Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সীমানা ছাড়িয়ে || Syed Shamsul Haque » Page 5

সীমানা ছাড়িয়ে || Syed Shamsul Haque

কদিন আগে মাসুদের চিঠি

কদিন আগে মাসুদের চিঠি পেয়েছিল ও ঢাকা আসছে। মনে মনে রোজই অপেক্ষা করছিল কখন মানুষটা এসে পৌঁছুবে। তখন কী হবে, সে সম্পর্কে কিছুই যদিও সে ভাবেনি, তবু বলা চলে বোঝাঁপড়া করার একটা সিদ্ধান্ত সে নিয়েছিল।

নিজের কাছে অত্যন্ত সৎ হলে এমনি নির্মম হয় মানুষ। কিন্তু আবাল্য এই শিক্ষাই তো সে পেয়েছে।

হঠাৎ করে বাইরেই আজ দেখা হয়েছে মাসুদের সঙ্গে। সকালে। রিকশায় উঠছিল, পাশ থেকে সবুজ জীপ থামিয়ে গলা বাড়িয়ে মাসুদ বলল, আমি।

তার দিকে ভালো করে তাকাতে পারল না জরিনা। কিন্তু সেটা এক মুহূর্তের জন্য। পরে খুব সরাসরি তাকিয়ে বলল, তোমার সাথে কথা আছে, এক্ষুণি।

পরে কিন্তু অনুতাপ হয়েছিল খুব–বৃষ্টির সময়ে, নিজের ঘরে। কেন সে অধীর হয়ে উঠেছিল কথা বলবার জন্য? কী দায় পড়েছিল তার? এক মুহূর্তের এই অসতর্কতার দরুণ নিজেকে যেন কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছিল না জরিনা।

মাসুদকে নিয়ে একটা রেস্তারাঁয় গিয়েছিল। জরিনা সরাসরি বলেছিল, কেন তুমি সবাইকে বলতে গেলে এসব? তাছাড়া আমি তো তোমাকে কোনদিন বলিনি যে ভালোবাসি।

তোমাকে আর বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে হয় না।

অভিযোগটা মাসুদ শুনছিল চোখ নাবিয়ে, মুখ নাবিয়ে। যেন এমনি করে থাকলে, তাকে স্পর্শ না করেই তার ওপর দিয়ে কথাগুলো পেছনের দেয়ালে চলে যাবে। ভঙ্গিটা দেখে আরো গা জ্বালা করল জরিনার। এবং এককোণে একটু মমতাও কি ছিল না? ছিল হয়ত।

কী, কথা বলছ না যে?

কী বলব?

আমি ঘৃণা করি খুব ঘৃণা করি।

কী?

যারা সত্যি কথা বলতে ভয় পায়।

জানি।

নিশ্চয়ই জানো না। জানলে কেন নিজে থেকে কথা বানালে? তোমাকে বিয়ে করবার কথা উঠালো কে?

মাসুদ তবু কিছু বলল না। জরিনা তখন নিজের সঙ্গে ভীষণ সংগ্রাম করছে। একদিকে, ওকে গলা ধাক্কা দিয়ে পথের ওপরে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে অন্যদিকে ইচ্ছে করছে মমতা দিয়ে ভরিয়ে দিতে। মনে মনে মাসুদকে সে বলল তুমি সাবধানে উত্তর দিও, তোমার কথার ওপরে সম্পূর্ণ নির্ভর করছে লড়াইয়ে কোন পক্ষ জিতে যাবে; আমার নিজের কোনো হাত নেই।

মাসুদ হঠাৎ চোখ তুলে বলল, হ্যাঁ বলেছি।

তার কণ্ঠে ঔদ্ধত্য মেশানো। হাসি পেল জরিনার। মাথা দোলালো সে। যেন বলতে চাইলো–না, বন্ধু না।

আবারো বলল মাসুদ, বলেছিলাম–একজন দুজনকে।

আর আমিই নাকি পাগল হয়ে আছি? তুমি রাজি হচ্ছি না?

কে বলেছে?

সেইটাই জানতে চাই?

যেন কী একটা ভীষণ জিদ চেপে গেছে জরিনার।

মাসুদ তখন খুব অন্তরঙ্গ কণ্ঠে শুধিয়েছে, আচ্ছা, একটা কথা জিগ্যেস করব?

চোখ দিয়ে নীরবে সম্মতি দিল জরিনা।

আমি বুঝতেই পারছি না, এ নিয়ে এত বিচলিত হবার কী আছে!

কিছু কি নেই?

নিজের কণ্ঠে ব্যঙ্গ শুনতে পায় জরিনা।

কী জানি, তোমার কাছে থাকতে পারে। আমার চোখে পড়ছে না। আমি তোমাকে ভালোবাসা দিয়েছি, এটা সত্যি। বিয়ের কথা যে ভানিনি তাও নয়। সেটা দশজনে জানলে কী এমন হয়?

এই হয়, যে আমার ক্ষতি হয়।

কেন?

বাহ, নিজে যা জানলাম না, বুঝলাম না, তা হঠাৎ করে মানতে যাবো কেন?

তাহলে–

কী তাহলে?

তাহলে, এতদিন কী বলেছো তুমি আমাকে? আমাকে জেনে শুনেও প্রশ্রয় দিলে কেন? ভালো না বাসলে, ফিরিয়ে দিলে না কেন? কে তোমাকে বলেছিল, আমার সবকিছু নিষ্ঠুরের মতো, স্বার্থপরের মতো, নিজের করে নিতে? দিনের পর দিন?

শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠল জরিনা। অতি কষ্টে সামলে নিল নিজেকে। মুখে শুধু বলল, থাক। আমি চলোম।

মাসুদ উঠে দাঁড়িয়ে, তার দাঁড়ানোর আগেই পথ আগলে বলল, নিজের কথাই বলে গেলে, আমারও কিছু বলার থাকতে পারে।

ভাবলো জরিনা। ভেবে সিদ্ধান্ত নিল– যা বলে বলুক। যে মানুষটা কারণে কিংবা অকারণে অসহ্য হয়ে উঠেছে, সে যা খুশি বলুক তাতে তার কিছু এসে যাবে না।

মাসুদ বসলো না। দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, আমি সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম না, কবিতার বই হাতে নিয়েও দিন কাটে না আমার। ফলিত বিজ্ঞানের সেরা ছাত্র ছিলাম তার মানে, তোমার কাছে একেবারে রস–বিবর্জিত আঁকজোঁকের মানুষ। আমি এসব কিছু বুঝতে পারি না–তোমার মতো নিজের মনকে চিবিয়ে চিবিয়ে রস নেওয়ার মতো রসনা আমাকে আল্লাহ দেননি।

কী–কী বলতে চান আপনি?

বজ্রপাতের মত শোনাল জরিনার উচ্চারণ –মাসুদের কাছে, এবং তার নিজের কাছেও। মাসুদ বলল, ভালোই হলো। বেশ করলেন। এবারে আপনি যেতে পারেন। তবে যাবার আগে একটা কথার উত্তর দিয়ে যাবেন? কটা প্রেম করেছেন আরো?

বিস্মিত হলো জরিনা মাসুদের অপমান করবার নির্ভেজাল ক্ষমতা দেখে। আর আক্রোশ হলো নিজের ওপর। নিজেকে শাস্তি দেয়ার হিংস্র বন্য একটা ইচ্ছেয় ভেতরটা দুলতে লাগল। বলল, অনেক। হিসাব করলে তা এক ডজন হবে বৈকি। আপনার তো মোটে একটা। লাফ গেম খেয়ে থুতু ছিটোচ্ছেন এখন।

জানতাম। নইলে লোকের রটনাকে এত ভয় করে আপনার? সবার কাছেই মুখোশ খুলবে যে। ধন্যবাদ, আপনার ভ্যানিটি ব্যাগে যে কটা ফুল আছে থাক, আমি আর সংখ্যা বাড়াতে চাই না।

তখন উঠে দাঁড়াল জরিনা। বলল, আর কিছু বলার আছে আপনার?

মাসুদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। জরিনা আবার শুধালো, বলুন যত খুশি সময় চান, দিতে পারি।

তবু মাসুদ কিছু বলল না। তখন জরিনা বেরিয়ে এলো কেবিনের সবুজ পর্দা ঠেলে বাইরে, সেখান থেকে পথে; পথটা ঠিক আগের মতই ব্যস্ত, উদাসীন, চঞ্চল।

সন্ধ্যার পর পরই আলীজাহ্ ঢাকা এসে পৌঁছুলো। ট্যাক্সি থামবার শব্দে রোকসানা বারান্দা থেকে উঁকি দিয়েছিল। দেখতে পেয়ে ফটক অবধি এগিয়ে এসে বলল, কেন, জরিনা এয়ারপোর্টে যায়নি?

না। নাতো।

আলীজাহ্‌ও একটু বিস্মিত হয়েছে জরিনাকে এয়ারপোর্টে না দেখে। লাহোরে যাবার পর অন্তত ছসাত বার সে এসেছে ঢাকায়। আর প্রত্যেকবারই এয়ারপোর্টে ছোট্ট মেয়েটির মতো জরিনা পায়ের গোড়ালি তুলে, রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ে, ফুলঝুরির মতো হাসিমুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। তারপর একসঙ্গে ফেরা। ফিরেও কি নিস্তার? সোজা একেবারে জরিনার কামরায় গিয়ে জিরোবে কতক্ষণ, ঝড়ের মতো বলবে, শুনবে, তবে মুক্তি।

এবারে তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। ব্যতিক্রমটা চোখে পড়লেও খুব একটা কষ্ট হয়নি আলীজাহ্‌। কেননা যে ম্লান মন নিয়ে সে আজ ফিরে আসছে ঢাকায় তা যে কোনো বিচ্যুতি সহ্য করতে পারে। আজ আলীজাহ্‌ সন্দেহ হচ্ছে, আদৌ তার মন বেঁচে আছে কিনা।

আলীজাহ্‌ গিয়েছিল লাহোরে। তার আগে প্রায় বছর দুয়েক ঢাকায় থেকেছে। ঢাকায় ফিল্ম স্টুডিও নেই। আলীজাহ্ তাই চেষ্টা করেছে এখানে আপাতত চলচ্চিত্রে না হোক, অন্তত নাট্য আন্দোলন গড়ে তোলা যায় কিনা। একটা নাটক লিখেছিল তখন। এই হঠাৎ জেলা–সদর থেকে বাজধানীতে রূপান্তবিত হয়ে যাওয়া, দ্রুত বেড়ে ওঠা, দ্রুত চেহারা বদলানো জ্বলন্ত, প্রখব অচেনা ঢাকাকে সে রক্তের মতো ব্যবহার করেছিল তার নাটকের জন্য। আর ছিল নতুন মধ্যবিত্তের কয়েকটা মানুষ প্রধান কুশীলব তারা। আলীজাহ্‌ সন্ধানী নির্মম চোখে নগ্নরূপ ফুটে বেরিয়েছিল এই মধ্যবিত্তেরযারা আসলে জাত মধ্যবিত্ত নয় মোটেই। দেশভাগের প্রবল ধাক্কায় নিচতলা থেকে উঠে এসেছে একদল, আরেকদল সীমান্তের ওপারে সব ফেলে এসে নিচে নেবে গেছে। দুরে যে মিলন–মঞ্চ সেটাই তো আজকের মধ্যবিত্তের পনেরো আনা। তাই মেজাজ পায়নি পুরোপুরি কেউই–মিশেল হয়নি–মানুষের চেতনা তো সজীব, তাই নেবুলার মতো অন্তস্থলে প্রবল ধর্ণমান সংঘর্ষ চলেছে। কে জানে কোন নক্ষত্র, কোন সৌরজগত জন্ম নেবে –ভালো কিংবা মন্দের জন্য। মোটামুটি এই ছিল তার বিষয়। নাটকটি পরিচালনা করেছিল আলীজাহ্ নিজেই। ভূমিকায় জরিনা, নূরুন্নাহার দুজনকেই দেখা গেছে। জরিনাকে আলীজাহ্ বলেছিল–তুই যে চরিত্রটা করতে যাচ্ছিস রিনু, সেটা খুব কঠিন। কিন্তু তোর কাছে খুব সোজা হবে। তুই শুধু ঢাকা আসবার পথে ট্রেনে সেই ছুঁড়ে দেয়া চুনের পানিতে বউটার অন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা মনে কর। ঠিক ওই মুহূর্তে তোর মুখটা যেমন হয়েছিল, তোর বিবেক যা বলছিল –ঠিক সেই মুখ, সেই ভাবনাটা আমি চাই।

নাটকের উপস্থাপনাও ছিল তেমনি পরীক্ষামূলক, তেমনি নতুন। গোটা মঞ্চ আলাদা আলাদা উচ্চতায় তিনটে ভাগে ভাগ করা ছিল। আর পেছনে আকাশ থেকে ঝোলানো ছিল ধূসর রঙের ড্রেপারি একটা অর্ধবৃত্ত সৃষ্টি করে। সবচেয়ে নিচের তল ছিল মিহি নীল, মাঝের তল সবুজ আর ওপরের তল গোলাপি আলোয় উদ্ভাসিত। রংটা ঠিক বোঝা যাবে না যতক্ষণ না কোনো শিল্পী এসে দাঁড়াবে। একেকটা দৃশ্য অভিনয় চলছিল একেক তলে। সব শেষের দৃশ্যে তিনটে তলেই একসঙ্গে তিনটে দৃশ্যের সম–উপস্থাপনা করা হয়েছিল।

বিদগ্ধ মহলে সাড়া পড়ে গিয়েছিল।

কিন্তু লক্ষ্য যার চলচ্চিত্র সে তৃপ্ত হতে পারল না নাটকের মাধ্যমে তা আসুক না খ্যাতি, আসুক না প্রতিষ্ঠা। আলীজাহ্‌ লাহোরে চলে গেল। বেনামিতে শস্তা কাহিনী, চিত্রনাট্য লেখা চলল, আর অনুসন্ধান চলল এমন এক প্রযোজকের যে আলীজাহ্‌ ইচ্ছে মতো আলীজাকে ছবি তৈরি করতে দেবে।

জরিনা বলেছিল, ঢাকায় থেকে যাও, আলীচাচা। লাহোঙ্কে গিয়ে মনের মতো ছবি বানালেও তো বানাবে উর্দুতে। তারচে আমার মনে হয় বাংলাতে নাটক লেখা ঢের ভালো।

আলীজাহ্ তখন বলেছে, দ্যাখ, চলচ্চিত্র হচ্ছে প্রথমে প্লাস্টিক আর্ট, তারপরে অন্য কিছু। ভাষা এখানে একেবারেই গৌণ। যে কোনো ভাষাতেই ছবি হোক না কেন, আসলে তা ছবি হওয়া চাই, পূরণ করা চাই প্লাস্টিক আর্টের, চলচ্চিত্র মাধ্যমের শর্তগুলো।

অবশেষে অনেক কাল পরে, অনেক বাজে ছবি লিখবার পরে, আলীজাহ্‌ মাস চারেক আগে ছবি করবার একটি সুযোগ পেল লাহোরে। সুযোগ মানে, কষ্ট হবে, পারিশ্রমিক মিলবে না, পাই পাই হিসেব করে কাজ করলে তবে ছবি হবে। অর্থাৎ মূলধন অতি সামান্য। ভিক্ষের মত করে প্রায় চেয়ে নেয়া লাখ খানেক টাকা। তিনজনের কাছ থেকে অঙ্কটা এসেছে।

বছরের পর বছর মুখে থুতু উঠিয়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুঝিয়ে, রাজি করিয়ে যখন মূলধনটা পাওয়া গেল তখন আলীজাহ্ তার যৌবন ফিরে পেল যেন–যে যৌবন, হিসেব করতে বসলে, পৃথিবীর চোখে অনেকদিন আগেই চলে গেছে।

বছরের পর বছর ধরে খেটেখুটে তৈরি করা চিত্রনাট্যটাকে বার করলো। কত রাত গেছে এর পৃষ্ঠা খুলে। কল্পনার পর্দায় নিজের বানানো ছবি তৃষিতের মত সে দেখেছে, একেবারে শুরু থেকে, যেখানে ফেড ইন করছে জরিনার কবিতা থেকে উদ্ধৃতি–

Beneath the black sun
We shall rise in a flame.

এত বিশদ করে, ধারাবাহিকভাবে সে প্রতিটি শট দেখেছে যে বানানোর আগেই তার মনের ভেতরে ছবিটি অনেকদিন আগে বানানো হয়ে গেছে।

সেদিন রাতে সে শাহ সাদেক আলীকে লেখল সুসংবাদ। সাদেক ফেরৎ ডাকেই লিখলেন, সাধনার সিদ্ধি অনিবার্য এ ছিল আমার চিরদিনের বিশ্বাস।

আর জরিনা, সে লিখেছিল– ইস, আমার যে কী খুশি হচ্ছে আলীচাচা তোমার চিঠি পেয়ে। জানো, ভীষণ হিংসে হচ্ছে তোমাকে। পৃথিবীর কাছ থেকে নিজের পাওনা আদায় করে নিতে পারলে তাহলে। আমি কিন্তু অন্ধকারেই রইলাম। তোমার উদাহরণ আমাকেও খুব সাহস দিচ্ছে। আমি জানি, তুমি যে ছবি করবে তা শুধু ছবি হবে না, হবে সৃষ্টি, তুমি হবে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী। জয় হোক তোমার।

ছবি তৈরির প্রায় সবগুলো কাজ এক অমানুষিক ধৈর্য আর পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে করে চলল আলীজাহ্। তিনমাসে বইয়ের দুতৃতীয়াংশের কাজ শেষ হলো। ইতিমধ্যে মূলধন এলো ফুরিয়ে। প্রযোজক হারুণ সাহেব বললেন, আলী, যতটুকু কাজ হয়েছে, এডিট করে কোনো ডিস্ট্রিবিউটারকে দেখাই। নইলে আমাদের পকেট থেকে কামান দাগলেও আর এক আধলা বেরুবে না।

ঠিক এ ধরনের একটা পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না আলীজাহ্‌। আজীবন প্রতীক্ষার পর হাতের কাছে এসেও বুঝি আকাঙিক্ষত ফিরে যায়। এক মিনিটের জন্য সে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো হারুণ সাহেবের বাসায় সাজানো ড্রইংরুমে একটা অতিকায় পুতুলের মতো। পরে বলল, আচ্ছা, তাই হবে।

একজন অবতারের অন্তর ছিল আলীজাহ্‌। যে সন্দেহ, যে ভয় সে করেছিল তাই ঘটলো। সেই দুতৃতীয়াংশের কাজ মোটামুটিভাবে দাঁড় করিয়ে লাহোরের সমস্ত ডিস্ট্রিবিউটরকে একে একে দেখানো হলো। সবাই এক রোল দেখেই দরোজা খুলে বেরিয়ে গেল। কেউ বলল– সমঝ মে নেহি আতা! কেউ বলল–বাকোয়াস, বাণ্ড। আবার কেউ বলল ডাইরেকটর সাব কহি পাগল তো নেহি হ্যাঁয়? পহলা ডকটরকে পাস যাও– ডকটর।

সবার কাছে এই একই কথার নানা রূপ শুনে হারুণ সাহেব আলীজাকে গম্ভীর হয়ে বললেন, এ রকম হলে তো চলবে না। টাকা খাঁটিয়ে টাকাই যদি না পেলাম, তাহলে টাকাগুলো রাভি নদীর পানিতে ফেলে দেয়াই বেহতর। তাতে তবু সান্ত্বনা থাকবে, সাদকা দিয়েছি, অক্ষয় পুণ্য হবে আমার।

হাল ছেড়ে দিল না আলীজাহ্‌। বলল, ঠিক আছে আমি করাচি যাচ্ছি, দেখি সেখান থেকে কাউকে পাই কিনা।

হাতে তেমন টাকা নেই; তবু, করাচি গিয়েছিল সে। পুরো পনেরো দিন দরোজায় দরোজায় ঘুরছে। কিন্তু সেই একই উত্তর, একই ব্যবহার মিলেছে। লাহোরে পা দিতেই হারুণ সাহেব বললেন, আলী, এখনো হুশ হোক তোমার। ভেবেছ, মাথা নিচু করে বসে থাকলেই সব সমাধান হয়ে যাবে? তা তোমার জন্যে হতে পারে। কিন্তু আমরা কী তোমার নেগেটিভ থেকে নেলপলিশ বানিয়ে বাড়ি ফিরবো?

আলীজাহ্‌ বলেছে, কিন্তু ব্যবস্থা তো একটা করতেই হবে। এখন আপনি বা আমি কেউই ছবি ফেলে রাখতে পারি না।

নিশ্চয়ই। ব্যবস্থা তো করতেই হবে। আমি বলি, তুমি একটা নাচ আর একটা ড্রিম সিকোয়েন্স দাও। শেষ সেটের সিনগুলোতে কমেডিয়ান কাউকে রাখা যায় না? তাহলে দেখবে সব ব্যাটারই ঘর থেকে সুড়সুড় করে টাকা বেরিয়ে আসছে। এটাই করো।

নিজের মাথাটা কেউ পিস্তল দিয়ে উড়িয়ে দিলেও এতটা বিমূঢ় হতো না আলীজাহ্‌। যে আপোষ সে করবে না বলে এতকাল ভাগ্যের হাতে মার খেয়েছে, সহ্য করেছে, সেই আপোষ কি তাকে শেষ অবধি করতে হবে? কীসের অভাব ছিল তার। ইচ্ছে করলে জনপ্রিয় নায়ক হতে পারত, বহু সংস্করণওয়ালা বইয়ার লেখক হতে পারত, সরকারের সব সেরা পদের বেতনভোগী সেবক হতে পারত, সংসার করতে পারত–বউ ছেলে, মেয়ে, বাড়ি, গাড়ি, সবই হতে পারত তার। তার সঙ্গের যারা তারা তার চেয়ে কম সুযোগ, কম মেধা নিয়েই, বিষয়ীদের চোখে, অনেক উন্নতি করেছে। আর সে? এমনকি বুকের ভেতরে যন্ত্রণাকর একটা বিরাট ক্ষত, আর কেউ জানুক বা না জানুক, এই জিদ থেকেই সে সইতে পেরেছে। জরিনাকে নিয়ে গিয়েছিল যে মহিলার জন্মদিনে, সেও তো বলেছিল আমি তোমার কথা পুরো বিশ্বাস করি, তুমি আমাকে ভালোবাসো; কিন্তু এ–কী সর্বনাশা নেশা তোমার? শিল্প করবে, কিন্তু না খেয়ে শিল্প? পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে আলো–অন্ধকারের সঙ্গে আপোষ করেই বেঁচে থাকতে হয়। সেটাকে অস্বীকার করে শুধু নিজে কষ্ট পাবে, পৃথিবীর তাতে একটুও এসে যাবে না।

আলীজাহ্‌ ভালোবাসাকেও তাই সইতে হয়েছে বিচ্ছেদ। ক্ষত হয়েছে। তা হোক। ক্ষত আমার ফুল।

না, আলীজাহ্ আপোষ করবে না।

হারুণ সাহেবের কাছ থেকে ফিরে এসে, সেদিন নিজের ঘরে টেবিলে মাথা রেখে, জীবনে এই প্রথম আলীজাহ্ কেঁদেছে।

পরপর চারদিন সে বোঝালো হারুণ সাহবেকে। কিন্তু উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে তারো গোঁ। বলেছেন, যা বলছি তাই করো। পাগলামি কোরো না। জানো কিছু –লোকমান সাহেব একলাখ টাকা নিয়ে তৈরি, শুধু দু–তিনটে সিন ঢোকানোর যা ওয়াস্তা। মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করো, আলী। তোমার জন্যে আমরা ভুখা মরব কেন?

পৃথিবী জুড়ে শিল্পীর জন্য এই একই জবাব। কোনো বদল নেই, কোনো নতুনত্ব নেই। সেই একই অভিযোগ তোমার জন্য আমি কেন মরবো?

অসম্ভব, আমি পারবো না।

তাহলে কী আমাকে অন্য পরিচালক ডেকে বই শেষ করাতে হবে?

হারুণ সাহেবের কণ্ঠ ছিল শীতল, নিষ্ঠুর, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আলীজাহ্‌ ঘুরে তাকায়নি তার দিকে তখন মঞ্চে যা সে হয়ত নিজেই নির্দেশ দিত করবার জন্য, যদি এই ঘটনাটা দেখানো হতো মঞ্চে। সেই মহিলার মুখ অস্পষ্ট দেখা যায় যেন স্মৃতির পটভূমিতে। কিন্তু ভালোবাসতে বাসতে চলে আসা যায়, সৃষ্টি করতে করতে সরে যাওয়া যায় না–অন্তত আলীজাহ্‌ তা পারবে না।

তার আগে আমি আমার নেগেটিভ জ্বালিয়ে দেব। হবে না, আমার ছবি হবে না, আমি ছবি করবো না।

বিলাপের মতো শুনিয়েছে আলীজাহ্‌ কণ্ঠ। বিলাপটা মাথার ভেতরে, বুকের ভেতরে, কয়েকদিন ঝড়ের মতো মাথা কুটে মরেছে তারপর।

পড়ে থাক ছবি, ডুবে যাক তার প্রতিভা, করুন হারুণ সাহেব তার ছবি শেষ, আলীজাহ্‌ মরে গেছে। মরে গেছে নিজের কাছে, পৃথিবীর কাছেও।

এতদিন ছবি করিনি, তার ছিল জ্বালা। কিন্তু ছবি করতে করতে ফিরে আসা, নিজের সৃষ্টিকে কলঙ্কিত হবার জন্য তুলে দিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া এবং কিছুই করতে না পারা–এ যন্ত্রণা মৃত্যুর, এর প্রাপ্তি অন্ধকার।

ছবি করতে করতে ছবির সঙ্গে তার হৃদস্পন্দন একতারে বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। আজ তাই আর মমতা নেই নিজের ওপর। যত নিষ্ঠুরতা থাকতে পারে সব এখন ডেকে আনা চলে নিজেকে চূড়ান্ত রকমে পীড়িত করবার জন্য; নিজের জন্য যে কোনো অবহেলা যে কোনো ক্ষতি।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress