সমকামি – তিরিশতম পর্ব
চা শেষ করে ওরা বেশকিছুক্ষণ একে অপরের অনেকটা কাছে দাঁড়িয়ে থাকে অন্যন্যা কৃষ্ণেন্দুর ঘাড়ে মাথা রেখে বলে অনেকটা রাত হলো এবার যে যেতে হবে। কৃষ্ণেন্দু অন্যন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো : কবে যে আমার পাখিটাকে আমার কাছে সারা জীবনের জন্য নিয়ে যেতে পারবো? এভাবে ছেড়ে থাকতে ভালো লাগছে না। চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। কালকে কিন্তু দেরী করো না আমি সময় মতো চলে আসবো। যতক্ষন না আমার পাখিটাকে আমি দেখতে পাই আমার কিছু ভালো লাগে না। কৃষ্ণেন্দু অন্যন্যাকে বাড়ি পৌঁছে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। ঘরে ঢোকার পর রিনা দেবী জানতে চায়: রাত দশটা বাজে সেই বিকেলে বেরিয়ে এখন ঢুকলি কোথায় ছিলিস এতক্ষন? বললাম তো মা দরকারে গেছিলাম যাতে অয়ন আমাদের কারো কোনো ক্ষতি করতে না পারে সেই ব্যাবস্থা করতে। রিনা দেবী বলে একটা কথা মনে রেখো তুমি যদি তোমার বসকে এই বাড়ির জামাই বানাবে ভেবে থাকো তাহলে সেই সম্পর্কও আমি মেনে নেবো না। অয়নকে ক্ষমা করতে না পারার সেটা ও যে একটা কারণ সেটা আমি এতদিন আন্দাজ করছিলাম কিন্তু আজ আমি নিশ্চিত। অন্যন্যা রিনা দেবীকে বলে: মা তুমি আবার ওনাকে নিয়ে পড়লে? রিনা দেবী ভীষণ রেগে গিয়ে বলে: মিথ্যে বলার চেষ্টা করো না অন্যন্যা। আমাকে অনেকেই বলেছিল একটা গাড়ি তোকে অফিস থেকে ফেরার সময় এখানে নামিয়ে দিয়ে যায়। আর আজকাল তো নিতে ও আসে। আমি সেদিনই বুঝেছিলাম বার বার বলেছিলাম অফিসের সম্পর্ক অফিস পর্যন্ত থাকবে সেটা ঘরের কোনোদিন হবে না। নিজে এগোচ্ছ নিজের দায়িত্বে অয়নকে যেমন তুমি মানলে না তেমন আমি কোনোদিন ওই বয়সের একটা লোককে তোমার স্বামী এই বাড়ির জামাই হিসেবে মানবো না। অন্যন্যা মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে: মা প্লিজ তুমি আমার কথাটা একটু শোনো একটা মানুষকে তার বয়স তার দেখা দিয়ে বিচার করা যায় না সেটা ঠিক না। রিনা দেবী কোনো কথা না শুনে নিজের ঘরে ঢুকে যায়।
অন্যন্যা ও আর কোনো কিছু বলতে না পেরে নিজের ঘরে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে খাটের উপর বসে পড়ে। কিছুক্ষন বাদে বিকাশ বাবু অন্যন্যার ঘরে আসে। বাবাকে দেখে অন্যন্যা বলে: বাবা তুমি বাইরে কেনো দাঁড়িয়ে আছো? ভীতরে এসো না। বিকাশ বাবু ভীতরে ঢুকে অন্যন্যাকে জিজ্ঞাসা করে: তোকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো সত্যি বলবি? অন্যন্যা বিকাশ বাবুকে বলে: আমি কি তোমাদের কোনোদিন মিথ্যে বলেছি বাবা? বিকাশ বাবু জানতে চায়: তোকে কি এখন কৃষ্ণেন্দু বাবু রোজ মানে তোরা কি এখন একসাথে অফিসে যাতায়াত করিস? অন্যন্যা বিকাশ বাবুকে বলে:হ্যাঁ, বাবা। উনি আমার কথা ভেবেই!!!বিকাশ বাবু বলে দেখ মা বড় হয়েছিস নিজের মতামত পছন্দ অপছন্দ তৈরী হয়েছে সবটাই সত্যি সবটাই ঠিক কিন্তু আবার যেনো কোনো ভুল না হয়ে যায়। তোর মা হয়তো সেটাই ভয় পাচ্ছে। বাবা তুমি অন্তত বিশ্বাস করো মানুষটা তেমন নয়। সত্যি ও অনেক আলাদা অনেকের থেকে অনেক আলাদা বাবা। বিকাশ বাবু হাঁসি হাঁসি মুখ করে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ছ বলে খুব ভালোবাসিস তাই না? অন্যন্যা লজ্জা পেয়ে বলে: না না বাবা বিশ্বাস করো আমি কথাটা সেই ভাবে বলতে চাইনি। বিকাশ বাবু স্নেহের স্বরে বলেন: ওরে পাগলী আমরা তোর মা বাবা। মুখে না বললে ও আমরা বুঝি। তবে তোর মার ওনার বয়স টা নিয়ে একটা বিরাট অবজেকশন আছে। কিন্তু তুই ভাবিস না সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দেখিস মা একটা ভুল তো হয়ে গেছে তাই আবার ও যেনো কোনো ভুল না হয়। আগে সব মিটুক তারপর তোর মাকে বোঝানোর দায়িত্ব আমার। অন্যন্যা বাবার কথার কোনো উত্তর দেয় না চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বিকাশ বাবু বলেন: যা তুই ফ্রেশ হয়ে নে। বেশী চিন্তা করিস না। আমি তো আছি।
পরেরদিন কৃষ্ণেন্দুর সকাল সকাল ফোন পেয়ে অন্যন্যার মন খুশিতে ভরে ওঠে ও ভাবে যে কৃষ্ণেন্দুকে অফিস যাওয়ার পথে বলবে যে বাবা ওদের সম্পর্কের ব্যাপারটা বুঝতে পারে এবং বাবার এতে কোনো আপত্তি নেই। খুব আনন্দের সাথে ফোনটা রিসিভ করে অন্যন্যা ঘুমন্ত গলায় বলে: গুড মর্নিং কৃষ্ণেন্দু। ওপাশ থেকে কৃষ্ণেন্দু আদুরে গলায় বলে: গুড মর্নিং আমার ছোট্ট পাখি। আই অ্যাম ভেরি সরি সোনা তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দেবার জন্য। সোনা আজকে আমাকে নটার মধ্যে একবার আমাদের ব্রাঞ্চ অফিস যেতে হবে। সোনা আজকে তুমি একটা ক্যাব বুক করে অফিসে চলে যেও। প্লিজ বাসে ট্রাভেল করতে যেও না। আমি লাঞ্চ আওয়ারের আগেই অফিসে ঢুকে যাবো। লক্ষ্মী সোনা রাগ করবে না। অফিসে দেখা হচ্ছে। আমার মিষ্টি পাখি আই লাইভ ইউ মিস ইউ বেবি। অফিস পৌঁছে আমাকে জানাতে ভুলবে না। মনে থাকবে? অন্যন্যা মন খারাপের সুরে বলে হুম থাকবে। রাখছি। অন্যন্যা সেদিন একটা ক্যাব বুক করে অফিস পৌঁছালো। কিন্তু লাঞ্চ আওয়ার পেরিয়ে গেলে ও কৃষ্ণেন্দু না আসায় ও কৃষ্ণেন্দুকে কল করে জানতে চায় ও কতক্ষনে অফিসে ঢুকছে,? কৃষ্ণেন্দু অন্যন্যাকে বলে: একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং এ আটকে আছে বুঝতে পারছে না কখন অফিসে ঢুকতে পারবে আদৌ পারবে কিনা। অন্যন্যা মন খারাপ করে বলে: তুমি প্লিজ এসো আমার জানি না কেনো আজকে খুব ইনসিকিউর লাগছে। আমার আজকে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মনে হলো কেউ যেনো আমাকে লক্ষ্য রাখছে। কৃষ্ণেন্দু প্লিজ আজকে চলে এসো তুমি। কৃষ্ণেন্দু অন্যন্যাকে বলে: সোনা তুমি আসলে অয়নকে নিয়ে টেনশন করছো। সেই জন্যই ভয় পাচ্ছো। আমি খুব চেষ্টা করছি চলে আসার আমার ও তোমাকে একা ছাড়তে মন চায় না। তুমি চিন্তা করো না। যা হবে আমি তোমাকে জানিয়ে দেবো। কৃষ্ণেন্দুর ফোন রাখার পরেই অন্যন্যার ফোনে একটা অজানা নম্বর থেকে ফোন আসে অন্যন্যা ফোন রিসিভ করলে উল্টো দিক থেকে একটা গম্ভীর গলা জানতে চায়: কে অন্যন্যা বলছো? অন্যন্যা উত্তর দেয়: বলছি। ওপাশ থেকে লোকটি বলে: আমি অয়নের বাবা বলছি। তোমার সাথে কিছু কথা আছে বলা যাবে কি? অন্যন্যা এক অদ্ভুত টেনশনের মধ্যে পড়ে যায়। তবু নিজের টেনশন কন্ট্রোল করে বলে: হ্যাঁ বলুন কি বলতে চান!! অয়নের বাবা বলেন: অয়ন গেছিলো তোমাদের বাড়িতে ক্ষমা চাইতে তুমি নাকি তাঁকে জানিয়ে দিয়েছো তুমি তার সাথে আর সংসার করতে চাও না। অন্যন্যা আমাদের পরিবারের একটা মানসন্মান আছে আমি চাই না তুমি সেটা কোর্ট পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাও। আমাদের পরিবারে এই ডিভোর্স এসব কিছু কখনো হয়নি। আমার ছেলের বেলায় ও আমি চাই না এসব হোক। ও যখন বলছে ও নিখিলেশের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবে না তোমার ফিরে আসতে কি সমস্যা হচ্ছে? অন্যন্যা দৃঢ় কন্ঠে জানায় অসুবিধা আছে। আমি আপনার ছেলের কথা বিশ্বাস করি না। যদি মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়েই যায় তাহলেই তো আর লোক জানবে না আর আপনাদের ও সন্মান হানি হবে না। তাছাড়া এতই যখন মানসম্মানের ভয় আপনাদের তখন ওরকম ছেলেকে বিয়ে দিলেন কেনো? যে কিনা অন্য করো কাছে কমিটেড। আমাকে ক্ষমা করবেন। অয়নের বাবা দ্বিগুণ কঠিন স্বরে বলে: খুব ভুল করছো অন্যন্যা। ক্ষমতা, অর্থ কোনো কিছুতেই আমাদের সাথে পেরে ওঠার ক্ষমতা তোমাদের নেই। এর দাম তোমায় দিতে হবে। তুমি ভুলে যেও না তুমি কার সাথে কথা বলছো!!! আমি ভুলিনি কিছু কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে একটা মেয়ে ফোন করে ভয় দেখানোর শাস্তি কি হতে পারে। দেশে আইন বলে একটা কথা এখনও আছে সে কথা আপনি ও ভুলে যাবেন না। অট্ট হাঁসিতে ফেটে পরে বিখ্যাত ডাক্তার ভাস্কর চৌধুরী। তারপর তীর্যক কণ্ঠে বলে: আইন? তুমি আমাকে আইন শেখাচ্ছো। আরে দুদিনের মেয়ে তুমি কতটুকুই বা জানো। আমাদের মতো পয়সা আর ক্ষমতাবান লোকেরা আইন কিনে নেয় টাকা দিয়ে। কিচ্ছু প্রমাণ করতে পারবে না তুমি কোর্টে গিয়ে। উল্টে আমি প্রমাণ করে দেবো তোমার আরে শুধু তোমার কেনো তোমার পুরো পরিবারের করো চরিত্রের ঠিক নেই। তোমরা বড়লোকদের এই ভাবে ফাঁসিয়ে পয়সা রোজগার করো। অন্যন্যা গর্জে ওঠে। ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে দেয় ভাস্কর চৌচুরী। অন্যন্যা তাড়াতাড়ি করে ঘুরিয়ে কৃষ্ণেন্দুকে ফোন করে কিন্তু বার বার চেষ্টার পরে ও কৃষ্ণেন্দু ফোন তোলে না। ও অন্যন্যাকে টেক্সট করে একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং চলছে আমি বেরিয়ে তোমাকে কল করছি। অন্যন্যা টেনশনে নিজের ডেস্কে বসে ঘামতে থাকে।
সন্ধ্যে তখন প্রায় সাতটা বেজে গেছে। কৃষ্ণেন্দু টেক্সট করে আমি আজকে আর অফিসে ঢুকছি না। কিছু ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাইন্ট আছে যাদের আমাকেই হ্যান্ডেল করতে হবে। তুমি আমার জন্য ওয়েট করো না। প্লিজ পাখি আজকের দিনটা একটু ম্যানেজ করে নাও। যদি তোমার বেশী ভয় লাগে বাসের জন্য অপেক্ষা করো না। ক্যাব নিয়ে বাড়ি চলে যাও। আর হ্যাঁ পৌঁছে আমাকে জানাতে ভুলে যেও না কিন্তু। এখন রাখছি। অন্যন্যা নিজের ডেস্কের চেয়ারে বসে ঘামতে থাকে। অন্যন্যাকে দেখে সমীর বললো: অন্যন্যা দি তুমি এতো ঘামছো কেনো? শরীর খারাপ লাগছে? অন্যন্যা বলে না আসলে তেমন কিছু না। আমি একটা ক্যাব বুক করেছি। আমাকে একটু এগিয়ে দিতে পারবি? হ্যাঁ চলো না আমি ও তো বেরোবো একসাথেই বেরোচ্ছি। অফিস থেকে বেরোনোর পর অন্যন্যার মনে হলো কেউ যেনো ওকে ফলো করছে। সমীর অন্যন্যাকে দেখে আবার বললো: অন্যন্যা দি তুমি কি কিছু নিয়ে ভয় পেয়ে আছো? তোমাকে এতো চিন্তিত কেনো লাগছে? অন্যন্যা ক্যাবের সামনে এসে বলে : না না তেমন কিছু না। তোকে অনেক ধন্যবাদ সমীর আমি আসি। সমীরকে বলে অন্যন্যা ক্যাবে উঠে যায়।