সমকামি – চল্লিশতম পর্ব
আজ দুদিন অন্যন্যার ঠিক মতো জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তার বলেছে ওকে ক্রমাগত হাই ডোজের ঘুমের ওষুধ পুশ করায় ও ভিতর থেকে অনেক বেশী দুর্বল হয়ে পড়েছে। ঠিক মতো জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না। এমন ও হতে পারে ও কোমায় চলে গেলো। কোনো সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ডাক্তারদের কথা মতো ওনারা এটা ভাবতেই পারছেন না যে ডক্টর চৌধুরীর মতো এতো বড় মাপের একজন ডাক্তার কি ভাবে দিনের পর এমন একটা হাই ডোজের ওষুধ কাউকে পুস করতে পারেন? ওদিকে রিনা দেবী ও জানতে পারে যে অন্যন্যাকে খুঁজে পাওয়া গেছে এবং ও এখন হসপিটালে । উনি বার বার জেদ করতে থাকেন মেয়েকে দেখতে যাবার জন্য। বিকাশ বাবু ওনাকে বোঝান উনি একটু সুস্থ হয়ে উঠলেই ওনাকে অন্যন্যার কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। অন্যন্যা ভালো আছে।
ওদিকে ডক্টর চৌধুরী নিজের সমস্ত ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ও জামিনের ব্যাবস্থা করতে পারেননি। কারণ সমস্ত ভিডিও আর ডক্টর মোহান্তির জবানবন্দী পুরোটাই ওনার বিরুদ্ধে। আর সব থেকে বড় কথা অয়ন পুলিশি জেরার মুখে ভেঙ্গে পড়ে সমস্ত কথা স্বীকার করে নিয়েছে। মিসেস চৌধুরী অবশ্য নীরব। তার একটাই কথা কেউ যদি অন্যায় করে এবং তার যথেষ্ট প্রমাণ থাকে তাহলে সে সাস্থি পাবে। কেস কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছালে মিসেস চৌধুরী বেল পেয়ে যায় কিন্তু অয়ন এবং ডক্টর চৌধুরীকে এবং ডক্টর মোহন্তিকে কোর্ট পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্যন্যার জ্ঞান ফিরছে এবং ও কথা বলার মতো অবস্থায় ফিরছে ততক্ষন পর্যন্ত ডক্টর চৌধুরী ডক্টর অয়ন চৌধূরী এবং ডক্টর মোহান্তি এদের করোর জামিন মঞ্জুর করা হবে না।
প্রায় চারদিন বাদে অন্যন্যার জ্ঞান ফেরে ভোর রাতের দিকে। খবর পেয়ে সকাল হতেই হসপিটালে ছোটে বিকাশ বাবু, কৃষ্ণেন্দু আর তৃণা। তিয়াসা যেতে পারেনি কারণ রিনা দেবীকে দেখাশোনার জন্য বাড়িতে কারোর একটা থাকা প্রয়োজন। ওরা সবাই অন্যন্যার কেবিনে ঢুকতেই দেখে অন্যন্যা তখনও চোখ বুজে আছে। বিকাশ বাবু স্বস্নেহে মেয়ের মাথায় হাত রাখতেই চোখ খোলে অন্যন্যা। ক্লান্ত অবসন্ন। কৃষ্ণেন্দুকে কিছু যেনো বলার চেষ্টা করছে। কৃষ্ণেন্দু ওর হাত দুটো ধরে বলে: সব শুনবো সব জানবো আগে তুমি ভালো হয়ে যাও। এই কটাদিন আমরা কেউ ভালো ছিলাম না তোমাকে ছেড়ে। ডক্টর বলছেন অন্যন্যা এখন আউট অফ ডেঞ্জার কিন্তু ও পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কোনো জিজ্ঞাসাবাদ বা কোনো রকম স্ট্রেস ওকে দেওয়া যাবে না।
অন্যদিকে ডক্টর মোহান্তি প্রধান সাক্ষী হতে রাজি হয়ে যায়। আর ওনার মেয়েকে ও ওরা সুস্থ ভাবে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে। রিনা দেবী ও আস্তে আস্তে অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠে। সেদিন বিকেলে সবাই যায় অন্যন্যাকে দেখতে। তৃণা, তিয়াসা, বিকাশ বাবু সেদিন যাননি। স্ত্রী এর কাছে ছিলেন। নার্স ওদের বলে অন্যন্যা আজ মুখে খাবার খেয়েছে। দুর্বলতা পুরোপুরি না কাটলে ও আগের থেকে অনেকটাই ভালো আছে । তৃণা তিয়াসা ওদের সাথে কথা বললে ও অন্যন্যার চোখদুটো যেনো আরো কাউকে খুঁজছিল। তৃণা সেটা বুঝতে পেরে অন্যন্যাকে বলে: বাবা রে বাবা আসবে আসবে অফিসের কাজে আটকে গেছিলো। On the way। দেখ দেখলি তিয়াসা আমরা এসেছি তাতে তোর দিভাই একটু ও খুশি নয়। শুধুই হবু বরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তিয়াসা মুচকি হাঁসে। অন্যন্যা বলে: আবার বাজে ইয়ার্কি। এর মধ্যেই কৃষ্ণেন্দু সেখানে ঢোকে। কৃষ্ণেন্দুকে দেখে তৃণা বলে: নিন আপনার বউকে এবার সামলান। আমরা এসেছি তাতে একটু ও খুশি হয়নি। শুধুই আপনাকে খুঁজে যাচ্ছে। কৃষ্ণেন্দু বলে: আমার শালিরা যদি বউটাকে এত রাগয় তাহলে কিন্তু আমিও খুব রেগে যাবো। অন্যন্যা লজ্জা পায়। তৃণা বলে: ওওও, বুঝেছি বুঝেছি এই তিয়াসা চল আমরা বাইরে যায় এখানে আর আমাদের কোনো দরকার নেই বুজলি তো? অন্যন্যা বলে আরে না, না কাউকে কোথাও যেতে হবে না তোরা বস না। তৃণা বলে না না কথা বলে নে তোরা আমরা আছি। ওরা বেরিয়ে যায় রুম থেকে। কৃষ্ণেন্দু কাছে গিয়ে অন্যন্যার হাতটা ধরলে অন্যন্যা জড়িয়ে ধরে কৃষ্ণেন্দুকে। তারপর আস্তে করে বলে আমি ভাবতে পারিনি আমি আর কোনোদিন তোমাদের কাছে ফিরতে পারবো। আমি বুঝতে পারতাম কিন্তু কিছু করার ক্ষমতা ছিল না আমার। ঠিক মতো জ্ঞান ফেরার আগেই ওরা আমাকে আবার ইনজেকশন পুস করে অজ্ঞান করে দিত। কৃষ্ণেন্দু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো: আর কোনো ভয় নেই। সেদিন আমি থাকলে এমন ঘটনা ঘটতো না। আর কোনোদিন আমার সোনা বউকে আমি একা ছেড়ে যাবো না কোথাও। ধীরে ধীরে অন্যন্যা সুস্থ হয়ে ওঠে অন্যন্যা। বাড়ি ফিরে যায়। রিনা দেবী ও এখন সুস্থ। অন্যন্যা পুলিশের কাছে নিজের জবানবন্দী দেয়। কেস কোর্টে উঠলে মিসেস চৌধুরী বেকুসুর খালাস পায়।অয়ন এবং ডক্টর মোহান্তি রাজ সাক্ষী হওয়ার কারণে ওদের স্বাস্থি কিছুটা কম হয়। ডক্টর চৌধুরীর হসপিটালের লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হয়। কারণ ডক্টর মোহান্তির সাক্ষীর ভিত্তিতে পুলিশ সেখানে তল্লাশি চালিয়ে বিভিন্ন রকম অসামাজিক কাজের তথ্য প্রমাণ খুঁজে পায়। ডক্টর চৌধুরীর পণের বছরের জেল হয়ে যায়। এবং তার ও ডাক্তারির লাইসেন্স ক্যান্সেল করে দেওয়া হয়। অন্যন্যা ও ডিভোর্স পেয়ে যায়।
অন্যন্যা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে থাকে। অফিসে এখন সবাই জানে কৃষ্ণেন্দু আর অন্যন্যার সম্পর্কের কথাটা। কৃষ্ণেন্দু অন্যন্যাকে এখন আর একা ছাড়ে না। অন্যান্য কৃষ্ণেন্দুর সাথেই অফিসে যাতায়াত করে। কিন্তু রিনা দেবীর কারণে ও এখনও বাড়িতে ঢুকে না। অন্যন্যার খারাপ লাগলেও কিছু বলে না। ও মা বা কৃষ্ণেন্দু কাউকেই কষ্ট দিতে চায় না। কারণ ওরা দুজনেই ওকে ভালবাসে ওর জন্য চিন্তা করে। সেদিন রাতে একসাথে খেতে বসে রিনা দেবী অন্যন্যাকে বলে: এই ভাবে আর কতদিন? পাড়ার লোক এবার নানা রকম কথা বলবে। এমনিতেই এতো কিছু ঘটে গেছে। তারপর ও কি আমার কথা শোনার করো দরকার মনে হচ্ছে না? অন্যন্যা চুপ করে থাকে। বিকাশ বাবু বলে তোমাকে কতবার আমি বলেছি বোঝানোর চেস্টা করেছি কিন্তু তুমি তো ধনুক ভাঙ্গা পণ করে রেখেছ তুমি কিছু বুঝবে না। ওই ছেলেটা না থাকলে আমি তোমাকে অনুকে কাউকে ফেরাতে পারতাম না। ও একদিকে নিজের কাজ সামলেছে অন্যদিকে আমাদের পরিবার এমনকি তিয়াসাকে ও নিজের ছোটো বোনের মতো করে খেয়াল রেখেছে। আমি কিছুতেই বুঝতে পড়ছি না আমাদের ভুলের দায় তুমি কেনো ওই ছেলেটার কাঁধে চাপাতে চাইছো? মানুষ চিন্তে আমরা ভুল করেছি ভুল জায়গায় আমরা মেয়ের বিয়ে দিয়েছি তাহলে এর মধ্যে ওর কি দোষ? রিনা দেবী কিছু বলতে যাবে বিকাশ বাবু থামিয়ে দিয়ে বললো: দেখো প্লিজ বলো না ওর বয়স বেশী বা ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে আগে। ডিভোর্স আমাদের মেয়ের ও হয়েছে কিন্তু তার জন্য কি আমাদের মেয়ে দাই? তাহলে এটা কেনো ধরে নিচ্ছ যে ওর ডিভোর্সের জন্য ওই দাই? আর বয়স? আমাদের মেয়েটা ওকে ভালবাসে ও মনে করছে ও সাথে ভালো থাকবে নিজের কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে যে মানুষটা ওর পাশে থাকলো আমাদের পাশে থাকলো তাঁকে অপছন্দ করার বয়স কোনো কারণ হতে পারে না। আর তাছাড়া ও কোনো বুড়ো নয় রিনা। রিনা দেবী এতক্ষন বিকাশ বাবুর সব কথা চুপ করে শুনে অন্যন্যার দিকে তাঁকিয়ে প্রশ্ন করে: তোমার ও ওই এক মত? অন্যন্যা মাথা নীচু করে উত্তর দেয়: আমি ওকে ভালবাসি আমার জীবনে ওকে ছাড়া আমি আর কাউকে কোনো জায়গা দিতে পারবো না। আমি তোমাকে ও কোনো কষ্ট দিতে চাই না। তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করা ছাড়া আর যা বলবে আমি সব করতে রাজি। কথাগুলো বলে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে যায় অন্যন্যা।
পরের দিন সকালে অন্যন্যা অফিসের জন্য তৈরী হয়ে খাবার টেবিলে আসে। বেরোনোর সময় রিনা দেবী জানতে চায়: তিয়াসা ও যাচ্ছে তোর সাথেই? অন্যন্যা উত্তর দেয়: হ্যাঁ, মা। কৃষ্ণেন্দু পৌঁছে দেবে: হুম ওকে কলেজে পৌঁছে তারপর আমরা অফিসে যাবো। বুজলাম, ওকে সন্ধ্যের সময় আমার সাথে একবার দেখা করতে বলবি। যখন ও তোকে ছাড়তে আসবে। ওর সাথে কথা আছে আমার। অন্যন্যা ঘার নাড়িয়ে বলে: ঠিক আছে বলবো। এরপর অন্যন্যা আর তিয়াসা বেড়িয়ে যায়। গাড়িতে কৃষ্ণেন্দুর পাশের সিটে অন্যন্যা। আর পিছনের সিটে তিয়াসা। কিছুটা দূরে সবাই চুপচাপ যাওয়ার পর তিয়াসা বলে: তোমার মনে হচ্ছে আমার জিজু হওয়াটা পাকা হয়েই গেলো। অন্যন্যা তিয়াসাকে ধমকে বলে: আবার বেশি পাকা পাকা কথা একদম চুপচাপ চল কোনো কথা না। কৃষ্ণেন্দু তিয়াসাকে বলে: এই তিয়াসা তুমি বলতো কি ব্যাপার? তোমার দিদি আমাকে পুরো লাইফ অপেক্ষায় রাখার তালে আছে। তিয়াসা মুখ ফুলিয়ে বলে: না, আমি আর কিছুই বলবো না। তুমি দিদিয়াকেই জিজ্ঞাসা করো। কৃষ্ণেন্দু অন্যন্যাকে বলে: কি হলো অনু বলো না কি হয়েছে? অন্যন্যা জানলার দিকে তাঁকিয়ে আস্তে করে উত্তর দেয় মা তোমাকে বিকেলে অফিসের পর যখন আমাকে যখন ছাড়তে আসবে তখন দেখা করতে বলেছে। কৃষ্ণেন্দু নিজের হাত মুঠো করে বলে: yesss।।