Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সীমান্ত-হীরা – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

সীমান্ত-হীরা – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

কিছুদিন যাবৎ ব্যোমকেশের হাতে কোন কাজকর্ম ছিল না। এদেশের লোকের কেমন বদ অভ্যাস, ছোটখাটো চুরি চামারি হইলে বেবাক হজম করিয়া যায়, পুলিশে পর্যন্ত খবর দেয় না। হয়তো তাহারা ভাবে সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো। নেহাত যখন গুরুতর কিছু ঘটিয়া যায় তখন সংবাদটা পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছায় বটে কিন্তু গাঁটের কড়ি খরচ করিয়া বেসরকারি গোয়েন্দা নিযুক্ত করিবার মতো উদ্যোগ বা আগ্রহ কাহারও দেখা যায় না। কিছু দিন হা হুতাশ ও পুলিশকে গালিগালাজ করিয়া অবশেষে তাহারা ক্ষান্ত হয়।

খুন জখম ইত্যাদিও যে আমাদের দেশে হয় না, এমন নহে। কিন্তু তাহার মধ্যে বুদ্ধি বা চতুরতার লক্ষণ লেশমাত্র দেখা যায় না; রাগের মাথায় খুন করিয়া হত্যাকারী তৎক্ষণাৎ ধরা পড়িয়া যায় এবং সরকারের পুলিশ তাহাকে হাজতজাত করিয়া অচিরাৎ ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাইয়া দেয়।

সুতরাং সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের পক্ষে সত্য অন্বেষণের সুযোগ যে বিরল হইয়া পড়িবে ইহা বিচিত্র নহে। ব্যোমকেশের অবশ্য সেদিকে লক্ষই ছিল না, সে সংবাদপরের প্রথম পৃষ্ঠায় উত্তর পশ্চিম কোণ হইতে শেষ পৃষ্ঠার দক্ষিণ পূর্ব কোণ পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পড়িয়া বাকি সময়টুকু নিজের লাইব্রেরি ঘরে দ্বার বন্ধ করিয়া কাটাইয়া দিতেছিল। আমার কিন্তু এই একটানা অবকাশ অসহ্য হইয়া উঠিয়াছিল। যদিচ অপরাধীর অনুসন্ধান করা আমার কাজ নহে, গল্প লিখিয়া বাঙালি পাঠকের চিত্তবিনোদনরূপ অবৈতনিক কার্যকেই জীবনের ব্রত করিয়াছি, তবু চোর ধরার যে একটা অপূর্ব মাদকতা আছে, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। নেশার বস্তুর মতো এই উত্তেজনার উপাদান যথাসময় উপস্থিত না হইলে মন একেবারে বিকল হইয়া যায় এবং জীবনটাই লবণহীন ব্যঞ্জনের মতো বিস্বাদ ঠেকে।

তাই সেদিন সকালবেলা চা পান করিতে করিতে ব্যোমকেশকে বলিলাম, “কি হে বাংলাদেশের চোর ছঁযাচড়গুলো কি সব সাধু সন্ন্যাসী হয়ে গেল না কি?”
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, “না। তার প্রমাণ তো খবরের কাগজে রোজ পাচ্ছ।”
“তা তো পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের কাছে আসছে কৈ?”
“আসবে। চারে যখন মাছ আসবার তখনি আসে, তাকে জোর করে ধরে আনা যায় না। তুমি কিছু অধীর হয়ে পড়েছ দেখছি। ধৈর্যং রহু। আসল কথা আমাদের দেশে প্রতিভাবান বদমায়শ — প্যারাডক্স হয়ে যাচ্ছে, কি করব; দোষ আমার নয়, দোষ তোমাদের দীনহীনা পিঁচুটি নয়না বঙ্গভাষায় – প্রতিভাবান বদমায়েশ খুব অল্পই আছে। পুলিশ কোর্টের রিপোর্টে যাদের নাম দেখতে পাও, তারা চুনোপুঁটি। যাঁরা গভীর জলের মাছ – তাঁরা কদাচিৎ চারে এসে ঘাই মারেন। আমি তাঁদেরই খেলিয়ে তুলতে চাই। জানো তো যে পুকুরে দু’চারটে বড় বড় রুই কাতলা আছে সেই পুকুরে ছিপ ফেলেই শিকারির আনন্দ।”

আমি বলিলাম, “তোমার উপমাগুলো থেকে বেজায় আঁশটে গন্ধ বেরুচ্ছে। মনস্তত্ববিদ যদি কেউ এখানে থাকতেন, তিনি নির্ভয়ে বলে দিতেন যে তুমি সত্যান্বেষণ্ন ছেড়ে শীঘ্রই মাছের ব্যবসা আরম্ভ করবে।”
ব্যোমকেশ বলিল, “তাহলে মনস্তত্ববিদ মহাশয় নিদারুণ ভুল করতেন। যে লোক মাছের সম্বন্ধে গবেষণা করে, সে জলচর জীবের কখনও নাম শোনেনি – এই হচ্ছে আজকালকার নতুন বিধি। তোমরা আধুনিক গল্প লেখকের দল এই কথটাই আজকাল প্রমাণ করছ।”
আমি ক্ষুব্ধ হইয়া বলিলাম, “ভাই, আমরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই, প্রতিদানের আশা না করে শুধু আনন্দ যোগাই, তবু কি তোমাদের মন ওঠে না? এর বেশি যদি চাও তাহলে নগদ কিছু ছাড়তে হবে।”

দরজার কড়া নাড়িয়া “চিঠি হ্যায়” বলিয়া ডাক পিওন প্রবেশ করিল। আমাদের জীবনে ডাক পিওনের সমাগম এতই অপ্রচুর যে, মুহূর্তমধ্যে সাহিত্যিক দুঃখ দীনতা ভুলিয়া গেলাম। গলা বাড়াইয়া দেখিলাম, একখানা ইন্সিওর করা খাম ব্যোমকেশের নামে আসিয়াছে।

খাম ছিঁড়িয়া ব্যোমকেশ যখন চিঠি বাহির করিল তখন কৌতূহল আরও বাড়িয়া গেল। ব্রঞ্জ ব্লু কালিতে ছাপা মনোগ্রাম যুক্ত পুরু কাগজে লেখা চিঠি এবং সেই সঙ্গে পিন দিয়া আঁটা একটি একশ টাকার নোট। চিঠিখানি ছোট; ব্যোমকেশ পড়িয়া সহাস্য মুখে আমার হাতে দিয়া বলিল, “এই নাও। গুরুতর ব্যাপার। উত্তরবঙ্গের বনিয়াদী জমিদার গৃহে রোমাঞ্চকর রহস্যের আবির্ভাব। সেই রহস্য উদ্ঘাটিত করবার জন্য জোর তাগাদা এসেছে – পত্রপাঠ যাওয়া চাই। এমন কি, একশ টাকা অগ্রিম রাহাখরচ পর্যন্ত এসে হাজির।”

চিঠির শিরোনামায় কোনও এক বিখ্যাত জমিদারি স্টেটের নাম। জমিদার স্বয়ং চিঠি লেখেন নাই, তাঁহার সেক্রেটারি ইংরাজিতে টাইপ করিয়া যাহা লিখিয়াছেন, তাহার মর্ম এই,

প্রিয় মহাশয়,
কুমার শ্রীত্রিদিবেন্দ্রনারায়ণ রায় মহাশয় কর্তৃক আদিষ্ট হইয়া আমি আপনাকে জানাইতেছি যে, তিনি আপনার নাম শুনিয়াছেন। একটি বিশেষ জরুরি কার্যে তিনি আপনার সাহায্য ও পরামর্শ লইতে ইচ্ছা করেন। অতএব আপনি অবিলম্বে এখানে আসিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলে বাধিত হইব। পথ খরচের জন্য ১০০ টাকার নোট এই সঙ্গে পাঠাইলাম।
আপনি কোন ট্রেনে আসিতেছেন, তার যোগে জানাইলে স্টেশনে গাড়ি উপস্থিত থাকিবে।
ইতি –

পত্র হইতে আর কোনও তথ্য সংগ্রহ করা গেল না। পত্র ফিরাইয়া দিয়া বলিলাম, “তাই তো হে, ব্যাপার সত্যই গুরুতর ঠেকছে। জরুরি কার্যটি কি – চিঠির কাগজ বা ছাপার হরফ থেকে কিছু অনুমান করতে পারলে? তোমার তো ও সব বিদ্যে আছে।”
“কিছু না। তবে আমাদের দেশের জমিদার বাবুদের যতদূর জানি, খুব সম্ভব কুমার ত্রিদিবেন্দ্রনারায়ণ বাহাদুর রাত্রে স্বপ্ন দেখেছেন যে, তাঁর পোষা হাতিটি পাশের জমিদার চুরি করে নিয়ে গেছে; তাই শঙ্কিত হয়ে তিনি গোয়েন্দা তলব করেছেন।”
“না না, অতটা নয়। দেখছ না একেবারে গোড়াতেই এতগুলো টাকা খরচ করে ফেলেছে। ভেতরে নিশ্চয় কোনও বড় রকম গোলমাল আছে।”
“ঐটে তোমাদের ভুল; বড় লোক রুগী হলে মনে কর ব্যাধিও বড় রকম হবে। দেখা যায় কিন্তু ঠিক তার উল্টো। বড়লোকের ফুসকুড়ি হলে ডাক্তার আসে, কিন্তু গরীবের একেবারে নাভিশ্বাস না উঠলে ডাক্তার বৈদ্যের কথা মনেই পড়ে না।”
“যা হোক,কি ঠিক করলে? যাবে না কি?”
ব্যোমকেশ একটু ভাবিয়া বলিল, “হাতে যখন কোনও কাজ নেই, তখন চল দুদিনের জন্যে ঘুরেই আসা যাক। আর কিছু না হোক, নূতন দেশ দেখা তো হবে। তুমিও বোধ হয় ও অঞ্চলে কখনও যাওনি।”
যদিচ যাইবার ইচ্ছা ষোল আনা ছিল তবু ক্ষীণভাবে আপত্তি করিলাম, “আমার যাওয়াটা কি ঠিক হবে? তোমাকে ডেকেছে -”
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, “দোষ কি? একজনের বদলে দু’জন গেলে কুমার বাহাদুর বরঞ্চ খুশিই হবেন। ধনক্ষয় যখন অন্যের হচ্ছে, তখন যাওয়াটা তো একটা কর্তব্যবিশেষ। শাস্ত্রে লিখেছে – সর্বদা পরের পয়সায় তীর্থ দর্শন করবে।”
কোন শাস্ত্রে এমন জ্ঞানগর্ভ নীতি উপদেশ আছে যদিও স্মরণ করিতে পারিলাম না, তবু সহজেই রাজি হইয়া গেলাম।

সেইদিন সন্ধ্যার গাড়িতে যাত্রা করিলাম। পথে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটিল না, শুধু একটি অত্যন্ত মিশুক ভদ্রলোকের সহিত আলাপ হইল। সেকেণ্ড ক্লাশ কামরায় আমরা তিনজন ছাড়া আর কেহ ছিল না, একথা সেকথার পর ভদ্রলোকটি জিজ্ঞাসা করিলেন, “মশাইদের কদ্দুর যাওয়া হচ্ছে?”
প্রত্যুত্তরে ব্যোমকেশ মধুর হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “মশাইয়ের কদ্দুর যাওয়া হবে?”
পালটা প্রশ্নে কিছুক্ষণ বিমূঢ় হইয়া থাকিয়া ভদ্রলোকটি আমতা আমতা করিয়া বলিলেন, “আমি – এই পরের স্টেশনেই নামব।”
ব্যোমকেশ পূর্ববৎ মধুর স্বরে বলিল, “আমরাও তার পরের স্টেশনে নেমে যাব।”

অহেতুক মিথ্যা বলিবার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু ব্যোমকেশের কোনও মতলব আছে বুঝিয়া আমি কিছু বলিলাম না। গাড়ি থামিতেই ভদ্রলোক নমিয়া গেলেন। রাত্রি হইয়াছিল, প্ল্যাটফর্মের ভিড়ে তিনি নিমেষমধ্যে কোথায় মিলাইয়া গেলেন, তাঁহাকে আর দেখিতে পাইলাম না।

দুই তিন স্টেশন পরে জানালার কাচ নামাইয়া বাহিরে গলা বাড়াইয়াছি, হঠাৎ দেখিলাম, পাশের একটা ইন্টার ক্লাশের কামরায় জানালায় মাথা বাহির করিয়া ভদ্রলোকটি আমাদের গাড়ির দিকেই তাকাইয়া আছেন। চোখাচোখি হইবামাত্র তিনি বিদ্যুদ্বেগে মাথা টানিয়া লইলেন। আমি উত্তেজিতভাবে ব্যোমকেশের দিকে ফিরিয়া বলিলাম, “ওহে -”
ব্যোমকেশ বলিল, “জানি। ভদ্রলোক পাশের গাড়িতে উঠেছেন। ব্যাপার যতটা তুচ্ছ মনে করেছিলুম, দেখছি তা নয়। ভালোই!”
তারপর প্রায় প্রতি স্টেশনেই জানালা দিয়া গলা বাড়াইয়া দেখিয়াছি, কিন্তু সে ভদ্রলোকের চুলের টিকি পর্যন্ত দেখিতে পাই নাই।

পরদিন ভোর হইতে না হইতে গন্তব্যস্থানে পৌঁছিলাম। স্টেশনটি ছোট, সেখান হইতে প্রায় ছয় সাত মাইল মোটরে যাইতে হইবে। একখানি দামি মোটর লইয়া জমিদারের একজন কর্মচারি উপস্থিত ছিলেন, তিনি আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা করিলেন। আমরা মোটরে বসিলাম। অতঃপর নির্জন পথ দিয়া মোটর নিঃশব্দে ছুটিয়া চলিল।

কর্মচারিটি প্রবীণ এবং বিচক্ষণ; ব্যোমকেশ কৌশলে তাঁহাকে দু’একটি প্রশ্ন করিতেই তিনি বলিলেন, “আমি কিছুই জানি না, মশাই! শুধু আপনাদের স্টেশন থেকে নিয়ে যাওয়ার হুকুম পেয়েছিলাম, তাই নিয়ে যচ্ছি।”

আমরা মুখ তাকাতাকি করিলাম, আর কোনও কথা হইল না। পরে জমিদারভবনে পৌঁছিয়া দেখিলাম, সে এক এলাহি কাণ্ড! মাঠের মাঝখানে যেন ইন্দ্রপুরী বসিয়াছে। প্রকাণ্ড সাবেক পাঁচমহল ইমারত – তাহাকে ঘিরিয়া প্রায় ত্রিশ চল্লিশ বিঘা জমির উপর বাগান, হট হাউস, পুষ্করিণী, টেনিস কোর্ট, কাছারি বাড়ি, অতিথিশালা, পোস্ট অফিস, আরও কত কি! চারিদিকে লস্কর পেয়াদা গোমস্তা সরকার খাতক প্রজার ভিড় লাগিয়া গিয়াছে। আমাদের মোটর বাড়ির সম্মুখে থামিতেই জমিদারের প্রাইভেট সেক্রেটারি স্বয়ং আসিয়া আমাদের সমাদর করিয়া ভিতরে লইয়া গেলেন। একটা আস্ত মহল আমাদের জন্য নির্দিষ্ট হইয়াছিল। সেক্রেটারি বলিলেন, “আপনারা মুখ হাত ধুয়ে জলযোগ করে নিন। ততক্ষণ কুমার বাহাদুরও আপনাদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য তৈরি হয়ে যাবেন।”

স্নানাদি সারিয়া বাহির হইতেই প্রচুর প্রাতঃরাশ আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার যথারীতি ধ্বংস সাধন করিয়া তৃপ্তমনে ধূমপান করিতেছি, এমন সময় সেক্রেটারি আসিয়া বলিলেন, “কুমার বাহাদুর লাইব্রেরি ঘরে আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। যদি আপনাদের অবসর হয়ে থাকে – আমার সঙ্গে আসুন।”
আমরা উঠিয়া তাঁহার অনুসরণ করিলাম। রাজসকাশে যাইতেছি, এমনি একটা ভাব লইয়া লাইব্রেরি ঘরে প্রবেশ করিলাম। ‘কুমার ত্রিদিবেন্দ্রনারায়ণ’ নাম হইতে আরম্ভ করিয়া সর্ববিষয়ে বিরাট আড়ম্বর দেখিয়া মনের মধ্যে কুমার বাহাদুর সম্বন্ধে একটা গুরুগম্ভীর ধারণা জন্মিয়াছিল, কিন্তু তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া সে ভ্রম ঘুচিয়া গেল। দেখিলাম, আমাদেরই মতো সাধারণ পাঞ্জাবি পরা একটি সহস্যমুখ যুবাপুরুষ, গৌরবর্ণ সুশ্রী চেহারা – ব্যবহারে তিলমাত্র আড়ম্বর নাই। আমরা যাইতেই চেয়ার হইতে উঠিয়া আগেই হাত তুলিয়া নমস্কার করিলেন। পলকের জন্য একটু দ্বিধা করিয়া ব্যোমকেশকে বলিলেন, “আপনিই ব্যোমকেশবাবু? আসুন।”

ব্যোমকেশ আমাকে পরিচিত করিয়া দিয়া বলিল, “ইনি আমার বন্ধু, সহকারী এবং ভবিষ্যৎ জীবনী লেখক।”
কুমার ত্রিদিব হাসিয়া কহিলেন, “আশা করি, আপনার জীবনী লেখার প্রয়োজন এখনও অনেক দূরে। অজিতবাবু এসেছেন, আমি ভারি খুশি হয়েছি। কারণ, প্রধানত ওঁর লেখার ভিতর দিয়েই আপনার নামের সঙ্গে আমাদের পরিচয়।”

উৎফুল্ল হইয়া উঠিলাম। অন্যের মুখে নিজের লেখার অযাচিত উল্লেখ যে কত মধুর, তাহা যিনি ছাপার অক্ষরের কারবার করেন, তিনিই জানেন। বুঝিলাম, ধনী জমিদার হইলেও লোকটি অতিশয় সুশিক্ষিত ও বুদ্ধিমান। লাইব্রেরি ঘরের চারিদিকে চক্ষু ফিরাইয়া দেখিলাম দেয়াল সংলগ্ন আলমারিগুলি দেশি বিলাতি নানা প্রকার পুস্তকে ঠাসা। টেবিলের উপরেও অনেকগুলি বই ইতস্তত ছড়ানো রহিয়াছে। লাইব্রেরি ঘরটি যে কেবল মাত্র জমিদার গৃহের শোভাবর্ধনের জন্য নহে, রীতিমতো ব্যবহারের জন্য – তাহাতে সন্দেহ রহিল না।

আরও কিছুক্ষণ শিষ্টতা বিনিময়ের পর কুমার বাহাদুর বলিলেন, “এবার কাজের কথা আরম্ভ করা যাক।”
সেক্রেটারিকে হুকুম দিলেন, “তুমি এখন যেতে পার। লক্ষ রেখো, এ ঘরে কেউ না ঢোকে।”
সেক্রেটারি সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করিয়া প্রস্থান করিলে কুমার ত্রিদিব চেয়ারে ঝুঁকিয়া বসিয়া বলিলেন, “আপনাদের যে কাজের জন্য এত কষ্ট দিয়ে ডেকে আনিয়েছি, সে কাজ যেমন গুরুতর, তেমনি গোপনীয়। তাই সকল কথা প্রকাশ করে বলবার আগে আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, এ কথা ঘুণাক্ষরেও তৃতীয় ব্যক্তির কর্ণগোচর হবে না। এত সাবধানতার কারণ, এই ব্যাপারের সঙ্গে আমাদের বংশের মর্যাদা জড়ানো রয়েছে।”
ব্যোমকেশ বলিল, “প্রতিশ্রুতি দেবার কোনও দরকার আছে মনে করিনে, একজন মক্কেলের গুপ্তকথা অন্য লোককে বলা আমাদের ব্যবসার রীতি নয়। কিন্তু আপনি যখন প্রতিশ্রুতি চান, তখন দিতে কোনও বাধাও নেই। কি ভাবে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে বলুন।”
কুমার হাসিয়া বলিলেন, “তামা তুলসীর দরকার নেই। আপনাদের মুখের কথাই যথেষ্ট।”
আমি একটু দ্বিধায় পড়িলাম, বলিলাম, “গল্পচ্ছলেও কি কোনও কথা প্রকাশ করা চলবে না?”
কুমার দৃঢ়কণ্ঠে বলিলেন, “না। এ সম্বন্ধে কোনও আলোচনাই চলবে না।”
হয়তো একটা ভালো গল্পের মশলা হাত ছাড়া হইয়া গেল, এই ভাবিয়া মনে মনে দীর্ঘশ্বাস মোচন করিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, “আপনি নির্ভয়ে বলুন। আমরা কোনও কথা প্রকাশ করব না।”

কুমার ত্রিদিব কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া, যেন কি ভাবে কথাটা আরম্ভ করিবেন তাহাই ভাবিয়া লইলেন। তারপর বলিলেন, “আমাদের বংশে যে সব সাবেক কালের হীরা জহরত আছে সে সম্বন্ধে বোধ হয়া আপনি কিছু জানেন না – ”
ব্যোমকেশ বলিল, “কিছু কিছু জানি। আপনাদের বংশে একটি হীরা আছে, যার তুল্য হীরা বাংলা দেশে আর দ্বিতীয় নেই – তার নাম সীমন্ত হীরা।”
ত্রিদিব সাগ্রহে বলিলেন, “আপনি জানেন? তাহলে এ কথাও জানেন বোধ হয় যে গতমাসে কলকাতায় যে রত্ন প্রদর্শনী হয়েছিল, তাহাতে ঐ হীরা দেখানো হয়েছিল?”
ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “জানি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে হীরা চোখে দেখার সুযোগ হয়নি।”
কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া কুমার কহিলেন, “সে সুযোগ আর কখনও হবে কি না জানি না। হীরাটা চুরি গেছে।”
ব্যোমকেশ প্রতিধ্বনি করিয়া কহিল, “চুরি গেছে!”
শান্তকণ্ঠে কুমার বলিলেন, “হঁযা, সেই সম্পর্কেই আপনাকে আনিয়েছি। ঘটনাটা শুরু থেকে বলি শুনুন। আপনি নিশ্চয় জানেন, আমাদের এই জমিদার বংশ অতি প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। বারো ভুঁইয়ারও আগে পাঠান বাদশাদের আমলে আমাদের আদি পূর্বপুরুষ এই জমিদারি অর্জন করেন। সাদা কথায় তিনি একজন দুর্দান্ত ডাকাতের সর্দার ছিলেন, নিজের বাহুবলে সম্পত্তি লাভ করে পরে বাদশার কাছ থেকে সনন্দ আদায় করেন। সে বাদশাহি সনন্দ এখনও আমাদের কাছে বর্তমান আছে। এখন আমাদের অনেক অধঃপতন হয়েছে; চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগে আমাদের ‘রাজা’ উপাধি ছিল।”
“ঐ ‘সীমন্ত হীরা’ আমাদের পূর্বপুরুষের সময় থেকে পুরুষানুক্রমে এই বংশে চলে আসছে। একটা প্রবাদ আছে যে, এই হীরা যতদিন আমাদের কাছে থাকবে, ততদিন বংশের কোনও অনিষ্ট হবে না; কিন্তু হীরা কোনও রকমে হস্তান্তরিত হলেই এক পুরুষের মধ্যে বংশ লোপ হয়ে যাবে।”

একটু থামিয়া কুমার আবার বলিতে লাগিলেন, “জমিদারের জ্যেষ্ঠ পুত্র জমিদারির উত্তরাধিকারী হয়, এই হচ্ছে আমাদের বংশের চিরাচরিত লোকাচার। কনিষ্ঠরা কেবল বাবুয়ান বা ভরণপোষণ পান। এই সূত্রে দু’বছর আগে আমার বাবার মৃত্যুর পর আমি জমিদারি পেয়েছি। আমি বাপের একমাত্র সন্তান, উপস্থিত আমার এক কাকা আছেন, তিনি বাবুয়ানস্বরূপ তিন হাজার টাকা মাসিক খোরপোষ জমিদারি থেকে পেয়ে থাকেন।
এ তো গেল গল্পের ভূমিকা। এবার হীরা চুরির ঘটনাটা বলি। রত্ন প্রদর্শনীতে আমার হীরা একজিবিট করবার নিমন্ত্রণ যখন এল, তখন আমি নিজে স্পেশাল ট্রেনে করে সেই হীরা নিয়ে কলকাতা গেলাম; কলকাতায় পৌঁছে হীরাখানা প্রদর্শনীর কর্তৃপক্ষের কাছে জমা করে দেবার পর তবে নিশ্চিন্ত হলাম। আপনারা জানেন প্রদর্শনীতে বরোদা, হায়দ্রাবাদ, পাতিয়ালা প্রভৃতি রাজবংশের খানদানি জহরত প্রদর্শিত হয়েছিল। প্রদর্শনের কর্তা ছিলেন স্বয়ং গভর্নমেন্ট, সুতরাং সেখান থেকে হীর চুরি যাবার কোনও ভয় ছিল না। তা ছাড়া যে গ্লাসকেসে আমার হীরা রাখা হয়েছিল, তার চাবি কেবল আমারই কাছে ছিল।
সাতদিন একজিবিশন চলল। আট দিনের দিন আমার হীরা নিয়ে আমি বাড়ি ফিরে এলাম। বাড়ি ফিরে এসে জানতে পারলাম যে আমার হীরা চুরি গেছে, তার বদলে যা ফিরিয়ে এনেছি, তা দু’শ টাকা দামের মেকি পেস্ট।”

কুমার চুপ করিলেন। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, “চুরিটা ধরা পড়বার পর প্রদর্শনীর কর্তৃপক্ষকে কিংবা পুলিশকে খবর দেননি কেন?”
কুমার বলিলেন, “খবর দিয়ে কোনও লাভ হত না, কারণ কে চুরি করেছে, চুরি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা জানতে পেরেছিলাম।”
“ওঃ” – ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ক্ষণকাল কুমারের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, “তারপর বলে যান।”
কুমার বলিতে লাগিলেন, “এ কথা কাউকে বলবার নয়। পাছে জানাজানি হয়ে পারিবারিক কলঙ্ক বার হয়ে পড়ে, খবরের কাগজে এই নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়ে যায়, এই ভয়ে বাড়ির লোককে পর্যন্ত একথা জানাতে পারি নি। জানি শুধু আমি আর আমার বৃদ্ধ দেওয়ান মহাশয়।”

“কথাটা আরও খোলসা করে বলা দরকার। পূর্বে বলেছি, আমার এক কাকা আছেন। তিনি কলকাতায় থাকেন, স্টেট থেকে মাসিক তিন হাজার টাকা খরচা পান। তাঁর নাম আপনারা নিশ্চয় শুনেছেন, তিনিই বিখ্যাত শিল্পী এবং বৈজ্ঞানিক স্যর দিগিন্দ্রনারায়ণ রায়। তাঁর মতো আশ্চর্য মানুষ খুব কম দেখা যায়। বিলেতে জন্মালে তিনি বোধ হয় অদ্বিতীয় মনীষী বলে পরিচিত হতে পারতেন। যেমন তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, তেমনই অগাধ পাণ্ডিত্য। গত মহাযুদ্ধের সময় তিনি প্ল্যাস্টার অফ প্যারিস সম্বন্ধে কি একটা তথ্য আবিষ্কার করে ইংরাজ গভর্নমেণ্টকে উপহার দিয়েছিলেন – তার ফলে ‘স্যর’ উপাধি পান। শিল্পের দিকেও তাঁর কি অসামান্য প্রতিভা, তার পরিচয় সম্ভবত আপনাদের অল্পবিস্তর জানা আছে। প্যারিসের শিল্প প্রদর্শনীতে মহাদেবের প্রস্তরমূর্তি একজিবিট করে তিনি যে সম্মান ও প্রশংসা লাভ করেন, তা কারুর অবিদিত নেই। মোটের পর এমন বহুমুখী প্রতিভা সচরাচর চোখে পড়েনা।” বলিয়া কুমার বাহাদুর একটু হাসিলেন।
আমরা নড়িয়া চড়িয়া বসিলাম। কুমার বলিতে লাগিলেন, “কাকা আমাকে কম স্নেহ করেন না, কিন্তু একটি বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আমার মতভেদ হয়েছিল। ঐ হীরাটা তিনি আমার কাছে চেয়েছিলেন। হীরাটার উপর তাঁর একটা অহেতুক আসক্তি ছিল। তার দামের জন্য নয়, শুধু হীরাটাকেই নিজের কাছে রাখবার জন্যে তিনি প্রায় পাগল হয়ে উঠেছিলেন।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “হীরাটার দাম কত হবে?”
কুমার ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “খুব সম্ভব তিন পয়জার। টাকা দিয়ে সে জিনিস কেনবার মত লোক ভারতবর্ষে খুব কমই আছে। তা ছাড়া আমরা কখনও তার দাম যাচাই করে দেখিনি। গৃহদেবতার মতোই সে হীরাটা অমূল্য ছিল। সে যাক। আমার বাবার কাছেও কাকা ঐ হীরাটা চেয়েছিলেন, কিন্তু বাবা দেননি। তারপর বাবা মারা যাবার পর কাকা আমার কাছে সেটা চাইলেন। বললেন, ‘আমার মাসহারা চাই না, তুমি শুধু আমায় হীরাটা দাও।’ বাবা মৃত্যুকালে আমাকে এ বিষয়ে সাবধান করে দিয়েছিলেন, তাই জোড়হাত করে কাকাকে বললাম, ‘কাকা, আপনার আর যা ইচ্ছা নিন, কিন্তু ও হীরাটা দিতে পারব না। বাবার শেষ আদেশ।’ কাকা আর কিছু বললেন না, কিন্তু বুঝলাম, তিনি আমার উপর মর্মান্তিক অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তারপর থেকে কাকার সঙ্গে আর আমার দেখা হয় নি।
তবে পত্র ব্যবহার হয়েছে। যেদিন হীরা নিয়ে কলকাতা থেকে ফিরে এলাম, তার পরদিন কাকার কাছ থেকে এক চিঠি এল। চোট্ট চিঠি, কিন্তু পড়ে মাথা ঘুরে গেল। এই দেখুন সে চিঠি।”

Pages: 1 2 3 4 5
Pages ( 1 of 5 ): 1 23 ... 5পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress