শ্বেত পাথরের থালা (Shwet Pathorer Thala) : 30
রূপের আজ মেজাজ খুব খুশি। নতুন চাকরি, বিয়ের পরে বেড়াতে যাবার ইচ্ছে থাকলেও হয়ে ওঠেনি। ছুটি পায়নি। এতদিনে ছুটি মিলেছে। অংশু, প্রদীপ, অচিন্ত্য তার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িতে ঢুকল। ওপরে উঠতে উঠতে সে দরাজ গলায় ডাকল. ‘মা, মা, শিগগির চা দাও। ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। অঞ্জু, মা কোথায়?’
অঞ্জু একবার রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বলল—‘কি জানি! নেই তো এখানে।’
—‘ফিরেছে তো?’
—‘হ্যাঁ। দেখলাম তো!’
—‘যাকগে, চা-টা দাও তো।’
অচিন্ত্য বলল—‘হ্যাঁ ভালো করে চা বানা দেখি।’
অঞ্জু বলল—‘আমার বয়ে গেছে। সারা দুপুর ধরে হাত-পা সমস্ত পরিষ্কার করেছি। আঙুলগুলো বাড়িয়ে দেখাল অঞ্জু, লম্বা লম্বা লাল টুকটুকে নখ।’
অংশু বলল—‘ওসব জানি না। অনেকদিন চালিয়েছিস। লাগা দিকি চা। আর কি কি আছে বার কর।’
রূপ বলল—‘মা নিশ্চয় কিছু না কিছু করে রেখেছে।’
অঞ্জু মুখ গম্ভীর করে উঠে গেল। রান্নাঘরে ঢুকল সসপ্যান নিয়ে চায়ের জল চড়াল। দুধ বার করল। বেশ খানিকটা ঢেলে দিল প্যানে। তারপর প্যান ঢাকা দিয়ে চায়ের কৌটো খুঁজতে লাগল। তার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। মিনিট কয়েক পরেই অঞ্জুর তীব্র চিৎকারে রান্নাঘরে ছুটে গেল সবাই। অঞ্জুর সিনথেটিক শাড়ি ধরে গেছে, আঁচল দিয়ে সে প্যানের হাতল ধরেছিল। রাগের মাথায় শাড়ির কথা খেয়াল ছিল না। হাতের ওপর দুধ জল উথলে উঠে হাতের কজিও পুড়েছে খানিকটা। আগুন নিভল। রূপের মুখে এখনও আতঙ্ক। অংশু বলল—‘চা খাওয়ার বারোটা বাজল আজ।’
রূপ অঞ্জুর কজিতে বার্নল লাগাচ্ছিল, বলল—‘আমার বউটা আরেকটু হলে সীতা হয়ে যাচ্ছিল, আর তোরা চা-চা করছিস!’
অচিন্ত্য বলল—‘তোর বউ সীতা না মায়ামৃগ তা শ্রীরামচন্দ্রই জানেন।’
অঞ্জু পা ছড়িয়ে বসেছিল, হাত বাড়িয়ে চিমটি কাটল একটা। অচিন্ত্য হাসতে হাসতে বলল—‘আসলে তোর বউ কিষ্কিন্ধ্যা-বাসিনী, কিরকম খিমচোয় দেখিস না।’
অংশু বলল—‘কিন্তু মাসিমা কোথায় গেলেন বল তো! প্রাণটা এখন সত্যি মাসিমা-মাসিমা করছে।’
রূপ বলল—‘অঞ্জু ঠিক আছ তো? দাঁড়া এবার মাতৃদেবীকে খুঁজতে যাই।’ ছাদে এসে মা-কে পেল রূপ। মাদুর পেতে চোখ বুজে শুয়ে আছে। —‘মা তুমি এখানে? অঞ্জু যে পুড়ে যাচ্ছিল!’
বুঝতে একটু সময় লাগল বন্দনার। ভীষণ মাথার যন্ত্রণা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। আজকাল এই আধকপালে মাথা ধরাটা প্রায়ই হচ্ছে। এসে দেখল অন্ন আসেনি। বন্দনা জামাকাপড় বদলে ওষুধ খেয়ে ছাদে চলে গেল। কিছু দরকার নেই। শুধু বিরাম। শুধু ঘুম।
রূপের ডাকে উঠে বসল, বলল—‘বলিস কি রে? কি করে?’
—‘চা করতে গিয়েছিল, আঁচল-টাঁচল ধরে একেককার!’
বন্দনা বলল—‘লাগেনি তো!’
—‘লেগেছে বই কি! বার্নল দিয়েছি। তুমি একটু দেখ যদি আর কিছু লাগে।’
বন্দনা নিচে নেমে এল। অনেকদিন পর ছেলের ঘরে ঢুকল। বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে অঞ্জু। হাতটা দেখে বন্দনা বলল—‘ঠিক আছে। আর কিছুর দরকার হবে না।’
অচিন্ত্য বলল—‘মাসিমা, আপনার কি শরীর খারাপ?’
—‘বড্ড মাথা ধরেছিল।’
—‘তাই তো ভাবি, আমরা এলাম, মাসিমা কোথায় গেলেন?’ অঞ্জু বলল—‘ওর প্রাণটা মাসিমা মাসিমা করছিল, এক্ষুনি বলছিল। বন্দনা ক্লান্তমুখে জোর করে হাসি টেনে বলল—‘কেন? চায়ের জন্য?’
—‘ঠিক ধরেছেন মাসিমা’, অচিন্ত্য হাউহাউ করে বলল। এরা দুঃখ, অভিমান, বিদ্রূপ কিছুই বোঝে না। এই অনুভূতিহীনতার বিরুদ্ধে কোনও লড়াই চলে না। এদের সঙ্গে লড়াই চালাতে গেলে যে হাতিয়ার দরকার তা বন্দনার নেই। এইরকম অসাড় সন্তানের চেয়ে দুষ্ট ছেলেও ভালো। তার সঙ্গে সামনাসামনি ঝগড়া করা যায়। তাকে তিরস্কার করা চলে। এরকম নির্বোধ ছেলেকে নিয়ে সে কি করবে?
বন্ধুরা চলে গেলে রূপ বলল—‘যাক টিকিটটা হয়ে গেল।’
—‘কিসের?’ বন্দনা, অঞ্জু দু-জনেই জিজ্ঞেস করল।’
—‘কাশ্মীর।’
অঞ্জু বলল—‘ইস্ এতক্ষণ খবরটা চেপে রেখেছিলে?’
বন্দনা বলল—‘যাক, তাহলে ছুটি পেলি?’
—‘পুরো পাইনি। পুজোর চারদিনের সঙ্গে আরও কিছু যোগ করে নিতে হল। ষষ্ঠীর দিন যাচ্ছি, লক্ষ্মীপুজোর দিন ফেরা।’
—‘ষষ্ঠীর দিনের টিকিট কেটেছিস?’—বন্দনা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল।
—‘হ্যাঁ! কেন? ওরকম করছ কেন?’
—‘রূপু, টিকিট ফেরত দিয়ে দাও, চেষ্টা করো পরের দিনে যদি পাও।’
—‘সে কি? কেন? কত কষ্ট করে টিকিট পেয়েছি, এখন লাস্ট মোমেন্টে…’
—‘আরেকটু কষ্ট করে ফিরিয়ে দিবি রূপু, ডেট পাল্টাতে না পারিস, যাওয়া হবে না এখন। বেড়াতে যাবার অনেক সুযোগ জীবনে আসবে, আমার কথা রাখ— ও দিনটাতে যাস না;’ বন্দনার গলা কাঁপছে।
—‘কারণটা বলবে তো!’
অঞ্জু বলল—‘পাগল হয়েছেন নাকি? টিকিট হয়ে গেছে, কবে থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে। এখন ফেরত দাও বললেই ফেরত দেবে, ছেলেখেলা নাকি?’
বন্দনা বলল—‘তুমি চুপ কর অঞ্জু। রূপ টিকিট ফেরত দিয়ে আসবে। পরে যেও।’
—‘ছুটিও আর পেয়েছি, যাওয়াও আর হয়েছে।’ রূপ হতাশ গলায় বলল, ‘হঠাৎ এমন খেপে গেলে কেন?’
বন্দনা বলতে পারছে না, রূপের বাবা ষষ্ঠীর দিন যাত্রা করে আর ফেরেননি। সে বলল—‘ষষ্ঠীর দিনটা যাত্রার পক্ষে ভালো নয় রে রূপ, লক্ষ্মীটি আমার কথা শোন।’
অঞ্জু তীক্ষ্ণ গলায় বলল—‘যাত্রার পক্ষে ভালো নয়? বললেই হল? এতো কুসংস্কার আপনার, জানা ছিল না তো? এদিকে তো কিছুই মানেন না। সবই খাচ্ছেন, সবই পরছেন! আমাদের বেড়াতে যাবার কথাতেই পাঁজি পুঁথি সব বেরিয়ে পড়ল।’
বন্দনার হাত-পা কাঁপছে। কি বলছে অঞ্জু? কি অসম্ভব স্পর্ধা? রূপ? রূপু কি কিছু বলছে? শাসন? অনুযোগ? মৃদুতম ভর্ৎসনা? না, রূপ ভুরু কুঁচকে নিজের ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। পেছনে পেছনে অঞ্জু। বন্দনা অস্থির পায়ে অভিমন্যুর ছবির সামনে এসে দাঁড়াল। দরজায় খিল তুলে দিল গিয়ে। জানলার পাল্লা বন্ধ করে দিল। আলো নিভিয়ে দিল। আবার ছবির সামনে এসে দাঁড়াল। বলল—‘সত্যিই তো, আমি ভর্তৃহীনা ধূমাবতী। বেঁচে থাকবার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনটুকু শুধু আমার উদাসভাবে গ্রহণ করা উচিত। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার একমাত্র পরিচয় আমার ভাতের থালায় আর আমার পরনের কাপড়ে। সেখানে যদি পরিচয় না রাখতে পারি তাহলে পুত্রবধূর কাছ থেকে এই অপমান আমার প্রাপ্য। নিশ্চয় প্রাপ্য।’