Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

কাঁশীধামে মৃত্যু হইলে হিন্দুদিগের বিশ্বাস যে শিবলোক প্রাপ্ত হওয়া যায়। তাই সদানন্দের পিসিমাতা কাশী যাইলেন, কিন্তু আর ফিরিলেন না। সদানন্দ, পুণ্যশরীরা পিসিমাতার দেহ বারাণসী ধামে গঙ্গাবক্ষে দাহ করিয়া চির-শিবলোকবাসের সুব্যবস্থা করিয়া হলুদপুরে ফিরিয়া আসিলেন।

শূন্য বাটীতে অনেক রাত্রে প্রবেশ করিয়া সদাপাগলা নিজ হস্তে দুটো সিদ্ধ করিয়া ভক্ষণ করিল। একবার মনে করিল তখনই হারাণবাবুর বাটীতে গিয়া সমস্ত সংবাদ লইয়া আসিবে, কিন্তু অত রাত্রে দেখাশুনার সুবিধা না হইতে পারে মনে ভাবিয়া শয্যা প্রস্তুত করিয়া শয়ন করিল। কাশী থাকিয়া সে হারাণবাবুর দুশ্চরিত্রের কথা, শুভদার দুরদৃষ্টের কথা, ললনার হতভাগ্যের কথা মনে করিত; রোগের সেবা করিতে করিতে নিতান্ত ব্যস্ত থাকিয়াও সে উহাদিগকে ভুলিতে পারিত না। মধ্যে একবার পত্র লিখিয়া সংবাদ অবগত হইয়াছিল, কিন্তু তাহার পর আর কোন পক্ষেই পত্রাদি লিখেন নাই—সদানন্দও তাই প্রায় একমাসকাল কোন সংবাদ জানিতে পারে নাই। দেশে ফিরিয়া আসিয়া সে সেইসব কথা মনে করিতে লাগিল।

অনেক রাত্রি পর্যন্ত বিনিদ্র থাকিয়া, চালাঘরের বাতার পানে শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিয়া মনে করিতে লাগিল, মেঘের উপর পদ্মফুল ফুটে কি না? ললনা বলিয়াছিল, মাটি ভিন্ন ফুল ফুটে না—সে কথা সঙ্গত কি না? আর একথা যে বলিয়াছিল, সে কেমন করিয়া জানিল মেঘের উপর পদ্ম ফুটিতে পারে না? যাহা হউক রাত্রিশেষে ঘুমাইয়া পড়িবার পূর্বে সদানন্দ স্থির করিয়া ফেলিল যে, উপরে পদ্ম ফুটিতে পারে, কিন্তু ফুটিয়া অনেকদিন থাকিতে পারে না, শুকাইয়া যাইবারই অধিক সম্ভাবনা—শুষ্ক হইয়াই যাইতেছে বোধ হয়।

পরদিন শ্রীমান সদানন্দ চক্রবর্তী ফুল, বেলপাতা, বিশ্বেশ্বরের প্রসাদী ইত্যাদি বহু দ্রব্য হস্তে লইয়া একেবারে হারাণবাবুর বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইল।

প্রবেশ করিয়া সম্মুখেই শুভদাকে দেখিতে পাইল। শুভদা উঠান ঝাঁট দিতেছিল; খ্যাংরাটা নীচে ফেলিয়া দিয়া, মাথার কাপড়টা একটু টানিয়া দিয়া শুভদা মৃদুস্বরে বলিল, কবে এলে সদানন্দ?

কাল রাত্রে।

সকলে ভাল আছেন?
সদানন্দ দুঃখিতভাবে অল্প হাসিয়া বলিল, সকলের মধ্যে ত পিসিমা; তিনি কাশীতেই স্থান পেয়েচেন।

শুভদা ভাল বুঝিতে পারিল না, বলিল, কি পেয়েচেন?

পিসিমাতার কাশীতেই মৃত্যু হয়েচে।

শুভদা একথা জানিত না; তাহার এক শোকে আর এক শোক উথলিয়া উঠিল। শুভদা কাঁদিতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ পরে বলিলেন, বাবা, ললনাও নাই।

সদানন্দ বিস্মিত হইয়া কহিল, নাই? কোথায় গিয়াছে?

শুভদা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, কোথায় আর যাইবে—বাছা সংসারের দুঃখেকষ্টে আত্মঘাতী হয়েচে। পাঁচদিন হল গঙ্গার তীরে তার পরনের কাপড়টি পাওয়া গেছে। শুভদা ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিলেন।

সদানন্দও চক্ষুর জল মুছিল, কিন্তু একফোঁটা কিংবা দুইফোঁটা মাত্র। তাহার পর শুভদা যতক্ষণ না শান্ত হইলেন ততক্ষণ স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। শুভদা শান্ত হইলে বলিল, কিছু বলে যায়নি?

কিছু না।

হারাণকাকা কোথায় আছেন?

শুভদা চক্ষুর জল মুছিয়া বলিল, বলিতে পারি না। কখন কখন বাটীতে আসেন বটে।

তিনি এখন কি করিতেছেন?

তাও জানি না।

মাধব কেমন আছে?

পূর্বের মত।

আর সকলে?

ভাল আছে।

সদানন্দ উঠিতেছিল। শুভদা বলিল, তোমার ওখানে রাঁধবে কে?

আমি নিজে।

শুভদা একটু চিন্তা করিয়া বলিল, এখানে খেলে হয় না?
হবে না কেন? কিন্তু তার দরকার কি, রাঁধতে আমার কোন কষ্ট হবে না।
তা হোক, তুমি এখানে খেয়ো।
সদানন্দ একটু ভাবিয়া বলিল, কিন্তু আজ নয়। আজ পিসিমার তর্পণ করতে হবে।
শুভদা ভাবিল, তা হবেও বা, তাই কোন কথা আর বলিল না।

সদানন্দ বাটী আসিয়া একটা ঘরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া মৃত্তিকার উপর শুইয়া পড়িল। তখন বেলা আটটা বাজিয়াছিল, পরে যখন ভূশয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিল তখন রাত্রি আটটা বাজিয়া গিয়াছে—জ্যোৎস্না রাত্রি ফুটফুট করিতেছে; সদানন্দ বাহিরে আসিয়া একটা বাগান পার হইয়া শারদাচরণের বাটীর পশ্চাতে একটা জানালার নিকট দাঁড়াইয়া বহুক্ষণ চাহিয়া রহিল; চাহিয়া চাহিয়া ডাকিল, শারদা !

শারদা গৃহে ছিল, সদানন্দর ডাক শুনিতে পাইল। জানালার নিকট আসিয়া বলিল, কে?
সদানন্দ বলিল, আমি।
কে—সদানন্দ?
হাঁ।
কবে এলে?
কাল রাত্রে।
এদিকে কেন? চল, বৈঠকখানায় গিয়া বসি।
না, ওদিকে যাব না, তুমি এখানেই এস।
শারদাচরণ নিকটে আসিলে সদানন্দ বলিল, ললনা মরেছে তা জান কি?
শারদাচরণ বিষণ্ণভাবে কহিল, জানি।
কেন মরিল কোন সংবাদ রাখ কি?
না তবে বোধ হয় সাংসারিক দুঃখেকষ্টে আত্মঘাতী হইয়াছে।
সদানন্দ তাঁহার পানে তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখিয়া বলিল, আর কিছু জান না?
কিছু না।

সদানন্দর তীক্ষ্ণদৃষ্টি তীক্ষ্ণতর করিয়া বলিল, তুমি পাষণ্ড। সাংসারিক দুঃখকষ্টে একজন মরিতে পারে, আর তুমি সম্মুখে থাকিয়া একটু সাহায্য করিতে পার না?

সদানন্দর ভাবভঙ্গি দেখিয়া শারদাচরণ একটু সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল। তাহার কারণও ছিল; সে এবং সদানন্দ বাল্যসুহৃৎ, উভয়ে উভয়কে বহুদিন হইতে চিনিত। শারদার ছেলেবেলার কথা সদানন্দ সমস্ত অবগত ছিল এবং সেইজন্যই যে আজ তাহাকে কথা শুনাইতে আসিয়াছিল, সদানন্দর সে প্রকৃতি নহে; কিন্তু শারদা অন্যরূপ ভাবিয়া লইল। সে মনে করিল, সদানন্দ ছেলেবেলার সেইসব লইয়া দুটো কথা শুনাইয়া দিতেছে; তাই একটু ভাবিয়া চিন্তিয়া কহিল, সদানন্দ, সে সকল কথায় এখন আর ফল কি? আরো মনে করে দেখ, আমার পিতা জীবিত রহিয়াছেন, তাঁর বর্তমানে ইচ্ছা হইলেই কি আমি যাকে ইচ্ছা তাকে সাহায্য করিতে পারি? বিশেষ সে আমাকে কিছুই বলে নাই।

সদানন্দ বিস্মিত হইল। কহিল, কিছুই বলে নাই? কিছুই বলিতে আসে নাই?

সম্প্রতি নহে; তবে অনেকদিন পূর্বে একবার আসিয়াছিল।

কি জন্য? কোথায়?
শারদাচরণ বলিল, বলিতেছি। বলিল, প্রায় মাসখানেক পূর্বে অনেক রাত্রে, আমাকে ঐ শিবমন্দিরে আসিতে অনুরোধ করিয়াছিল; আমার যাইবার ইচ্ছা না থাকিলেও গিয়াছিলাম—
সদানন্দ রুদ্ধকণ্ঠে কহিয়া উঠিল, যাইবার ইচ্ছা ছিল না?
শারদা ম্লানমুখে বলিল, আর কেন ভাই!
সদানন্দ সেকথা শুনিল না, বলিল, তারপর?
তারপর বিবাহ করিতে অনুরোধ করিয়াছিল।
কাহার সহিত?
তাহার নিজের সহিত।
নিজের? ললনার সহিত? তুমি কি বলিলে?
শারদা আপনার বাল্যকথা স্মরণ করিয়া বড় লজ্জিত হইল; কতকটা অপ্রস্তুত হইয়া বলিল, আমি—আমি—তা কি করিব বল? বাবা এখনো বাঁচিয়া আছেন।
সদানন্দ কতকটা ক্রোধে, দুঃখে, কতকটা মনের আবেগে বলিয়া ফেলিল, তোমার বাবার বাঁচিয়া কি লাভ?
এইবার শারদাচরণ কুপিত হইল। পিতার সম্বন্ধে কোন কথা তাহার সহিত না; বলিল, লাভালাভের কথা তিনি ভাল জানেন। আমাদের এবিষয়ে বিচার করিবার কোন অধিকার নেই—ভালও দেখায় না। যা হউক, আমি বলিলাম, তোমাকে বিবাহ করিতে পারিব না।
সে চলিয়া গেল?
না, তখনও চলিয়া যায় নাই; ছলনাকে বিবাহ করিতে বলিল।
তুমি স্বীকার করিলে না?
শারদাচরণ সদানন্দর মুখ দেখিয়া এবং তাহার মনের কথা অনুমান করিয়া অল্প হাসিয়া বলিল, অস্বীকারও করি নাই; বলিয়াছিলাম পিতার মত হইলে করিতে পারি।
সদানন্দ বলিল, পিতার মত হইল না?
না।
কেন?
বলিবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু বলিতেছি শুন; বাবার ইচ্ছা আমার বিবাহ দিয়া কিছু অর্থ লাভ করেন—হারাণবাবু কি তাহা দিতে পারিতেন?
সদানন্দ সে কথা শুনিয়াও যেন শুনিল না; বলিল, তোমার পিতা কি আশা করেন?
আমি বলিতে পারি না।
অর্থের আশা পূর্ণিত হইলে আর কোন আপত্তি হইতে পারে কি?
সম্ভবতঃ নহে।
তোমার নিজের কোন আপত্তি নাই?
কিছু না।
তবে দেখা যাউক, বলিয়া সদানন্দ পুনর্বার বনবাদাড় ভাঙ্গিয়া ফিরিয়া চলিল।
শারদাচরণ বলিল, কোথায় যাও? একটু বসিবে না?
না।

সদানন্দ, আমার কোন দোষ নাই।

বোধ হয় নাই—ভগবান জানেন—আমি বলিতে পারি না।

রাগ করিলে?

না।

সদানন্দ বাটী ফিরিয়া আসিয়া কিছুক্ষণ এঘর ওঘর করিয়া বেড়াইল, তাহার পর পুনরায় বাহির হইয়া আসিল। পথ বাহিয়া গঙ্গাপানে চলিল। ভাগীরথীর ছোট ছোট ঢেউ বাঁধাঘাটের সোপানে ঝলমল ছলছল করিয়া ঘাত-প্রতিঘাত করিয়া সরিয়া যাইতেছে আবার ফিরিয়া আসিতেছে, সদানন্দ কিছুক্ষণ সেইগুলি দেখিতে লাগিল; দূরে একখানা বজরা ছপ্‌ছপ্‌ করিয়া দাঁড় ফেলিয়া প্রশান্ত গঙ্গাবক্ষে ভাসিয়া আসিতেছে, সদানন্দ অন্যমনে কিছুক্ষণ তাহার পানে চাহিয়া রহিল, তাহার পর ঘাটের সর্বনিম্ন সোপানের উপর বসিয়া জলে পা ডুবাইয়া আপনার মনে আকাশপানে চাহিয়া গান ধরিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress