রামায়ণ : সুন্দরাকাণ্ড – মৈনাক পর্ব্বত সহ হনুমানের সম্ভাষণ
দেখি মারুতির হেন বীর্য্য বুদ্ধি বল।
প্রশংসা করেন তারে অমর সকল।।
হেনকালে নদীপতি সচিন্তিত মন।
করিছেন হৃদয়েতে এই বিচরণ।।
নগর নৃপতি হতে মোর উপাদান।
এ লাগি সাগর বলি ভুবন আখ্যান।।
সেই ত সগর-বংশে রামের জনম।
সে রাম কার্য্যেতে যান পবন-নন্দন।।
এ লাগি ইহার হিত কর্ত্তব্য আমার।
অন্যথা হইলে নিন্দা লোকেতে অপার।।
লঙ্ঘিছেন হনুমান এই পারাবার।
হইতেছে বড় শ্রম ইহাতে ইহার।।
অতএব মধ্যপথে আলম্বন পাই।
যেরূপেতে সুখে যান, করিব তাহাই।।
এত ভাবি নদীপতি মৈনাক ভূধরে।
ডাকিয়া কহেন কিছু বচন সাদরে।।
হিমালয়-তনয় মৈনাক গিরিরাজ।
করহ তুমিহ মোর আজি এক কাজ।।
শুন শুন শুন হিমালয়ের নন্দন।
এত কাল করিলাম তোমার পালন।।
ইন্দ্রের ভয়েতে মম লইলে শরণ।
লুকাইয়া রাখিয়াছি করিয়া যতন।।
তদুপরি জিরাইবে পবন-নন্দন।
শ্রীরামের সহায়তা কর এইক্ষণ।।
সগর হইতে হয় উৎপত্তি আমার।
জন্ম লয়েছেন রাম বংশেতে তাঁহার।।
সেই রামকার্য্যে যান সমীর-তনয়।
তাঁর হিত কিছু মোরে করিবারে হয়।।
এই লাগি কহি আমি তোহে পৌটি করি।
একবার উঠ তুমি সলিল উপরি।।
ঊর্দ্ধ অধঃ আর চারিপার্শ্বে বাড়িবার।
আছয়ে তোমার শক্তি অনেক প্রকার।।
এই লাগি কহিতেছি তোহে বার বার।
উঠিয়া করহ তুমি মোর উপকার।।
তোমার উপরি শৃঙ্গ দুশত যোজন।
মারুতি বিশ্রাম করি করুন গমন।।
এত শুনি ভাল ভাল বলি গিরিবর।
উঠিলেন সাগরের জলের উপর।।
কিবা সাজে সিন্ধুমাঝে সুবর্ণ-শিখরী।
প্রাতের তপন যেন সমুদ্র-উপরি।।
পথমাঝে দেখি তারে মারুতি চিন্তিত।
একি আসি কোন্ বিঘ্ন হলো উপস্থিত।।
তবে সেই গিরি ধরি মনুষ্য-মূরতি।
নিজ শৃঙ্গে থাকি কন মারুতির প্রতি।।
বায়ুপুত্র শুন কিছু আমার বচন।
সমুদ্র-আদেশে আমি কৈনু আগমন।।
শ্রীরামের পূর্ব্ববংশ নৃপতি সগর।
তিনি খাদ করেছেন এই ত সাগর।।
এই হেতু রামদূত তোহে সম্মানিতে।
পাঠালেন মোরে তেঁহ প্রীতিযুক্ত চিতে।।
তুমিহ আমার শৃঙ্গে করিয়া বিশ্রাম।
খাও দিব্য ফল মূল জল অনুপম।।
পরেতে হইয়া তমি সুখযুক্ত মন।
করিবে রাবণপুর মধ্যেতে গমন।।
আমাকেও না করিবে তুমি শঙ্কা সব।
হই আমি তোমাদের সম্বন্ধে বান্ধব।।
এ লাগিয়ে আসিয়াছি পূজিতে তোমায়।
তুমিহ সফল কর মোর বাসনায়।।
এত শুনি হনুমান থাকিয়া আকাশে।
জিজ্ঞাসা করেন তারে সুমধুর ভাষে।।
কহ কহ কি কারণে তুমি গিরিবর।
বাসা করিয়াছ সিন্ধু-জলের ভিতর।।
কিরূপে বা হও তুমি আমার বান্ধব।
বিবরণ করি কহ কথা এই সব।।
শুনি বাণী মহীধর আনন্দিত হৈয়া।
কহেন পবন-পুত্রে প্রণয় করিয়া।।
পূর্ব্বে যাবতীয় গিরি ছিলা পক্ষবান।
উড়িয়া করিত তারা সর্ব্বত্র পয়ান।।
তবে তাহাদের দুষ্ট বুদ্ধি উপজিল।
পড়িয়া নগর গ্রাম ভাঙ্গিতে লাগিল।।
তাহা দেখি ক্রুদ্ধ হৈয়া সহস্রলোচন।
বজ্রে করি কৈলা পক্ষচ্ছেদ আরম্ভণ।।
সকলের পক্ষচ্ছেদ করি অবশেষে।
বজ্র ধরি ইন্দ্র আইল মোর পার্শ্বদেশে।।
তাহা দেখি ভয়ে আমি করি পলায়ন।
পাছে পাছে চলিলেন সহস্র-লোচন।।
তবে মোরে দেখিয়া কাতর অতিশয়।
করুণাতে আদ্র হৈল বায়ু মহাশয়।।
তিনি অতিশয় বেগ প্রকাশ করিয়া।
ফেলাইলা মোরে এই সমুদ্রে আনিয়া।।
তাঁহার কৃপাতে আর সমুদ্র আশ্রয়ে।
না কাটিলা ইন্দ্র মোর এ পক্ষ উভয়ে।।
সে অবধি আছি আমি সাগর ভিতর।
হিমালয়-পুত্র নাম মৈনাক ভূধর।।
তুমি হও মোর বন্ধু পবন-তনয়।
তোমার সম্মান মোরে করিবারে হয়।।
অতএব মোর আর সিন্ধুর পীরিতে।
তুমিহ বিশ্রাম কর মোর উপরেতে।।
গিরিবাক্য শুনি কন পবন-কুমার।
তোমার দর্শনে দিন সফল আমার।।
তোমার মধুর বাক্যে মন জুড়াইল।
ক্ষুধা তৃষ্ণা ক্লেশ শ্রম নিবৃত্ত হইল।।
করিলে আতিথ্য তুমি দেখাইয়া প্রীত।
তোমাতে বিশ্রাম করা মোর সমুচিত।।
কিন্তু বড় ত্বরা আছে লঙ্কায় যাইতে।
এ লাগি না পারিলাম এক্ষণে থাকিতে।।
আর শুন আসিবার কালে সিন্ধুতটে।
এসেছি প্রতিজ্ঞা করি বান্ধব নিকটে।।
নিরালম্বে পার হব শতেক যোজন।
অতএব যোগ্য নহে বিশ্রাম-করণ।।
অঙ্গুলি মাত্রেতে করি পরশ তোমারে।
দোষ ক্ষমা করি দাও অনুজ্ঞা আমারে।।
এত শুনি সাধু সাধু বলি গিরিবর।
অনুমতি দিল তারে প্রশংসি বিস্তর।।
তবে কর অঙ্গলিতে স্পর্শিয়া ভূধরে।
পরশি পয়াণ কৈলা মারুতি অম্বরে।।
মারুতির আতিথ্যেতে সন্তুষ্ট অন্তর।
মৈনাক ভূধর প্রতি কন পুরন্দর।।
মৈনাক তোমার আজি দেখি এই কর্ম্ম।
পাইলাম মোরা সবে অতিশয় শর্ম্ম।।
রামদূত মারুতির আতিথ্য করিয়া।
ত্রিজগতে করিলে তুমি হে তুষ্ট হিয়া।।
অতএব আমি তোমা দিলাম অভয়।
সুখে থাক তুমি হয়ে নির্ভয় হৃদয়।।