পউষ প্রখর শীতে জর্জর , ঝিল্লিমুখর রাতি ;
নিদ্রিত পুরী , নির্জন ঘর , নির্বাণদীপ বাতি ।
অকাতর দেহে আছিনু মগন সুখনিদ্রার ঘোরে —
তপ্ত শয্যা প্রিয়ার মতন সোহাগে ঘিরেছে মোরে ।
হেনকালে হায় বাহির হইতে কে ডাকিল মোর নাম —
নিদ্রা টুটিয়া সহসা চকিতে চমকিয়া বসিলাম ।
তীক্ষ্ণ শাণিত তীরের মতন মর্মে বাজিল স্বর —
ঘর্ম বহিল ললাট বাহিয়া , রোমাঞ্চকলেবর ।
ফেলি আবরণ , ত্যজিয়া শয়ন , বিরলসন বেশে
দুরু দুরু বুকে খুলিয়া দুয়ার বাহিরে দাঁড়ানু এসে ।
দূর নদীপারে শূন্য শ্মশানে শৃগাল উঠিল ডাকি ,
মাথার উপরে কেঁদে উড়ে গেল কোন্ নিশাচর পাখি ।
দেখিনু দুয়ারে রমণীমুরতি অবগুণ্ঠনে ঢাকা —
কৃষ্ণ অশ্বে বসিয়া রয়েছে , চিত্রে যেন সে আঁকা ।
আরেক অশ্ব দাঁড়ায়ে রয়েছে , পুচ্ছ ভূতল চুমে ,
ধূম্রবরন , যেন দেহ তার গঠিত শ্মশানধূমে ।
নড়িল না কিছু , আমারে কেবল হেরিল আঁখির পাশে —
শিহরি শিহরি সর্ব শরীর কাঁপিয়া উঠিল ত্রাসে ।
পাণ্ডু আকাশে খণ্ড চন্দ্র হিমানীর গ্লানি-মাখা ,
পল্লবহীন বৃদ্ধ অশথ শিহরে নগ্ন শাখা ।
নীরব রমণী অঙ্গুলী তুলি দিল ইঙ্গিত করি —
মন্ত্রমুগ্ধ অচেতনসম চড়িনু অশ্ব- ‘ পরি ।
বিদ্যুৎবেগে ছুটে যায় ঘোড়া — বারেক চাহিনু পিছে ,
ঘরদ্বার মোর বাষ্পসমান মনে হল সব মিছে ।
কাতর রোদন জাগিয়া উঠিল সকল হৃদয় ব্যেপে ,
কণ্ঠের কাছে সুকঠিন বলে কে তারে ধরিল চেপে ।
পথের দুধারে রুদ্ধদুয়ারে দাঁড়ায়ে সৌধসারি ,
ঘরে ঘরে হায় সুখশয্যায় ঘুমাইছে নরনারী ।
নির্জন পথ চিত্রিতবৎ , সাড়া নাই সারা দেশে —
রাজার দুয়ারে দুইটি প্রহরী ঢুলিছে নিদ্রাবেশে ।
শুধু থেকে থেকে ডাকিছে কুকুর সুদূর পথের মাঝে —
গম্ভীর স্বরে প্রাসাদশিখরে প্রহরঘন্টা বাজে ।
অফুরান পথ , অফুরান রাতি , অজানা নূতন ঠাঁই —
অপরূপ এক স্বপ্নসমান , অর্থ কিছুই নাই ।
কী যে দেখেছিনু মনে নাহি পড়ে , ছিল নাকো আগাগোড়া —
লক্ষ্যবিহীন তীরের মতন ছুটিয়া চলেছে ঘোড়া ।
চরণে তাদের শব্দ বাজে না , উড়ে নাকো ধূলিরেখা —
কঠিন ভূতল নাই যেন কোথা , সকলি বাষ্পে লেখা ।
মাঝে মাঝে যেন চেনা-চেনা-মতো মনে হয় থেকে থেকে —
নিমেষ ফেলিতে দেখিতে না পাই কোথা পথ যায় বেঁকে ।
মনে হল মেঘ , মনে হল পাখি , মনে হল কিশলয় ,
ভালো করে যেই দেখিবারে যাই মনে হল কিছু নয় ।
দুই ধারে এ কি প্রাসাদের সারি ? অথবা তরুর মূল ?
অথবা এ শুধু আকাশ জুড়িয়া আমারই মনের ভুল ?
মাঝে মাঝে চেয়ে দেখি রমণীর অবগুণ্ঠিত মুখে —
নীরব নিদয় বসিয়া রয়েছে , প্রাণ কেঁপে ওঠে বুকে ।
ভয়ে ভুলে যাই দেবতার নাম , মুখে কথা নাহি ফুটে ;
হুহু রবে বায়ু বাজে দুই কানে ঘোড়া চলে যায় ছুটে ।
চন্দ্র যখন অস্তে নামিল তখনো রয়েছে রাতি ,
পূর্ব দিকের অলস নয়নে মেলিছে রক্ত ভাতি ।
জনহীন এক সিন্ধুপুলিনে অশ্ব থামিল আসি —
সমুখে দাঁড়ায়ে কৃষ্ণ শৈল গুহামুখ পরকাশি ।
সাগরে না শুনি জলকলরব , না গাহে উষার পাখি ,
বহিল না মৃদু প্রভাতপবন বনের গন্ধ মাখি ।
অশ্ব হইতে নামিল রমণী , আমিও নামিনু নীচে ,
আঁধার-ব্যাদান গুহার মাঝারে চলিনু তাহার পিছে ।
ভিতরে খোদিত উদার প্রাসাদ শিলাস্তম্ভ- ‘ পরে ,
কনকশিকলে সোনার প্রদীপ দুলিতেছে থরে থরে ।
ভিত্তির গায়ে পাষাণমূর্তি চিত্রিত আছে কত ,
অপরূপ পাখি , অপরূপ নারী , লতাপাতা নানা-মতো ।
মাঝখানে আছে চাঁদোয়া খাটানো , মুক্তা ঝালরে গাঁথা —
তারি তলে মণিপালঙ্ক- ‘ পরে অমল শয়ন পাতা ।
তারি দুই ধারে ধূপাধার হতে উঠিছে গন্ধধূপ ,
সিংহবাহিনী নারীর প্রতিমা দুই পাশে অপরূপ ।
নাহি কোনো লোক , নাহিকো প্রহরী , নাহি হেরি দাসদাসী ।
গুহাগৃহতলে তিলেক শব্দ হয়ে উঠে রাশি রাশি ।
নীরবে রমণী আবৃত বদনে বসিলা শয্যা- ‘ পরে ,
অঙ্গুলি তুলি ইঙ্গিত করি পাশে বসাইল মোরে ।
হিম হয়ে এল সর্বশরীর , শিহরি উঠিল প্রাণ —
শোণিতপ্রবাহে ধ্বনিতে লাগিল ভয়ের ভীষণ তান ।
সহসা বাজিয়া বাজিয়া উঠিল দশ দিকে বীণা-বেণু ,
মাথার উপরে ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িল পুষ্পরেণু ।
দ্বিগুণ আভায় জ্বলিয়া উঠিল দীপের আলোকরাশি —
ঘোমটা-ভিতরে হাসিল রমণী মধুর উচ্চহাসি ।
সে হাসি ধ্বনিয়া ধ্বনিয়া উঠিল বিজন বিপুল ঘরে —
শুনিয়া চমকি ব্যাকুল হৃদয়ে কহিলাম জোড়করে ,
‘ আমি যে বিদেশী অতিথি , আমায় ব্যথিয়ো না পরিহাসে ,
কে তুমি নিদয় নীরব ললনা , কোথায় আনিলে দাসে । ‘
অমনি রমণী কনকদণ্ড আঘাত করিল ভূমে ,
আঁধার হইয়া গেল সে ভবন রাশি রাশি ধূপধূমে ।
বাজিয়া উঠিল শতেক শঙ্খ হুলুকলরব-সাথে —
প্রবেশ করিল বৃদ্ধ বিপ্র ধান্যদূর্বা হাতে ।
পশ্চাতে তার বাঁধি দুই সার কিরাতনারীর দল
কেহ বহে মালা , কেহ বা চামর , কেহ বা তীর্থজল ।
নীরবে সকলে দাঁড়ায়ে রহিল — বৃদ্ধ আসনে বসি
নীরবে গণনা করিতে লাগিল গৃহতলে খড়ি কষি ।
আঁকিতে লাগিল কত না চক্র , কত না রেখার জাল ,
গণনার শেষে কহিল ‘ এখন হয়েছে লগ্ন-কাল ‘ ।
শয়ন ছাড়িয়া উঠিল রমণী বদন করিয়া নত ,
আমিও উঠিয়া দাঁড়াইনু পাশে মন্ত্রচালিতমত ।
নারীগণ সবে ঘেরিয়া দাঁড়ালো একটি কথা না বলি
দোঁহাকার মাথে ফুলদল-সাথে বরষি লাজাঞ্জলি ।
পুরোহিত শুধু মন্ত্র পড়িল আশিস করিয়া দোঁহে —
কী ভাষা কী কথা কিছু না বুঝিনু , দাঁড়ায়ে রহিনু মোহে ।
অজানিত বধূ নীরবে সঁপিল শিহরিয়া কলেবর
হিমের মতন মোর করে তার তপ্ত কোমল কর ।
চলি গেল ধীরে বৃদ্ধ বিপ্র , পশ্চাতে বাঁধি সার
গেল নারীদল মাথায় কক্ষে মঙ্গল-উপচার ।
শুধু এক সখী দেখাইল পথ হাতে লয়ে দীপখানি —
মোরা দোঁহে পিছে চলিনু তাহার , কারো মুখে নাহি বাণী ।
কত না দীর্ঘ আঁধার কক্ষ সভয়ে হইয়া পার
সহসা দেখিনু সমুখে কোথায় খুলে গেল এক দ্বার ।
কী দেখিনু ঘরে কেমনে কহিব , হয়ে যায় মনোভুল ,
নানা বরনের আলোক সেথায় , নানা বরনের ফুল ।
কনকে রজতে রতনে জড়িত বসন বিছানো কত ,
মণিবেদিকায় কুসুমশয়ন স্বপ্নরচিত-মতো ।
পাদপীঠ- ‘ পরে চরণ প্রসারি শয়নে বসিলা বধূ —
আমি কহিলাম , ‘ সব দেখিলাম , তোমারে দেখি নি শুধু । ‘
চারি দিক হতে বাজিয়া উঠিল শত কৌতুকহাসি ।
শত ফোয়ারায় উছসিল যেন পরিহাস রাশি রাশি ।
সুধীরে রমণী দু-বাহু তুলিয়া , অবগুণ্ঠনখানি
উঠায়ে ধরিয়া মধুর হাসিল মুখে না কহিয়া বাণী ।
চকিত নয়ানে হেরি মুখপানে পড়িনু চরণতলে ,
‘ এখানেও তুমি জীবনদেবতা! ‘ কহিনু নয়নজলে ।
সেই মধুমুখ , সেই মৃদুহাসি , সেই সুধাভরা আঁখি —
চিরদিন মোরে হাসালো কাঁদালো , চিরদিন দিল ফাঁকি ।
খেলা করিয়াছে নিশিদিন মোর সব সুখে সব দুখে ,
এ অজানাপুরে দেখা দিল পুন সেই পরিচিত মুখে ।
অমল কোমল চরণকমলে চুমিনু বেদনাভরে —
বাধা না মানিয়া ব্যাকুল অশ্রু পড়িতে লাগিল ঝরে ।
অপরূপ তানে ব্যথা দিয়ে প্রাণে বাজিতে লাগিল বাঁশি ।
বিজন বিপুল ভবনে রমণী হাসিতে লাগিল হাসি ।