শেষ বিকেলে
সবাই অবাক হয়ে যাবে । শুধু অবাক কেন নিন্দা- মন্দও কম হবে কিছু! ছি ছি করার লোকের তো আর অভাব নেই এ সংসারে! তবে কিনা আশ্চর্যের বিষয় হলো যে সাতান্ন বছর বয়সে কমলা প্রেমে পড়েছেন।তাও কিনা ফেসবুক করতে গিয়ে। সময় কাটাতে ফোনে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল বৌমা রমা, তা সেখানেই আলাপ! জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, রোমাঞ্চকর অনুভূতির
কথা ভাগ করে নিতে নিতে, দুজনের একাকীত্বের অনুভূতি কাটতে লাগলো। ভদ্রলোক থাকেন দুর্গাপুরে,সেখানেই কেটেছে চাকরি জীবন ,এখন অবসরের সময়। অকৃতদার মানুষ, রঙ তুলির আঁচড়েই সময় কাটিয়ে দেন তিনি।
কলকাতায় এলে মাঝে মধ্যে, দেখাও হয় বৈকি !
যে মানুষটা মাত্র দুবছর একসাথে কাটিয়ে তিরিশ বছর আগেই চলে গেছেন তার কথা মনে করে নিজের মনকে প্রতিরোধ করতে অনেক চেষ্টাও করেছিলেন , সময়ের বিবর্তনে সেই স্মৃতিগুলোও এতটাই ঝাপসা যে শেষ বিকেলের আলোটুকুকে আটকানো গেল না কোনোমতেই।
জীবনের অপরাহ্ন বেলায় রথীনবাবুর হঠাৎ আগমনে জীবনটাই আমূল বদলে গেছিল। বদলে যেতে থাকলেন ক্রমশ! এক জীবনেই যেন জন্মান্তরের অনুভূতি! প্রেমের কথা এতদিন কেবল শুনেই এসেছিলেন ,এখন টের পেলেন বুকের ভেতর কদম ফুল ফুটে ওঠার সৌরভ। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে সময় কাটতে লাগলো। পরিবর্তনটা চোখে পড়লো বৌমা রমার! তার চোখ এড়ানো বড়ো কঠিন। সে একদিন দুপুর বেলায় একটু একটু করে সমস্তটা জেনে নিল কবে, কেমন করে আলাপ, পরেই বা দেখা হতো কিভাবে।রথীনবাবুর সম্পর্কেও জানতে চাইলে বললেন কমলাদেবী রথীনবাবুর একাকীত্বের কথা, তার শিল্পী জীবনের কথা! বলতে বলতে দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল , বৌমা জিজ্ঞাসা করলো রথীনবাবুকে ছেড়ে থাকতে কমলাদেবীর কষ্ট হয় কিনা। চোখ নামিয়ে নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ !’ সবটুকু শুনে সাহস দিয়ে বলল রথীনবাবুর কাছে গিয়ে থাকতে । সেদিন রাতেই রমা স্বামীকে বললো ‘বাবার মৃত্যুর পর মা তোমাকে বড়ো করে তোলার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। তার অনেক ত্যাগ স্বীকারের মধ্য দিয়েই তোমার বড়ো হওয়ার রাস্তা প্রশস্ত হয়েছে। এখন সময় হয়েছে মায়ের নিজের জীবন নিয়ে ভাবার। মা তার জীবনে সঙ্গী খুঁজে পেয়েছেন। কারোর আপত্তি থাকার কথা নয়।’ ছেলে চুপ, মুখ দেখে মনের ভাব বোঝা কঠিন! ছেলের যে খুব একটা সম্মতি ছিল এমন নয় কিন্তু বৌমা ভারি বুদ্ধিমতী আর বিচক্ষণ।
পরদিন ছেলেও সম্মতি জানালো। বৌমা যাবে সাথে, রথীনবাবুর সাথে দেখা করতে চায় । যত্ন করে বৌমা ব্যাগ গোছাতে লাগলো। বাজারে গিয়ে কমলা রথীনবাবুর পছন্দের কটা জিনিসও চুপিচুপি কিনে আনে। আগামীকাল সকাল সাতটায় ট্রেন। সকাল দশটার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন। রথীনবাবুকে বলেছেন স্টেশনে আসতে।
কখন থেকে স্টেশনে ঠায় বসে আছেন,সময় কাটতেই চাইছে না।বারবার মোবাইল বের করে সময় দেখছেন আর মাঝে মাঝে একবার করে উঠে পায়চারি করছেন।
আরে দশটা বাজতেই দেরী আছে দেখছি। মাথা টাথা খারাপ হলো নাকি!নিজের মনেই হাসলেন, কমলার আসবার কথা শুনে তিনি এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন যে সময়টাও গুলিয়ে ফেললেন! পায়চারি করছেন আর ভাবছেন যা ঘটতে যাচ্ছে তাকি সত্যিই নাকি স্বপ্ন দেখছেন। তারপক্ষে যে কল্পনা করাও অসম্ভব ছিল।
দশটা পনেরোতে ট্রেনটা এসে থামলো । ট্রেন থেকে নেমে এদিকেই আসছে, পাশের মেয়েটিই বোধকরি বৌমা! কাছে আসতেই পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই আশীর্বাদ করলেন । আবার বলে কিনা ‘মাকে দিতে এলাম।’
বললেন রথীনবাবু-‘চলো বাড়ীতে,যদিও বড়োই অগোছালো ঘর আমার ।’ হাসছে বৌমা,বলল ‘না আজ নয়,এখুনি ফিরতে হবে। সবাইকে নিয়ে আসবো নাহয় আরেকদিন। ঘর গোছানো হোক মা তো এসেই গেলেন। ‘
ট্রেনে উঠে হাত নাড়ল রমা,ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। কমলাদেবীর দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলে বুকটা ভিজে যাচ্ছে ।