শেষবেলায় মিলন
আমার ভাঙাচোরা বাড়ির সামনে এসে এক ভদ্রমহিলা বেশ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। আমি সিসিটিভি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলাম।মনে মনে ভাবি এত আস্পর্ধা , আমার বাড়িতে হয়তো চুরি করার মতলব।
একবার গেট খুলে ,কী ভাবছে! আবার বন্ধ করছে।
হঠাৎ মহিলা আমার একজন চেনা প্রতিবেশীকে জিজ্ঞেস করে এই বাড়িতে পল্টু বলে একজন ছেলে ছিল ,উনি কি এই বাড়িতে আছেন! প্রতিবেশী ছেলে আশু বলে ছেলে নেই তো,পল্টু কাকু আছেন! আমি বারান্দায় এসে হাঁক দিই,কে রে আশুতোষ! উনি মনে হচ্ছে কোনো মতলবে এসেছেন!
অনেক্ষণ ধরে উঁকি দিচ্ছেন। বয়স্কা ভদ্রমহিলা বলেন, কাউকে খোঁজ করতে হলে প্রথমে উঁকি দিতে হয়। এই ভাঙাচোরা বাড়িতে একটা নেমপ্লেট ও নেই।আসলে পল্টুকে খোঁজ করতে এসেছিলাম।
কিন্তু মাসিমা আপনি তো বললেন একটা ছেলে, এখানে পল্টু কাকু থাকেন।তাও উনি সম্প্রতি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন।
ওই আশুতোষ এত সব কথা বলছিস কেন!
গলা বাড়িয়ে ভদ্রমহিলা চিৎকার করে বলেন-আচ্ছা আপনার কি আমায় দেখে ছেলেধরা মনে হচ্ছে?
আপনার মতো আধবুড়োকে চুরি করে নিয়ে যাব।
ভদ্রমহিলা মৃদু হেসে বলেন, আসলে আমার বলাটা ভুল হয়েছে। আমি প্রেসিডেন্সির পল্টুকে ভাবছি এখনো ছেলে আছে।সে ও তো আমার মতন বুড়ো হয়েছে নিশ্চয়! আমি ইতস্তত করে বলি আচ্ছা আপনি প্রেসিডেন্সির পল্টুকে কত বছর পর খোঁজ করছেন!
ভদ্রমহিলা এখটু ভেবে হাসতে হাসতে বলে আনুমানিক প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পর! আমার কলেজ পড়ুয়া বন্ধু পল্টু ওরফে পল্লব সরকার’কে খুঁজছি।
আমি উপর থেকে নেমে সদর দরজার কাছে আসি। আপনার নাম!
মহিলা বলে আমি সাগরিকা।
আমি গোঁফের ফাঁকে মিচকি হাসি দিয়ে বলি আমার সেই সাগর!
ভদ্রমহিলা সব দাঁত বার করে বলে আমার সাগর বলতে,তাহলে তুই কি পল্লব?
চেহারায় আমুল পরিবর্তন!
আমি আঠারো বছরের কিশোরের মতো হি হি করে হেসে দন্ত বিকশিত করে বলি আয় আয় সাগর আমার বাড়িতে।কত বছর পর দেখা বলত ! সাগর কিশোরীর মতো খিলখিলিয়ে ওঠে।আরে পল্টু টানাটানি করিস না,ধপাস হলে এই বয়সে …!
আমি পুলকিত হয়ে আমার প্রতিবেশী ছেলেটিকে বলি এই আশুতোষ,যা তুই , উনি আমার পূর্ব পরিচিতা,অত্যন্ত আপন লোক। মাঝে পঁয়ত্রিশ বছর চলে গেছে বলে ঠিক ঠাহর করতে পারি নি।
তারপর দুজনে বসে প্রচুর গল্প। এই করে তিন ঘণ্টা কেটে গেছে। সাগরিকা হাসতে হাসতে বলে চল পল্লব অতীত তো অপারেশন হলো, এবার ওটি থেকে বার হয়ে একটু চা পান করি।
তা তোর বৌ কোথায়!কোন সিন্দুকে লুকিয়ে রাখলি। আমি গম্ভীর ভাবে বলি,দেখ সাগর এতক্ষণ তো নিজেদের কথা বলা হয় নি।আসলে আমি বিয়ে করি নি।
সাগর আৎকে বলে আরে এতক্ষণ এক ব্যাচেলার ছেলের ঘরে একা একটি যুবতী মেয়ে! তারপর দুজনের অট্টহাসি। একটা কাক বারান্দায় বসে কা কা করছিল, হঠাৎ আমাদের কলকল শব্দে ভয় পেয়ে উড়ে গেল।
আমি বলি এই সাগর কিসের সর্বনাশ!
সাগরিকা বলে বোকা হাঁদু, এখনো খোকা আছিস।
হাহাহা করে উভয়ের হাসি। এবার চা খেতে খেতে বলি, তোর কপালে সিঁদুরের ছোঁয়া নেয়, তাহলে কি তোর বর!
তা ছেলে মেয়ে কটি ?
কে বলেছে সিঁদুর নেই। এই দেখ চুলের ভিতরে। বাবা এত স্টাইল কপালে লাগাস না! নাকি এখনো দেখাস তুই একা!
এইলাল রং চল্লিশ বছর আগে লাগানো।
মনে করে দেখ পল্লব,সেই কালীঘাট মন্দিরে!
আমি বলি ,তোর কী লজ্জা!
আমি উত্তেজিত হয়ে বলি এই সাগর একটু অপেক্ষা কর!
থমথমে পরিবেশ!
এই সাগর এই রুমালটা চিনিস, সেই সিঁদুর মাখানো।
সাগর বলে পল্লব সরকার এখনো সযতনে রেখে দিয়েছিস!
আমি বলি সিঁদুর পরে তোর কী ভয়!সবে দুজনের কুড়ি বছর,স্টুডেন্ট তখন।
তারপর….
ভুল বোঝাবুঝি ব্রেক আপ!
সাতদিন রেগে ছিলাম। জানিস সাগরিকা তোদের বাড়িতে গেছিলাম। গিয়ে শুনি তোরা আসানসোল চলে গেছিস।
তারপর থেকে এই রুমালটা নিয়ে খাটে ঘুমাই।
আবার হাসি।
কিন্তু এ হাসিতে কান্না ছিল।
আমি গম্ভীর ভাবে বলি সাগরিকা তোর স্বামী কোথায়?
আর ছেলে মেয়ে আছে তো!
সাগরিকা প্রায় রেগে বলে,আচ্ছা পল্লব একবার বিয়ে হলে
আবার বিয়ে হয় বুঝি!
একা তুই আমাকে ভালোবাসিস, আমি বাসতাম না!
তার মানে এখনো তুই আমার !
ওই সিঁদুর আমার নামে পরিস।
দেখ সাগরিকা একদম বিশ্বাস হচ্ছে না।
দুজনে কান্নাকাটির আবেগে ভেসে চলি।
বর্তমানে দুজনেই অবসর প্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী।
সাগরিকা কোথায় থাকিস রে!
আপাতত আসানসোলের পাট চুকিয়ে কোলকাতাতে এসে ,ভাড়া বাসায় আছি।
এই পল্লব একটা ফ্ল্যাট খুঁজে দে না ।
পল্লব বলে এখানে চলে আয়।
তোর নতুন বাসা কিসের দরকার!
তা মন্দ হয় না,ভাড়া দিয়ে থাকি তো।তা তোকে ভাড়া দিয়ে থাকব।
আমি চাপা গলায় বলি বরের বাড়িতে ভাড়াটে হবি!
কিছু বললি রে পল্টু।
না রে এই বয়সে তোকে তো তুমি বলতে পারি না।
সাগরিকা বলে কেন বলা যাবে না, আমরা তো স্বামী স্ত্রী।
আমি বলি সমাজ কত কথা বলবে।
সাগরিকা বলে সমাজ!
আমি বলি চল রেজিস্ট্রি করে ফেলি।
আমি আনন্দে ভাসছি।
হঠাৎ সাগরিকা বলে এই আসি রে।
আমি কান্না জড়ানো গলায় বলি কাল আসবি তো ।
আজ থেকে যা না সাগর। তোকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।
পল্লব ঠিক বলেছিস একাকিত্ব জীবন বুঝলি।
আসি বলে সেই যে গেল।
আসলে কথায় কথায় দুজনের একে অপরের ফোন নম্বর নেওয়া হয় নি।
বুঝলাম পাখি ফুড়ুৎ।ও নিশ্চয় স্বামী পুত্র নিয়ে সংসার করছে।
আসলে দেখতে এসেছিল আমি কেমন আছি।
মনে মনে বলি বেশ তো ছিলাম,কেন এসে সংসার করার লোভ দেখিয়ে চলে গেলি!
এত বেইমান ভাবি নি।আজ ও তা ভাবি না, তোকে যে সাগরিকা আমার প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি।
তারপর কষ্টে তিন মাস ষোল দিন কেটে যায়।আসলে ও হয়তো স্বামী নিয়ে সংসার করছিল,আমার কাছে মিথ্যা অভিনয় করে গেছে।
তিনমাস ষোল দিন পর….
সাগরিকার আগমন।
আমার এখান থেকে বাড়িতে যাবার সময়,এক ভদ্রলোকের গাড়িতে ধাক্কা। তারপর ভদ্রলোকের তত্ত্বাবধানে হাত পা প্লাস্টার করে তার বাড়িতে ছিলেন। মাথায় চোট ছিল, আমার বাড়ির রাস্তাটা মনে করতে পারছিল না।
গতকাল আশ্রয়দাতা ভদ্রলোক একটা পরিবারের অ্যালবাম দেখতে দেন।
হঠাৎ ভদ্রলোকের অ্যালবাম দেখে সাগরিকা বলে-
আপনি পল্লবকে চেনেন?
পল্লবের ছবি আপনার ছবির সঙ্গে!
আমার বোন বলে, উনি তো আমার নিজের দাদা।
সদলবলে বোন বোনাই, সাগরের আবির্ভাব।
তারপর…..
বোনের সহায়তায় সাগরিকা ও পল্লবের যথারীতি ধুমধাম করে বিবাহ হয়। সবার যে বয়সে পঁচিশ বা পঁয়ত্রিশ তম বিবাহ বার্ষিকী হয়। তাঁদের প্রথম আনুষ্ঠানিক বিবাহ অনুষ্ঠান।
বুল ক্যানে বুড়ো ও বুড়ি হয়েছিক বল্যে হানিমুনটো হবেক লাই।সাগর তো কচি মেয়ার মুতন বায়না করছেক ,টঙ্কা আচ্ছেক ,বিদ্দেশটো যাব্বক ঘুইরতেক।
মালদ্বীপে আমি সাগরিকা বেড়াতে গেছি। ওই সবাই বলে না হানিমুন।
কুড়িতে বিয়ে একষট্টিতে হানিমুন।
এমনি করে যাক না দিন যাক না।
মুর বাউল মনটো কেঁদে কেঁদে বল্যেক
“মিল্লন হল্যো ইত্তদিন্যে
মুন্যের মানুষটোর সন্যে”
মিল্লন হল্যো ইত্তদিনে।
বিয়ের পর এক বছর শুধু বেড়াতে যাওয়া।
তারপর সাগরিকার হার্ট অ্যাটাক। দামামা বাজিয়ে প্রথম বলে আউট।
হায় রে আবার একাকিত্ব জীবন। দিনের বেলায় দুজনের মিলিত টাকা গোনা।রাতে সব তারাদের মাঝে সাগরিকাকে খোঁজ।
হয়তো ওখানে গিয়ে ‘নীহারিকা ‘নাম হয়েছে,আমার বোল্ড আওট হলে যাতে ওকে আসমানে খুঁজে না পাই।
যতই তুমি ‘নীহারিকা ‘হয়ে থাকো আমি ‘নক্ষত্র’ হয়ে ঠিক তোমাকে খুঁজে আকাশের বুকে ভেসে বেড়াবো। ঈশ্বর কবে যে আমার ডাক আসবে! সাগর এক বছরে আনন্দের সাগর পার করিয়ে গেছে।দিনের শেষে তার কথা ভাবতে ভাবতে নিদ্রা চলে আসে । এইভাবে আমার জীবন চলে যাচ্ছে।তবে বন্ধু খুঁজতে বাড়ি বিক্রি করে বৃদ্ধাশ্রমে আসা। এখানে বেশ লাগছে,মন্দ লাগছে না। আবার একটু বাঁচার আশা দেখছি।