সমকামি – বাইশতম পর্ব
পরেরদিন সকালে অন্যন্যার ঘুম ভাঙ্গে একটু দেরীতে। তাড়াতাড়ি করে ঘুম থেকে উঠে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে কৃষ্ণেন্দু টেক্সট করেছে। “অনেক রাত জানি এখন তোমাকে লেখাটা হয়তো আমার ঠিক হচ্ছে না। আমার ব্যাবহারের জন্য আমি সত্যি দুঃখিত। আজকে সত্যি খুব চিন্তায় পড়ে গেছিলাম তোমাকে নিয়ে। এরকম আগে কখনো অনুভব করিনি আসলে অনুভব করার মতো কাউকে কখনো পাইনি আমি। জানি আমাকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন তোমার মনে। তোমার জীবনে নতুন কোনো ঝড় উঠুক সেটা আমি চাই না। আর কখনো তোমার সামনে সরাসরি না আসবার চেষ্টা করবো। তুমি ভালো থেকো। দূর থেকে সবসময় তোমার সাথে আছি। তুমি ভালো থেকো সেটাই চাই”। আর হ্যাঁ কালতো সানডে কথায় কথায় সেটা আমাদের কারোরই মনে নেই। কালকের দিনটা ভালো ভাবে কাটাও বিশ্রাম নাও। ভালো থেকো অন্যন্যা”।
তারপর থেকে অন্যন্যা অনেকবার চেষ্টা করেছে কৃষ্ণেন্দুকে ফোন করার জন্য। কিন্তু প্রত্যেকবারই ফোন সুইচ অফ পেয়েছে। কি করবে অন্যন্যা বুঝতে পারছে না। একবার ভাবছে ও নিজে তো চেয়েই ছিল যে কৃষ্ণেন্দুর থেকে সরে থাকতে। তাহলে কেনো যখন কৃষ্ণেন্দু নিজেই সরে যাচ্ছে তার জন্য ওর কষ্ট হচ্ছে কেনো চিন্তা হচ্ছে ওর জন্য। আবার ভাবছে যা হচ্ছে তা ভালোর জন্যই হচ্ছে। কিন্তু এই কথাটা ও নিজে কেনো বিশ্বাস করতে পারছে না। কালকে হয়তো ও একটু বেশী বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। কৃষ্ণেন্দুকে একটু বেশি অপমানিত করেছে ও যেটা ও একদম ঠিক কাজ করেনি। কিছু মাথায় আসছে না ওর কি করবে ও। দেখতে দেখতে বেলা প্রায় বারোটা বাজে। অন্যন্যা রান্না ঘরে আজ মায়ের সাথে হাতে হাতে কাজ করছে সারা সপ্তাহ মা একা সব সামলায়। হঠাৎ তিয়াসা এসে অন্যন্যার ফোনটা ওর হাতে দিয়ে বলে দিভাই কৃষ্ণেন্দু বলে কেউ একজন তোকে বার বার ফোন করছে। এই লোকটাই তোকে কালকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছিলো না? মাথা নাড়িয়ে তিয়াসার কথার সম্মতি জানায় অন্যন্যা। রিনা দেবী অন্যন্যাকে প্রশ্ন করে: কি ব্যাপার উনি তোকে এখন ফোন করছে যে? আজকে তো রবিবার অফিসের তো কোনো কাজ থেকে উচিত নয়। তাহলে কি দরকার?
অন্যন্যা মার দিকে তাঁকিয়ে বলে: ” তুমি এভাবে কেনো বলছো মা”? একজন মানুষ ফোন করছে তার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। উনি তো কোনো রাস্তার লোক নন। আমার অফিসের বস। কালকে উনি না থাকলে কি হতো মা ভাবতে পারছো? রিনা দেবী গম্ভীর হয়ে বললো: আমি সব বুঝতে পারছি। আমি কৃতজ্ঞ ওনার কাছে আমার মেয়েকে উনি অনেক সাহায্য করেছেন। উনি অফিসের বস বলেই আমি চাই সবটা অফিস পর্যন্তই থাক। আমরা যে সমাজে বাস করি সেখানে কিছু বাধ্য বাধকতা আছে আর সেটা মেনে চলাই ভালো। অন্যন্যা একটু রেগে গিয়ে বললো: মা তুমি কি বলতে চাইছো বলতো? কি এমন হলো যে তুমি এতগুলো কথা বলছো? একটা মানুষ ফোন করেছে এতে সমস্যাটা কোথায়? আর কোন সমাজের কথা বলছো যে সমাজে অয়ন আর ওর পরিবারের মতো লোকেরা ও বাস করে? আমি মানি না এই তোমাদের সো কল্ড সমাজকে। জীবনটা আমার তোমার সমাজের না। রিনা দেবী চিৎকার করে বলে: অনু!!! তুমি ভুলে যেও না তুমি তোমার মার সাথে কথা বলছো। আমি বলেছি এই লোকটার সাথে বেশি কথা না বলতে, বলবে না। একটা ভুল শোধরাতে গিয়ে আর ও একটা ভুল ডেকে আনতে আমি দেবো না। কোনো কথা আমি চাইছি না আর জানতে। অন্যন্যা আরো বিরক্ত হয়ে বললো: কিসের ভুল? কি হয়েছে মা? তুমি কেনো এমন করছো? তিয়াসা পিছন থেকে এসে অন্যন্যার কাঁধে হাত দিয়ে বলে: দিভাই তুই ঘরে যা গিয়ে কথা বলে নে। হয়তো কোনো দরকারে উনি ফোন করছেন। আমি মাকে সাহায্য করে দিচ্ছি। তুই তো জানিস মা রেগে গেলে কোনো কথা বুঝতে চায় না। তুই যা।
অন্যন্যা আর কথা না বাড়িয়ে ঘরে চলে যায়। তারপর কৃষ্ণেন্দুকে কল করে। ওপাশ থেকে ফোন ধরে কৃষ্ণেন্দু: হ্যালো কৃষ্ণেন্দু বলছি। অন্যন্যা চিৎকার করে উত্তর দেয়: আমি জানি যে তুমি কৃষ্ণেন্দুই বলছো। এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন গলার আওয়াজ আর কার হতে পারে। নাকি কালকের ঘটনার রিভেঞ্জ নিচ্ছিলে। কৃষ্ণেন্দু কিছু বলতে যাবে অন্যন্যা আবার বললো: ওতো রাতে একটা ওরকম টেক্সট করে দিলে তারপর সকাল থেকে এতবার ফোন করলাম ফোনটা অফ করে কেনো রেখেছিলে? কি ভাবছিলে তোমাকে না পেয়ে খুব চিন্তায় পড়ে যাবো? ভুল ভাবছো মিস্টার কৃষ্ণেন্দু। কৃষ্ণেন্দু জোড়ে হেঁসে ওঠে। অন্যন্যা আরো রেগে গিয়ে বলে: তোমাকে এতো হেঁসে ওঠার মতো কি বললাম আমি? কৃষ্ণেন্দু এবারও হেঁসে উঠে বলে: ইস্ তোমার এই রাগটা সামনে থেকে দেখতে পারলে আরো ভালো লাগতো। কতটা রেগে গেছো? কতোটা কান লাল হয়ে গেছে তোমার? কিছুই দেখতে পারলাম না। মিস করছি এই সবকিছু। কিন্তু একটা জিনিষ বুঝতে পারছি যে তোমার একদম চিন্তা হচ্ছে না আমার জন্য। কিন্তু অন্যন্যা কেনো হচ্ছে এমনটা? তুমি তো আমাকে পছন্দই করো না। অন্যন্যা বলে: এসব কথা রাখো!!!! কথার মারপ্যাঁচ করো না। ফোনটা কেনো ধরলে না আগে সেটা বলো?
এতো রেগে কেনো আছো সত্যি বুঝতে পারছি না। কাল রাতে ফোনটা নিজে থেকেই অফ হয়ে গেছিলো চার্জ ছিল না। অনেক রাতে ঘুমিয়েছি শরীরটা ও ভালো নেই জ্বর এসেছে উঠতে অনেক দেরী হয়ে গেলো। কাজের দিদি ও আসেনি। উঠে ফোন অন করতে তোমার ফোন এসেছিলো দেখলাম তাই জন্য কল ব্যাক করলাম। কিন্তু তুমি এতো কেনো রেগে গেলে বুজলাম না।
অন্যন্যা একটু ঝেঁঝিয়ে উত্তর দিলো জ্বর এসেছে সেটা লেখার দরকার ছিল না বাকি সব কথাই লিখেছো। তোমার আমাকে কি মনে হয়? আমি আদ্যোপান্ত একটা স্বার্থপর মানুষ তাই না? এই শোনো তোমার এতো কথা আমার ভালো লাগছে না আমাকে তোমার অ্যাড্রেসটা দাও। অবাক হয়ে কৃষ্ণেন্দু জানতে চায়: আমার অ্যাড্রেস কেনো কি হবে আমার অ্যাড্রেস দিয়ে? শোনো এতো চিন্তা করার কিছু নেই আমি ঠিক কিছু বানিয়ে নেবো। গতকালকে তোমার অনেক স্ট্রেস গেছে আবার আগামী কালকে অফিস আজকে রেস্ট নাও।
অন্যন্যা এবার আরো গম্ভীর হয়ে বললো: কৃষ্ণেন্দু তুমি আমার বস অফিসে। অফিসের বাইরে নয়। এতো কথা আমার ভালো লাগছে না। প্লিজ অ্যাড্রেসটা টেক্সট করো!!!! অন্যন্যা, শোনো অন্যন্যা প্লিজ ছেলে মানুষি করো না আমি ঠিক আছি আমি পারবো। অন্যন্যা আবার ও বলে: তুমি কি পাঠাবে? কৃষ্ণেন্দু এবার একটু চুপসে গিয়ে বলে: উফফ কি দস্যি মেয়ে দেখলে বোঝা যায় না। ঠিক আছে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। অন্যন্যা ফোন রেখে তাড়াতাড়ি তৃনাকে ফোন করে। ফোন ধরে ওপার থেকে তৃণা বলে: কি রে কালকে বাড়ি কখন পৌঁছালি? এতবার বললাম বাড়ি গিয়ে জানাতে ভুলিস না সেই করলি না। যাক্ আমি ও আর চাপ নিনি তোর বডি গার্ড সাথে ছিল। অন্যন্যা একটু গলা ঝাঁঝিয়ে বললো: এই তোর বাজে কথাগুলো থামা তো। শোন তোকে এখুনি এখানে আসতে হবে আমার বাড়িতে আর এসে বলতে হবে তোর খুব দরকার আমাকে তুই একটা কাজে নিয়ে যাবি। তাই তুই আমাকে নিতে এসেছিস। তৃণা অবাক হয়ে বলে: এখন ? আমি কিছু বুঝতে পারছিনা। মানে তুই যাবি কোথায়? বাড়িতে আজকে মানে। অন্যন্যা এবার সুর নরম করে বলে: প্লিজ তৃণা আজকে এই হেল্প টুকু কর আর কোনোদিন কিছু চাইবো না। আমি একা ও বেরোতে পারতাম কিন্তু মা এতো ঝামেলা করবে যে আমি বেরোতেই পারবো না। একমাত্র তুই পারবি আজকে আমাকে বাড়ি থেকে বের করতে। বাকি সব কথা দেখা হলে বলবো তুই প্লিজ আয় প্লিজ না করিস না। তৃণা একপ্রকার বাধ্য হয়ে বললো ঠিক আছে আসছি আমি। ফোন রেখে অন্যন্যা দেখলো কৃষ্ণেন্দু ও এড্রেসটা পাঠিয়ে দিয়েছে।
প্রায় আধা ঘন্টা পর তৃণা এলো অন্যন্যার বাড়িতে আর অন্যন্যার কথা মতোই সব বললো: বিকাশ বাবু রাজি হলে ও রিনা দেবী যেনো ঠিক রাজি না আজকে অন্যন্যার বাড়ি থেকে বেরোনোর ব্যাপারে। অনেক কষ্টে রিনা দেবীকে রাজি করিয়ে অন্যন্যা আর তৃণা বেরিয়ে গেলো। তারপর ক্যাব বুক করে সোজা কৃষ্ণেন্দুর বাড়ির পথ ধরলো!!!!!! গাড়িতে বসে এবার তৃণা অন্যন্যাকে বললো: ” এই অন্যন্যা কি ব্যাপার বলতো কোথায় যাচ্ছি আমরা? বাড়িতে সবাই খোঁচে গেছে। যাচ্ছি কোথায় আমরা”? অন্যন্যা সব খুলে বললো তৃনাকে। তৃণা অন্যন্যার কান ধরে মুলে দিয়ে বললো: রাধিকা প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই স্বীকার করবে না। শালা নিজে প্রেম করবে আর আমাকে এই একটা ছুটির দিনে ও টেনে বের করলি বাড়ি থেকে? তুই কি রে!!! কোথায় একা যাবি নৃভিতে নির্জনে কথা বলবি তা না আমাকে টেনে নিয়ে চললি? অন্যন্যা এবার বিরক্ত হয়ে বলে: এই তুই থামবি। কালকে উনি এতো ঝক্কি করে আমাদের পাশে ছিল তাই এটা শুধু কৃতজ্ঞতা। সবকিছুতে প্রেম খুঁজিস নাতো। কিন্তু জানিস তৃণা মা না কেমন যেনো একটা ব্যাবহার করছে। কালকে মানুষটাকে একবার ভীতরে যেতে বললো না। বাবা বললো খেয়ে যান কিন্তু মা চুপ। আজকে সকালে ও ফোন আসতে খুব রেগে গেলো আমার সাথে তর্ক লেগে গেলো। মা কেনো কৃষ্ণেন্দুকে পছন্দ করছে না বুঝতে পারছি না। মা তো ওকে কোনোদিন দেখেনি চেনে না তাহলে এত কেনো অপছন্দ ওকে? বুঝতে পারছিনা। কাল থেকে শুধু একটা কথাই বলছে অফিসের বস অফিস পর্যন্তই থাকবে। সেই জন্যই তোকে বিরক্ত করতে হলো। মা কিছুতেই আমাকে বেরোতে দিত না। তৃণা ব্যাঙ্গ করে বললো: তোমার মা বুঝতে পারছে লোকটা তার মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে মার চোখ তো। কিন্তু যেটা বুঝতে পারছে না সেটা হলো যে মেয়ে ও যে তার বসের প্রেমে পড়েছে। অন্যন্যা বিরক্ত হয়ে বলে: আবার সেই তোর প্রেম!!! তুই কি এটা ছাড়া কিছু ভাবতে পারছিস না?
অন্যন্যার গাল টিপে ধরে তৃণা বলে: মাই ডিয়ার অনু আমি সত্যি কথাই বলছি। হয় সেটা তুই বুঝে ও না বোঝার ভান করে অস্বীকার করতে চাইছিস অথবা নিজেই বুঝতে পারছিস না। কই বাত নেহি আগে আগে দেখো হোতা হ্যায় কেয়া? কিছুক্ষন পর ওরা এসে পৌঁছায় কৃষ্ণেন্দুর বাড়ির সামনে।