রামায়ণ : সুন্দরাকাণ্ড – অশোকবনে সীতাদেবীর নিকট রাবণের গমন
দ্বিতীয় প্রহর রাত্রে উঠিল রাবণ।
চন্দ্রোদয় হইয়াছে উপর গগন।।
সুশীতল বায়ু বহে অতি মনোহর।
ধবল রজনী দেখি বিচিত্র সুন্দর।।
মধুপানে রাবণ হইয়া কামাতুর।
বলে চল যাই হে সীতার অন্তঃপুর।।
সীতা লাগি যাব আমি অশোকের বনে।
মন্দোদরী রাণী আদি ডাকে রাণীগণে।।
রাবণের আজ্ঞা পেয়ে সাজে রাণীগণ।
বেষ্টিত করিল সবে রাজা দশানন।।
রাবণের সঙ্গে চলে দশ শত নারী।
রূপে আলো করিছে কনক-লঙ্কাপুরী।।
চামর ঢুলায় কেহ, কার হাতে ঝারি।
নারায়ণ তৈল জ্বলে, দেউটী সারি সারি।।
দশ-শত নারী সহ আইল রাবণ।
অশোক কানন হইল দেবতা-ভবন।।
হনু বলে, রাবণ করিল আগুসার।
দেখিব সীতার সঙ্গে কি করে আচার।।
কুড়ি চক্ষে দশানন চারিদিকে চাহে।
সীতার নিকটে আছি, কভু ভাল নহে।।
গাছের আড়ালে বসি পাতাতে প্রচুর।
আপনি লুকায়ে দেখে বানর চতুর।।
নারিগণ সঙ্গে গেল সীতার সম্মুখে।
থাকিয়া গাছের আড়ে হনুমান দেখে।।
কি বলে বারণ রাজা,কি বলে জানকী।
শুনিবারে আগুসারে মারুতি কৌতুকী।।
দুই পদ রাখিলেন ডালের উপর।
গাত্র বাড়াইয়া দেখে সীতার গোচর।।
রাবণে দেখিয়া সীতার কাঁপিল অন্তর।
মলিন বসনে ঢাকে নিজ কলেবর।।
দুই হাতে দুই স্তন ঢাকিল জানকী।
লাবণ্য ঢাকিতে পারে কিবা হেন শক্তি।।
সোণার প্রতিমা জিনি সীতা ঠাকুরাণী।
হিঙ্গুল জিনিয়া মার চরণ দুখানি।।
চন্দ্র জিনি চরণের দশ নখ-জ্যোতি।
মুকুতা জিনিয়া মার দশনের পাঁতি।।
পদ্ম জিনি জননীর দুই চক্ষু শোভে।
ভ্রমর ধাইছে কত শত মধু লোভে।।
দশদিক্ আলো করে জনক-ঝিয়ারী।
শিংশপার তলে যেন পড়িছে বিজুরী।।
সীতামার গাত্রে মলা, মলিন বদন।
তবু রূপে আলো করে অশোকের বন।।
রাবণে দেখিয়া সীতার উড়ে গেল প্রাণ।
বলেন দুহাত তুলি রক্ষা কর রাম।।
এমন সময়ে কোথা দেবর লক্ষ্মণ।
জাতি মান রক্ষা কর ভাই দুই জন।।
বিকলি করিয়া সীতা রৈলা হেঁট মাথে।
মাথা তুলি না চাহেন রাবণ-সাক্ষাতে।।
সীতারূপ হেরি রাবণ ভাবে মনে-মন।
আমার উদ্ধারে সীতা তব আগমন।।
যে হোক্ সে হোক্ মোর, জানি মনে মনে।
উন্নত হইয়া আমি নত হই কেনে।।
ডাক দিয়া বলে তবে লঙ্কা-অধিকারী।
হেঁট মাথা কৈলে কেনে জনক-ঝিয়ারী।।
অভিমান ছাড়ি সীতা চাহ নয়ন-কোণে।
পাটরাণী হয়ে বৈস স্বর্ণ-সিংহাসনে।।
দশ হাজার দেবকন্যা বিভা করি আমি।
তার পরে পাটরাণী হয়ে রহ তুমি।।
সর্ব্বাঙ্গ ভরিয়া পর রাজ-আভরণ।
তব আজ্ঞাকারী রবে রাজা দশানন।।
মোর মত রাজা আর নাহি ত্রিভুবনে।
ধনের ঈশ্বর আমি জানে জগজ্জনে।।
রাবণ বলিল, সীতা কারে তব ডর।
দেবতা আসিতে নারে লঙ্কার ভিতর।।
বলে ধরি আনিয়াছি, এই ত্রাস মনে।
রাক্ষসের জাতিধর্ম্ম ছলে বলে আনে।।
ত্রিভুবন জিনিয়া তোমার সুবদন।
কি পদ্ম কি সুধাকর জ্ঞান করে মন।।
দুই কর্ণে শোভে তব রত্নের কুণ্ডল।
দেখি নবনীত প্রায় শরীর কোমল।।
মুষ্টিতে ধরিতে পারি তোমার কাঁকালি।
হিঙ্গুলে মণ্ডিত তব চরণ-অঙ্গুলি।।
করিয়া রামের সেবা জন্ম গেল দুঃখে।
হইয়া আমার ভার্য্যা থাক নানা সুখে।।
রামের অত্যল্প ধন, অত্যল্প জীবন।
শোকে শোকে ফিরে রাম করিয়া ভ্রমণ।।
এখনও কি আছে রাম মনে হেন বাস।
বনের মধ্যেতে তারে খাইল রাক্ষস।।
মোর হাতে সুমেরু নাহিক ধরে টান।
মানুষ সে রাম তার কত বড় জ্ঞান।।
দেবতা দানব যক্ষ কিন্নর গন্ধর্ব্ব।
যুদ্ধে করিলাম চূর্ণ সবাকার গর্ব্ব।।
দিগ্বিজয় কৈনু আমি রণে বাহুবলে।
কত শত যোদ্ধৃ পতি দিনু রসাতলে।।
হেন জন ছাড়ি তব তপস্বীতে মন।
জটিল তপস্বী তব শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
কিছু বুদ্ধি নাহি তব অবোধিনী সীতা।
সর্ব্বলোকে তোমারে তো কে বলে পণ্ডিতা।।
রতিশাস্ত্র জানি আমি বিবিধ বিধানে।
তুমি আমি কেলি রস করিব দুজনে।।
নানা রত্নে পূর্ণ আছে আমার ভাণ্ডার।
আজ্ঞা কর সুন্দরী সে সকলি তোমার।।
তোমার সেবক আমি তুমিত ঈশ্বরী।
তোমার আজ্ঞাতে লয়ে যাই অন্তঃপুরী।।
তোমার চরণ ধরি করি যে ব্যগ্রতা।
কোপ ত্যজি মোর কথা শুন দেবী সীতা।।
কারো পায়ে নাহি ধরে রাজা দশাননে।
দশ মাথা লোটালাম তোমার চরণে।।
রাবণের বাক্যে সীতা কুপিয়া অন্তরে।
কহেন রাবণ প্রতি অতি ধীরে ধীরে।।
অধার্ম্মিক নহি আমি রামের সুন্দরী।
জনক রাজার কন্যা আমি কুলনারী।।
রাবণেরে পাছু করি বৈসে ক্রোধ মনে।
গালাগালি পাড়ে সীতা রাবণ তা শুনে।।
নাহি হেন পণ্ডিত বুঝায় তোরে হিত।
পণ্ডিতে কি করে তোর মৃত্যু উপস্থিত।।
শৃগাল হইয়া তোর সিংহে যায় সাধ।
সবংশে মরিবি রে রামের সনে বাদ।।
তোর প্রাণে না সহিবে শ্ররামের বাণ।
পলাইয়া কোথাও না পাবি পরিত্রাণ।।
অমৃত খাইয়া যদি হস্ রে অমর।
তথাপি রামের বাণে মরিবি পামর।।
লঙ্কার প্রাচীর ঘর তোর অহঙ্কার।
শ্রীরামের বাণানলে হইবে অঙ্গার।।
সাগরের গর্ব্ব রে করিস্ দুরাচার।
রামের বাণের তেজে কোথা কথা তার।।
অতঃপর দুষ্ট তোরে আমি বলি হিত।
আমা দিয়া রাম সঙ্গে করহ পীরিত।।
যদি বা রামের সঙ্গে না কর পীরিতি।
শ্রীরামের হাতে তোর নাই অব্যাহতি।।
আমার সেবক তুই কহিলি আপনি।
সেবক হইয়া কোথা হরে ঠাকুরাণী।।
যার পায় পড়ি সেই হয় গুরুজন।
পায়ে পড়ি বলিস্ কেন কুৎসিৎ বচন।।
পিতৃসত্য পালিতে রামের বনবাস।
ক্রোধে শাপ দিলে তাঁর হয় সত্য নাশ।।
কি হেতু রাবণ মোরে বলিস্ কুরাণী।
তোর শক্তি ভুলাইবি রামের ঘরণী।।
রাম প্রাণনাথ মোর রাম সে দেবতা।
রাম বিনা অন্য জনে নাহি জানে সীতা।।
এত বলি সীতাদেবী অগ্নি হেন জ্বলে।
কোপে দুই চক্ষু রাঙ্গা রাবণেরে বলে।।
দুরাচার রাক্ষস পাপিষ্ঠ দুষ্টমতি।
ধরেন কতই গুণ মোর রঘুপতি।।
রামের অমৃত জিনি বচন শীতল।
বিপক্ষ-বিনাশে যাহা মহা কালানল।।
জিনিয়া সূর্য্যের তেজ অযোধ্যার পাটে।
আশী হাজার রাজা যাঁর পদতলে খাটে।।
হেন বংশে জন্ম মোর লভিলা শ্রীরাম।
চৌদ্দ ভুবনের কর্ত্তা, সংসারের প্রাণ।।
শুন রে রাবণ, মোর পতি রঘুমণি।
তাঁরে সিংহ, শৃগাল কুক্কুর তোরে গণি।।
তোর দেশে তাকিয়া কি তোরে ভয় করি।
জাগেন হৃদয়ে মোর রাম জটাধারী।।
পঙ্গু হয়ে চাস্ তুই লঙ্ঘিতে সাগর।
বামন হইয়া চাস্ ধর্ত্তে শশধর।।
শৃগাল হইয়া চাস্ সিংহের রমণী।
কোন শাস্ত্রে কোন ধর্ম্মে কোথাও না শুনি।।
সরোবর-পঙ্ক আর সুগন্ধি চন্দনে।
কতই অন্তর তুই ভেবে দেক্ মনে।।
সরোবর-পঙ্ক তুই রাজা দশানন।
সুগন্ধি চন্দন মোর কমল-লোচন।।
চন্দ্র ও লক্ষত্রে দেখ্ কতেক অন্তর।
তারা হয়ে হতে চাস্ চন্দ্রের সোসর।।
এক চন্দ্র আলো করে গগন-মণ্ডলে।
কুড়ি চন্দ্র রহে রাম-চরণ-কমলে।।
তৈল বিনা যথা দীপ কভু নাহি রয়।
নদীকূলে বৃক্ষ যথা চিরস্থায়ী নয়।।
বস্ত্রে অগ্নি-বন্ধে যথা মৃত্যু আপনার।
ধর্ম্মে বিনা লঙ্কা তথা হবে ছারখার।।
মক্ষিকা না পারে কভু বজ্র ধরিবারে।
রাবণ না পারে কভু লইতে সীতারে।।
যে সে নারী নহি আমি জনক-ঝিয়ারী।
মোর শাপে ভস্ম হবে স্বর্ণ লঙ্কাপুরী।।
দশ-হাজার দেবকন্যা হরেছিস্ বলে।
ডুবাবেন তোরে রাম সাগরের জলে।।
বৃথায় করিস্ গর্ব্ব সাগরের গড়।
রাম গুণে বদ্ধ হবে স্বয়ং সাগর।।
ক্ষেপণ করিলে বজ্র-বাণ রঘুমণি।
করিতে পারেন শুষ্ক সাগরের পানি।।
ইন্দ্রের নিকটে গিয়া তোর ভারি-ভুরি।
এবার রামের হাতে যাবি যমপুরী।।
রাবণ ভাবিস্ তুই এম্নি দিন যাবে।
ঘাঁটাইলি কাল সর্প, ঘরে আসি খাবে।।
মরণ নিকট, ছাড় জীবনের আশ।
অবিলম্বে হইবেক তোর সর্ব্বনাশ।।
এত যদি সীতাদেবী বলিলেন রোষে।
মনে সাত পাঁচ ভাবে রাবণ বিশেষে।।
আসিবার কালে আমি বলেছি বচন।
এক বর্ষ জানকীরে করিব পালন।।
বৎসরের তরে তোরে দিয়াছি আশ্বাস।
বৎসরের মধ্যে তোর যায় দশ মাস।।
সহিবেক আর দুই মাস দশস্কন্ধ।
দুই মাস গেলে তোর যে থাকে নির্ব্বন্ধ।।
জানকী বলেন, রাজা না বল কুৎসিত।
আমা লাগি মরিবি রে দৈবের লিখিত।।
বিষ্ণু-অবতার রাম, তুই নিশাচর।
গরুড় বায়সে দেখে অনেক অন্তর।।
অনেক অন্তর দেখ কাঁজি সুধাপানে।
অনেক অন্তর দেখ লোহা ও কাঞ্চনে।।
অনেক অন্তর দেখ ব্রাহ্মণ চণ্ডালে।
অনেক অন্তর হয় বারিনিধি খালে।।
শ্রীরাম হইতে তোর দেখি বহুদূর।
রাম সিংহ, তোরে দেখি যেমন কুকুর।।
এত যদি বলিলেন কর্কশ বচন।
সীতারে কাটিতে খাঁড়া তুলিল রাবণ।।
হাতে করি নিল বীর খাঁড়া এক ধারা।
কুড়ি চক্ষু ফিরে যেন আকাশের তারা।।
এ খাঁড়ায় কাটিয়া করিব দুইখানি।
আর যেন নাহি বল দুরক্ষর বাণী।।
অর্ব্বুদ কামিনী আছে রাবণের আড়ে।
আড়ে থাকি তাহারা সীতারে চক্ষু ঠারে।।
তবু ভয় নাহি করে রামের সুন্দরী।
রাবণেরে ভৎসে সেইকালে মন্দোদরী।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব নহে জাতিতে মানুষী।
কত বড় দেখ প্রভু জানকী রুপসী।।
রাবণ সীতারে দেখি কামে অচেতন।
খাঁড়া ফেলি যায় বলে ধরিতে তখন।।
কামে মত্ত চতুর্দ্দিকে রাবণ নেহালে।
মন্দোদরী হাতে ধরি বলে হেনকালে।।
নলকুবেরের শাপ পাসরিলে মনে।
শৃঙ্কার করিলে বলে মরিবে পরাণে।।
নেউটিল দশানন রাণীর প্রবোধে।
চেড়ীগণে মারিবারে যায় বড় ক্রোধে।।
চেড়ীগণে ডাকে যে যাহার যেই নাম।
চেড়ীগণ দ্রুত গিয়া করিল প্রণাম।।
নির্দ্দয়া নিষ্ঠুরা এল প্রভাসা দুর্ম্মুখা।
পাইয়া সীতার বার্ত্তা রাঁড়ী সূর্পনখা।।
অস্ত্রমুখী বজ্রধারী এল চিত্তক্ষমা।
ধার্ম্মিকা ত্রিজটা এল রাক্ষসী সরমা।।
কহিল রাবণ, চেড়ী সকলের কাণে।
বুঝাও সীতায় ভালমতে রাত্রিদিনে।।
রুক্ষ বাক্য না বলিহ করহ পীরিতি।
ভাল মতে বুঝাইয়া লহ অনুমতি।।