Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu » Page 12

শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu

সোমনাথবাবু বললেন—‘বুড়ি একটাই মুশকিল মা। আমার পেনশন আর ডিভিডেন্ডের টাকায় আমার একারটা রাজার হালে চলে যেত। দাদার জমা টাকাও বেশ কিছু ছিল। কিন্তু আমি যে ছাই ভ্রমণ করে করে তার অনেকটাই খরচ করে ফেলেছি। সে টাকা তো আসলে তোরই। দাদারও সে জ্ঞান হয়নি, আমারও না।’

বন্দনা রাগ করে বলল—‘তা, বাবার টাকাকড়ি, যা নাকি আসলে আমার, সে সব খরচ করে ফেলেছো বলে কি আর আমাকে খাওয়াবে না? নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নিতে বলছ, না কি বলো তো!’

এতোটা তরল ভঙ্গিতে কথা বলা অনেক দিন বন্দনার অভ্যাস নেই। কিন্তু নন্দন রোডের এই দোতলা সবুজ রঙের বাড়িটার মধ্যে ঢুকে হঠাৎ তার শরীর মনের ওপর থেকে একটা ঘেরাটোপের মতো বিষণ্ণতার আবরণটা খসে পড়েছে। ছেলেকে বলছে—‘দ্যাখ রূপু, এই উঠোনটা আমার সুইমিংপুল হতো ছোটবেলায়। মুষলধারে বৃষ্টি পড়লে নর্দমাটা বন্ধ করে দিতুম। দাওয়া অবধি জল উঠে যেত, তার ভেতর সাঁতার কাটতুম। কাকাও নামত, জানিস তো?’

রূপ বলল—‘আমিও করব মা, আমিও করব। তখন কিন্তু বারণ করতে পারবে না।’

ছাদের লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে অন্তত পাঁচ বার ওঠা-নামা করা হয়ে গেল ছেলের। দু-তিনটে ধাপ দৌড়ে ওঠে। আর ফাঁক দিয়ে হাসি-হাসি মুখ বার করে নিচে তাকায়, সেই মুখে বন্দনা তার নিজের ছেলেবেলার মুখখানা অবিকল দেখতে পায়। ছাদের ওপর সে স্কিপিং করত, পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে চু-কিত-কিত খেলত। কিংবা নাম-পাতাপাতি, কিংবা বুড়ি-বাসন্তী। খেলার নাম শুনে রূপ হেসেই অস্থির। দোতলার দালানে এক কোণে দেয়াল-আলমারি, তাতে মায়ের তোলা বাসন থাকত। তার তলায় দু-ফুট মতো ফাঁক। সেই জায়গাটুকুতে ছিল তার পুতুলের সংসার। মা একটা পর্দা করে দিয়েছিল। পর্দাটা দু পাশে সরিয়ে দিলেই তার পুতুলের সংসার বেরিয়ে পড়ত। বেনে পুতুল, মুড়কি পুতুল, কাচের পুতুল, কাচকড়ার পুতুল এবং সবচেয়ে দামী, সবচেয়ে আদরের আলুর পুতুল। তাকে রোজ ফ্রক পাল্টে, দুধ খাইয়ে তবে তার নিজের খাওয়া-দাওয়া আরম্ভ হত। সে কথা বলতে কাকা বললেন, ‘তোর সেই আলুর পুতুল কিন্তু আলমারিতে এখনও তোলা আছে বুড়ি। তুই তাকে শেষ যে ফ্রকটা পরিয়েছিলি, সেটা পরে। এখন যদি ছেলেকে দিতে চাস তো দিতে পারিস!’

রূপ বলল—‘ধ্যাৎ। আমি কি মেয়ে যে পুতুল নিয়ে খেলব! মেয়েগুলো বোকা তাই আলু-পটলের পুতুল নিয়ে খেলে।’

বন্দনা হেসে ফেলল—‘আলু-পটলের আলু নয় রে, প্লাস্টিকেরই পুতুল, আমাদের ছোটতে তাকে আলুর পুতুল কেন বলতো জানি না।’

সোমনাথবাবু খাতা-কলমে কিসব অঙ্ক কষে বললেন—‘তিনজনের চলে যাবে ঠিকই। কিন্তু একটু কষ্ট করতে হবে। একটু হিসেব করে চলতে হবে—এই আর কি!’

বন্দনা বলল—‘বারে, হিসেব করে চলা বুঝি আমার অভ্যেস নেই? আমার বিয়ের আগেকার কথা ভাবো তো! কে করত হিসেব?’

সোমনাথ বললেন—‘আমাতে আর তোতে। ঠিকই। কিন্তু সে তো হিসেবে চলত না রে, বেহিসেবে চলত। যা ইচ্ছে, যা দরকার, দাও খরচ করে দাও। নেহাৎ খরচা করার নানান উপায় আমাদের খুড়ো-ভাইঝির জানা ছিল না তাই। কিন্তু তোর ছেলে তো বড়মানুষের ছেলে, আজকালকার ছেলেও বটে।’

—‘ওকে মাথায় চড়িয়ে আর আমার সর্বনাশ করো না’, —বন্দনা বলল আমাদের যেমনি আয়, আমরা তেমনিই চলব। ওকে অযথা আদর, প্রশ্রয় একদম নয়। আর তুমি অত ভাবছোই বা কেন? আমার হাজার পঁচিশেক টাকা ফিক্সড আছে।’

সোমনাথ বললেন—‘ওতে তুই হাত দিসনি। ওটা থাকুক। পরে কত খরচ আছে।’

—‘লোকজন রেখ না। কাজকর্ম আমি একাই করে নেব।’ বন্দনা পরামর্শ দিল।

—‘তুই কি পারবি? যা ভূতের মতো চেহারা হয়েছে।’

—‘না কাকা, আমাকেও কিন্তু অযথা আদর দেবে না। কাজ করতে পেলে আমি বেঁচে যাব। তিনটে মানুষের তো কাজ!’

অবশেষে, অনেক বাগবিতণ্ডার পর ঠিক হল বাসন মাজা এবং ঘর-পরিষ্কারের জন্য একজন লোক থাকবে। কিন্তু বাকি সব, অর্থাৎ রান্না এবং তার আনুষঙ্গিক ও কাপড়-কাচা বন্দনা নিজেই করবে।

কার্যকালে অবশ্য দেখা গেল, কাজের লোকটির চেয়ে অনেক বেশি কাজের সোমনাথবাবু নিজে। নিজের গুলো তো বটেই, রূপের জামাকাপড়, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় ইত্যাদি খুব নিপুণভাবে কেচে ফেলে তিনি চোরের মতো কলঘর থেকে বেরোচ্ছেন এবং বন্দনার হাতে ধরা পড়ে যাচ্ছেন। বন্দনা ঝঙ্কার দিচ্ছে—‘আচ্ছা কাকা, তুমি কি বলো তো? বিছানার চাদর কি কেউ রোজ রোজ কাচে? কালই তো আছড়ে আছড়ে কাচলে।’

সোমনাথবাবু অপরাধীর মতো মুখ করে বলছেন—‘আজকে তোদেরটা কেচে দিলুম।’

—‘বাঃ। তাহলে আমি কাচব কি? রূপুর গুলোও তো তুমিই কেচে দিলে।’

—‘আরে, কত কাচার আছে, ধর, তোর ওই বালিশের ওয়াড় গুলো, তার ঢাকা…।’

এবার বন্দনা হেসে ফেলে। কাকা করুণ চোখে তার দিকে চেয়ে বলেন—‘তুই আগে বেঁচে ওঠ মা, তারপরে করতে চাইলে অনেক কাজ পাবি।’

ভোরবেলা চা করে তিনি বন্দনাকে ডাকেন। ততক্ষণে তাঁর আনাজপাতি কাটাও সারা। বঁটি দিয়ে পারেন না, টেবিলের ওপর ছুরি দিয়ে সব ফালা-ফালা করে কেটে রেখেছেন।

প্রথম যেদিন ভোরবেলায় চা খেতে ডাকলেন কাকা, তখন পাখিরা সবে তাদের আধো-আধো বুলি কপচানো সেরে ব্যস্ততার সুর ধরতে আরম্ভ করেছে। জানলা দিয়ে সরু ফিতের মতো আবছা আলো এসে পড়েছে, একটু পরেই সেটা রোদ হয়ে উঠবে। —‘বুড়ি বুড়ি, চা হয়ে গেছে রে, ওঠ।’ যেন বহুযুগের ওপার থেকে ভেসে আসে এই ডাক।

ঘরের বাইরের দালানেই খাবার ব্যবস্থা। আগে রান্নাঘর, খাবার ঘর, বৈঠকখানা সব নিচে ছিল। সোমনাথবাবু সে সব ব্যবস্থা ওপরে তুলে এনেছেন। ইচ্ছে আছে, নিচেটা ভাড়া দিয়ে দেবেন। বড় চৌকো দালান, তারই একধারে পার্টিশন করে নিয়ে রান্নার ব্যবস্থা। অন্য দিকটাতে টেবিল পাতা; সেই সাবেকি গোল টেবিল, যাতে একসময়ে বন্দনা তার বাবা-কাকার সঙ্গে খেতে বসত।

বন্দনা বিছানা ছাড়তে-ছাড়তে বলল—‘ওকি! আমায় ডাকলে না! এত ভোরে চা-ই বা কেন?’

—‘ভুলে গেছিস? ভুলে মেরে দিয়েছিস সব? আমরা তিনজনে এমনি ভোরে চা খেতুম না বুঝি? শিগ্‌গিরি আয়। জুড়িয়ে যাবে।’ কাকা নিজের পুরনো র‍্যাপার ভাঁজ করে চায়ের পট ঢেকে রাখেন।

—‘দাঁড়াও আগে দাঁত মাজি, কাপড় ছাড়ি।’

—‘এ হে হে হে, তুই যে দেখছি সাত গিন্নির এক গিন্নি বড়াইবুড়ি হয়ে উঠেছিস! এ যে বাসি মুখে বাসি কাপড়ে খাবারই চা রে!’

—‘না বাবা, আমার অভ্যেস নেই।’

—‘শোন বুড়ি, মুখটা ধুয়ে আয়। কাপড়-টাপড় ছাড়তে যাসনি। আগে চা, তারপর অন্য সব। চা জুড়িয়ে যাবার মতো প্যাথেটিক ব্যাপার আর হয় না।’

অগত্যা বন্দনা বেডটির অভ্যাস ঝালিয়ে নেয়। প্রথম প্রথম শ্বশুর বাড়িতে খুব অসুবিধে হত। সকালে জলখাবারের সময়ে দুধ খেতে হত। বাবাকে শাশুড়ি জিজ্ঞেস করে নিয়েছিলেন—‘বেয়াই মশাই, আপনার মেয়ের খাওয়া-দাওয়ার অভ্যেস কি?’

বাবা কিছুই বলতে চান না।—‘যা দেবেন তাই খাবে, ওর কোনও ন্যাটা নেই।’

—‘তবু!’

তখনই বাবা বলেছিলেন—‘মেয়েটি আমার বেড়াল। মাছ আর দুধ ছাড়া চলে না। বাস আর কিছু চাই না।’ সকালে এক কাপ দুধ খাওয়া। কিন্তু ভোরবেলা উঠে যে তার আগেই একবার চা খাওয়া হয়ে যেত, সেটা আর বাবা ভেঙে বলেননি। বললেও অবশ্য বিশেষ কাজ হত না। কারণ এ বাড়িতে, সকালবেলায় শুদ্ধ হয়ে স্নান-টান করে তবে খাবার নিয়ম।

ভোরবেলা ঘুম ভেঙে প্রাণটা চা-চা করত। অভিমন্যু অঘোরে ঘুমোচ্ছ। তাদের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ঠাকুর রয়েছেন। ঠাকুমা এই সেদিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। তাঁর বেঁধে দেওয়া নিয়ম পালন করেই তারা বড় হয়েছে। বিদেশে বেড়াতে গিয়ে ভোরবেলা বেয়ারা চা নিয়ে ডাকাডাকি করলে অভিমন্যু ভীষণ বিরক্ত হত—‘এঃ, দিলে ঘুমটা মাটি করে।’ বন্দনা কিন্তু ভাবত বাড়িতে না হোক ঘরের মধ্যে যদি চালু করা যায় জিনিসটা। কিন্তু মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস আবার সব অভ্যাসের ওপরে যায়! কবে ভোরের গলা-শুকোনো বন্ধ হয়ে গেছে। বাসি কাপড় না ছেড়ে, স্নান না করে কিছু খাবার চিন্তাও অশুচি মনে হতে আরম্ভ করেছে, সে নিজেই জানে না। সে স্নান করে আসার পর অভিমন্যু বিছানা ছাড়বে, বিশেষত ছুটির দিনে, তখন কত রকম আহ্লাদিপনা, ঢং করবে গায়ে পড়ে। বন্দনা তাড়াতাড়ি দূরে সরে গিয়ে বলত—‘ইস্ দিলে তো ছুঁয়ে! যাই, বদলে আসি কাপড়টা!’

—‘কাছাখোলা বাড়ির মেয়ে। তোমার আবার কবে থেকে এতো ছুঁৎমার্গ হল গো!’

—‘হয়েছে, হানতি পারোনি।’ বন্দনা উত্তর দিত।

এখন আবার সেই অভ্যাসকে জোর করে পাল্টে ফেলা। কাকা তাকে তার কুমারী-জীবনের ছন্দে নিয়ে আসবেনই। নইলে নিজের জীবনটার ছন্দও বোধহয় মেলে না। বেসুরো, বেতালা হয়ে যায়।

রান্নাঘরে গিয়ে বন্দনা দেখল, টেবিল-ময় কুচি-কুচি আলু। কুচি-কুচি লাউ; ফালা-ফালা পেঁয়াজ।

—‘একি! ও কাকা! এগুলো কি হবে গো?’

কাকা মাথা চুলকে বলেন—‘কেনরে আলু রাঁধবি, পেঁয়াজ রাধবি, লাউ রাঁধবি। মাছ সব কাটিয়ে কুটিয়ে এনেছি।’

বন্দনা বলল—‘আলু যে রাঁধব সে তো হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি, লাউও রাঁধব। কিন্তু কি রাঁধব? তোমার প্ল্যানটা কি?’

—‘প্ল্যান আবার কি? রান্নাও আবার একটা কাজ। তারও আবার প্ল্যান? দেনা সব কিছু নুন চিনি আদা হলুদ দিয়ে চড়িয়ে, দেখবি দিব্যি একটা যা-হোক কিছু হয়ে যাবে।’ সোমনাথবাবু একটু কাঁচুমাচু হয়ে বলেন।

বন্দনা বলল—‘তোমাকে আর আমায় এতো সাহায্য করতে হবে না। আর কত কেটেছো বলো তো! আমরা মানুষ আড়াইটে সে খেয়াল আছে? নাকি আমি রাক্ষসী-টসী হয়ে এসেছি বলে তোমার ধারণা।’

রূপ তার আগের স্কুলেই যাচ্ছে। প্রচণ্ড খরচ স্কুলের, স্কুল বাসও আছে। সোমনাথবাবু তার জন্যে আলাদা খেলার ঘর করে দিয়েছেন। সে ওই ঘরে সমবয়সী ছেলে-মেয়ে জুটিয়ে বিজলি-চালিত এরোপ্লেন, কাঠের দোতলা বাঘ-আঁকা বাস, রবারের সেপাই-বাহিনী। ব্যাগাটেলি ইত্যাদি নিয়ে মহা-আনন্দে সময় কাটায়। বিকেলবেলা মাঠে যায় হাতে ক্রিকেট ব্যাট, ক্যাম্বিসের বল, উইকেট নিয়ে। ও বাড়িতে নজরদারি ছিল খুব বেশি, বাড়িতে অন্য কোনও বাচ্চা সহসা ঢুকতে পেত না। রূপ ছিল সঙ্গীহীন। পার্কে গেলেও মন খুলে খেলাধুলো করার বা সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা করবার সুযোগ পেত না। এখানে শুধু বন্ধুবান্ধবই নয়। খেলার মাঠে তাকে ছেড়ে দিয়ে সোমনাথবাবু কাছাকাছি বেঞ্চে বসে থাকেন। অনেক সময়ে ঘুরে বেড়ান। রূপের সেই প্রচণ্ড মা-মা বাতিক কমতে আরম্ভ করেছে। সকালবেলা তাড়াতাড়ি চান-টান সেরে মাকে গম্ভীর চালে বলে—‘দেখো আবার বেশি দেরি করিয়ে দিও না, যা হয়েছে তাই দিয়ে দাও।’ তারপর কাকার হাত ধরে বড় রাস্তায় স্কুলবাস ধরতে যায়। কিছুতেই সোমনাথবাবুকে সে দাদু বলবে না। দাদু তো শ্যামবাজারে থাকে। ছোড়দাদুও তো শ্যামবাজারে থাকে। এটা কাকা। মায়েরও কাকা, ছেলেরও কাকা। বন্দনা বলেছিল—‘কেন শ্যামবাজারের বাড়িতে তোর কাকা নেই বুঝি? আমার কাকাকে কেন কাকা বলবি রে?’

রূপ মায়ের অজ্ঞতায় অবাক হয়ে যায়—‘সে তো কাকু! মেজকাকু, ছোটকাকু! কাকা কোথায়?’

—‘ঠিক আছে বাবা, যা প্রাণ চায় বল। তুই খুশি থাকলেই হল।’

প্রথমটা ভাবা গিয়েছিল, দাদু-দিদার জন্য রূপ খুবই কান্নাকাটি করবে। কিন্তু দেখা গেল বাচ্চারা খুব স্বার্থপর। নিজের খেলাধুলো, খাওয়া-দাওয়া, বন্ধুবান্ধব এবং মায়ের কোলটি ঠিক থাকলে আর বাদ বাকি সব কিছুই তারা চট করে ভুলে যেতে পারে। এক দাদু স্কুল বাসে তুলে দিতে, নামিয়ে আনতে যেতেন। এখন যাচ্ছেন আরেক জন। রূপের তাতে কিছু এসে যায় না। স্কুল থেকে ফিরে জলখাবার খেতে-খেতে সে মহাউৎসাহে বন্ধু আর টিচারদের গল্প করে। ক্লাসে কিরকম ডিগডিগে রোগা আর হোঁৎকা মোটা দুটো ছেলে আছে। অরিন্দম রোজ-রোজ জোক বলে। সঞ্জয় দত্ত খুব খারাপ ছেলে, রোজ পয়সা চায়। রাজা হাজরা আর অর্ণব শেঠ কিরকম ফাইট করে। তার পরই সে মাঠে যাবার জন্যে হামলাতে থাকে। মাঠ থেকে ফিরে ছেলে ঢুলতে থাকবে। অল্প একটু পড়ান সোমনাথবাবু। স্কুলটা ভালো। হোম-টাস্ক দেয় না। বেশির ভাগ পড়াই স্কুলে হয়ে যায়। পড়তে-পড়তে গল্প শুনতে-শুনতে ঢুল এসে যায়। দুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে রূপ।

একটা পুরো সংসারের কর্তৃত্ব। অভ্যাস ছিল না কোনদিনই। প্রথম প্রথম বাধো-বাধো ঠেকত। তারপর নেশা ধরে গেল। শ্যামবাজারের বাড়িতে আজ্ঞাপালন ছাড়া আর কোনও সাংসারিক কর্তব্য পালনের বালাই ছিল না। কোনও-কোনও দিন শখের পোশাকি রান্না শাশুড়িরা রাঁধতে বলতেন। শ্বশুরদের খাওয়ার সময় মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে থাকতে হত। কিন্তু, নিজের ইচ্ছেমতো, বুদ্ধিমতো চলবার সুযোগ তার কোনদিনই হয়নি। এখন বন্দনা রান্নার বই কেনে কাকাকে ফরমাশ করে। নানারকম পদ রাঁধতে-রাঁধতে, কাকা আর ছেলের উৎসাহে আর উচ্ছ্বাসে সে রীতিমত দক্ষ রাঁধুনি হয়ে উঠেছে। দুপুরবেলা বাসনওয়ালী যাচ্ছে, তাকে ডেকে ছেঁড়া জামাকাপড় দিয়ে একটা সসপ্যান, কি একটা কেটলি কেনা হল তো সে মহা জয়ের আনন্দ। অবসর সময়ে বসে-বসে মায়ের পুরনো সেলাই-কলটা টেনে নিয়ে সেলাইও সে মন্দ করে না। বালিশের ঢাকা, পেটিকোট, পায়জামা, পর্দা, সুটকেসের ঢাকা—কি নয়? টেবলক্লথ তৈরি করে কোনকালে স্কুলে শেখা কার্পেটের স্টিচ দিয়ে। কত কতদিন সে রাস্তায় বেরোয়নি। এখনও বেরোবার দরকার হয় না। বাজার হাট সব কাকাই করেন। কিন্তু মাসে একদিন অন্তত কাকা তাদের নিয়ে বেরোবেনই। যেখানে হোক। কলকাতায় এবং তার আশপাশে যে এতো যাবার জায়গা আছে, দেখবার জিনিস আছে তা-ই তো বন্দনার জানা ছিল না। কলকাতার লোকেরা কলকাতা দেখে সবচেয়ে কম। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ভেতরে অতবড় মিউজিয়ামটা সে কোনদিন দেখেনি। সেন্ট পল্‌স ক্যাথিড্রালের ভেতরে কোনদিন ঢোকেনি। গান্ধীঘাট বা ব্যান্ডেল চার্চ জায়গাগুলো কী সুন্দর। দমদম এয়ারপোর্টে গিয়ে শুধু প্লেন ওঠা-নামা দেখতে-দেখতেই রূপের মতন তারও মনে ছেলেমানুষি উৎসাহ আসে। ইন্টারন্যাশন্যাল লাইনের প্লেন নামবে তো? রূপের সঙ্গে-সঙ্গে বন্দনাও জিজ্ঞেস করতে থাকে। সেই বিশাল প্লেন ডানা মুড়ে খুব কাছে দাঁড়ায়। অ্যালিট্যালিয়া লুফথানজা রূপ পড়ে। সিঁড়ি লাগে গিয়ে। যাত্রীরা সব আত্মীয়স্বজনদের টাটা করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যায়। সুন্দরী এয়ার হোস্টেস, সুদর্শন ইউনিফর্ম পরা ক্রুরা সব চলে যায়। প্লেনের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, সিঁড়ি ফিরে আসে। তারপর বিরাট দেহ নিয়ে বাঁক ফিরে একসময় উড়ে চলে যায় প্লেন। বন্দনার বুকের ভেতর হু-হু করে। বুক যেন ফেটে যাচ্ছে শতখান হয়ে। চোখ ফাটে না। মুখে ভাষা ফোটে না। শুকনো আমসির মতো মুখ দেখে, কাকা বলেন—‘বড্ড গরম, চ’ আজ ট্যাক্সি করে বাড়ি ফেরা যাক।’ রূপ উৎসাহিত হয়ে বলে—‘আবার কবে আসব কাকা!’ বন্দনার মুখের দিকে তাকিয়ে কাকা বলেন—‘চল্‌ তো এখন শিগ্‌গির শিগ্‌গির।’ রাক্ষসীর প্রাণ যেমন কৌটোর ভোমরাতে, কাকার প্রাণ যেন তেমন বন্দনার সুখ-দুঃখের সঙ্গে প্রাণের অধিক টানে বাঁধা হয়ে গেছে। এতটুকু চোখ ছলছল, মুখের ছায়া তাঁকে বুঝি যম-যন্ত্রণা দেয়। ট্যাক্সিতে বসে চোখ বুজোয় বন্দনা। হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও বৃষ্টি বাধা মানে না। ঝরে পড়ে শাড়িতে, কোলের ওপর, পাশে বসা ছেলের গায়ের ওপর। রূপ বলে—‘কাকা, আমার বাবা কি অমনি প্লেনে করেই চলে গেছে? আর কোনদিন আসবে না? যারা চলে গেল ওরা আসবে না? আসে না কেন? বলো না, বলো না, কাকা!’

আজ কতদিন পরে রূপের মুখে বাবার নাম। বন্দনা বাইরে মুখ ফেরায়। রূপ তখন কাকার হাতে ছোট্ট ছোট্ট হাতে, ছোট্ট ছোট্ট কিল মারছে—‘ওদের আমি মারব, মারব, মারব।’

কাকা বলেন,—‘ওদের মারিস। আমাকে মারছিস কেন রে পাগলা?’ তিনি হাসবার চেষ্টা করেন, এই প্রথম কিছুতেই হাসি ফোটে না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress