শুধু কবিতাই পারে
রাজনীতি যেখানে কোটি কোটি মানুষকে দুনিয়া থেকে স্রেফ মুছে ফেলতে চায়, তাকে নিয়ে ইয়ার্কি মারা যায় কি না, সে ব্যাপারে তর্ক চলতেই পারে ( যেটা চার্লি চ্যাপলিন ‘ গ্রেট ডিরেক্টার’-য়ে করেছেন। একজায়গায় দাঁড়িয়ে চ্যাপলিন হিটলার আর মুসোলিনির আদলে একটা হিংকেল আর একটা নাপালোনিকে নিয়ে আসছেন। এবং দর্শকের সামনে প্রমাণ করে দিচ্ছেন, চেয়ারের লিভার ঘুরিয়ে দু’জন দুজনকে ছাড়িয়ে যতই ওপরে ওঠার চেষ্টা করুক না কেন, ডিক্টেটররা আসলে নেহাতই খাটো মাপের লোক। ভিতু, মেগালোম্যানিয়াক। পৃথিবীসুদ্ধ লোককে ভয় খাওয়ানো মহান ডিক্টেটরবাবু বেলুনের গ্লোব নিয়ে লোফালুফি খেলতে খেলতে যখন ফটাস করে ফাটিয়ে ফেলে, তখন ছোট বাচ্চাদের মতোই ফ্যাঁচফ্যাঁচ ফোঁতফোঁত করে কান্না জোড়ে। চ্যাপলিন তো এটাই চাইতেন! ক্ষমতাকে যতটা পারো, হাস্যকর, ল্যাজে-গোবরে, ভাঁড় বানাও! ওর ফোলানো-ফাঁপানো পাবলিক ইমেজের হাওয়া বের করে দাও! চ্যাপলিনের ভাষায়: ‘দ্য বিগার দ্যাট ফেলো গেট্স, দ্য হার্ডার মাই লাফটার উইল হিট হিম।’) তবে গোদার যখন ‘আল্ফাভিল’ ছবিটায় একটা স্বৈরাচারী ব্যবস্থার মহড়া দেন, তখন কোথাও কোনও ফাজলামির ব্যাপার থাকে না। বরং সায়েন্স ফিকশন, স্পাই থ্রিলার ইত্যাদি হলিউডের নানা রকম ফর্মুলা মশলা ঘেঁটেঘুঁটে শেষ অবধি গোদার যে পদটা বানান, সেটা একদম তাঁর নিজের ঘরানার কালো কুটকুটে কমেডি। আল্ফাভিল আসলে ভিন-গ্যালাক্সির একটা তারা। ‘আলফা-সিক্সটি’ নামে একটা সুপারকম্পিউটার সেখানকার সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই কম্পিউটারটা যিনি বানিয়েছেন সেই প্রফেসর ফন ব্রাউনই বকলমে এখানকারই শাসক। ফন ব্রাউনের নিজের দেশে হাসি , কান্না, প্রেম – এ সব ফালতু আবেগের কোন স্থান নেই। স্ত্রীর মৃতদেহের সামনে বসে চোখের জল ফেলাও মানা। কেউ ফেললে পরে তাকে গুলি করে মেরে, ঝকঝকে সুইমিং পুলের টলটলে অ্যান্টিসেপ্টিক জলে ফেলে দেওয়া হয়। এখানে সব কিছুই যুক্তির নিয়মে চলে। অভিধান থেকে প্রতিদিন পুরনো অকেজো শব্দ বাতিল করে কম্পিউটার তার মর্জি অনুযায়ী নতুন নতুন শব্দ যোগ করে। ‘গ্র্যান্ড ওমেগা মাইনাস’ নামে যন্তর-মন্তর ঘরে লোকদের ধরে নিয়ে গিয়ে মগজধোলাই করে,তাদের অন্যগ্রহে বন্ধ, হরতাল, বিপ্লব ইত্যাদি ঝামেলা পাকাতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
অনেকটা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘লাল সাম্রাজ্য’র মতো মনে হচ্ছে তো? আসলে একনায়কতন্ত্র পার্টিই হোক কিংবা কম্পিউটার, তার মোডাস অপারেন্ডি প্রায় একই রকম! মানুষের মগজ দখল করাটাই প্রথম লক্ষ্য। তাই এদের মোকাবিলাটাও মগজ দিয়েই করতে হয়। এখানে প্রফেসর ব্রাউন আর তার কম্পিউটার-রাজ খতম করতে যে সিক্রেট এজেন্টটি আল্ফাভিল-এ পা রাখেন, একেবারে বন্ড-মার্কা এই লোকটি ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই করে পিস্তল চালাতে পারেন , সুযোগ পেলেই মেয়েমানুষের স্বাদ নিতেও ওস্তাদ, কিন্তু ‘আলফা-সিক্সটি’র সঙ্গে এনকাউন্টারে তার হাতিয়ার কবিতা! হ্যাঁ, কবিতা। কারণ, যুক্তি আর কার্য-কারণ বিশ্লেষণ দিয়ে সাজানো সুপারকম্পিউটারের প্রোগ্রাম-ভুবনে সেটা একেবারেই ‘ফোরেন মাল’! আবেগ-ফাবেগ, অনুভূতি-টনুভূতি, কী সব আজেবাজে অচেনা জিনিসে ভরা! সেই শত্রুকে বুঝে ওঠাই যেখানে অসম্ভব ‘আলফা-সিক্সটি’-র পক্ষে,সেখানে তার মোকাবিলা করারও তাই প্রশ্ন ওঠে না। ফলে তার সুপার-সিস্টেম পুরো ঘেঁটে-গুলিয়ে একশা হয়ে যায়। কম্পিউটারজী দেহ রাখেন। সেই বীর এজেন্টও প্রফেসর ব্রাউনের নাতাশাকে উদ্ধার করে ‘আউটল্যান্ড’-এর মুক্ত বিশ্ব, থুড়ি গ্যালাক্সির দিকে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে যায়। আর ‘প্রেম’ শব্দের মানেই না বোঝা নাতাশাও যেতে-যেতে পথে গেয়ে ওঠে ‘আই লাভ ইউ’ ।
‘আল্ফাভিল’-এর সঙ্গে চট করে এক নজরে আমাদের চেনা যে ছবিটার খানিকটা মিল পাওয়া যায়,তার নাম ‘হীরক রাজার দেশে’। ওমেগা মাইনাস-এর মতো এখানেও ‘মস্তিষ্ক প্রক্ষালক যন্ত্র’, মগজধোলাইয়ের দৌরাত্ম্য। তবে ওই যন্ত্র আর তার মগজধোলাইয়ের মন্ত্রের কোনও মিল নেই। যন্ত্রের স্রষ্টা ‘বৈজ্ঞানিক’ও আপাদমস্তক পেশাদার, তার কোনও দল নেই। তাই গুপি-বাঘা তাকে হাত করে ওই যন্ত্রে রাজার মন্ত্র পুরে দিতে পারে! এবং ফ্যাসিস্ট রাজা ও তার গোটা পুতুল-ক্যাবিনেটের মগজধোলাইয়ের পর সব্বাই মূর্তির মাঠে জড়ো হয়। আর জনগণের সঙ্গে হাত মিলিয়েই রাজা ‘দড়ি ধরে মারো টান’ বলে নিজেই নিজের মূর্তি ভেঙে খানখান করেন।
‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এর শেষে হিংকেল-এর জায়গায় তার ডুপ্লিকেট ইহুদি নাপিত শাসকের মঞ্চে উঠছে। কিন্তু আগের ডিক্টেটরের ওই লাফঝাঁপ, হুংকার, নাটকের বদলে সে নরম গলায় ধীরে ধীরে সাধারণ লোকের আশা, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষার কথা বলে। মাত্র তিনটে শটে ক্যামেরার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে প্রায় ছ’মিনিটের সে বক্তৃতা কবিতার মতোই শোনায়। আর ‘আল্ফাভিল’-এ সিক্রেট এজেন্ট তো কবিতার ধাঁধাতেই স্বৈরাচারের বারোটা বাজায়। কিন্তু একনায়ক শাসকের নিজেরই মগজধোলাই হয়ে যাচ্ছে, এই আইডিয়ার জুড়ি নেই! নিজের মূর্তি টেনে নামানোর জন্য ফ্যাসিস্ট নায়কের হাতে দড়ি ধরিয়ে দেওয়াটা স্যাটায়ার হিসেবে মাস্টারস্ট্রোক, যেটা শুধু এক জন মাস্টারই দিতে পারেন। তিনি সত্যজিৎ রায়!
————————————–
[ তথ্যসূত্র- অন্তর্জাল। ]