Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu » Page 6

শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu

জুন মাসের দুপুরবেলা। গরমের ছুটির পর সবে স্কুল খুলেছে। রূপ স্কুলে চলে গেছে। বন্দনা তার ঘরের কাজ সারছে। জানলা-দরজায় ধুলো পড়ে, রোজ না ঝাড়লে গরাদে হাত দেওয়া যায় না। আসবাবপত্রের ওপরেও এখন পাতলা ধুলোর সর। রূপের টেবিল এলোমেলো হয়ে থাকে। রঙের প্যালেট, জলের মধ্যে রঙগোলা, তুলি ডোবানো। বই, খাতাপত্তর যেগুলো সেদিনের রুটিন অনুযায়ী নিয়ে গেছে, গেছে। কিন্তু বাকি সব উল্টোপাল্টা। এই সময়ে সব কিছু গুছিয়ে ঝেড়ে-ঝুড়ে ঝকঝকে করে তোলবার কাজটা পরিপাটি করে করবে এই সংকল্প তার।

ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। খোলাই আছে। মোটা পর্দার আড়াল। ননদেরা পর্দা ঠেলে ঢুকে আসে, শাশুড়িরাও তাই। তাহলে হয়ত ছোট দেওর। কেন? দরজার কাছে গিয়ে বন্দনা দেখল শ্বশুরমশাই। খুব অন্যমনস্ক ছিল নিশ্চয়ই নয়ত খড়মের শব্দ শুনতে পেত, খোলা দালানের পথে অনেক দূর থেকেই।

‘আসুন বাবা, ভেতরে আসুন’— মাথার কাপড় টেনে বন্দনা বলল। কাশীনাথবাবু বললেন—‘যোগীন্দর অ্যান্ড যোগীন্দর প্রভিডেন্ট ফান্ড-এর কাগজপত্রগুলো সব পাঠিয়েছে। এবার টাকাকড়িগুলো সব পাওয়া যাবে। খোকা তোমাকে আর তোমার মাকে জয়েন্ট নমিনি করেছে দেখছি। দুজনেরই ফিফটি-ফিফটি শেয়ার। টাকাটা আনতে তোমাকেই যেতে হবে মা, খোকার কিছু বকেয়া পাওনাও আছে। আমি নিজে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাব। কাল সুবিধে হবে?’

—‘ক’দিন পরে গেলে হয় না?’ বন্দনা থতমত খেয়ে বলল। সে এতদিন বাইরে বেরোয়নি, মানুষজনের মুখ না দেখে কাটিয়েছে যে হঠাৎ বাইরে বেরোবার প্রস্তাবে সে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। আরও সঙ্কোচ অভিমন্যুর অফিসে যেতে। অফিসের বার্ষিক উৎসবে রানীর মতন সেজেগুজে গেছে। গান, নাটক, স্পোর্টস হত সব শ্রেণীর কর্মচারীদের স্ত্রী ছেলেমেয়েদের জন্য। কত পার্টিতে অভিমন্যুর সমপর্যায়ের এবং আরও উচ্চপদস্থ অফিসারদের সঙ্গে আলাপ করেছে। তার নরম অথচ সপ্রতিভ ব্যক্তিত্বের জন্য বিশেষ জনপ্রিয় ছিল সে অভিমন্যুদের অফিসের এই সব নানাবিধ উৎসবে অনুষ্ঠানে। সেখানে এই অনাথিনী, ভিখারিনীর বেশে স্বামীর পাওনা টাকার ভিক্ষা হাত পেতে নেবার জন্য যেতে হবে ভেবে শিউরোচ্ছিল সে। খবরটাও একদম হঠাৎ। প্রস্তুতি ছাড়া, নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে না নিয়ে সে পারবে না, পারবেই না।

কাশীনাথবাবু গম্ভীর গলায় বললেন—‘দেরি না করাই ভালো। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেল। অমনি একেবারে ব্যাঙ্কের কাজটাও সেরে আসব।’

বন্দনা চেয়ে আছে দেখে একটু ইতস্তত করে থেমে থেমে বললেন—‘মোট পঞ্চাশ হাজারের মতো টাকা, আমি বলছিলাম কি সবটাই একসঙ্গে আমার অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে রাখি। কি বলো?’

বন্দনা হঠাৎ আতঙ্কে স্থির হয়ে গেল। ইনি বলছেন কি? আজ এক বছরেরও বেশি সময় হল একটা পয়সারও মুখ দেখেনি সে। কিছুদিন আগে এল আই সি’র দরুন হাজার তিরিশেক টাকা পাওয়া গিয়েছিল। অভিমন্যু লাইফ ইনসিওর করাতে চাইত না। কেমন একটা বিরাগ ছিল ওর ব্যাপারটার ওপর। বলত—‘কমপালসারি সেভিং-এর আমার দরকারটা কি? আমি কি অসংযমী, না বদখেয়ালি? তাছাড়া আমি চিরকাল বেঁচে থাকব। শুধু শুধু কতকগুলো টাকা প্রিমিয়াম গুনতে আমার বয়ে গেছে।’ এক এজেন্ট বন্ধু অনেক বলে কয়ে, অনেক কাঁদুনি গেয়ে ওইটুকু করিয়েছিল। রূপ তার নমিনি ছিল। সে নাবালক বলে তার অভিভাবক হিসেবে ঠাকুর্দাদা সে টাকা তুলেছেন, বন্দনাকে তার বিলি-ব্যবস্থার কথা কিছু জিজ্ঞেস করেননি। অভিমন্যুর সব সঞ্চয় তার বাবার সঙ্গে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে থাকত। সেসবের খবরও সে কিছু রাখে না। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে একটি পয়সারও মুখ দেখেনি। অবশ্য তার দরকারই বা কি? কিন্তু স্বামী সব সময়ে তার হাতে কিছু টাকা রাখত। বলত—‘নিজেকে পরাধীন-টিন ভেবো না যেন, এটা তোমার একদম নিজস্ব। নিজের ইচ্ছেমতো খরচ করবে।’ মাসের শেষে হিসেব দিতে গেলে অভিমন্যু নানা উপায়ে মুখ বন্ধ করে দিত। সেই টাকা দিয়ে বন্দনা ননদদের সিনেমা দেখিয়েছে, রেস্তোরাঁয় খাইয়েছে, দেওরদের প্রতি শীতে নতুন নতুন সোয়েটার বুনে দিয়েছে। শাশুড়িদের স্কার্ফ; ননদদের কার্ডিগ্যান। স্বামীকে পুল-ওভার, স্লিপ-ওভার, হাতওয়ালা কার্ডিগ্যান, ছোট হাতা টি শার্ট। জন্মদিনে উপহার দিয়েছে সবাইকে। ইচ্ছে করলে তার থেকেও সঞ্চয় করতে পারত, করেনি, দুহাতে বিলিয়ে দিয়েছে। দেওয়াতে তার বরাবরই ভীষণ আনন্দ। আর বাপের বাড়ির তো কথাই নেই। বাবা-কাকা তো সংসার-খরচের টাকা সব তার হাতেই রাখতেন। অল্পবয়স থেকেই পয়সা-কড়ির মাসিক হিসেব করে চলা তার অভ্যাস। শূন্য হাতে কেমন অসহায় লাগে।

উত্তর দেবার সময়ে বন্দনা নিজের গলার স্বর নিজেই চিনতে পারল না। —‘না, বাবা।’

কাশীনাথবাবু প্রতিক্রিয়া একটু দেরিতে এল। কেমন খসখসে স্বর, গলাটা যেন হঠাৎই বসে গেছে। কেটে কেটে বললেন—‘কি না! আমার অ্যাকাউন্টে টাকা রাখবে না? বেশ, তুমি যদি মনে করো তোমার আলাদা অ্যাকাউন্ট দরকার, তো তাই হবে।’

ফেরবার সময়ে তাঁর খড়মের শব্দ বন্দনার কানে বাজতে লাগল। সিঁড়ি দিয়ে তিনি নেমে যেতেই মনটা ব্যাখ্যার অতীত গ্লানিতে ভরে গেল। যেন সারা শরীরে তার কাদা লেগে গেছে। কেন যে নিজেকে এতো ক্লিন্ন লাগল সে ভেবে পেল না। টাকাকড়ির বিষয়ে কোনদিন ভাবতে হয়নি, কোনও মতামত দিতে হয়নি। অভিমন্যু কোনদিন তার সঙ্গে আলোচনা করেনি তার টাকা নিয়ে সে কি করবে। একটা সাজানো যৌথ পরিবারের চৌখুপি কাটা ছকে সে যেন একটা ঘুঁটির মতো এসে বসে গিয়েছিল। তার জন্য কোনও নিয়ম বদলাবার দরকার হয়নি, কোনও ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি, বাড়িতে ন’জন সদস্যের জায়গায় দশজন হয়েছিল এই পর্যন্ত। বন্দনা কোথাও এতটুকু ভার হয়নি। সকলকে সে তারা যেমন তেমনিভাবেই মেনে নিয়েছিল। অভিমন্যু শুধু তার জন্য কিছু মাসিক হাত-খরচ বরাদ্দ করেছিল। কথায় কথায় বাবার সঙ্গে তার জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের কথা সে জানতে পেরেছিল। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর সবচেয়ে কৃতী সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন ছেলে সংসারের দেখাশোনা করবে, তাই এই ব্যবস্থা। অন্যরকম কিছু যে হতে পারে সে সম্ভাবনার কথা কি কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিল। প্রভিডেন্ট ফান্ড, এল আই সি’র নমিনি সে কাকে করল, কাকে অভিভাবক রাখল রূপের, এত সব সংবাদ বন্দনার সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। ছ বছরের বিবাহিত জীবনে তাদের সম্পর্কটা ছিল হাসি আনন্দ আহ্লাদের, বিশেষ করে অভিমন্যু তার থেকে এগার বছরের বড় হওয়ায়, বন্দনার নির্ভরশীলতা ও সমর্পণ ছিল একেবারে প্রশ্নহীন।

সেই স্বামী দু ঘণ্টার মধ্যে তাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেল এখন সে তার রেখে-যাওয়া টাকাকড়ির বিষয়ে কথা বলছে, নিজস্ব মতামত দিচ্ছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে—এই পরিস্থিতিটা বন্দনার সমস্ত অস্তিত্বকে যেন টেনে কাদা-মাটির মধ্যে ফেলে দিল। সে বাতাসে বিচরণ করত, এখন পচা ডোবায় পড়ে কোনমতে কাদা ঠেলে ওঠবার চেষ্টা করছে। অনুভূতিটা এইরকম। শ্বশুরমশাই স্পষ্টই ক্ষুণ্ণ হয়েছেন। সে যেন সূক্ষ্মভাবে বয়স্ক মানুষটিকে অপমান করল। অভিমন্যুর অবর্তমানে সে তার বাবার ওপর নির্ভর করতে পারছে না, যদিও অভিমন্যু তার টাকা-পয়সাঘটিত ব্যবস্থাদির মধ্যে দিয়ে নিজের বাবার ওপর তার নির্ভরতা তার বিশ্বাস বারবার প্রকাশ করে গেছে। অভিমন্যু পেরেছিল, বন্দনা পারছে না। এই খবরটা আজকের ছোট্ট সংলাপটুকুর মধ্যে দিয়ে ফাঁস হয়ে গেল। যা গোপন থাকলে ভালো হত, তা চাউর হয়ে গেল। সমস্ত ব্যাপারটার স্থূলতা, নগ্নতা বন্দনাকে লজ্জায় আপাদমস্তক এমনি মলিন করতে থাকল যে শ্বশুরমশাইনেমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে সে দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে দিয়ে রূপের চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে কেঁদে ফেলল। কাঁদল কতদিন পর! এত কান্না কেঁদেছে যে মনে হয়েছিল চোখের জল বুঝি সব ফুরিয়ে গেছে। শরীরটাকে নিংড়োলেও আর জল বেরোবে না। কিন্তু চোখের জল কতরকমের হয়, সবই তো শুধু শোকের নয়! সেই বহুবিধ চোখের জলের সঙ্গে তার পরিচয় করাবে বলেই তার জীবন যেন ভূমিকা হিসেবে জুন মাসের এই রোদ- ঝনঝনে সকালবেলাটাকে বেছে নিয়েছে।

ড্রয়ার থেকে চিঠি লেখার প্যাড বার করল বন্দনা। এ তার গায়ে হলুদের তত্ত্বের গোলাপি ফুলছাপ লেটার প্যাড। ব্যবহার করার দরকার হয়নি। তাদের জীবনে বিরহ বিশেষ ছিল না। বন্দনার এমন কোনও অন্তরঙ্গ সখীও ছিল না যাকে গোলাপি লেটার প্যাডে চিঠি দেওয়া যায়। কিন্তু এই ছাড়া আপাতত কিছু নেই। এতেই লিখতে হবে। তারপর খামের জন্য শাশুড়ির কাছে যেতে হবে। তিনি বলবেন—‘কাকে চিঠি লিখলে বউমা?’ এমনিই জিজ্ঞেস করবেন। অতিসাধারণ মেয়েলি কৌতূহল। তবু ভালো লাগে না।

বন্দনা অনিচ্ছার সঙ্গে বলবে—‘কাকাকে।’

—‘বে-ই মশায়ের চিঠি আজকালের মধ্যে এসেছে বুঝি? কই দেখিনি তো? উনি তো বলেননি?’

যেন কাকা সম্প্রতি চিঠি দিয়ে না থাকলে বন্দনা একটা অতিরিক্ত চিঠি তাঁকে দিতে পারে না।

কাকাকে চিঠি দিয়ে অবশ্য খুব যে একটা লাভ আছে, তা-ও নয়। প্রথম মুশকিল চিঠি কাকার কাছে পৌঁছবে কি না। কখন যে কোথায় থাকেন? বছর দেড়েক হল সরকারি চাকরি থেকে আগেভাগে অবসর নিয়ে নিয়েছেন। দাদা অর্থাৎ বন্দনার বাবা মারা যাবার পর থেকেই উড়ু-উড়ু করছিলেন। রিটায়ার করার পর যেন পাখা গজালো। হিমালয়ের নেশা চিরদিনই ছিল। এখন আর কাকাকে বাড়িতে পাওয়া যায় না। অভিমন্যুর মৃত্যু সংবাদও তাঁর কাছে পৌঁছেছিল অনেক দেরিতে। খবর পেয়েও আসেননি। শুধু শ্বশুরমশাইকে একটা চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন বুড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো মনের জোর তাঁর নেই। কাশীনাথবাবু স্বয়ংই বুড়ির দ্বিতীয় পিতা। এই অকল্পনীয় বিপর্যয়ে তিনিই যেন বুড়িমাকে কোলে তুলে নেন।

নানান জায়গা থেকে এখন কাকার চিঠি আসে, হরিদ্বার, কাঠগুদাম, আলমোড়া, রিলকোট, মিলাম। তাতে কোনও সান্ত্বনার ভাষা থাকে না, কোনও ব্যক্তিগত কথাই না। খালি হিমালয় আর হিমালয়। বন্দনা ড্রয়ার থেকে কাকার শেষ চিঠিটা বার করে খুলল। উত্তর দেওয়া হয়নি এ চিঠির। বেশির ভাগেরই জবাব বন্দনা দেয় না। কিন্তু সে জবাব দিক না দিক, কাকার চিঠি নিয়মিত এসে যায়। কাকা লিখেছেন:

বুড়িমা,

এমন একটি আকাশের তলায় দাঁড়াইয়া আছি, যেখানে সভ্যতার ধোঁয়া-কালি পৌঁছয় না। আকাশই যে আদিমাতা, আকাশই যে সেই বহুকথিত ফার্স্ট প্রিন্সিপল, তাহা বুড়িমা এইস্থানে দাঁড়াইয়া তোমার ঠিকই উপলব্ধি হইবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ হইতে এগারহাজার ফুট উচ্চে আছি। বাতাস একটু পাতলা। ধীরে ধীরে অভ্যাস হইয়া যাইবে। কোথাও তৃণাদি গুল্ম অবধি লক্ষিত হইতেছে না। কিন্তু সামান্য দূরে (যদিও প্রকৃতপক্ষে বহু দূর) অপরূপা কাঞ্চনজঙ্ঘা একদিকে এবং মহিমময় এভারেস্ট আরেক দিকে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। দেখিতে দেখিতে কুয়াশার আড়ালে চলিয়া যাইতেছে, আবার সূর্য কিরণে হাসিয়া উঠিতেছে। কাঠের নির্জন, আক্ষরিক অর্থে জনহীন বাংলোয় কাচের মধ্য হইতে এই অলৌকিক দৃশ্য দেখিতেছি, এ যে কি অতীন্দ্রিয়ানুভূতি সৃষ্টি করে, আমি সামান্য মানুষ ভাষায় প্রকাশ করিতে পারি এ ক্ষমতা নাই। যেন স্বর্গের দ্বার আমার সম্মুখে উন্মুক্ত। এই তুষার, এই পর্বতপৃষ্ঠ ওই দূর-দৃষ্ট শৃঙ্গগুলি ইহারাই স্বর্গের পথের প্রথম সোপান ইহাতে সন্দেহ নাই। শুধু সৌন্দর্য ও নির্মলতার কারণে নয়। এই পীঠের উপর পা রাখিয়া দেখিতেছি পৃথিবীতে ক্রোধ নাই, লোভ নাই, মাৎসর্য নাই, শোক দুঃখ কিছু নাই, শুধু অখণ্ড শান্তি ও আনন্দ, আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। এই আনন্দ বাহিরে, এই আনন্দ অন্তরে, ইহা জীবন এবং অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ। দাঙ্গা হাঙ্গামা করিয়া যে নিষ্ঠুর ব্যক্তিগুলি সাম্প্রতিক কালে অগণিত মানুষ খুন করিয়াছে, তাহাদেরও যদি সূর্যোদয়ের সময়ে সুবর্ণ জ্যোৎস্নাময় কাঞ্চনজঙ্ঘা ও এভারেস্ট গিরিশৃঙ্গ দেখানো যাইত তাহারাও ইহা উপলব্ধি করিত। মা আমি কবিত্ব করিতেছি না, দর্শনতত্ত্বও লিখিতে বসি নাই। কবি অথবা ঋষি করিয়া ঈশ্বর আমাকে পাঠান নাই। কিন্তু আমার নিশ্চিত বিশ্বাস মানব-জন্ম দুঃখের জন্য, বিষাদের জন্য, হত্যা-হানাহানি-ঈর্ষা-বিদ্বেষ-জড়ত্বের জন্য সৃষ্টি হয় নাই। অনন্ত সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করিব বলিয়া অনন্তমাধুর্য আস্বাদন করিব বলিয়া, অনন্ত আনন্দ হইব বলিয়া মনুষ্য হইয়াছি। শুধু আমি নহে, পৃথিবীতে যতেক পৃথক দেহযন্ত্রে এক আমি-স্রোত প্রবাহিত হইতেছে, সেই প্রত্যেক স্বতন্ত্র দেহাশ্রিত ‘আমি’ আনন্দ লাভ করিবে। করিবেই। মনুষ্যের শেষ পুরস্কার ইহাই।’

আশীর্বাদক কাকা।

সান্ত্বনা নেই। তবু বারবার উল্টেপাল্টে চিঠিটা পড়ল বন্দনা। কাকার হাত ধরে দেশবন্ধু পার্কে গান্ধীজীর বক্তৃতা শুনতে যাওয়া। চিড়িয়াখানায় হাতির শুঁড়ে পয়সা দেওয়া, জিরাফ দেখা, কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে এসপ্লানেড পর্যন্ত এসে পড়া শীতের রবিবারের সকালে। খুব কড়া সিগারেট খেতেন কাকা, ডান হাতের আঙুলগুলো নিকোটিনে হলুদ হয়ে থাকত। বন্দনা যখন ছোট্ট ছিল ওর ধারণা ছিল কাকা মাত্রেরই আঙুলের ডগা ওরকম তামাটে হলুদ হয়ে থাকে। কাকাত্বের এটা একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মা যখন অল্প বয়সে মারা গেলেন তখনই কাকা ঠিক করে ফেলেছিলেন সংসার করবেন না। বাবা বহুবার চেষ্টা করেছেন। কাকার সেই এক কথা—‘যা দুরন্ত মেয়ে দাদা, তোমার একার কর্ম নয়। এ মেয়েকে মানুষ করতে হলে আমায় হাল ধরতে হবে।’ বাবার কাছে রাত, কাকার কাছে দিন। লেখাপড়া গান বাজনা সবই কাকার উৎসাহে। নয়তো বাবা মায়ের মৃত্যুর পর ভীষণ মনমরা হয়ে গিয়েছিলেন। সেই কাকার অপরাজিত চিরকুমার স্নেহময় ব্যক্তিত্বটি যেন চিঠিগুলোর মধ্যে থেকে বন্দনার হাত ধরবার জন্য উঠে আসে। সে ড্রয়ার হাঁটকায় কাকার আরও চিঠির জন্য। সাদা বণ্ড পেপারে সারি সারি পিঁপড়ের শ্রেণীর মতো লেখা। একটা লাইনও একটু বেঁকে যায় না। শুদ্ধ ভাষার বাঁধুনি কোথাও আলগা নেই। অক্ষরগুলো সামান্য কুঁকড়োনো। সই করবেন সব সময়ে এক লাইনে ‘আশীর্বাদক কাকা।’ ‘বুড়িমা,

কালামুনি গিরিপথের অভিমুখে চলিয়াছি। এ জায়গাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ হইতে সাত হাজার একানব্বুই ফুটের মতো উঁচু। সবুজে সবুজ। দুটি ছোট ছোট ঝর্ণাধারা। এই উপত্যকার ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’ আরও আরও প্রাণের আশ্বাস লইয়া বহিতেছে। চারিদিকে যেদিকেই চাহি রক্তবর্ণ রডোডেনড্রন গুচ্ছ। এপ্রিল হইতে জুলাই অবধি ইহারা ক্রমাগত ফুটিতে থাকিবে। শীতের বরফ গলিবার সঙ্গে সঙ্গে পাথরের খাঁজে মাথা চাড়া দেয় সবুজ তৃণগুচ্ছ। সরলসুন্দর মানবশিশুর সহিত ইহাদের আমি তফাত করিতে পারি না। ভেড়া এবং ছাগলেরা তখন নির্ভয়ে চরিবে। তাহাদের পাহারা দিবে বড় বড় পাহাড়ি কুকুর। হঠাৎ-হঠাৎ যেন মনে হয় সেই অতীত যুগে ফিরিয়া গিয়াছি যখন মানুষ পশুপালক ছিল, কৃষিকাজ শেখে নাই। গৃহপালিত পশুর দল লইয়া দেশ হইতে দেশান্তরে সবুজের সন্ধানে ঘুরিয়া বেড়াইত। সঞ্চয় করিত না। প্রকৃতির দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করিত। এবং পশুর সহিত গায়ে গা লাগাইয়া বসবাস করিত। জটিলতাহীন সে জীবন তো ভালোই ছিল! উচ্চ হিমালয়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামের অধিবাসীরা এখনও আদিমানবের জীবনযাপন করে। মাতৌলি, মাপা, বরফু—সঙ্গীতময় নামগুলি গ্রামের। নভেম্বর হইতে প্রায় মে মাস পর্যন্ত ইহারা নিম্ন হিমালয়ে অস্থায়ী বাসস্থান প্রস্তুত করিয়া বাস করে, গ্রীষ্মে পথ তুষার মুক্ত হইলেই ঢালু পাহাড়ের বিস্তীর্ণ তৃণাঞ্চল বা বুগিয়াল বাহিয়া ইহারা বকরি চরাইতে চরাইতে চলিবে, ক্রমাগত উপরে উঠিয়া যাইবে। সবুজ ঘাস এবং গোলাপি ফুলের দেশে। ইহারা এ অঞ্চলের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য পথপ্রদর্শক। আমার কোনও গিরিশৃঙ্গ জয় করিবার স্বপ্ন নাই। দূর হইতে দেখিয়াছি ত্রিশূলীর মুকুট হইতে দিব্য স্বর্ণ ঝরিয়া পড়িতেছে। গায়ে গা লাগাইয়া পরম মিত্রের মতো দণ্ডায়মান হরদেওল। ওই গিরিশিরায় জমাট ঝুলন্ত তুষার দ্বিপ্রহরে প্রলয়ঙ্কর নির্ঘোষে ভাঙিয়া পড়িত। কুয়াশায় চতুর্দিক ঢাকিয়া যাইত, চলিতে থাকিত ঝড়ো বাতাস। পৃথিবীর আদিম চরিত্র যদি দেখিয়া লইতে চাও, তাহা হইলে এখানে আসিতে পারো। আমি বকরিওয়ালাদের সহিত পুরা এক পক্ষকাল বুগিয়ালে তাহাদের জীবন যাপন করিলাম।…’

বন্দনা অনেকক্ষণ ধরে কাকার সঙ্গ করে। কাকার হাত ধরে বেড়াতে যায়। কুয়াশায় ঢাকা ঘুম, অর্ধেক মেঘাবৃত অর্ধেক সোনার বরণ কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে আটচল্লিশ সালের এপ্রিলের সকালে দাঁড়িয়ে থাকে, একপাশে বাবা, একপাশে কাকা।

দু এক মাস আগে কাকা একটা সংক্ষিপ্ত চিঠিতে লিখেছিলেন—বন্দনা কি তাঁর সঙ্গে অমরনাথ যাবে? তবে রূপকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। যদি বন্দনা রাজি থাকে তিনি তাহলে ব্যবস্থা করতে আরম্ভ করবেন। চিঠিটা এসেছিল কনখল হরিদ্বার থেকে। অনেক চিঠিই ওখান থেকে আসে। কে জানে ওখানে স্থায়ী আস্তানা করেছেন কি না। নিজের কথা তো কিছুই লেখেন না। কিন্তু বন্দনার রূপকে ছেড়ে যাবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, সে এখন স্কুলে যাবার আগে পর্যন্ত মায়ের আঁচল আঁকড়ে থাকে। স্কুলবাস যতক্ষণ না মোড় পেরিয়ে বাঁক নিচ্ছে, ততক্ষণ বারান্দায় দাঁড়ানো মায়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। বাড়ি ফিরে আর কোন দিকে চাইবে না, যেন জাদুকরের নিষেধ আছে, খুড়শ্বশুর ডাক দ্যান—‘দাদাভাই, দাদাভাই, এদিকে একবার শুনে যাও।’ আর দাদাভাই! সে ততক্ষণে উর্ধ্বশ্বাসে তার মায়ের খোঁজে ছুটেছে। ঘরে ঢুকে মা তার গোটাগুটি আছে কি না দেখে তবে শান্তি।

প্রথমেই জিজ্ঞেস করবে—‘বারান্দায় দাঁড়াওনি কেন, আগে বলো!’

—‘ঠিক বুঝতে পারিনি রে, তোর বাস কি কাঁটায় কাঁটায় এক সময়ে আসে?’ কিম্বা বন্দনা হয়ত বলে—‘ঘুম এসে গিয়েছিল রূপু।’

আর যায় কোথায়! সঙ্গে সঙ্গে অর্ডার হয়—‘এবার থেকে তুমিও দুপুরবেলা আমার মতো টাস্‌ক করবে।’

—‘বেশ তো, তুই আমাকে দিয়ে যাস টাস্‌ক্‌।’ অমনি রূপের ভারি হাসি পেয়ে যায়।

—‘চালাকি, না? আমি টাস্‌ক দেবো আবার তুমি সেগুলো পটাপট সেরে রেখে আবার মজা করে ঘুমিয়ে পড়বে, না? সে হবে না।’

রূপের কথাবার্তা থেকেই পরিকল্পনাটা বন্দনার মাথায় এল। শ্বশুরমশাইকে একদিন বলল —‘বাবা, আমি মনে করছি পড়াশোনা করব। পরীক্ষা দেবো আবার।’

—‘তুমি তো গ্র্যাজুয়েট হয়েই গেছ আবার কিসের পড়াশোনা?’

—‘কেন, স্পেশ্যাল অনার্স পড়তে দিচ্ছে আজকাল, তাছাড়াও এম এ তেই তো ভর্তি হতে পারি।’

—‘ভেবে দেখি, তোমার মাকে জিজ্ঞেস করে দেখি।’ কাশীনাথবাবু বললেন।

মায়ের মত হল না। প্রথমে বললেন—‘ওই তো তোমার শরীরের অবস্থা! কি করে তুমি ট্রাম-বাস করবে?’ তারপর ছেলের দোহাই দিলেন।

—‘ছেলের অযত্ন হবে, দেখেছ তো তোমাকে ছেড়ে একদণ্ডও থাকতে পারে না।’

বন্দনা বলল—‘আমি কি আর সব ক্লাস করব। যে সময়টা রূপ স্কুলে থাকে, সেই সময়টাই খালি যাব।’

তখন উনি বললেন—‘খোকা পছন্দ করত না।’ এ কথাটার কোনও প্রমাণ নেই। কিন্তু এরপর আর কথা চলে না।

সে তাহলে কি করবে? সংসারের কাজ-কর্ম তাকে দিয়ে হয় না। রান্নাঘর পুরোপুরি শাশুড়িদের দখলে। সেখানে আর কারুর প্রবেশাধিকার নেই। ননদেরা নিজেদের ঘর গুছোয়। দাদাদের ঘর গুছিয়ে দেবার লোক আছে। নিজের ঘরটুকু গুছিয়ে, রূপের পড়াশোনা দেখেও তার হাতে অঢেল সময়। বাড়িতে জমা রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মধুসূদন, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ গ্রন্থাবলী তার বারবার করে পড়া হয়ে গেল। পড়তে আর ভালোও লাগে না। মনের স্থৈর্য, মনোযোগ বলে কিছু নেই, হাতে পায়ে কাজ করতে পারলে হয়ত সে মুক্তি পেত। সে কয়েকবার এগিয়েছেও। কিন্তু শাশুড়িরা হাঁ-হাঁ করে ওঠেন। ‘ও কি? ওকি? তুমি চা করছ কেন? তোমাকে করতে হবে কেন। আমরা এতগুলো মানুষ থাকতে? যাও গে যাও ঘরে যাও। খোকনকে দেখো গে যাও।’ এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গীয় বাড়িতে বউয়েদের আদর খুব। কাজকর্ম শাশুড়িরা, কিম্বা লোকজনেই করে। গোড়ায় গোড়ায় তার শাশুড়ি তাকে চুল বেঁধে মাথায় সিঁদুর দিয়ে তবে ছাড়তেন। নাপতিনী আসত নিয়মিত, আলতা পরাতে। কিন্তু সামান্য চা-করা, খাবার দেওয়া এ কাজগুলোও করতে না দিলে সারা দিন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে তার সময় কাটবে কি করে? ছাদে ঠাকুর ঘর, দুবেলা ঠাকুরকে ফুল ফল দেওয়ার অধিকারটাও এঁরা তার কেড়ে নিয়েছেন। সেই কবে শোকের মাথায় ঠাকুরের ছবি ভেঙেছিল! দিনের পরে দিন যায়। রূপ স্কুলে চলে গেলে হাতের সামান্য কাজ সারবার পর মনে হয় সময় থাবা গেড়ে তার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে বসে আছে। তার কি বীভৎস চেহারা। ঘরের ওয়ালক্লকটার টিকটিকোনি শুনতে শুনতে মাথা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় হয়। ঘড়িটা প্রতি মিনিটে, প্রতি সেকেন্ডে কিছু না-কিছু অপ্রীতিকর, হতাশাজনক খবর তাকে শোনায়। বন্দনা শোনে: ‘কেউ নেই, নেই কেউ, নেই নেই নেই। একা তুমি, একা একা, একা থাকো, কেউ আসবে না আর, এই ভাবে দিন যাবে, ভেবে ভেবে, দেখো দিন, যাবে কি না, তুমি নেই, সে-ও নেই। নেই, নেই, নেই নেই…। কোয়ার্টারের ঘণ্টা বাজে কিরকির করতে করতে, ঢং ঢং শব্দে ঘড়িটা বলে ‘তুমি অনাথা, ‘তুমি বিধবা’, ‘তুমি শেষ।’

এইভাবে দিন যায়। দিন কাটে। যেন মনে হয় কাটে না। কাটবে না। কিছুতেই কাটবে না আর। তবু কেটে যায়। একই রকমের রাতের পরে একই রকমের দিন, কোনও প্রাতেই তার সূর্য-ওঠা সফল হয় না। একা ঘরে অসহায়, নিরুপায় কষ্টে তার মাথার চুল দু হাতে ছিঁড়তে ইচ্ছে করে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress