সমুদ্র যাত্রা (Samudra Jatra) : 10
দাদু মারা যাবার পর আমার ঘাড়ে অতিরিক্ত বোঝা চেপেছে, তবু আমার কী রকম হালকা লাগে। কেন আমি বুঝি না। দাদুই ছিলেন আমার একমাত্র বন্ধু। দাদুকে যা বলতে পারতুম, অন্য কাউকেই তা পারতুম না। ঘোর বন্ধন একটা। হস্টেল থেকে বাড়ি আসতুম শুধু ফিনকির জন্যে নয়, দাদুর জন্যেও। দাদুকে বুঝতে দিতুম না। আমার প্রকাশ চিরকালই কম। তবু দাদু হয়তো বুঝতেন, তাঁর প্রকাশ বেশি, কিন্তু তিনিও আমাকে কোনওদিন বুঝতে দ্যাননি যে তিনি আমার টান বুঝেছেন। আর যেহেতু দাদু পুরো পরিবারটার ভাল-মন্দের সঙ্গে অমন নিবিড় ভাবে যুক্ত, তাই দাদুর আগ্রহগুলোতে অংশ না নিয়ে আমি পারতুম না। আর এমনই অন্তর্দৃষ্টি ছিল ওঁর আমাদের বিষয়ে! কী যেন বলেছিলেন দাদার বিষয়ে— ওর কাছ থেকে বিশেষ কিছু আশা কোরো না! কী যেন বলেছিলেন আমাকে — হেরোইন খেয়ে, খারাপ পাড়ায় যাবার পর! —তুমি বড় হয়ে গেছ। আর ফিনকি? ফিনকিই একমাত্র আশা তোমাদের। আমাকেও কি উনি ডিসমিস্ করে গিয়েছিলেন? তা হলে শেষ কথাগুলো কেন আমাকে বললেন? আর কেউ বলবার ছিল না, অথচ কথাগুলো বলা দরকার ছিল বলে?
এখন কথাগুলো, দাদুর সে সময়কার আচরণ মনে মনে তোলা পাড়া করি, মেট্রো রেলের কাজ হচ্ছে। সাইটে আছি। ক্রেন, থিয়োডোলাইট, মিক্সার, স্তূপীকৃত স্টোন চিপস্ ও অজস্র শ্রমিকের মাঝখানে খোঁড়া গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। একটানা আওয়াজ, আমি হঠাৎ বুঝতে পারি ঘটনাটা। দাদু জীবন সম্পর্কে সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এটা কোনও মান-অভিমানের প্রশ্ন নয়। বাড়ির সকলের উদাসীনতা আত্মপরতার শূন্যতা দাদু নিজের প্রবল আসক্তি দিয়ে সারাজীবন পূর্ণ করে গেছেন। ওঁর মনে হত উনি ছাড়া আর কোনও কাণ্ডারী নেই। ওঁর দাদারা মৃত, দুই বিধবার বিপুল ভার, বড় ছেলে উন্মাদ, তার সমস্ত দেখাশোনা ও আর্থিক দায়িত্ব আর কেউই তো নিতে চায়নি। ভালবাসার সঙ্গে আসে কর্তব্যবোধ। তিনি করেছিলেন, মেজ ছেলের কোনও দায়িত্ববোধ ছিল না। অথচ পরিবার বলতে যা বোঝায় তা তো তাঁরই। ছোট ছেলে স্রেফ চুপচাপ পালিয়ে গেল। পরের প্রজন্মে দাদা অবিকল কাকার পথ অনুসরণ করল। এদের সবাইকার প্রেমহীনতার উল্টো দিকে তাঁর প্রবল ভালবাসা, নিঃশব্দ, নির্বিচার, কিন্তু সবসময়ে সক্রিয়। এই আসক্তিই জীবন। জীবনকে আঁকড়ে ছিলেন তিনি। একদিন কার জাদু ছোঁয়ায় খসে পড়ল আসক্তি। মৃত্যুর আগে যদি এই নিরাসক্তি না আসে তা হলে জীবন ছেড়ে যেতে বড় কষ্ট! শেষকালটায় তাই দাদুর হৃদয়ে আমরা কেউ, আমাদের কোনও সমস্যার জড় আর ছিল না। আমি ব্যাপারটা টের পেয়েছিলুম। পুরোপুরি বুঝতে পারিনি যদিও। আমার মনে হচ্ছিল— দাদু হঠাৎ বদলে গেছেন, এই বদলটা শুভ নয়। কিন্তু সেই রাতে ওঁর ঘরে আমার থাকায়, হয়তো নয়-নয় করেও কিছু ভাবনা-চিন্তা ওঁর নিরাসক্ত মনে বুদবুদের মতো ভেসে উঠেছিল। আমি না থাকলে বলতেন না। ছিলুম বলেই জোর করে পরলোক থেকে ফিরে এসেছিলেন। অর্থাৎ দাদু আগেই মারা গিয়েছিলেন।
আমার সহকর্মীদের সঙ্গে আমার একেবারে বনে না। তার মানে যে ঝগড়া তা নয়। আমি বাইরের আচরণে সৌজন্য, ভদ্রতা সব সময়ে বজায় রাখি। কিন্তু এদের বেশির ভাগই এত ধড়িবাজ, এত পরশ্রীকাতর এবং আদিরসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত যে এদের সঙ্গ আমি আদৌ সইতে পারি না। আমি জানি এরা আমাকে নিজেদের মধ্যে উন্নাসিক বলে। আমার তাতে কিছু যায় আসে না। আমারও তো ওদের খুব অপূর্ণ লাগে। যেন কোন ফসিল-স্তরে আটকে আছে।
আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট এঞ্জিনিয়ার, আমার সমগোত্র আরও জনা সাতেক আছে। কেউ কেউ সামান্য বড়। তিনজন মহিলা আছেন, এঁদের এরা অসম্ভব বিরক্ত করে। এদের মধ্যে একজন, দীপা বেশ একটু রোখা টাইপের। অন্য দুজন জয়ন্তী আর মুকুলিকা চুপচাপ সব হজম করে যায়। এরা সকলেই আমার ব্যাচমেট। তবে অন্য কলেজের। দীপা ছাড়া।
একদিন জয়ন্তী জিজ্ঞেস করল— আপনি পুলককে চেনেন?
আমরা তখন অফিসার্স ক্যানটিনে খাওয়া সারছি। লাঞ্চের পরে আবার ফিরে যেতে হবে চৌরঙ্গিতে। কাজের হিসেব-পত্র নিয়ে অফিসে ফিরতে হবে। এবং রিপোর্ট। চিফ এঞ্জিনিয়ারের কাছে রিপোর্ট জমা দেবার পর অন্য কোনও কাজ না থাকলে ছুটি।
জয়ন্তীর কথায় আমি হুঁশে ফিরে আসি— পুলক? নিশ্চয়ই। আজীবন আমার ক্লাস-মেট।
—আমার কাজিন।
কোথাও থেকে কেউ বলল—কী পুলক!
জয়ন্তী ডাকল বাকি দুজনকে— দীপা, মুকুল, এদিকে এসো।
আমার টেবিলেই বসল এসে তিনজনে।
দীপা বেশ চড়া গলায় বলল— এখানে বোধহয় বসা যায়, তুমি ঠিকই ধরেছ জয়ন্তী। ইঁদুরের গর্ত-টর্ত নেই।
—বেড়াল আছে — আবারও কেউ বলল।
—ওসব কথায় কান দেবেন না, আমি নিচু গলায় বলি।
—ফিগার ভাল, চৌত্রিশ চৌত্রিশ চৌত্রিশ।
—দেখছেন তো। এতটুকু স্বস্তি দেবে না।
—ইগনোর করুন। কিছুদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।
—ধ্যাৎ, ঠিক বলিসনি। বাস্টের তফাত আছে, ছত্রিশ তো নিশ্চয়ই, চল্লিশও হতে পারে।
—আবার তিরিশ হওয়াও অসম্ভব নয়।
প্রত্যেকে খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে কথাগুলো বলছিল। কেউ ধরতে পারবে না, দীপা বলল— তুমি বোধহয় আমায় চিনতে পারছ না সমুদ্র, আমি কিন্তু বি.ইরই। এই জাতীয়রা ওখানেও আমার জীবন অতিষ্ঠ করে দিয়েছে।
আমি দীপাকে চিনতুম ঠিকই। দূর থেকে দেখা এক জটলা গাছের মতো। একটা থেকে আরেকটা আলাদা করা যায় না।
বলি— চিনেছি বই কী! কিন্তু সেরকম আলাপ-পরিচয় তো ছিল না!
—সে কী? চেনা ছিল না? জয়ন্তী অবাক।
আসলে, মেয়ে ছিল মোটে চার-পাঁচজন। নিজেদের মধ্যে থাকত একটু ডাঁট নিয়ে। ইলেকট্রনিকস, আর্কিটেকচার-এ ওদের দুগুণ তিনগুণ, কিন্তু সিভল-এ সংখ্যা এরকমই।
—চেনবার মতো চাঁদমুখ থাকলে তো চিনবে। ওদিক থেকে মন্তব্য এল।
দীপার মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। হাত দুটো মুঠো করা।
—নো একসাইটমেন্ট প্লিজ — আমি আস্তে বলি।
—আসলে কী জান, গাঁইয়া তো। শহুরে মেয়ে দেখেনি। বুঝলে সমুদ্র, এখনও রিপোর্টে বানান ভুল করে। বাজে অসভ্যতাগুলোই ছিল ওদের ডিফেন্স।
জয়ন্তী বলল— আমাদের যাদবপুরে গোড়ায় গোড়ায় একটু টিজিং হত বটে, তবে কিছুদিন পরই আর ফারাক থাকত না।
মুকুলিকা বলল— আসলে কী জান … অনেকেই ফার্স্ট জেনারেশন লিটারেট।
আমি বেগতিক দেখে উঠে পড়ি, বলি— আমাকে এক্ষুনি সাইটে যেতে হবে, নিচু গলায় বলি — তোমরাও প্লিজ বেরিয়ে এসো।
পরদিন পুরো দলটা আমায় ধরল।
—সেন, এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন?
—আমার যাত্রা একদম ভাল লাগে না। থিয়েটার সিনেমা বরং পছন্দ হয়। শম্ভু মিত্র আর একবার দেখতে বলো দেখব। কিংবা সত্যজিৎ রায়-তপন সিনহা। এনি থিং।
—ফান বই তো কিছু না, সিরিয়স কিছু তো না!
—দেখো অনিন্দ্য নিজেকে নিয়ে মজা করো কেউ বাধা দেবে না। কিন্তু অন্যকে নিয়ে ফান … এসব ছেলেমানুষি অসভ্যতার অভ্যেসগুলো তোমাদের ক্যাম্পাসের ফার্স্ট ইয়ারেই ফেলে আসার কথা। ইটস ভেরি ভেরি আনফর্চুনেট ইফ ইউ ডোন্ট।
—এটা শুধু মজা নয় সেন, তুমি চিন্তা করো চাকরির এই বাজারে, এত খরচ করে খেটেখুটে পাশ করছি। ওদের কী রাইট আছে আমাদের চাকরিগুলো এইভাবে বাগিয়ে নেবার? — বিজিত বলল।
—ওরা খেটেখুটে খরচ করে পাশ করেনি বলছ?
—দরকারটা কী! সিটটা আটকাচ্ছে তো! বিয়ে করলেই তো ওদের হিল্লে হয়ে যাবে। আমাদের? আমাদের হবে? সেই তো শ্রাবন্তী বলে মেয়েটা বিয়ে বসে গেল। সে তো মাঝপথে? থার্ড ইয়ারে গিয়ে ছেড়ে দিল! একটা ছেলে তো পেতে পারত সিটটা। ছেলেদের ফ্যামিলি দেখতে হয়।
—অনেক সময়ে মেয়েদেরও ফ্যামিলি দেখতে হয় কিন্তু, তুমি দুটোর তফাত কী করে করবে। যে চাকরি দেবে সে যোগ্যতা দেখে দেবে, প্রয়োজন দেখে কক্ষনও দেবে না। ওই জায়গাটায় বরঞ্চ আন্দোলন করলে একটা কাজের কাজ হয়।
—হুঁঃ আন্দোলন! আমরা ওদের লাইফ হেল করে দেব, তাড়াব।
—চেষ্টা করো। ওরা যদি কমপ্লেন করে তা হলে কিন্তু আমি সঠিক সাক্ষ্য দেব।
—ওরা ফিল্ড ওয়ার্ক করতে পারবে? ওদের দেখবে বেশির ভাগ ডেস্ক জব দেওয়া হবে এর পর।
—ফিল্ড ওয়ার্ক তো করছে বলেই জানি। আর যদি মেয়েদের শুধু ডেস্ক জব দেওয়া হয়, তখন আপত্তি কোরো। এগুলো কোরো না। এগুলো ঠিক নয়। তোমার বোন কিংবা বউ যদি এই জায়গায় থাকত, তা হলে কিন্তু করতে না।
—ওরা চিফদের পটায়, স্রেফ মেয়ে বলে সুবিধে আদায় করে।
—সেইজন্যেই আরও বলছি কমপ্লেন হলে তোমাদের চাকরি যাবে, খামোখা।
খুব ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলে চলে এলুম। আমি একা ওরা পাঁচজন, ইতিমধ্যেই উন্নাসিক, ডাঁটিয়াল বলে নাম কিনেছি। একটুও উত্তেজিত হইনি আজ। কে আমার ভেতর থেকে কথাগুলো বলল? আমার মনে হল— আমি বলিনি। দরকারের সময়ে, আমার ভেতর থেকে কেউ শীতল যুক্তি সাজায়, তেমন তেমন হলে বৌদ্ধিক প্রতি- আক্রমণ। এই ক্ষমতাটা আমার ছিল বলে আমি জানতুম না। আমি একলা, ভিড় অপছন্দ করি, অনেকের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারি না, বলতে কি পুলক দুর্গাপুর চলে যাওয়ার পর আমার একজনও বন্ধু নেই। এ ধরনের অমিশুক লোকেরা একটু পাশ-কাটানো, ভিতু ধরনেরও হয়। আমি তা হলে তেমন নই? নার্ভ নেই আমার, না কী? স্নায়ুকোষ দিয়ে কোনও উদ্দীপক মাথায় পৌঁছয় না? হরমোন বেশি নেই? অ্যাড্রিনালিন? আমার ব্রেন সেল গুলো কী অন্যরকম?
দাদার সঙ্গে শেষ সাক্ষাতেও এই শীতলতা, বা শীতল যুক্তিবোধ আমায় সাহায্য করেছিল। দাদা দাদুর শ্রাদ্ধে এসেছিল। উপস্থিত ছিল, কিছু টাকাও দিয়ে যায়। আমি দিল্লি থেকে ফিরে আসার দিন কয়েক পরেই ওরা রেজিস্ট্রি করে। কিন্তু সোনু আসেনি, বা দাদুর মৃত্যুর পরও ওদের দিক থেকে কোনও আনুষ্ঠানিক সান্ত্বনা বাক্যও না।
বাবা উপোস করতে পারবেন না, তাই কাজটা আমাকেই করতে হল। শেষ হলে, একেবারে বিকেলবেলায় অতিথি-অভ্যাগতরা চলে গেলে খুব ক্লান্ত লাগল। অশৌচপালন, লোকের বাড়ি গিয়ে গিয়ে আমন্ত্রণ। শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা সব করা। পুরোহিত মশায় কিছু আনলেন, কিছু আমাকেই আনতে হল। হালুইকর বামুনের বন্দোবস্ত। সেখানেও বাজারের ঝামেলা। নিজের ঘরে চুপ করে শুয়ে আছি, দাদা ঢুকল। ওর একানে তক্তপোশ এখনও ওধারে। আজকে এক রকম বেড-কভার বালিশ দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। ফিনকি।
—তুমি … তোমরা … বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করছ সমু। বলতে বাধ্য হচ্ছি।
আমি শুধু তাকাই।
—মানে, এই সবের তো কোনও মানেই হয় না। এ তো টাকার শ্রাদ্ধ …
—টাকার শ্রাদ্ধ না দাদুর শ্রাদ্ধ …
আমি আমার কথা অসম্পূর্ণ রেখে দিই।
—টাকাটা যদি দাদুর চিকিৎসায় খরচ হত, তা হলে কিছু বলার ছিল না, কিন্তু এই ভূত ভোজন …
—প্রচলিত রীতি-নীতির কিছু তো আমাদের মানতেই হয় দাদা। জীবিতকালে দাদুর চিকিৎসায় যে খরচ করতে হয়নি, সেটা আমাদের ভাগ্য, কিন্তু শ্রদ্ধা জানাবার এই রীতিই চালু। কী করা যাবে!
—একটা উচ্চশিক্ষিত ছেলে হয়ে যে তুমি কী করে অন্যের কথায় চলো। অন্যের মতামতকে এতটা গুরুত্ব দাও!
—তুমিও তো তাই করছ, অন্যের মতে চলছ।
—কী ভাবে?
—মজা হচ্ছে তুমি হয় সেটা জানই না আর নয়তো সেটা মানছ না। না মানাটা বুদ্ধির পরিচয় নয় দাদা, আর যদি না মানো, তা হলেও সেটা খুব পৌরুষের লক্ষণ বলতে পারি না। তুমি অরোরাদের কাছে তোমার আত্মা বিক্রি করে দিয়েছ দাদা। তারা তোমাকে যেভাবে যা করতে বলছে তুমিও তাই করে যাচ্ছ, খুব সম্ভব ইজি লাইফের লোভে। এভাবে যদি নিজের অসম্মান করো, অন্যের মানে এমনকী অরোরাদের সম্মানও তুমি পাবে না।
—একদম বাজে কথা বলছ সমু না জেনে। দে আর ভেরি ভেরি কনসিডারেট। আমাকে এখানে ওরাই আসতে বলেছে, ইনফ্যাক্ট যে টাকাটা দিলুম সেটা সোনুই হাতে গুঁজে দিয়েছে।
—এই তো প্রমাণ হয়ে গেল, তুমি নিজেই প্রমাণ করে দিলে, — আমি হাসি, — যে ওরা যা বলছে তুমি তাই করছ। ভাল হোক মন্দ হোক সিদ্ধান্তটা ওদেরই। আর টাকাটা যদি বউদির হয়, তা হলে … দাদা ওটা আমি ফেরত দিতে বাধ্য। এই নাও, আমি ড্রয়ার খুলে নোটের বান্ডিলটা দাদার দিকে এগিয়ে দিই।
দাদা রাগে লাল হয়ে গেছে — তুমি আমাকে এভাবে অপমান করতে সাহস করো!
—তুমি যে নিজেই নিজেকে অপমান করলে! সোনু টাকাটা দিয়েছে বললে! মানে যে সোনু বা অরোরা ফ্যামিলি দাদুর মৃত্যুতে একটা চিঠি দিয়েও সহানুভূতি জানানো দরকার মনে করেনি, সে। তারা। তাদের টাকা দাদু কেন নিতে যাবেন? আমিই বা কেন নেব? দাদা ঠান্ডা মাথায় ভেবে দ্যাখো বুঝতে পারবে, তোমার টাকায় আমাদের ষোলো আনা অধিকার, কিন্তু ওঁদের টাকা হল ভিক্ষার মতন, ওটা নিতে পারি না।
—এর পরে কিন্তু আমার থেকে আর কিচ্ছু আশা কোরো না সমু। দাদা এখনও লাল, কিন্তু ওর ফোঁসানি বন্ধ হয়ে গেছে।
—আশা করব না দাদা, দাবি করব। খুব অনুত্তেজিত ওঠাপড়াহীন গলায় বলি। যে দাদু তোমাকে পালন করেছেন, যে মা তোমাকে জন্ম দিয়েছেন, যে দিদা মায়ের সঙ্গে তোমাকে বড় করেছেন, যে বাবা তোমার লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছেন, যেখানেই যাও তাঁদের সবাইকার ন্যায্য দাবি আছে তোমার ওপরে। তুমি সেটা এড়িয়ে যেতে পারো, কিন্তু দাবিটা সত্যিই থাকে, থাকবে।
দাদা চলে গেল, মাকে প্রণাম করল, দিদাদের প্রণাম করল, তাঁদের কান্নার জবাবে শুকনো চোখে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, বাবার পায়ের দিকে একটু নিচু হল, এবং ফিনকি যখন সেই ছোটবেলার মতো দাদাকে জড়িয়ে ধরে আদর করল, দাদা হঠাৎ বোকার মতো বলল— দিল্লির চটি, না? লাল, সবুজ? ফিনকি মজা পাওয়া হাসি হেসে বলল—দুৎ, ওসব চটিফটি আমার চাই না। তুমি বউদিকে নিয়ে আসবে এবার।
ট্যাক্সি অপেক্ষা করছে, আমি দাদার স্যুটকেসটা বুটে ভরে দিয়েছি, ড্রাইভারের পাশের আসনে বসেছি। ডাক দিলুম— তাড়াতাড়ি এসো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
সারাক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতার মধ্যে দিয়ে দাদাকে তার এ.সি কোচে তুলে দিলুম। একটু বসলুম— দাদা পকেট থেকে টাকার খামটা বার করে বলল— বিশ্বাস করো সমু। এটা আমারই টাকা। তোমার ইমপ্রেশন যাতে ভাল হয় তাই সোনুর নাম করেছিলুম। ওরা কি অত জানে টাকা ফাকা দেওয়া না দেওয়ার কথা? দে বিলং টু অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড, নেবে না?
আমি হাত বাড়িয়ে নিই।
—মাকে দিয়ে এলেই পারতে, ভাল হত।
—মা! ঠিকই! কিন্তু মা এত এত ডিসট্যান্ট, কীরকম অপর-অপর, তোমাকেই আমার সবচেয়ে কাছের মনে হয়। প্লিজ!
—ঠিক আছে, আমি মাকে দিয়ে দেব— আমি হেসে বলি, এটা মায়েরই প্রাপ্য। রাইট?
—তুমি যা মনে করো!
সত্যিই বলছি আমার কিন্তু কোনও আত্মবিশ্বাস ছিল না। আত্মবিশ্বাস ব্যাপারটা নিয়ে মাথাটাথাও ঘামাইনি কোনওদিন। যে অবস্থায় যা করেছি বলেছি একেবারে তাৎক্ষণিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। প্রত্যেকবার এরকম ঘটে আর পরে ব্যাপারটার কথা মনে করে আমার অবাক লাগে। এগুলো কী? কোথা থেকে আসে? এগুলোর সঙ্গে আমার চেতনার কোনও যোগ নেই তো! বুদবুদের মতো ওঠে, বুদবুদের মতো মিলিয়ে যায়। কিন্তু নিটোল বর্ণালি এক একটা। যা কিছু শিখছি সারাজীবন ধরে, করছি, বলছি কোনওটার সঙ্গেই আমার ভেতরের কোনও আদানপ্রদান নেই। মাঝে মাঝে, খুব মাঝে মাঝে কিছুর প্রতিক্রিয়ায় একটা শক্তিশালী অনুভূতি আমাকে অধিকার করে বটে। রাগ, বেশির ভাগই ক্রোধ, কখনও কখনও কাম। কিন্তু আবার ফিরে যাই। কোথায় যাই? ভেবে দেখতে গেলে কোথাও না। কোনও দুশ্চিন্তা আমার আসে না। খারাপ বা খুব আহ্লাদে মেজাজে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। কোন আমিটা সত্য, এই দাদাকে, সহকর্মীদের উচিত কথা শুনিয়ে দেওয়া লোকটা, না সেই লোকটা যে কোনওরকম ভার বোধ না করে জীবনের যাবতীয় দায় পালন করে যায় এবং যে ঘুমের মধ্যে জেগে ওঠে, পার হয়ে যায় সীমান্ত, উড়ে চলে যায় দিক-দিশাহীন শূন্যে, এবং পায় সেই আহ্লাদ যা জেগে জেগে কখনও কোনও সফলতার সময়েও সে পায়নি!
সুতরাং আমি দাদাকে চলে যেতে দেখি। প্রায় কোনও অনুভূতি ছাড়া। ট্রেন ছেড়ে দিল। আমি ওকে আর দেখতে পাচ্ছি না, ওর কিন্তু আমাকে দেখতে পাবার কথা। দাদা কি দেখছে? নাকি এখনই বহু দূর চলে গেছে, গ্রেটার কৈলাস, অরোরাদের জগতে! দেখুক না দেখুক আমি হাত নাড়তে থাকি, যতক্ষণ না ট্রেন প্ল্যাটফর্মের সীমা পার হয়ে চলে যায়, আমার উত্তোলিত হাত একটা আলিঙ্গন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যাই ভাবুক দাদা রূঢ় ভাবতে পারবে না কিছুতেই। দু এক বছরের তফাতে এই দেখা-সাক্ষাৎ একটাও লাবণ্যময় হল না। আমার মধ্যে কোনও তিক্ততা নেই। দাদার মধ্যে যদি থাকে, যদি তৈরি হয়, তা হলে সেটা দাদার জীবন-যাপন, তার মন, তার সিদ্ধান্ত থেকেই উঠে এসেছে। এই তিক্ততার একটুও আমি নিলুম না। সুতরাং সবটাই দাদার কাছে ফিরে যাচ্ছে।
বাড়ি ফিরে মাকে টাকাটা দিই। তার পেছনের দীর্ঘ ইতিহাস, দেওয়া-নেওয়া-ফিরিয়ে দেওয়া-আবার নেওয়া সেসব কিছুই আমি বলিনি। মা টাকাটা আমারই হাতে দিয়ে বলেন— খরচ মিটিও।
—সে সব হয়ে গেছে। তুমি যা বুঝবে কোরো।