শুক্রগ্রহ (সাহিত্যরসে আকাশ বিজ্ঞান ও পুরাণ)
দিন কতক আগে ঊষাকালে পুব আকাশে দেখলাম, আমার অতি প্রিয় “শুকতারা” কে।
সেই ছোট্ট বেলার “সন্ধ্যাতারা ” ও “শুকতারা “। কৌতুহলি মন তখন থেকেই জানতাম, ঐ দুটি তারা, আসলে একটিই গ্রহ, নামটি যার শুক্র। তারপর আরও অনেক অনেক কথা। শুক্রগ্রহ বা ভেনাস ত কবি ও বিজ্ঞানীর এক মনটানা আকর্ষণ —- সূর্য ডোবার পর বা সূর্য ওঠার আগে পশ্চিম বা পুব আকাশে যখন সে আকাশ কালো, দেখা যায় তাদের এক স্বল্প কালীন মস্ত বড়ো এক জ্বলজ্বল জ্যোতিষ্করূপে , হ্যাঁ আমাদের কাছে রাতেরবেলা চাঁদের পর দ্বিতীয় উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হলো শুক্র । চাঁদের মতোই যার আলো স্থির, কারণ তার আলোও সূর্যের কাছ থেকে ধার করা, নক্ষত্রের মতো নিজস্ব বহ্নিপ্রভ নয় যে মিটমিট করবে। অদ্ভুত এক রহস্য লুকিয়ে আছে ঐ শুক্র গ্রহে। যেমন বিজ্ঞান তত্ত্বে, তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পুরাণ শাস্ত্রেও। আর কবিরা, চাঁদের মতো কত না গান কবিতার সৃষ্টি করেছেন ঐ রূপবতী গ্রহকে নিয়ে, কই , এমন ত দেখা যায় নি লাল গ্রহ মঙ্গল বা ছোট্ট বুধ বা বলয়যুক্ত শনি অথবা বৃহৎ বৃহস্পতি গ্রহ ছুয়ে !!! প্রথমেই বলি, এই শুক্রগ্রহের এক বিশেষ স্থান আছে, Astrology, Astronomy, Cosmology তে, বৈশিষ্ট্যময় বলে। পৃথিবীর এই নিকট প্রতিবেশী , রাতের দ্বিতীয় উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক শুক্রগ্রহ নিয়ে বিজ্ঞান জানিয়েছে, অবাক করা কিছু তথ্য। যেমন, কয়েকটি
১) সব সৌর গ্রহের আহ্নিক গতি নির্দেশ হলো— anti clockwise কিন্ত, একমাত্র শুক্র ও ইউরেনাস হলো বিপরীত , আহ্নিক গতি অর্থাত নিজের axis এ ঘোরে —clockwise পৃথিবী ঘোরে ত anticlockwise—পশ্চিম থেকে পূর্বে, সূর্য কে দেখি তাই, পূর্ব থেকে পশ্চিমে যেতে। কিন্ত শুক্র যেহেতু ঘুরছে clockwise, সে চলছে আমাদের উল্টো ,তাই জন্য দিনে সে আকাশে থাকে সূর্যের আশেপাশে, শুধুমাত্র দেখা যায় তাকে সূর্যাস্তের ঠিক পরে ও সূর্যোদয়ের ঠিক আগে— সন্ধ্যাতারা ও শুকতারা তবে যেদিন সন্ধ্যাতারা দেখা যায়, তার পরদিন শুকতারা দেখা যায় না। শুক্র গ্রহে অবস্থান করলে, দেখা যাবে সূর্য উঠছে পশ্চিমে , অস্ত যাচ্ছে পূর্বে। তবে সকাল থেকে দিন সময় নেবে কত? পরে আসছি সে কথায়।
২)
সকল গ্রহরেরই ত নিজস্ব কোন আলো নেই,আলোকিত হয়, রবিরশ্মিতে—- কিন্ত একমাত্র শুক্রগ্রহের ছায়াও দেখা যায় তার পাশে, এবং তা খালি চোখেই, তবে তা কদাচিৎ, আমার দেখবার সৌভাগ্য এখোন হয় নি।
৩)
আরও একটি মজার ব্যাপার, শুক্র গ্রহের দিন রাত্রি পৃথিবীর দিন রাত্রির চেয়ে অনেক বড়ো পৃথিবীর ২৪৩ দিন রাত্রি— শুক্রের এক দিনরাত্রি। অথচ সূর্যকে প্রদক্ষণ করতে বা বার্ষিক গতি পৃথিবীর চেয়ে কম। পৃথিবীর৩৬৫/৩৬৬ দিন অথচ শুক্রের লাগছে ২২৪.৭ দিন। আহ্নিক গতি বার্ষিক গতির চেয়ে বেশি ,শুক্রগ্রহে বছরের চেয়ে দিন বড়ো, এমনটি আর কোন সৌরগ্রহে নেই। অর্থাত, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত হতে সময় লাগবে শুক্রের ২৪৩ দিন।
৪)
না , বুধ ও শুক্র গ্রহের কোন উপগ্রহ নেই, রাতের আকাশে শুক্র গ্রহে থাকলে দেখা যাবে , প্রতিদিন অমাবস্যার তারা ঝিলমিল আকাশ।
৫)
কিন্ত কে যাবে, কোন প্রাণী কোনদিন সম্ভব হলেও ঐ রূপসী গ্রহে গিয়ে টিকে থাকতে পারবে কি? উত্তর — একেবারেই না। শুক্র ও পৃথিবী কে বলা হয় twin মানে যমজ বোন— প্রায় একই আকার একই ভর আর [they are paired about their opposite spins (chemical electronic pair)] কিন্ত, প্রাণী থাকবে কি করে? উগ্র তাপমাত্রার (370 ⁰ Celsius) দরুণ, সব সমূদ্র শুকিয়ে সব খটখট ,আবহাওয়ায় আছে অল্প মাত্রায় বাষ্প আর নাইট্রোজেন আর বেশিরভাগ কার্বন ডাই অক্সাইড যা প্রচন্ড ভারী ও গভীর , সে মেঘ ভেদ করে সূর্য রশ্মি প্রবেশ করতে পারে ভেতরে, মাত্র 3%। আবহাওয়া অম্লপ্রধান , অধিক পরিমাণ সালফিউরিক অ্যাসিড গ্যাস যা প্রতিফলিত হয়ে শুক্রকে করেছে বর্ণছটার রূপসী। শুক্রগ্রহকে ঢেকে রেখেছে, ঐ অ্যাসিড ও কার্বন- ডাই- অক্সাইড গ্যাস এক রঙ্গীন বর্ণছটায়। ঐ ঘেরাও মেঘ ভেদ করে ভেতরে আলোআঁধারি ছায়ায় আছে লাল উত্তপ্ত মাটি, পাহাড় উপত্যকা শুকনো সমূদ্র।
কিন্ত পৃথিবীজ প্রাণীর টিকে থাকার সম্ভাবনা না থাকলেও অন্য anaerobic bacteria বা প্রাণী থাকতে পারেই, কারণ সেখানে পাওয়া গিয়েছে ” ফসফিন” (PH3) ফসফরাস হাইড্রোজেন যৌগ পদার্থ যা একমাত্র প্রাণী থেকে উৎপন্ন হয়। Astrology তে, শুক্র বা ভেনাসের প্রভাব পাশ্চাত্য ভেনাস দেবীর প্রভাবই লক্ষিত হয়, চারুকলা , প্রেম ও কামজ প্রীতি। করতলে বৃদ্ধাঙ্গুলির নিম্নে শুক্রের স্থান, সেখানে বলিষ্ঠ শৃঙ্গও একই ইঙ্গিতাবহ ।
এবার Mythology ও “পুরাণ” কি বলে, শুক্রগ্রহকে নিয়ে—- একটু আলোচনা। নাম তাঁর “ভেনাস”, তিনি অপূর্ব সুন্দরী নারীমূর্তি প্রেম-ভালবাসার প্রতীক দেবী — তাঁর সৌন্দর্যমন্ডিত প্রতিমা —প্রেম, ভালবাসা passion, নানা চারুকলা সম্পন্ন প্রাচীন রোমানদের তিনি পূজ্য দেবী, আছে এ দেবীর নিজস্ব প্রেম কাহিনী , প্রেমিকের মৃত্যুবিচ্ছেদ ইত্যাদি।
প্রথমে কিন্ত প্রাচীন ইটালিয়ানরা মানতেন গ্রীকদের দেবী ” আফরদিতি” ঐ ভেনাস গ্রহকেই যিনি ছিলেন সবুজায়নের মানে শষ্যক্ষেত্র, ফুলবাগিচার দেবী, জন্ম হয়েছিল এক ঝিনুক থেকে। বিদেশী মাইথোলজিতে ভেনাস নারীরূপে স্বীকৃত। কিন্ত হিন্দু বৈদিক ও পুরাণে শুক্র এক বলিষ্ঠ পুরুষ তিনি ভৃগুপুত্র শুক্রাচার্য—- পণ্ডিত, জ্ঞানগর্ভ , স্বচ্ছ উজ্জ্বল, জ্যোতির্ময় ব্রাহ্মণ ঋষি, শুক্রগ্রহ তাঁর প্রতীক। বৈদিক নবগ্রহের অন্যতম।
শুক্রাচার্যের প্রতি বৈদিক কালে এক গায়ত্রীমন্ত্র আছে। ঋগ্বেদে অনেক দেবতাদের প্রতিই নানা প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণে যজ্ঞে আহুতি দিয়ে স্মরণ করা হতো। গায়ত্রী এক ছন্দের নাম, ঐ ছন্দে রচিত হলে তাঁকেই গায়ত্রী মন্ত্র বলা হতো। গায়ত্রী ছন্দের নিয়ম —তিনটি চরণ, আটটি করে অক্ষর। তবে বৈদিক সংস্কৃত অনুসারে ৎ, ন্ , দ্ ,ম্ , অনুস্বার বিসর্গ ইত্যাদি অক্ষর বলে ধরা হয় না।
গায়ত্রী মন্ত্র: শুক্রের প্রণাম
ওঁ
ভৃগুসূতায় বিদ্মহে
দিব্যদেহায় ধীমহি
তন্নোঃ শুক্র প্রচোদায়াৎ।
পুরাণশাস্ত্রমতে শুক্রাচার্য ছিলেন অসুরদের কূলগুরু, জানতেন মৃতসঞ্জিবনী বিদ্যা, যার জন্য দেবতারা অসুরদের বধ করলেও আবার তাদের তিনি বাঁচিয়ে তুলতেন। এহেন জ্ঞানী শুক্রাচার্য নানা বিদ্যা আয়ত্ত নিমিত্ত ধ্যানযোগভ্যাসে মগ্ন থাকতেন। দেবতারা বুঝলেন, আরও বিপদ। শুক্রাচার্যের ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য স্বয়ং ইন্দ্র নিজ কন্যা সুন্দরী জয়ন্তীকে পাঠান । তারপর, শুক্রাচার্য ও জয়ন্তী কিছুদিন একসঙ্গে কাটানোর পর, তাদের কন্যা জন্মে—নাম দেবযানী। শুক্রাচার্য জয়ন্তীর ছলচাতুরী বুঝতে পারলে জয়ন্তী স্বর্গে ফিরে যান, কিন্ত দেবযানীকে শুক্রাচার্য মা জয়ন্তীর কাছে দেন নি।
মৃত সঞ্জিবনী বিদ্যা দেবতাদের কূলগুরু বৃহস্পতি জানতেন না। ফলে ক্ষুরবুদ্ধি দেবতারা বৃহস্পতির ছেলে “কচ”কে পাঠালেন অসুর বা দৈত্যকূলে কোন ছলে যাতে ঐ বিদ্যা আয়ত্ত করে ফিরে আসতে পারেন কচ। শুরু হয় পরে কচ-দেবযানী আর এক উপাখ্যান।
পরম গুণবতী, অসামান্যা রূপসী,সাথে তীব্র দেমাকী, দেবযানী ছিলেন চরম অসুখী, সে এক দারুণ করুণ কাহিনী। শুক্র গ্রহ প্রসঙ্গে শুক্রাচার্য, আর শুক্রাচার্যের একমাত্র কন্যা দেবযানী, এজন্যই তার কথা একটু ছুয়ে এ পর্ব শেষ করলাম।
সৌজন্য: কসমোলজি, উইকিপিডিয়া ও পুরাণ