ে না হয়। বিয়ে হলে তখন আমাকে দূর দূর করবে। আমার এই জন্মের সাধ-আহ্লাদ সবই ফুরিয়েছে। বাকি আছে পরের লাথি-ঝাঁটা খাওয়া ইত্যাদি।
আমার হৃদয় ও মন বলে কিছু আছে কিনা জানিনে। কথাগুলি লিখে দেওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করবার ছিল না।
রোজ, দুবেলা দেখি, সুবাসী যায় আসে আমার সামনে দিয়ে। সাদা থান পরে, ঘোমটা দিয়ে, মাথাটি একদিকে হেলিয়ে। এখন আর মুখ ঢাকে না ঘোমটায়।
পৌষের শীতে মারা গেল দুলাল। এখন বাতাস বইছে রোজ। ন্যাড়া গাছগুলি ভরে উঠছে কচি পাতায়। রোজ একটু একটু করে ছেয়ে যাচ্ছে সবুজে। পাখিপাখালিরা শীতের আড়ষ্ট ডানা খুটে খুটে পুরনো পালক ঝাড়ছে।
আর দিনে দিনে কৃশ হচ্ছে সুবাসী। ও যে মাথা নিচু করে যায়, তবু বুঝতে পারি, একবার ওর মধ্যেই আড়চোখে তাকিয়ে যায় আমার দিকে। মুখটি রোগা হয়ে গেছে, চুলগুলি হয়েছে শননুড়ি। সারা মুখের মধ্যে চোখ দুটি যেন ভরে আছে সবটা। হঠাৎ দেখলে আর বয়স বোঝা যায় না।
রোজই শুনি ঝগড়া হয় পিসির সঙ্গে। পিসি বলে, কেন মরবি এমনি করে? সোমসারে কি ছেলে নেই। কত জনায় হাত বাড়িয়ে আছে পাবার জন্যে।
প্রথম প্রথম মারতে গেছে সুবাসী পিসিকে ধরে। তারপর গাল দিয়েছে পিসি, তোর মরণ আছে আমার হাতে।
পিসি বলেছে, তাই মার তবু তোর এই মরণ আমি দেখতে পারিনে আর। এখন আর কিছুই বলে না সুবাসী।
তখন একদিন সেই বিধবা মহিলা আমাকে বলেছিলেন, জানেন, সুবাসীর পিসি বেটি অসতের শিরোমণি। অমন মেয়েটির মাথা খেতে চাইছে।
আমার যেন মনে হত, সুবাসী যখন যায় আমার সামনে দিয়ে, ওর চলার মধ্য দিয়ে যেন বলে যেত আমাকে, দেখছ তো দাদাবাবু, কেমন করে পেছন লেগেছে সব। ওরা জানে না, কার বিধবার সঙ্গে এমনি করছে। তুমি তো জানো সেই লোককে।
সত্যি, একলা পিসি নয়, অনেকেই লেগেছে ওর পিছনে। সুবাসীর যৌবন, শ্রী, সবই চোখে পড়বার মতো। কিন্তু সে সবই যে ছিল ওর দুলালের জন্যে।
তবু ওর ওপর যে লোকের টান, তার সবটুকুই আমার কাছে দোষের বলে মনে হয়নি। কিন্তু সুবাসীর মনের কথা মনে হলে, নির্বাক বেদনায় আমাকে শুধু চেয়ে থাকতে হত।
সুবাসী যে এখনও সেই ঘরেই থাকে। আজও শোনে সেই বাঁশি। বোধ হয় ওই বাঁশি শুনেই ও এখন লোকের বাড়ি যায় কাজ করতে।
বিলে ঘরামির দিদিমা একদিন এসে বলে গেল, বাবাগো বাবা, দুলালটা মরেও বউটাকে ছেড়ে যায়নি।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
বিলের দিদিমা ফিসফিস করে বলল, আতু ভট্টচাযের বিবা মেয়েটা কাল রাত্রে পেট খসিয়েছে, তাই নিয়ে এখন থানা পুলিশ হচ্ছে, আর সুবাসীটা শুকিয়ে মরছে দুলালের জন্যে। বলে, দুলালকে নাকি দেখতে পায়। এও আবার ভাল নয় বাপু।
কীসে যে সুবাসীর ভাল, সেটাই আবিষ্কারের জন্য গোটা পাড়ার সবাই ভাবছে।
কিন্তু সুবাসী কী ভাবছে, কেউ জানে না। আতু ভট্টচাযের মেয়ের সঙ্গে যে তুলনা হয়েছে, তার কারণ আর কিছু নয়। দেখো, সুবাসী তার চেয়ে কত বড়।
সুবাসী যে ছোট নয়, তা আমি জানতাম। আতু ভট্টচাযের বিধবা মেয়েটার অতবড় পাপের মধ্যেও ব্যথাটুকু তো আমি ভুলতে পারিনে।
একদিন গাল থেকে আমার হাত নামিয়ে দিয়ে, বুড়ো গোপাল বললে, কী ভাবছিলে বলো দিকি।
সত্যি কথাই বললাম, তোমাদের সুবাসীর কথা ভাবছিলাম। একগাল হেসে বলল গোপাল, যে গাছ নারকেল দেয়, তাকেও চোখে পড়ে, যে না দেয়, তাকেও পড়ে। কেন? না, গাছটার হল কী? এমন শুকোচ্ছে কেন? অমনি তদ্বির আরম্ভ হয় গাছের। তোমরা যে সবাই ভাবছ, তা এই জন্যেই।
বললাম, গোপালদাদা, গাছ তো মানুষ নয়।
গোপালের বুড়ো চোখে অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা। বলল, মনের কথা বলছ তো? গাছের বুঝি মন নেই? জুঁইকুঁড়ে সে দাঁইড়ে আছে, শিকড় বাড়িয়ে মাটির রস খেতে তারও মন চায়। নইলে সে গাছ কেন? ওটা যে জীবের ধম্মো। তবে হ্যাঁ, যেমন জীব তার তেমনি পথ।
গোপালবুডোর কথার মধ্যে কী একটা অদৃশ্য সত্য ছিল, যে সত্যটার সামনে আমাদের গোটা জীবনটা বেঢপ বিকৃত মনে হতে লাগল।
.
আবার বছর এসেছে ঘুরে। মাঘ মাস যাচ্ছে। শীতটা পড়েছে মন্দ না। গাছগুলির পাতা গেছে ঝরে। পুকুরের জলে জলে ধরেছে টান। উত্তরায়ণের পথে দিনগুলি বড় হচ্ছে একটু একটু করে।
তিনদিন বাদে ফিরলাম কলকাতা থেকে।
সন্ধ্যাবেলা দেখলাম, সুবাসী এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়।
অবাক হয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, সুবাসীর কৃশ শরীরখানি আবার পুষ্ট হয়েছে। কালো রং হয়েছে চিকন কৃষ্ণ। চুলেও চিরুনি পড়েছে।
কতদিন যেন দেখিনি সুবাসীকে। জিজ্ঞেস করলাম, কী খবর সুবাসী।
এ সেই শোকাচ্ছন্ন বিরহিনী সুবাসী নয়। একটু হেসে মাথা নিচু করে বলল, আপনার সামনে দু দণ্ড আসতে ইচ্ছে করে। নিজের কাজ, আপনারও কাজ, তাই আসতে পারিনি।
বললাম, যখন তোমার ইচ্ছে হয় এসো।
চলে গেল। অবাক হলাম, কষ্টও হল। হয়তো দুলালের কথা শুনতে চাইছিল আমার মুখ থেকে।
আর একদিন দেখলাম, সুবাসীর হাতে কাঁচের চুড়ি। আর একদিন, গলায় দেখলাম, দুলালের দেওয়া রূপোর হারখানি। তারপরে একদিন, পেতলের দুটি টব কানে।
সুবাসীর শ্রী ঢলঢল হয়ে উঠল। কালো রূপসীটির চলায়-ফেরায়ও কেমন একটি বিচিত্র ছন্দ লেগেছে।
যত অবাক হই, তত ভাল লাগে। অথচ মনের মধ্যে একটা ভীষণ অস্বস্তিও বোধ করি।
বছর গেল ঘুরে। বাতাসে শুনি সাগরের গর্জন।
বিপিন এল একদিন। দুলালের হেলপার, সাকরেদ, বন্ধু। বলল, দাদাবাবু, ওস্তাদের মিস্তিরির পোস্টটা আমি পেলাম।
খুশি হয়ে বললাম বটে।
হা। তবে মনটা বড় খারাপ। দুলুদা থাকলে, ওর সবচেয়ে আনন্দ হত। হাতে করে মানুষ করেছে আমাকে।
কিছু না ভেবেই হঠাৎ বলে ফেললাম, ভাল হয়েছে বিপিন। একটি কথা, মাইনে তো বাড়ল?
হ্যাঁ, নতুন তো। এখন সতরো টাকা হপ্তা।
বললাম, যদি অসুবিধা না হয়, দরকার পড়লে, সুবাসীকে তুমি দু এক টাকা মাঝে মধ্যে সাহায্য করো।
বিপিন এক মুহূর্ত চুপ করে কী ভাবল। তারপর হঠাৎ বলল, ওসব সাহায্য-টাহায্য আমি কাউকে করতে পারব না দাদাবাবু, সোজা কথা। ওসব বাবুগিরি আমার নেই।
আমি রীতিমত ক্রুদ্ধ, বিস্ময়ে স্তব্ধ। আর বিপিন কয়েক মুহূর্ত ছটফট করল, কিছু একটা বলবার জন্যে। তারপর চলে গেল।
ভীষণ রাগ হল আমার। ওস্তাদের প্রতি কী ভক্তি, আহাহা। তারপর হঠাৎ সন্দেহ হল, বিপিন বোধ হয় কোনও কারণে সুবাসীর প্রতি ঘৃণা পোষণ করছে। সাম্প্রতিককালের সুবাসীকে দেখে আমারও যে বড় অস্বস্তি কিনা!
দিনে দিনে বদলাচ্ছে সুবাসী। আজকাল যেন লকলক ঢলঢল করছে। সুবাসীর এমন রূপ দুলাল থাকতেও দেখিনি।
হঠাৎ একদিন ছুটির বিকেলে বাগদিপাড়ায় অসম্ভব চিৎকার শুনতে পেলাম। প্রায় মার-দাঙ্গা আর কী।
বিপিনের বাবা কড়ি বাদির গলাটা সবচেয়ে চড়া। বলছে, তোর মতো ছেলেকে আজ কচুকাটা করব রে, কচুকাটা। খবরদার, যদি আর ওকথা মুখে আনবি–
শুনতে পেলাম বিপিনের গলা, মিছিমিছি চেঁচিয়ো না বলে দিচ্ছি। তোমার ঘরে থাকব না। কোম্পানির লাইনে গে বাস করব।
কড়ি চোপ, চোপ শুয়োরের ছেলে, আমাকে পিরিত দেখাতে এসেছ?
মনে হল, ওদিকে সুবাসীর পিসিও মরাকান্না জুড়েছে। হঠাৎ হাসি শুনে চমকে তাকিয়ে দেখলাম, আমার দরজায় গোপালবুড়ো। বলল, কী শুনছ?
জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার গোপালদাদা?
গোপাল হেসে বলল, ওই শুনছ না? গাছের শুকনো ডালপালা ঝাড়াই হচ্ছে, তাই এত শব্দ।
শুকনো ডাল ঝাড়াই হচ্ছে?
হ্যাঁ গো! নতুন ডাল গজাচ্ছে, পাতা বেরুচ্ছে। শুকনোগুলোন ভাঙছে, ছড়াচ্ছে। একটু শব্দাশব্দি, একটু নোংরা তো হবেই।
বলে গোপালবুড়োর কী হাসি। ডায়লেটিকে বলে, আলো থাকলে আঁধার আছে। আমার মন ধাঁধিয়ে গেল সেই আলো আঁধারিতে। বললাম, একটু খুলে বলল গোপালদাদা।
আবার খুলে কী গো। তোমাদের বিপিন আর সুবাসী ঘর বাঁধছে একসঙ্গে।
সহসা যেন প্রচণ্ড চপেটাঘাতে পাংশু হয়ে গেলাম। বিপিন সুবাসী!
গোপাল বলল, কী খারাপ লাগছে?
খারাপ লাগছে কিনা, বুঝছিনে। ভাল লাগছে না।
গোপাল বলল, ঘরের দাওয়া নিকিয়ে রাখো, কেউ কিছু বলবে না। খেত জমিন নিকিয়ে রাখেনা কেন। সে কি তোমার দেখতে ভাল লাগে? না কি ভাল লাগে ঢ্যালা ছড়ানো মাঠ দেখতে। সোমসারের নিয়মে মানুষ গেরো বাঁধে ভালর জন্যে। কিন্তু মন্দও কম হয় না। তখন ফসকা গেরো ছিঁড়ে যায়।
কেন জানিনে, শেষ পর্যন্ত সুবাসী আর বিপিনকে আমি আর আলাদা করে ভাবতে পারিনি। পরে বুঝেছিলাম, কেন বিপিন সাহায্য করতে চায়নি। তখন বোধ হয় সে শূন্য বাগানে ফুল ফোটাচ্ছিল। একজন দাবি করবে আর বিপিন দেবে সঁপে, সাহায্যটা এখানে অপমান বইকী! শূন্য বাগানের কান্নাটা আমি শুনতে পাইনি। আসলে ওটা কান্না তো নয়, হরিতের অভিযান।
কিছুদিন পর। বসে লিখছিলাম। ছুটির দিনের দুপুর। হঠাৎ একটি মিষ্টি ধমক শুনতে পেলাম, আহা, তোকে যেন দেখেনি কোনওদিন দাদাবাবু। আয় না।
তাকিয়ে দেখি বিপিন। পাশে ধবধবে শাদা কালোপাড় শাড়ি কুচিয়ে পরে দাঁড়িয়ে আছে সুবাসী। ঘোমটা তত নেই। পায়ে শ্লিপার।
বলতে যাচ্ছিলাম, থাক না। কিন্তু তার আগেই কালোপাড় শাড়িখানি লুটিয়ে পড়ল পায়ের কাছে।
বড় সঙ্কোচে আর লজ্জায় সরে গিয়ে তাকালাম সুবাসীর দিকে। সুবাসীকে যেন আরও বলিষ্ঠ সুন্দরী মনে হল।
বললাম, কোথায় যাচ্ছ তোমরা।
দেখি, দুজনেই মিটমিট করে হাসছে। বিপিন বলল, বল না। সুবাসী বলল, তুমি বলো।
বিপিন বলল, বুড়ো বয়সে পড়তে যাচ্ছি দুজনে। আমাদের ইউনিয়নে একটা স্কুল হয়েছে, ছুটির দিনে লেখাপড়া শেখায়। তাই যাচ্ছি।
হঠাৎ আজ আবার আমার বুকটা ফুলে উঠল ফানুসের মতো। হ্যাঁ, জলই আসছিল আমার চোখে।
পাশাপাশি চলে গেল দুজনে।
এলেন সেই বিধবা যুবতী ভদ্রমহিলা। হাতে কাগজ, চিঠি লেখাতে এসেছেন। এসেই বললেন ঠোঁট বেঁকিয়ে, দেখছিলাম জানালা থেকে। ছি! কী সাহস বিপিন-সুবাসীর। আবার আপনার কাছে এসেছে। অসভ্য কোথাকার!
তারপর, নিন, লিখে দিন, ছিচরণেষু– মা, আমি আর এ জীবনের ভার সইতে পারিনে।–