সত্যান্বেষী ০২
অতুল মিত্র আমার ঘরে আসিয়া বাস করিতে লাগিল। অনুকূলবাবুর কাছেও একটা বাড়তি তক্তপোষ ছিল, তিনি সেখানা অতুলের ব্যবহারের জন্য উপরে পাঠাইয়া দিলেন।
অতুল দিনের বেলায় বড় একটা বাসায় থাকিত না। সকালে উঠিয়া চাকরির সন্ধানে বাহির হইয়া যাইত, বেলা দশটা এগারোটার সময় ফিরিত; আবার স্নানাহারের পর বাহির হইত। কিন্তু যতটুকু সময় সে বাসায় থাকিত, তাহারই মধ্যে বাসার সকলের সঙ্গে বেশ সম্প্রীতি জমাইয়া তুলিয়াছিল। সন্ধ্যার পর খেলার মজলিসে তাহার ডাক পড়িত। কিন্তু সে তাস-পাশা খেলিতে জানিত না, তাই কিছুক্ষণ সেখানে বসিয়া আস্তে আস্তে নীচে নামিয়া গিয়া ডাক্তারের সহিত গল্প-গুজব করিত। আমার সঙ্গেও তাহার বেশ ভাব হইয়া গিয়াছিল। দু’জনের একই বয়স, তার উপর একই ঘরে ওঠা-বসা; সুতরাং আমাদের সম্বোধন ‘আপনি’ হইতে ‘তুমি’তে নামিতে বেশি বিলম্ব হয় নাই।
অতুল আসিবার পর হপ্তাখানেক বেশ নিরুপদ্রবে কাটিয়া গেল। তারপর মেসে নানা রকম বিচিত্র ব্যাপার ঘটিতে আরম্ভ করিল।
সন্ধ্যার পর অতুল ও আমি অনুকূলবাবুর ঘরে বসিয়া গল্প করিতেছিলাম। রোগীর ভিড় কমিয়া গিয়াছিল; দু’একজন মাঝে মাঝে আসিয়া রোগের বিবরণ বলিয়া ঔষধ লইয়া যাইতেছিল, অনুকূলবাবু আমাদের সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে ঔষধ দিতেছিলেন ও হাত-বাক্সে পয়সা তুলিয়া রাখিতেছিলেন। গতরাত্রিতে প্রায় আমাদের বাসার সম্মুখে একটা খুন হইয়া গিয়াছিল, আজ সকালে রাস্তার উপর লাস আবিষ্কৃত হইয়া একটু উত্তেজনার কারণ এই যে, লাস দেখিয়া লোকটাকে দরিদ্র শ্রেণীর ভাটিয়া বলিয়া মনে হইলেও তাহার কোমরের গেঁজের ভিতর হইতে একশ’ টাকার দশকেতা নোট পাওয়া গিয়াছিল। ডাক্তার বলিতেছিলেন–“এ কোকেন ছাড়া আর কিছু নয়। ভেবে দেখুন, টাকার লোভে যদি খুন করত, তাহলে ওর কোমলে হাজার টাকার নোত পাওয়া যেতো না–আমার মনে হয়, লোকটা কোকেনের খরিদ্দার ছিল; কোকেন কিনতে এসে কোকেন-ব্যবসায়ীরদের সম্বন্ধে কোনও মারাত্মক গুপ্তকথা জানতে পারে। হয়তো তাদের পুলিসের ভয় দেখায়ম blackmail করবার চেষ্টা করে। তার পরেই ব্যস,–খতম।”
অতুল হাসিয়া বলিল–“কে জানে মশায়, আমার তো ভারি ভয় করছে। আপনার এ পাড়ায় আছে কি করে? আমি যদি আগে জানতুম, তাহলে–”
ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন–“তাহলে ওড়িয়াদের আড্ডাতেই যেতেন? আমাদের কিন্তু ভয় করে না। আমি তো দশ-বারো বছর এ পাড়ায় আছি, কিন্তু কারুর কথায় থাকি না বলে কখনও হাঙ্গামায় পড়তে হয়নি।”
অতুল ফিস্ফিস্ করিয়া বলিল–“ডাক্তারবাবু, আপনি নিশ্চয় কিছু জানেন–না?”
হঠাৎ পিছনে খুট করিয়া একটা শব্দ শুনিয়া ফিরিয়া দেখি, আমাদের মেসের অশ্বিনীবাবু দরজার ফাঁকে মুখ বাড়াইয়া আমাদের কথা শুনিতেছেন। তাঁহার মুখের অস্বাভাবিক পাণ্ডুরতা দেখিয়া আমি সবিস্ময়ে বলিলাম–“কি হয়েছে অশ্বিনীবাবু? আপনি এ সময় নীচে যে?”
অশ্বিনীবাবু থতমত খাইয়া বলিলেন–“না, কিছু না–অমনি। এক পয়সার বিড়ি কিনতে–” বলিতে বলিতে তিনি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠিয়া গেলেন।
আমরা পরস্পর মুখ-তাকাতাকি করিলাম। পৌঢ় গম্ভীর-প্রকৃতি অশ্বিনীবাবুকে আমরা সকলেই শ্রদ্ধা করিতাম–তিনি হঠাৎ নিঃশব্দে নীচে নামিয়া আসিয়া আড়ি পাতিয়া আমাদের কথা শুনিতেছিলেন কেন?
রাত্রিতে আহারে বসিয়া জানিতে পারিলাম অশ্বিনীবাবু পূর্বেই খাওয়া-দাওয়া শেষ করিয়াছেন। আহারান্তে অভ্যাসমত একটু চুরুট শেষ করিয়া শয়নঘরে প্রবেশ করিয়া দেখি, অতুল মেঝের উপর একটা বালিশ ফেলিয়া শুইয়া আছে। একটু বিস্মিত হইলাম, কারণ, এমন কিছু গরম পড়ে নাই যে মেঝেয় শোয়া প্রয়োজন হইতে পারে। ঘর অন্ধকার ছিল, অতুলও কোনও সাড়া দিল না–তাই ভাবিলাম, সে ক্লান্ত হইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। আমার তখনও ঘুমের কোনও আগিদ ছিল না, কিন্তু আলো জ্বালিয়া পড়িতে বা লিখিতে বসিলে হয়তো অতুলের ঘুম ভাঙিয়া যাইবে, তাই খালি পায়ে ঘরের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ এইভাবে বেড়াইবার পর হঠাৎ মনে হইল, যাই অশ্বিনীবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসি, তাঁহার কোন অসুখ-বিসুখ করিয়াছে কি না। আমার দু’খানা ঘর পরেই অশ্বিনীবাবুর ঘর; গিয়া দেখিলাম, তাঁহার দরজা খোলা, বাহির হইতে ডাক দিয়া সাড়া পাওয়া গেল না। তখন কৌতুহলী হইয়া ঘরে ঢুকিলাম; দ্বারের পাশেই সুইচ ছিল, আলো জ্বালিয়া দেখিলাম ঘরে কেহ নাই। রাস্তার ধারের জানালাটা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিলাম, কিন্তু রাস্তাতেও তাঁহাকে দেখিতে পাইলাম না।
তাই তো! এত রাত্রে ভদ্রলোক কোথায় গেলেন? অকস্মাৎ মনে হইল–হয়তো ডাক্তারের নিকট ঔষধ লইতে গিয়াছেন। তাড়াতাড়ি নীচে নামিয়া গেলাম। ডাক্তারের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ। এত রাত্রে নিশ্চয় তিনি শুইয়া পড়িয়াছেন। বন্ধ দরজার সম্মুখে অনিশ্চিতভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়ে ফিরিয়া আসিতেছি, এমন সময় ঘরের ভিতর গলার শব্দ শুনিতে পাইলাম। অত্যন্ত উত্তেজিত চাপা কণ্ঠে অশ্বিনীবাবু কথা কহিতেছেন।
একবার লোভ হইল, কান পাতিয়া শুনি কি কথা। কিন্তু পরক্ষণেই সে ইচ্ছা দমন করিলাম–হয়তো অশ্বিনীবাবু কোনও রোগের কথা বলিতেছেন, আমার শোনা উচিত নয়। পা টিপিয়া টিপিয়া উপরে ফিরিয়া আসিলাম।
ঘরে আসিয়া দেখিলাম, অতুল পূর্ববৎ মেঝের উপর শুইয়া আছে, আমাকে দেখিয়া ঘাড় তুলিয়া বলিল–“কি অশ্বিনীবাবু ঘরে নেই?”
বিস্মিত হইয়া বলিলাম–“না। তুমি জেগে ছিলে?”
“হ্যাঁ। অশ্বিনীবাবু নীচে ডাক্তারের ঘরে আছেন।”
“তুমি জানলে কি করে?”
“কি করে জানলুম, যদি দেখতে চাও, এই বালিশে কান পেতে মাটিতে শোও।”
“কি হে, মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?”
“মাথা ঠিক আছে। শুয়েই দেখ না।”
কৌতুহলের বশবর্তী হইয়া অতুলের মাথার পাশে মাথা রাখিয়া শুইলাম। কিছুক্ষণ স্থির হইয়া থাকিবার পর অস্পষ্ট কথাবার্তার শব্দ কানে আসিতে লাগিল। তারপর পরিস্কার শুনিতে পাইলাম, অনুকূলবাবু বলিতেছেন–“আপনি বড় উত্তেজিত হয়েছেন। ওটা আপনার দৃষ্টি-বিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়। ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে অমন হয়। আমি ওষুধ দিচ্ছি, খেয়ে শুয়ে পড়ুন গিয়ে। কাল সকালে উঠে যদি আপনার ঐ বিশ্বাস থাকে, তখন যা হয় করবেন।”
উত্তরে অশ্বিনীবাবু কি বলিলেন, ধরা গেল না। চেয়ার টানার শব্দে বুঝিলাম, দু’জনে উঠিয়া পড়িলেন।
আমি ভূ-শয্যা ছাড়িয়া উঠিয়া বসিলাম, বলিলাম–“ডাক্তারের ঘরটা যে আমাদের ঘরের নীচেই, তা মনে ছিল না। কিন্তু কি ব্যাপার বল তো? অশ্বিনীবাবুর হয়েছে কি?”
অতুল হাই তুলিয়া বলিল,–“ভগবান জানেন। রাত হল, এবার বিছানায় উঠে শুয়ে পড়া যাক।”
আমি সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম–“তুমি মাটিতে শুয়েছিলে কেন?”
অতুল বলল–“সমস্ত দিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, মেঝেটা বেশ ঠাণ্ডা বোধ হল, তাই শুয়ে পড়লুম। ঘুমও একটু এসেছিল, এমন সময় ওঁদের কথাবার্তায় চটকা ভেঙে গেল।”
সিঁড়িতে অশ্বিনীবাবুর পায়ের শব্দ শুনিতে পাইলাম। তিনি নিজের ঘরে ঢুকিয়ে সশব্দে দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন।
ঘড়িতে দেখিলাম, রাত্রি প্রায় এগারোটা বাজে। অতুল শুইয়া পড়িয়াছিল, মেসও একেবারে নিশুতি হইয়া গিয়াছি। আমি বিছানায় শুইয়া অশ্বিনীবাবুর কথাই ভাবিতে ভাবিতে ঘুমাইয়া পড়িলাম।
সকালে অতুলের ঠেলা খাইয়া ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলাম। বেলা সাতটা বাজিয়াছে। অতুল বলিল–“ওহে, ওঠ ওঠ; গতিক ভাল ঠেকছে না।”
“কেন? কি হয়েছে?”
“অশ্বিনীবাবু ঘরের দরজা খুলছেন না। ডাকাডাকিতে সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে না।”
“কি হয়েছে তাঁর?”
“তা বলা যায় না। তুমি এস”–বলিয়া সে ঘর হইতে তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া গেল।
আমিও তাহার পশ্চাতে বাহিরে আসিয়া দেখিলাম, অশ্বিনীবাবুর দরজার সম্মুখে সকলেই উপস্থিত আছেন। উৎকণ্ঠিত জল্পনা ও দ্বার ঠেলাঠেলি চলিতেছে। নীচে হইতে অনুকূলবাবুও আসিয়াছেন। দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা ক্রমেই বাড়িয়াই চলিল, কারণ, অশ্বিনীবাবু এত বেলা পর্যন্ত কখনও ঘুমান না। তা ছাড়া, যদি ঘুমাইয়া পড়িয়াই থাকেন, তবে এত হাঁকডাকেও জাগিতেছেন না কেন?
অতুল অনুকূলবাবুর নিকটে গিয়া বলিল–“দেখুন, দরজা ভেঙে ফেলা যাক। আমার তো ভাল বোধ হচ্ছে না।”
অনুকূলবাবু বলিলেন–“হ্যাঁ, হ্যাঁ, স আর বল্তে! ভদ্রলোক হয়তো মূর্ছিত হয়ে পড়ে আছেন, নইলে জবাব দিচ্ছেন না কেন? আর দেরি নয়, অতুলবাবু, দরজা ভেঙে ফেলুন।”
দেড় ইঞ্চি পুরু কাঠের দরজা, তাহার উপর ইয়েল্-লক্ লাগানো। কিন্তু অতুল এবং আরও দুই-তিনজন একসঙ্গে সজোরে ধাক্কা দিতেই বিলাতি তালা ভাঙিয়া ঝন্ ঝন্ শব্দে দরজা খুলিয়া গেল। তখন মুক্ত দ্বারপথে যে-বস্তুটি সকলের দৃষ্টিগোচর হইল তাহা দেখিয়া বিস্ময়ে ভয়ে কাহারও ম্যখে কথা ফুটিল না। স্তম্ভিত হইয়া সকলে দেখিলাম, ঠিক দরজার সম্মুখেই অশ্বিনীবাবু উর্দ্ধমুখ হইয়া পড়িয়া আছেন–তাঁহার গলা এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত কাটা। মাথা ও ঘাড়ের নীচে পুরু হইয়া রক্ত জমিয়ে যেন একটা লাল মখমলের গালিচা বিছাইয়া দিয়াছে। আর, তাঁহার প্রক্ষিপ্ত প্রসারিত দক্ষিণ হস্তে একটা রক্ত-মাখানো খুর-তখনও যেন জিঘাংসাভরে হাসিতেছে। নিশ্চল জড়পিণ্ডবৎ আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলাম। তারপর অতুল ও ডাক্তার একসঙ্গে ঘরে ঢুকিলেন। ডাক্তার বিহ্বলভাবে অশ্বিনীবাবুর বীভৎস মৃতদেহের প্রতি তাকাইয়া থাকিয়া কম্পিত স্বরে কহিলেন,–“কি ভয়ানক, শেষ অশ্বিনীবাবু আত্মহত্যা করলেন!”
অতুলের দৃষ্টি কিন্তু মৃতদেহের দিকে ছিল না। তাহার দুই চক্ষু তলোয়ারের ফলার মত ঘরের চারিদিকে ইতস্তত ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। সে একবার বিছানাটা দেখিল, রাস্তার ধারের খোলা জানালা দিয়া উঁকি মারিল, তারপর ফিরিয়া শান্তকণ্ঠে বলিল–“আত্মহত্যা নয়, ডাক্তারবাবু, এ খুন, নৃশংস নরহত্যা। আমি পুলিস ডাকতে চললুম–আপনারা কেউ কোন জিনিস ছোঁবেন না।”
অনুকূলবাবু বলিলেন–“বলেন কি, অতুলবাবু–খুন! কিন্তু দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল–তা ছাড়া ওটা–” বলিয়া অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া মৃতের হস্তে রক্তাক্ত ক্ষুরটা দেখাইলেন। অতুল মাথা নাড়িয়া বলিল–“তা হোক্, তবু এ খুন! আপনারা থাকুন–আমি এখনই পুলিস ডেকে আনছি।”–সে দ্রুতপদে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।
ডাক্তারবাবু কপালে হাত দিয়া সেইখানে বসিয়া পড়িলেন, বলিলেন–“উঃ, শেষে আমার বাসাতে এই ব্যাপার হল!”