Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu » Page 3

শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu

পঁয়তাল্লিশ নম্বরের বাথরুমে শাড়ি নিয়ে ঢোকার চল নেই। হয় ভিজে কাপড়ে আসতে হবে। নয়তো শুদ্ধু কাপড়ে অর্থাৎ একখানা মটকার কাপড় আছে, তাই পরে। এই মটকার কাপড় না-কাচা, ময়লা এবং অনেকজনের পরা হলেও সবসময়ে পবিত্র। কেন তার যুক্তি খুঁজতে যাওয়া বৃথা। ভিজে-কাপড়ে বেরোতে বন্দনার বরাবর লজ্জা করে। ব্যাটাছেলে কারুর সামনে পড়ে গেলে তো কথাই নেই। মেয়েদের বিশেষত গুরুজনদের সামনে পড়লেও বিশ্রী অস্বস্তি হয়। একখানা মটকার কাপড়, ব্লাউজ নয়, পেটিকোট নয়, শুদ্দু কাপড় সারা গায়ে ব্যান্ডেজের মতো জড়িয়ে দোতলার কোণের বাথরুম থেকে দালানের মাঝবরাবর নিজের ঘরে আসত সে। স্নানের সময়টাও নিজের ইচ্ছে এবং সুবিধে মতো হলে চলবে না। সকালে উঠে বাসিমুখ ধোয়ার পরই চান-টান করে নেওয়া এ বাড়ির নিয়ম। চান সেরেই বাইরে বেরিয়ে দেখতে হবে ব্রাশ মুখে, গামছা কাঁধে মেজদা কি ছোড়দা দাঁড়িয়ে। কি যে অপ্রস্তুত অবস্থা। ওর জড়োসড়ো ভাব দেখে একদিন অভিমন্যু বলেছিল—‘একটা বিদ্রোহের স্লোগান ছেড়ে দেবো নাকি ভট্‌চায্যি বাড়িতে?’

—‘কিরকম স্লোগান?’

—‘কলঘরেতে বউমেয়েদের জামাকাপড় নিয়ে যেতে দিতে হবে দিতে হবে।’

—‘সর্বনাশ। তাহলে রান্নাঘর খাবার ঘরে ঢোকা একদম বন্ধ হয়ে যাবে যে! অচ্ছুৎ হয়ে যাব!’

—‘তবে? পুরুষমানুষদের কলঘর আলাদা করতে হবে করতে হবে।’

—‘করতে হবে, করতে হবে করে না চেঁচিয়ে নিজেই করে দাও না।’

সেই দক্ষিণ দিকে নিচ থেকে পিলার তুলে দ্বিতীয় স্নানঘর তোলবার তোড়জোড় হল। বন্দনার ঘরের ঠিক পাশে খানিকটা ফাঁকা দালান আছে। তারপর কলিদের পড়ার ঘর। এইটুকুর সঙ্গে বাইরে থেকে খানিকটা যোগ করে বেশ বড়—বাথটব, বেসিন, কমোড, শাওয়ার-অলা টালিবসানো, এক আধুনিক বাথরুম। হঠাৎ, আধখানা পিলার তোলার পর শ্বশুরমশাই সেটা বন্ধ করে দিলেন। ঘরের লাগোয়া বাথরুম অস্বাস্থ্যকর। অরুচিকর, অশুচি। পিলারগুলো এখনও বেকার পড়ে রয়েছে। লোহার শিকগুলো জড়িয়ে মাকড়সার জাল। কলঘর থেকে মটকার সেই কাপড় জড়িয়েও এখন আসা যায় না। সেটার চওড়া লাল পাড়। বন্দনা ভিজে কাপড় গায়ে জড়িয়ে বুকের ওপর আড়াআড়ি তোয়ালে ফেলে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢুকে তাড়াতাড়ি আলনার দিকে গেল। একি? আলনার ওপর এই টুকটুকে লাল শাড়িটা কে রাখল? লাল জমি। তাতে ঢালা সোনালি জরির পাড়। সোনার পাতের মতো চকচক করছে। ভেতরে ছোট ছোট বুটি। এই শাড়ি অভিমন্যু শেষ বিবাহবার্ষিকীতে উপহার দিয়েছিল। মাত্র সেইদিনই পরা হয়েছিল। পরে পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোঁরায় দুজনে খেতে যাওয়া হয়েছিল। ফেরবার সময়ে ফ্লুরি থেকে ছেলে এবং বোনেদের জন্যে একগাদা চকোলেট, পেস্ট্রি। পাটভাঙা শাড়িটা ইস্ত্রি করে ভোলাও হয়নি। অনেক সময়ে একবার পরা শাড়ি বন্দনা খাটে তোষকের তলায় রেখে দেয়। এটা হয়ত সেই নিয়মেই তোষকের তলায় থেকে গিয়েছিল। শয্যার ওপর থেকে একটা মানুষ কর্পূরের মতো উবে গেছে। আরেকটা মানুষ আপাদমস্তক ভিতর-বাহির পাল্টে গেছে। অথচ জড় বস্তু বলেই দুটি মানুষের জীবনের সঙ্গে পাটে পাটে জড়ানো ওই শাড়ি একইরকম রয়ে গেছে! এখনও ওতে তাদের স্পর্শ, তাদের গন্ধ মাখানো। শাড়িটা নাকের কাছে ধরে বন্দনা যেন অভিমন্যুর আফটার-শেভ লোশনের গন্ধ পেল। একমুহূর্ত। একমুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল বন্দনা। কিন্তু ঠাণ্ডাটা সর্বাঙ্গে ফুটছে। বসন্তের হাওয়া। কেমন গা শিরশির করে। কোথায় গেল ওর পরবার কাপড়টা? কোথাও কোনও চিহ্ন নেই। রূপের ছোট ছোট সার্ট প্যান্ট পাজামা গুছোনো রয়েছে। আলনার পেছনে পড়ে গেল না কি? না তো! পেছন ফিরে নিচু হতে খাটের তলায় কোণে দলা পাকানো কি যেন একটা দেখা গেল। খাটের তলা থেকে দোমড়ানো মোচড়ানো কালোপাড় শাড়িটা বেরোল। কি ভাবে ওখানে গেল ভাববার সময় নেই। ঝেড়ে-ঝুড়ে এটাকেই পরতে হবে। একটা কাচা হয়েছে। দুটো ধোপার বাড়ি গেছে। এই একটাই মাত্র আছে এখন। কারও খেয়াল হয়নি চারটের বেশি এই শাড়ি বন্দনার দরকার হতে পারে। কে খেয়াল করবে? খেয়াল করার লোক তো চলে গেছে। হঠাৎ শিউরে উঠল বন্দনা। খেয়াল করার লোকটি থাকলে তাকে এ জিনিস পরতে হত না। দুটো আলমারি ভর্তি থাকে-থাকে শাড়ি সাজানো রয়েছে। তার কতো পরাই হয়নি। কি যে উল্টোপাল্টা চিন্তা! কালো-পাড় শাড়িটা চার ভাঁজ করে বিছানার ওপর রেখে হাত দিয়ে সমান করতে লাগল বন্দনা। বিশ্রী কুঁচকে গেছে। জায়গায় জায়গায় ময়লা। এমন সময়ে কোথা থেকে চিলের মতো চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে এসে শাড়িটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রূপ। কান্নায়, রাগে মুখখানা লালচে-কালো। অনেকক্ষণ থেকে কেঁদে কেঁদে চোখ রগড়াচ্ছে বোধহয়, মুখময় সেই রগড়ানির কাদা।

—‘এই কাপড়টা বিচ্ছিরি, নোংরা, এই কাপড়টা বাঁদর, শালা, ননসেন্স, ড্যাম, ড্যামিট, ইডিয়ট’—কাপড়টাকে ঘুসি মারছে আর পাগলের মতো ছড়া কাটছে রূপ। তার পাঁচ বছরের জীবনে যেখান থেকে যত গালাগাল শিখেছে। বাড়িতে পাড়ায় যেখান থেকে যত কটু-কাটব্য সংগ্রহ করতে পেরেছে সব এখন তার মুখ দিয়ে গরম ফোয়ারার মতো বেরিয়ে আসছে। তার অস্থির দাপাদাপির মধ্যে থেকে শুধু এইটুকু বার করতে পারল বন্দনা যে এই কাপড়টা নাকি মদনার মায়ের, এটা ওর মায়ের নয়। ওর মা টকটকে লাল, কিংবা সবুজ সবুজ, কিংবা পিংক পিংক শাড়ি পরবে খালি, নইলে ও খাবে না দাবে না, স্কুল যাবে না। দেশবন্ধুর পার্কের পুকুরে যেখানে গত বছর ছোটির দাদা নাইতে গিয়ে ডুবে গিয়েছিল সেইখানে গিয়ে ডুবে যাবে। কী ভয়ঙ্কর!

ছেলের চিৎকারে, কান্নায় তখন ঘরের দরজায় সারা বাড়ির লোক জড়ো হয়ে গেছে। শাশুড়ি হাউ-হাউ করে কাঁদছেন। চোখের জলে সব ঝাপসা, বন্দনা ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না মুখগুলো। শ্বশুর, খুড়শ্বশুর, ছোট দেওর, কলি, কাকিমা সবাই আছে। সবার মুখে উদ্বেগ, আতঙ্ক। দুঃসহ শোক আবার ছায়া ফেলেছে তার। হাতড়ে হাতড়ে আলমারি খুলল সে, অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়েই একটা হালকা নীল জমির শাড়ি বার করল। হলুদ পাড়। ছেলের দিকে চেয়ে ফিসফিস করে বলল—‘এইটে পরি সোনা! এটা যে আমার খুব ভালো লাগে, জানো না? লাল টুকটুকেটা যে তোমার বউ-এর জন্যে রেখে দিয়েছি।’

আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল রূপ—‘বউকে আমি খুন করে ফেলব।’

এতটুকু বাচ্চার শরীরে যে কোথা থেকে এতো জোর এল, এত জেদ! দাঁত দিয়ে সে সারাক্ষণ ‘মদনার মার শাড়ি’টাকে কুটি-কুটি করে কাটতে লাগল। অনেক করে বুঝিয়ে সুজিয়ে, বউ যে কত লক্ষ্মী, কত বেচারা, লাল শাড়িটার জন্যে সে যে কতদিন ধরে হা পিত্যেশ করে করে আছে, না পেলে অভিমানে সে যে কি করে ফেলতে পারে—এত রকম বলে কয়ে বন্দনা যখন ফিকে নীল শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে উঠে দাঁড়াল, তখন বেলা গড়িয়ে গেছে।

ছেলেকে শিশুকালের মতো চাপড়ে চাপড়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে সে বাইরে এল। কোথাও কারো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িটা অস্বাভাবিক স্তব্ধ। এতগুলো জ্যান্ত মানুষ বুকের মধ্যে ধরেও যেন কবরখানা। অনেক দূরের কোনও ঘর থেকে খালি পাখা চলার ঝিকঝিক আওয়াজ আসছে। বন্দনার মনে হল সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সে একাই শুধু জেগে। অনেক বেলা। রোদ হেলে গেছে। খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে গেছে। কিংবা ও পাট আজকে বন্ধ। রূপের পাশে এসে নির্জীবের মতো শুয়ে পড়ল বন্দনা। শীত-শীত করছে। গায়ে একটা চাদর টেনে দিল। বিকেলের দিকে ছেলেকে ডাকতে গিয়ে গায়ে হাত দিতেই হাতটা ছ্যাঁক করে উঠল। প্রচণ্ড জ্বর। হু হু করে উঠছে। থার্মোমিটার বগলে দিতে দেখতে দেখতে চার ছাড়িয়ে গেল।

চা দিতে কলি ঢুকেছে, বলল—‘থার্মোমিটার কেন গো বউমণি?’

—‘রূপের অনেক জ্বর রে কলি, ডাক্তারবাবুকে একটু ডাকতে বলবি?’

বন্দনার মনে হল তার নিজেরও জ্বর। কেমন বমি-বমি পাচ্ছে। গা শির শির করছে। সারা সকালবেলাটা ভিজে কাপড় গায়ে কেটে গেছে। একে ঋতুবদলের সময়। তার ওপর এই তো শরীর! হওয়া কিছু বিচিত্র নয়।

এই সময়েই রূপ বেঁকতে শুরু করল। হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে। মুখে ফেনা, গোঁ গোঁ আওয়াজ। তারস্বরে চিৎকার করতে করতে কলি ছুটে চলে গেল। শাশুড়ি দৌড়ে এলেন। ‘বউমা, মুখে চামচে ধরো, ছোট গিন্নি শিগগিরই আঁশবটি নিয়ে এসো, আঁশবটি ঠেকাও গায়ে। কলি জল নিয়ে আয়। জল নিয়ে আয়।’

বন্দনা ছেলের মাথাটা কোলে নিয়ে কাঠের মতো বসে।

কাকিমা বললেন—‘বেশ করে ব্রহ্মতালুতে বরফজল ঢাললা বন্দনা। জ্বরটা মাথায় চড়ে গেছে। তড়কা। ভয় খেয়ো না মা।’

ডাক্তারবাবু এসে সব বিবরণ শুনে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। হাতে কলম, প্রেসক্রিপশন লেখার প্যাড। ভালো করে বুক-পিঠ দেখে শুনে বললেন—‘কোথাও কিছু গণ্ডগোল নেই। শক থেকে জ্বর এসেছে মনে হয়। ওষুধ আমি দিচ্ছি। জ্বর কমে যাবে। কিন্তু ছেলেকে যদি মানুষ করতে চাও, সুস্থ সবল ভাবে বাঁচতে দিতে চাও মা তো ও আঘাত পায় এমন কিছু করো না। সেনসিটিভ ছেলে, এই বয়সে বাপকে হারালো। সব সময়ে তার কোলে, পিঠে, দেখেছি তো! তার সেই ছেলে একবারও বাপের নাম মুখে আনে না, ওর এতবড় শোকটা তোমরা বুঝলে না? এই বেশে তোমাকে ওর অচেনা লাগে, ও ভয় পায়। ফিলিং অফ ইনসিকিওরিটি।’

ছেলে তখন জ্বরের ধমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। মাথার কাছে ঠাকুমা বসে, পায়ের কাছে দাদু। তাঁদের দিকে ফিরে বয়স্ক ডাক্তার বললেন—‘কাশীদা, এখনও পর্যন্ত এটা তড়কাই মনে হচ্ছে। কিন্তু এর থেকে শক্ত ব্যামো, মৃগী-টৃগি দাঁড়িয়ে যাওয়া আশ্চর্য নয়। আর তাহলে এ ছেলের জ্যান্ত মড়া হয়ে থাকা কেউ আটকাতে পারবে না। বউদি, আর কোনদিন বন্দনা-বউমাকে সাদা কাপড় পরতে দেবেন না। বুঝলেন?’ ওদিক থেকে কোনও সাড়া এল না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে থেকে ডাক্তারবাবু ব্যাগ তুলে নিয়ে চলে গেলেন।

কিন্তু কেউ অনুমতি দিক আর না দিক, বন্দনা আর কোনদিন সেই কালোপাড় সাদা শাড়ি গায়ে তোলেনি। হাতে যেমন চুড়ি পরত, গলায় সরু সোনার চেন। কানে মুক্তো, আঙুলে হীরের আংটি যা দিয়ে অভিমন্যু সর্বপ্রথম তার হাত ছুঁয়েছিল। রূপ তার পছন্দের লাল শাড়িটা মাকে পরাতে পারেনি বটে, কিন্তু তার ড্রয়িংখাতা ভর্তি মোম রং আর প্যাস্টেলে শুধু একটাই ছবি। চারদিকে খাড়া খাড়া সবুজ ঘাস। তার ওপর দিয়ে দোলনা। বিন্দুর মতো সব ছেলেমেয়ে চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধু দুজনকে এদের মধ্যে স্পষ্ট চেনা যায়। ছোট্ট ছেলে তার মায়ের হাত ধরে বেড়াচ্ছে। ছেলেটির মাথায় গোল্লা-পাকানো পাকানো চুল, পাশে তার মা, কাঁধের পাশে মস্ত খোঁপা দেখা যাচ্ছে, তাতে ফুল গোঁজা। পরনে লাল শাড়ি। তলায় ছবির নাম—‘মা এবং নূপ।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress