সমকামি – পঁয়ত্রিশতম পর্ব
ফিরে গিয়ে বিপ্লব কমিশনারের কথা মতো কাজ শুরু করে। ওদিকে অন্যন্যার মা সজ্জা নেন। ডক্টর পরামর্শ দেন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ওনাকে হসপিটালে অ্যাডমিট করানোর জন্য কারণ বাড়িতে ওনাকে ঠিক মতো খাওয়ানো যাচ্ছে না। এই ভাবে চলতে থাকলে ওনাকে বাঁচানো নিয়ে সমস্যা দেখা দেবে। সেখানে একটা প্রপার ট্রিটমেন্ট হলে উনি অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠবেন আশা করা যায়। বাড়ির একটা অগোছালো অবস্থা সবকিছু যেনো এক নিমেষে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির মেয়ে তার প্রায় সাত দিনের উপরে কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির কর্ত্রীর প্রাণ সংশয়।
তিয়াসা বাবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে : বাবা কৃষ্ণেন্দু দা কে একটা ফোন করি? উনি ছাড়া এই মুহূর্তে আর কার কাছেই বা হেল্প চাইবো আমরা? মাকে বাড়িতে রাখলে আমরা বাঁচাতে পারবো না। বেশকিছুক্ষণের মৌনতা ভেঙ্গে বিকাশ বাবু উত্তর দেন: বিয়েটা একটা ভুল ছিল কিন্তু তার থেকেও বড় ভুল হলো তোর মার কথা না শোনা। মা তো বিপদের আঁচ তাই আগে থেকেই পেয়েছিল। জানি না আর কোনোদিন তোর দিদিকে ফিরে পাবো কিনা? আমার সংসারটা ছারেখারে চলে গেলো। আর কি সর্বনাশ তো যা হবার হয়েই গেলো। এখন আর ফোন করলেই কি আর না করলেই বা কি? তবু দেখি তোর দিদিকে তো বাঁচানো গেলো না তবু যদি তোর মাকে ফেরাতে পারি!!! মেয়ের দিকে তাঁকিয়ে বিকাশ বাবু বললো আমাকে এক কাপ চা দিবি মা? মাথাটা বড্ড ধরেছে। আর দেখ ফোন করে যদি কিছু করতে পারে। ঠিক আছে বাবা বলে তিয়াসা বাবার জন্য চা আনতে গেলো। মনে মনে ভাবলো বাবাকে চা টা দিয়ে নিয়ে তারপর কৃষ্ণেন্দুকে ফোনটা করবে সে। ইতি মধ্যেই বাড়ির কলিং বেলটা বেজে উঠলে রান্না ঘর থেকে ছুটে আসে তিয়াসা বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে: তুমি বসো বাবা। মা সারা রাত জেগে সবে মাত্র ঘুমিয়েছে তুমি একটু কাছে থাকো। তিয়াসা ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেখে তৃণা আর কৃষ্ণেন্দু দাঁড়িয়ে ওদের দেখে তিয়াসা বলে: ও তোমরা ভালোই হয়েছে এসেছো। আমি তোমাকে ফোন করতেই যাচ্ছিলাম কৃষ্ণেন্দু দা। উদ্বিঘ্ন ভাবে কৃষ্ণেন্দু প্রশ্ন করে: সবকিছু ঠিক আছে তো? কাকিমা? কাকিমা ভালো আছে তো? তিয়াসা শান্ত ভাবে উত্তর দেয়: তোমরা ভীতরে এসো। এসো তৃণা দি। ঘরের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে তিয়াসা বললো : না, মা ভালো নেই। ডাক্তার বাবু বলে গেলেন ইমিডিয়েট হসপিটালে অ্যাডমিট করতে। মাকে কিছু খাওয়ানো যাচ্ছে না। এই ভাবে চলতে থাকলে বাঁচানো মুস্কিল হয়ে যাবে। তোমরা বসো আমি বাবাকে ডেকে দিচ্ছি। মা সবে মাত্র ঘুমিয়েছে। মিনিট দুই পরে বিকাশ বাবু এলেন: তৃনাকে দেখে বললেন: আর মনে হয় কিছুই বাঁচাতে পারলাম না। কৃষ্ণেন্দু একটা হসপিটালে অ্যাডমিটের ব্যাবস্থা যদি করে দিতে পারো তাহলে অন্তত অনুর মাকে বাঁচানোর একবার চেষ্টা করে দেখতে পারতাম। কৃষ্ণেন্দু বিকাশ বাবুর হাতদুটো শক্ত করে চেপে ধরে বলে: এই ভাবে বলবেন না প্লিজ। একটা খবর নিয়ে এসেছিলাম। আর কাকিমার অ্যাডমিশন নিয়ে ভাববেন না। আমি সব ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি। ওনার ট্রিটমেন্ট ভালো জায়গাতেই হবে। বিকাশ বাবু উত্তর দেয়: না না টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা নেই ওর ট্রিটমেন্টের সব টাকাই আমি পাবো। শুধু লোক বলের অভাব জানোতো। তাই বোধ হয় বিয়েটা দিতে গিয়ে এতো বড় ভুল হয়ে গেলো।
তৃণা এরপর বিকাশ বাবুকে বললো: কাকু একটা ভালো খবর আছে। অনুর খোঁজ পাওয়া গেছে। বিকাশ বাবু চিৎকার করে ওঠেন: কি অনুর খোঁজ পাওয়া গেছে? কৃষ্ণেন্দু বলে ওঠে: আস্তে আস্তে কাকু। এই কথা আর কাউকে কিছু বলবেন না। আপনি খোঁজ পাননি সেই ভাবেই থাকবেন। বিকাশ বাবু প্রশ্ন করে: কেনো? আমার মেয়েটার কি ওরা অনেক বড় কোনো ক্ষতি দিয়েছে? যা জানাজানি হলে লোক নিন্দা হতে পারে? তৃণা বলে না, না কাকু তেমন কিছুই ঘটেনি কিন্তু ওরা কোথায় কি জাল বিছিয়ে রেখেছে সেটা আমরা কেউ জানি না। ওরা যদি জানতে পারে আমরা অনুর খোঁজ পেয়েছি তাহলে ওর আরও বড় বিপদ হতে পারে তাই। তৃণা আবার বলতে শুরু করে কাকু ওরা ডক্টর চৌধুরীর হসপিটালে অন্যন্যাকে লুকিয়ে রেখেছে। তবে এর থেকে বেশী কিছু জানা যায়নি। আর একটু ধৈর্য রাখতে হবে কাকু অনুকে আমরা ঠিক ফিরিয়ে আনতে পারবো। বিকাশ বাবুর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে!!! আমার মেয়েটাকে না জানি ওরা কতো কষ্ট দিচ্ছে। ও তো কোনো প্রতিবাদ করেনি। শুধু মুক্তি চেয়েছিল সম্পর্কটা থেকে। নিজের মতো বাঁচার অধিকার তো সবারই আছে। আমি কতো অভাগা আমি কাঁদতে ও পারি না পাছে ওর মা আবার উত্তেজিত হয়ে পড়ে। কৃষ্ণেন্দু বলে: আজ সকালে আমি আমার কমিশনার বন্ধুকে ফোন করেছিলাম এই ইনফরমেশনটা ওই আমাকে দিলো। জানি এতো ধৈর্য রাখা আপনাদের পক্ষে সত্যি অসম্ভব কিন্তু আর কটাদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। এর মধ্যে তিয়াসা চা নিয়ে এলো। কৃষ্ণেন্দু ওকে বললো: তুমি এই সময় আবার চা কেনো আনতে গেলে এটা কি ভদ্রতা করার সময়? বিকাশ বাবু কৃষ্ণেন্দুকে থামিয়ে দিয়ে বললো: না, না আমি ওকে আমার জন্য চা করতে বলেছিলাম বড্ড মাথা ধরে আছে। এর মধ্যেই তোমরা ঢুকলে তাই আর কি।
চা খেতে খেতে কৃষ্ণেন্দু বিকাশ বাবুকে প্রশ্ন করে: মাসিমা কে তাহলে কোথায় ভর্তি করবেন ভাবলেন? বিকাশ বাবু চা খেতে খেতে উত্তর দিলেন: নাইট এঞ্জেলে ভাবছি বাড়ির একটু কাছে ও আছে আর ওকে যে ডক্টর দেখছেন তিনি ও ওখানে বসেন। বাড়ির কাছে থাকলে আমি নিজে সব সময় যাতায়াত করতে পারবো। একটা মেয়েকে সাহস দেখতে গিয়ে হারাতে বসেছি আর একটা মেয়েকে নিয়ে আমি কোনো রিস্ক নিতে পারবো না। তাহলে আমি একটা অ্যাম্বুলেন্স কল করি? প্রশ্ন করে কৃষ্ণেন্দু। ও হ্যাঁ তার আগে হসপিটালে একটা খোঁজ নিয়ে নিলে ভালো হতো না বেড খালি আছে কিনা? না, তার দরকার হবে না। আমি ডাক্তার বাবুকে একটা ফোন করলেই উনি সব ব্যাবস্থা করে রাখবেন বলেছেন। তার আগে আমি মেডিক্যাল ডকুমেন্টস গুলো বের করে আনি। তোমার বসো। এই কথা বলে বিকাশ বাবু ঘরের ভিতরে চলে যান। তিয়াসা চুপচাপ চেয়ারের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। তৃণা ওর হাত ধরে টেনে বলে: বস এখানে। আমি জানি এই সময় তোদের করো পক্ষেই মাথা ঠিক রাখা সম্ভব না। কিন্তু কাকু কাকিমা দুজনেরই বয়স হয়েছে তুই একটু শক্ত না হলে খুব মুশকিল তিয়া। তিয়াসা মাথা নীচু করে কাঁদতে থাকে কোনো কথার উত্তর দিতে পারছে না ওর গলা আটকে আসছে। তৃণা ওর পাশে গিয়ে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে: চোখ মোছ চোখ মোছ কাকু যদি এখানে এসে দেখে তুই কাঁদছিস তাহলে আরো ভেঙ্গে পড়বে। তিয়াসা তৃণার হাত চেপে ধরে বলে : মা বাবার কথা চিন্তা করে আমি একটু কাঁদতে ও পারছি না। আমি আর পারছি না তৃণা দি। আমি মাকে ছোটো থেকে কখনো এই ভাবে বিছানা নিতে দেখিনি। দিদিয়ার এই বিয়েটার আগে বিশ্বাস করো আমরা খুব ভালো ছিলাম। প্রতিটা দিন এই ভাবে মরে করে বাঁচতে হয়নি আমাদের। এমন কি দিদিয়া ফিরে আসার পরে ও আমাদের সুখ শান্তির কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু মার খুব আপত্তি ছিল জানো তো এই ডিভোর্সের ব্যাপারে। মা চায়নি দিদিয়া এই ডিভোর্স টা করুক। আমরা ভুল বুঝেছিলাম মাকে, মা হয়তো এই ভয়েই যে ওরা দিদিয়ার কোনো ক্ষতি না করে দেয় সেই জন্যই। আর কথা বলতে পারে না তিয়াসা। মুখ চেপে কাঁদতে থাকে তিয়াসা। কৃষ্ণেন্দু বা তৃণা কিছুই বলতে পারে না । এর মধ্যেই বিকাশ বাবু সমস্ত কাগজ পত্র নিয়ে বসার ঘরে আসেন। তারপর ডক্টরকে ফোন করে বলেন যে ওনারা রিনা দেবীকে হসপিটালে নিয়ে আসছেন। তারপর কৃষ্ণেন্দু একটা অ্যাম্বুলেন্স বুক করে সবাই মিলে রিনা দেবীকে নিয়ে যাওয়া হয় হসপিটালে। অ্যাডমিশনের পুরো সময়টাতে তৃণা আর কৃষ্ণেন্দু ওদের সাথেই ছিল। সব ফর্মালিটি কমপ্লিট হওয়ার পর কৃষ্ণেন্দু বিকাশ বাবুকে বলে: চলুন আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসি বাড়িতে আর বিকেলে আমি ঠিক সময় পৌঁছে যাবো আপনারা আমার সাথে আসবেন। আমি ডক্টরের সাথে কথা বলে নিয়েছি কাউকে থাকার এখানে দরকার পড়বে না। আমার নম্বর ও দেয়া আছে যদি কোনো ইমারজেন্সি হয় তার জন্য। তৃণা বললো তাহলে আপনি ওদের পৌঁছে দিন। আমি এখান থেকেই একটা ক্যাব বুক করে নিচ্ছি। আরে না না কাউকে কোনো ক্যাব বুক করতে হবে না আপনি চিন্তা করবেন না তৃণা আমি আপনাকে ও পৌঁছে দেবো কৃষ্ণেন্দু তৃনাকে বলে।
তৃণা হেঁসে বলে আমাকে নিয়ে এত চাপ নিয়ে হবে না আপনি যান ওদের সাথে। আমি বিকেলে আসবো তখন দেখা হচ্ছে আর তেমন হলে আমি পৌঁছে আপনাকে জানিয়ে দেবো আপনি চিন্তা করবেন না। আমি এখন আসি তাহলে। সকলকে বলে তৃণা সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। কৃষ্ণেন্দু বিকাশ বাবুকে উদ্দেশ্য করে বলে: চলুন আমরা ও এগোই তাহলে। আবার তো সময় মতো আসতে হবে।