সমুদ্র যাত্রা (Samudra Jatra) : 16
আমি কি নারীবিদ্বেষী হয়ে যাচ্ছি? কিংবা হয়েই জন্মেছি! আমার মা’র সঙ্গেও তো আমার সম্পর্ক হয়নি! সেটা কার দোষ, মায়ের না আমার? নাকি পরিস্থিতির? কোনও মেয়েকে আজ পর্যন্ত আমি চাইনি। কেন? এ কি সেই তরুণ বয়সে কুৎসিত উলঙ্গ বেশ্যাকে দেখার ফল? যা সুন্দর, যা স্বাভাবিক, সৃষ্টির প্রথম যে শর্ত আমাদের শরীর জুড়ে রয়েছে তাকে বিকৃত উৎকট চেহারায় দেখাল আমার নিয়তি। অথচ, আমার সহপাঠীদের তো কিছু হল না! তারা প্রথম যৌবনের কৌতূহল ও প্রবৃত্তি মেটাতে বেশ্যাসঙ্গ করল, তারপর একদিন কোনও মেয়েকে ভালবেসে বা গুরুজনের ব্যবস্থাপনায় বিয়ে করে জীবনভর আইনসঙ্গত নারীসঙ্গ করছে, কোথাও কোনও কাঁটা ফুটছে না, বিষ উগরোচ্ছে না! যদি বা সুন্দর আমাকে দেখা দিল, স্বর্গ আমার জানা হল, পরমুহূর্তে এ কী অদ্ভুত প্রতারণা! আমার ভাগ্যেই ছিল? এখন আবার জানতে পারছি আরও দুটি মেয়ে আমার অনুরক্ত। এমনই নাকি আমার চুম্বক টান! তা এরাও বোধহয় সেইভাবেই আমাকে চাইছে। এক রাতের বনিতাগিরি!
কিন্তু, আমিই কি সত্যি চিরকালের জন্য কাউকে চাইছি। দীপাকে চেয়েছিলুম কেন না সেটাই সামাজিক রীতি। সামাজিক কর্তব্য, দায়িত্ব। যদি ঘটনাটা না ঘটত তা হলে তো চাইতুম না। এই প্রথম আমার মনে হল প্রশ্নটাকে না এড়িয়ে সোজাসুজি এর মুখোমুখি দাঁড়াই। কীভাবে দাঁড়াব? সোজাসুজি জিজ্ঞেস করব? তা কি করা যায়! আমার চাপা স্বভাব। স্বভাবের বিরুদ্ধে কি এতখানি যাওয়া যায়? ঠিক আছে। আমি পর্যবেক্ষণশীল হব। জীবনকে সহজে নিতুম। এবার সহজে নেব না। জটিলে নেব। নিজেও জটিল হব, সতর্ক।
ছোড়দা, তোর কী হয়েছে বল তো? —আমার দিকে চোরা চাউনি হেনে ফিনকি অবধারিত বলল। ফিনকির চুল ফুলে রয়েছে। সালোয়ার কামিজ পরে আজ ওকে আরও ছেলেমানুষ দেখাচ্ছে। কনুই ভেঙে হাতের পাতায় মুখ রেখে ও আমার দিকে চেয়ে রয়েছে।
—কী আবার হবে?
—তা অবশ্য। আমাকে বলবিই বা কেন। কে একটা খুড়তুতো বোন।
আমি হেসে ফেলি। ও-ও হাসে।
—তুই প্রেমে পড়েছিস, না রে?
আমি চমকে উঠি—ইস্স্ কথাটা আমার মাথাতেই আসেনি ফিনকি বুঝলি। তুই নিশ্চয়ই প্রেমে পড়েছিস। আমার খোঁজ রাখা উচিত ছিল। কিন্তু কী জানিস জারতুতো ভাই তো! নিজের দাদা হলে যতটা …
ফিনকি আমাকে একটা রাম-চিমটি কাটল। চোখ হাসিতে চকচক করছে।
হঠাৎ আমার মনে হল আমি এক তেপান্তরের মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। পুরো দৃশ্যটা আধো-অন্ধকার। চারদিকে ভূতের মতো কয়েকটা গাছ। আকাশে তিন চারটে তারা জ্বলজ্বল করছে। বহুদূর থেকে কে আমার দিকে আসছে। মেয়েই বোধহয়। ফিনকি? ফিনকির মতোই তো দেখায়, কেমন একটা কালো মতো পোশাক পরেছে— ছায়ার সঙ্গে মিশে আছে যেন। আসছেই আসছেই, কিন্তু এগোচ্ছে না, একটুও এগোচ্ছে না।
—কী রে? একটা ঝটকা দিল ফিনকি।
—হ্যাঁ, কী বলছিলি?
—বলছিলুম খুড়তুতো বোনকে প্রেমে পড়ার গপ্পো করা যায় না।
—করা যায়, কিন্তু মজাটা হচ্ছে কিছুতেই প্রেম ঘটছে না।
—তুই চেষ্টা করছিস?
—ধুর, চেষ্টা করে হয়? তুই-ই বল্।
—চেষ্টা করাটা দরকার, তোর বিশেষ করে।
—কেন? আমার আবার বিশেষ করে কেন?
—ছোড়দা তুই বড্ড একা। এত একা হওয়া ভাল না।
—তুই একা নয় তো?
—না আমি একা নই। আমার অনেকে আছে। মা বাবা জেঠু, দিদা, বন্ধুবান্ধব, মাস্টারমশাই। তোর কেউ নেই!
আমি এবার গম্ভীর ভাবে বলি— তুইও নেই?
—আমি তো থাকতে চাই। কিন্তু তোর ঘরের ছিটকিনি তুই সব সময়ে লাগিয়ে রাখিস। তুই কাউকে ঢুকতে দিস না।
—হয়তো আমার মন নেই।
—মন যে আছে সেটা জানার জন্যে কারও দরকার হয় ছোড়দা, তুই প্রেমে পড় প্লিজ।
আমি হাসি সামলাতে গিয়ে কেশে ফেলি, তারপর ও একটুও হাসছে না দেখে, গম্ভীর ভাবে বলি— প্রেমে পড়লেও যদি একা থেকে যাই?
—দূর, প্রেমে পড়া মানেই দরজা খুলে গেল। মুখোমুখি দুটো দরজা। সেই খোলা দরজা দিয়ে একা মানুষটা বেরিয়ে যায়, অন্তত আর একটা মানুষের কাছে। ছোড়দা আমার কিন্তু তোর তিন কলিগকেই খুব ভাল লেগেছে।
—তা হলে তুই-ই ওদের প্রেমে পড়েছিস?
—ঠাট্টা নয় রে। তুই যাকে ইচ্ছে পছন্দ করতে পারিস, বাড়িতে কোনও আপত্তি হবে না।
মনে-মনে ভাবলুম— হায় হায়, বাড়ির আপত্তির কথা কে কখন ভেবেছে! নিজের আপত্তিকেই সামলে উঠতে পারছি না।
বলি— ছাড় ফিনকি, আমার এই প্রসঙ্গ ভাল লাগছে না, তোর কথা বল।
—আমার কোন কথা? এত কথা আছে, কোনটা বাছব?
—বাপ রে! বলিস কী! এত?
—হ্যাঁ, যেন এটা স্বতঃসিদ্ধ এমন ভাবে বলল ও। অনেক কথা থাকাটাই যেন স্বাভাবিক।
—তো আমাকে তার এক গণ্ডূষ দে।
—ছোড়দা তুই কী নিয়ে ভাবিস জানি না, আমার মনে হয়, নিজেকে নিয়ে। মানে তুই স্বার্থপর, নিজের ছাড়া কারও কথা ভাববার তোর মন নেই এটা কিন্তু একেবারেই বলতে চাইছি না। সেদিক থেকে দেখতে গেলে তুই বরঞ্চ উল্টোটাই। তুই জেঠুর কথা এত করে ভেবেছিস, মাকে সেদিন কীভাবে বোঝালি আত্মত্যাগের ইউসলেস মোহ, দাদাকে আমাদের পারিবারিক প্রয়োজন থেকে ছেঁটে ফেলে মান বাঁচিয়েছিস আমাদের। এ সবই। কিন্তু ছোড়দা তুই নিজেকে নিজের সমস্ত সম্ভাবনাসুদ্ধ একটা কৌটোর মধ্যে আটকে রেখেছিস। তোর যেন অনেক দূরে একটা আলাদা বাড়ি আছে, সেখান থেকে এসে তুই আমাদের কাজগুলো করে যাস। তারপর ফিরে যাস তোর নিজের বাড়িতে।
ফিনকি সব সময়ে হাসি-খুশিতে ভরা, ইয়ার্কি-ফাজলামিতে ভরা ফিনকি এইসব অপ্রত্যাশিত কথাগুলো বলছিল আর আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল বাড়ির পরে বাড়ি। বিরাট, ক্ষয়রোগে আক্রান্ত, পাঁচিল দিয়ে ডালপালা মেলে অট্টহাসি হাসছে বট পাকুড় অশথ, ঘরদালান সব খালি পড়ে রয়েছে। আওয়াজ করলে তার প্রতিধ্বনি উঁচু সিলিং-এ, দেয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে ফিরে আসে, চতুর্দিকে ছড়িয়ে যায়। জানলা দিয়ে তাকালে চোখে পড়ে ধ্বংসস্তূপ, কত দেয়াল, কত ছাদ ভেঙে পড়ে রয়েছে, দালান দিয়ে উঠোনে, উঠোন থেকে ঘরে, ঘরের পর ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে একজন ছোট্ট ছেলে, কিছু খুঁজছে। কিন্তু কী খুঁজছে আমার জানা নেই।
সত্যিই তার সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে ওই নাম-না জানা তল্লাশিতে। মন বলো মন, প্রাণ বলো প্রাণ। আর তাই-ই হয় তো সে পথ চলে আনমনে, কাজ করে যান্ত্রিক, সব বুঝতে পারে, যা করার করে যায় কিন্তু আধখানা সিকিখানা মন দিয়ে। বাকি আধখানা, বা তিন চতুর্থাংশ নিখোঁজ। কেউ কি নেই, কিছু কি নেই যা আমাকে ওই রহস্যাধার বাড়ি থেকে ছুটিয়ে বাইরে বার করে আনতে পারে?
চুপ করে ভাইবোন মুখোমুখি বসে থাকি। এই যে ফিনকি, এ সত্যি-সত্যি কে? আমি একে বেশ পছন্দ করি, এ আমার খুব আদরের ছাত্রীও। কিন্তু এ কে? এ বাড়িতে এ-ই আমার ঘনিষ্ঠতম, এ জেনে ফেলেছে আমার অন্য বাড়ির কথা, আমিও জানি ওর সমকেন্দ্রিক বৃত্তীয় স্বভাব-কথা। এই জানা ইনস্টিংকটিভ, বা ইনটুইশন জাত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তেমন কোনও দৃঢ় সেতু নেই যা বেয়ে আমরা পরস্পরের কাছে পৌঁছতে পারি।
—ও বলে— এই ছোড়দা, মন খারাপ করছিস না কি, আমার কথায়?
দূর ও জানেই না সে-অর্থে আমার মন খারাপ হয়ই না।
—আমি জানি তুই এই উদাসীনতাটা পেয়েছিস মায়ের কাছ থেকে।
এই তো একটা শব্দ পাওয়া গেছে। অন্ধের নড়ির মতো নির্ভরযোগ্য একটা শব্দ— ‘উদাসীনতা।’ শব্দটা আমরা চিনি, তার অনুষঙ্গগুলো আমাদের চেনা ফিনকি। ‘বাড়ি’ থেকে ‘উদাসীনতা’য় পৌঁছলে বড় স্বস্তি পাই। আমাকে যেন কে খোলামকুচির মতো ছুড়ে দিয়েছিল এক চলন বিলে। হাবুডুবু খাচ্ছিলুম। সযত্নে সেখান থেকে তুলে এনে কেউ স্থাপন করল পাথরের গর্তে জমে থাকা বৃষ্টির জলে। আমার কাজটা সোজা হয়ে গেল।
আমি হাসি, — তো তারপর?
—তারপর মানে, মায়ের উদাসীনতাটা কিন্তু কতকগুলো ঘটনার কারণ, মোটেই স্বভাব নয়। জানিস?
—না তো! কী?
—এই দ্যাখ, কোনওদিন মানুষটাকে জানবার চেষ্টাই করিসনি! আমরা যে একেক জন একেক রকম গড়ে উঠি তার পেছনে একটা কার্য-কারণ থাকে। স্বীকার করছি সহজাত স্বভাবও থাকে খানিকটা। কিন্তু কার্য-কারণটা ভীষণ ইমপর্ট্যান্ট!
—তা তো বটেই, —আমি ঠেকা দিয়ে যাই। ফিনকি বাজুক। নিজের ইচ্ছে মতো বাজুক।
—জানিস কি? মা একজন স্কলারশিপ পাওয়া মেয়ে! লজিক আর সিভিক্স-এ মায়ের হায়েস্ট মার্কস ছিল ইউনিভার্সিটিতে? সে সময়ে ইনটারমিডিয়েট পড়তে হত!
এ খবর সত্যিই আমি জানতুম না। আরও কিছু শোনবার আশায় চেয়ে থাকি।
—মা শুধু পড়াশোনায় ভালই ছিল না। ভালবাসত খুব। পড়াশোনাটাই প্রাণ ছিল। তার ওপরে মা অপূর্ব গাইত। তুই মায়ের গান শুনেছিস?
আমি অবাক হয়ে বলি— কই না তো!
—আমি মায়ের বাথরুমে গুনগুন থেকে ধরে ফেলি। তারপর জেরা, জেরা। শেষে স্বীকার করতে বাধ্য হল প্রথমে উস্তাদের কাছে, তারপর পঙ্কজ মল্লিক, শৈলজারঞ্জন এঁদের কাছে গান শিখেছিল। কিন্তু সুদ্ধু কালো মেয়ে বলে মায়ের বাবা-মা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে মনস্থ করেন। যেদিন যেদিন মেয়ে দেখতে আসত মা কলঘরের ছিটকিনি দিয়ে বসে থাকত। কিছুতেই বেরোত না। আমাদের দাদু সব কথা শুনলেন, তারপর নিজে কলঘরের দরজায় ঘা দিয়ে বলেন— মা, আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে কলেজে পড়াব, তুমি গান শিখবে— ঠিক যেমন আগে ছিলে তেমনই থাকবে। আমরা তোমার মতো গুণী মেয়েই চাই মা।
এইভাবে বয়স্ক মানুষের পীড়াপীড়িতে আর আদরে মা বেরিয়ে এসেছিল।
—তারপর?
—তারপর? তোর তা হলে কৌতূহল আছে বলছিস!
—নিশ্চয়ই — (ওই যে বললুম আমি শুধু ঠেকা দিয়ে যাই)।
—তারপর খুব ঘটাপটা করে বিয়ে হল। মা থার্ড থেকে ফোর্থ ইয়ারে ওঠার পরীক্ষাটা মিস করল। তা সত্ত্বেও অত ভাল ছাত্রী বলে কোনও অসুবিধে হয়নি, কিন্তু তারপরই প্রেগন্যান্সি, মায়ের প্রাণান্তকর কষ্ট হয়েছিল, হাসপাতালে থাকতে হয় বহুদিন। ড্রিপ চালাতে হয়। দাদা হল, ফাইন্যাল পরীক্ষা এসে গেল, বইয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন বহুদিন। মা বলল— পরীক্ষা দেব না।
দাদু বললেন—ঠিক আছে, পরের বছর দিয়ো। পরের বছর মায়ের দ্বিতীয় সন্তান হল, মেয়ে, এবং মারা গেল, পরীক্ষা দেবার প্রশ্নই নেই। তারপরে মা কলেজ যেতেও চায়নি। পরীক্ষা দিতেও অস্বীকার করে।
—আর গান?
—ওরে বাবা, দাদু লিবার্যাল হলে কী হবে, আমাদের ঠাকুমা ছিলেন ভীষণ গোঁড়া। ঠাকুমারা সবাই। বাড়ির বউ গান শিখবে?
—কিন্তু সেই কথা দিয়েই তো আনা হয়েছিল!
—এরকম ঠকানো তো অনেক মেয়েকেই হয়! এখনও হচ্ছে!
ঠকানো! প্রতারণা! মেয়েকে! ‘ঠকানো’ এবং তার শুদ্ধ সংস্করণ ‘প্রতারণা’ দুটোই আমার ভীষণ চেনা-চেনা লাগে। জীবনে কত শব্দ ব্যবহার করি, তার পুরো মানে না বুঝেই তো করি। ভাষাটা শিখি শুনে শুনে, আবৃত্তি করে করে, তারপর তার শব্দাবলি নিয়মাবলি শিখি। কিন্তু একটা শব্দের পেছনে যে অনেক সময়েই একটা অনুভূতি থাকে, সেটাকে না বুঝলে শব্দটাকে জানা হয় না। ‘ভক্তি’— কী মানে এর? জানি না, বুঝি না শব্দটা ব্যবহার করি। ‘বিরহ’ মানে কী? ব্যবহার করে যাচ্ছি। তার বাইরের খোলসটাকে ছুঁচ্ছি। কিন্তু ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ আসল মানেটা জানবে না। ‘ঠকানো’, ‘প্রতারণা’ এগুলো সাধারণত টাকাপয়সা বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারেই ব্যবহার হয়। টাকাপয়সা, বিষয়সম্পত্তি যেহেতু স্থূলতর বিষয় তাই ঠকানোর চতুর উল্লাস, ঠকে যাওয়ার ক্রোধ কিছুটা-কিছুটা বুঝি। কিন্তু প্রতারণা যে কত রকম হতে পারে! মা বুঝেছিলেন প্রতারণার মানে, জেঠু বুঝেছিলেন, আমি বুঝেছি। মা পাষাণ হয়ে গেলেন, জেঠু পাগল হয়ে গেলেন, আর আমি কী হলুম? সিনিক, সিনিক বোধহয়। হঠাৎ একটা অদ্ভুত কথা আমার মনে হল।
এই যে মা, জেঠু, আমি— আমাদের প্রতারণা, এটার মধ্যে কি একটা পরিকল্পনা আছে? কার? তা জানি না। কিন্তু মা, একজন নারী তাঁকে যেভাবে ঠকানো হল তার প্রতিক্রিয়া আশেপাশে চুপিচুপি রয়ে গেল। সুযোগ খুঁজতে লাগল। জেঠুর ঠকে যাওয়াটা একরকম বদলা। আমারটাও তাই। মায়ের বিশ্বাস ভঙ্গ করা হয়েছিল, অন্য নারীরা সেই বিশ্বাস ভঙ্গের প্রতিশোধ নিল। প্রতিহিংসার ইচ্ছে এবং ফলাফল পরের প্রজন্মে ফিকে হতে থাকে। তাই জেঠু যেভাবে যাতনা ভোগ করলেন, আমি ঠিক সেভাবে করলুম না।
—দাদু কিন্তু ঠকাতে চাননি। ফিনকি বলল— যতদূর সম্ভব সাহায্য করে গেছেন মাকে। প্রথম কথা, প্রতিদিন সন্ধেয় দাদু ফিরলে মা গান শোনাত, ঠাকুমারাও ভক্তিভরে শুনতেন, দাদু চুপিচুপি বাপের বাড়ি নিয়ে যাবার নাম করে মাকে উস্তাদজির কাছে নিয়ে যান। কিন্তু মা বলে—কাউকে লুকিয়ে মা কিছু করতে পারবে না।।
—অর্থাৎ তথাকথিত সততাও এক ধরনের বোকামি, তাই নয়? আমি বলি— তারপর জিজ্ঞেস করি— এই সমস্তর মধ্যে বাবার কোনও ভূমিকা ছিল না?
—নাঃ।
—খুব অদ্ভুত, না?
—নয় বোধহয়। খুব আত্মসর্বস্ব করে ওঁকে তৈরি করা হয়েছিল তো! মা আসাতে বাবার অনেকগুলো প্রয়োজন চমৎকার মিটে গেল। তারপরে সেই মেয়েটিকে পরিবার কেমন ভাবে চালাবে, কী দেবে না দেবে সেটা পরিবারের ব্যাপার।
এইবারে ফিনকি আমার দিকে ফেরে। ওর মনোযোগের কেন্দ্রে আমি। বলল— শুনলি তো, মায়ের ব্যাপারটার পেছনে কতকগুলো কারণ আছে। তোরটার কোনও কারণ নেই। হঠাৎ দেখলে মনে হয় তুই উদাসীনতাটা মা’র কাছ থেকে পেয়েছিস, আত্মকেন্দ্রিকতাটা বাবার থেকে নিয়েছিস। কিন্তু তুই সে অর্থে উদাসীনও নোস, আত্মকেন্দ্রিকও নোস। এগুলো আমি বুঝি। তুই দাদুর খুব ফেভারিট নাতিও তো ছিলি।
—তা হলে ধরে নে, দাদুই আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিল। দাদু নেই, তাই বন্ধুও নেই।
—শোন, ধোঁকা দেবার চেষ্টা করে লাভ নেই। এতদিন ধরে কারও শোক একরকম থাকে না। থাকা সম্ভব নয়। তার ওপরে তুই যে-রকম হাড়-হিম-করা প্র্যাকটিক্যাল!
—শোকের কথা হচ্ছে না ফিনকি। বন্ধুত্বের কথা হচ্ছে। যে বালক একজন প্রতিষ্ঠিত, জীবনের সব অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ, সদাশয়, সমব্যথী টাইপের বয়স্ক মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, সে আর কারও সঙ্গে সেটা পারবে কেন? সবটাই কি তার জলো আনইন্টারেস্টিং লাগবে না?
হঠাৎ ফিনকির চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। চোখ মুছতে মুছতে বলল
—আমি জলো, আমি আনইন্ট্রেস্টিং?
—আরে বাবা, এতে কান্নার কী হল? তোর কথা বলেছি না কি? বন্ধুদের কথা বলেছি।
—দ্যাখ্ যার সঙ্গে যে সম্পর্কই থাক, বন্ধুত্ব হতে কোনও বাধা নেই।
—ঠিক আছে। তোকে একটা ছোট বোন বলে দেখি তো! সেইজন্যে হয় তো! কিন্তু কথা দিচ্ছি, বলবার মতো কোনও কথা হলেই আমি তোকে বলব। ইন দা মীন টাইম ওই মায়ের উদাসীনতা আর বাবার আত্মকেন্দ্রিকতার কম্বিনেশনটা চলুক। হ্যাঁ? —ফিনকি, ছোট্ট একটা ভেংচি কেটে উঠে গেল। ফিনকি আমার ভিন্ন বাড়ির কথা জেনে গেছে। কী করে? জেনেও ও আমাকে কাছে টানে। সবাই ওর মন ছোঁয়, কী করে জানি না। হয়তো কোনওদিন ও কাকাকেও বুঝে ফেলবে, বিশ্বাসঘাতকের প্রতি নৈতিক অসমর্থন থাকা সত্ত্বেও কাছেই টানবে।