সমুদ্র যাত্রা (Samudra Jatra) : 03
বাড়ির জীবন নিস্তরঙ্গ নিরাপদ। হস্টেল যে তা হয় না, হতে পারে না সেখানে যে প্রতিপদে বুদ্ধি খাটিয়ে চলতে হবে এ সব কথা আমি ভাবিনি। জানতুমই না। পুলু একবার যেন বলেছিল, আমি খেয়াল করিনি। বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে আসবার পরের দিনই সেকেন্ড ইয়ার থার্ড ইয়ারের কিছু দাদা আমাকে ডেকে পাঠাল। কী নাকি ভীষণ দরকার আছে।
কথাবার্তা হল খুব অদ্ভুত। ওদের প্রশ্ন আর আমার উত্তর। কোনওটার জন্যেই আমি প্রস্তুত ছিলুম না।
—এই তোর ফ্যামিলি স্ট্রাকচার কী রে?
—যেমন হয়। মা-বাবা-ভাই-বোন-দাদু-ঠাকুমা-দাদা-বউদি ভাইপো-ভাইঝি-মেজদা-মেজবউদি-সেজদা-সেজবউদি-জ্যাঠা-জেঠি-কাকা-কাকিমা-জেঠতুতো-ভাই-বোন-দাদা-বউদি-খুড়তুতো।
—মারব এক থাবড়া, ইয়ার্কি হচ্ছে আমাদের সঙ্গে? তোর জ্ঞাতিগুষ্টির কথা কে জানতে চেয়েছে? তুই যে বাড়িতে থাকিস সেইখানে।
আমি অবাক হয়ে বলি— সেই বাড়ির কথাই তো বলছি!
—এত বড় জয়েন্ট ফ্যামিলি তোদের?
—ইয়েস।
—তোরা কটা ভাই কটা বোন?
—বড়দা-মেজদা-সেজদা-ন’দা-ক’নেদা-নতুনদা-রাঙাদা-ফুলদা…
—বাস বাস বুঝতে পেরেছি। এতগুলো কি তোর নিজের মায়ের পেট থেকে বেরিয়েছে?
—কেউ কেউ জেঠিমা কাকিমাদেরও, তবে আমরা এইভাবেই নিজেদের কাউন্ট করি।
—বোন ক’টা, সাফ বলবি?
—এই অচিন্ত্য এক্ষুনি নামতা পড়বে রে। অন্য কোয়েশ্চন কর?
—সবচেয়ে সুন্দর বোন কোনটা!
—আমার নিজের ছোট বোন।
—চিয়ার্স চিয়ার্স হিপ হিপ হুররে। বোনটার সঙ্গে শুতে দিবি? ক’জনের সঙ্গে দিবি সেটাও ঠিক করে নে, রাইট?
—গ্ল্যাডলি। হিসি করবে, কাঁথা পাল্টাতে যতজন থাকে ততই ভাল, একজনের ওপর চাপটা বেশি পড়ে যাবে।
—রাম রাম, কত বয়স তোর বোনটার?
—মাস পাঁচেক হবে।
—বাপ রে, দাদা এঞ্জিনিয়ার হতে এয়েছে। বোন পাঁচ মাস? তোর বাবা-মা তো এখনও দিব্যি চালু রে! বয়স কত তোর মায়ের?
—মা? …আমি চোখ কপালে তুলে একটু ভাবি— ঠিকঠাক বলতে পারছি কিনা জানি না। চৌত্রিশ পঁয়ত্রিশ হবে বোধহয়।
—ইয়ার্কি পেয়েছিস? মাত্র সতেরো বছরের বড় তোর থেকে?
নিস্পাপ মুখ করে আমি বলি— কেন, সতেরো বছরে বুঝি ছেলে হয় না?
অ্যাকশন— আড়াল থেকে কে বলল।
অমনি আমাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিল ক’জন। তারপর কয়েকবার দুলিয়ে ছুড়ে দিল। আর কয়েকজন আমাকে লুফে নিল।
মাথাটা ঝুলে পড়ল। আমি অজ্ঞান হয়ে গেছি। মুখটা অল্প হাঁ, আস্তে আস্তে নিশ্বাস পড়ছে।
পুলুর গলা শুনতে পেলুম—সর্বনাশ। ওর যে হার্টের একটু গোল.. আছে। শিগগির ডাক্তার ডাকুন।
—এই খবর্দার। ঢপ অনেক দেখেছি, হেল্থ এগজামিন হয়নি? হার্টের গোল! এই কাতুকুতু দে তো রে!
যে কোনও কারণেই হোক, আমার কাতুকুতু লাগে না। মাথা একদিকে নেতিয়ে গেছে। চার হাত পা ছেতরে মড়ার মতো পড়ে আছি।
—জল ঢাল মাথায় জল ঢাল।
পুলু বলল সাবধানে ঢালবেন। নাকে মুখে ঢুকে গেলে চোক করে যাবে। দাঁড়ান আমি দেখছি—সমুদ্র, এই সমুদ্র। চোখ মেলে দ্যাখ আমি পুলু রে। আর আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের দাদারা। —সারা মাথা ভিজে, শার্টের ভেতর দিয়ে জল গলে যাচ্ছে, আমি বেশ পাঁচ মিনিট পরে চোখ একটু খুলি….
—আরেকটু হলে খুনের দায়ে পড়ে যাচ্ছিলেন ইশ্শ্… পুলু বলল,— আমাকে যা করার কালকে করবেন। আজ ওকে নার্স করতে হবে। একজন কেউ কাইন্ডলি ডাক্তার ডেকে আনুন।
—এত রাতে ডাক্তার কোথায় পাব! মালকে ঘরে নিয়ে যা।
কয়েকজন কাঁধে পিঠে করে আমাকে বয়ে নিয়ে গেল। পুলু জামা-কাপড় পাল্টে দিল, পাজামা সুদ্ধু।
ঘর নিশ্চয় ফাঁকা হয়ে গেছে। কেন না পুলু বলল— এই সমু এবার চোখ খোল। তুই যে এত ভাল অ্যাক্টিং করতে পারিস আমি জানতুম না।
কথাগুলো ক্ষীণভাবে আমার কানে এল। যেমন আরও কিছু-কিছু কথাও আমি শুনতে পেয়েছিলুম। আমি কিন্তু সত্যিই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলুম। একটা ঝাঁকুনি, তারপরে আর কিছু মনে নেই। অন্ধকার। একটা বিশাল পরিত্যক্ত বাড়ি। ঘরদোর হাঁ হাঁ করছে। অন্ধকারের মধ্যে থেকে কয়েকটা দূরবর্তী স্বর, তারপরে জল থাবড়া পড়তে আস্তে আস্তে আবার ঘরটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। দূরে জানলা, বাইরে অন্ধকার, গাছপালার মধ্যে দিয়ে একফালি চাঁদের আধখানা। চতুর্দিকে ঝিঁঝি ডাকছে। খুব আর্তস্বরে কে কী বলছে, কারা কী সব বলছে, আর্ত গলা, কড়া গলা, আর্ত, কড়া, কড়া, আর্ত।
—তুই কথা বলতে পারছিস না কেন? কী রে সমু?
—আমি বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলুম পুলু— আমি খুব কষ্ট করে বলি।
—বলিস কী রে! কাল সকাল হলেই দাদুকে ফোন করব। কী কাণ্ড!
আমি বলি— সকালের কথা পরে। এখন শোন চুপ করে। কিছুক্ষণ চুপ করে শুনল পুলু। তারপর বলল— কী শুনব, কিছু তো শুনতে পাচ্ছি না!
—অনেক গলা, কাঁদছে, অনুনয় করছে, অন্য পক্ষ ধমক দিচ্ছে, গালাগালি দিচ্ছে, কত কত দিন এই ঘরে কত ছেলেদের ওপর অত্যাচার হয়েছে, ঘরটা সব রেকর্ড করে রেখেছে।
—তুই একটা পাগল!
আমি হাসি। দেখাই যাচ্ছে আমার শোনা সবাই শুনতে পায় না, আমার দেখা সবাই দেখতে পায় না। সুতরাং আমি পাগল। আমি পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুম ভাঙতে দেখি ঘর রোদে ভেসে যাচ্ছে, সুপার দাঁড়িয়ে, তাঁর পাশে স্টেথো হাতে ডাক্তার। বললেন— নিশ্বাস নাও জোরে জোরে।
পরীক্ষা শেষ হলে বললেন— এর কয়েকটা পরীক্ষা করাতে হবে। আমি লিখে দিচ্ছি। তোমার আগে কখনও এমন হয়েছে?
আমি মাথা নাড়ি। না।
—স্বাস্থ্য তো চমৎকার।
আমি চেয়ে আছি।
উনি বললেন— এর বাড়িতে খবর দিন। ইনভেস্টিগেশনগুলো করিয়ে নিতে হবে।
আমি এবার আস্তে বলি— বাড়িতে খবর দেবেন না। ওঁদের ডিস্টার্ব করার দরকার নেই।
—তার মানে? বিনা চিকিৎসায়…?
—হ্যাঁ। আমার তাতে কোনও অসুবিধে নেই। অচিন্ত্যদা, সুব্রতদাদের জন্যে যখন হয়েছে… হস্টেলের ঘরে, তখন হস্টেলেরই দায়িত্ব…। আমার বাড়ির অবস্থা ভাল নয়। এসব ঝামেলা পোয়াবার ক্ষমতা নেই।
সুপার বললেন— এগুলো তো আমাদের করবার কথা নয়। এমার্জেন্সি হলে আলাদা কথা।
—মানুষ ছোড়াছুড়িটা তা হলে আপনাদের করবার কথা, কিন্তু তার ফলগুলোর দায়িত্ব নেবার কথা নয়। আমি ক্ষীণ গলায়, কোনও রাগ ছাড়া শান্ত ভাবে বলি।
ডাক্তার বললেন— সিচ্যুয়েশন এ রকম হলে আমি আপনাদের হায়ার অথরিটিকে জানাব। তাতেও কাজ না হলে পুলিশ। ইন এনি কেস— এ ছেলেটির যদি কোনও ইনজুরি হয়ে থাকে, তাতেও প্রসিডিওরটা একই থেকে যাচ্ছে। এর বাড়িতে জানালেও…
সুপার বললেন— তোমরা সবাই চাঁদা তুলে ফেলো, দ্যাখা যাক কী হয়। সুব্রত অধিকারীর চোখে ভয়ের ছায়া দেখে আমি আবার চোখ বুজলুম।
নিজের সম্পর্কে এই কথাগুলো আমার জানা ছিল না। সম্মিলিত আক্রমণের বিরুদ্ধে আমার মন যে আপনাআপনি এরকম একটা নীতি ঠিক করে নিতে পারে, শরীর তাতে সাহায্যও করে,—এটা নতুন খবর। খবরটাকে আমি শান্ত ভাবে হজম করি। পুলু অনেকবার বলে তোর বাড়িতে জানাই। আমি না করি। একজন বৃদ্ধ, একজন ভিতু, আর একজন অনুপস্থিত, এই তো আমার বাড়ির সত্যিকার স্ট্রাকচার। নিজেই যতটা পারি নিজেকে দেখব। চিরকালই সম্ভবত এমনটাই করে এসেছি। এখনও না করার কোনও কারণ নেই।
ইনভেস্টিগেশনে অবশ্য তেমন কিছু বার হল না। স্নায়বিক ব্যাপার— ডাক্তার বললেন। নিউরোলজিস্ট দেখাতে বললেন। আমার নিউরোলজিস্ট দেখাবার সময় নেই।
সুব্রতদা বলল— দেখিয়ে নে সমু, আমরা টাকা দিচ্ছি। সত্যি যদি কোনও গণ্ডগোল হয়ে যায় তা হলে বাড়ির লোকেদের জানা দরকার।
আমি রাজি হইনি।
সত্যি কথা বলতে কি সুব্রত অ্যান্ড কোং যখন আমাকে অকথ্য অশ্লীল কথাগুলো বলছিল, আমার কিচ্ছু মনে হয়নি। কথার পিঠে শুধু কথা সাজিয়ে দিয়েছিলুম। মিথ্যার পিঠে মিথ্যা। শারীরিক আক্রমণটা যতটা লেগেছিল মানসিক আক্রমণটা তার দশ শতাংশও না। অথচ এসব কথা আমি কখনও শুনিনি। আর হস্টেলে আসবার আগে কেউ আমাকে সাবধানও করেনি। কিন্তু আমার অসুবিধে হয়নি। কার কথা ওরা বলছে— মা, বাবা, ভাই, বোন… কতগুলো শব্দ শুধু। তার পেছনে যদি অনুভূতি ও আবেগ থাকে তা হলেই শব্দগুলো অর্থপূর্ণ। নাহলে তো নয়। সুব্রতদাদের মুখে ওই শব্দগুলো শুধু শব্দই ছিল। প্রাণহীন অর্থহীন শব্দ। পরে যখন পুলু বলল— ‘সমু তোর রাগ হয়নি? আমাকে ও রকম বললে আমি তো লাফিয়ে পড়ে ওদের আঁচড়ে কামড়ে দিতুম…’ আমি বললুম— না রে কিচ্ছু মনে হল না। যে মুহূর্তে ওরা দল বেঁধে ঘরে ঢুকল আমার মনে হল একদল ছায়া মানুষ ঢুকল, যারা কিছু না কিছু অত্যাচার করে যাবে, আমার লাগবে না, কেন না সবটারই ভিত্তি মিথ্যে। মিথ্যেটাকে মিথ্যে দিয়ে আটকাতে তাই আমার অসুবিধে হয়নি।
কিন্তু মনটা আমার আয়ত্তে হলেও শরীরটা তো নয়। ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যখন আমাকে ছুড়ে দেওয়া হল তখন একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি, একটা মারাত্মক স্নায়বিক ভয়। এক্ষুনি মাটির ওপর আছড়ে পড়ব। থেঁতলে যাব। শরীরটা কুঁকড়ে ঠান্ডা হয়ে গেল, কালঘাম ছুটতে লাগল, বেগতিক বুঝে সেই কটা মুহূর্তের জন্যে শরীরটা মরে গেল। ওটা শরীরের নিজস্ব ডিফেন্স মেকানিজ্ম্।
পুলক বলল— কিন্তু তুই তো পুরো অজ্ঞানও হোসিনি। আমাদের কথাগুলো তো শুনতে পাচ্ছিলি!
—হ্যাঁ, কিন্তু কেমন যেন অনেকে দূর থেকে। খুব হালকা গলা, যেন অনেক কুয়াশা ভেদ করে আসছে দু’চার ছিটে রোদের কণা। তবে সেটা ঠিক কী, কেন ও রকম হল পুলু আমি বলতে পারব না। আমি তো ডাক্তার নই। তা ছাড়া ধর মৃত্যুর সময়ে কী হয়? চারপাশের কান্না, হাহাকার তো এমনই দূর থেকে চেতনায় এসে পৌঁছয়, তাই না?
—মৃত্যুর সময়ে কী হয় আমি কী করে জানব? পুলক অবাক হয়ে বলল, তুই-ই বা কী করে শিওর হচ্ছিস যে ও রকমই হয়?
—জানি না, কেমন মনে হল।
—তুই একটা কিম্ভূত।
পুলু বা পুলক আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। পাড়ার বন্ধু, স্কুলের আবার ক্লাবেরও বন্ধু। একদম ছোট্ট থেকে যেহেতু দু’জনে সর্বত্র একসঙ্গে একই জায়গায় যাওয়া আসা করেছি সেইজন্যেই প্রধানত ওর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা। ও যে আমাকে সব সময়ে বোঝে তা না। কিন্তু কখনও আমাকে ঠাট্টা-তামাশা করে না, বিশেষত অন্য কারও সামনে। কেমন একটা টানও ওর আছে আমার ওপর।
বয়-স্কাউটের দলে সেবার আমরা জাম্বোরিতে গেছি গিরিডি। দিন সাতেকের ক্যাম্প। খাণ্ডোলি পাহাড়ের কাছাকাছি ক্যাম্প পড়েছে। একটু দূরে তিরতির করে বইছে উশ্রী নদী। খুব সরু, জল কম। সন্ধেবেলায় ক্যাম্প ফায়ার ঘিরে প্রতিদিনই আমাদের নানা রকম আনন্দ অনুষ্ঠান হত। গান হচ্ছে আবৃত্তি হচ্ছে। সুকুমার ছিল হরবোলা। পশুপাখির ডাক তো নকল করতে পারতই। নানান মানুষের গলা অবিকল তুলে নিতে পারত নিজের গলায়। আমাদের, স্কাউট মাস্টারদের— সবার।
সেদিন ওই রকম অনুষ্ঠান হচ্ছে। কেউ করছে রবীন্দ্রসঙ্গীত, কেউ নজরুল, বেশ গরম গরম কবিতাও আবৃত্তি হচ্ছে। সুকান্ত, নজরুল। হঠাৎ আধো-অন্ধকার থেকে শম্ভুদার গলা এসে আমাকে বিঁধল—সকলেই কিছু না কিছু করছে, তুই কেন চুপ করে বসে আছিস সমুদ্র? কিছু বল! কর!
আমি কিছুই পারি না। অন্যরা যেটা করে আমার ভাল লাগে।
গানের সুরটা জানা থাকলে বা কবিতাটা মুখস্থ থাকলে গলা মেলাবার চেষ্টা করি। কিন্তু নিজে না পারি সে ভাবে গান করতে, কবিতা-টবিতা আওড়াতে, কমিক-টমিক তো আমার একেবারেই আসে না। এ-ও জানি এখানে সবাই কিছু না কিছু করতে বাধ্য। না করলে পুরো মেজাজটাই নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়াও ‘আমি কিছু জানি না পারব না’ এ সব বলাও আমার কেমন ন্যাকামি মনে হত।
বিনা ভূমিকায় ছাই-পাঁশ যা মনে হল বলে গেলুম অতএব— দেখ স্কাউট ভাইরা, মালদা, বর্ধমান, বাঁকুড়া, শিলিগুড়ি, কলকাতা, হুগলি, নদিয়া আরও কত জায়গা থেকে আমরা এখানে এসে মিলেছি। আমাদের জীবনযাত্রা, পরিবার, ভাল-লাগার জিনিস, আলাদা আলাদা। দক্ষতাও সব বিষয়ে সবাইকার একরকমের নয়। কিন্তু এক জায়গায় আমরা সবাই এক। এই জাম্বোরিতে। একদিকে দেখ ওই ঝিরঝিরে নদী, আর একদিকে পাহাড় দিয়ে আমরা ঘেরা। নদী যদি শুরু হয় তো পাহাড় দাঁড়ি। মাঝের ফাঁকটায় ক্যাম্প পড়েছে আমাদের; আগুন জ্বেলেছি, হাত-পা সেঁকে নিচ্ছি শীতের রাতে, গ্রীষ্মে ওই নদীর জল যত কমই হোক ঝাঁপিয়ে স্নান করব। আমাদের সারা জীবনের যা কিছু জানা বোঝা সব আমরা অন্যদের কাছে উজাড় করে দিচ্ছি। এর পর আগুন নিবে যাবে, জাম্বোরি শেষ। সব গান কবিতা, অভিনয় সব রকমের খেলাধুলো, একসঙ্গে কাজ-কর্মের দিন, বক্তৃতা, নির্দেশ ডুবে যাবে, জেগে থাকবে শুধু পাহাড়। এসো আমরা পাহাড়ের কথা ভাবি।
কিছুক্ষণ সব চুপ। তারপর সুকুমার চেঁচিয়ে উঠল— জল ঢেলে দিলি সমুদ্র। একেবারে বালতি বালতি ঠান্ডা জল ঢেলে দিলি। তোকে কিছু করতে বলাই আমার ভুল হয়েছে। ধুস্।
তখন বুঝতে পারলুম শম্ভুদার গলা নকল করে সুকুমারই ফরমাশটা আমাকে করেছিল। শম্ভুদা ওখানে নেই-ই।
কিন্তু আশ্চর্যের কথা অন্য কেউ কোনও শব্দ উচ্চারণ করল না। আমরাই তখন সবচেয়ে সিনিয়র। আমাদের থেকে ছোটও অনেক ছিল। কেউ কিছু বলল না।
শুধু পুলু বলে উঠল— যার যা মনে হয়েছে করেছে, বলেছে, সমুকে বলতে বলেছিলি ও ওর মতো বলেছে। সুকুমার তুই যা করছিস সেটা ক্যাম্পের স্পিরিট নয়। চুপ করে যা।
আমিই ছিলুম শেষ বক্তা। তখনও আগুন জ্বলছে। ছোট ছোট শিখা মাঝে মাঝে হুস করে জ্বলে উঠছে। তলায় কাঠগুলোর ধিকি ধিকি দেখা যাচ্ছে, একটা ঠান্ডা হাওয়া উঠল, শিরশির করছে গা, সেই নিবন্ত আগুন মাঝখানে নিয়ে আমরা বসে আছি সব্বাই সুকুমার সুদ্ধু। যতই রাত বাড়ছে অন্ধকার আকাশের পটে আরও জমাট অন্ধকার হয়ে ফুটে উঠছে ধূম্র পাহাড়। কতক্ষণ বসেছিলুম কে জানে, শম্ভুদা বিপ্লবদারা এসে ডাকলেন। ‘খাবার রেডি। দেখি আজ কে ক’টা রুটি খেতে পারিস।’ আসলে অন্যান্য দিন রান্না ওঁদের সাহায্য নিয়ে আমরাই করতুম। আজকে ওঁরা করেছেন।
আমাদের চুপচাপ দেখে বিপ্লবদা বললেন— ‘কী রে তোরা কি মেডিটেশন করছিস?’ প্রসঙ্গত, ধ্যানও আমাদের ক্যাম্প-জীবনের একটা প্রাত্যহিক করণীয় ছিল। তবে বিপ্লবদা ক্যাম্প-জীবনে বৈচিত্র্য আনতে পুরো রুটিনটাকে একেক দিন ওলোটপালোট করে দিতেন। ধ্যান যে কখন হবে তা কেউ বলতে পারত না। একদিন সকালবেলা আমরা অনেকে মিলে ডিমসেদ্ধ, পাউরুটি টোস্ট করলুম। কয়েকজন মাখন লাগাল, কয়েকজন চা তৈরি করল। কয়েকটা শালপাতার থালায় খাবারগুলো রাখা হল রোজকার মতো, মাটির ভাঁড়ে চা, কয়েকজন মিলে একসঙ্গে গোল হয়ে বসা একটা থালায় দিস্তে দিস্তে টোস্ট, আরেকটাতে ডিম, এরকম অন্তত দশটা দল তো থাকতই।
খাওয়া শেষ? বিপ্লবদা আধঘণ্টা সময় দিয়ে হাঁকলেন— ব্যস হাত মুখ ধুয়ে সমবেত হও বৎসগণ।
আমরা এঁটো শালপাতা মাটির ভাঁড় জড়ো করে ফিরে এলুম। বিপ্লবদা বললেন— মেডিটেশন, গেট সেট গো…।
ব্যস সব্বাইকে যে যেখানে আছে পদ্মাসনে বসে পড়তে হবে। তারপর ধ্যান। চোখ বুজে। বিপ্লবদা স্টপওয়াচ দেখে ঠিক দশ মিনিট পরে মিলিটারি গলায় বলবেন— ওভার।
এইরকম।
সে রাতে কি তারা-জ্বলা, নিচাঁদ আকাশের তলায় পাহাড়ের নিশ্চলতা গাম্ভীর্য, অবশ্যম্ভাবিতা… প্রাকৃতিক বস্তুর এবং মৃত্যুর… আমরা সবাই-ই কিছুক্ষণের জন্যে অনুভব করেছিলুম? তাতে আমার উল্টোপাল্টা কথাগুলোর কি সত্যি কোনও ভূমিকা ছিল?
টেন্টগুলো ছিল ছোট ছোট। বদলে বদলে থাকতে হত আমাদের, যাতে সবাই সবাইকার সঙ্গে থাকার সুযোগ পায়। সে রাতে আমার সঙ্গে ছিল দুটি জুনিয়র ছেলে— হাফিজ আর মাইকেল। এটাও স্কাউটমাস্টারদের প্ল্যানের অন্তর্গত। নানা ধর্মের ছেলেদের পারস্পরিক মেলামেশা, যৌথ জীবন। শুয়ে শুয়ে গল্প করাটাকে খুব একটা উৎসাহ দেওয়া হত না। তবে সারাদিন খেলাধুলো, সাঁতার এবং অত রকম কাজ-কর্ম করে বিছানায় শোওয়ামাত্র আমরা ঘুমিয়েই পড়তুম। দূর থেকে বিপ্লবদার হুইসলের শিস্, সঙ্গে সঙ্গে পাশ ফিরে ঘুম।
হয়তো সেদিন রাত্রের রান্নাটা মাস্টারমশাইরা করায় আমাদের ক্লান্তি একটু কম ছিল, হাফিজ বলল,— সমুদা ঘুমোলে?
—না।
—মাইক্ল ঘুমিয়েছিস?
—উঁহু।
আমারও ঘুম আসছে না। —তারপরে কেমন কাঁপা-কাঁপা গলায় হাফিজ বলল— আমি চিতাকে ভয় পাই।
—চিতাকে আবার কে না ভয় পায়? বিশ্বের দ্রুততম হিংস্র প্রাণী। তবে এখানে চিতা-টিতা নেই। —আমি আশ্বাস দিই।
—জানোয়ার চিতার কথা বলিনি। ওই মড়া পোড়ানোর কথা বলছি।
—তোরা হঠাৎ চিতা-টিতার কথা ভাবছিস কেন?
—তুমি যে বললে পাহাড়ের কথা ভাব।
আমি চুপ করে যাই। সেই মুহূর্তের একটা নিজস্ব অনুভবের কথাই তো আমি বলেছি, সমস্ত আমোদ-আহ্লাদের মধ্যে প্রকৃতি আমাকে এমন একটা এক্স-ফ্যাক্টরের উপমা দেখিয়েছিল যেটা নাকি সনাতন।
—মৃত্যুর সঙ্গেও চিতা বা কবরের তেমন কোনও সম্পর্ক নেই। মৃত্যু একটা অজানা দিগন্ত, পাহাড় যেমন রহস্যময়, তেমনই। তাই থেকেই তুলনাটা এল। মৃতদেহের তো নানা জনে নানারকম সৎকার করে। মৃত্যু একটা অন্য অভিজ্ঞতা।
—তোমার কথা বুঝতে পারলুম না।
আমি নিজেই কি বুঝি? তাই হেসে বললুম— বুঝতে হবে না। কী করব, বলব ভেবে না পেয়ে ওই সব উল্টোপাল্টা বকেছি।
দূর থেকে হুইসল বেজে উঠল। বিপ্লবদা বোধহয় কোনও কোনও টেন্টে কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন। তাই দ্বিতীয়বার হুইসল।
—ঘুমিয়ে পড়। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।
পরদিন দুপুরবেলা। তখন আমরা বাসন মাজছি। বড় ছেলেরা কড়া হাঁড়ি ডেকচি এইসব নিয়ে বসেছি। ছোটরা জল ঢেলে দিচ্ছে। কেউ কেউ দূরে শালপাতা মাটির খুরি গেলাস ফেলে আসছে, সুকুমার চাপা রাগত গলায় বলল—তোকে আমি দেখে নেব সমুদ্র। বাড়ি ফিরি। তোকে আমি ছাড়ব না।
আমি অবাক।
—আমার ওপর রাগ করে আছিস এখনও? শুধু কালকের ওই কথাগুলোর জন্যে?
—আমার বাবা-মা ক’দিনের মধ্যে মারা গেছে, আমি মামার বাড়িতে থাকি তুই জানিস না? সবে ভুলতে শুরু করেছি, ক’দিন একটু আনন্দ করছি, মজায় আছি, তোর সেটা সইছে না, কেমন? মীন। মীন একটা…
—আমি সত্যি জানতুম না সুকুমার। কী করে জানব, বল।
—কোথাও থেকে জেনেছিস। বেস্ট স্কাউটের দৌড়ে আমি এগিয়ে আছি। জেনে বুঝে তুই আমাকে দমিয়ে দিতে চেষ্টা করছিস, তোর ওই চামচা পুলকটা সেকেন্ড প্লেস পাচ্ছে বলে!
এত অবাক হয়ে গেছি যে মুখ দিয়ে কথা সরছে না আমার।
বলি— আমায় বিশ্বাস কর, আমি কিছু জানতুম না। এভাবে কাউকে দমিয়ে দেওয়া যায়, তা-ও আমার ধারণায় নেই। ওটা একটা কী বলব…যে মুহূর্তে বললুম সেই মুহূর্তের ভাবনা। আমার তো তোদের মতো কোনও গুণ নেই। যা মনে হল তাই বলে ফেলেছি। তুই ওসব আজে-বাজে কথা ভাবিসনি।
সুকুমার অতবড় শক্তপোক্ত ছেলেটা হঠাৎ মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল।
কিছুক্ষণ কাঁদবার পর যখন একটু শান্ত হয়েছে তখন সাহস করে ওর কাঁধে একটা হাত রাখি। —সুকুমার, আমি বুঝতে পারছি। তোর কষ্টটা ঠিকঠাক বুঝতে পারছি। ভুলে যা। কালকের কথা ভুলে যা। আজ খুব দারুণ কিছু একটা করবি। আজ শেষ।
—আমি আর কিছুই করতে পারব না, সমুদ্র। আমার বাবা মা ওই পাহাড় থেকে আমায় ডাকছে। কী জোর সেই ডাকের তুই বুঝবি না। কান্না ভেজা ফুলো লাল চোখমুখ নিয়ে সুকুমার বেরিয়ে গেল।
পুলুকে জিজ্ঞেস করি—কী করব? এই ব্যাপার।
—অদ্ভুত তো! —পুলু অবাক, এরকম হয়?
আমরা দুজন পরামর্শ করে সেদিন টেন্টগুলোর পেছনে একেবারে তিরতিরে নদীটার ধারে বন ফায়ার জ্বালালুম। সারেরা বললেন— কী একটা স্পট বাছলে?
—রোজ রোজ এক জায়গায় ভাল লাগে না সার।
পাহাড়ের দিকে মুখ জায়গাটা পুরো ভর্তি। সুকুমারকে বসতে হল নদীর দিকে মুখ করে।
ক্রমশ ক্রমশ জমে উঠতে লাগল আমাদের জাম্বোরির শেষ রাত। হই-হল্লা। এক সারের বাকসো থেকে বেরোল একটা লজঝড়ে স্প্যানিশ গিটার। একজন বার করল মাউথ অরগ্যান। স্টিলের থালা আর লম্বা হাতা নিয়ে রেডি আরও একজন। নাচবে বলে কয়েকজন দাঁড়িয়ে উঠল, মুখে মুখে গান তৈরি, হাতে হাতে বাজনা… একেবারে যাকে বলে আবোল-তাবোল। বিপ্লবদা ধরলেন— হেই হেই আশিয়ানা ট্যাংগো
পুলু পরের লাইন— যত পারো করে নাও ব্যঙ্গ
সমীরদার লিডে সবাই— কেউ থামাবে না গান, কেউ থামাবে না নাচ
কেউ দিচ্ছে না রণে ভঙ্গ, ভ্যাংগো—ও-ও।
হাফিজ— হো হো আমাদের ট্যাংগো
তপন— আমাদের দেশিয়ানা ম্যাঙ্গো
সবাই— চেখে দ্যাখো সয়ে যাবে, না চাখলে বয়ে যাবে
এর নাম রঙ্গ, র্যাংগো…