শ্বেত পাথরের থালা (Shwet Pathorer Thala) : 15
স্কুল থেকে ফিরে খেলতে যাবার জন্যে ছটফটানি শুরু হয়েছে রূপের। আজকাল খাওয়া শেষ করে আর শোয় না, যদি ঘুমিয়ে পড়ে। বিকেল বয়ে যায়। সারাদিন রপটাচ্ছে। পরিশ্রম হচ্ছে খুব। কিন্তু সোমনাথ বলেন, ‘ও হল বালক, নতুন বড় হচ্ছে, প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে ওর শক্তি বাড়ছে, ওর শক্তিসামর্থ্যের পরিমাপ আমার মতো বুড়োরা করতে পারবে না। ওর শরীর যখন পারছে, তখন ও বিশ্রাম না নিয়েই খেলতে যাক, খেলুক। না পারলে তখন দেখা যাবে।’ ইতিমধ্যে ওকে দুবেলা দুধ খাওয়ানো হচ্ছে, প্রতিদিন একটি করে মুরগীর ডিম, সপ্তাহে তিন দিন মাংস এবং যথেষ্ট ফল খাওয়ানো হচ্ছে। তার মা চাকরি নেওয়ার পর খাওয়ার মান আরও উন্নত হয়েছে। জামা প্যান্ট পাল্টে, পায়ে ধবধবে কেডস হাতে ব্যাট নিয়ে, দাদুর হাতে উইকেটগুলো ধরিয়ে দিয়ে রূপ খুব বড় সড় মানুষের মতো পায়চারি করছে। মা বাড়ি না ফিরলে সে খেলতে যেতে পারছে না। ভারি উৎকণ্ঠিত। দালানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই ব্যাটটাকে শূন্যে হাঁকড়াচ্ছে রূপ—‘দেখলে কাকা, হাতটা কি রকম সট করে উঠে গেল। আমি হবো স্ট্রোক প্লেয়ার। ঠুকে ঠুকে কিষেণের মতো খেলা আমার পোসাবে না। কি বলো?’
সোমনাথ বললেন—‘ঠিক। একেবারে ঠিক।’
—‘আচ্ছা কাকা স্ট্রোক-প্লেয়ার কি বোলার হতে পারে না?’
—‘কেন পারবে না রে?’
—‘তাই ভাবছিলুম কাকা। আমার ডান হাতটা কিরকম ঘোরে না, বল করবার সময় বাঁ-হাতি বোলার। সেদিন সঞ্জুর ক্যাচখানা ধরলুম, দেখেছিলে? মাটিতে ডিগবাজি খেয়ে, একেবারে বাঁ-হাতের আঙুল দিয়ে…’ উৎসাহের চোটে ডিগবাজিটা শানের মেঝের ওপর খেয়েই দেখিয়ে দিল রূপ। তারপর ধুলো ঝেড়ে বলল—‘হাতে স্পিন কি? রাইটহ্যান্ড ব্যাটসম্যান, ন্যাটা স্পিনার, খারাপ, কাকা?’
—‘দারুণ ভালো রে, জব্বর!’
চারদিক চেয়ে ভারিক্কি চালে আবার বলে রূপ—‘মা এখনও কেন এল না বলো তো। বড্ড ভয় হয় কাকা। চারদিকে যা অ্যাকসিডেন্ট! মায়ের আবার কিছু হলো টলো না তো?’
সোমনাথ হাসতে-হাসতে তার পিঠ চাপড়ে বলেন—‘দূর পাগলা উদীয়মান ক্রিকেটারদের মায়েদের কিস্যু হয় না।’
বন্দনার আজকে বাড়ি ফিরতে সত্যিই খুব দেরি হচ্ছে। ছুটির পর সে স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়িমুখো না হয়ে উল্টো দিকে চলে গিয়েছিল। ভিক্টোরিয়ার দিকে। চওড়া রাস্তা দিয়ে দ্রুতগামী গাড়িদের পাশাপাশি সে হেঁটে যাচ্ছিল রেসকোর্সের দিকে। অনেকটা হেঁটে তবে মন বশে এল। পিকনিকের আয়োজন হচ্ছে স্কুলে। ডায়মন্ড হারবারের দিকে যাওয়া হবে, নিজেদের স্কুল-বাস নিয়ে। কি কি রান্না হবে তার একটা তালিকা তৈরি হচ্ছিল। প্রতিমাদি বলে বলে যাচ্ছিলেন, নতুন আসা একটি মেয়ে নাম নন্দা, লিখে নিচ্ছিল। ‘চার কিলো মাংস, পাঁচ কিলো মাছ’…বলতে- বলতে প্রতিমাদি হঠাৎ থেমে বললেন—‘দুজনের মতো নিরামিষের ব্যবস্থা রাখতে হবে নন্দা, ফ্রায়েড রাইসটা নিরামিষ রাখো, কাজু কিসমিস কড়াইশুঁটি দিয়ে হোক মিষ্টি-মিষ্টি, কড়াইশুঁটির কচুরি, আলুর দম, ভেজিটেবল চপ, চাটনিটা কমন।’ বন্দনা কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারল না সে সবই খায়, তার জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করবার দরকার নেই। কথাটা না বলতে পেরে ভেতরে-ভেতরে কী গভীর লজ্জা! এঁরাও তো জিজ্ঞেস করতে পারতেন। ধরেই নিলেন কেন যে তার খাওয়া নিরামিষ হবে? তাহলে বললে প্রতিক্রিয়া কি হত। ঘৃণা? বিস্ময়? বিদ্রূপ? টিটকিরি? নিজের কাছে লজ্জিত হলেও এদের কাছে যেন তার মানটা বেঁচে গেল। কিন্তু অস্বস্তিতে স্টাফরুমে বসতে পারল না সে। উঠে বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ কানে এল নন্দার গলা, আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করছে—‘কেন প্রতিমাদি, বন্দনাদি নিরামিষ খাবেন কেন? উনিও কি প্রিন্সিপ্যালের মতো সৎসঙ্গী?’
নীলিমাদি অনুচ্চস্বরে বললেন—‘জানো না বুঝি? ও তো উইডো। সাজ-পোশাক দেখলে বোঝা যায় না অবশ্য। অনেকেই এ ভুল করে।’
মা বাড়ি ফিরতে রূপ মুরুব্বির মতো বলল—‘তোমার জন্যে আমরা আটকে ছিলুম। রোজ রোজ কিন্তু এতো দেরি করো না। অন্ধকার হয়ে গেলে কি আর বলের সুতো দেখতে পাব?’ ব্যাট কাঁধে বীরপুরুষ বেরিয়ে গেল। বন্দনা দরজা বন্ধ করে দিয়ে ওপরে উঠল। কোত্থেকে যে আজ এত ক্লান্তি এল! টেবিলের ওপর কাকা ফ্লাসকে চা রেখে দিয়েছেন, পাশে কিছু ঢাকা প্লেট, কিছু খাবার-দাবার আছে। বন্দনা ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে ঢেলে অনেকক্ষণ ধরে খেল। আর কিছু মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না। প্লেটের ঢাকা খুলে দেখল—কবিরাজি কাটলেট, স্যালাড। মাঝে মাঝে শখ করে দোকান থেকে আনান কাকা। খেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু পড়ে থাকলে কাকাকে অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে। সে কাটলেটটাকে টুকরো-টুকরো করে জানলা দিয়ে নিচে ফেলে দিল, কয়েকটা কুকুর ছুটে এসে টুকরোগুলো নিয়ে মহা কাড়াকাড়ি চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে দেখে আস্তে-আস্তে জানলা থেকে সরে এল। যাক নিশ্চিন্ত।
অনেক রাতে কোথা থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজে উঠে বসলেন সোমনাথ। তাঁর ঘুম খুব সজাগ। পাশের বাড়ির কার্নিশে পায়রারা রাতে পা বদলায়, তার খসখস আওয়াজে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমটা উঠলেন না। কোথা থেকে আসছে কান্নাটা? সরু একটা বারান্দা আছে রাস্তার দিকে, পরপর তিনটে ঘর তার কোলে। মনে হচ্ছে, বন্দনার ঘরের সংলগ্ন সেই বারান্দার অংশ থেকেই আসছে আওয়াজটা। আজ রূপ মায়ের কাছে শুয়েছে। পাছে তার ঘুম ভেঙে যায় তাই বারান্দায় উঠে গিয়ে কাঁদছে বন্দনা।
শ্বশুরবাড়িতে যেভাবে ছিল তাতে তিল তিল করে মরে যাচ্ছিল মেয়ে। সেখান থেকে তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসে একটা সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশের মধ্যে রেখে তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য তিনি খুব সম্ভব ফেরাতে পেরেছেন। কয়েক বছর আগেকার বন্দনার সঙ্গে আজকের বন্দনার আকৃতিতে কোনও মিল নেই। এখন তার বয়স যেন কমে গেছে, দেখলে মনে হয় নবীনা কুমারী মেয়ে। বিবাহিত জীবনেও সে এতো সুন্দর ছিল না বোধহয়। সোমনাথ নিজে থেকে চিরকৌমার্য বেছে নিয়েছেন। কৌমার্যের মধ্যে তিনি একটা অতিরিক্ত সৌন্দর্য দেখতে পান। বিবাহিত রমণীর রূপ যেন সকালের আকাশের মতো, খোলামেলা। তার মধ্যে কোনও রহস্য থাকে না। বন্দনা এখন নিজের মতো একটা জীবন পেয়েছে। নিজের সঙ্গে অনবরত বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে সে নিজেকে চিনতে পারছে। স্বনির্ভরতা এবং দায়হীনতা এ দুটো জিনিসের স্বাদ আলাদা। বন্দনা নিজস্ব জীবনবৃত্ত পেয়ে স্ব-নির্ভর এবং একই সঙ্গে তার কাকা মাথার ওপরে থাকায় অনেকটা দায়হীন। এখন সে সুস্থ, স্বাভাবিকও। কিন্তু এ আশা সোমনাথের নেই যে মেয়ে অভিমন্যুর অভাবের দুঃখ, তার অকালমৃত্যুর বেদনা কোনদিন ভুলতে পারবে। ভুলুক—তা তিনি চানও না। এ ব্যথাও যে জীবনের এক দুরূহ দান। যে পায় সেই জানে, এর মূল্য কত! জীবনের কত তুচ্ছতা, জীর্ণতা ঝরে ঝরে যায়, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। মানুষ ভেঙে ভেঙে আবার নতুন হয়ে গড়ে ওঠে গভীর রাতে মৃত প্রিয়জনের জন্য এই সন্তপ্ত কান্না এ বড় নিভৃত, গোপন কান্না, কে জানে কত ফাল্গুনী রাতের বকুলগন্ধ মেশা সুখস্মৃতি মথিত হচ্ছে ওই কান্নায়, সেসব রাতের পুনরাবৃত্তি এ জীবনে আর কখনও হবে না। তারও জন্য এ ব্যাকুল কান্না। গুরুজনদের দেখবারও নয়, শোনবারও নয়। বুক দিয়ে আগলে রাখতে পারেন মেয়েকে, কিন্তু এই স্মৃতির আগ্রাসী কবলের কাছে তিনি ব্যর্থ। সন্তর্পণে পাশ ফিরে শোন সোমনাথ। কাঁদুক। একটু কেঁদে নিক। মাঝে মাঝে এমনি হালকা হয়ে না নিলে গুরুভার বুকে বেঁধে মেয়ে পথ চলবে কি করে? কিন্তু গুমরে গুমরে কান্না চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। যেন বুক নিংড়ে যাচ্ছে বেদনায়, দুঃসহ কষ্টে। অনেকক্ষণ শুনে। শুনে আর থাকতে পারলেন না সোমনাথ। ধীরে ধীরে পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। অঘ্রান মাসের কৃষ্ণপক্ষ। চাঁদ নেই। কিন্তু অসংখ্য তারার আলো। বাড়িগুলো সে আলোয় ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। বন্দনার ছায়ামূর্তিও যেন ভৌতিক। সান্ত্বনা জানাবার ভাষা নেই। শুধু আলতো করে মাথায় হাতটা রাখলেন সোমনাথ। কান্না স্বভাবতই বেড়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর সোমনাথ আস্তে আস্তে বললেন, ‘কি হয়েছে বুড়ি? এমনি করে কাঁদছিস কেন? আমায় বলবি না?’ গুমরে গুমরে বন্দনা বলল—‘আমি তাকে ভুলে গেছি কাকা। তার জন্যে আমি আর শোক করি না। সেই দুঃসহ কষ্ট আমায় আজকাল ছেড়ে গেছে। আমি কি রকমের সতী সাধ্বী স্ত্রী বলো! খাচ্ছি-দাচ্ছি, দিব্যি সাজপোশাক করছি, বেঁচে আছি মহা আনন্দে। প্রতিদিন কিভাবে উপভোগ করছি জীবনটাকে তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। কিন্তু সে যে অকালে অত কষ্ট পেয়ে মর্মান্তিকভাবে চলে গেল, তাকে আমি মন থেকে একেবারে মুছে ফেলে দিয়েছি। তুমিই বলো কাকা আমি কি এক নিষ্ঠুর, নির্দয়, পাপিষ্ঠা নই? আমি কি নারী নামের যোগ্য? দেশের পুরাণে লোককথায় মৃত স্বামীর পেছন পেছন স্ত্রীর যমালয়ে গিয়ে স্বামীকে ফিরিয়ে আনার তপস্যার কথা লেখা আছে, যে দেশের একটি মেয়ে একদিন লর্ড বেন্টিংকের সামনে নিজের আঙুল মোমবাতির শিখায় পুড়তে দিয়ে দেখিয়ে অবাক করে দিয়েছিল যে আগুনে পুড়ে মরা তার কাছে কিছুই নয়, আমিও তো সেই দেশেরই মেয়ে….’
সোমনাথবাবু এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন এইবার আর থাকতে পারলেন না, বললেন, ‘থাম বন্দনা, চুপ কর। তুই স্কুলে-কলেজে পড়া শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এ দেশের সবচেয়ে কলঙ্কজনক লজ্জাকর কুসংস্কারের বীভৎস নজির তুলে কিসের সাফাই গাইতে চাইছিস? ছি, ছি। আমি তোকে কিছুই শেখাতে পারিনি। কিচ্ছু দিতে পারিনি। আর আমাকেই বা শেখাতে হবে কেন, তুই নিজেই বা নিজের শক্তিতে শিখবি না কেন?’
কাকাকে এত ক্ষুব্ধ বন্দনা কোনদিন দেখেনি। তিনি তার দিকে তাকিয়ে নেই। তাঁকে ভেদ করে পেছনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন বন্দনা তাঁর সামনে থেকে মুছে গেছে।
কাকা বলছেন, ‘যে সাবিত্রী বেহুলার গল্পের তুই উল্লেখ করলি, সে তো মানুষের সবচেয়ে বড় আকাঙক্ষা অমৃতত্ব লাভের প্রতীক কাহিনী বলেই আমি জানি। বিশুদ্ধ জ্ঞান, বিশুদ্ধ প্রেম দিয়ে অমৃতত্ব লাভ। এত পড়েছিস এটুকু বুঝিসনি? দেখতে পাই তুই রোজ অভিমন্যুর ছবিতে ফুল দিস, ঠাকুরের ছবির পাশাপাশি তার ছবি রেখে দিয়েছিস। ধূপধুনো দিয়ে পুজো করিস। তোর সেন্টিমেন্টে লাগবে বলে কিছু বলতে পারিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাধা দেওয়া উচিত ছিল। এমনি করেই কুসংস্কারের চোরাবালিতে তোরা ডুবিস।’
বন্দনা ব্যথিত গলায় বলল, ‘ফুল দিতেও বারণ করছ?’
‘ফুল দিতে বারণ করিনি বুড়ি, আনুষ্ঠানিক পুজো করতে বারণ করছি। ভালোবাসা মনের ধর্ম। তাকে যে মুহূর্তে অনুষ্ঠানের মধ্যে ফেলবি, সেই মুহূর্ত থেকে সে মরতে আরম্ভ করবে। স্তূপীকৃত হয়ে থাকবে শুধু শুকনো ফুল বেলপাতার জঞ্জাল। মন্দিরে মন্দিরে একটু ঘুরলেই তো এ তথ্য বুঝতে বাকি থাকে না।’
‘আকাশের দিকে চেয়ে দ্যাখ শুদু এক মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্তর্গত কিছু গ্রহতারা দেখতে পাচ্ছিস। তাই-ই এতো যে হিসেব হয় না। তোর আমার দৃষ্টির বাইরে। ধারণাশক্তির বাইরে অবাধ অগাধ মহাশূন্য পড়ে আছে, অণুর পরে অণু জমে জমে সৃষ্টি হল জল, মাটি, প্রাণী। এই সব, এই এত আয়োজন কি বৃথা মনে করিস? বিজ্ঞানের কথা না হয় ছেড়েই দিলুম।’
‘আমি তো মনে করি অভিমন্যু এক অর্থে পুণ্যাত্মা মানুষ ছিল। মাত্র আটত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা তার প্রয়োজন হয়েছিল এ যাত্রায়। তুই কি মনে করিস তোর পুজো নিতে এখনও সে পৃথিবীর আবহমণ্ডলের মধ্যে গতিহীন প্রেত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে! জানিস না মানুষের মধ্যে অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ যে আলোকবর্তিকা জ্বলছে, অভিজ্ঞতার সারটুকু নিয়ে তাকে বিশুদ্ধ দীপ্তি হতে হবে বলেই তার বারবার পৃথিবীতে আসা? অভিমন্যুর যে অভিজ্ঞতাটুকুর প্রয়োজন তোকে দিয়ে ছিল, তা নিশ্চিত পূর্ণ হয়ে গেছে, দেহাতীত আত্মা কাউকে মনে রাখে না, সতীত্ব সাধ্বীত্ব ইত্যাদি বাঁধা বুলি কপচে তুই যে জিনিসের ছায়ামাত্র প্রকাশ করতে চাইছিস সেই ভালোবাসা মনে রাখার প্রয়োজনও আর তার নেই।
বন্দনা আর কাঁদছিল না, অবাক হয়ে কাকার উত্তেজিত মুখের দিকে চেয়েছিল, বলল, ‘বাঃ, যে মুহূর্তে একটা মানুষ চলে গেল, অমনি তাকে ভুলে যাব? তাকে আর মনে রাখার দরকার নেই? পুরনো কাপড়ের মতো ধোবার বাক্সে ফেলে দিয়ে নতুন কাপড়ের পাট ভাঙব? এই তোমার তত্ত্ব কাকা? এ যে বড় হৃদয়হীন দর্শন, তোমার বিজ্ঞান, তোমার আধ্যাত্মিক তত্ত্ব মাথা দিয়ে বুঝলাম, কিন্তু হৃদয় কি তা মানে?’
—‘ভুলে যাওয়া উচিত তা তো বলিনি; প্রিয়জনের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক তার মধ্যে একটা চিটচিটে আসক্তির দিক আছে, সেটা ত্যাগ করার কথা বলছি। সেটা বাদ দিলে যে ভালোবাসা থাকে সেটুকুই তো হল সেই ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে। নৈনং ছিন্দান্তি শস্ত্ৰানি নৈনং দহতি পাবকং, ন চৈনং ক্লেদয়ান্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ। সেই ভালোবাসা অনুভূতির মধ্যে সূক্ষ্ম লাইট ওয়েভের মতো মিশে থাকবে, তুই আরও উজ্জ্বল হবি, আরও পরিপূর্ণ। সমৃদ্ধ হবে তার ব্যক্তিত্ব, তোর আত্মা। কারণ তুই শুধু পেয়েছিলি না, পেয়েছিস। যা একবার পাওয়া যায় বুড়ি তা আর হারায় না কখনও, তোর সত্তার ভেতরে তা নিশ্চয় কাজ করে যাচ্ছে, তাকে কাজ করতে দে…’
মাঝরাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে সোমনাথবাবুর গলা গমগম করে উঠল। তিনি তখনও বলছেন—‘এ-ও বলি বুড়ি, শুধু স্বামীর ব্যাপারেই এই ভোলা-না-ভোলার ব্যাকুলতা মেয়েদের এতো বেশি কেন, ভেবে দেখেছিস? আদরের সন্তান গেলে মেয়েরা সে শোক কাটিয়ে উঠে আর একটি সন্তানকে গর্ভে ধারণ করতে দুঃখ বা লজ্জা বোধ করে না, তোর মা তোর দশ বছর বয়সে মারা গেছেন, তুই কখনও মায়ের কাছছাড়া হতিস না, তোর মারও তুই ছিলি প্রাণ, দশ বছর বয়সটার স্মৃতি বেশ ভালোই তৈরি হয়ে যায় বুড়ি, অথচ তোর মায়ের জন্যে মনে কতটুকু জায়গা রেখেছিস! মায়ের ছবিতে কোনদিন ফুল দিয়েছিস, মালা পরিয়েছিস? ধূপ জ্বেলেছিস? জ্বালাসনি বলে বিবেকের কাছে নিজেকে কখনও অপরাধী মনে করেছিস? তিনি গিয়েছিলেন নিতান্ত অল্পবয়সে, চৌত্রিশও বোধহয় পুরো হয়নি, সে-ও তো অকালমৃত্যুই! এই মায়ের কাছে তোর, কিংবা যে কোনও মানুষের ঋণ যত, আর কারও কাছে তো তার কণাও নয়! তবে? শুধু স্বামীকে ভোলা না ভোলা নিয়ে তোদের বিবেকের এতো জ্বালা কেন মা? কিছু না শুধু এইটুকুই। তোকে বোঝাতে চাই যাকে বিবেক বলে মনে করছিস সে শুধু একরকমের আত্মপ্রবঞ্চনা। সত্যকে যে মুহূর্তে চিনতে পারবি, হয়ত ধাক্কা খাবি কিন্তু আস্তে আস্তে মিথ্যে ভয়, মিথ্যে লজ্জা, মিথ্যে দুঃখের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবি। বিপত্নীকদের আরেকটা বিয়ে করার কোনও সামাজিক বাধা নেই, মৃত স্ত্রীর জন্য পালনীয় কোনও কঠোর আচারও নেই, তাই তাদের স্ত্রীর শোক ভুলতে দেরি হয় না। স্বামীহীনাদের বেলায় সব দিক থেকেই নিষেধের দেয়াল ওঠে তাই শোকও যেতে চায় না। না হলে কি হত বলা যায় না।’
বন্দনা কাঁপছে দেখে কাকা তার হাত শক্ত করে ধরে বললেন, ‘আমার কথায় যে সত্য আছে সে তুই পাশ্চাত্য দেশগুলোর দিকে তাকালেই বুঝতে পারবি। যেহেতু স্বামীর মৃত্যুতে স্বাধীনতা খর্ব হয় না, সেহেতু শতকরা নব্বুইজন সেখানে সুবিধে পেলেই পুনর্বিবাহ করে। দশ পার্সেন্টের ক্ষেত্রে মৃতের প্রতি আনুগত্যটা খাঁটি। তা-ও তাদের মধ্যে কতজন বিবাহক্ষম, সন্দেহ আছে।’
বন্দনা বলল, ‘তুমি আজ আমায় এমন কঠিন কঠিন কথা বলছ কেন কাকা, আমি জানি না। আমার ভেতরটা যে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে তুমি কি বুঝতে পারছ না?’
—‘তুই যে বললি জীবনটাকে উপভোগ করছিস বলে হঠাৎ তোর ভীষণ বিবেকদংশন হচ্ছে। তাই এত কথা বললুম। সত্যি যদি জীবনটাকে ভালো লাগে তো ভালো লাগতে দে, তার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে স্মৃতি জাগিয়ে জোর করে আজকের ভালোলাগাটাকে বাধা দিস না। তাতে একবারও প্রমাণ হবে না, তুই অভিমন্যুকে ভালোবাসিস না। মা মিথ্যা মোহ, ভ্রান্তি, মায়ার আবরণ আমি তোর ওপর থেকে সরিয়ে নিতে চাইছি।’ সোমনাথবাবুর গলার স্বর কোমল, বললেন, ‘জীবনকে তুই সহজভাবে দেখতে শেখ, কোনও কিছুই নিজের ওপর জুলুম করে, সংস্কারবশে করিস নি। স্বাভাবিক জীবনের ধর্মে যদি মৃত প্রিয়জনের জন্য কষ্ট আর তেমন তীব্র না থাকে তো না-ই থাকল। সত্যকে সহজে নে, এই আমার প্রার্থনা। স্ত্রীর শোকের কতটা যে প্রকৃত ভালোবাসা থেকে আর কতটা বৈধব্যভীতি থেকে তার অনুপাতের একটা ভয়াবহ এবং করুণ গল্প বলি শোন, তারপর তোকে ছেড়ে দেব। আমাদের বাড়িতে ছিলেন বড়পিসিমা—চোদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়, ষোলতে বিধবা হন। মাথা ন্যাড়া, আধময়লা থান পরনে, বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের সব রান্না একা হাতে করতেন, কাউকে ছাড়তেন না, যেন সংসারকে ওইটুকু না দিলে নিজের অস্তিত্বটার কৈফিয়ত দেওয়া যাবে না এমনই একটা ভাব ছিল তাঁর। কিংবা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছেন যেন। বেলা তিনটের সময়ে খেতেন, সেই একবেলার আহার। বোধহয় আমার মা রাত্রে জোর করে দুধ মিষ্টি কিছু খাওয়াতেন কোনদিন কোনদিন। একসময়ে আমার ছোট পিসেমশাই-এর হল সাঙ্ঘাতিক উদুরি। সে অসুখ তখন ক্যানসারের মতোই দুরারোগ্য ছিল। নিজের বাড়িতে তেমন দেখবার কেউ নেই। ছোট পিসিমা পিসেমশাইকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে উঠলেন। চিকিৎসা চলল কিন্তু অবস্থা উত্তরোত্তর খারাপ হতে হতে অবশেষে এমন হল যে দিন কাটে তো রাত কাটে না। সকাল থেকে ছোটপিসিমা রোগীর শয্যার পাশে। দুপুরবেলা বেচারি দিদির ডাকে সবে উঠে একটু খেয়ে আসতে গেছেন এমন সময়ে পিসেমশাই-এর শেষ সময় উপস্থিত হল। আমাকে পাঠানো হল তাঁকে ডাকতে দেখলুম খাবার ঘর ভেতর থেকে এঁটে বন্ধ। প্রাণপণে দরজা ঠেলছি কোনও সাড়া নেই। শেষে জানলার খড়খড়ি তুলে দেখি আসনে ছোটপিসিমা বসে, সামনে ভাতের থালা, বড়পিসিমা গ্রাস তুলে তুলে ছোটবোনের মুখে দিচ্ছেন। মাছ মাংস ইত্যাদি যে তিনি কখন কাকে দিয়ে আনিয়েছেন অসুখের বাড়িতে, কখন চুপি চুপি রান্না করে রেখেছেন কেউ জানতে পারেনি। মুখে গ্রাস তুলে দিচ্ছেন আর বলছেন—‘আগে খেয়ে নে রে ছুটি, জীবনে আর কোনদিন ছুঁতে পারবি না।’
‘আমি সেখান থেকে ছুট্টে পালিয়ে এলুম। তারপর ছোটপিসিমা যখন মৃত্যুপথযাত্রী স্বামীর পায়ের কাছে এসে দাঁড়ালেন তখন তাঁর পরনে লাল পাড় শান্তিপুরী শাড়ি। মাথায় ডগডগে সিঁদুর, পানের রসে ঠোঁট রাঙা কিন্তু পিসেমশাইয়ের তখন আর জ্ঞান নেই। জ্ঞান হারাবার আগে করুণ চোখে যাকে খুঁজছিলেন তিনি তখন জীবনের শেষ খাওয়া খেতে, শেষ সাজ সাজতে ব্যস্ত।
‘সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনকে মেনে নে বন্দনা। কত স্মৃতি যাবে, কত স্মৃতি আসবে, কত কিছু হারাবি, কত পাবি। এভাবে নিজেকে অতীতে প্রোথিত বাড়বৃদ্ধিহীন গাছের শব করে রাখিসনি। তুই যত চলবি, যে ভালোবাসা মানুষকে অন্য মানুষ করে তোলে সে ততই তোর দু হাতে ধরা দেবে। নইলে নয়।’