আজি মেঘমুক্ত দিন ; প্রসন্ন আকাশ
হাসিছে বন্ধুর মতো ; সুমন্দ বাতাস
মুখে চক্ষে বক্ষে আসি লাগিছে মধুর —
অদৃশ্য অঞ্চল যেন সুপ্ত দিগ্বধূর
উড়িয়া পড়িছে গায়ে । ভেসে যায় তরী
প্রশান্ত পদ্মার স্থির বক্ষের উপরি
তরল কল্লোলে । অর্ধমগ্ন বালুচর
দূরে আছে পড়ি , যেন দীর্ঘ জলচর
রৌদ্র পোহাইছে শুয়ে । ভাঙা উচ্চতীর ;
ঘনচ্ছায়াপূর্ণ তরু ; প্রচ্ছন্ন কুটির ;
বক্র শীর্ণ পথখানি দূর গ্রাম হতে
শস্যক্ষেত্র পার হয়ে নামিয়াছে স্রোতে
তৃষার্ত জিহ্বার মতো । গ্রামবধূগণ
অঞ্চল ভাসায়ে জলে আকণ্ঠমগন
করিছে কৌতুকালাপ । উচ্চ মিষ্ট হাসি
জলকলস্বরে মিশি পশিতেছে আসি
কর্ণে মোর । বসি এক বাঁকা নৌকা- ‘ পরি
বৃদ্ধ জেলে গাঁথে জাল নতশির করি
রৌদ্রে পিঠ দিয়া । উলঙ্গ বালক তার
আনন্দে ঝাঁপায়ে জলে পড়ে বারম্বার
কলহাস্যে ; ধৈর্যময়ী মাতার মতন
পদ্মা সহিতেছে তার স্নেহ-জ্বালাতন ।
তরী হতে সম্মুখেতে দেখি দুই পার —
স্বচ্ছতম নীলাভ্রের নির্মল বিস্তার ;
মধ্যাহ্ন-আলোকপ্লাবে জলে স্থলে বনে
বিচিত্র বর্ণের রেখা ; আতপ্ত পবনে
তীর উপবন হতে কভু আসে বহি
আম্রমুকুলের গন্ধ , কভু রহি রহি
বিহঙ্গের শ্রান্ত স্বর ।
আজি বহিতেছে
প্রাণে মোর শান্তিধারা — মনে হইতেছে
সুখ অতি সহজ সরল , কাননের
প্রস্ফুট ফুলের মতো , শিশু-আননের
হাসির মতন , পরিব্যাপ্ত বিকশিত —
উন্মুখ অধরে ধরি চুম্বন-অমৃত
চেয়ে আছে সকলের পানে বাক্যহীন
শৈশববিশ্বাসে চিররাত্রি চিরদিন ।
বিশ্ববীণা হতে উঠি গানের মতন
রেখেছে নিমগ্ন করি নিথর গগন ।
সে সংগীত কী ছন্দে গাঁথিব , কী করিয়া
শুনাইব , কী সহজ ভাষায় ধরিয়া
দিব তারে উপহার ভালোবাসি যারে ,
রেখে দিব ফুটাইয়া কী হাসি আকারে
নয়নে অধরে , কী প্রেমে জীবনে তারে
করিব বিকাশ । সহজ আনন্দখানি
কেমনে সহজে তারে তুলে ঘরে আনি
প্রফুল্ল সরস । কঠিন আগ্রহভরে
ধরি তারে প্রাণপণে — মুঠির ভিতরে
টুটি যায় । হেরি তারে তীব্রগতি ধাই —
অন্ধবেগে বহুদূরে লঙ্ঘি চলি যাই ,
আর তার না পাই উদ্দেশ ।
চারি দিকে
দেখে আজি পূর্ণপ্রাণে মুগ্ধ অনিমিখে
এই স্তব্ধ নীলাম্বর স্থির শান্ত জল ,
মনে হল সুখ অতি সহজ সরল ।