শ্বেত পাথরের থালা (Shwet Pathorer Thala) : 31
সোমবার দিন সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ যোগীন্দর অ্যান্ড যোগীন্দরের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অমলেন্দু ঘোষাল অবাক হয়ে দেখলেন এক অদ্ভুতদর্শন মহিলা তাঁর ঘরে ঢুকছেন। এবড়ো-খেবড়ো চুল কাটা। নতুন মিলের থান পরনে, সাদা ব্লাউজ। নতুন কাপড়ের রঙের সঙ্গে পুরনো ব্লাউজের রঙে মিল খায়নি বলে খুব অদ্ভুত দেখাচ্ছে। মহিলা সম্পূর্ণ নিরাভরণ। ইনি কে? কি চান? কোনও ভদ্রবংশের মহিলা ভিক্ষা চাইতে এসেছেন? ঢুকলেন কী করে? তাঁর ব্যক্তিগত বেয়ারা রতন কী করছে? মুখ ফসকে কিছু বলে ফেলবার আগেই ঘোষাল আরও অবাক হয়ে দেখলেন ভদ্রমহিলা তাঁর ফাইল ক্যাবিনেটে চাবি লাগাচ্ছেন এবং ঘোষাল তক্ষুনি চিনতে পারলেন মহিলা তাঁরই ব্যক্তিগত সচিব মিসেস বন্দনা ভট্টাচার্য।
আর্তনাদ করে উঠলেন ঘোষাল—‘একি মিসেস ভট্টাচারিয়া! একি করেছেন? এভাবে এখানে একি? চুল কেটেছেন এভাবে?’ একজোড়া কাচের মতো চোখ ঘোষালের মুখের ওপর স্থির হল। বন্দনা ভট্টাচার্য বললেন—‘কেন মিঃ ঘোষাল, জানেন না এই তো আমার ইউনিফর্ম!’
অমলেন্দু দেখলেন বন্দনা বিকারগ্রস্তের মতো ঠকঠক করে কাঁপছেন; ভেতরের কি এক দুরন্ত আবেগে, আক্ষেপে, কান্নায় যা তিনি কিছুতেই প্রকাশও করতে পারছেন না। ঘোষাল তাড়াতাড়ি উঠলেন, দু হাতে বন্দনাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। কলিংবেলের দিকে হাত যাচ্ছিল, বন্দনা প্রাণপণে তাঁর হাত চেপে ধরলেন, অস্ফুটে বললেন—‘এখন কাউকে ডাকতে পারবেন না, আজ আমি আপনার কাছে রেজিগনেশন দিয়ে যাচ্ছি।’
—‘রেজিগনেশন? বউদি! কেন!’ ঘোষাল চমকে উঠেছেন।
—‘আমি পারছি না। এভাবে চাকরি করতে পারব না, দাদা, আমার মাথা আর কাজ করবে না, করছে না…।’
ঘোষাল বললেন—‘শুনুন, আমার কথা শুনুন, বউদি! কি হল? আপনি তো শ্বশুরবাড়িতে থাকেন না! কে, কে তাহলে আপনাকে এতো কষ্ট দিল! ছিঃ!’
বন্দনার মুখচোখ চুরমার হয়ে ভেঙে যাচ্ছে। সে টেবিলের ওপর মাথা রেখে ফুলে ফুলে উঠছে।
স্যারা এসে গেছে। তাকে কিছু নির্দেশ দিয়ে ঘোষাল বন্দনাকে বললেন—‘চলুন, বউদি, আজ আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই।’ স্যারার বিস্মিত চোখ। অফিসে এখনও খুব কম লোক এসেছে, তাদেরও বিমূঢ় দৃষ্টির সামনে দিয়ে ঘোষাল বন্দনাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।
ভি আই পি রোড দিয়ে তাঁর গাড়ি ছুটছে। অমলেন্দু পেছনে তাকাচ্ছেন না, যেন তিনি জানেন না পেছনে বসা মানুষটি মুখ ঢেকে কাঁদছেন, তিনি কোনমতেই আর নিজের বশে নেই। সমস্ত অভিমান, ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাচ্ছে আজ। ঘোষাল বলছেন—‘অনেকদিন আপনাকে এখানে নিয়ে আসব ভেবেছি। আসা হয়ে ওঠেনি। অফিসের এতো উৎসব, এক্সকার্শন, কোনটাতে আপনি যোগ দেন না, অনেকবার ভেবেছি জিজ্ঞেস করব কেন, অনুরোধ করব আসতে। তারপর ভেবেছি ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের ওপর জোর না করাই ভাল। এখন দেখছি ভুল করেছি। আসলে আমার ধারণা ছিল আপনি আপনার অবাঞ্ছিত পরিবেশ থেকে একবার যখন বেরিয়ে আসতে পেরেছেন, স্ব-নির্ভর হতে পেরেছেন, তখন আপনার অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়েই গেছে। কিন্তু আপনি যে এতো দুর্বল, এতো ছেলেমানুষ কখনও বুঝিনি।’
তাঁর কথা পেছনের মানুষটির কানে যাচ্ছে কিনা বোঝার উপায় নেই।
—‘কি অদ্ভুত কাকতালীয় দেখুন’—অমলেন্দু বললেন, ‘আজ থেকে আঠার বছর আগে আজকের দিনেই আপনি আমার কাছে এসেছিলেন। মনে আছে? আমি বলেছিলাম আপনার দেখাশোনা করবার নৈতিক দায়িত্ব আমাদের। আজকে আসতে আসতে সে কথাই ভাবছিলাম। ভাবছিলাম আনন্দ করব, সেলিব্রেট করব। আপনার মতো রক্ষণশীল পরিবারের বধূর অফিসে চাকরি নেবার ঘটনা সেই পঞ্চাশের দশকে খুব ঘটত না। আজ অনেকেই আসছেন। আবহাওয়াও অনেক বদলে গেছে। কিন্তু তখন কেউ ভাবতে পারত না। অফিসে মহিলা-কর্মী নেবার রেওয়াজও ছিল না। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা বরাবরই ছিলেন। কিন্তু বাঙালি মহিলা, একেবারেই ছিলেন না। আপনি হয়ত জানেন না আপনি আমাদের অফিসের প্রথম বাঙালি মহিলা। আর দু বছর পূর্ণ হলেই অফিস আপনাকে ফেলিসিটেশন দেবার কথা ভাবছে।’
গাড়ি থামল। ঘোষাল নেমে পেছনের দরজা খুলে বললেন—‘আসুন বউদি, নামুন।’
বন্দনা মুখ ফিরিয়ে বলল—‘আমার কোথাও কারো সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না। আমায় মাফ করুন দাদা।’ ঘোষাল বললেন—‘এখানে সে অর্থে কেউ নেই। যারা আছে তারা আপনাকে পেলে নিজেদের কৃতার্থ মনে করবে। আমার কথা রাখুন। একবার নেমে দেখুন।’
পাশে বাঁশের গেট। একটি দোলনচাঁপার গাছ। গেট খুলে দু-তিনটি ছেলেমেয়ে ছুটে এল। কারো হাতে শাবল, কারো হাতে খুরপি। মাটিমাখা হাত। অমলেন্দু একজনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—‘কুণাল! তোদের মা কোথায়?’
কুণাল নামের বালকটি অস্ফুটে কিছু বলল। বন্দনা ততক্ষণে মাথায় ঘোমটা দিয়ে নেমে দাঁড়িয়েছে। অমলেন্দু বললেন—‘ঠিক আছে তোরা বাগান কোপাচ্ছিলি, যা। আমি দেখছি।’ একটি ষোল সতের বছরের ছেলে তার বাঁকা চোখ বাঁকিয়ে বলল—‘দাদা, মা? আমার মা?’
ঘোষাল সস্নেহে তার দিকে তাকিয়ে বললেন—‘হ্যাঁরে হ্যাঁ তোর মা।’ খুব খুশি হয়ে ছেলেটি এগিয়ে এসে বন্দনার হাত ধরতে গেল। অমলেন্দু বললেন—‘বাঃ, প্রণাম কর।’
ছেলেমেয়ের দলটি কলরব করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। অমলেন্দু বললেন—‘বউদি, এরা জড়বুদ্ধি। কেউ নানারকম রোগে, কেউ জন্মের সময়কার কোনও আঘাতে এমন হয়ে গেছে। বিকলাঙ্গ শিশুদের জন্য সরকারি বেসরকারি অনেক রকম প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এদের কেউ দেখে না, এদের কথা কেউ ভাবে না। মানুষের সমস্ত আয়োজন, সমস্ত ভাবনা-চিন্তার বাইরে এরা। যেটুকু ব্যবস্থা আছে প্রয়োজনের তুলনায় তা এতো সামান্য যে সিন্ধুতে বিন্দুবৎ বললেই হয়। অথচ অভিভাবক এদেরই সবচেয়ে বেশি দরকার। জানেন তো বেশিরভাগ এই রকম অভাগা শিশু আমরাই তৈরি করছি। পৃথিবীর কোনও সভ্য উন্নত দেশে এখন ফরসেপ ডেলিভারি হয় না, একমাত্র এই ভারতেই হয়। আর তার ফলে যে কত বাচ্চার ব্রেন অ্যাফেকটেড হয় ভাবতে পারবেন না। নিজেদের বাবা-মা এদের নিয়ে লজ্জাবোধ করে। খুব অসহায় তারাও। সমাজে এদের স্থান নেই। পথের কুকুরের মতো এদের গায়ে ঢিল ছোঁড়ে, খারাপ মন্তব্য করে, নানা রকমভাবে অত্যাচার করে এদেরই সমবয়সী ছেলেরা। এরা বড় হয়ে গেলেও শিশু, কি যে করুণ অবস্থা এদের না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না।’
দালান পেরিয়ে সামনের অফিস ঘরে এসে বসলেন অমলেন্দু। কৌতূহলী ছেলেমেয়েগুলি ঘুরছিল। একটি মেয়ে বলল—‘দাদু, তুমি আজ আমাদের বেড়াতে নিয়ে যাবে? তাই সকাল সকাল এসেছ?’
ঘোষাল হেসে বললেন—‘দুর্গাপুজোর জোগাড় করছিস তোরা। এখন কি বেড়াতে যেতে পারবি? আগে দীপু মা-কে ডেকে দে তো!’ বলতে বলতেই একটি মেয়ে এসে ঢুকল। বয়স অল্প, রূপের চেয়েও ছোট। বলল—‘বাবা, আজ এতো সকালে?’
অমলেন্দু বললেন—‘আমাদের বন্দনা বউদির কথা তোকে কতদিন বলেছি। আজ ওঁকে আনলাম। সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখা। আগে অবশ্য একটু কফি খাওয়া।’
মেয়েটি তাড়াতাড়ি চলে গেল।
বন্দনা বলল—‘আপনার মেয়ে?’
—‘মেয়েও বলতে পারেন। পুত্রবধূও বলতে পারেন। অনেক দেখেশুনে ছেলের বিয়ে দিলাম। আপনাকে কার্ড দিয়েছিলাম। আপনি হয়ত ভুলে গেছেন। বছরখানেক পর অফিস থেকে ছেলেকে স্টেটসে পাঠাল। বেশি আর বলব কি, কয়েক মাসের মধ্যেই গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে মারা গেল। দীপু ফিরে এল। আমরা স্বামী-স্ত্রী তখন থেকে ওকে মেয়ের মতো করে মানুষ করলাম। ও কলেজে পড়ল, পাশ করল, নিজের ইচ্ছেয় নার্সিং-এর কোর্স নিল। তারপর ওর বিয়ের ব্যবস্থা করলাম। দীপুর বরকে আমি জামাই মনে করি বউদি। ও ডাক্তার। স্পেশালাইজ করেছে এই সব সমাজ-ছাড়া অভাগাদের দেখবার জন্য। প্রধানত ওরা দুজনে মিলেই এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। স্বভাবতই আমিও জড়িয়ে পড়েছি। বউদি এরা সমাজের সৃষ্টি, মানুষের দায়, অথচ সমাজ এদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমার সাধ্য সীমাবদ্ধ। কিন্তু আমার যে ছেলে চলে গেছে তার শোক এই শিশুগুলির কান্নায়, অস্বাভাবিক চলাফেরায় রেখে দিয়ে গেছে।’ অমলেন্দু চোখ থেকে চশমা খুলে ফেললেন, খুব মনোযোগ দিয়ে তিনি চশমার কাচ মুছছেন।
দীপু বলল—‘আমরা এদের কতকগুলো শ্রেণীবিভাগ করে নিয়েছি, প্রথমত তো ছেলে আর মেয়েদের বিভাগ আলাদাই। তাছাড়াও খুব গুরুতর, গুরুতর, অল্প জড়তা এইভাবে এদের আলাদা আলাদা ক্লাস নেওয়া হয়। হাতের কাজ শেখানো, গান-বাজনা শেখানো, শোনানো, এ সমস্তই ডাক্তারদের নির্দেশমতো হয়। এদের পড়াতে, এতটুকু কিছু শেখাতে বিস্তর পরিশ্রম, প্রচুর ধৈর্য আর বিশেষ ট্রেনিং-এর দরকার হয় কাকিমা। এদের স্বাভাবিক বুদ্ধি পাঁচ ছ বছরের শিশুর বেশি এগোয়নি।’
মেয়েদের ওয়ার্ডে একটি বছর বারো তেরর মেয়ে বিছানায় একেবারে বেঁকে পড়ে আছে দেখে শিউরে উঠল বন্দনা, বলল—‘ওর মুখ দিয়ে যে গাঁজলা উঠছে ডাক্তার ডাকবে না দীপু!’
দীপু বলল—‘ও সবসময়েই ডাক্তারের নজরে আছে কাকিমা। ওর অবস্থা আরও অনেক খারাপ ছিল নল দিয়ে ছাড়া খাওয়ানো যেত না। এখন তো তবু মাঝেমধ্যে সলিড খাওয়ানো যায়। সিভিয়ার এপিলেপসি ওর।’
মেয়েদের ওয়ার্ড ছাড়তেই ছেলেটি এসে বন্দনার হাত চেপে ধরল—‘মা, মা, তুমি যেও না।’
দীপু ইংরেজিতে বলল—‘কাকিমা, টুলুর মা মারা যাবার পর ওর বাবা ওকে এখানে রেখে গেছেন। ও সেমি-সিরিয়াস টাইপের পেশেন্ট। আপনাকে দেখে ওর মৃত মায়ের কথা কেন মনে হয়েছে কে জানে। আসলে ওরা স্নেহের জন্য, মায়ের জন্য কাঙাল কাকিমা, শিশু যখন সুন্দর হয়, আকর্ষণীয় হয় তখনই সে ভালোবাসা স্নেহ যত্ন পায়। নইলে আমরা খুব কৃপণ কাকিমা, আমাদের সব দানই এতো সীমাবদ্ধ! এদের দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন, স্নেহ-মমতা নিয়ে আমাদের গর্ব করার কিছু নেই। ওটা একটা রিফ্লেক্স। সুন্দর সুগন্ধ ফুলের জন্য যেমন আমরা আকর্ষণবোধ করি সুন্দর শিশুর জন্যও তেমনি।’
বন্দনা আস্তে আস্তে বলল—‘দীপু তুমি কি তোমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছ? তোমার এতো অল্প বয়স…!’
—‘তবু কেন স্নেহ-ভালোবাসার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি, জিজ্ঞাসা করছেন তো! ওই যে বললাম, এদের অনেকেরই বাবা-মা আছেন, কিন্তু আমাদের হাতে এদের ফেলে দিতে পেরে তাঁরা যেন নিশ্চিন্ত। আর তাঁদেরই বা কি বলব, এই সেদিন একজন মা হাউ-হাউ করে কাঁদছিলেন, বলছিলেন ‘আমার বাড়িতে আত্মীয়স্বজন কেউ আসে না। পাড়া-প্রতিবেশী এড়িয়ে চলে, মেয়ে বাইরে বেরোলেই পাড়ার ছেলেরা নিষ্ঠুর বিদ্রূপ করে, মেয়েও চোদ্দ-পনের বছরের হল। কে জানে কোনদিন এই অল্পবুদ্ধি মেয়েকে কে কিভাবে ব্যবহার করবে!’ দীপুর চোখ ছলছল করছে। এই সময়ে কুণাল নামের ছেলেটি দৌড়তে দৌড়তে এসে বন্দনার আঁচল ধরল—‘তুমি দুর্গাপুজোর সময় আমাদের বাড়ি আসবে, হ্যাঁ!’ তার চোখ-মুখে অকৃত্রিম ভালো বাসা। বন্দনা ডানহাত দিয়ে কুণালকে জড়িয়ে ধরে বলল—‘আসব, নিশ্চয় আসব।’ কুণাল খুশি হয়ে ঘোষালের গায়ে মাথা ঘোষল খানিকটা, তারপর লাফাতে লাফাতে চলে গেল।
বন্দনা বলল—‘একে তো অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না দাদা।’ দীপু হাসল, বলল—‘ও মাইল্ড। আপনি ঠিকই ধরেছেন। তবু স্বাভাবিক বাচ্চাদের স্কুলে রেখে ওর কি হাল হয়েছিল শুনুন। ক্লাসের ছেলেরা রোজ ওর নামে মিথ্যে কথা বলে বলে ওকে টীচারের হাতে মার খাওয়াতো। রোজ। শুধু মার নয়, বকুনি, ব্যঙ্গ। শেষে একদিন ও ভীষণ রেগে গিয়ে দরজার চৌকাঠে যে ছেলেটি দাঁড়িয়েছিল এবং সবাই মিলে ওর প্যান্ট খুলে নেবার মতলব করছিল, তার ওপর দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে দেয়। ছেলেটির মাথা ফেটে যায়। ওর স্কুল ওকে “নিষ্ঠুর প্রকৃতির বাচ্চা” বলে সাঙ্ঘাতিক বেত মেরে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেয়। মৃগী রোগটা ওর তারপর থেকে শুরু হয়েছে।’
ঘোষাল বললেন—‘স্নেহ-মায়া-মমতা-বিবেচনা-বিচক্ষণতা এই সব ভালো ভালো শব্দের বাইরের জীব এরা।’
বন্দনা বুঝতে পারছে তার ঠোঁট কাঁপছে। সে চোখের জল সামলাবার জন্য মুখ নিচু করে হঠাৎ তার কাপড়ের কুঁচির থেকে কম্পিত চোর-কাঁটা বাছতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ফিরে আসবার সময়ে ছেলেমেয়েগুলি শাবল, খুরপি ফেলে আবার ঘিরে ধরল ওকে। ‘তুমি আসবে, আবার আসবে, কবে আসবে?’ মাতৃস্নেহর জন্য অবুঝ অবোধ অস্পষ্ট চিৎকার! টুলুর চোখ দিয়ে জল পড়ছে। কান্নায় বিকৃত হয়ে যাচ্ছে তার মুখ। তার ছোট্ট পৃথিবী থেকে মা আবার চলে যাচ্ছে। সেই মানুষ একমাত্র যে স্নেহ-মমতা বলে বস্তুর স্বাদ তাকে দিয়ে গেছে।—‘টুলু কাঁদে না, আমি শিগগির আবার আসব!’ বন্দনা নিচু হয়ে ওকে আদর করে বলল।
গাড়ি ঘুরিয়ে অমলেন্দু এবার শহরের কেন্দ্রের পথ ধরলেন। বললেন—‘বউদি, মাথার চুল কেটেছেন, বেশ করেছেন। অমন পাঁচচুলো থাকলে রাস্তায় বেরোবেন কি করে?’ মেয়েদের একটি সেলুনের সামনে তাঁর গাড়ি থামল। বললেন, ‘চলুন, চুলটা ওরা ঠিক করে দিক।’ বন্দনার কোনও আপত্তিই শুনলেন না। পনের মিনিট পর বন্দনা বেরিয়ে আসতে বললেন—‘চলুন এবার একটু খাওয়াদাওয়া করা যাক। কোথায় যাবেন?’
বন্দনা বলল—‘আপনার যেখানে ইচ্ছে।’
এলিয়ট রোডের এক বাঙালি রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ সারা হল। পরিবেশন করছে মেয়েরা। খাওয়াদাওয়া শেষ করে মুখে পান দিয়ে ঘোষাল বললেন—‘এবার আমি আপনাকে আপনার বোনের বাড়ি পৌঁছে দেব, বউদি। আর পরশুদিন আমার বাড়ি আপনার নেমন্তন্ন, অফিস থেকে নিয়ে যাব। কালকের দিনটা আপনার ছুটি। এখন বোনের বাড়ির ডিরেকশনটা দিন।’
—‘বোনের বাড়ি? কে? কলি?’
—‘হ্যাঁ।’
—‘কেন দাদা?’
—‘আমার বাড়িই নিয়ে যেতাম। কিন্তু একদিনের পক্ষে একটু বেশি হয়ে যাবে আপনার। সেখানে আমার মিসেস রয়েছেন। হাজার হোক তিনি তো বাইরেরই লোক। আজ চলুন বোনের বাড়ি।’
কলি আজকাল ক্যামাক স্ট্রিটে থাকে। রঞ্জন আই. আই. টি। সঞ্জয় এখন অফিস। দরজা খুলে অমলেন্দু এবং তার পেছনে বন্দনাকে দেখে চমকে উঠল কলি। মুখে ভয়ের ছায়া। ‘কিছু হয়েছে?’
অমলেন্দু হেসে বললেন—‘আমাকে দেখলেই কি তোমার ভয় করে?’ চোখের সামান্য ইশারা করলেন। বললেন—‘বউদিকে পৌঁছে দিয়ে গেলাম।’
বন্দনার মাথায় ঘোমটা। আপাদমস্তক সাদা। ভেতরে ঢুকতে তার মাথা থেকে ঘোমটা খসে পড়ল। কলি প্রথম থেকেই চমকে ছিল, এখন আতঙ্কিত হয়ে বলল—‘একি বউমণি?’
বন্দনার মাথার চুল ঘাড় অবধি। তাতে সাদার ছিট। তার পরনে থান। শ্বেতবর্ণ, কঠিন মূর্তি এক। কলির মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন। কিন্তু বউমণির মুখের ভাব অদ্ভুত, কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হচ্ছে না কলির। কিন্তু রাগ হচ্ছে। ভীষণ রাগ। শেষকালে আর থাকতে পারল না, বলল- ‘বউমণি, এবার তো তাহলে আর পঁয়তাল্লিশ নম্বরে ফিরে যেতে কোন বাধা নেই!’
বন্দনা বলল—‘তা নেই। কলি। যাব। ওখানেই যাব। কিন্তু ফিরে যাব না। নতুন করে যাব।’
কলি বসে পড়ে বলল—‘বউমণি, কি হয়েছে?’ তার চোখে ভয়। বউমণিকে এরকম অদ্ভুত সুদূর, শান্ত, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে এতো বড় সে কখনও দেখেনি। বন্দনা তেমনি দূর থেকে, কেমন এক রকমের অপার্থিব হাসি হেসে বলল— ‘ভয় পাচ্ছিস কলি! বড় ঘুম পাচ্ছে রে, আজ তোর কাছে একটু ঘুমোতে এসেছি। মনে হচ্ছে ভয়ে, লজ্জায়, শোকে, দুঃখে অনেকদিন ভালো করে ঘুমোইনি। কাল, কাল তোকে সব বলব। কাল শ্যামবাজারে যাব।’