Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সমদৃষ্টি || Rajshekhar Basu

সমদৃষ্টি || Rajshekhar Basu

ইস্কুলের পড়া মুখস্থ করছি, বাবা প্রশ্ন করলেন, কি বই পড়ছ?

উত্তর দিলাম, ভারতবর্ষের ইতিহাস।

–কোনখানটা?

–মোগল সম্রাটের বংশ। বাবরের পুত্র হুমায়ুন, তাঁর পুত্র আকবর, তারপর জাহানগির শাজাহান আরংজিব

–হয়েছে হয়েছে। নিজের পিতামহর নাম জান?

শুনেছিলাম আমার ঠাকুদ্দা নেপোলিয়ন আর রণজিৎ সিংহের আমলের লোক, কিন্তু তার নামটা কিছুতেই মনে পড়ল না। বললাম, ভুলে গেছি।

লিখে নাও। তোমার পিতামহ কালিদাস বসু, প্রপিতামহ গুরুদাস, বৃদ্ধ প্রপিতামহ রত্নেশ্বর, অতিবৃদ্ধ রামসন্তোষ, অতি-অতিবৃদ্ধ রামভদ্র। [পিতা স্বয়ং–চন্দ্রশেখর।]

গড়গড় করে ঊর্ধ্বতন সপ্তম পুরুষ পর্যন্ত নাম করে বাবা বললেন, মুখস্থ করবে, ভুলে যেয়ো না যেন। এঁরা মোগল বাদশাদের চাইতে তোমার ঢের বেশী আপন জন।

আপন জন হতে পারেন, কিন্তু আধুনিক দৃষ্টিতে নগণ্য পেটি বুর্জোআ। একটু আধটু ভাল মন্দ কাজ করে থাকবেন, কিন্তু এঁদের ভাগ্যে সুকীর্তি বা কুকীর্তি কিছুই লাভ হয় নি। এঁরা অশ্বমেধ যজ্ঞ দিবিজয় করেন নি, ধর্মসংস্থাপন বা রাজ্যশাসন করেন নি, তাজমহল গড়েন নি, বাপকে কয়েদ আর ভাইদের খুন করেন নি। এই পিতৃপুরুষদের সম্বন্ধে আমার কৌতূহল ছিল না, শুধু বাবার আজ্ঞায় নাম মুখস্থ করতে হল। কিন্তু তাতেও নিস্তার নেই। বাবার বংশপ্রীতি অসাধারণ ছিল। ঊধ্বর্তন চতুর্দশ পুরুষ পর্যন্ত শাখাপ্রশাখায় বিস্তৃত বংশবিবরণ ছাপিয়েছিলেন। সেই চটি বই একখানা আমাকে দিয়ে বললেন, মাঝে মাঝে পড়বে, হিস্টরির চাইতে কম দরকারী নয়।

বড় হয়ে শুনলাম, সাত পুরুষ পর্যন্ত সপিণ্ড, তার পরে আরও সাত পুরুষ পর্যন্ত সমানোদক। অর্থাৎ পরলোকস্থ ঊর্ধ্বতন সাত পুরুষের অন্তর্গত সকলকে মাঝে মাঝে পিণ্ড দিতে হয়, আরও সাতপুরুষকে শুধু জল দিয়ে তর্পণ করলেই চলে। আরও আগে যাঁরা ছিলেন তাদের কিছু না দিলেও দোষ হয় না।

যাঁদের চোখে দেখেছি, স্নেহ পেয়েছি, এবং তাদের মুখে যাঁদের বিবরণ শুনেছি তারাই আমার সপ্তম পুরুষান্তৰ্গত জ্ঞাতি। তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে আমার জ্ঞাত শ্রদ্ধাভাজন আপন জন, সেজন্য সপিণ্ড। পূর্বে যে সাত পুরুষ ছিলেন তাঁদের নাম ছাড়া হয়তো কিছুই জানা নেই, তারা আমার সমানোদক। তাঁদের ঊর্ধ্বে যাঁরা ছিলেন তারা শুধুই জ্ঞাতি। আমাদের ধর্মশাস্ত্রে এইভাবে আত্মবর্গের বিভাগ করা হয়েছে। পিতৃকুল মাতৃকুল দুই থেকে মানুষের উৎপত্তি, কিন্তু অধিকাংশ সমাজে মানুষ পিতৃকুলে বাস করে, সেজন্য বংশগণনায় পিতৃকুলই ধরা হয়। আধুনিক বিজ্ঞানীরা পুংসম্পর্ক বাদ দিয়েও কোনও কোনও স্ত্রী প্রাণীর গর্ভাধান করতে পেরেছেন। হয়তো ভবিষ্যতে মানুষের পক্ষেও মাতাই মুখ্য এবং পিতা গৌণ ও. ক্ষেত্রবিশেষে অনাবশ্যক গণ্য হবেন।

উৎপত্তিকালে আমরা পিতা মাতা থেকে যেসব দৈহিক উপাদান পাই তার বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা ক্রোমোসোম, জীন, বা যাই হক, চলিত কথায় তাকেই রক্তের সম্পর্ক বলা হয়। পিতা মাতা প্রত্যেকের কাছ থেকে আমরা রক্ত সম্পর্কের অর্ধেক অংশ পাই। সিকি অংশ পিতামহ-মহী মাতামহ-মহী প্রত্যেকের কাছ থেকে পাই। ঊর্ধ্বতন সপ্তম পুরুষ থেকে ১/৬৪ অংশ এবং চতুর্দশ পুরুষ থেকে ১/৮১৯২ অংশ পাই। একবিংশতিতম পুরুষ থেকে যা পাই তা দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগের চাইতেও কম। হোমিওপ্যাথিক ঔষধের ডাইলিউশনের মতন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর সূত্রে আমাদের বংশধারা বজায় থাকে এবং তাতেই আত্মীয়তাবোধ তৃপ্ত হয়।

যোগসূত্র যেমনই হক, সম্পর্ক যত নিকট আত্মীয়তাবোধ ততই বেশী। কিন্তু স্থলবিশেষে এই বোধ আরও প্রসারিত হয়। বিলাতের অভিজাতবর্গ উইলিয়ম-দি-কংকরার, রবার্ট ব্রুস ইত্যাদি থেকে বংশ গণনা করতে পারলে অত্যন্ত গৌরব বোধ করেন। আমাদের দেশেও অদ্বৈত মহাপ্রভু, প্রতাপাদিত্য, সীতারাম রায় প্রভৃতির বংশধর নিজেকে ধন্য মনে করেন। গল্প আছে, কোনও এক বড়লাটের মুখে ডারউইনের অভিব্যক্তিবাদ শুনে একজন রাজপুত নৃপতি বলেছিলেন, আমার বংশমর্যাদা আপনার চাইতে ঢের বেশী; আমি সূর্যবংশজাত আর আপনি বানরের বংশধর।

সাধারণ লোকের দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আত্মীয়রাই সবচেয়ে আপন জন। তার পর যথাক্রমে সগোত্র, সবর্ণ, সজাতি, স্বদেশবাসী বা সধর্মী। সামাজিক সংস্কার, শিক্ষা, চর্চা বা হুজুকের ফলেও আত্মীয়তাবোধের তারতম্য হয়। গোঁড়া বাঙালী ব্রাহ্মণের দৃষ্টিতে বাঙালী শূদ্রের তুলনায় অবাঙালী ব্রাহ্মণ বেশী আত্মীয়। এ দেশের অনেক মুসলমান মনে করে ভারতীয় হিন্দুর চাইতে ইরানী আরবী তুর্কী মুসলমানের সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশী। রাজনীতিক কারণে বা প্রাদেশিক বিরোধের ফলে এই প্রকার ধারণার পরিবর্তন হতে পারে।

ষাট-সত্তর বৎসর পূর্বে শিক্ষিত ভদ্র বাঙালীর আর্যতার মোহ ছিল। তারা মনে করতেন তাদের পূর্বপুরুষরা দীর্ঘকায় গৌরবর্ণ নীলচক্ষু পিঙ্গলকেশ খাঁটি আর্য অর্থাৎ ইংরেজ জার্মনের সজাতি ছিলেন, এই সুজলা সুফলা বাংলাদেশের রোদ বৃষ্টিতে আধুনিক বাঙালীর চেহারা বদলে গেছে। আর্য বজায় রাখবার জন্য এবং উচ্চতর বর্ণে প্রমোশন পাবার জন্য অনেকের উকট আগ্রহ ছিল। অব্রাহ্মণরা পইতে নিয়ে ধন্য হতেন, কেউ কেউ অগ্নিহোত্রীও হতেন। আমরা শুনতাম, ব্রহ্মার কায় থেকে কায়স্থ, হাড় থেকে হাড়ী, বাক্ থেকে বাদী, চামড়া থেকে চামার হয়েছে। এখনও অনেকে কৌলিক পদবীতে তুষ্ট নন, নামের শেষে শর্মা বর্মা জুড়ে দিয়ে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেন।

ইতিহাস আর নৃবিদ্যার গবেষণার ফলে আমাদের আর্যতার অভিমান দূর হয়েছে, আমরা এখন বুঝেছি যে বাঙালী (এবং অধিকাংশ ভারতীয়) অতিমিশ্র সংকর জাতি, সভ্য অর্ধসভ্য অসভ্য নানা নৃজাতির রক্ত ও সংস্কৃতি আমাদের দেহে মনে ও সংস্কারে বিদ্যমান আছে। আমাদের সকলের সাংকর্ষ এবং বংশগত (inherited) দেহলক্ষণ সমান নয়, সেজন্য আকৃতির বিলক্ষণ প্রভেদ দেখা যায়। কালো বামুন, কটা শূদ্র, নর্ডিক, মঙ্গোলীয়, সাঁওতাল, হাবশী, সব রকম চেহারাই আমাদের ইতর ভদ্রের মধ্যে অল্পাধিক আছে। রবীন্দ্রনাথের গোরা নিজেকে ইওরোপীয় জানতে পেরে প্রথমে স্তম্ভিত তার পর নিশ্চিন্ত হয়েছিল। আমরাও সেই রকম আবিষ্কারের প্রথম ধাক্কা সামলে নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলছি, যাক বাঁচা গেল, কর্তার ভূত আমাদের কাঁধ থেকে নেমে গেছেন, এখন আমরা আত্মপরিচয় মোটামুটি জেনেছি। দ্রাবিড়, কিরাত (মঙ্গোলয়েড), নিষাদ (অস্ট্রিক), আল্পীয় প্রভৃতি নানা জাতির রক্ত আমাদের দেহে আছে, নর্ডিক রক্তেরও ছিটেফোঁটা আছে। যাঁরা সবিশেষ জানতে চান তারা কেন্দ্রীয় নৃবিদ্যা বিভাগের অধ্যক্ষ ডাঃ বিরজাশঙ্কর গুহ মহাশয়ের ভারতীয় জাতি পরিচয় পুস্তিকা পড়ে দেখবেন। বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে আমাদের কুলগর্ব খর্ব হয়েছে কিন্তু এই আশ্বাসও পেয়েছি যে, উৎপত্তি যেমনই হক, কৃতিত্বের সম্ভাবনা সব জাতিরই সমান, শুধু জন্মের ফলে কেউ herren volk হয় না। কর্ণের মতন আমরা সকলেই বলতে পারি–দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম মমায়ত্তং হি পৌরুষম্।

এচ জি ওয়েল্স তার First and Last Things গ্রন্থে এক জায়গায় লিখেছেন–যত পিছনে যাওয়া যায় ততই আমাদের পূর্বপুরুষ (ও তৎস্ত্রী) দের সংখ্যা বেড়ে যায়। আমার পিতা মাতা দুজন, পিতামহ-মহী মাতামহ মহী চারজন, প্রপিতামহ প্রভৃতি আটজন। এই রকম দ্বিগুণোত্তর হিসাব করলে দেখা যাবে–পৃথিবীর বর্তমান লোকসংখ্যা ২০০ কোটির চাইতে, আমার শততম পূর্বস্ত্রীপুরুষদের সংখ্যা অনেক বেশী। এই হিসাবে অতিগণনা আছে, কারণ পূর্বজগণের মধ্যে অন্তর্বিবাহ বিস্তর হয়েছিল। তথাপি বলা যেতে পারে–যাঁরা আমার শততম পূর্বজ, এবং তাদের মধ্যে যাঁদের বংশধর এখনও জীবিত আছে, তারা শুধু আমার নয়, বর্তমান সমস্ত মানবের পূর্বজনকজননী। ওয়েসের এই সিদ্ধান্তে ত্রুটি থাকতে পারে, কিন্তু সমস্ত মানবজাতির মধ্যে যে বংশগত সম্বন্ধ এবং রক্তের যোগ আছে তাতে সন্দেহ নেই। জগতের সমস্ত লোকই আমার জ্ঞাতি, সপিণ্ড বা সমানোদক না হলেও সমপ্ৰভব বলা যেতে পারে।

বিজ্ঞানীরা বর্তমান মানবজাতির নাম দিয়েছেন হোমো সাপিয়েন্স অর্থাৎ বিজ্ঞমানব। এই জাতির বয়স অনেকের মতে লক্ষ বৎসরের কাছাকাছি। আমাদের চতুঃসহস্রতম পূর্বপুরুষরা হয়তো অবিজ্ঞ অবমানব ছিলেন, সাধারণ লোকে যাকে মিসিং লিংক বলে। আরও পিছিয়ে গেলে বনমানুষ বানর এবং নিম্নতর অসংখ্য প্রকার জীব দেখা দেবে। শাস্ত্রে ব্রহ্মা থেকে জীবোৎপত্তি ধরা হয়েছে, সে হিসাবে আব্রহ্মস্তম্ব মায় ব্যাকটিরিয়া পর্যন্ত আমার জ্ঞাতি। বহু কোটি বৎসর পূর্বে যে সমুদ্রজলে আদিম জীবের উৎপত্তি হয়েছিল তাতে লবণের পরিমাণ এখনকার চেয়ে কম ছিল। সেই অল্পলবণাক্ত কারণবারি আজ পর্যন্ত প্রাণিদেহের রক্তরসে বা প্লাজমায় বিদ্যমান থেকে সর্বপ্রাণীর বংশগত সম্পর্ক বজায় রেখেছে।

মানুষ এবং ইতর প্রাণীর যে সন্তানম্নেহ ও স্বজাতিপ্রীতি দেখা যায় তা স্বভাবজাত, বংশপর্যায় গণনা না করেই উদ্ভূত হয়েছে। আদিম মানুষের পরপ্রীতি বা পরার্থপরতা বেশী ছিল না, সমাজের অভিব্যক্তির ফলে ক্রমে ক্রমে স্বজনপ্রীতি, মানবপ্রীতি আর ইতরজীবপ্রীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক সভ্য মানুষ যুদ্ধ করে, মৃগয়া খেলা বিলাস খাদ্য ও অন্য নানা উদ্দেশ্যে প্রাণিহত্যা করে। তথাপি এই ধারণা ধীরে ধীরে উদ্ভূত হচ্ছে–সর্বমানবপ্রীতি ও সর্বজীবপ্রীতিই আদর্শ ধর্ম।

আদর্শ আর আচরণ সমান হয় না, সেইজন্যই বলা হয়েছে–জানামি ধর্মং ন চ মে প্রবৃত্তি। গোঁড়া খ্রীষ্টানরা মনে করেন খ্রীষ্টের দশ অনুশাসনই শ্রেষ্ঠ ধর্মনীতি, কিন্তু কার্যত তারা অনেক অনুশাসন মানেন না। গোঁড়া হিন্দু মুখে বলেন গোমাতা, কিন্তু গোখাদক পাশ্চাত্ত্য জাতির তুল্য গোসেবা এদেশে দেখা যায় না। আদর্শ আর আচরণের প্রভেদ সব সমাজেই আছে, তথাপি বলা যায় আদর্শ যত উন্নত ততই আচরণের উৎকর্ষের সম্ভাবনা আছে।

আত্মীয়তাবোধের যখন চরম প্রসার হয় তখন সর্বভূতে সমদৃষ্টি আসে। এই সাম্যের উপলব্ধি ভারতীয় জ্ঞানী ও সাধকদের মধ্যে যেমন হয়েছে অন্য দেশে তেমন হয়নি। অভিব্যক্তিবাদ আর সর্বজীবের বংশগত সম্বন্ধ না জেনেও এদেশের আত্মতত্ত্বজ্ঞ মহাপুরুষরা বলেছেন–

বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি।
শুনি চৈব শপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ (গীতা)।
–বিদ্যাবিনয়সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গো, হস্তী, কুকুর ও চণ্ডালকে পণ্ডিতরা সমভাবে দেখেন।

সর্বভূতেষু চাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি।
সমং পশ্যন্নাত্মযাজী স্বারাজ্যমধিগচ্ছতি৷ (মনু)
–যে সর্বভূতে নিজেকে এবং নিজের ভিতর সর্বভূতকে দেখতে পায় সেই আত্মজী স্বরাজ্য লাভ করে।

য ভূতহিতমত্যন্তমেতৎ সত্যং মতং মম। (মহাভারত)
–যাতে জীবগণের অত্যন্ত হিত হয় তাই আমার মতে সত্য (অবলম্বনীয়)।

ন ত্বহং কাময়ে রাজ্যং ন স্বর্গং নাপুনর্ভব।
কাময়ে দুঃখপ্তানাং প্রাণিমার্তিনাশনম্ । (ভাগবত)
–আমি রাজ্য চাই না, স্বর্গ চাই না, পুনর্জন্মনিবৃত্তিও চাই না, দুঃখতপ্ত প্রাণিগণের আর্তিনাশই চাই।

যেন কেন প্রকারেণ যস্য কস্যাপি জনঃ।
সন্তোষং জনয়েদ্ধীমাংস্তদেবেশ্বরপূজনম্ (ভাগবত)
–যিনি ধীমান তিনি যে কোনও প্রকারে যে কোনও জন্তুর সন্তোষ উৎপাদন করবেন, তাই ঈশ্বরপূজা।

এদেশে সর্বভূতে সমদৃষ্টি ও অহিংসার বাণী বহু ভাবে বহু মুখে প্রচারিত হয়েছে, তার ফলে ভারতবাসীর (বিশেষত হিন্দু জৈন প্রভৃতির) চরিত্রে কিছু বৈশিষ্ট্য এসেছে। পাশ্চাত্ত্য জাতিদের তুলনায় আমরা অপেক্ষাকৃত অহিংস্র মৃদুস্বভাব ও পরমতসহিষ্ণু। প্রাচীন মিশরীয়গণ যেমন কয়েকটি প্রাণীকে দেবতুল্য গণ্য করত, হিন্দুও গরুকে সেইরকম মর্যাদা দেয়। পাশ্চাত্ত্য দেশে অকর্মণ্য ও মরণাপন্ন পালিত জন্তুকে মেরে ফেলা হয়, এদেশে সে প্রথা নেই। হিন্দুর মৃগয়াপ্রবৃত্তিও কম। এখনকার তুলনায় প্রাচীন ভারতে আমিষাহার বেশী প্রচলিত ছিল, কিন্তু বৌদ্ধ আর জৈন ধর্মের প্রভাবে তা কমে গেছে। মহাভারতে মনুর উক্তি আছে–যজ্ঞাদি কর্মে এবং শ্রাদ্ধে পিতৃগণের উদ্দেশে যে মন্ত্রপূত সংস্কৃত মাংস নিবেদিত হয় তা পবিত্র হবিঃস্বরূপ, তা ভিন্ন অন্য মাংস বৃথামাংস এবং অভক্ষ্য। সম্রাট অশোক প্রাণিহত্যা নিয়ন্ত্রিত করেছিলেন। বর্তমান কালে ভারতবর্ষে যত নিরামিষাশী আছে অন্য দেশে তত নেই, তবে স্বাধীনতা লাভের পর এদেশে যে পাশ্চাত্ত্য বিলাসিতার স্রোত এসেছে তার ফলে নিরামিষাশী সম্প্রদায়ের মধ্যেও আমিষাহার প্রচলিত হচ্ছে।

উক্ত বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও বলা চলে না যে অন্যদেশবাসীর তুলনায় ভারতবাসী, অধিকতর সমদর্শী। এদেশে অস্পৃশ্যতা আছে, উচ্চ বর্ণের অভিমান এবং নীচ বর্ণের প্রতি ঘৃণা অবজ্ঞা আছে। যার ধর্ম ভাষা আকৃতি পরিচ্ছদ খাদ্য ইত্যাদি ভিন্ন প্রকার তাকে আমরা আপন জন মনে করতে পারি না। ইংরেজীতে একটি ব্যঙ্গোক্তি আছে–সব মানুষ সমান, কিন্তু কেউ কেউ বেশী সমান। আমাদের সমদর্শিতা সম্বন্ধেও এই কথা বলে চলে।

ভারতবর্ষে ধর্মপ্রচারক সাধু অনেক ছিলেন, এখনও আছেন, কিন্তু ভক্তি আর অধ্যাত্মবিদ্যার প্রচার যত হয়েছে জনহিতব্রত আর সমদর্শিতার প্রচার তেমন হয়নি। আশার কথা, ভারত সরকার এদিকে মন দিয়েছেন এবং শিক্ষিত লোকের মধ্যে এ বিষয়ে উৎসাহ দেখা দিয়েছে।

সকল সভ্য সমাজেই সমদর্শিতা আদর্শরূপে অল্পাধিক স্বীকৃতি পেয়েছে, আদর্শ আর আচরণের প্রভেদও সর্বত্র আছে। শ্বেত আর অশ্বেত জাতির মর্যাদা সমান নয় এই ধারণা পাশ্চাত্ত্য দেশে খুবই প্রবল। তথাপি পাশ্চাত্ত্য আদর্শ ধীরে ধীরে উদার হচ্ছে এবং ইতর প্রাণীর প্রতিও যে মানুষের কর্তব্য আছে এই ধারণা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বহু বৎসর পূর্বে টমাস হেনরি হাক্সলি লিখেছিলেন–মানবজাতির দুরকম নীতি বা আদর্শ আছে এবং এই দুইএর দ্বন্দ্ব চিরকাল চলছে। একটি হচ্ছে। ধর্মনীতি বা সাধারণ মরালিটি, মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে অভিব্যক্তি লাভ করেছে। অহিংসা দয়া সত্য অলোভ সমদর্শিতা পরোপকার প্রভৃতি এর অঙ্গ এবং প্রধান প্রধান সকল ধর্মেই এই সকল বৃত্তি প্রশংসিত হয়েছে। অপর নীতিটি অত্যন্ত প্রাচীন, জীবোৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে সহজাত সংস্কাররূপে উদ্ভূত হয়েছে। হাক্সলি এই নীতির বিশেষণ দিয়েছেন কমিক, অর্থাৎ নৈসর্গিক। এই নীতির লক্ষ্য স্বার্থসাধন এবং তার জন্য যে পরিমাণ পর প্রীতি আবশ্যক শুধু তারই চর্চা। এই নিসর্গনীতি অনুসারে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ইতর জীবের গোষ্ঠীবন্ধন এবং আদিম মানব সমাজের উদ্ভব হয়েছে। কৌটিল্য আর মেকিয়াভেলি এই নীতিই বিবৃত করেছেন এবং নেপোলিয়ন হিটলার মুসোলিনি প্রভৃতি তা অবলম্বন করে রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করেছিলেন। অধিকাংশ রাষ্ট্রের ব্যবহারে যে কুটিলতা দেখা যায় তাও এই নীতির ফল।

ধর্মনীতি বলে–পরের অনিষ্ট কর না। নিসর্গনীতি বলে–স্বার্থসিদ্ধির জন্য করতে পার। শেষোক্ত নীতি অনুসারেই সেকালে এদেশের রাজারা দিগবিজয় করতেন। পরাক্রান্ত জাতি দুর্বলের উপর এখনও আধিপত্য করে, প্রবল ব্যবসায়ী দুর্বল প্রতিযোগীর জীবিকা নষ্ট করে। রাজনীতিক উদ্দেশ্যে এবং পণ্যদ্রব্যের বিক্রয় বৃদ্ধির জন্য সংবাদপত্রাদির সাহায্যে অজস্র অসত্য প্রচার করা হয়। যুদ্ধকালে বিপক্ষের গ্রামনগরাদি ধ্বংস এবং নিরপরাধ অসংখ্য প্রজার সর্বনাশ করা হয়। সমাজ রক্ষার জন্য অপরাধী দণ্ড পায় কিন্তু তার পরিবারের যে দুর্দশা হয় তার প্রতিকার হয় না।

আদিম যুগ থেকে মানুষ নানা উদ্দেশ্যে প্রাণিপীড়ন করে আসছে। আত্মরক্ষার জন্য অনেক প্রাণী হত্যা করা হয়। পৃথিবীর অধিকাংশ লোক আমিষাহারী। মাছ ধরা, পাখি হরিণ ইত্যাদি মারা অনেকের বিচারে নির্দোষ আমোদ। রেশম তসর গরদ ইত্যাদির জন্য অসংখ্য কীট হত্যায় আমাদের আপত্তি নেই, হিন্দুর বিচারে কৌষেয় বস্ত্র আর মৃগচর্ম অতি পবিত্র। বলদকে নপুংসক করে নাকে দড়ি দিয়ে খাটাতে আমাদের বাধে না। মধুর লোভে আমরা মৌমাছির কষ্টসঞ্চিত ভাণ্ডার লুঠ করি, অনেক ক্ষেত্রে বুভুক্ষু বাছুরকে বঞ্চিত করে দুধ খাই। তুচ্ছ শখের জন্য আকাশচারী পাখিকে বন্দী করি। আধুনিক সভ্য সমাজে অনর্থক প্রাণিপীড়ন গহিত গণ্য হয়, কিন্তু আত্মরক্ষা, খাদ্য, মৃগয়া, বিলাস, আর বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য জীবহিংসায় দোষ ধরা হয় না।

সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর পক্ষে পূর্ণ অহিংসা এবং সর্বভূতে সমদৃষ্টি সম্ভব হতে পারে, হাক্সলিকথিত নিসর্গনীতি বর্জন করে উচ্চতম ধর্মনীতি অনুসারে জীবনযাপন করা যেতে পারে। কিন্তু সাধারণ লোকের পক্ষে তা অসম্ভব। বিভিন্ন জাতির মধ্যে বৈরভাব এবং যুদ্ধের সম্ভাবনা শীঘ্র দূর হবে না, জনসাধারণের পক্ষেও নিঃস্বার্থ নির্ঘ জীবনযাত্রা দুঃসাধ্য। এমন অবস্থায় ধর্মনীতি আর নিসর্গনীতির মধ্যে রফা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আধুনিক হিউম্যানিজম বা মানবধর্মে এই রফার চেষ্টা আছে। এই ধর্মে জ্ঞান ও ভক্তির চর্চায় বাধা নেই, কিন্তু প্রধান লক্ষ্য–সমগ্র মানবজাতির মঙ্গলের অবিরোধে ব্যক্তি ও সমাজের স্বার্থসাধন এবং সেই স্বার্থের অবিরোধে যথাসম্ভব জীবে দয়া। মহাভারতে হংসরূপী প্রজাপতি বলেছেন–ন মনুষ্যাৎ শ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ। চণ্ডীদাস বলেছেন–সবার উপরে মানুষ সত্য। এই দুই উক্তির গূঢ় অর্থ থাকতে পারে, কিন্তু সরল অর্থ ধরলে আধুনিক হিউম্যানিজমএর সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। এই ধর্ম এখন পর্যন্ত একটি সমস্যাসংকুল অতি অস্পষ্ট আদর্শ মাত্র। এর নির্বাচন বা enunciation হয় নি, চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ও হয় নি। তথাপি আশা হয় এই ধর্মের ক্রমবিকাশের ফলে সাধারণ মানুষ যথাসম্ভব সমদর্শিতা লাভের উপায় আবিষ্কার করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *