Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu » Page 23

শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu

এ কি সম্ভব? না এ হয় না। এতদিন পর হয় না। নাকি এত দিন পর বলেই হয়? সময়ের দূরত্বটা দরকার একজনকে নামিয়ে আরেকজনকে বসাতে? একজনকে নামিয়ে? হঠাৎ সমস্ত শরীর ব্যথায় শিউরে মুচড়ে ওঠে, বিসর্জনের বাজনা বাজছে কোথায়। বন্দনা তার স্বামীর মূর্তি বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছে। আবার সিঁদুর পরবে বলে। না, এ হয় না। এখনও যে সে অভিমন্যু ভট্টাচার্যের স্ত্রী। দিনান্তে তাকে একবারও মনে পড়ে না এরকম কত দিন চলে গেছে। তার স্পর্শের স্বাদ আর এ দেহে নেই। খুব দূরের এক নিষ্প্রাণ ছবি সে। কিংবা গতজন্মের কোনও সম্পর্ক। সুদীপ্ত সত্যিই তাদের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছেন। কিশোর বয়সে রূপ বিপথে চলে যাচ্ছিল, তাকে শক্ত হাতে ফিরিয়ে এনেছেন। এখনও ওর ওপর মাস্টারমশাইয়ের প্রভাব কাজ করে। সুদীপ্ত ওকে বোঝেন। বন্দনা বরং বোঝে না। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি? তাদের সঙ্গে সম্পর্ক না-ই বা থাকল। তারা কি ভাববে? নির্ঘাৎ বলাবলি করবে এই জন্যেই বন্দনা শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল। স্বভাব যাদের এই রকম, তারাই বৈধব্যের রীতি-নীতি পালন করে না। অসংযমী। রূপ হয়ত খুশিই হবে, কিন্তু তাকে সে বলবে কি করে? লজ্জা না পেয়ে, প্রতিদিনকার বাজার করতে বলার মতো স্বাভাবিক গলায় বলতে হবে। অথচ ভাবতেও বন্দনার বুক শুকিয়ে যাচ্ছে, মুখে রক্ত জমছে। কলি? কলি-সঞ্জয় কি বলবে? ওরা তার একমাত্র বন্ধু। বলতে গেলে বোন-ভগিনীপতির মতো। ওরা যদি ঘৃণা করে? দূরে সরে যায়! চোদ্দ বছর কেটে গেছে এইভাবে। এখন জীবনযাত্রায় পরিবর্তনই কি সম্ভব? অথচ সুদীপ্ত এখন তার একমাত্র ভরসা, একমাত্র ভালো লাগা। তিনি এলে বাড়ি-ঘর-দোর, জীবন-সংসার সব পূর্ণ লাগে। আজ সুদীপ্ত মুখ ফুটে কথাটা বললেন, তাই। কিন্তু অকথিত এই বন্ধুতা, এই নির্ভর-এর ইতিহাস তো অনেকদিন হয়ে গেল। রূপ যখন সপ্তাহে তিনদিন মাস্টারমশাইয়ের কাছে দু রকমের আঁকা শিখত—অঙ্ক এবং চিত্রাঙ্কন, তখন সুদীপ্ত একদিন না আসতে পারলেই তার খারাপ লাগত। অভদ্রভাবে কখনও কখনও বলে ফেলেছে —‘শুক্রবার এলেন না?’

—‘আরে একটা কাজ পড়ে গিয়েছিল ভীষণ, আমি আগামী সপ্তাহে চারদিন এসে যাব এখন।’

বন্দনা ভীষণ লজ্জিত হয়ে বলেছে— ‘ছি ছি আমি কি তাই বলেছি? আমি শুধু খোঁজ নিচ্ছিলাম।’

সুদীপ্ত মাঝে মাঝে বাইরে যেতেন। কখনও কাজে, কখনও বেড়াতে। সে সময়গুলো বন্দনার ভেতরে ভেতরে অস্থির লাগত। এতদিনে মাত্র একবারই বন্দনা বেড়াতে গেছে, দীঘা, কলিদের সঙ্গে, ফিরে আসার পর সুদীপ্ত বললেন—‘বেড়াতে কেমন লাগল?’

—‘খুব ভালো।’

—‘আমার আর রূপের সঙ্গে ফুলেশ্বর ঘুরে আসবেন চলুন।’

সে যে কি আনন্দ আর আশ্বাসে পরিপূর্ণ দিন। ইন্সপেকশন বাংলোয় জানলার ধারে ইজেল খাটিয়ে দু’জনে বসে গেছে। কখনও বাইরে, নদীর ধারে। বন্দনা আঁকা দেখছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে একা-একা। অথচ একা লাগছে না। গলা ছেড়ে গান গাইছে।

রূপ ছবি আঁকতে আঁকতে বলছে—‘মা তো বেশ ভালোই গায় সুদীপ্তকাকু, কখনও তো শুনিনি আগে!’

সুদীপ্ত বলছেন, ‘উহু কথা বলো না, গানটা যে শুনছ, সেটা জানতে দিও না। নো কমেন্ট।’

—‘কেন। কাকু?’

—‘আরে তোমার মা লজ্জা পেয়ে যাবেন। গান গায় মানুষ ভেতরের তাগিদে, নিজেকে যখন আর ভেতরে ধরে রাখতে পারে না, তখন। সেই গান জোর করে বন্ধ করে দিলে মানুষের বুক ফেটে যায়।’

রূপ পরে গলগল করে গল্প করেছে এসব মায়ের কাছে। তখন খুব কথা বলতে ভালোবাসত ছেলে। কিছু লুকোত না। দু-চার বছরের মধ্যে কিরকম আমূল পাল্টে গেল! সুদীপ্তর সবচেয়ে বড় গুণ তিনি কাউকে আত্মসচেতন করে দ্যান না। তিনি যেন খুব সুন্দর একটা খুশি এবং আন্তরিকতার পরিমণ্ডল। ক্যানভাস। সে ক্যানভাসে তুমি আপন খেয়ালে ছবি এঁকে যাও। ভালো হল কি মন্দ হল ভাববার দরকার নেই। আসল কথা হল আত্মপ্রকাশ। নিজেকে খুলে মেলে ধরবার অভ্যাস বন্দনার ছিল না বলে বুকটা ফাটত। সুদীপ্ত থাকলে তার আত্মপ্রকাশ সহজ হয়।

কিন্তু অফিস? অণিমা হালদার প্রমুখ সহকর্মিণীরা? কি বলবে? আড়ালে বলবে না, সামনেই বলবে। স্থূল কথাবার্তা, স্থূল আক্রমণ সে যে সইতে পারে না। আসলে সে যত দিনই চাকরি করুক, এই জগতের জন্য এখনও সে তৈরি হতে পারেনি। যে শক্ত খোলসটা নিজের চারপাশে দরকার, যে সপ্রতিভ আচার-আচরণ বাক-চাতুর্য প্রয়োজন তা সে এখনও আয়ত্ত করে উঠতে পারেনি। আরও ভয় আছে। অনুপম সোম? তাকে অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছিল। গর্ব করে বলেছিল—আমি বিবাহিত, অভিমন্যু ভট্টাচার্যের স্ত্রী। বলেছিল— কট্টর বৈধব্য পালন করি না বলেই কি মনে করেন আমি পুনর্বিবাহের জন্য মুখিয়ে আছি! এই অনুপমের কাছে তার মুখ থাকবে কি করে? সেই দিন থেকে অনুপম তার সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলে, ফর্ম্যাল কথাবার্তার বেশি বলে না। বন্দনার মুখোমুখি হলেই তার মুখভাব একটা আহত চেহারা ধারণ করে। বন্দনা যদি আজ সুদীপ্ত সরকারকে বিয়ে করে অনুপমের প্রতিক্রিয়াটা কি হবে? সে কি অপমানের প্রতিশোধ নেবে না? সে কি হিংস্র হেসে বলবে না —‘তাই বলুন। মিসেস ভট্টাচার্য। সোজা সত্যি কথাটা বলতেই পারতেন। আরেকজনের সঙ্গে আপনার মন দেওয়া-নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। অন্য কথা বললেন কেন? কেন বললেন আপনি বিবাহিত, আপনি অভিমন্যু ভট্টাচার্যের স্ত্রী, আর কাউকে বিয়ে করা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। কেন আমাকে অপমান করলেন?’

ভেবে দেখলে, অনুপম এ কথা বলতেই পারে! সত্যিই বন্দনা তাকে যেভাবে অপমান করেছিল, সে বেচারা তার মতো কিছুই করেনি। কিছু না। আসলে কতকগুলো কথা ‘উইডো’, ‘ইউ ডোন্ট লিভ লাইক এনিবডিজ উইডো’— এই কথাগুলোই তার মাত্রাছাড়া ক্রোধের কারণ।

কিছুতেই এ কমপ্লেক্স সে কাটিয়ে উঠতে পারল না। কাকা বেঁচে থাকলে হয়ত তাকে ধীরে ধীরে মুক্তমনের নারী, মুক্ত মানুষ করে তুলতেন, তার নিজের হওয়ার সাধ্য নেই।

এক শুক্রবার বিকেল তিনটে নাগাদ নিজের টেবিলের ওপর অজ্ঞান হয়ে গেল বন্দনা। অমলেন্দু অন্য কোনও ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন। স্যারা টকাটক টাইপ করে যাচ্ছে। অমলেন্দু ফিরে সুইং ডোর খুলে ঢুকতে যাবেন বাঁদিকের টেবিলে স্যারা টাইপ করে যাচ্ছে। দেখলেন ডান দিকের টেবিলে বন্দনার মাথাটা টেবিলের ওপর, আস্তে আস্তে ঝুলে যাচ্ছে।

—‘এ কি, মিসেস ভট্টাচার্য! কি হয়েছে?’ সাড়া নেই। স্যারাকে ডাকলেন। স্যারা এসে দেখে বলল— ‘শী হ্যাজ আ ব্ল্যাক আউট।’

কোম্পানির ডাক্তার এসে দেখলেন, তক্ষুনি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হল। যেতে যেতে অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে এল বন্দনার। দেখল সব ঘুরছে। সে শুয়ে আছে তবু ঘুরছে। স্বয়ং পৃথিবী মাতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেল কি সে? মাথার কাছে স্যারা বসেছিল, নড়াচড়া টের পেয়ে ঝুঁকে পড়ল— ‘বন্ডনা, বন্ডনা, ডোন্ট ওয়ারি য়ু আর আ বিট আনওয়েল। উই আর টেকিং য়ু টু মেট্রোপলিট্যান জাস্ট ফর আ চেক-আপ। হাউ আর য়ু ফীলিং নাউ?’

ঘোষাল উল্টো দিকে বসেছিলেন, এগিয়ে এসে বললেন— ‘কি কষ্ট হচ্ছে বউদি?’

—‘মাথা ঘুরছে প্রচণ্ড।’

—‘ঠিক আছে কথা বলবেন না, চোখ বুজিয়ে থাকুন।’ ঘোষালের আত্মীয় সম্বোধনে বোজা পাতার তলায় চোখ দুটো ভিজে ভিজে ওঠে।

কোম্পানি তাকে বারো দিন নার্সিং হোমে রাখল। সমস্ত চেক-আপ। ই. সি. জি, ই. ই. জি, ব্রেন-স্ক্যান সব রকম বিশেষজ্ঞ এলেন। কিছুতেই উপশম হয় না। রোগিণী খালি শান্ত হবার ওষুধ, ঘুমের ওষুধ খেয়ে থাকে। ঘোরে থাকে।

শেষে সুদীপ্তবাবু বললেন—‘সঞ্জয়বাবু, ঘোষালসাহেবকে বুঝিয়ে বলুন ওঁকে এবার আমরা বাড়ি নিয়ে যাই। সব কিছু চেক-আপ তো হয়ে গেছে। এখানে চিকিৎসা-বিভ্রাট ছাড়া আর কিছু হচ্ছে না। এতো সিডেশন ভালো না।’

সঞ্জয় বলল, ‘বাড়িতে? সে কি? কে দেখবে?’

কলি বলল, ‘আমি দেখতে পারি। সেটা কোনও কথা না। কিন্তু চিকিৎসার কি হবে?’

একটু চুপ করে থেকে সুদীপ্ত বললেন—‘আমি ডাক্তার জানি। আপনাদের একদম নিশ্চিন্ত থাকতে বলছি। ঠিক হয়ে যাবে সব। এখানে যেভাবে বার্বিচ্যুরেট ব্যবহার করছে একটা স্থায়ী ক্ষতি না হয়ে যায়।’

ঘোষালের সঙ্গে অনেক বাগ-বিতণ্ডা করে সুদীপ্ত একরকম জোর করেই নিয়ে এলেন বন্দনাকে। কলি রইল। কিন্তু কলির থাকার চেয়েও বড় থাকা সুদীপ্তর। হোমিওপ্যাথ ডাক্তারকে ঠিক করা, তাঁকে ডেকে এনে দেখানো, নিয়মমতো ওষুধ খাওয়ানো। রূপ যদি ডাক্তারকে রিপোর্ট দেবার ভার নিতে যায়, সুদীপ্ত বলেন ‘থাক। অনেকক্ষণ বসে থাকতে হবে। তোর ক্ষতি হবে। আমিই যাব এখন।’

আসলে সুদীপ্তর ভয় রূপ ঠিকমতো রিপোর্ট দিতে পারবে না। রূপ তার মায়ের কিছু জানে না। ডাক্তার সিনহা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পূর্বাপর জিজ্ঞেস করবেন। রূপ সেসব বলতে পারা দূরের কথা, জানেই না।

মাসখানেকের মাথায় একেবারে সুস্থ হয়ে গেল বন্দনা। খাট থেকে উঠে দাঁড়াতে আর মাথা টলটল করছে না। নিজের শরীরটা নিজের মনে হচ্ছে। কলি ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করল—‘কি রোগটা হয়েছিল আমার বউদির? ডাক্তারবাবু!’

প্রবীণ ডাক্তার বললেন—‘আমরা তো ডায়াগনসিস করে চিকিৎসা করি না মা, সিমটমের চিকিৎসা করি, রোগীর শরীরের স্বাভাবিক হালচাল বুঝে লক্ষণ মিলিয়ে চিকিৎসা।’

‘—রোগীর হিসট্রি তো আপনি জিজ্ঞেস করেননি। কনস্টিট্যুশন জানলেন কি করে?’

—‘খানিকটা দেহ লক্ষণ মিলিয়েই জানা যায়। হিসট্রি সব সুদীপ্তবাবুর কাছেই জেনেছি। তাঁর রিপোর্ট এতো পুঙ্খানুপুঙ্খ ছিল বলেই এতো তাড়াতাড়ি সারল। নয়তো মাকে আরও কিছুদিন শুয়ে থাকতে হত।’

কলি আশ্চর্য হয়ে গেল। বলল—‘লক্ষণের চিকিৎসা করলেও একটা না একটা ডায়াগনোসিস তো আছে!’

—‘তা আছে। সুদীপ্তবাবু ঠিকই ধরেছিলেন। নার্ভাস সিসটেমের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়াতেই এমনি হয়েছিল। অ্যাংজাইটি নিউরোসিস।’

—‘তাই? আর কিছু না?’

—‘এটা কি সামান্য জিনিস হল মা? একটা মানুষের ভাবনাচিন্তা সহনশক্তি সব কিছুরই একটা সীমা আছে। সেটা মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে অতিবড় অঘটন ঘটে যাওয়াও অসম্ভব নয়। যে যেভাবে রি-অ্যাক্‌ট করে।’

—‘তাহলে আবার এরকম হতে পারে!’

—‘না হওয়ারই কথা। চিকিৎসা তো একটা হল। সিসটেমটা একটা বুস্ট পেল। তবে অসম্ভব নয়। ওঁকে একটু নিশ্চিন্তে থাকবার ব্যবস্থা করে দিন।’

কলি যেদিন চলে যাবে বন্দনার রোগমুক্তি উপলক্ষে একটু খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করল। সে নিজেই নানারকম রান্না করল, বন্দনাকে কিছু করতে দিল না। সবাইকে খাওয়ালো নিজের হাতে। রূপ আর রঞ্জু রূপের ঘরে, সুদীপ্ত সঞ্জয়ের সঙ্গে গল্পে মত্ত।

কলি বলল—‘বউমণি আমার তো সময় হয়ে গেল।’

বন্দনা তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল—‘আমার তোকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না কলি। তুই চলে গেলে আমি একা কি করে থাকব?’

কলি হেসে বলল—‘এতদিন কি করে চলছিল বউমণি?’

—‘চলছিল না রে কলি, ওকে কি চলা বলে?’

—‘কেন, তোমার ছেলে?’

—‘ছেলে কি কখনও মায়ের সঙ্গী হয়? হয় না।’

—‘তাহলে তোমার সুদীপ্ত?’

বন্দনা যেন আচমকা চড় খেয়েছে। মুখ একবার লাল হয়েই পরক্ষণে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

কলি বলল—‘সুদীপ্তবাবু তোমাকে সত্যি-সত্যি ভালোবাসেন, তুমি ওঁকে বিয়ে করো।’

—‘কি বলছিস? ছিঃ ছিঃ।’

—‘ছি ছি নয়। না করলেই বরং তোমায় আমি ছি ছি করব বউমণি। এবার উনিই তোমাকে বাঁচিয়ে তুলেছেন। তোমার খুঁটিনাটি এতো উনি কি করে। জানলেন বলো তো?’

—‘তোর যুক্তিতে তো তাহলে ডাক্তারদের আগে বিয়ে করে ফেলতে হয় আমাদের।’

—‘ওটা কু-যুক্তি বউমণি, তুমি ঠিকই বুঝেছ আমি কি বলছি। আমার মনে হয় তুমি নিজেও ওঁকে…’

—‘কলি, কি হচ্ছে?’

—‘কেন বলো তো তোমার এতো লোকভয়?’ কলি এবার রেগে উঠল, ‘লোকে তোমার কে কি করবে? কোন সমাজের সঙ্গে মেশো, কার খাও পরো যে গাল শুনতে হবে? তুমি ভীষণ দুর্বল বউমণি। এতো লোকলজ্জা, এতো দুর্বলতা ভালো নয়। সুদীপ্তদার ভালোবাসাকে তুমি স্বীকার করে নাও।’

—‘তুই যা বলছিস তা যদি সত্যি হয় তাহলে স্বীকৃতির অপেক্ষায় থাকবার দরকার হবে না কলি। বিয়ে না করেও ভালোবাসা যায়।’

তিরস্কারের দৃষ্টিতে বন্দনার দিকে তাকিয়ে রইল কলি, বলল— ‘যায়। কিন্তু বিয়েটাই সবচেয়ে শোভন, সুন্দর। ব্যক্তির চোখেও, সমাজের চোখেও। আশা করি তুমি এ বিষয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মনঃস্থির করে ফেলবে।’

—‘তুই আমায় জোর করছিস? কলি নিজের তোর খারাপ লাগবে না? কষ্ট হবে না?’

—‘কষ্ট? কার জন্য? দাদার জন্য?’

বন্দনা চুপ করে রইল।

কলি বলল—‘বউমণি দাদা কি স্বর্গে তোমার জন্যে বসে আছে মনে করেছ নাকি? যদি স্বর্গ বলে সত্যিই কিছু থাকে। কোনও একটা মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা, সেখানে দাদার মতো মানুষের খুব শান্তিতে বিচরণ করবার কথা। দাদার জন্য কষ্ট আছে। সে অকালে চলে গেল আমার সবচেয়ে ভালো দাদাটা। কিন্তু সে কষ্ট এখন ফিকে হয়ে এসেছে। মিথ্যে বলে তো লাভ নেই! আর তার সঙ্গে সুদীপ্তদার সঙ্গে তোমার বিয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। বউমণি একটা শূন্যের জন্য তুমি তোমার পুরো জীবনটাকে বরবাদ করে দেবে, কোনদিকে তাকাবে না, কাউকে ভালোবাসবে না, এ আমি কখনই বাঞ্ছনীয় মনে করি না।’

—‘তুই হলে পারতিস? কিছু মনে করিসনি কলি।’

—‘পারতাম কি? পেরে আছি বউমণি। আমার হৃদয় এতো ছোট নয় যে সেখানে একজন মৃতের পাশে একজন জীবিতের জন্য স্থান-সঙ্কুলান হবে না।’

—‘পেরে আছিস? মৃত-জীবিত? কি বলছিস কলি?’

—‘আমার জীবনের, আমার যন্ত্রণার তুমি কতটুকু জানো বউমণি? নিজে যন্ত্রণা না পেলে আমি তোমার কষ্ট বুঝতাম কি না তাই কে জানে! যন্ত্রণা না পেলে কেউ মানুষ হয় না বউমণি!’

কলি আর দাঁড়াল না। চটপট করে সবাইকে চা খাইয়ে চলে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress