শ্বেত পাথরের থালা (Shwet Pathorer Thala) : 04
খুড়তুত ননদ মিলি এসে বসল। ওরা বড় একটা এ ঘরে আসে না আজকাল। কলি এম. এ পড়ছে, সময় কম। মিলিরও এবার বি এস-সি ফাইনাল ইয়ার। কেমিস্ট্রিতে বড্ড মুখস্থ করতে হয়। সারাদিনই দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করছে মিলি। তাছাড়া ওদের আগ্রহবিন্দু এখন পঁয়তাল্লিশ নং শ্যামবাজার স্ট্রীটের দোতলার ঘর ছেড়ে অন্যত্র সরে গেছে। সে ঘরে সেই নতুন নতুন গন্ধওয়ালা হাসি-খুশি হইহল্লার মানুষগুলি আর থাকে না। জাদুকরের ফুসমন্তরে তারা উধাও হয়ে গেছে। সিন্ডারেলার রাজকুমারী বেশ যেমন রাত বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছিল! বন্দনার জুড়িগাড়ি এখন লাউয়ের খোল, কোচম্যান জোড়া টিকটিকি, সাত ঘোড়া সাতটি নেংটি ইঁদুর। সুন্দরী রাজকুমারীর জায়গায় ধুলোকালিমাখা ঘুঁটেকুড়ুনি। যদি আবার একটা বিয়ে লাগে বাড়িতে, তখন ওদের আগ্রহ শ্যামবাজার স্ট্রীটের বাড়িকে ঘিরে কিছুদিনের জন্য ফিরে আসবে। কোনও একজন চাঁদের আলো রঙের খড়মড়ে নতুন শাড়ি, ঝকঝকে সোনার গয়না লালহলুদ সুতো বাঁধা হাতওয়ালা শ্রীময়ী মুখ তাদের সবসময়ে টানবে। আপাতত টানের মানুষগুলি রুনু, নমিতা, সুচরিতা, সর্বাণী, এ. কে. বি, এস. এম, প্রদীপ, সুপ্রকাশ, পরিমল ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের খবর পঁয়তাল্লিশ নম্বর রাখে না। মিলির আবার আরেক পাগলামি আছে। সে ক্রিকেট-পাগল। অ্যালবাম জুড়ে ক্রিকেটারদের ছবি—পলি উমরিগর, লালা অমরনাথ, হাজারে, মুস্তাক আলি, ফাদকার, মানকড়, নীল হার্ভে, কাউড্রে, লেন হাটন এবং পলি উমরিগর। পলি পলি করে মিলি পাগল। তার অটোগ্রাফ অভিযান, ক্রিকেট কমেন্টারি শোনা, ফটো কাটিং, কাগজের ছবি আটকানো এবং সেই বৈভব ভালো করে দেখতে দেখতেই অবসর সময় কেটে যায়।
সকালের প্রথম দিকটা রূপকে নিয়ে দেখতে দেখতে কেটে যায় বন্দনার। সে স্কুলে চলে যাবে পৌনে দশটা নাগাদ। ফার্স্ট ট্রিপের বাস। ফিরতে ফিরতে সাড়ে তিনটে। এই সময়টুকু বন্দনা একা। সমস্ত বিশ্ব তার সমাজ-সংসার নিয়ে একটা বিশাল স্রোতোস্বান সমুদ্র, মাঝখানে অনন্ত নির্জনতার মধ্যে একটি মৌনী জলটুঙ্গি ঘরে প্রেতিনী এক। যার কোনও ভবিষ্যৎ নেই। বর্তমানও নিভু-নিভু, আছে শুধু অতীত। সে প্রেতিনী ছাড়া কি? ঘরখানা তার লম্বায়, চওড়ায় বিরাট। সেই ঘরের কোণে কোণে ইচ্ছে করলে ছড়িয়ে যাওয়া যায়, নিজেকে তুলে দেওয়া যায় পনের ফুট উঁচু সিলিং-এ। বড় বড় জানলা আছে। তার বাইরে তাকালেই বাড়ির মাথায় মাথায় খোলা আকাশ দেখা যায়। বারো মাস তাতে একটা দুটো ঘুড়ি ওড়ে। একমুঠো আকাশ নয়, বেশ উদার আকাশই। ছাদে ছাদে কাপড় শুকোচ্ছে, কোনও কোনও ছাদে বাহারি বাগান। কিন্তু বন্দনা এভাবে নিজেকে ছড়াতে পারে না। প্রত্যকটি ছাদের দিকে তাকালে তার মনে হয় কৌতূহলী চোখে কেউ চেয়ে আছে। অপবিত্র কৌতূহল। আকাশটা এত নির্বিকার, নির্বিকল্প যে বন্দনা সেখানে কোনও উত্তর কোনও ভাষা খুঁজে পায় না, সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলে ঘরের চতুর্দিকে কালো কালো ছায়া। বন্দনা ভাবে রোদ থেকে চোখ ফেরানোর জন্যে এমন হচ্ছে। কিন্তু বারবার চোখ কচলালেও, অনেকক্ষণ সময় কেটে গেলেও একই রকম ছায়া কোণে কোণে ওৎ পেতে থাকে। ফিকে নীল, রঙ-জ্বলা হলুদ চৌকোনা নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে বন্দনা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। ওই ছায়ারা হয় সরে যাক, নয় তাকে একেবারে গ্রাস করে নিক।
আজকে মিলি আসতে ছায়াগুলো তড়িঘড়ি সরে গেল। মিলির চান করা চাপ-চাপ কোঁকড়া চুল পিঠের ওপর ছড়ানো। ক্যান্থারাইডিন হেয়ার-অয়েলের উগ্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে। চান করে গায়ে পাউডার দিয়েছে। ঘাড়ে গলায় সাদা ছোপ। ছাপা শাড়ির আঁচল খাঁটের প্রান্ত বেয়ে মেঝেয় লুটোচ্ছে।
—‘আজ বুঝি তোর সকাল-সকাল ছুটি হল?’
—‘না গো বউমণি আজ বন্ধুর গাড়িতে লিফট পেয়েছি।’
‘তুমি কি করছিলে?’
—‘কিছু না।’
—‘কিচ্ছু না?’
—‘না রে।’
—‘বউমণি আমাকে একটা কার্ডিগ্যান বুনে দেবে? ডিজাইনটা তোমায় এনে দেবো। রুইতন শেপের জালি, ধারে ধারে গিঁট গিঁট মতন, তুমি নিশ্চয় দেখেছ। নতুন উঠেছে গো, খুব সুন্দর। দেবে বুনে?’
—‘দেবো। কিন্তু অনেক দেরি হবে।’
—‘তাতে কি? এ বছর তো শীত হয়েই গেল। পরের বছর পরব।’
—‘আমি যদি ভুল করে ফেলি?’
—‘যাঃ।’
বউমণি কত সোয়েটার অবলীলায় বুনেছে ছ বছর ধরে, তার আবার ভুল? মিলি বিশ্বাস করতেই পারে না।
তারপর চুপি চুপি গলায় বলল—‘একটা কথা বলব বউমণি, কিছু মনে করবে না?’ বন্দনা বলল—‘বল না কি বলবি!’
—‘জ্যাঠাইমা আর মা বলছিল খোকামণি যখন স্কুলে চলে যায় তখন তো তুমি শাড়ি খুলে ফেললে পারো। আর ডাক্তার-জ্যাঠা কি তোমায় এতো গয়নাও পরতে বলেছিলেন?’
কথা শুনে বন্দনা মিলির মুখের দিকে বোকার মতো চেয়ে রইল। বুঝতে দেরি হল। কি বলছে রে বাবা! খোকামণি মানে ছেলে স্কুলে গেলে সে শাড়ি খুলে ফেলতে পারে? মানে? শাড়ি খুলে কি পরবে? সালোয়ার-টালোয়ার? নাকি সায়া-ব্লাউজই তার পক্ষে যথেষ্ট! ডাক্তার-জ্যাঠা? গয়না? আস্তে আস্তে বুঝতে পারল। নিজের শাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল রঙ ফিকে হয়ে আসা তুঁতে রঙের টাঙাইল একটা। এগুলোর রঙ থাকে না। ফিকে হতে হতে দুপুরের আকাশের মতো একটা ঘষা-ঘষা নীল হয়ে এসেছে। ভেতরের শাদা বুটিগুলো মিলে-মিশে গেছে। একটু ছাই-ছাই রঙ ধরেছে শাদা পাড়ে আর বুটিগুলোয় কষে পরা হয়েছিল শাড়িটা। ধোপার বাড়িও গেছে। তাই এই দশা। এই রঙিন শাড়ি রূপ স্কুলে চলে গেলে তাকে খুলে ফেলতে বলছে মিলি। খুলে বোধহয় সেই কালো পাড় শাদা শাড়ি পরতে হবে। মিলি অবশ্য বলছে না। মিলিটা বোকা, সরল। তাকে দিয়ে তার মা-জেঠিমা বলাচ্ছেন। নিজেদের বলতে কিন্তু-কিন্তু লেগেছে। কিছুদিন ধরেই ওর কেমন মনে হত সামনে থেকে যেন সবাই সরে সরে যাচ্ছে। সে তো চট করে ঘর থেকে বেরোয় না। তবু ছেলেকে খাওয়াবার সময়ে, স্কুলে পাঠাবার সময়ে তাকে তো যেতেই হয়। সে সময়টা বাড়িতে মোটামুটি সবাই থাকে, দেওররা ছাড়া। অথচ বন্দনার দৃষ্টি পরিধির মধ্যে যেন কেউ থাকে না। শাশুড়ি রান্নাঘরের মধ্যে, কাকিমা যেন মনে হয় খাবার ঘরের কপাটের আড়ালে সরে গেলেন, খুড়শ্বশুর ছেলের হাত ধরে রাস্তায় নামেন, স্কুল বাসে তুলে দেবেন, কিন্তু শ্বশুরমশাইকে দেখতে পাওয়া যায় না। ‘মা’ বলে তিনি যেন অনেকদিন ডাকেননি। সবাই যেন অস্বাভাবিক গম্ভীর। এ সবের তাহলে একটা মানে আছে? এবং সে মানে এই রঙ-চটা তুঁতে নীল শাড়ি?
ওর হতভম্ব ভাব দেখে ততক্ষণে ছোট ননদ ‘আসছি একটু’ বলে পগার পার।
একটা ঝাপসা ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠবার মতো বন্দনা হঠাৎ তার পারিপার্শ্বিক সজাগ চোখে দেখতে পেল। এতক্ষণ সে চুপচাপ খাটে বসেছিল। উঠে দাঁড়াতে উল্টো দিকের আলমারির লম্বা আয়নায় তার পুরো দৈর্ঘ্যের ছায়া পড়ল। বন্দনার মনে হল সে ভূত দেখছে। ডিগডিগে রোগা, বিবর্ণ, কণ্ঠার হাড় উঁচু। সেই গর্তে বোধহয় এক পো তেল ধরে যাবে। চোখের তলায় ঘন কালি, হাতে কয়েকগাছি চুড়ি ঢলঢল করছে, একটি অসুস্থ, আধপেটা খাওয়া, অপরিণত দেহ, অপুষ্টিতে ভোগা বালিকামূর্তি আয়নার ভেতর থেকে তার দিকে ভীতু চোখে চেয়ে রইল। বন্দনার যেন হঠাৎ খেয়াল হল, সে আর ননদ-দেওরদের সবার সঙ্গে টেবিলে বসে খায় না। কোনও কোনও দিন ছুটির সকালে বা রাতে নির্দিষ্ট খাবার সময়ে নিচ থেকে দেওরদের দরাজ গলার তর্কাতর্কি ভেসে আসে। ননদদের সরু গলার হাসি। শ্বশুরমশাইয়ের গলা-খাঁকারি। সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। তার বেশ কিছুক্ষণ পর, এক কিম্বা দেড়ঘণ্টা বাদে, মিলি কিম্বা কলি এসে বলে যায়—‘বউমণি তোমার হয়ে গেছে, মা খেতে ডাকছে।’ নিচে গিয়ে দেখে খাবার ঘরের এক কোণে কম্বলের আসন পাতা। একটি পাথরের গ্লাসে জল, সাদা পাথরের থালায় দলা পাকানো আতপচালের ভাত। বেশির ভাগ দিনই কয়েক রকম আনাজসেদ্ধ, ডালসেদ্ধ আর ঘি থাকে। কোনও কোনও দিন সেদ্ধর বদলে কোনও তরকারি। অম্বল। রাত্রে লুচি, পরোটা। কিন্তু খাদ্যটা ভালো হলেও দিনের পর দিন খেতে খেতে প্রচণ্ড অম্বল হয়, মুখ সব সময়ে টকে থাকে। রুটি খেলেও সহ্য হয় না। আমাশা হয়ে যায়। বেশির ভাগ দিনই রাত্রে খায় না বন্দনা। শাশুড়ি দুধ নিয়ে সাধাসাধি করলে দুধটুকু কোনমতে গলাধঃকরণ করে নিয়ে শুয়ে পড়ে। রাত্রে পেটের মধ্যে কেমন একটা অচেনা অনুভূতিতে ঘুম ভেঙে যায়। সর্বক্ষণ গা-বমি-বমি করতে থাকে। দুঃখ, বিষাদ, দারুণ মানসিক অবসাদের সঙ্গে শারীরিক কষ্টগুলো এতদিন এমন নিঃশেষে মিশে ছিল যে আলাদা করে তাদের শারীরিক বলে বুঝত না বন্দনা। আজ এক চমকে বুঝতে পারল এ সমস্তই দিনের পর দিন অর্ধাহার, অনাহার এবং অনভ্যস্ত আহারের ফল। তার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে অবশ্য এঁদের দুঃখের শেষ নেই। দুধ-ছানা-ফল ইত্যাদি নিয়ে শাশুড়ি সাধাসাধিও করেন। বলেন—‘শরীর টিঁকবে কেন? নিজের দিকে না তাকাও, ছেলেটির দিকে তো তাকাতে হবে বউমা!’ কিন্তু সে সাধ্য-সাধনাতে কোনও জোর থাকে না। তিনি সাধাসাধি করবেন এ-ও যেমন স্বাভাবিক, সে সাধাসাধিতে ফল হবে না সে-ও যেন ঠিক তেমনি স্বাভাবিক। অনেক সময়ে কাকিমা বলেন—‘দিদি, ওর গলা দিয়ে খাবার নামে না গো আর! তুমি আমি বলে করব কি?’ চোখে আঁচল চাপা দেন কাকিমা। কিন্তু সাতাশ বছরের পরিপূর্ণ যৌবনের জঠরাগ্নি সে তো বাধা মানে না। গভীর রাতে সকলে যখন নিশ্চিন্তে ঘুমোয় তখন সেই বাড়বানল তাকে জাগিয়ে রাখে। কষ্টে চোখ দিয়ে ঝরঝর করে গরম জল পড়ে। খাটের বাজুতে মাথা রেখে অবসন্নের মতো পড়ে থাকে বন্দনা, মনে করে এটা ওর শোকেরই প্রতিক্রিয়া। অবসন্ন হয়ে একটা ঘোর লাগে, ঠিক ঘুম নয়, সেই ঘোরের মধ্যে বন্দনা স্বপ্ন দেখে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। জানলা বন্ধ করতে গিয়ে দেখে ওমা এ তো বৃষ্টি নয়! জল নয়! শিলের মতো কি যেন পড়ছে! ওমা শিল তো নয় মাছ! খণ্ড খণ্ড মাছ ওলট পালট খেতে খেতে ভীষণ বেগে বন্দনার জানলায়, জানলার সিলে, বন্ধ শার্শিতে, বন্ধ চেতনায় এসে আছড়ে পড়ছে। কী হীন কি দীন এই নিষিদ্ধ স্বপ্ন! বন্দনা মাঝরাত্তিরে পশ্চিমের বাথরুমে যায়। বমি করে আসে। ওঠে শুধু জল। টক জল।
আসলে বন্দনা কোনদিন মাছ ছাড়া খেতে পারত না। অত্যধিক মৎস্য-প্রীতির জন্যে বাবা-কাকা আদর করে বেড়াল বলে ডাকতেন। মাতৃহীন কন্যা, মাছ খেতে ভালোবাসে, বাবা মাছ খাইয়ে কৃতার্থ হয়ে যেতেন। রুই, কাতলা, ইলিশের সময়ে ইলিশ, তপসের সময়ে তপসে। চিংড়ি, পার্শে, কই, মৌরলা। বন্দনার শ্বশুরবাড়িতে আর এক কাঠি বাড়া। নিরামিষ রান্নার রেওয়াজই নেই। পোস্তচচ্চড়ি এঁরা পেঁয়াজ ছাড়া খেতে জানেন না, ডালে রসুন ফোড়ন, আলুবেগুনের তরকারিতে কুচো চিংড়ি, চচ্চড়িতে মাছের মুড়ো, এ পড়বেই। খুব সম্ভব সেই জন্যই এখন তার জন্য বেশির ভাগ দিন ভাতে-ভাত-এর আয়োজন হয়। এখন মাছের হেঁশেল আলাদা হয়ে গেছে। অত রকম রান্না সেরে এঁরা আর নিরামিষ রান্না করে উঠতে পারেন না। বোধহয় ভালো জানেনও না। অথচ এদিকে ভীষণ গোঁড়া।
অভিমানে বন্দনার চোখে জল এল। এতদিন ধারণা ছিল শ্বশুর-শাশুড়ি তাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন। বিয়ের পর মাতৃহীন কন্যা বলে বন্দনার বাবা যখন অত্যধিক কাতর হয়ে পড়েছিলেন, শাশুড়ি বলেছিলেন—‘ভাবছেন কেন বেইমশাই। ও আমার মেয়ে হল। বউ নয়। মেয়ে। বউমা বলে ডাকতে ভালোবাসি তাই ডাকি। নইলে আমার কলি, কলিও যা বন্দনাও তা।’
সত্যিই, কোনদিন বন্দনার মনে হয়নি, শ্বশুরবাড়িতে সে কিছু খারাপ আছে। আগে সংসারের নানান কাজ, বিশেষত তদারকি করতে হত, এখানে চা-টা পর্যন্ত মুখে ধরা হয়, ছাড়া-কাপড়টা পর্যন্ত লোকে কেচে দেয়। একটু কড়া শাসন, বাইরে বেরোনোর ব্যাপারে একটু সংযম, নিয়ম মেনে চলতেই হয়। কিন্তু বন্দনার কোনদিন তা নিয়ে কোনও নালিশ ছিল না। তার এতবড় দুঃখের ওপর সেই শ্বশুর-শাশুড়ি কি করে অমন নিষ্ঠুরতা করতে পারলেন? শাশুড়ি হয়ত অশিক্ষিত বলে পুরনো সংস্কার আঁকড়ে আছেন, কিন্তু শ্বশুরমশাই? তিনি যে তাকে কত মা মা করে ডাকেন, কত আপনজনের মতো ব্যবহার করেন তিনিও তো বলতে পারতেন!
দশ-এগার বছর বয়সে মা চলে গেছেন। স্ত্রীলোকহীন সংসারে বাবা-কাকার তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা, গানবাজনা নিয়ে মেতে থেকেছে, বৈধব্যের নিয়মকানুন, মেয়েলি আচার-বিচারের কিছুই সে জানে না। এসব নিয়ে কোনদিন চিন্তা করারও দরকার হয়নি। দু বেণী ঝুলিয়ে কলেজ গেছে হালকা মনে, বাড়ি ফিরে স্কিপিং রোপ, সেতার, রেডিও, সিনেমা, গল্পের বই। সংসারের আর পাঁচটা সাধারণ দৃশ্যের মতো দেখেছে থানপরা শূন্যসিঁথি বিধবাদের। আভরণহীন, শূন্যদৃষ্টি, মুখে হয় বিষাদ নয় কেমন একটা কাঠিন্য। কিন্তু প্রিয়জন বিয়োগের সন্তাপ ছাড়াও যে তাঁদের জীবনে আর কোনও দুঃখ থাকতে পারে এবং তা অসহনীয়ও হতে পারে তার বেণীদোলানো মাথায় সে চিন্তা কখনও আসেনি। আজ নিজে সেই থানকাপড়ের দলে ভর্তি হয়ে সেই দীর্ঘ, কঠিন, নিঃশব্দ মিছিলের অন্তর্বর্তিনী হয়ে বড় মর্মান্তিকভাবে বোধোদয় হল।
হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মতো তার মনে হল আচ্ছা তার শাশুড়ি, খুড়শাশুড়ি এঁরাও তো তার সঙ্গে খান না। ওঁরা তাহলে সবই খান। আচ্ছা, তার স্বামী-বিয়োগের শোক যেমন প্রচণ্ড, শাশুড়ির পুত্রশোকও কি তেমনি প্রচণ্ড নয়, তাহলে? স্বামীহারা স্ত্রীর রসনা যদি খাদ্যের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে যাবে বলে লোকে প্রত্যাশা করে, পুত্রহীনা মায়ের ক্ষেত্রেও তো তাই-ই হবার কথা। অর শুধু মা-ই বা কেন? বাবা? বাবা কি ছেলেকে কম ভালোবাসেন? অভিমন্যুর বাবা খোকা-অন্ত প্রাণ ছিলেন। খোকার সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া কোনও কাজ করতেন না। ছেলেও ছিল ভীষণ পিতৃ-মাতৃ-ভক্ত। বাবা বারণ করলেন বাথরুম ওঠা বন্ধ হয়ে গেল। আগে কেন কথাটা বলেননি, পিলার অর্ধেক উঠে যাবার পর কেন বললেন এসব প্রশ্নই আর তার মনে এল না। কোনও খেদও না। অথচ একটা বিলাস- বাথরুমের কি শখই ছিল! আচ্ছা, বিপত্নীকের দুঃখই বা কম কিসে? আজ যদি অভিমন্যু থাকত, বন্দনা চলে যেত, অভিমন্যুর কি এরকম বুকের শিরছেঁড়া যন্ত্রণা হত না? তার জন্যে কি নিরামিষ হেঁশেল হোত? এমনি আলাদা আয়োজন? আলাদা প্রয়োজন? এতদিনে বন্দনা বুঝতে পারল হিন্দু নারীর জীবনে বৈধব্যকেই কেন সবচেয়ে বড় অভিসম্পাত মনে করা হয়, আর কেনই বা গুরুজনরা বিবাহিত মেয়েদের ‘জন্ম-এয়োস্ত্রী হও’ বলে অমন গুরুভঙ্গিতে আশীর্বাদ করে থাকেন! প্রিয়জন বিয়োগের দুঃখের চেয়েও বোধহয় শেষ পর্যন্ত বড় হয়ে ওঠে সারা জীবন বঞ্চনার এই নিষ্ঠুর শাস্তি। আয়নার দিকে চেয়ে বন্দনার মনে হল গত শতাব্দীর কঙ্কাবতী কন্যার সঙ্গে আজকের বন্দনা ভট্চায্যির মৌলিক কোনও পার্থক্যই নেই। যতদিন কঙ্কাবতীর দশার মধ্যে মোটা দাগের নিষ্ঠুরতাগুলো চোখে পড়ত ততদিন করুণাসাগর তার দিকে ধাবিত হয়েছে। আজকের এই যন্ত্রণা নীরব এবং গোপন।
এরপরই খাবার ঘরে সেই বিস্ফোরণ—‘এ আমি আর খেতে পারছি না, পারছি না।’