Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রাত্রি-ডাকিনী
প্রথম পরিচ্ছেদ

ভূষণা দখল হইল। যুদ্ধে সীতারামের জয় হইল। তোরাব খাঁ মৃণ্ময়ের হাতে মারা পড়িলেন। সে সকল ঐতিহাসিক কথা। কাজেই আমাদের কাছে ছোট কথা। আমরা তাহার বিস্তারিত বর্ণনায় কালক্ষেপ করিতে পারি না। উপন্যাসলেখক অন্তর্বিষয়ের প্রকটনে যত্নবান হইবেন-ইতিবৃত্তের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখা নিষ্প্রয়োজন।
ভূষণা অধিকৃত হইল। বাদশাহী সনদের বলে এবং নিজ বাহুবলে সীতারাম বাঙ্গালার দ্বাদশ ভৌমিকের উপর আধিপত্য স্থাপন করিয়া মহারাজা উপাধি গ্রহণপূর্বক প্রচণ্ড প্রতাপে শাসন আরম্ভ করিলেন।
শাসন সম্বন্ধে আগেই গঙ্গারামের দণ্ডের কথাটা উঠিল। তাহার বিরুদ্ধে প্রমাণের অভাব ছিল না। পতিপ্রাণা অপরাধিনী রমাই সমস্ত বৃত্তান্ত অকপটে সীতারামের নিকট প্রকাশ করিল। বাকি যেটুকু, সেটুকু মুরলা ও চাঁদশাহ ফকির সকলই প্রকাশ করিল। কেবল গঙ্গারামকে জিজ্ঞাসা করা বাকি-এমন সময়ে এ কথা লইয়া গোলযোগ উপস্থিত হইল।
কথাগুলা রমা, অন্তঃপুরে বসিয়া সীতারামের কাছে চক্ষুর জলে ভাসিতে ভাসিতে বলিল। সীতারাম তাহার একবর্ণ অবিশ্বাস করিলেন না। বুঝিলেন, সরলা রমা নিরপরাধিনী, অপরাধের মধ্যে কেবল পুত্রস্নেহ। কিন্তু সাধারণ পুরবাসী লোক তাহা ভাবিল না। গঙ্গারাম কয়েদ হইল কেন? এই কথাটা লইয়া সহরে বড় আন্দোলন পড়িয়া গেল। কতক মুরলার দোষে, কতক সেই পাহারাওয়ালা পাঁড়ে ঠাকুরের গল্পের জাঁকে; রমার নামটা সেই সঙ্গে লোকে মিলাইতে লাগিল। কেহ বলিল যে, গঙ্গারাম মোগলকে রাজ্য বেচিতে বসিয়াছিল; কেহ বলিল যে, সে ছোট রাণীর মহলে গিরেফতা হইয়াছিল। কেহ বলিল, দুই কথাই সত্য, আর রাজ্য বেচার পরামর্শে ছোট রাণীও ছিলেন। রাজার কানে এত কথা উঠে না, কিন্তু রাণীর কানে উঠে–মেয়েমহলে এ রকম কথাগুলা সহজে প্রচার পায়–শাখা-প্রশাখা সমেত। দুই রাণীর কানেই কথা উঠিল। রমা শুনিয়া শয্যা লইল; কাঁদিয়া বালিশ ভাসাইল, শেষ গলায় দড়ি দিয়া কি জলে ডুবিয়া মরা ঠিক করিল। নন্দা শুনিয়া বুদ্ধিমতীর মত কাজ করিল।
নন্দা খুঁজিয়া রমা যেখানে বালিসে মুখ ঝাঁপিয়া কাঁদিতেছে, আর পুকুরে ডুবিয়া মরা সোজা, কি গলায় দড়ি দিয়া মরা সোজা, ইহার যতদূর সাধ্য মীমাংসা করিতেছে, সেইখানে গিয়া তাহাকে ধরিল। বলিল, “দেখিতেছি, তুমিও ছাই কথা শুনিয়াছ |” রমা কেবল ঘাড় নাড়িল–অর্থাৎ শুনিয়াছি |” চক্ষুর জল বড় বেশী ছুটিল।
নন্দা তাহার চক্ষুর জল মুছাইয়া, সস্নেহবচনে বলিল, কাঁদিলে কলঙ্ক যাবে না, দিদি! না কাঁদিয়া, যাতে এ কলঙ্ক মুছিয়া তুলিতে পারি, তাই করিতে হইবে। পারিস্ ত উঠিয়া বসিয়া, ধীরে সুস্থে আমাকে সকল কথা ভাঙ্গিয়া চুরিয়া বল দেখি। এখন আমাকে সতীন ভাবিস না–কালি চূন তোর গালে পড়ুক না পড়ুক, রাজারই বড় মাথা হেঁট হয়েছে। তিনি তোরও প্রভু-আমারও প্রভু, এ লজ্জা আমার চেয়ে তোর যে বেশী, তা মনে করিস না। আর মহারাজা আমাকে অন্তঃপুরের ভার দিয়া গিয়াছিলেন,–তাঁর কানে এ কথা উঠিলে আমি কি জবাব দিব?”
রমা বলিল, “যাহা যাহা হইয়াছিল, আমি তাঁহাকে বলিয়াছি; তিনি আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া আমাকে ক্ষমা করিয়াছেন। আমার ত কোন দোষ নাই |”
ন। তা বলিতে হইবে না–তোর যে কোন দোষ নাই, সে কথা আমায় বলিয়া কেনদুঃখ পা? তবে কি হইয়াছিল, তা আমাকে বলিস না বলিস।
র। বলিব না কেন? আমি এ কথা সকলকেই বলিতে পারি।
এই বলিয়া রমা, চক্ষুর জল সামলাইয়া, উঠিয়া বসিয়া, সকল কথা যথার্থরূপে নন্দাকে বলিল। নন্দার সে কথায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস জন্মিল। নন্দা বলিল, “যদি ঘুণাক্ষরে আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়া এ কাজ করিতে দিদি, তবে কি এত কাণ্ড হইতে পায়? তা যাক–যা হয়ে গিয়েছে, তার জন্য তিরস্কার করিয়া এখন আর কি হইবে? এখন যাহাতে আবার মানসম্ভ্রম বজায় হয়, তাই করিতে হইবে |”
র। যদি তা না কর দিদি, তবে তোমায় নিশ্চিত বলিতেছি, আমি জলে ডুবিয়া মরিব, কি গলায় দড়ি দিয়া মরিব। আমি ত রাজার মহিষী–এমন কাঙ্গাল গরিব ভিখারীর মেয়ে কে আছে যে, অপবাদ হইলে আর প্রাণ রাখিতে চায়?
ন। মরিতে হইবে না, দিদি! কিন্তু একটা খুব সাহসের কাজ করিতে পারিস্? বোধ হয়, তা হলে কাহারও মনে আর কোন সন্দেহ থাকিবে না।
র। এমন কাজ নাই যে, এর জন্য আমি করিতে পারি না। কি করিতে হইবে? ন। তুমি যে রকম করিয়া আমার কাছে সকল কথা ভাঙ্গিয়া চুরিয়া বলিলে, এই রকম করিয়া তুমি যার সাক্ষাতে ভাঙ্গিয়া চুরিয়া বলিবে, সেই তোমার কথায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিবে, ইহা আমার নিশ্চিত বিবেচনা হয়। যদি রাজধানীর লোক সকলে তোমার মুখে এ কথা শুনে, তবে আর এ কলঙ্ক থাকে না।
র। তা, কি প্রকারে হইবে?
ন। আমি মহারাজকে বলিয়া দরবার করাইব। তিনি ঘোষণা দিয়া সমস্ত নগরবাসীকে সেই দরবারে উপস্থিত করিবেন; সেখানে গঙ্গারামের সাক্ষাৎকারে, সমস্ত নগরবাসীর সাক্ষাৎকারে, তুমি এই কথাগুলি বলিবে। আমরা রাজমহিষী, সূর্যও আমাদিগকে দেখিতে পান না। এই সমস্ত নগরবাসীর সম্মুখে বাহির হইয়া, মুক্তকণ্ঠে তুমি এই সকল কথা কি বলিতে পারিবে? পার ত সব কলঙ্ক হইতে আমরা মুক্ত হই।
রমা তখন সিংহীর মত গর্জিয়া উঠিয়া বলিল, “তুমি সমস্ত নগরবাসী বলিতেছ দিদি! সমস্ত জগতের লোক জমা কর, আমি জগতের লোকের সম্মুখে মুক্তকণ্ঠে এ কথা বলিব |”
ন। পারিবি?
র। পারিব-নহিলে মরিব।
ন। আচ্ছা, তবে আমি গিয়া মহারাজকে বলিয়া দরবারের বন্দোবস্ত করাই। তুই আর কাঁদিস্ না।
নন্দা উঠিয়া গেল। রমাও শয্যা ত্যাগ করিয়া চোখের জল মুছিয়া, পুত্রকে কোলে লইয়া মুখচুম্বন করিল। এতক্ষণ তাহাও করে নাই।
নন্দা রাজাকে সংবাদ দিয়া অন্তঃপুরে আনাইল। যে কুরব উঠিয়াছে, সকলেই যাহা বলিতেছে, তাহা রাজাকে শুনাইল। তার পর রমার সঙ্গে নন্দার যে কথাবার্তা হইয়াছিল, তাহা সকলই অবিকল তাঁহাকে বলিল। তার পর বলিল, “আমরা দুই জনে গলায় কাপড় দিয়া তোমার পায়ে লুটাইয়া (বলিবার সময়ে নন্দা কাপড় দিয়া জানু পাতিয়া বসিয়া, দুই হাতে দুই পা চাপিয়া ধরিল) বলিতেছি যে, এখন তুমি আমাদের মান রাখ, এ কলঙ্ক হইতে উদ্ধার কর, নহিলে আমরা দুই জনেই আত্মহত্যা করিয়া মরিব |”
সীতারাম বড় বিষণ্ণভাবে-কলঙ্কের জন্যও বটে, নন্দার প্রস্তাবের জন্যও বটে,–বলিলেন, “রাজার মহিষী—আমি কি প্রকারে দরবারে বাহির করিব? কি প্রকারে আপনার মহিষীকে সামান্যা কুলটার ন্যায় বিচারালয়ে খাড়া করিয়া দিব?”
ন। তুমি যেমন বুঝিবে, আমরা কিন্তু তেমন বুঝিব না; কিন্তু সে বেশী লজ্জা, না রাজমহিষীর কুলটা অপবাদে বেশী লজ্জা?
সী। এরূপ মিথ্যা অপবাদ রাজার ঘরে, সীতা হইতে চলিয়া আসিতেছে। প্রথামত কাজ করিতে হইলে এত কাণ্ড না করিয়া সীতার ন্যায় রমাকে আমার ত্যাগ করাই শ্রেয়। তাহা হইলে আর কোন কথা থাকে না।
ন। মহারাজ! নিরপরাধিনীকে ত্যাগ করিবে, তবু তার বিচার করিবে না? এই কি তোমার রাজধর্ম? রামচন্দ্র করিয়াছিলেন বলিয়া কি তুমিও করিবে? যিনি পূর্ণ ব্রহ্ম, তাঁর আর ত্যাগই কি, গ্রহণই বা কি? তোমার কি তা সাজে মহারাজ?
সী। এই সমস্ত প্রজা, শত্রু মিত্র ইতর ভদ্র লোকের সাক্ষাতে আপনার মহিষীকে কুলটার ন্যায় খাড়া করিয়া দিতে আমার বুক কি ভাঙ্গিয়া যাইবে না? আমি ত পাষাণ নহি।
নন্দা। মহারাজ! যখন পঞ্চাশ হাজার লোক সামনে, শ্রী গাছের ডালে চড়িয়া নাচিয়াছিল, তখন কি তোমার বুক দশ হাত হইয়াছিল?
সীতারাম নন্দার প্রতি ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। বলিলেন, “তা হয়েছিল, নন্দা! আবার তেমন হইল না, সেই দুঃখই আমার বেশী |”
ইট‍‍টি মারিয়া পাটখেল খাইয়া, নন্দা জোড়হাতে ক্ষমা প্রার্থনা করিল। জোড় হাত করিয়া নন্দা জিতিয়া গেল। সীতারাম শেষে দরবারে সম্মত হইলেন। বুঝিলেন, ইহা না করিলে রমাকে ত্যাগ করিতে হয়। অথচ রমা নিরপরাধিনী, কাজেই দরবার ভিন্ন আর কর্তব্য নাই।
বিষণ্ণভাবে রাজা, চন্দ্রচূড়ের নিকটে আসিয়া দরবারে কর্তব্যতা নিবেদিত হইলেন। ব্রাহ্মণ ঠাকুরের আব্র‍রু পরদার উপর ততটা শ্রদ্ধা হইল না। তিনি সাধুবাদ করিয়া সম্মত হইলেন। তাঁর কেবল ভয়, রমা কথা কহিতে পারিবে না। সীতারামেরও সে ভয় ছিল। সে যদি না পারে, তবে সকল দিক যাইবে।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

তখন সীতারাম ঘোষণা করিলেন যে, আমদরবারে গঙ্গারামের বিচার হইবে। রাজার আজ্ঞানুসারে নগরবাসী উপস্থিত হইয়া বিচার দর্শন করিবে। আজ্ঞা পাইয়া অবধারিত দিবসে, সহস্র সহস্র প্রজাবৃন্দ আসিয়া দরবার পরিপূর্ণ করিল। দিল্লীর অনুকরণে সীতারামও এক “দরবারে আম” প্রস্তুত করিয়াছিলেন। আজিকার দিন তাহা রাজকর্মচারীদিগের যত্নে সুসজ্জিত হইয়াছিল। দিল্লীর মত তাহার রূপার চাঁদোয়া, মতির ঝালর ছিল না; কিন্তু তথাপি চন্দ্রাতপ পট্টবস্ত্রনির্মিত, তাহাতে জরির কাজ। স্তম্ভ সকল সেইরূপ কারুকার্যখচিত, পট্টবস্ত্রে আবৃত। নানাচিত্রবর্ণরঞ্জিত কোমল গালিচায় সভামণ্ডপ শোভিত, তাহার চারি পার্শ্বে বিচিত্রপরিচ্ছদধারী সৈনিকগণ সশস্ত্র শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দণ্ডায়মান। বাহিরে অশ্বারূঢ় রক্ষিবর্গ শান্তি রক্ষা করিতেছে। সভামণ্ডপমধ্যে শ্বেতমর্মরনির্মিত উচ্চ বেদীর উপর সীতারামের জন্য স্বর্ণখচিত, রৌপ্যনির্মিত, মুক্তাঝালরশোভিত সিংহাসন রক্ষিত হইয়াছে।
ক্রমে ক্রমে দুর্গ লোকারণ্য হইয়া উঠিল। সভামণ্ডপমধ্যে কেবল উচ্চ শ্রেণীর লোকেরাই স্থান পাইল। নিম্ন শ্রেণীর লোকে সহস্রে সহস্রে সভামণ্ডপ পরিবেষ্টিত করিয়া বাহিরে দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল।
বাতায়ন হইতে এই মহাসমারোহ দেখিতে মহারাজ্ঞী নন্দা দেবী রমাকে ডাকিয়া আনিয়া এই ব্যাপার দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন, এই সমারোহের মধ্যস্থানে দাঁড়াইয়া বলিতে পারিবে? সাহস হইতেছে ত?”
র। যদি আমার স্বামিপদে ভক্তি থাকে, তবে নিশ্চয় পারিব।
ন। আমরা কেহ সঙ্গে যাইব? বল ত আমি যাই।
র। তুমিও কেন আমার সঙ্গে এ অসম্ভ্রমের সমুদ্রে ঝাঁপ দিবে? কাহাকে যাইতে হইবে না। কেবল একটা কাজ করি। যখন আমার কথা কহিবার সময় হইবে, তখন যেন আমার ছেলেকে কেহ লইয়া গিয়া আমার নিকট দাঁড়ায়। তাহার মুখ দেখিলে আমার সাহস হইবে।
নন্দা স্বীকৃত হইয়া বলিল, “এখন সভামধ্যে যাইতে হইবে, একটু কাপড়-চোপড় দুরস্ত করিয়া নাও। এই বেলা প্রস্তুত হও |”
রমা স্বীকৃত হইয়া আপনার মহলে গেল। সেখানে ঘর রুদ্ধ করিয়া মাটিতে পড়িয়া যুক্তকরে ডাকিতে লাগিল, “জয় লক্ষ্মীনারায়ণ! জয় জগদীশ্বর! আজিকার দিনে আমার যাহা বলিবার, তাহা বলিয়া, আমি যদি তার পর জন্মের মত বোবা হই, তাহাও আমি তোমার কাছে ভিক্ষা করি। আজিকার দিনে সভামধ্যে আপনার কথা বলিয়া, আর কখনও ইহ জন্মে কথা না কই, তাও তোমার কাছে ভিক্ষা করি। আজিকার দিন মুখ রাখিও। তার পর মরণে আমার কোন দুঃখ থাকিবে না |”
তার পর বেশ পরিবর্তনের কথা মনে পড়িল। রমা ধাত্রীদিগের একখানা সামান্য বস্ত্র চাহিয়া লইয়া, তাই পরিয়া সভামণ্ডপে যাইতে প্রস্তুত হইল। নন্দা দেখিয়া বলিল, “এ কি এ?”
রমা বলিল, “আজ আমার সাজিবার দিন নয়। বিধাতা যদি আবার কখন সাজিবার দিন দেন, তবে আবার সাজিব। নহিলে এই সাজাই শেষ। এই বেশেই সভায় যাইব |”
নন্দা বুঝিল, ইহা উপযুক্ত। আর কোন আপত্তি করিল না।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

যথাকালে, মহারাজ সীতারাম রায় সভাস্থলে সিংহাসনে গিয়া বসিলেন। নকিব স্তুতিবাদ করিল, কিন্তু গীত–বাদ্য সে দিন নিষেধ ছিল।
তখন শৃঙ্খলাবদ্ধ গঙ্গারাম সম্মুখে আনীত হইল। তাহাকে দেখিবার জন্য বাহিরে দণ্ডায়মান জনসমূহ বিচলিত ও উন্মুখ হইয়া উঠিল। শান্তিরক্ষকেরা তাহাদিগকে শান্ত করিল।
রাজা তখন গঙ্গারামকে গম্ভীরস্বরে বলিলেন, “গঙ্গারাম! তুমি আমার কুটুম্ব, আত্মীয়, প্রজা এবং বেতনভোগী। আমি তোমাকে বিশেষ স্নেহ ও অনুগ্রহ করিতাম, তুমি বড় বিশ্বাসের পাত্র ছিলে, ইহা সকলেই জানে। একবার আমি তোমার প্রাণ রক্ষা করিয়াছি। তার পর, তুমি বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করিলে কেন? তুমি রাজদণ্ডে দণ্ডিত হইবে |”
গঙ্গারাম বিনীতভাবে বলিল, “কোন শত্রুতে আপনার কাছে আমার মিথ্যাপবাদ দিয়াছে। আমি কোন বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করি নাই। মহারাজ স্বয়ং আমার বিচার করিতেছেন–ভরসা করি, ধর্মশাস্ত্রসম্মত প্রমাণ না পাইলে আমার কোন দণ্ড করিবেন না |”
রাজা। তাহাই হইবে। ধর্মশাস্ত্রসম্মত যে প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, তাহা শুন, আর যথাসাধ্য উত্তর দাও।
এই বলিয়া রাজা চন্দ্রচূড়কে অনুমতি করিলেন, “আপনি যাহা জানেন, তাহা ব্যক্ত করুন |”
তখন চন্দ্রচূড় যাহা জানিতেন, তাহা সবিস্তারে সভামধ্যে বিবৃত করিলেন। তাহাতে সভাস্থ সকলেরই হৃদয়ঙ্গম হইল যে, যে দিন মুসলমান দুর্গ আক্রমণ করিবার জন্য নদী পার হইতেছিল, সে দিন চন্দ্রচূড়ের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও গঙ্গারাম দুর্গরক্ষার কোন চেষ্টা করেন নাই। চন্দ্রচূড়ের কথা সমাপ্ত হইলে, রাজা গঙ্গারামকে আজ্ঞা করিলেন, “নরাধম! ইহার কি উত্তর দাও?”
গঙ্গারাম যুক্তকরে বলিল, “ইনি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, ইনি যুদ্ধের কি জানেন? মুসলমান এ পারে আসেও নাই, দুর্গ আক্রমণ করে নাই। যদি তাহা করিত, আর আমি তাহাদের না হঠাইতাম, তবে ঠাকুর মহাশয় যাহা বলিয়াছেন, তাহা শিরোধার্য হইত। মহারাজ! দুর্গমধ্যে আমিও বাস করি। দুর্গের বিনাশে আমার কি লাভ?”
রাজা। কি লাভ, তাহা আর এক জনের নিকট শুন।
এই বলিয়া রাজা চাঁদশাহ ফকিরকে আজ্ঞা করিলেন, “আপনি যাহা জানেন, তাহা বলুন |”
চাঁদশাহ তখন দুর্গ আক্রমণের পূর্ব রাত্রিতে তোরাব খাঁর নিকট গঙ্গারামের গমনবৃত্তান্ত যাহা জানিতেন, তাহা বলিলেন। রাজা তখন গঙ্গারামকে আজ্ঞা করিলেন, “ইহার কি উত্তর দাও?”
গঙ্গারাম বলিল, “আমি সে রাত্রে তোরাব খাঁর নিকট গিয়াছিলাম বটে। বিশ্বাসঘাতক সাজিয়া, কুপথে আনিয়া, তাহাকে গড়ের নীচে আনিয়া টিপিয়া মারিব–আমর এই অভিপ্রায় ছিল |”
রাজা। সে জন্য তোরাব খাঁর কাছে কিছু পুরস্কার প্রার্থনা করিয়াছিলে?
গ। নহিলে তাঁহার বিশ্বাস জন্মিবে কেন?
রাজা। কি পুরস্কার চাহিয়াছিলে?
গ। অর্ধেক রাজ্য।
রাজা। আর কিছু?
গ। আর কিছু না।
তখন রাজা চাঁদশাহ ফকিরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি সে কথা কিছু জানেন?”
চাঁ। জানি।
রাজা। কি প্রকারে জানিলেন?
চাঁ। আমি মুসলমান ফকির, তোরাব খাঁর কাছে যাতায়াত করিতাম। তিনিও আমাকে বিশেষ আদর করিতেন। আমি কখন তাঁহার কথা মহারাজের কাছে বলিতাম না, অথবা মহারাজের কথা তাঁহার কাছে বলিতাম না। এজন্য কোন পক্ষ বলিয়া গণ্য নহি। এখন তিনি গত হইয়াছেন, এখন ভিন্ন কথা। যে দিন তিনি মহারাজের হাতে ফতে হইয়া মধুমতীর তীর হইতে প্রস্থান করেন, সেই দিন তাঁহার সঙ্গে পথিমধ্যে আমার দেখা হইয়াছিল। তখন গঙ্গারামের বিশ্বাসঘাতকতা সম্বন্ধে তাঁহার সঙ্গে আমার কথাবার্তা হইয়াছিল। গঙ্গারাম তাঁহাকে প্রতারণা করিয়াছে, এই বিবেচনায় তিনি আপনা হইতেই সে সকল কথা আমাকে বলিয়াছিলেন। গঙ্গারাম অর্ধেক রাজ্য পুরস্কারস্বরূপ চাহিয়াছিল বটে, কিন্তু আরও কিছু চাহিয়াছিল। তবে সে কথা হুজুরে নিবেদন করিতে বড় ভয় পাই—অভয় ভিন্ন বলিতে পারি না।
রা। নির্ভয়ে বলুন।
চাঁ। দ্বিতীয় পুরস্কার মহারাজের কনিষ্ঠা মহিষী।
দর্শকমণ্ডলী সমুদ্রবৎ গর্জিয়া উঠিল—গঙ্গারামকে নানাবিধ গালি পাড়িতে লাগিল। শান্তিরক্ষকেরা শান্তি রক্ষা করিল। গঙ্গারাম বলিল, “মহারাজ! এ অতি অসম্ভব কথা। আমার নিজের পরিবার আছে—মহারাজের অবিদিত নাই। আর আমি নগররক্ষক–স্ত্রীলোকে আমার রুচি থাকিলে, আমার দুষ্প্রাপ্য বড় অল্প। আমি মহারাজের কনিষ্ঠা মহিষীকে কখনও দেখি নাই-কি জন্য তাঁহাকে কামনা করিব?”
রা। তবে তুমি কুকুরের মত রাত্রে লুকাইয়া আমার অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতে কেন?
গ। কখনও না।
তখন সেই পাঁড়েঠাকুর পাহারাওয়ালাকে তলব হইল। পাঁড়েঠাকুর দাড়ি নাড়িয়া বলিলেন যে, গঙ্গারাম প্রত্যহ গভীর রাত্রিতে মুরলার সঙ্গে তাহার ভাই পরিচয়ে অন্তঃপুরে যাতায়াত করিত।
শুনিয়া গঙ্গারাম বলিল, “মহারাজ! ইহা সম্ভব নহে। মুরলার ভাইকেই বা ঐ ব্যক্তি পথ ছাড়িয়া দিবে কেন?”
তখন পাঁড়েঠাকুর উত্তর করিলেন যে, তিনি গঙ্গারামকে বিলক্ষণ চিনিতেন; তবে কোতোয়ালকে তিনি রোখেন কি প্রকারে? এজন্য চিনিয়াও চিনিতেন না।
গঙ্গারাম দেখিল, ক্রমে গতিক মন্দ হইয়া আসিল। এক ভরসা মনে এই উদয় হইল, মুরলা নিজে কখনও এ সকল কথা প্রকাশ করিবে না–কেন না, তাহা হইলে সেও দণ্ডনীয়-তার কি আপনার ভয় নাই? তখন গঙ্গারাম বলিল, “মুরলাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করা হউক–কথা সকলই মিথ্যা প্রকাশ পাইবে |”
বেচারা জানিত না যে, মুরলাকে মহারাজ্ঞী শ্রীমতী নন্দা ঠাকুরাণী পূর্বেই হাত করিয়া রাখিয়াছিলেন। নন্দা মুরলাকে বুঝাইয়াছিল যে, “মহারাজা স্ত্রীহত্যা করেন না-তোর মরিবার ভয় নাই। স্ত্রীলোককে শারীরিক কোন রকম সাজা দেন না। অতএব বড় সাজার তোর ভয় নাই। কিছু সাজা তোর হইবেই হইবে। তবে, তুই যদি সত্য কথা বলিস—তোর সাজা বড় কম হবে |” মুরলাও তাহা বুঝিয়াছিল, সুতরাং সব কথা ঠিক বলিল—কিছুই ছাড়িল না।
মুরলার কথা গঙ্গারামের মাথায় বজ্রাঘাতের মত পড়িল। তথাপি সে আশা ছাড়িল না। বলিল, “মহারাজ! এ স্ত্রীলোক অতি কুচরিত্রা। আমি নগরমধ্যে ইহাকে অনেক বার ধরিয়াছি, এবং কিছু শাসনও করিতে হইয়াছিল। বোধ হয় সেই রাগে এ সকল কথা বলিতেছে |”
রা। তবে কার কথায় বিশ্বাস করিব, গঙ্গারাম? খোদ মহারাণীর কথা বিশ্বাসযোগ্য কি?
গঙ্গারাম যেন হাত বাড়াইয়া স্বর্গ পাইল। তাহার নিশ্চিত বিশ্বাস যে, রমা কখনও এ সভামধ্যে আসিবে না বা সভায় সকল কথা বলিতে পারিবে না। গঙ্গারাম বলিল, “অবশ্য বিশ্বাসযোগ্য। তাঁর কথায় যদি আমি দোষী হই, আমাকে সমুচিত দণ্ড দিবেন |”
রাজা অন্তঃপুর অভিমুখে দৃষ্টি করিলেন। তখন গঙ্গারাম সবিস্ময়ে দেখিল, অতি ধীরে ধীরে সশঙ্কিত শিশুর মত, এক মলিনবেশধারিণী অবগুণ্ঠনবতী রমণী সভামধ্যে আসিতেছে। যে রূপ গঙ্গারামের হাড়ে হাড়ে আঁকা, তাহা দেখিয়াই চিনিল। গঙ্গারাম বড় শঙ্কিত হইল। দর্শকমণ্ডলীমধ্যে মহা কোলাহল পড়িয়া গেল। শান্তিরক্ষকেরা তাহাদের থামাইল।
রমা আসিয়া আগে রাজাকে, পরে গুরু চন্দ্রচূড়কে দূর হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া, অবগুণ্ঠন মোচন করিয়া সর্বসমক্ষে দাঁড়াইল–মলিন বেশেও রূপরাশি উছলিয়া পড়িতে লাগিল। চন্দ্রচূড় দেখিল, রাজা কথা কহিতে পারিতেছেন না–অধোবদনে আছেন। তখন চন্দ্রচূড় রমাকে বলিলেন, “মহারাণী! এই গঙ্গারামের বিচার হইতেছে। এ ব্যক্তি কখন আপনার অন্ত:পুরে গিয়াছিল কি না, গিয়া থাকে, তবে কেন গিয়াছিল, আপনার সঙ্গে কি কি কথা হইয়াছিল, সব স্বরূপ বলুন। রাজার আজ্ঞা, আর আমি তোমার গুরু, আমারও আজ্ঞা, সকল কথা সত্য বলিবে|”
রমা গ্রীবা উন্নত করিয়া গুরুকে বলিল, “রাজার রাণীতে কখনও মিথ্যা বলে না। আমরা যদি মিথ্যাবাদিনী হইতাম, তবে এই সিংহাসন এত দিন ভাঙ্গিয়া গুঁড়া হইয়া যাইত |”
দর্শকমণ্ডলী বাহির হইতে জয়ধ্বনি দিল–“জয় মহারাণীজিকী!”
রমা সাহস পাইয়া বলিতে লাগিল, “বলিব কি গুরুদেব! আমি রাজার মহিষী-রাজার ভৃত্য, আমার ভৃত্য–আমি যে আজ্ঞা করিব-রাজার ভৃত্য তা কেন পালন করিবে না? আমি রাজকার্যর জন্য কোতোয়ালকে ডাকিয়া পাঠিয়াছিলাম–কোতোয়াল আসিয়া আজ্ঞা শুনিয়া গিয়াছিল–তার আর বিচারই বা কেন, আমি বলিবই বা কি?”
কথা শুনিয়া দর্শকমণ্ডলী এবার আর জয়ধ্বনি করিল না–অনেকে বিষণ্ণ হইল-অনেকে বলিল, “কবুল |” চন্দ্রচূড় বলিলেন, “এমন কি রাজকার্য মা! যে রাত্রিতে কোতোয়ালকে ডাকিতে হয়?”
রমা তখন বলিল, “তবে সকল কথা শুনুন |” এই বলিয়া রমা দেখিল, পুত্র কোথা? পুত্র সুসজ্জিত হইয়া ধাত্রীক্রোড়ে। মুখ দেখিয়া সাহস পাইল। তখন রমা সবিশেষ বলিতে আরম্ভ করিল।
প্রথমে অতি ধীরে ধীরে, অতি দুরাগত সঙ্গীতের মত রমা বলিতে লাগিল–সকলে শুনিতে পাইল না। বাহিরের দর্শকমণ্ডলী বলিতে লাগিল, “মা! আমরা শুনিতে পাইতেছি না-আমরা শুনিব |” রমা আরও একটু স্পষ্ট বলিতে লাগিল। ক্রমে আরও স্পষ্ট-আরও স্পষ্ট। তার পর যখন রমা পুত্রের বিপদ শঙ্কায় এই সাহসের কাজ করিয়াছিল, এই কথা বুঝাইতে লাগিল–যখন একবার একবার চাঁদমুখ দেখিতে লাগিল, আর অশ্রুপরিপ্লুত হইয়া, মাতৃস্নেহের উচ্ছ্বাসের উপর উচ্ছ্বাস, তরঙ্গের উপর তরঙ্গ তুলিতে লাগিল-তখন পরিষ্কার স্বর্গীয়, অপ্সরোনিন্দিত তিন গ্রাম সংমিলিত মনোমুগ্ধকর সঙ্গীতের মত শ্রোতৃগণের কানে সেই মুগ্ধকর বাক্য বাজিতে লাগিল। সকলে মুগ্ধ হইয়া শুনিতে লাগিল। তার পর সহসা রমা, ধাত্রীক্রোড় হইতে শিশুকে কাড়িয়া লইয়া সীতারামের পদতলে তাহাকে ফেলিয়া দিয়া, যুক্তকরে বলিতে লাগিল, “মহারাজ! আপনার আরও সন্তান আছে–আমার আর নাই! মহারাজ! আপনার রাজ্য আছে-আমার রাজ্য এই শিশু। মহারাজ! তোমার ধর্ম আছে, কর্ম আছে, যশ আছে, স্বর্গ আছে-আমি মুক্ত কণ্ঠে বলিতেছি, আমার ধর্ম এই, কর্ম এই, যশ এই, স্বর্গ এই-মহারাজ! অপরাধিনী হইয়া থাকি, তবে দণ্ড করুন__” শুনিয়া দর্শকমণ্ডলী অশ্রুপূর্ণ হইয়া পুনঃ পুনঃজয়ধ্বনি করিতে লাগিল। কিন্তু লোক ভাল মন্দ দুই রকমই আছে-অনেকেই জয়ধ্বনি করিতে লাগিল-কিন্তু আবার অনেকেই তাহাতে যোগ দিল না। জয়ধ্বনি ফুরাইলে তাহারা কেহ অর্ধস্ফুট স্বরে বলিল, “আমার ত এ কথায় বিশ্বাস হয় না |” কোন বর্ষীয়সী বলিল, “পোড়া কপাল! রাত্রে মানুষ ডাকিয়া নিয়া গিয়াছেন-উনি আবার সতী!” কেহ বলিল, “রাজা এ কথায় ভুলেন ভুলুন-আমরা এ কথায় ভুলিব না |” কেহ বলিল, “রাণী হইয়া যদি উনি এই কাজ করিবেন, তবে আমরা গরিবদুঃখীকি না করিব?”
এ সকল কথা সীতারামের কথা কানে গেল। তখন রাজা রমাকে বললেন, “প্রজাবর্গ সকলে ত তোমার কথা বিশ্বাস করিতেছে না |”
রমা কিছুক্ষণ মুখ অবনত করিয়া রহিল। চক্ষুতে প্রবল বারিধারা বহিল-তার পর রমা সামলাইল। তখন মুখ তুলিয়া রাজাকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিল, “যখন লোকের বিশ্বাস হইল না, তখন আমার একমাত্র গতি-আপনার রাজপুরীর কলঙ্কস্বরূপ এ জীবন আর রাখিতে পারিব না। আপনি চিতা প্রস্তুত করিতে আজ্ঞা দিন–আমি সকলের সম্মুখেই পুড়িয়া মরি।দুঃখতাহাতে কিছু নাই। আপনিও কি আমাকে অবিশ্বাসিনী ভাবিতেছেন? তাহা হইলে বুঝি–(আবার রমার চক্ষুতে জলের ধারা ছুটিল,)–বুঝি আমার পুড়িয়া মরাও বৃথা হইবে। তুমি যদি এই লোকসমারোহের সম্মুখে বল যে, আমার প্রতি তোমার অবিশ্বাস নাই–তাহা হইলে আমি সেই চিতাই স্বর্গ মনে করিব। মহারাজ! পরলোকের উদ্ধারকর্তা, ভূদেব তুল্য আমার গুরুদেব এই সম্মুখে। আমি তাঁহার সম্মুখে, ইষ্টদেবকে সাক্ষী করিয়া বলিতেছি, আমি অবিশ্বাসিনী নহি। যিনি গুরুর অপেক্ষাও আমার পূজ্য, যিনি মনুষ্য হইয়াও দেবতার অপেক্ষা আমার পূজ্য, সেই পতিদেবতা, আপনি স্বয়ং আমার সম্মুখে–আমি পতিদেবতাকে সাক্ষী করিয়া বলিতেছি, আমি অবিশ্বাসিনী নহি। মহারাজ! এই নারীদেহ ধারণ করিয়া যে কিছু দেবসেবা, ব্রাহ্মণসেবা, দান ব্রত নিয়ম করিয়াছি, যদি আমি বিশ্বাসঘাতিনী হইয়া থাকি, তবে সে সকলেরই ফলে যেন বঞ্চিত হই। পতিসেবার অপেক্ষা স্ত্রীলোকের আর পুণ্য নাই, কায়মনোবাক্যে আমি যে আপনার চরণসেবা করিয়াছি, তাহা আপনিই জানেন,–আমি যদি অবিশ্বাসিনী হইয়া থাকি, তবে আমি যেন সে পুণ্যফলে বঞ্চিত হই। আমি ইহজীবনে যে কিছু আশা, যে কিছু ভরসা, যে কিছু কামনা, যে কিছু মানস করিয়াছি,–আমি যদি অবিশ্বাসিনী হইয়া থাকি, সকলই যেন নিষ্ফল হয়। মহারাজ! নারীজন্মে স্বামিসন্দর্শনের তুল্য পুণ্যও নাই, সুখও নাই-যদি আমি অবিশ্বাসিনী হই, আমি যেন সেই পুত্রমুখদর্শনে চিরবঞ্চিত হই। মহারাজ! আর কি বলিব–যদি আমি অবিশ্বাসিনী হইয়া থাকি, তবে জন্মে জন্মে যেন নারীজন্ম গ্রহণ করিয়া, জন্মে জন্মে স্বামিপুত্রের মুখদর্শনে চিরবঞ্চিত হই |”
রমা আর বলিতে পারিল না-ছিন্ন লতার মত সভাতলে পড়িয়া গিয়া মূর্ছিতা হইল–ধাত্রীগণে ধরাধরি করিয়া অন্তঃপুরে বহিয়া লইয়া গেল। ধাত্রীক্রোড়স্থ শিশু মার সঙ্গে সঙ্গে কাঁদিতে কাঁদিতে গেল; সভাতলস্থ সকলে অশ্রুমোচন করিল। গঙ্গারামের করচরণস্থিত শৃঙ্খলে ঝঞ্ঝনা বাজিয়া উঠিল। দর্শকমণ্ডলী বাত্যাপীড়িত সমুদ্রের ন্যায় চঞ্চল হইয়া মহান কোলাহল সমুত্থিত করিল–রক্ষিবর্গ কিছুই নিবারণ করিতে পারিল না।
তখন “গঙ্গারাম কি বলে?” “গঙ্গারাম কি এ কথা মিছা বলে?” গঙ্গারাম যদি মিছা বলে, তবে আইস, আমরা সকলে মিলিয়া গঙ্গারামকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলি |” এইরূপ রব চারি দিক হইতে উঠিতে লাগিল। গঙ্গারাম দেখিল, এই সময়ে লোকের মন ফিরাইতে না পারিলে, তাহার আর রক্ষা নাই। গঙ্গারাম বুদ্ধিমান্, বুঝিয়াছিল যে, প্রজাবর্গ যেমন নিষ্পত্তি করিবে, রাজাও সেই মত করিবেন। তখন সে রাজাকে সম্বোধন করিয়া লোকের মনভুলান কথা বলিতে আরম্ভ করিল, “মহারাজ! কথাটা এই যে, স্ত্রীলোকের কথায় বিশ্বাস করিবেন–না আমার কথায় বিশ্বাস করিবেন? প্রভু! আপনার এই রাজ্য কি স্ত্রীলোকে সংস্থাপিত করিয়াছে-না আমার ন্যায় রাজভৃত্যদিগের বাহুবলে স্থাপিত হইয়াছে? মহারাজ! সকল স্ত্রীলোকেই বিপথগামিনী হইতে পারে, রাজরাণীরাও বিপথগামিনী হইয়া থাকেন; রাজরাণী বিপথগামিনী হইলে রাজার কর্তব্য যে, তাঁহাকে পরিত্যাগ করেন। বিশ্বাসী ভৃত্য কখনও বিপথগামী হয় না; তবে স্ত্রীলোকে আপনার দোষ ক্ষালন জন্য ভৃত্যের ঘাড়ে চাপ দিতে পারে। এই মহারাণী রাত্রিতে কাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া আমাকে দোষী করিতেছেন, তাহার স্থিরতা-মহারাজ, রক্ষা কর! রক্ষা কর!”
কথা কহিতে কহিতে গঙ্গারাম কথা সমাপ্ত না করিয়া,-অতশয় ভীত হইয়া, “মহারাজ, রক্ষা কর! রক্ষা কর!” এই শব্দ করিয়া স্তম্ভিত বিহ্বলের মত হইয়া নীরব হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সকলে দেখিল, গঙ্গারাম থর-থর কাঁপিতেছে। তখন সমস্ত জনমণ্ডলী সবিস্ময়ে সভয়ে চাহিয়া দেখিল-অপূর্বমূর্তি! জটাজুটবিলম্বী, গৈরিকধারিণী, জ্যোতির্ময়ী মূর্তি, সাক্ষাৎ সিংহবাহিনী দুর্গা তুল্য, ত্রিশূল হস্তে, গঙ্গারামকে ত্রিশূলাগ্রভাগে লক্ষ্য করিয়া, প্রখরগমনে তাহার অভিমুখে সভামণ্ডপ পার হইয়া আসিতেছে। দেখিবামাত্র সেই সাগরবৎ সংক্ষুব্ধ জনমণ্ডলী একেবারে নিস্তব্ধ হইল। গঙ্গারাম একদিন রাত্রিতে সে মূর্তি দেখিয়াছিল-আবার এই বিপৎকালে, যখন মিথ্যা প্রবঞ্চনার দ্বারা নিরপরাধিনী রমার সর্বনাশ করিতে সে উদ্যত, সেই সময়ে সেই মূর্তি দেখিয়া, চণ্ডী তাহাকে বধ করিতে আসিতেছেন বিবেচনা করিয়া, ভয়ে কাতর হইয়া “রক্ষা কর! রক্ষা কর!” শব্দ করিয়া উঠিল। এ দিকে রাজা, ও দিকে চন্দ্রচূড়, সেই রাত্রিদৃষ্ট দেবীতুল্য মূর্তি দেখিয়া চিনিলেন, এবং নগরের রাজলক্ষ্মী মনে করিয়া সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান করিলেন। তখন সভাস্থ সকলেই গাত্রোত্থান করিল।
জ কোন দিকে দৃষ্টি না করিয়া খরপদে গঙ্গারামের নিকট আসিয়া, গঙ্গারামের বক্ষে সেই মন্ত্রপূত ত্রিশূলাগ্রভাগ স্থাপন করিল। কথার মধ্যে কেবল বলিল, “এখন বল |”
ত্রিশূল গঙ্গারামের গাত্র স্পর্শ করিল মাত্র, তথাপি গঙ্গারামের শরীর হঠাৎ অবসন্ন হইয়া আসিল; গঙ্গারাম মনে করিল, আর একটি মিথ্যা কথা বলিলেই এই ত্রিশূল আমার হৃদয়ে বিদ্ধ হইবে। গঙ্গারাম তখন সভয়ে, বিনীতভাবে, সত্য বৃত্তান্ত সভাসমক্ষে বলিতে আরম্ভ করিল। যতক্ষণ তাহার কথা সমাপ্ত হইল, ততক্ষণ জয়ন্তী তাহার হৃদয় ত্রিশূলাগ্রভাগের দ্বারা স্পর্শ করিয়া রহিল। গঙ্গারাম তখন রমার নির্দোষিতা, আপনার মোহ, লোভ, ফৌজদারের সহিত সাক্ষাৎ, কথোপকথন এবং বিশ্বাসঘাতকতার চেষ্টা সমুদয় সবিস্তারে কহিল।
জয়ন্তী তখন ত্রিশূল লইয়া খরপদে চলিয়া গেল। গমনকালে সভাস্থ সকলেই নতশিরে সেই দেবীতুল্য মূর্তিকে প্রণাম করিল। সকলেই ব্যস্ত হইয়া পথ ছাড়িয়া দিল। কেহ কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে বা তাহার অনুসরণ করিতে সাহস পাইল না। সে কোন দিকে কোথায় চলিয়া গেল, কেহ সন্ধান করিল না।
জয়ন্তী চলিয়া গেলে রাজা গঙ্গারামকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “এখন তুমি আপন মুখে সকল অপরাধ স্বীকৃত হইলে। এরূপ কৃতঘ্নের মৃত্যু ভিন্ন অন্য দণ্ড উপযুক্ত নহে। অতএব তুমি রাজদণ্ডে প্রাণত্যাগ করিতে প্রস্তুত হও |”
গঙ্গারাম দ্বিরুক্তি করিল না। প্রহরীরা তাহাকে লইয়া গেল। বধদণ্ডের আজ্ঞা শুনিয়া সকল লোক স্তম্ভিত হইয়াছিল। কেহ কিছু বলিল না। নীরবে সকলে আপনার ঘরে ফিরিয়া গেল। গৃহে গিয়া সকলেই রমাকে “সাক্ষাৎ লক্ষ্মী” বলিয়া প্রশংসা করিল। রমার আর কোন কলঙ্ক রহিল না।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

রাজা মুরলাকে মাথা মুড়াইয়া, ঘোল ঢালিয়া, নগরের বাহির করিয়া দিবার আদেশ করিলেন। সে হুকুম তখনই সামিল হইল। মুরলার নির্গমনকালে এক পাল ছেলে, এবং অন্যান্য রসিক লোক দল বাঁধিয়া করতালি দিতে দিতে এবং গীত গায়িতে গায়িতে চলিল।
গঙ্গারামের ন্যায় কৃতঘ্নের পক্ষে, শূলদণ্ড ভিন্ন অন্য দণ্ড তখনকার রাজনীতিতে ব্যবস্থিত ছিল না। অতএব তাহার প্রতি সেই আজ্ঞাই হইল। কিন্তু গঙ্গারামের মৃত্যু আপাততঃ দিনকতক স্থগিত রাখিতে হইল। কেন না, সম্মুখে রাজার অভিষেক উপস্থিত। সীতারাম নিজ বাহুবলে হিন্দুরাজ্য স্থাপন করিয়া রাজা হইয়াছেন, কিন্তু তাঁহার অভিষেক হয় নাই। হিন্দুশাস্ত্রানুসারে তাহা হওয়া উচিত। চন্দ্রচূড় ঠাকুর এই প্রসঙ্গ উত্থাপিত করিলে, সীতারাম তাহাতে সম্মত হইয়াছিলেন। তিনি বিবেচনা করিলেন, এরূপ একটা মহোৎসবের দ্বারা প্রজাবর্গ পরিতুষ্ট হইলে তাহাদের রাজভক্তি বৃদ্ধি পাইতে পারে। অতএব বিশেষ সমারোহের সহিত অভিষেক কার্য সম্পন্ন করিবার কল্পনা হইতেছিল। নন্দা এবং চন্দ্রচূড়, উভয়েই এক্ষণে সীতারামকে অনুরোধ করিলেন যে, এখন একটা মাঙ্গলিক ক্রিয়া উপস্থিত, এখন গঙ্গারামের বধরূপ অশুভ কর্মটা করা বিধেয় নহে; তাহাতে অমঙ্গলও যদি না হয়, লোকের আনন্দেরও লাঘব হইতে পারে। এ কথায় রাজা সম্মত হইলেন। ভিতরের আসল কথা এই যে, গঙ্গারামকে শূলে দিতে সীতারামের আন্তরিক ইচ্ছা নহে, তবে রাজধর্ম পালন এবং রাজ্যশাসন জন্যই অবশ্য কর্তব্য বলিয়া তাহা স্থির করিয়াছিলেন। ইচ্ছা ছিল না, তাহার কারণ-গঙ্গারাম শ্রীর ভাই। শ্রীকে সীতারাম ভুলেন নাই, তবে এত দিন ধরিয়া তাহাকে খুঁজিয়া না পাইয়া, নিরাশ হইয়া বিষয়কর্মে চিত্তনিবেশ করিয়া শ্রীকে ভুলিবেন, ইহা স্থির করিয়াছিলেন। অতএব আবার রাজ্যের উপর তিনি মন স্থির করিতেছিলেন। সেই জন্যই দিল্লীতে গিয়া বাদশাহের দরবারে হাজির হইয়াছিলেন। এবং বাদশাহকে সন্তুষ্ট করিয়া সনদ সংগ্রহ করিয়াছিলেন। সেই জন্য উৎসাহ সহকারে সংগ্রাম করিয়া ভূষনে অধিকার করিয়াছিলেন, এবং দক্ষিণ বাঙ্গালায় এক্ষণে একাধিপত্য প্রচার করিতেছিলেন। কিন্তু শ্রী এখনও হৃদয়ের সম্পূর্ণ অধিকারিণী। অতএব গঙ্গারামের শূলে যাওয়া এখন স্থগিত রহিল।
এ দিকে অভিষেকের বড় ধুম পড়িয়া গেল। অত্যন্ত সমারোহ–অত্যন্ত গোলযোগ, দেশ বিদেশ হইতে লোক আসিয়া নগর পরিপূর্ণ করিল–রাজা, রাজপুরুষ, ব্রাহ্মণ, পণ্ডিত, অধ্যাপক, দৈবজ্ঞ, ইতর, ভদ্র, আহুত, অনাহুত, রবাহূত, ভিক্ষুক, সন্ন্যাসী, সাধু, অসাধুতে নগরে আর স্থান হয় না। এই অসংখ্য জনমণ্ডলের কর্মের মধ্যে প্রতিনিয়ত আহার। ভক্ষ্য ভোজ্য লুচি সন্দেশ দধির ছড়াছড়িতে সহরে এক হাঁটু কাদা হইয়া উঠিল, পাতা কাটার জ্বালায় সীতারামের রাজ্যের সব কলাগাছ নিষ্পত্র হইল, ভাঙ্গা ভাঁড় ও ছেঁড়া কলাপাতে গড়খাই ও মধুমতী বুজিয়া উঠিবার গোছ হইয়া উঠিল। অহরহ বাদ্য ও নৃত্য–গীতের দৌরাত্ম্যে ছেলেদের পর্যন্ত মাথা গরম হইয়া উঠিল।
এই অভিষেকের মধ্যে একটা ব্যাপার দান। সীতারাম অভিষেকের দিনে সমস্ত দিবস, কখনও স্বহস্তে, কখনও আপন কর্তৃত্বাধীনে ভৃত্যহস্তে, সুবর্ণ, রজত, তৈজস এবং বস্ত্রদান করিতে লাগিলেন। এত লোক আসিয়াছিল যে, সমস্ত দিনে দান ফুরাইল না। অর্ধরাত্র পর্যন্ত এইরূপ দান করিয়া সীতারাম আর পারিয়া উঠিলেন না। অবশিষ্ট লোকের বিদায় জন্য রাজপুরুষদিগের উপর ভার দিয়া অন্তঃপুরে বিশ্রামার্থ চলিলেন। যাইতে সভয়ে, সবিস্ময়ে অন্তঃপুরদ্বারে দেখিলেন যে, ত্রিশূলধারিণী সুবর্ণময়ী রাজলক্ষ্মীমূর্তি।
রাজা ভক্তিভাবে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া বলিলেন, “মা! আপনি কে, আমাকে দয়া করিয়া
বলুন |”
জয়ন্তী বলিল, “মহারাজ! আমি ভিখারিণী। আপনার নিকট ভিক্ষার্থ আসিয়াছি |”
রাজা। মা! কেন আমায় ছলনা করেন? আপনি দেবী, আমি চিনিয়াছি। আপনি সাক্ষাৎ কমলা-আমার প্রতি প্রসন্ন হউন।
জ। মহারাজ! আমি সামান্য মানুষী। নহিলে আপনার নিকট ভিক্ষার্থ আসিতাম না। শুনিলাম, আজ যে যাহা চাহিতেছে, আপনি তাহাকে তাই দিতেছেন। আমার আশা বড়, কিন্তু যার এমন দান, তার কাছে আশা নিষ্ফলা হইবে না মনে করিয়া আসিয়াছি।
রাজা বলিলেন, “মা, আপনাকে অদেয় আমার কিছুই নাই। আপনি একবার আমার রাজ্য রক্ষা করিয়াছেন, দ্বিতীয় বারে আমার কুলমর্য্যাদা রক্ষা করিয়াছেন, আপনি দেবীই হউন, আর মানবীই হউন–আপনাকে সকলই আমার দেয়। কি বস্তু কামনা করেন, আজ্ঞা করুন, আমি এখনই আনিয়া উপস্থিত করিতেছি |”
জ। মহারাজ! গঙ্গারামের বধদণ্ডের বিধান হইয়াছে। কিন্তু এখনও সে মরে নাই। আমি তার জীবন ভিক্ষা করিতে আসিয়াছি।
রাজা। আপনি!
জ। কেন মহারাজ? অসম্ভাবনা কি?
রাজা। গঙ্গারাম কীটাণুকীট–আপনার তার প্রতি দয়া কিসে হইল?
জ। আমরা ভিখারী–আমাদের কাছে সবাই সমান।
রাজা। কিন্তু আপনিই ত তাহাকে ত্রিশূল বিঁধিয়া মারিতে চাহিয়াছিলেন-আপনা হইতেই দুই বার তাহার অসদভিসন্ধি ধরা পড়িয়াছে। বলিতে কি, আপনি মহারাণীর প্রতি দয়াবতী না হইলে সে সত্য স্বীকার করিত না, তাহার বধদণ্ড হইত না। এখন তাহার অন্যথা করিতে চান কেন?
জ। মহারাজ! আমা হইতে ইহা ঘটিয়াছে বলিয়াই তাহার প্রাণভিক্ষা চাহিতেছি। ধর্মের উদ্ধার জন্য ত্রিশূলাঘাতে অধর্মচারীর প্রাণবিনাশেও দোষ বিবেচনা করি না, কিন্তু ধর্মের এখন রক্ষা হইয়াছে, এখন প্রাণিহত্যা– পাপ হইতে উদ্ধার পাইবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছি। গঙ্গারামের জীবন আমাকে ভিক্ষা দিন।
রাজা। আপনেক অদেয় কিছুই নাই। আপনি যাহা চাহিলেন, তাহা দিলাম। গঙ্গারাম এখনই মুক্ত হইবে। কিন্তু মা! তোমাকে ভিক্ষা দিই, আমি তাহার যোগ্য নহি। আমি তোমায় ভিক্ষা দিব না। গঙ্গারামের জীবন তোমাকে বেচিব–মূল্য দিয়া কিনিতে হইবে।
জ। (ঈষৎ হাস্যের সহিত) কি মূল্য মহারাজ! রাজভাণ্ডারে এমন কোন ধনের অভাব যে, ভিখারিণী তাহা দিতে পারিবে?
রাজা। রাজভাণ্ডারে নাই-রাজার জীবন। আপনি সেই মধুমতীতীরে ঘাটের উপর কামানের নিকট স্বীকার করিয়াছিলেন যে, আমি যাহা খুঁজি, তাহা পাইব। সে অমূল্য সামগ্রী আমাকে দিন–সেই মূল্যে আজ গঙ্গারামের জীবন আপনার নিকট বেচিব।
জ। কি সে অমূল্য সামগ্রী মহারাজ? আপনি রাজ্য পাইয়াছেন।
রাজা। যাহার জন্য রাজ্য ত্যাগ করিতে পারি, তাই চাহিতেছি।
জ। সে কি মহারাজ?
রাজা। শ্রী নামে আমার প্রথম মহিষী আমার জীবনস্বরূপ। আপনি দেবী, সব দিতে পারেন। আমার জীবন আমায় দিয়া, সেই মূল্যে গঙ্গারামের জীবন কিনিয়া লউন।
জ। সে কি মহারাজ! আপনার ন্যায় ধর্মাত্মা রাজাধিরাজের জীবনের সঙ্গে সেই নরাধম পাপাত্মার জীবনের কি বিনিময় হয়? মহারাজ! কাণা কড়ির বিনিময়ে রত্নাকর?
রাজা। মা! জননী যত দেন, ছেলে কি মাকে কখনও তত দিতে পারে!
জ। মহারাজ! আপনি আজ অন্তঃপুর-দ্বার সকল মুক্ত রাখিবেন; আর অন্ত:পুরের প্রহরীদিগের আজ্ঞা দিবেন, ত্রিশূল দেখিলে যেন পথ ছাড়িয়া দেয়। আপনার শয্যাগৃহে আজ রাত্রিতেই মূল্য পৌঁছিবে। গঙ্গারামের মুক্তির হুকুম হৌক।
রাজা হর্ষে অভিভূত হইয়া বলিলেন, “গঙ্গারামের এখনই মুক্তি দিতেছি |” এই বলিয়া অনুচরবর্গকে সেইরূপ আজ্ঞা দিলেন।
জয়ন্তী বলিলেন, “আমি এই অনুচরদিগের সঙ্গে গঙ্গারামের কারাগারে যাইতে পারি কি?”
রাজা। আপনি যাহা ইচ্ছা করিতে পারেন, কিছুতেই আপনার নিষেধ নাই।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

অন্ধকারে কূপের ন্যায় নিম্ন, আর্দ্র, বায়ুশূন্য কারাগারমধ্যে গঙ্গারাম শৃঙ্খলবদ্ধ হইয়া একা পড়িয়া আছে। সেই নিশীথকালেও তাহার নিদ্রা নাই-যে পর্যন্ত সে শুনিয়াছে যে, তাহাকে শূলে যাইতে হইবে, সেই পর্যন্ত আর সে ঘুমায় নাই-আহার–নিদ্রা সকলই বন্ধ। এক দণ্ডে মরা যায়, মৃত্যু তত বড় কঠিন দণ্ড নহে; কিন্তু কারাগৃহে একাকী পড়িয়া দিবারাত্র সম্মুখেই মৃত্যুদণ্ড, ইতি ভাবনা করার অপেক্ষা গুরুতর দণ্ড আর কিছুই নাই। গঙ্গারাম পলকে পলকে শূলে যাইতেছিল। দণ্ডের আর তাহার কিছু অধিক বাকি নাই। ভাবিয়া ভাবিয়া, চিত্তবৃত্তি সকল প্রায় নির্বাপিত হইয়াছিল। মন অন্ধকারে ডুবিয়া রহিয়াছিল–ক্লেশ অনুভব করিবার শক্তি পর্যন্ত যেন তিরোহিত হইয়াছিল। মনের মধ্যে কেবল দুটি ভাব এখনও জাগরিত ছিল–ভৈরবীকে ভয়, আর রমার উপর রাগ। ভয়ের অপেক্ষা, এই রাগই প্রবল। গঙ্গারাম আর রমার প্রতি আসক্ত নহে, এখন রমার তেমন আন্তরিক শত্রু আর কেহ নহে।
গঙ্গারাম এখন রমাকে সম্মুখে পাইলে নখে বিদীর্ণ করিতে প্রস্তুত। গঙ্গারামের যখন কিছু চিন্তাশক্তি হইল, তখন কি উপায়ে মরিবার সময়ে রমার সর্বনাশ করিয়া মরিতে পারিবে, গঙ্গারাম তাহাই ভাবিতেছিল। শূলতলে দাঁড়াইয়া রমার সম্বন্ধে কি অশ্লীল অপবাদ দিয়া যাইবে, গঙ্গারাম তাহাই কখন কখন ভাবিত। অন্য সময়ে জড়পিণ্ডের মত স্তম্ভিত হইয়া পড়িয়া থাকিত। কেবল মধ্যে মধ্যে বাহিরে অভিষেকের উৎসবের মহৎ কোলাহল শুনিত। যে পাচক ব্রাহ্মণ প্রত্যহ তাহার নুন ভাত লইয়া আসিত, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া গঙ্গারাম উৎসবের বৃত্তান্ত শুনিয়াছিল। শুনিল যে, রাজ্যের সমস্ত লোক অতি বৃহৎ উৎসবে নিমগ্ন-কেবল সেই একা অন্ধকারে আর্দ্র ভূমিতে মূষিকদষ্ট হইয়া, কীটপতঙ্গপীড়িত হইয়া, শৃঙ্খলভার বহন করিতেছে। মনে মনে বলিতে লাগিল, রমার কবে এই রকম স্থান মিলিবে!
যেমন অন্ধকারে বিদ্যুৎ জ্বলে, তেমনি গঙ্গারামের একটি কথা মনে পড়িত, যদি শ্রী বাঁচিয়া থাকিত! শ্রী একবার প্রাণভিক্ষা করিয়া লইয়াছিল, আবার ভিক্ষা চাহিলে কি ভিক্ষা পাইত না! আমি যত পাপী হই না কেন, শ্রী কখনও আমাকে পরিত্যাগ করিত না। এমন ভগিনীও মরিল!
দুই প্রহর রাত্রিতে ঝঞ্ঝনা বাজাইয়া কারাগৃহের বাহিরের শিকল খুলিল। গঙ্গারামের প্রাণ শুকাইল–এত রাত্রিতে কেন শিকল খুলিতেছে! আরও কিছু নূতন বিপদ আছে না কি?
অগ্রে রাজপুরুষেরা প্রদীপ লইয়া প্রবেশ করিল। গঙ্গারাম স্তম্ভিত হইয়া তাহাদের প্রতি চাহিয়া রহিল। কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না। তাহার পর জয়ন্তীকে দেখিল-উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিয়া বলিল, “রক্ষা কর! রক্ষা কর! আমি কি করিয়াছি?”
জয়ন্তী বলিল, “বাছা! কি করিয়াছ তাহা জান। কিন্তু তুমি রক্ষা পাইবে। শ্রীকে মনে আছে কি?”
গ। শ্রী! যদি শ্রী বাঁচিয়া থাকিত!
জ। শ্রী বাঁচিয়া আছে। তার অনুরোধে আমি মহারাজের কাছে তোমার জীবন ভিক্ষা চাহিয়াছিলাম। ভিক্ষা পাইয়াছি। তোমাকে মুক্ত করিতে আসিয়াছি। পলাও গঙ্গারাম! কাল প্রভাতে এ রাজ্যে আর মুখ দেখাইও না। দেখাইলে আর তোমাকে বাঁচাইতে পারিব না।
গঙ্গারাম বুঝিতে পারিল কি না সন্দেহ। বিশ্বাস করিল না, ইহা নিশ্চিত। কিন্তু দেখিল যে, রাজপুরুষেরা বেড়ি খুলিতে লাগিল। গঙ্গারাম নীরবে দেখিতে লাগিল। জিজ্ঞাসা করিল, “মা! রক্ষা করিলে কি?”
জয়ন্তী বলিলেন, “বেড়ি খুলিয়াছে। চলিয়া যাও |”
গঙ্গারাম ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল। সেই রাত্রিতেই নগর ত্যাগ করিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress