Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আপনার প্রশস্ত কাছারিঘরে উকিলবাবু শ্রীঅঘোরনাথ বসু মহাশয় বসিয়া আছেন। সম্মুখে টেবিলের অপর পার্শ্বে নারায়ণপুরের সুরেন্দ্রবাবু বসিয়া আছেন। টেবিলের উপর একরাশি মকদ্দমার কাগজপত্র রহিয়াছে; ব্যস্তভাবে দুইজনে তাহারি তদ্বির করিতেছেন।

কিছুক্ষণ পরে মুখ তুলিয়া সুরেন্দ্রবাবু বলিলেন, অঘোরবাবু, বোধ হয় এ মকদ্দমা আমি জিতিতে পারিব না।

অ। এখনো কিছুই বলা যায় না।

সু। বলা বেশ যায়। ঠিক বুঝিতেছি মকদ্দমা হারিতেই হইবে।

অ। কিন্তু হাইকোর্টের উপরও ত আছে?

সু। আছে, কিন্তু ততদূর যাইবার ইচ্ছা নাই।

অ। তবে কি মালপুরের বিষয়টা ছাড়িয়া দিবেন?

সু। না দিয়া আর উপায় কি?

অ। বিস্তর আয় কমিয়া যাইবে।

সু। হাঁ, প্রায় অর্ধেক কমিবে।

অঘোরবাবু মৌন হইয়া রহিলেন। মনে মনে বড় বিরক্ত হইয়াছিলেন, কারণ তিনিও বুঝিয়াছিলেন যে, সুরেন্দ্রবাবুর অনুমানই কালে সত্য হইয়া দাঁড়াইবে। এইসময় একজন ভৃত্য আসিয়া কহিল, বাহিরে একজন আপনার সহিত দেখা করিতে চান।

অঘোরবাবু তাহার পানে চাহিয়া বলিলেন, কে?

চিনি না। দেখে বোধ হয় কোন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত।

তবে বল্ গে যা এখন আমার সময় নেই।

কিছুক্ষণ পরে পুনর্বার সে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, তিনি যেতে চান না—বলেন বড় দরকার আছে।

অঘোরবাবু আরো একটু বিরক্ত হইলেন; কিন্তু সুরেন্দ্রবাবুর পানে চাহিয়া বলিলেন, এঘরেই ডাকিয়া পাঠাব কি?

ক্ষতি কি?

ভৃত্যকে তিনি সেইরূপ অনুমতি করিলেন। কিছুক্ষণ পরে একজন দীর্ঘাকৃতি গৌরবর্ণ ব্রাহ্মণ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গলদেশে যজ্ঞোপবীত, মস্তকে শিখা, কিন্তু কপালে ফোঁটাতিলক প্রভৃতি কিছুই নাই। অর্ধময়লা উত্তরীয় বসন, সাদা থান পরিধানে, পায়ে জুতা নাই—হাঁটু পর্যন্ত ধূলা উঠিয়াছে। দুজনেই চাহিয়া দেখিলেন। অঘোরবাবু বলিলেন, বসুন।

ব্রাহ্মণ অদূরে চৌকির উপর স্থান গ্রহণ করিয়া বলিলেন, উকিলবাবু অঘোরনাথ বসু মহাশয়ের—

আমারই নাম অঘোরনাথ।
ব্রা। তবে আপনার নিকটেই প্রয়োজন আছে। যা বলিবার এইখানেই বলিব কি?

অ। স্বচ্ছন্দে বলুন।

তিনি তখন উত্তরীয়-বস্ত্র হইতে একখানা কাগজ বাহির করিয়া বলিলেন, এ টাকা শুভদা দেবীকে কি আপনি পাঠাইয়াছিলেন?

অঘোরবাবু তাহা পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, হ্যাঁ, আমিই পাঠাইয়াছিলাম।

ব্রাহ্মণ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, হলুদপুরে হারাণ মুখুজ্যের বাটীতে শুভদা দেবীকে?

অ। হাঁ, তাই বটে।

ব্রা। কেন?

অ। মনিবের হুকুম।

ব্রা। মনিব কে?

অঘোরবাবু সুরেন্দ্রবাবুর পানে ঈষৎ কটাক্ষ করিয়া বলিলেন, তাহা বলিতে নিষেধ আছে।

ব্রা। তবে এ টাকা ফিরাইয়া নিন। যাঁহাকে ইহা পাঠাইয়াছিলেন, তিনি গ্রহণ করিবেন না, আপনাকে তিনি চিনেন না এবং সম্ভবতঃ আপনার মনিবকেও চিনেন না। আমাকে এখানে সমস্ত সংবাদ লইয়া নোটখানা ফিরাইয়া দিবার জন্য পাঠাইয়াছেন। আমরা মনে করিয়াছিলাম আপনি বুঝি ভ্রম করিয়া একজনের স্থানে আর একজনের নাম লিখিয়া ফেলিয়াছেন।

অঘোরবাবু হাসিলেন, বলিলেন, এতটা ভ্রম উকিলের হয় না।

ব্রা। না হোক, কিন্তু এখন প্রতিগ্রহণ করুন।

অ। তাহাও পারি না—মনিবের হুকুম ব্যতীত কিছুই করিব না।

ব্রা। তবে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া সংবাদ দিবেন, আমি অন্যদিন আসিয়া দিয়া যাব। তিনি উঠিতেছিলেন, কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ আপনা হইতেই বলিলেন, মহাশয়ের নাম?

আমার নাম সদানন্দ চক্রবর্তী।

সুরেন্দ্রনাথ চমকিত হইলেন। কিছুক্ষণ চাহিয়া বলিলেন, আপনি এখানে কোথায় আছেন?

স। কোথায় থাকিব এখনো স্থির করি নাই; বরাবর এখানেই চলিয়া আসিয়াছিলাম এবং সম্ভবতঃ আজই ফিরিয়া যাইব।

সুরেন্দ্রনাথ অঘোরবাবুকে বলিলেন, এখন যাই, রাত্রে আবার আসিব। তাহার পর সদানন্দর পানে চাহিয়া বলিলেন, আপনার সহিত আমার কিছু কথা আছে।

স। বলুন।

সু। এখানে নহে। আমার বাসা নিকটেই, আপত্তি না থাকে ত চলুন সেখানেই যাই—তথায় সমস্ত বলব।

সদানন্দর তাহাতে আপত্তি ছিল না; তখন দুইজনে গাড়িতে আসিয়া উপবেশন করিলেন। উপবেশনান্তে সদানন্দ কহিলেন, ইহার পূর্বে আপনাকে কখন দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না—কিন্তু—কিন্তু—আপনি আমাকে কখন দেখিয়াছিলেন কি?

সু। না, দেখি নাই। কিন্তু আপনাকে জানি।
স। কিরূপে?

সু। বাসায় চলুন—সেখানেই বলিব।

অল্পক্ষণ পরে গাড়ি বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল। সুরেন্দ্রবাবু বলিলেন, আমিও ব্রাহ্মণ, বেলাও অধিক হইয়াছে—আপনি এখানে আহার করিলে ক্ষতি কি?

কিছু না।

তাহার পর আহারাদি শেষ করিয়া উভয়ে উপবেশন করিলে সুরেন্দ্রবাবু বলিলেন, শুভদা দেবী দরিদ্র নয় কি?

স। দরিদ্র বটে; কিন্তু তাই বলিয়া—

সু। বুঝিয়াছি। তাই বলিয়া দান লইবেন কেন?

স। কতক তাই বটে; বিশেষ দাতার নাম না জানিতে পারিলে—

সু। কিন্তু তাহাতে ক্ষতি কি? যে দান করিয়াছে, সে-ই বলিতেছে, ভুল-প্রমাদ কিছুই ঘটে নাই। যোগ্য ব্যক্তিকেই দেওয়া হইয়াছে।

স। কে দান করিয়াছে?

সু। ধরুন, এখন অঘোরবাবুই—

স। অঘোরবাবুর কি অধিকার আছে?

সুরেন্দ্রবাবু ঈষৎ অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, কিন্তু দান করিতে সকলেরি অধিকার আছে।

স। থাকিতে পারে, কিন্তু সকলেই গ্রহণ করে কি?

সু। করে না; কিন্তু যাহার চলে না সে?

সদানন্দ ঈষৎ বিরক্ত হইল; বলিল, শুভদা দেবীর এরূপ ভিক্ষা না লইলেও চলে।
সু। আজকাল বোধ হয় চলে, কিন্তু কিছুদিন পূর্বে চলিত কি?
স। সেকথার প্রয়োজন কি? আর আপনি এত জানিলেন কিরূপে?
সু। আমি অনেক কথা জানি। হারাণবাবু উপার্জন করেন না—অধিকন্তু আনুষঙ্গিক নানা দোষ আছে—যে আপনার স্ত্রী-পুত্র- পরিবার প্রতিপালন করে না, তাহার সংসার পরের সাহায্য ব্যতীত চলে কি?
সদানন্দ কিছু গোলমালে পড়িল, উপস্থিত কোনরূপ উত্তর করিতে পারিল না।
সুরেন্দ্রবাবু পুনরায় কহিলেন, হারাণবাবু এখন কি করেন?
স। কিছু না।
সু। বুঝিয়াছি। আপনার সাহায্যে তবে তাঁহার সংসারযাত্রা নির্বাহ হয়?
স। ভগবান সাহায্য করেন—আমি দরিদ্র।
সু। ছলনার বিবাহ হইয়াছে?
স। হইয়াছে।
সু। কোথায়? কাহার সহিত?
স। আমাদের গ্রামেই। শারদাচরণ রায়ের সহিত।
সু। মাধব কেমন আছে?
স। সে বাঁচিয়া নাই—অনেকদিন মরিয়া গিয়াছে।
সু। আহা! তাঁর বড় মেয়েটি এখন কোথায়?
সদানন্দ বিস্মিত হইয়া বলিল, কোথায় কিরূপ? সেও ত বাঁচিয়া নাই।
সু। বাঁচিয়া নাই? মরিল কিরূপে?
স। গঙ্গাজলে আত্মহত্যা করিয়াছিল।
সু। কেমন করিয়া জানিলেন? মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল কি?
স। মৃতদেহ ভাসিয়া উঠে নাই; কিন্তু তাহার পরিধেয় বস্ত্র গঙ্গাতীরে পাওয়া গিয়াছিল—তাহাতেই বোধ হয় আত্মহত্যা করিয়াছে। সু। সে বিষয়ে আর কাহারো সন্দেহ নাই?
স। কিছু না।
কিছুক্ষণ দুইজনেই চুপ করিয়া রহিলেন; তাহার পর সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, আচ্ছা, মনে করুন, যদি এ-টাকা সে-ই পাঠাইয়া থাকে?
স। কে? ললনা?
সু। ললনা কে? তার নাম কি ললনা ছিল?
স। হাঁ।
সু। আমি বিস্মৃত হইয়াছিলাম, ললনাই বটে! ললনা, ছলনা দুই বোন,—না?
স। হাঁ।
সু। মনে করুন দেখি, যদি সে-ই এ টাকা পাঠাইয়া থাকে?
স। যে মরিয়াছে, সে?
সু। হাঁ, সে-ই। গঙ্গাতীরে তাহার বস্ত্র পাওয়া গিয়াছিল বলিয়াই যে সে মরিয়াছে, তাহার কোন নিশ্চয়তা নাই। এখন যদি সে-ই পাঠাইয়া থাকে?

সদানন্দ বড় বিহ্বল হইল। কিছুক্ষণ অধোবদনে ভাবিয়া বলিল, সে বাঁচিয়া নাই; বাঁচিয়া থাকিলে পত্র লিখিত।

সু। পত্র লিখিতে যদি তাহার লজ্জা বোধ হয়?

স। আমি ললনাকে জানি। লজ্জার কাজ কখনো সে করিবে না—জীবিত থাকিয়া কখনো আত্মগোপন করিবে না!

সু। সে মরে নাই—বাঁচিয়া আছে; সে-ই টাকা পাঠাইয়াছে এবং প্রতি মাসে পাঠাইবে।

সদানন্দ আপনার কপাল টিপিয়া ধরিয়া বলিল, আপনার নাম?

সুরেন্দ্রনাথ রায়।

নিবাস?

নারায়ণপুর।

স। আপনি হারাণবাবুর এত কথা কি করিয়া জানিলেন?

সু। ললনা বলিয়াছে।

স। ললনা বলে কেউ নাই—সে মরিয়াছে।

সু। মরে নাই—সে সুখে আছে।

স। সে স্বর্গে গিয়াছে—

সুরেন্দ্রবাবু চিৎকার করিলেন, সদানন্দবাবু, আর একটু দাঁড়ান—

আমি যাই—

দাঁড়ান—আর দুটো কথা—

যদি কখন দেখা হয় বলিবেন, সদাদাদা তাহাকে অনেক অনেক আশীর্বাদ করিয়াছে—

তাঁর মাকে বলিবেন—

হাঁ—স্বর্গে গিয়াছে।

সদানন্দ ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। আর ফিরিল না—আর বসিল না।

সে চলিয়া গেলে সুরেন্দ্রনাথ বহুক্ষণাবধি নির্বাক নিস্তব্ধ বসিয়া রহিলেন। কিছু দিবস পূর্বে হইলে বোধ হয় এখন হাসিতেন, কিন্তু আজ চক্ষুকোণে জল আসিয়া পড়িল। এইসময় বাহিরে ভৃত্য ডাকিয়া বলিল, বাবু, গাড়ি সাজাবে?

হাঁ, সাজাও।—ছিঃ ছিঃ—এমন বিষও মানুষ ইচ্ছা করিয়া খায়!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress