জোনাকি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কস
০৬.
জোনাকি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কস-এর পাঁচিল ঘেঁসে ননীর রিকশা যখন নিঃশব্দে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়াল, তখন রাত আড়াইটে। আরোহী শিবা। সিটের ওপর সে উঠে দাঁড়াতেই পাঁচিল ছাড়িয়ে প্রায় দুফুট ওপরে উঠে গেল তার মাথা। ফ্যাক্টরির পেছন দিকটা এই প্রথম সে দেখছে। দূরে জ্বলছে ইলেকট্রিক বাতি। আবছা আলোয় যতটা দেখা যায় তাইতে দেখল লম্বা লম্বা ঘাস, ডোবার মতো একটা শুকনো গর্ত, প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে কোয়ার্টারটা। একতলা, নিচু ছাদ। তার মনে হল, ডান দিকের ঘরটাই শোওয়ার।
দুটো বড় জানলাই খোলা। নিশ্চয় গরম সহ্য করতে না পেরে খুলতে বাধ্য হয়েছে।
ছাদের পাঁচিল থেকে কার্নিসে নামাটা শক্ত নয়। তার দুহাত নীচেই জানলার ওপরে বেরিয়ে রয়েছে কংক্রিটের ছাঁচা। ওর ওপর নামতে গেলে একটু সাহায্য লাগবে। তারপর ছাঁচা থেকে মাটিতে, কাঁধে পা রেখে নেমে পড়তে পারবে। একটু মুশকিল হবে দু বছরের বাচ্চাটা নিয়ে।
ওটা কিছু নয়, এই ভেবে শিবার মাথাটা যখন হালকা হতে শুরু করেছে, তখনই টর্চের আলো অন্ধকার কেটে কেটে ঘাসের ওপর খাঁড়ার কোপ দিল। শিবা চট করে নামিয়ে নিল মাথা। কোয়ার্টারের অপর দিকে কেউ একজন জেগে পাহারা দিচ্ছে, অন্ধকারে তাকে দেখা যাচ্ছে না। পাঁচিলের ওপর চোখ পর্যন্ত তুলে সে লক্ষ করতে লাগল লোকটা এখন কোথায়, ঘুরে বেড়াচ্ছে কি না, এই দিকে আসবে কি না।
এল না। কোনও সাড়াশব্দ বা টর্চের আলো আর পড়ল না। তা হলেও খানিকটা সময় দেওয়া দরকার, এখনই কাজে নামা ঠিক হবে না। শিবা রিকশার সিটের ওপর বসল।
ক্যামন দ্যাখলা? ননী ফিসফিসিয়ে বলল।
একজন জেগে পাহারায় রয়েছে, টর্চ নিয়ে।
তা হলে তো ডেঞ্জার!
ডেঞ্জার আবার কী, একটু টাইম দিয়ে তারপর নামব। তুই কাছিটা ওদিকে ঝুলিয়ে রাখবি। মিতার দিদি, জানি না ধরে উঠতে পারবে কি না, মিতা হলে বিনা দড়িতেই একটা ভল্ট দিয়ে উঠে যাবে, জিমন্যাস্টিক করত তো!
ওর দিদিও তো মিতা, পুরা নাম মধুমিতা, পারমিতারই বড় বইন। তাইলে ভল্ট দিতি পারুম না ক্যান?
তোর বুদ্ধিশুদ্ধি কি শুধু রিকশার প্যাডেলেই ঘুরপাক খাবে, হ্যান্ডেল পর্যন্ত ওঠাতে পারিস না? দুবছরের একটা বাচ্চার মা, সে কিনা ভল্ট খাবে?…জামাইবাবুর নাম উৎপল, সেটা মনে রাখবি।
পদবিটা চাটুজ্জে না রায়, কী একডা যেন কইছিল মিতা?
চট্টরাজ। আর মিতাকে বাড়িতে ডাকে পারো বলে। দুই বোন মধু আর পারো। কিন্তু ওকে জিজ্ঞেস করেছিলি জামাইবাবুর ফিটনেস কেমন, দৌড়তে, লাফাতে পারে কি না?
জিগাই নাই। তয় দুখ কইরা কইছিল, মালিকের লগে আপস ক্যইল্লে আইজ আর দিদিরে এই হ্যানস্তায় পইড়তি হইত না।
লোকটা খুব জেদি, মনের ফিটনেসটা দারুণ!
কিন্তু সংসারের ব্যাপার স্যাপারে একদম আনফিট। ওনার উচিত আছিল রিজাইন কইর্যা, টাহাকড়ি পকেটে পুইরা চইলা যাওয়া। কাম জানা, ল্যাহাপড়া জানা লোক, ওনার কি চাকরির অভাব হইব?
তার মানে! অন্যায়কে মেনে নিতে বলছিস? অধর্মকে তুই বলছিস মেনে নিতে? একটা এত বড় ফ্যাক্টরি, কত লোক এখানে কাজ করে! এটা তুলে দেওয়া কি অন্যায়, অধর্ম নয়?
কথাটা বলেই শিবা বুকের মধ্যে একটা বিদ্যুৎচমক বোধ করল। মাথার মধ্যে আলোর ঝলকানি লাগল। তার মুখ দিয়ে অন্যায় আর অধর্ম শব্দ দুটো কী করে বেরোল? কে তুলে দিল তার মুখে? তার মাথার মধ্যে এই শব্দ দুটো বাসা বেঁধে রয়েছে কবে থেকে?
আবার একটা ঝলকানি।…শিবা দেখতে পেল জানলার একটা পাল্লা আধখোলা। ঘরের ভেতরে দেখা যাচ্ছে শুধু একটা কোণ। সে দেখতে পাচ্ছে পাঁচটি ছেলে ও একটি মেয়ে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে। তারা যেন কাঠের পুতুল, কেউ নড়ছে না, শুধু সামনে তাকিয়ে। প্রত্যেকের চোখে ভয়, মুখের চামড়ার নীচে রক্ত নেই।
শিবার কেন যে ইচ্ছে হল ভবানীসারের কোচিংটা একবার ঘুরে দেখে আসার! বটকেষ্টর দোকানে সাধু আর তার সঙ্গীকে দেখতে না পেয়ে তার মনে যে ভয় ধরল, হয়তো তাই থেকেই কৌতূহলটা তৈরি হয়।
জানলা দিয়ে ছয় জনের দিকে হতভম্ব হয়ে সে যখন তাকিয়ে, তখন ঘরের আর-এক কোণে, ভেজানো পাল্লার পাশেই একটা কণ্ঠস্বর শুনল।
যদি হাতটা ভেঙে দিই? মৃদু, শান্ত উচ্চারণ। শিবার মনে হল, সাধুর গলা।
উত্তর দিল না কেউ।
কথা নেই কেন মুখে? যদি ভেঙে দিই, তা হলে অঙ্ক কষাবেন কী করে?
বাঁ হাত দিয়ে।
ওরে বাবা! দেবু শুনলি, বাঁ হাত দিয়ে উনি—।
বাঁ হাতটাও তা হলে ভেঙে দাও।
দরকার নেই ওসবের। শুনুন, পরীক্ষার কটা দিন আপনি স্কুলে যাবেন না। এই ঘরে বসে যত খুশি অঙ্ক কষুন, কিন্তু স্কুলে যাবেন না।
তার মানে অন্যায়ের কাছে আমাকে মাথা নোয়াতে হবে, অধর্ম আমাকে মেনে নিতে হবে!
ভবানীসারের গলা। অনুত্তেজিত, গম্ভীর অথচ কঠিন। শিবার সারা শরীর শক্ত হয়ে পড়ছে। পাঁচটি ছেলে ও একটি মেয়ে একইভাবে দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে।
অতশত বুঝি না, মোট কথা, যা বললুম তাই করবেন। বাড়িতেই থাকবেন, পরীক্ষা হয়ে গেলে স্কুলে গিয়ে চুটিয়ে মাস্টারি করবেন। কাল আপনি তিনটে ছেলের ক্ষতি করতে গেছলেন, ওদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন, অবশ্য ম্যানেজ করে নিয়েছি।
আমি সত্যিই দুঃখিত যে, ওদের ক্ষতি করতে পারিনি। একটা কথা তুমি শুনে রাখো, হাতই ভাঙো আর পা-ই ভাঙো, অন্যায়কে আমি প্রশ্রয় দেব না। আমার হাতের চেয়েও বড় ব্যাপার এই ছেলেদের চরিত্র তাদের মনুষ্যত্ব। সেটা আমাকে বাঁচাতেই হবে। এভাবে স্কুলের পরীক্ষায় পাশ করলেও, জীবনের পরীক্ষায় তো এরা বরাবরই ফেল করবে। ঘুণ ধরে ঝাঁঝরা হওয়া মানুষ, কি পরিবারের কি সমাজের কোনও বড় কাজের দায়িত্বই তো নিতে পারবে না, ভেঙে পড়ে যাবেই।
বড় বড় কথা এখন শোনার সময় নেই, ওসব ক্লাসে কপচাবেন। পাশ করলে চাকরি জুটবে, খাইয়ে-পরিয়ে সংসার বাঁচাতে পারবে, এটাই বড় কথা। সাধুর গলা থেকে এবার রাগ বেরিয়ে এল।
না, না, পারবে না, এটা কোনও কাজের কথা নয়। মানুষ শুধু খেয়েই বাঁচে না। তার মন আছে, চেতনা আছে, আত্মা আছে। ভবানীসারের গলায় ব্যাকুলতা।
সাধু, কথাবার্তা কি একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? দেবুর ধৈর্য আর অপেক্ষা করতে পারছে না।
থাম তুই, আমাকে আত্মা দেখাচ্ছে! আত্মা তা হলে তো আমারও আছে, বলুন, আছে তো?
সাধু এক পা পিছিয়ে দাঁড়াতেই শিবা ওকে এবার দেখতে পেল, ডান হাতটা বুকে। ঠেকানো। আত্মা বোধহয় ওখানেই থাকে। সাধুর সুন্দর মুখটা কুঁকড়ে রয়েছে রাগে, চোখ জ্বলছে। বাঁ হাতের বেতের ব্যাটনটা দিয়ে সে সামনে দাঁড়ানো কাউকে খোঁচা মারল, বোধহয় সারকেই।
তা হলে আমারও আত্মা আছে, বলছি আছে। এই ছেলেগুলোরও আছে, দেখবেন?
সাধু তালুর উলটো পিঠ দিয়ে একটি ছেলের গালে আঘাত করল। আঁ বলেই ছেলেটি গালে হাত দিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল। বিশ্বাস করতে পারছে না এভাবে মার খাবে! সংবিৎ ফিরে পেয়েই ছেলেটি খোলা দরজা দিয়ে উধ্বশ্বাসে ছুটে বেরিয়ে গেল। সাধু হাসতে শুরু করল।
দেখলেন? ওর আত্মা বলল পালাও, তাই সটকান দিল।
সাধু আর-একটি ছেলের সামনে দাঁড়াল। ডান হাতটা ধীরে ধীরে তুলতে শুরু করতেই দুহাতে মুখ ঢেকে ছেলেটি ফুপিয়ে উঠল।
এর আত্মা বলল কাঁদো, তাই না? সাধু ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘরের কোণের দিকে তাকিয়ে হাসল। এই হচ্ছে আত্মা। শরীরের জন্যই আত্মা। এই এলাকার সব আত্মা সুযোগ-সুবিধে পাওয়ার জন্য, কাজ উদ্ধারের জন্য আমাকে তোয়াজ করে, ভয় পায়, হাতজোড় করে। তারপর সে দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে চারটি ছেলে ও মেয়েটিকে মৃদুস্বরে বলল, বাড়ি যাও।
মেঝে থেকে বই-খাতা কুড়িয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েই ওরা বি টি রোডের দিকে প্রায় ছুটতে শুরু করল, শুধু মেয়েটিই একবার দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে পেছনে তাকায়।
জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে শিবার মনে হচ্ছিল, সে যেন হিন্দি সিনেমা দেখছে। পরদা থেকে একটা ভিলেন জ্যান্ত নেমে এসেছে তার চোখের সামনে। বটকেষ্টর। চিৎকার ভেসে এল। চেঁচাক, এমন একটা সত্যিকারের সিনেমা ফেলে তার এখন। যাওয়া সম্ভব নয়।
সাধু পা পা এগিয়ে গেল ঘরের কোণের দিকে, মুখভরা হাসি।
আমার আত্মা বলছে আপনার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করতে হবে, আপনার আত্মা বলছে হাত দুটো আস্ত রাখতে হবে। দুটোই সম্ভব। ঠিক বলেছি কি?
জানলার কিনারে মুখ রেখে একচোখ দিয়ে শিবা ঘরের অন্য দিকটা দেখার চেষ্টা করল। ভবানীসার ডান হাতটা বাড়িয়ে, মুখে পাতলা হাসি। চশমার পুরু কাচে ইলেকট্রিক আলো, বরফ কুচির ওপর রোদের মতো ঝকঝক করছে।
হাত আমার দরকার নেই, তুমি এটা নিতে পারো, কিন্তু স্কুলে আমি যাবই।
যাবেনই।
হ্যাঁ।
কোনও দ্বিধা নেই একফোঁটা শব্দটিতে। বাড়ানো হাতটা আর-একটু তুলে বিবেকানন্দর ছবিটির দিকে নিবদ্ধ করলেন।
ওই মানুষটি একটি কথা বলেছেন।
সাধু মুখ ঘুরিয়ে ছবিতে চোখ রাখল।
বলেছেন, সত্যের জন্য সব কিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনও কিছুর জন্যই সত্যকে ত্যাগ করা যায় না। হাতটা নামিয়ে ভবানীসার হেসে বললেন, পরীক্ষার কটা দিন আমি স্কুলে যাব। অন্যায় হচ্ছে দেখলে বাধা দেব।
এবার সাধু এগিয়ে গেল। ভবানীসারের ডান হাতের কবজি মুঠোয় ধরে চোয়াল শক্ত করল। সাধুর হাতের পেশিগুলো, আঙুল থেকে কাঁধ পর্যন্ত, ফুলে উঠে ডেলা বেঁধে গেল। সারের মুখের হাসিটা থমকে গিয়ে যন্ত্রণায় একবার কুঁকড়ে উঠল, তবে দু-তিন সেকেন্ডের জন্য। আবার হাসি ফুটল।
সাধুর মুখ টসটস করছে উত্তেজনায়, কপালে ঘাম ফুটছে। একদৃষ্টে সে সারের মুখের দিকে তাকিয়ে। হাতের পেশিগুলো আরও কঠিন হচ্ছে।
সারের মাথাটা এবার ধীরে ধীরে সামনে ঝুঁকে পড়ছে। ঠোঁট দুটি ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। থরথর করতে করতে তাঁর দেহ কুঁজো হয়ে গেল। আহহ আহহ, আমি নুইব না, কিছুতেই না, ওহহ…পারবে না, আমাকে দিয়ে অন্যায়, অধর্ম—
এর পর শিবা নিজেও জানে না কখন সে কোচিংয়ের দরজায় এসে দাঁড়াল। সাধু মুখ ফিরিয়ে তাকে শুধু দেখল মাত্র। তখন ভবানীসারের কবজিটা তার মুঠোর মধ্যে ধরা।
শিবা বলল, ছেড়ে দাও সারকে। বাঘের গর্জনের আদল ছিল তার স্বরে।
.
পাঁচিল থেকে একটা বেড়ালের মতো লাফিয়ে শিবা ঘাসের ওপর নামল। ফ্যাক্টরি ঘিরে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। কোয়ার্টারের পেছনে অন্ধকার, সামনে আলো। এতে তার সুবিধেই হবে। গুঁড়ি মেরে সে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে অতি দ্রুত এগোল পেছনের জানলা লক্ষ্য করে।
জানলার নীচে উবু হয়ে বসে সে বোঝার চেষ্টা করল ঘরে কেউ জেগে আছে কি না। কোনও সাড়াশব্দ নেই। খোলা জানলার কাচে সে তিনটে টোকা দিল। সাড়া নেই। এবার একটু জোরেই টোকা দিয়ে সে ফিসফিসিয়ে ডাকল, উৎপলবাবু, উৎপলবাবু।
কে? কে? সন্ত্রস্ত চাপা পুরুষ গলা।
ভয় পাবেন না, জানলায় আসুন, আমি পারমিতার বন্ধু। শিবা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে গলা নামিয়ে বলল।
একটা ছায়ামূর্তি সন্তর্পণে জানলার দিকে এগিয়ে এসে একটু দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াল। কে? কে আপনি?
আমার নাম শিবা। মিতা, পারমিতা আমার বন্ধু। আপনাদের তিনজনকে কোয়ার্টার থেকে বার করে নিয়ে যেতে এসেছি।
একটা সন্দিগ্ধ নীরবতা। কোনও উত্তর এল না। ঘরের মধ্যে চাপা গলায় দুজনের। কথা বলার শব্দ শোনা গেল। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছে। শেষরাতে জানলার বাইরে। দাঁড়িয়ে কোনও অপরিচিত লোক যদি বলে, বার করে নিয়ে যেতে এসেছি তা হলে চট করে তাকে বিশ্বাস করা শক্ত, উচিতও নয়।
আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। ওরা আপনার টেলিফোন আর ইলেকট্রিক লাইন কেটে দিয়েছে, কাল থেকে কলের জল পাবেন না। দরজায় তালা মেরে দিয়েছে। আপনাকে ওরা রিজাইন করতে বাধ্য করাবেই। আপনার ছেলে টুটু, যার হাম হয়েছে, তাকে বাঁচাবার কথা ভাবুন। শিবা প্রায় মিনতির সুরে কথাগুলো বলল।
আবার ঘরের মধ্যে চাপা কথাবার্তা শোনা গেল। শিবা আবার বলল, মিতা ভবানীসারের কোচিংয়ে পড়ত, আমি তার কাছাকাছিই থাকি। একদিন এক গুণ্ডা সারকে মারবার জন্য কোচিংঘরে ঢুকেছিল। তারপর থেকে ও আর পড়তে যায়নি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঘরের মধ্যে নারীকণ্ঠে শোনা গেল, ঠিকই, পারো তারপর আর যায়নি। শিবা নামে একটা ছেলে গুণ্ডাটাকে নাকি
দিদি, আমিই সেই শিবা। নির্ভাবনায় আপনারা আমার সঙ্গে আসতে পারেন।
তুমিই সেই বক্সার? উৎপল জানতে চাইল।
হ্যাঁ বলতে গিয়ে শিবার জিভ আটকে গেল। বলল আগে ছিলাম। কিন্তু আপনারা আর দেরি করবেন না।
কীভাবে যাব? বাড়ির সামনে লোক, গেটেও লোক।
পেছনের পাঁচিল টপকে বেরিয়ে যাব। আপনারা ছাদ থেকে নামবেন। নিচু ছাদ, পা রাখারও জায়গা আছে। দিদিকে আর টুটুকে আমি নামিয়ে নেব। দরকারি জিনিস যা নেওয়ার, সঙ্গে নিন। একটা কাপড় নিন ছাদ থেকে ধরে নামবার জন্য। তাড়াতাড়ি করুন। পাঁচিলের বাইরে আমার বন্ধু ননী সাইকেল রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেরি করবেন না। একবার সামনের জানলা দিয়ে দেখে নিন তো লোকগুলো কী করছে।
উৎপল আধ মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে বলল, দুজন মাত্র চ্যাটাইয়ে শুয়ে রয়েছে, ছিল তো পাঁচ-ছজন!
সব দরজা জানলা বন্ধ করে এবার ছাদে চলে যান। টুটু কি ঘুমোচ্ছে? দেখবেন। যেন কেঁদে না ওঠে।
টুটু কেঁদে ওঠেনি। ছাদের পাঁচিল ডিঙিয়ে কার্নিসে পা রেখে, পাকানো বেড কভারটা ধরে মধুমিতাই প্রথমে নামল জানলার ওপরের ছাঁচায়। শাড়ি পালটে সালোয়ার কামিজ পরে নেওয়ায় তার সুবিধেই হয়েছে।
দিদি, কাপড়টা শক্ত করে ধরে থেকে এবার বসুন, পা দুটো ঝুলিয়ে আমার কাঁধে রাখুন, না, না, লজ্জা করবেন না, তাড়াতাড়ি। জমিতে দাঁড়িয়ে শিবা জরুরি তাড়া দিল।
কাঁধে দাঁড়ানো মধুমিতাকে নিয়ে শিবা ধীরে ধীরে উবু হয়ে বসল। মধুমিতা কাঁধ থেকে ছোট্ট লাফে জমিতে নামল। উৎপল বেডকভারটা ধরে আছে ছাদে। শিবা এবার ছাঁচার ওপর উঠে বলল, টুটুকে নামিয়ে দিন আমার হাতে।
অসুস্থ, সদ্য ঘুমভাঙা বাচ্চার অন্ধকারের মধ্যে এই ধরনের নাড়ানাড়ি পছন্দ হচ্ছে। দুহাত ধরে তাকে ঝুলিয়ে দিতে সে ভয়ে কেঁদে উঠল শিবাকে জড়িয়ে ধরে।
দিদি ধরুন। টুটুকে সে দ্রুত নামিয়ে দিল মায়ের বাড়ানো হাতে। যেন না কাঁদে আর।
উৎপল চট্টরাজ যুবক এবং মোটেই আনফিট নয়। বেডকভার টেনে ধরে থাকার জন্য ছাদে আর কেউ নেই। সেটা ছাদেই রেখে দিয়ে সে কার্নিস থেকে অবলীলায়ই ছাঁচায় দাঁড়ানো শিবার পিঠে পা দিয়ে নামল এবং বগলে একটা পলিথিনের ব্যাগ ঝুলিয়ে।
সবাই জমির ওপর। অন্ধকার থেকে ফ্যাক্টরির পাঁচিল পর্যন্ত যেতে, দূর থেকে আসা আলোয় আবছা হওয়া প্রায় কুড়ি মিটার জমি অতিক্রম করতে হবে। শিবা এগিয়ে গেল দুধারে তাকাতে-তাকাতে। পাঁচিলের ওপর ননীর মুণ্ডুটা দেখতে পেয়ে সে হাত নাড়ল। ননী দুবাহু তুলে হাতছানি দিয়ে বোঝাল, বিপদ নেই, চলে এসো।
টুকুকে কোলে নিয়ে মধুমিতা দৌড়ল পাঁচিলে ঝোলানো কাছিটা লক্ষ্য করে। তার পেছনেই শিবা এবং উৎপল। বড় বড় ঘাসের মধ্যে একটা ঢিপি, দেখে বোঝা যায় না। মধুমিতা হোঁচট খেয়ে টুটুকে নিয়েই ঘাসের ওপর পড়ল। ভয়ে এবং আঘাত পেয়ে টুটু এবার জোরেই কেঁদে উঠল। ওকে এক ঝটকায় কোলে উঠিয়ে শিবা ছুটে গেল পাঁচিলের দিকে।
ননী একে তুলে নে।
ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, শীর্ণ দুটি হাত টুটুকে তুলে নিয়েই মুহূর্তে পাঁচিলের ওপাশে অদৃশ্য হল। টুটুর কান্না বেড়ে তখন আরও উচ্চগ্রামে উঠেছে।
দিদি কাছিটা ধরুন, কাঁধে উঠুন। শিবা উবু হয়ে বসেই দ্রুত নির্দেশ দিল। আর সেই সময়ই টর্চের আলো এসে পড়ল এবং চিৎকার শোনা গেল, কে ওখানে, কে?…আরে পালাচ্ছে, ওরে দৌড়ে আয়, ম্যানেজার পালাচ্ছে।
মধুমিতাকে কাঁধে নিয়ে শিবা সোজা হয়ে দাঁড়াল। পাঁচিলের ওপর সে উঠে বসতেই ননীর অনুত্তেজিত গলা শোনা গেল, আমার হাত ধরেন…রিসকাডা পায়ের নীচেই, নাইম্যা পড়েন।
চারটে লোক ছুটে আসছে। হাতে লাঠি আর রড। ওরা চিৎকার করছে, পালাচ্ছে, পালাচ্ছে, ধর, ধর, ধর,…পিটিয়ে লাশ ফেলে দেব।
দেখছেন কী হাঁ করে? উঠুন। উবু হয়ে বসে, শিবা অধৈর্য স্বরে ধমক দিল।
তুমি?—ইতস্তত করল উৎপল।
ধ্যাত তুমি, আগে নিজে বাঁচুন তো।
কাছি আঁকড়ে উৎপল কাঁধে পা রেখে দাঁড়াতেই শিবা সোজা হয়ে উঠল। উৎপল চটপট ওধারে যখন নেমে যাচ্ছে ঠিক তখনই শিবার পিঠে প্রথম লাঠিটা পড়ল।
রিকশার সিট আর হ্যান্ডেল ধরে ননী তৈরিই ছিল। প্রায় পনেরো মিটার রিকশাটা নিয়ে দৌড়ে, লাফিয়ে উঠেই সে দেহটিকে খাড়া রেখে, সামনে ঝুঁকে, সিট থেকে পাছা তুলে প্রাণপণে প্যাডেল করতে শুরু করল।
শিবা যে ভেতরে রয়ে গেল। উৎপল চাপাগলায় আর্তনাদ করে উঠল। পাঁচটা লোক, হাতে ডাণ্ডা!
ননী গ্রাহ্য করল না কথাগুলো। জোনাকির পেছনের পাঁচিল ঘেঁষে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে মিনিটখানেক যাওয়ার পর তার প্যাডেল করার গতি বাড়ল।
অহন চুপ থাহেন। শিবারে লইয়া আপনার ভাইববার দরকার নাই, নিজেদের কথাডা ভাবেন।
এর পরই রিকশা প্রচণ্ড গতিতে বাঁ দিকে ঘুরে কলোনির ইট বাঁধানো সরু রাস্তায় ঢুকল। ঘুটঘুটে অন্ধকার, একতলা ছোট ছোট বাড়িগুলোকে ভুতুড়ে মনে হয় যেন, ভাঙাচোরা রাস্তায় রিকশা ছোটার ধড়ধড় শব্দে ঘুম ভেঙে ছুটে আসা কুকুরের চিৎকার পেছনে রেখে রিকশাটা অন্তত সাত-আটবার পথ বদল করে ইলেকট্রিক আলো জ্বলা একটা পিচের রাস্তায় উঠল। আরোহীরা নির্বাক, টুটু কান্না বন্ধ করে মাকে . জড়িয়ে। তাড়া করে তাদের ধরতে যাতে না পারে, ননী সেইজন্যই অনেকটা ঘুরে এসেছে। এখান থেকে বি টি রোড আরও আধ মাইল।
চালাইলাম ক্যামন, কন?
ঢোঁক গিলে উৎপল বলল, দারুণ! ভাবাই যায় না তোমার পায়ে এত জোর আছে!
প্যাডেল ঈষৎ মন্থর করে, মাথা ঘুরিয়ে ননী বলল, আমার পায়ের থাইক্যাও শিবার হাতের জোর বেশি। ও যদি বক্সিং ভুইল্যা না যায় তাইলে লোকগুলার কপালে আইজ দুঃখ আচে। মাইর যেমন খাইতে পারে তেমনি দিতেও পারে। মুস্কিলডা হইল কী, শিবার তো অহন কোনও প্র্যাকটিসই নাই!
ক্ষীণ স্বরে অতঃপর মধুমিতা জানতে চাইল, আমরা এখন যাচ্ছি কোথায়?
ভবানীসারের বাসায়। আপনার বুইনরে ওখানেই হগালে আইবার কইছি।
এর পর ননী কুঁজো হয়ে হ্যান্ডেলের ওপর ঝুকে পা দুটোকে পিস্টনের মতো ওঠানামা করাতে শুরু করল।
.
০৭.
লাঠিটা পিঠের ওপর আসছে, চোখের কোণ দিয়ে শিবা তা দেখেই পিঠের পেশিগুলো শক্ত করে ফেলেছিল। লাঠিটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে ঘুরে ডান হাত বাড়িয়ে মুঠোর মধ্যে সেটা পাওয়ার চেষ্টা করেও পেল না। একটা রড় তার মাথা তাক করে চালিয়েছিল যে-লোকটি, সে খুবই নিশ্চিত ছিল সেটা শিবার খুলি দুফাঁক করে দেবে। রড চালিয়েই সে ঝুঁকে পড়েছিল। শিবা একটা রাইট ক্রসকে মাঝপথে থামিয়ে দেওয়ার মতো বাঁ হাত তুলে রডটাকে পুরো বাহুর পেশির ওপর নেওয়ার সঙ্গেই ডান হাতে আপার কাট চালাল। দুপাটি দাঁতের মধ্যে প্রবল সঙ্ঘর্ষের এবং আঘাতজনিত যন্ত্রণা পাওয়ার শব্দ হল। লোকটা ছিটকে পড়েই থুতনি চেপে ধরল দুহাতে।
বহু দিন, বহু মাস পর শিবা হাড়ের সঙ্গে হাড়ের, হাড়ের সঙ্গে পেশির ধাক্কা লাগার শব্দটা পেল। তার ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে উঠেছে। একটা বাঘ যেন তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত শরীরটা চাটছে আর ক্রমশ সে নিজেই বাঘ হয়ে যাচ্ছে।
ঠিক এইরকম একটা বোধ সেদিন তাকে আচ্ছন্ন করেছিল। ছেড়ে দাও সারকে বলার সময় মাথার মধ্যে গরগর করে উঠেছিল একটা খ্যাপা রাগ। দমকে দমকে সেই রাগটা ফুলে উঠে তাকে ঠেলে দিয়েছিল ফেটে পড়ার জন্য। এগিয়ে গিয়ে সে সাধুর ঘাড় ধরে ধাক্কা দেয়। ওর সঙ্গী দেবুর হাতে একটা ছোরা তখন ঝলসে উঠেছে। ভবানীসার কবজি ধরে উবু হয়ে, ছোরাটা সাপের ফণার মতো দোলাতে দোলাতে দেবু এক পা দুপা এগোল। শিবা একদৃষ্টে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে। এক পা দুপা পিছিয়ে গিয়ে সে দেয়ালে বাধা পেল। আর তার পিছু হটার উপায় নেই। ডাইনে দেয়াল, বাঁয়ে খোলা দরজা। ছুটে বেরিয়ে যাওয়া যায়। পালাবে? তার মাথার মধ্যে একটা কথাই ঝনঝন করছে, বাঁচতে হবে, বাঁচতে হবে।
বাঁচার প্রেরণা সবচেয়ে জোরালো হয়ে উঠে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখোমুখি হলে। সেদিনে ছিল দেবুর ছোরা, আর এখন তাকে ঘিরে রড় আর লাঠি। ওদের উদ্দেশ্যটা একই—তাকে খুন করে ফেলা। সেদিনের মতোই, মাথা থেকে একটা সঙ্কেত তার স্নায়ুতন্ত্রী মারফত বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে, শিবা, বাঁচা নিজেকে।
দেবুর ছোরাটা তার তলপেট লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে—একটা রড উঁচু থেকে মাথায় নেমে আসছে প্রায় দশ ইঞ্চি ঝকঝকে একটা ইস্পাতের ফলা—প্রায় দুহাত লম্বা কালো একটা লোহার রড—আসছে, আসছে, এক সেকেন্ডও লাগবে না দুমিটার বাতাস কেটে ছোরাটার এগিয়ে আসা।
সেদিনের মতোই শিবার এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময় শুধু লাগল নেমে আসা রডের পথ থেকে নিজেকে বিঘতখানেক সরিয়ে নিতে। তার কাঁধ থেকে রডটা পিছলে জমিতে ঠোক্কর খেল আর মারার ঝোঁকে লোকটার মাথা নেমে গেল।
সেদিন বে-টাল দেবুর মুখটাও ঠিক এইভাবে তার দিকে এগিয়ে এসেছিল। স্নায়ুকেন্দ্র থেকে সঙ্কেত পৌঁছে গেল বাঁ হাতে—মারো। দেড় ফুট দূরে ছিল দেবুর বুক আর পেট। কনুইটা সামান্য পেছনে টেনে পলকে সে ওর পেট লক্ষ্য করে বাঁ হাতের মুঠোটাকে স্প্রিংয়ের মতো ছেড়ে দিয়েছিল।
রড হাতে লোকটা মাথা তোলা মাত্র শিবা বাঁ হাতের হুকটা তার ডান চোয়ালে রাখল। আঁক শব্দটার পরই জমিতে একটা ভারী জিনিস পড়ার শব্দ হল। তারপরই শিবা দুই মুঠো মুখের কাছে ধরে তিন পা পিছিয়ে এসে নাচ শুরু করল যেভাবে বক্সিং রিংয়ে প্রতিপক্ষকে ঘিরে সে নাচত।
তিনটে লোক প্রথমে হকচকিয়ে গেল শিবার এহেন কাণ্ড দেখে। তাদের একজন পাশ থেকে রড চালাল। শিবার বাহুর এক হাত দূর দিয়ে সেটা অর্ধচক্রাকারে বেরিয়ে গেল। দড়িতে স্কিপ করার মতো জমি থেকে সামান্য লাফিয়ে লাফিয়ে শিবা সরে সরে যাচ্ছে শরীরটা দুলিয়ে ক্রিকেট ব্যাট ধরে পুল করার ভঙ্গিতে, ওরা রড তুলে পা পা এগিয়ে এল।
ডান দিকের লোকটা। শিবা বেছে নিল ওকেই। রড ধরা হাতটা বেশি নামিয়ে রাখার জন্য রডের মাথাটা জমির দিকে। ওটা তুলে নিয়ে পেছন দিকে টেনে তারপর সামনে চালাতে গেলে, অন্তত এক সেকেন্ড বেশি সময় খরচ হবে। ওই এক সেকেন্ডেই ফয়সলা হয়ে যাবে।
শিবা এক পা, দুপা, তিন পা এগোল নাচ না থামিয়ে। বাঁ দিকের লোকটা দাঁত চেপে একটা শব্দ করে হাতের রড তুলল। শিবা জানে দুহাত লম্বা কিছু দিয়ে জোরে। আঘাত করতে হলে আঘাতের জিনিসটাকে অন্তত তিন থেকে আড়াই হাত দূরে থাকতে হবে। ওই তিন হাতের মধ্যে ঢুকে লোকটার শরীরের কাছে চলে যেতে পারলে।
ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই শিবা ডান দিকের লোকটাকে যেন মারতে যাবে এমন একটা ভান দেখাতে, ডান দিকে শরীর হেলিয়েই ছোবল মারার মতো পলকে বাঁ দিকে সরে, তিন হাত গণ্ডির মধ্যে ঢুকেই লেট হুক করল। ঠিক ডান কানের নীচে চোয়ালের গোড়ায়—ফ্রাঙ্ক গোস বলেছিল, ইউ হ্যাভ আ বিউটিফুল লেক্ট হুক—ঘুসিটা জমে গেল।
ঘুসির পরিণতিটা জানার জন্য শিবা চোখের কোণ দিয়েও তাকাল না। ঘুসিটা শেষ করার সঙ্গেই সে ডাইনে নজর ঘুরিয়েছে। ডান দিকের লোকটার রডের মাথা জমি থেকে উঠছে।
হঅঅঅ…উউউ। বিকট স্বরে সে এক ডাকাতে চিৎকার করেই লোকটার এক হাতের মধ্যে ছিলে-ঘেঁড়া ধনুকের মতো সোজা হয়ে দাঁড়াল। অবশ্যই হকচকিয়ে গেছল লোকটা এবং তারপরই কম্বিনেশন পাঞ্চ-এর ওয়ান-টু-থ্রি, ওয়ান-টু-থ্রি তার দুই চোয়ালকে ও সংবিৎকে অবশ করে দিল। টলতে টলতে দুপা পিছিয়ে গিয়েই লোকটি উবু হয়ে বসল এবং কাত হয়ে জমিতে গড়িয়ে পড়ল।
তার হাত থেকে পড়ে যাওয়া রডটা তুলে নিয়ে শিবা অবশিষ্ট লোকটিকে চাপা গলায় বলল, এবার তোর পালা।
দূর থেকে আসা ফ্যাক্টরির আলোয় চোখমুখের ভাব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু লোকটির ভঙ্গিতে ধরা পড়ছে, প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে।
না, না, আমি না— বলার সঙ্গে সঙ্গেই লোকটা পেছন ফিরে অবিশ্বাস্য গতিতে দৌড়তে শুরু করল, ডাকাত, ডাকাত চিৎকার তুলে।
একটা হইচইয়ের শব্দ গেটের দিক থেকে উঠল। শিবা বুঝে গেল, দল বেঁধে এবার ওরা আসবে, আর এখানে থাকা নয়। সে ছুটে গেল পাঁচিলের কাছে। লাফিয়ে পাঁচিলের মাথা ধরে হিচড়ে নিজেকে তুলে একটা পা রেখে পাঁচিলে উঠে বসেই দেখতে পেল কিছু লোক ছুটে আসছে। ইটের বড় একটা খণ্ড শিবার হাতচারেক দূরে পাঁচিলের গায়ে এসে লাগতেই টুক করে সে ওধারে লাফিয়ে যে রাস্তায় ননীর রিকশাটা গেছে, সেইদিকে ছুটতে শুরু করল। ভাঙা ইট, পাথরকুচি, গর্ত করা রাস্তা তার খালি পা দুটিকে ব্যথায়, যন্ত্রণায় নাজেহাল করতে লাগল।
মিনিট কয়েক ছোটার পর তার মনে হল, কেউ আর তাড়া করে আসবে না। অন্ধকারে এভাবে ছোটা বা হেঁটে যাওয়াও বিপজ্জনক। তাকে চোর ভেবে যদি কেউ চেঁচিয়ে ওঠে, যদি কুকুরে তাড়া করে। পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলার ঘটনা তো এখন চারদিকেই ঘটছে!
একটা পুকুরের ধার দিয়ে যেতে যেতে সে অসম্ভব ক্লান্তি বোধ করল। জল দেখে তার ইচ্ছা হল স্নান করে তাজা হয়ে নেওয়ার। অন্ধকারে সে আঘাটাতেই, গেঞ্জি খুলে জলে নেমে পড়ল। গলা পর্যন্ত শরীর ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। চার বছর সে এই ধরনের পরিশ্রম করেনি। এই ধরন বলতে, বক্সিং। প্রায় এক রাউন্ড সময় সে ব্যয় করেছে পাঁচটা লোকের সঙ্গে। সেইসঙ্গে উদ্বেগ, ভয় আর উত্তেজনার ধকল যোগ করলে–! পুকুর থেকে টলতে টলতে সে উঠল। তার সারা দেহে পানা, দু পায়ে পাঁক।
হাঁটু থেকে পায়ের নীচের দিক তার পাথরের মতো ভারী লাগছে। সে পা টেনে টেনে কিছুটা হেঁটে আর পারল না। শরীরটা দুলছে, মাথার মধ্যে কামড়ে ধরছে যন্ত্রণা। ঠাণ্ডা জল শরীরটা জুড়িয়ে দেওয়ায় এখন তার শরীরে বিছিয়ে যাচ্ছে আলস্য।
রাস্তাটা ফাঁকা ফাঁকা, বাড়িগুলো দূরে দূরে। একটা ছোট মাঠের মতো, মাঝখানে ঝাঁকড়া ডালপালা নিয়ে একটা গাছ। শিবা এগিয়ে গেল গাছটার দিকে। গুঁড়িতে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসল। ভোরের হাওয়ায় শীত শীত লাগছে। তার চোখের পাতা ভারী হয়ে উঠছে।
ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না। শিবা জোরে মাথা ঝাঁকাল। ননী ওদের নিয়ে ঠিকমতো পৌঁছতে পেরেছে কি না কে জানে! সে আকাশের দিকে মুখ তুলল। গাঢ় অন্ধকারটায় এখন ছাই ছাই রং ধরেছে। একটু পরেই ভোর হবে। একটা দিন থেকে আর-একটা দিন…জীবনের একটা সময় থেকে আর-একটা সময়…।
হঠাৎ শিবা সোজা হয়ে বসল।…আশ্চর্য, সবই তো ঠিকঠাক রয়েছে!…সেই ফুটওয়ার্ক, সেই হুক, আপার কাট, রাইট ক্রস! কিছুই তো সে ভোলেনি, কিছুই হারায়নি!
মনে পড়ছে জীবনের প্রথম ঘুসিটা! শিবা অবাক হয়ে আকাশে তাকাল। পাশে একটা দোতলা বাড়ির পাঁচিল। এটা বোধহয় খেলার মাঠ। আবছাভাবে গোলপোস্ট দেখা যাচ্ছে। তার মনে পড়ল, দেবুর পেট লক্ষ্য করে প্রথম ঘুসি, তারপরই ডান হাতের মুঠো নীচের থেকে ওপরে উঠল থুতনিতে। দেবু দেওয়ালে ছিটকে গিয়ে খালি বস্তার মতো ঝরে পড়ল মেঝেয়। তিন-চার সেকেন্ডের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটে গেল।
তারপর একটা খ্যাপা গোরিলার মতো সাধু দুহাত ছড়িয়ে এগিয়ে এল। এক পা পিছিয়ে সরে যাওয়ার জন্য শিবা জলপোকার মতো নড়াচড়া করল ডাইনে বাঁয়ে। সাধুর দুটো হাত হাতুড়ির মতো নেমে এল শিবার দুই কাঁধের দিকে। বিদ্যুৎগতিতে হাঁটু ভেঙে শরীরটা নামিয়ে নিয়ে আঘাতের ধাক্কাটা কমিয়ে নিতে নিতেই সে পাশে সরে গেল। কিন্তু বাঁ কাঁধটা এড়াতে পারেনি সাধুর ডান মুঠোর আঘাতটা। অসাড় হয়ে গেল বাঁ কাঁধ।
সাধু আবার জোড়া মুঠো তুলেছে। মারো—সঙ্কেতটা ডান হাতে পৌঁছনো মাত্র ঘুসিটা বেরিয়ে এসে সাধুর বাঁ কানের নীচে চোয়ালে বসে গেল। সাধুর চোখদুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে বিস্ময়ে কিংবা আঘাতের ধাক্কায়। তোলা দুটো হাত ধীরে ধীরে নেমে এল। তারপরই শিবার দুটো ঘুসি পাঁজরের দুধারে টপ টপ শব্দ তুলল। দুহাতে বুক চেপে সাধু ধীরে ধীরে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল।
তখন তার মাথার মধ্যে কিছু নেই, একদম খালি। শুধু সোঁ সোঁ বাতাসের শব্দ। সে বুঝতেই পারছিল না দুমিনিটের মধ্যে কোচিংঘরের মধ্যে নিঃশব্দেই প্রায় কী ঘটে গেছে।…ভোররাতে গাছতলায় বসে সেদিনের মতো শিবা বুঝতে পারছে না, জোনাকি ফ্যাক্টরির পাঁচিলের ধারে, নিঃশব্দেই বলা যায়, সে কী ঘটাল!
সেদিন ছুটে এসেছিল অনেকে। প্রথমে বটকেষ্ট এসে ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে, কুঁজো হয়ে বসা ভবানীসার, দেয়ালে নেতিয়ে থাকা দেবু, হাতে ভর দিয়ে মেঝে থেকে ওঠার চেষ্টা করা সাধু, আর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা শিবাকে দেখে চিৎকার করে মাথা চাপড়ে বলেছিল, সব্বোনাশ হয়ে গেছে গো, এবার আমরা মারা পড়ব গো! অর আমাদের রক্ষে নেই। শিবা আমাদের সব্বোনাশ করেছে।
কী হল বটকেষ্ট, চ্যাঁচাচ্ছ কেন?
বটাদা, কীসের সব্বোনাশ?
বটুবাবু, কে মারা গেল?
সবশেষে হাউহাউ করে উঠে সুপ্রভা বলেছিলেন, ওগো, আমি কোথায় যাব গো!
ঘরের মধ্যে অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখতে দেখতে জমে ওঠা ভিড়ের মধ্যে কে ফিসফিস করে প্রথম বলেছিল, শিবা, আমাদের শিবা করেছে!
শিবা, চায়ের দোকানের ছেলেটা?
সাধু কথা বলতে গিয়ে, আহহবলে গাল চেপে ধরল। তারপর ইশারায় জানাল, সাইকেল রিকশা চাই। ননী তখন বলেছিল, এই দুডারে রিকশা কইর্যা আমিই পৌঁছাইয়া দিমু।
.
রিকশাটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে। শিবার মুখের ওপর ননীর ছায়া। চোখ পিটপিট করে দুধারে তাকিয়েই শিবা ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। গাছতলায় কখন সে ঘুমিয়ে পড়ল!
প্যান্ট থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বোকার মতো হেসে শিবা বলল, তুই…কটা বাজে?…ই বেলা হয়ে গেছে, দাদা বসে আছে দোকানে আলুর দমের জন্য, আর আমি কিনা…তাড়াতাড়ি বাড়ি নিয়ে চল আমায়।
শিবা প্রায় ছুটে গিয়েই রিকশায় বসল। তারপরই মনে পড়ায় উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ওদের ঠিকমতো নিয়ে গেছিস তো?
প্যাডেল করতে করতে ননী বলল, তর হারগোর ঠিক আছে তো?
যা বলছি তার জবাব দে। শিবা ঝাঁঝিয়ে উঠল। ওরা কোথায় এখন?
বোধহয় অহন কোয়ার্টারেই। পথেই ধরা পইরা গ্যালাম। আন্ধারে ওত পাইত্যা কয়েকজন যে বইসা আছে, তা আর ক্যামন কইরা জানুম…আমারে কয়ডা চরচাপ্পর মাইরা কইল ভাগ, নয়তো খতম কইরা ফালামু। এই বইলা অগো নামাইয়া লইয়া গেল। ননী নিস্পৃহ স্বরে কথাগুলো যখন বলছে, শিবার অবস্থা তখন বজ্রাহতের মতো।
এত কাণ্ড করে শেষে কিনা—। দুঃখে, মর্মবেদনায়, হতাশায় শিবার স্বর আটকে গেল। মাথা নিচু করে সে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর চোখ থেকে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল ঝরল।
ব্রেক কষে রিকশাটা থেমে যেতেই শিবা মুখ তুলল। ননী হাসছে। কয়েক সেকেন্ড তার সময় লাগল হাসির অর্থটা বুঝে নিতে। তারপরই, ছুঁচো কোথাকার, ছারপোকা কোথাকার… হাত বাড়িয়ে শিবা ননীর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল।
আমারে মাইরা হাতে গন্ধ কইরলে তর হাতের থাইকা আলুর দম কিন্তু খামু না। আমি নিতুদার থাইকাই নিমু।
কোথায় ওরা?
অতক্ষণে ট্যাসকিতে ভবানীসারের কোচিং হইতে পাইকপাড়ায় মিতাগো বাড়ি পৌচাইয়া, হন্দেশ, রসগোল্লা বইস্যা বইস্যা সাঁটাইতেছে।
শিগগির চল, মা ডেকচি নিয়ে বাড়িতে বসে আছে। শিবা ব্যস্ত হয়ে গেঞ্জিটা পরে নিল।
অহন নয়ডা বাজে, ডেচকি লইয়া গিয়া নিতুদার সামনে দাঁড়াইয়া কইবিডা কী? আগে সেইডা মনে মনে ঠিক কইরা ল। তারপর রিকশা থেকে নেমে ননী শিবাকে নির্দেশ দিল, নাম।
কেন?
আগে নাম তো, তারপর কইতাছি।
শিবা নামতেই, সিট তুলে যাত্রীদের সামনে ঝোলাবার পলিথিনের ময়লা চাদরটা বার করে ননী বলল, হাসপাতালে যেভাবে রুগিরা যায়, ত্যামন কইরা এডা। আপাদমস্তক গায়-মাথায় জড়াইয়া সিটে কাত হইয়া শুইয়া থাক। অরা পথে ঘুরতাসে, যদি তরে একবার দেইখ্যা চিইন্যা ফেইলতে পারে…নে জড়া, জড়া, গায়ে জড়া।
পলিথিনে মাথা-মুখ ঢেকে শিবা রিকশায় কাত হয়ে পড়ল, ননী হুডটা তুলে দিল। মিনিট দশেক চলার পর রিকশা থামল। শিবার মনে হল, এত তাড়াতাড়ি তো পূর্বপল্লিতে পৌঁছনোর কথা নয়! মুখের সামনে থেকে চাদরটা সামান্য সরিয়েই সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।
রিকশাটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। নিতুদা গ্লাসের ওপর গুঁড়ো চা দেওয়া ছাঁকনিটা ধরে গরম জল ঢালতে ঢালতে তারই দিকে তাকিয়ে। সামনে আলুর দমের ডেকচিটা।
কী ব্যাপার, ডেকচিটা পৌঁছল কী করে!
কেন লাফালাফি করতে যাস? নিতু বিরক্ত স্বরে ধমকে উঠল। কী বললেন ডাক্তারবাবু, হাত-পা ভেঙেছে?
বুঝতে না পেরে শিবা হকচকিয়ে তাকাল ননীর দিকে। ননী ব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি বলল, কইলেন, বোধহয় ভাঙে নাই। তবুও পনেরো ফুট উঁচা কার্নিস থাইক্যা লাফাইছে তো, একবার খালি হাড়ের একটা ছবি তুইলবার কইচে আর দুই হপ্তা পুরা রেস্ট। তো আমি কইলাম, ডাক্তারবাবু শিবা যদি পুরা রেস্ট লয় তাইলে নিতুদা একা দোকানডা সামলাইব কী কইরা?…তহন অনেক ভাইব্যা তিনি কইলেন, ঠিক আছে একবেলা কাম কইরব আর বাকি দিনডায় রেস্ট লইব। বড় ডাক্তার তো, নামের পর বিলাতি ডিগ্রিই ছয়-সাতটা! চিকিচ্ছার কায়দাই আলাদা! কোনও ওষুদপত্তর না, মলম-ইনজেকশান না, কইয়া দিলেন শুদ্দ রেস্ট।
কী দরকার ছিল তোর, অত রাত্তিরে জানলার ওপর থেকে বেড়াল-বাচ্চা নামাতে যাওয়ার?…সারারাত আমি আর মা ভেবে মরি! কাজের মধ্যেই নিতু গজগজ করতে লাগল। এখন চুপ করে বসে থাক এখানে। পায়ের রেস্ট মানে দাঁড়ানো উচিত নয়।
রিশকায় বইসা আছে, ওহানেই থাউক, আমি বরং অহন ওরে বাড়ি লইয়া যাই। তোমার লগে হগালে যে কথাডা হইল নিতুদা, মনে আছে তো?।
মনে আছে মানে? নিতু বিরক্ত হয়ে বলল, তুই বিকেলে এসে শিবার বদলে কাজ করবি আর আমি তোর সেই কাজ নেব।
আহা রাগ করো ক্যান। বিড়াল-বাচ্চাটা নামাইতে আমিই তো অরে উশকাইয়া ছিলাম। দোষ তো আমারই। দুপুর থাইকা বিড়ালডা জানলার উপর। ডাক্তারবাবুর মাইয়া কান্নাকাটি করতা আছিল। তাই দেইখা আমিই শিবারে খোঁচাইলাম, দ্যাখ নামাইয়া আনতে পারস কি না। তয় একডা কথা নিতুদা, ডাকতারবাবু ভদ্দর লোকই, রাইতে তিনি শিবারে বাড়িতে রাইখা সেবাযত্ন করচ্যান। আমার মনের মইধ্যে একটা খচখচানি তহন থাইকাই কইরতাচে—ইয়ের জন্য দায়ি তো আমিই। শিবা তো সাদাসিদা মানুষ, অর ক্ষতি তো আমিই কইরাচি।..না না নিতুদা, অর আধা কাম আমিই করুম, তুমি না কইরো না। চোখে জল এনে, গলা কাঁপিয়ে ননী ঝপ করে বসে নিতুর পা জড়িয়ে ধরল।
অ্যাই অ্যাই, এ কী হচ্ছে! ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুইই আদ্ধেক কাজ করবি। নিতু আপ্লুত হয়ে ননীকে দুহাতে দাঁড় করাল। ডেকচিটা—আনা-নেওয়া শুধু এইটুকু করে দিস। তা হলেই হবে। তোকেও না, শিবাকেও না, কাউকেই আমার দরকার নেই। রিকশা চালানো বন্ধ করে লোকসান করবি, তাতে আমার মনেও তো খচখচানি শুরু হবে।
শিবার কাছে পুরো ব্যাপারটাই হেঁয়ালির মতো প্রথমে ঠেকছিল। এইবার কুয়াশাটা যেন রহস্য থেকে কিছুটা কাটছে। ডেকচিটা সকালে বাড়ি থেকে ননীই তা হলে এনে দিয়েছে। রাতে বাড়িতে না ফেরার জন্য কোনও এক কাল্পনিক ডাক্তারের মেয়ের বেড়াল বাচ্চা পাড়া এবং পাড়তে গিয়ে পায়ে চোট আর সেজন্যই বাড়ি ফিরতে না পারা! কৃতজ্ঞ চোখে ননীর দিকে তাকিয়েই শিবার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। ননীর বরাভয় দানের পাঞ্জায় চারটে আঙুল উঠে রয়েছে। সারা মুখে নধর একটি হাসি ছড়ানো।
দাদা, ননীর…ইয়ে, শিবা ঠিক গুছিয়ে কথাটা বলতে পারছে না।
আমার আবার কী! ননী খুবই অবাক হয়ে শিবার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরই কিছু একটা মনে পড়ার মতো ভাব করে বলল, অঅঅ, হগালে আমি কী খামু তাই নিয়া তুই ভাবতাচস? আরে দূর পাগল, নিতুদারে এসব কওন লাগে না। চাইরড়া আলু আর একডা পাউরুটি, এ তো নিতুদা আসা মাত্রই দিব।
নিশ্চয় দেব। ননী, খাওয়ার ব্যাপারে তুই একদম নিশ্চিন্ত থাকবি। নিতু শশব্যস্তে বলে উঠল। তুই চারটের সময় আসবি, আটটা পর্যন্ত থাকবি, ওই সময়টায়ই আমার একটু হেল্প দরকার হবে। সেজন্য তোকে পাঁচটাকা রোজ দেব।
রিকশায় শিবাকে নিয়ে পূর্বপল্লিতে ফেরার সময় ননী বলল, তর ভাগ্যি ভাল অমন এক ভাই পাইচিস। খাঁটি মানুষ, লোক ঠকাইয়া পয়সা করে না।
খাঁটি মানুষ বলেই ঘেন্নায় ইউনিয়নবাজি থেকে সরে এসেছে। কিন্তু তুই ওখানে পৌঁছলি কী করে?
কোথায়? যেহানে তুই ঘুমাইতেছিলি?
এরপর ননী যা বলল তার সারাংশ: রিকশায় সে উৎপল, মধুমিতা এবং টুটুকে নিয়ে হুহু করে চালিয়ে ভোর হওয়ার আগেই পৌঁছে যায় ভবানীসারের কোচিংয়ে। সার অপেক্ষা করছিলেন তাদের জন্য। কিন্তু শিবা ফিরে না আসায় তিনি খোঁজ করার জন্য বেরোতে যাচ্ছিলেন। ননীই তাঁকে আটকে রেখে ভোরের আলো ফুটতেই রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
প্রথমে সে যায় শিবার বাড়ি। নিতুদা তখন বেরিয়ে গেছে। তারাময়ী ওর কাছে শিবার হদিস জানতে চাইলে তখন বিড়াল নামানোর গল্পটা তার মাথায় আসে। তারপর সে আলুর দমের ডেকচিটা রিকশায় তুলে নিয়ে—মা কালীর কিরা ডেকচির ঢাকনা খুলি নাই।—নিতুর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বেরিয়ে প্রথমে ভবানীসারের কোচিংয়ে এসে শুনল, মিতা এসেছিল। ওরা ট্যাক্সিতে পাইকপাড়ায় চলে গেছে। নিতুকেও সে গল্পটা বলে এবং শিবার জন্য একবেলা ছুটির ব্যবস্থা করে নেয়। তারপর সে শিবাকে খুঁজতে বেরিয়ে, বহু ঘোরাঘুরির পর আদর্শ সম্মেলনীর ফুটবল মাঠে তাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে।
ওস্তাদ, একবেলা ছুটির ব্যবস্থা কেন কইরলাম কইতে পারো?ননী গম্ভীর গলায় বলল দেবদাস পাঠক রোডে ঢোকার আগে রিকশাটা থামিয়ে।
উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই সে আবার বলল, ওস্তাদ, আইজই বিকালে লালবাগানে গিয়া প্র্যাকটিস শুরু কইর্যা দাও। নিতুদা বাইর হইলেই তুমিও বাইর হইবা। মায়েরে কইবা ডাক্তারের কাছে যাইতেচি। রোজ বিকালে প্রাকটিস করনের জইন্যই ছুটির এই ব্যবস্থা! নইলে আমি মিথ্যা কথা কইতাম না।
মুখ ঘুরিয়ে শিবার চোখের দিকে তাকাল। জ্বলজ্বল করছে ননীর মুখ। চপল, পরিহাসপ্রবণ ভাবটা চোখে আর নেই। এই ননী যেন রিকশাওলা নয়, কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের সারথি শ্রীকৃষ্ণ! শিবা তোরে ফিইরা আইতে হইব। বকসিং তোর রক্তে। চার-পাঁচডারে একসঙ্গে ফ্যালাইতে পারিস আর রিংয়ে উইঠ্যা একডারে ফ্যালাইতে পারবি না? ক শিবা ক, তুই আবার ফিরবি। আমাগো পোলা ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ান হইতে পারে নাই, আমাগো হেই লজ্জা মুইছা দিবি।
দুজোড়া চোখ পরস্পরের সঙ্গে প্রায় কুড়ি সেকেন্ড ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধে রত হল। অবশেষে একজোড়া চোখ পরাজয় মেনে দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে বলল, চেষ্টা করব।
চেষ্টা! চিৎকার করে উঠল ননী। যারা জিততে চায় তারা কহনো চেষ্টা কয় না, তারা কয় জিতুম। হ, চেষ্টা নয়, জিতুমই।
জিতুম। শিবা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধীরকণ্ঠে, চোখে চোখ রেখে বলল, ননী আমি ফিরব, জিতব।
শিবার মাথার থেকে সঙ্কেত তার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ছে। মুঠি দুটো পাকিয়ে সে শূন্যে পরপর কয়েকটা ঘুসি ছুড়ল।
ঠিক সেই সময় বি টি রোড দিয়ে দ্রুত ধাবমান একটা স্কুটার ব্রেক কষে মন্থর হল। হেলমেট পরা চালক পেছনে বসা লোকটিকে বলল, দেবু, ওটা কে রে? শিবা না? আবার বক্সিং শুরু করেছে নাকি?
কই, তেমন তো কিছু শুনিনি! আচ্ছা খবর নিচ্ছি।
চালকের হাতটা ডান কানের নীচে চোয়ালে অজান্তেই যেন উঠে এল। চোয়ালটা কঠিন হল।
.
০৮.
আরে শিবা না! আয়, আয়…কত বছর পরে আবার তুই এলি। …থাক, থাক, ভালভাবে বেঁচে থাক। শরীরে আর কোনও ঝামেলা নেই তো?…সব শুনেছি আমি, গুণ্ডারা মেরে তোর কী অবস্থা করেছিল…।
লালবাগান জিমন্যাশিয়ামের আঠারো বছরের সচিব আশ্চর্য ঘটক শিবার প্রণাম নিতে নিতে কথাগুলো বললেন। সারা মুখে প্রসন্ন হাসি। প্রথম দিন শিবা যেমনটি দেখেছিল, আশ্চয্যদা আজও তেমনই রয়েছেন। মিশকালো বিরাট কাঠামো, একটু কুঁজো, চিবুকে ও ঘাড়ে দুথাক চর্বি। সাদা ধুতি, সাদা হাফ শার্ট, বাহুতে সোনার তাবিজ, চোখ দুটি আয়ত ও কোমল।
রিংয়ের ধারে লম্বা বেঞ্চটায় দুজনে বসল। দুজোড়া ছেলে রিংয়ে পার করছে। দড়ি নিয়ে স্কিপ করছে একজন। রিং ঘিরে দুটি ছেলে ছুটছে শূন্যে ঘুসি ছুড়তে ছুড়তে। অ্যাসবেসটসের চাল দেওয়া হলঘরটায় কড়িকাঠ থেকে ঝোলানো হেভি ব্যাগে ঘুসি মেরে যাচ্ছে একটা ছেলে। বালিভরা ব্যাগটা আকারে বছর সাত-আট বয়সি ছেলের মতো। একটি ছেলে সেটা দুহাতে ধরে রয়েছে যাতে না দোলে।
সাধুর চোয়াল ভেঙে দেওয়ার কয়েকদিন পর শিবা প্রথম লালবাগান জিম-এ পা দিয়ে যা কিছু দেখেছিল, আজও ঠিক তাই দেখছে। তেলোহাঁড়ির মতো রবারের স্পিড ব্যাগে অনবরত ঘুসি মেরে চলেছে একজন। ওপরে নীচে স্প্রিং দিয়ে টানা, তার মাঝখানে ব্যাগটা শূন্যে। ঘুসি খেয়ে ব্যাগটা ছিটকে গিয়েই পলকে ফিরে আসছে মুখের কাছে, সঙ্গে সঙ্গে আবার ঘুসি। অতি দ্রুত হাত চালাবার প্র্যাকটিস।
দেয়ালে বিরাট আয়নাটার সামনে শ্যাডো করে যাচ্ছে দুজন। নিজেদের প্রতিবিম্বের সঙ্গে একাকী লড়াই করে চলেছে তারা। ঘুসি চালাচ্ছে, ঘুসি কাটাচ্ছে, নেচে নেচে সরে যাচ্ছে, হঠাৎ মাথাটা ডুব দেওয়ার মতো নামাচ্ছে, পেছনে হেলছে, পাশে কাত হচ্ছে।
বেঞ্চে বসে জানলা দিয়ে জিম-এর মধ্যে অনেকটা অংশ দেখা যায়। আশ্চয্যদা এইখান থেকে ভেতরে বাইরে দুদিকেই নজর রাখেন। এটা শিবা টের পেয়েছিল। প্রথম দিনেই। সেদিন অবাক হয়ে এখানকার ব্যাপারস্যাপার লক্ষ করতে করতে রিংয়ের পেছনে ছ্যাঁচা বাঁশের ছফুট উঁচু বেড়ার ওধারে তার চোখ আটকে গেছল।
ওধারে একটা জিমন্যাসটিকস ক্লাব। সেখানে বিম-এর ওপর একটা মেয়ে। দেহটাকে চাকার মতো ঘুরিয়ে ভল্ট দিচ্ছিল। কখনও তার দুটো পা শূন্যে উঠছে, কখনওবা দুহাত ছড়িয়ে বিমের ওপর দিয়ে টলমল করে হাঁটতে গিয়ে নৌকো থেকে প্রতিমার বিসর্জনের মতো পড়ে যাচ্ছে। মেয়েটির মুখ চেনা চেনা লাগছিল বলেই সে তাকিয়ে থেকেছিল। সেই সময় আশ্চয্যদা পেছন থেকে বলে উঠেছিল, ওদিকে কী দেখছ? এখানে কেউ আশপাশে তাকায় না। এটা ঘাম-রক্ত ঝরিয়ে সাধনার জায়গা। কণ্ঠস্বরে বিদ্রুপ বা রুক্ষতা ছিল না। শিবা লজ্জা পেয়েছিল।
বিম-এ ভল্ট দেওয়ার প্র্যাকটিস করছিল যে-মেয়েটি, শিবা পরে তাকে চিনতে পেরেছিল। ভবানীসারের কোচিংয়ে পড়তে আসে। তারপর এখন তো সে জানেই ওর নাম মিতা, পারমিতা দাস।
আশ্চয্যদা, আমি আবার শুরু করব, রিংয়ে নামব। গলা নামিয়ে শিবা প্রায় ফিসফিস করে বলল।
আশ্চর্য ঘটক ভালমতো শুনতে পেলেন না। মাথাটা কাত করে বললেন, কিছু বললি?
আমি আবার শুরু করব।
কী শুরু করবি?
বক্সিং।
আশ্চর্য ঘটকের চোখ পৃথিবীর নবম বা দশম আশ্চর্যতম বস্তুটি দেখার মতো হয়ে উঠল। কী বলবেন, ভেবে পাচ্ছেন না।
তুই…তুই আবার—।
পারব না? মাত্র তো চারটে বছর সরে আছি, আবার ফেরা যাবে না? শিবা ব্যগ্র উৎকণ্ঠা নিয়ে আশ্চর্য ঘটকের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে রইল।
ফেরা যায় না মানে! আলবাত ফেরা যায়। মহম্মদ আলি সাড়ে তিন বছর পর রিংয়ে ফিরে আরও দুবার চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল। তা হলে তুই কেন ফিরে আসতে পারবি না?
আলির সঙ্গে আমার কোনও তুলনাই হয় না। কী বিরাট ফাইটার! ওর কাছে আমি তো একটা পিপড়ে।
ঠিক কথাই, তুই আলি নোস কিন্তু তোর অপোনেন্টরাও তো কেউ ফ্রেজিয়ার, নর্টন বা ফোরম্যান হবে না। বড় বড় ফাইটারদের মতো নিজেকে ভাব, তাদের সঙ্গে একই লাইনে নিজেকে দাঁড় করা, এটাকে বামন হয়ে চাঁদ ধরা বলে হেসে উড়িয়ে দিসনি। এইরকম করে ভাবলে তবেই চেষ্টাটা আসে। আশ্চর্য ঘটক থেমে গিয়ে হেসে উঠলেন। এই দ্যাখ লেকচার দিয়ে ফেলছি! কবে থেকে শুরু করবি?…তোর শরীর তো আগের থেকে অনেক বড় হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে জোরও বেড়েছে, লাইট ওয়েটে লড়েছিলি, এখন ওজন কত?
জানি না, ওজন নিইনি।
চল, চল, ঘরে চল, ওজনটা নিয়ে দেখি।
শিবাকে নিয়ে তিনি হলঘরে এলেন। এরই কোণের দিকে ছোট্ট অফিসঘরটা। আশ্চর্য ঘটককে দেখে ছেলেরা জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে তাকাল। জরুরি কিছু বলার না থাকলে, যখন ট্রেনিংয়ে ছেলেরা ব্যস্ত থাকে তখন তিনি হলঘরে পা দেন না।
হেভি ব্যাগটার পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে আশ্চর্য ঘটক থেমে গিয়ে মুচকি হাসলেন। ব্যাগে হাত রেখে বললেন, মনে আছে তোর?
শিবা লাজুক হাসল। ঘটনাটা মনে তো আছেই, চিরজীবনই তার মনে থাকবে।
.
তখন রাত প্রায় দশটা। জিম-এর হলঘরটা, ইলেকট্রিক খরচ বাঁচাবার জন্য অন্ধকার। শিবা একাই হেভি ব্যাগে ঘুসি মেরে চলেছে। বাইরে কয়েকজন প্রবীণ মেম্বারের সঙ্গে আশ্চর্য ঘটকও বেঞ্চে বসে গল্প করে যাচ্ছেন। ঢপ ঢপ ঢপ, ব্যাগে ঘুসি মারার শব্দটা ওদের কানে আসছিল।
একজন জানতে চাইল, অন্ধকারের মধ্যে কে ট্রেনিং করছে, আশ্চয্য?
গোমূসের ছেলে, ডেডিকেটেড, শিবা নাম। গোমস এবার ওকে নিয়ে পড়েছে। আশ্চর্য ঘটক বললেন।
এই নিয়ে গোমস্ কটাকে ধরে আনল বলো তো? একটাও তো ন্যাশনালের ফাইনালে পর্যন্ত উঠতে পারল না।…ওঠার জন্য খাটতে হয়, এটাই বাঙালি ছেলেরা পারে না। জোর চাই জোর, ঘুসির জোর। এই বলে ভদ্রলোক বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। ঠিক তখনই হলঘরের দরজার কাছ থেকে শিবার ভীত সন্ত্রস্ত গলা শোনা গেল, আশ্চয্যদা, একবার আসবেন?
আশ্চর্য ঘটক হলঘরে গেলেন, আলো জ্বাললেন এবং এক মিনিটের মধ্যেই ছিটকে বেরিয়ে এসে চেঁচিয়ে ডাকলেন, নোটনদা, নোটনদা, এক মিনিট, একটু এদিকে আসুন।
কৌতূহল নিয়ে সবাই হলঘরে ঢুকলেন। এককোণে শিবা জড়োসড়ো, চুরির দায়ে ধরা পড়ার মতো মুখ। ওঁরা সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে কিছুই বুঝতে পারলেন না।
আশ্চর্য ঘটক আঙুল দিয়ে হেভি পাঞ্চিং ব্যাগটাকে দেখালেন। ক্যাম্বিসের খোলের মধ্যে বালি ভরা ব্যাগটা নিথর হয়ে ঝুলছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে ব্যাগের একটা জায়গায় দুটো আঙুল ঢুকিয়ে দিতেই ঝুরঝুর করে মেঝেয় বালি পড়ল।
অ্যা, ফেটে গেছে! নোটনদা হাঁ করে শিবার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তুমি ফাটিয়েছ?
সবাই ব্যাগটাকে তন্নতন্ন পরীক্ষা করলেন। কাপড়টা খুব পুরনো নয়। মাসছয়েক আগে ব্যাগটা করানো হয়েছে। সন্দেহ প্রকাশ করে তখন ওঁরা অনেক কথাই বলেন কাপড়ের ওই জায়গাটা পচে গেছল, ঘেঁড়াটেড়া ছিল, বাহাদুরি নেওয়ার জন্য ছেলেটা কিছু একটা দিয়ে খুঁচিয়ে গর্ত করে রেখেছিল।
শিবা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, আমি শুধু পাঞ্চ করে গেছি, আর কিছু করিনি।
ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর শিবা চোখে জল নিয়ে বলে, আশ্চয্যদা, মাইনে পেলেই আমি নতুন ব্যাগ করিয়ে দেব, ইচ্ছে করে আমি ফাটাইনি।
তুই একটা বলদ! ইচ্ছে করে কি কেউ ঘুসি মেরে এই ব্যাগ ফাটাতে পারে? তারপর ভাল্লুকের থাবার মতো বিশাল দুই তালুতে শিবাকে আঁকড়ে বুকে টেনে নিয়ে আশ্চর্য ঘটক বলেছিলেন, সামনেই হলধর টুর্নামেন্ট, তোকে নামাব।…চালিয়ে যা শিবা, চালিয়ে যা, যত ব্যাগ ফাটাতে চাস ফাটিয়ে যা।
.
ওজন যন্ত্রের কাঁটার দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য ঘটক জ কোঁচকালেন। করেছিস কী, প্রায় বায়াত্তর কেজি!..লাইট মিডল। অবশ্য ট্রেনিং করতে করতে শরীর ঝরবে, একাত্তরের নীচে ওয়েল্টারে এসে যাবি।
খালি গায়ে শুধুমাত্র জাঙিয়া পরে শিবা ওজন দিতে যন্ত্রের ওপরে উঠেছিল। প্যান্ট আর টি-শার্টটা পরতে পরতে বলল, গোমসসার কখন আসেন আশ্চয্যদা?
গোমস? আশ্চর্য ঘটক আমতা আমতা করে বললেন, ও তো আর আসে না। বছর-দুই আগে ওর একমাত্র মেয়ে বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ার পর থেকেই কী রকম যেন হয়ে গেল। দুনিয়ায় ওই মা-মরা মেয়েটি ছাড়া আর কেউ তো ছিল না। প্রাণ দিয়ে ভালবাসত। পুরনো মোটর কেনাবেচার ব্যবসাটা ছেড়ে দিল। হাতে যা টাকা ছিল তাই দিয়ে দিনরাত্তির মদ খেতে শুরু করল।…জিম-এ আসা বন্ধ করল। ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা আমরা করেছি। দু-তিনবার এসেওছিল; কুঁদ হয়ে বসে থাকত, হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে উঠত, ছেলেদের চড়-থাপ্পড়ও মারত। তারপর নিজেই আসা বন্ধ করে দিল।
সেই পার্ক সার্কাসের বাড়িতেই আছেন?
না রে, ওখান থেকে বাড়িওলা উঠিয়ে দিয়েছে। আর ভাড়া দিতে পারত না।
ফ্র্যাঙ্ক গোমসের কথা শুনতে শুনতে শিবা যেমন দুঃখ পেল তেমনই অসহায়ও বোধ করল। গোসই তাকে বক্সিং শিখিয়েছে, তার প্রথম ও একমাত্র গুরু। এখন নতুন করে গুরু চাই।
আমাদের এখানে ট্রেনার এখন কান্তি, কান্তি সরকার। তুই তো ওকে চিনিস।
কান্তি নামটা শোনামাত্র শিবার মুখ হাজার বছরের পাথরের মূর্তির মতো ঘষা, ভাঙা, কর্কশ হয়ে উঠল। লোকটাকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে। ধূর্ত, শয়তান এবং অতি-অমায়িক। লালবাগান জিম-এরই বক্সার ছিল। গোস যখন ইস্টার্ন রেলওয়ের কোচ ছিলেন তখন সেখানে ওকে চাকরি করে দেন। কান্তি এখন আর রিংয়ে নামে না।
শিবা মাথা নেড়ে বলল, কান্তিদাকে নয়, আমার চাই গোসারকে। ওঁকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
বলতে পারব না, তবে পাড়ার লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো হদিস মিলতে পারে।
শিবা ঠিক করল হদিসই করবে। পার্ক সার্কাস ট্রাম ডিপোর পাশের রাস্তায় গোমস থাকতেন। পরদিন বিকেলে সে হাজির হল সেখানে। কাঠের পাল্লার ফটক দিয়ে ঢুকে দশ মিটার জমি পেরিয়ে চারধাপ সিঁড়ি। ঢাকা বারান্দা। এখানেই চেয়ার-টেবল নিয়ে বৈঠকখানা, পেছনে দুটো ঘর। এখন আর তা নেই। বারান্দার আধখানা কাঠের পার্টিশান দিয়ে জেরক্স মেশিন বসিয়ে ব্যবসা চলছে।
সেখানে মালিকের মতো হাবভাব দেখে লোকটিকে সে জিজ্ঞেস করল, এখানে ফ্র্যাঙ্ক গো নামে একজন থাকতেন, তিনি কোথায় গেছেন, বলতে পারেন কি?
লোকটি জানাল সে মাত্র সাতমাস এখানে ভাড়া নিয়ে এসেছে। ভেতরের ঘরে কীসের একটা অফিস। শিবা উঁকি দিয়ে জনাচারেক লোককে দেখল। নিশ্চয় এখানে বাস করে না, সুতরাং কিছুই বলতে পারবে না গোল্স সম্পর্কে। তবু একবার বলে দেখাই যাক না ভেবে সে একজনকে জিজ্ঞেস করল। তিনজন মাথা নাড়ল, শুধু চতুর্থজন পরামর্শ দিল—গেটের সামনে পানের দোকানটায় জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।
পানওয়ালা গোমসকে চেনে, কিন্তু কোথায় যে গেছে সেটা আর জানে না। কিছুই বলে যায়নি। রাতারাতি হাওয়া হয়ে গেল। তবে শুনেছি এধার-ওধারেই কোথাও আছে।
ওদের কথা দাঁড়িয়ে শুনছিল মাঝবয়সি একজন। সে বলল,হাতিনেক আগে ট্রাম থেকে ওকে এলিয়ট রোডে দেখেছি। একটা বড় হোটেল আছে, তার সামনের গলিতে ঢুকল।
এলিয়ট রোডে কীভাবে যাবে জেনে নিয়ে শিবা বাসে উঠল এবং কন্ডাক্টরের হাঁক শুনে ঠিক জায়গাতেই নামল। বড় হোটেল ওই একটিই, অতএব সেটিকে খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। তার উলটোদিকের গলিটি এঁকেবেঁকে কত দূর ঢুকে গেছে কে জানে! দুধারে ঘিঞ্জি পুরনো বাড়ি, রাস্তায় প্রচুর আবর্জনা আর দোকান। এখানকার লোকেদের পোশাকআশাক দেখেই বোঝা যায় অঞ্চলটায় অভাবী মানুষই, বেশি।
কাকে সে জিজ্ঞেস করবে ফ্র্যাঙ্ক গোমস নামে কাঁচাপাকা চুল, কুচকুচে কালো, ছিপছিপে গড়নের, বাংলা-হিন্দি বলা এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সাহেবকে কোথায় পাব?
সে একের পর এক দোকানদারদের জিজ্ঞেস করে করে এগোতে থাকল। শোনামাত্রই তারা মাথা নেড়ে দিল, কেউ কেউ কয়েক সেকেন্ড ভাবার চেষ্টাও করল। সন্ধ্যা নামছে। রাস্তার আলো, দোকানের আলো জ্বলল। কিন্তু গোসের পাত্তা সে পাচ্ছে না। যত সে গলির মধ্যে ঢুকছে, বাড়ির চেহারাগুলো বদলে যাচ্ছে। টালির বা। টিনের চালের কাঠের দোতলা বাড়ি, তবে একতলা বাড়ির সংখ্যাই বেশি। রাস্তার জলের কলে ভিড়। শিবা ঠিক করল আর সে এগোবে না।
ফিরে আসার জন্য ঘুরে হাঁটতে শুরু করেই ভাবল, শেষবার সে একজন কাউকে এবার জিজ্ঞেস করবে। বাড়ির দরজার পাশে রকে এক বৃদ্ধ চিনা, কোলে বাচ্চা নিয়ে বসে। একেই বলা যাক, ঠিক করে শিবা এগিয়ে গেল।
শিবার কথাগুলো মন দিয়ে শুনে সেই চিনা আঙুল দিয়ে সামনের বাড়িটা দেখিয়ে বলল, ওহি কোঠিমে দেখো তো। ডাহিনা পহেলা কামরামে এক আদমি আয়া। তুম য্যায়সা বোলতা, ওহি মাফিকই হ্যায়। উয়ো লোক তো আভি বাহার গিয়া, থোড়া ওয়েট করো। আ যায়গা।
শিবা কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে পায়চারি শুরু করল। গোমসসার এইরকম একটা নোংরা বস্তিতে আছেন, এটা সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সে মনে মনে বলল, যে লোকটার জন্য অপেক্ষা করছে সে যেই হোক গোস সার যেন না হয়! ফিটফাট শৌখিন মানুষ এই দুর্গন্ধভরা পরিবেশে!
এই ছোকরা। বৃদ্ধ শিবাকে ডেকে আঙুল দিয়ে দেখাল! তুমারা আদমি আতা হ্যায়।
শিবা তাকিয়ে রইল। চেক লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা, হাতে একটা কাগজের মোড়ক নিয়ে যে-লোকটা এগিয়ে আসছে সেই কি ফ্র্যাঙ্ক গো?
গোমসসার।
গোমস থমকে ঘুরে দাঁড়ালেন। হু?
আমি শিবা।
এবার গোমসের চমকে ওঠার পালা।
শিবা! আই মিন শিবাজি আইচ?
হ্যাঁ সার।
তুমি তো মরে গেছ শুনেছি!
না সার, তবে প্রায় মরে গেছলুম।
গোমস হঠাৎ দুহাতে শিবাকে জড়িয়ে ধরল। শিবা ওর মুখ থেকে যে-গন্ধটা পেল, জুট মিলের বহু মজুরের মুখে সে এই গন্ধ পেয়েছে।
কাম, কাম টু মাই রুম। আমি একাই থাকি।
ঘরটায় একটা চৌপায়া, চামড়ার একটা জীর্ণ সুটকেস, প্লাস্টিকের জল-রাখার জার। দুটো কাচের গ্লাস আর হ্যাঙারে প্যান্ট আর বুশ শার্ট। তার পাশে দেয়ালে আঁটা বিঘতখানেক লম্বা মাটির একটা মূর্তি—সবিদ্ধ যিশু। বিছানা বলতে সুজনি আর ওয়াড়বিহীন চিটচিটে বালিশ। বালব থেকে নির্গত জন্ডিস রুগির মতো পাণ্ডুর আলোয় ঘরটাকে শ্রান্ত, অবসন্ন দেখাচ্ছে।
সিট ডাউন।
শিবা চৌপায়ায় বসল। তারপরই দাঁড়িয়ে উঠে উত্তেজিত স্বরে বলল, সার, এ কী দশা হয়েছে আপনার! কী করে হল? কেন হল? আপনি যে এখানে নেমে আসবেন, এ তো কল্পনাও করা যায় না। আপনাকে যেভাবে দেখেছি, তার সঙ্গে আজকের এই দেখা…। তার চোখে জল এসে গেল।
সিট ডাউন, সিট ডাউন…আপসেট হয়ে গেছ তুমি। আমার কথা শুনে তোমার কোনও লাভ হবে না, আই অ্যাম ফিনিশড। আমার জীবনে আর কিছু করার নেই, শুধু এই বডিটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া ছাড়া। ওয়েলেসলিতে একটা পুরনো ফার্নিচারের দোকানে কাজ করি, ছশো টাকা দেয়। এই ঘরটার ভাড়া দেড়শো। বাকি টাকায় এর থেকে স্টাইলে কি থাকা যায়?
হাতের মোড়কটা খুলে গোমর্স শিবার সামনে ধরল। রুটি, পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা আর শুকনো কয়েক টুকরো ভাজা মাংস। টেক।
না।
বিফ, তাই খাবে না?
তা নয়। খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না।
কেন?
আপনি আমার সঙ্গে প্রথম যেদিন কথা বলেছিলেন, সেসব কথা কি আপনার মনে আছে?
প্রথম কবে বলেছি? আই কান্ট রিমেমবার।
দুর্লভ চক্রবর্তীর গ্যারাজ থেকে একটু দূরে একটা কোচিং, সেখান দিয়ে যেতে যেতে আপনি কিছু একটা দেখেছিলেন।
ওহহ, ইয়েস, ইয়েস, ফ্যান্টাস্টিক! তুমি একটা মাসকিউলার গুণ্ডার জ-এ লেফট হুক ল্যান্ড করালে, তখন আমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেটা দেখতে পেয়ে থেমে গেলাম। আই ওয়াজ স্টান্ড। তোমার কাছে গিয়ে বললাম—ইউ হ্যাভ আ বিউটিফুল লেফট হুক, টেরি, আ ডেডলি জেম অব আ পাঞ্চ, কতদিন ট্রেনিং করছ? যখন বললে জীবনে তুমি বক্সিং করোনি, নেভার ফট ইন দ্য রিং, তখন বললাম লালবাগানে এসো, আমি তোমাকে শেখাব, ট্রেনিং করাব।…ইয়েস শিবা, ডিভিডলি আমার মনে পড়ছে তোমার সেই মুখ, ফ্ল্যাবারগাস্টেড অ্যান্ড ইনোসেন্ট ফেস। আই লাইকড দ্যাট ফেস। বললে, তোমার বয়স ওনলি সেভেনটিন। শুনে আমি কী বলেছিলাম, মনে আছে?
গোমসের কথাগুলো জড়িয়ে আসছে। রুটি ছিঁড়ে মুখে তুলতে গিয়ে সে থমকে বলল, খাবে না?
না।
ওয়েল। মাংসের টুকরো মুখে ঢুকিয়ে গোমস্ শিবার দিকে তাকাল। কী বলেছিলাম সেদিন?
হঠাৎ গলা চড়ে গেল গোমসের। হোয়াট আই সেইড অন্য দ্যাট ডে? আই সেইড—তুমি বড় আছ, স্ট্রং আছ, ফাস্ট আছ, কারেজিয়াস আছ। ভাল ফাইটার
হবে। গোমসের বসে যাওয়া দুটো গালের চামড়া টানটান হয়ে উঠেছে। কোটরের মধ্যে চোখের মণি দুটো জ্বলছে।
তুমি কি ফাইটার হয়েছ?
শিবার মাথা ঝুঁকে পড়ল।
তুমি লালবাগান জিম-এ প্রথমে আসোনি। আমিই গিয়ে চা-এর দোকান থেকে তোমাকে ধরে দুর্লভের গ্যারাজে নিয়ে যাই। ওকে বলেছিলাম, দিস বয় উড বি আ ব্রিলিয়ান্ট ফাইটার। যদি আমার কাছ থেকে ফারদার কাজ চাও তা হলে একে চায়ের দোকান থেকে সরিয়ে এনে তোমার কাছে রাখো। বলেছিলাম, দারুণ জিনিস আছে। এই ছেলেটার মধ্যে। দুর্লভ আমার রিকোয়েস্ট রেখেছিল, তোমাকে কাম দিয়েছিল। ঠিক কিনা? বাট ইউ লেট মি ডাউন। রোজারিওর কাছে ফাইনালে হেরেছিলে, একটা ওল্ড ফাইটার…হোয়াট আ শ্যেম!
শিবার মাথা আর-একটু ঝুকল।
তুমি এখানে এসেছ কেন, হোয়াট ফর? আচমকা গোম বিরক্ত গলায় প্রশ্নটা করল। আই অ্যাম গ্র্যাজুয়ালি ফেডিং আউট ফ্রম লাইফ, এক দিন এই ঘরেই লাশ পড়ে থাকবে। আমি চাই না চেনা কেউ এখানে এসে আমার খোঁজ করুক। ইউ মে গগা নাউ।
সার, আমি আবার রিংয়ে নামতে চাই।
হোয়াট! সে ইট এগেইন! গোমস প্রায় চিৎকার করে উঠল।
আমি আবার শুরু করতে চাই, ফিরে আসতে চাই। আপনি আমাকে ফিরিয়ে আনুন। শিবা অবলম্বন খোঁজার মতো করে দুহাত বাড়িয়ে দিল। গো তা দেখেও দেখল না।
কাম ব্যাক? তুমি কাম ব্যাক করতে চাও? টেক সামওয়ান এলস অ্যাজ ইওর ট্রেনার। নট মি।…ইউ মে গো নাউ।
সার, এবার আমি কোনও ভুল করব না, চ্যাম্পিয়ান হবই।
ভেরি গুড, নাউ গেট আউট। গোমূসের তর্জনী দরজা দেখাল।
এরপর আর থাকা যায় না। শিবা উঠে দাঁড়িয়ে মন্থর ভাবে দরজায় পৌঁছে ঘুরে দাঁড়াল।
সার, এই ঘরেই মরে পড়ে থাকবেন?
গোমস্ রুটি চিবোতে ব্যস্ত, জবাব দিল না।
আমাকে আপনি ভেসে উঠতে সাহায্য করবেন না?
ভ্রূ তুলে গো একবার তাকাল।
আপনি হেরে গিয়ে ডুবে মরতে চাইছেন।
গোমস্ রুটি চিবোননা বন্ধ করল।
দ্যাটস মাই বিজনেস।
সার, একটা ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ানও আপনি তৈরি করতে পারেননি। সবাই বলে ফ্র্যাঙ্ক গো একটা জালি ট্রেনার। বক্সিং-এর কিছু জানে না, শুধু বড় বড় কথাই বলে।
আই নো দ্যাট, আমিও শুনেছি।
একবার শেষ চেষ্টা করুন না সার…সবার মুখ বন্ধ করে দিয়ে তারপর যেখানে ইচ্ছে মরে পড়ে থাকুন। একটা নকআউট পাঞ্চ শেষবারের মতো দিয়ে যান। শিবা দরজা থেকে ফিরে এসে গোসের সামনে উবু হয়ে দুই মুঠি তুলে ধরল। এই দুটো আপনাকে ভাসিয়ে তুলবে সার…আপনি আমাকে শুধু তৈরি করে দিন।
নীরবতা নেমে এল ঘরে। কেউ আর কথা বলছে না। গোমসের রুক্ষ কর্কশ মুখভাব ধীরে ধীরে মোলায়েম হয়ে আসছে। সে মাথা নাড়ল ধীরে ধীরে, অন্যমনস্কভাবে। মৃদু স্বরে বলল, ইউ আর টেমটিং-মি। কিন্তু শিবা, লাইফে আমি একটা টোটাল ফেইলিওর…আমার সাকসেস দেখে খুশি হবে এমন কেউ আর আমার নেই।
কেন, আমি আছি, ননী আছে, আশ্চয্যদা আছে, সাগরমামমি, পূর্বপল্লির মানুষরা আছে।…আরও কত, কত লোক যে খুশি হবে! বেঙ্গল থেকে বক্সিং-এ একটা ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ান কত বছর যে বেরোয়নি!
শিবার উদ্ভাসিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল গোমস। ঠোঁট দুটো কাঁপল। নাকের নীচে রুটির গুঁড়ো লেগে, আঙুল দিয়ে মুছল। চোখ তুলে পেরেক দিয়ে ক্রুসে বেঁধানো যিশুর দিকে তাকাল। তার মুখের ওপর দিয়ে করুণাঘন যন্ত্রণার ছায়া ভেসে। গেল।
তুমি বাইবেল পড়োনি, তাতে রেজারেকশন বলে একটা ব্যাপার আছে। ক্রাইস্টকে কবর দেওয়ার পর তিনি উঠে এসেছিলেন। এর পর একটা ডিপার মিনিং আছে। জীবন মরে পড়ে থাকে না, সে উঠে আসে।…শিবা, আমি জিম-এ যাব।
তাঁর দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা শিবার মাথায় গোসের হাত নেমে এল।
.
০৯.
গোমস একদা বলেছিল বটে, এই ছেলেটার মধ্যে দারুণ জিনিস আছে, কিন্তু শুধু জিনিস দিয়েই তো খেলোয়াড় তৈরি করা যায় না! জিনিসটাকে মারাত্মক করে তোলার জন্য সেটাকে নিয়ে কাজ করতে হয়। কাজ মানে পরিশ্রম। সেটাকেই ধ্যানজ্ঞান করে তোলা, অর্থাৎ তাতে সময় দেওয়া। এই সময় দেওয়াটাই শিবার কাছে অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠল।
সকালে ননী রিকশায় ডেকচি ও শিবাকে পৌঁছে দিত, যেহেতু শিবার পায়ের চোটটা বিশ্বাসযোগ্য করে নিতুর কাছে দাখিল করতে হত। দুসপ্তাহ পর ননী ঘোষণা করে, ডাক্তারবাবু পরীক্ষা কইরা কইয়া দিছেন শিবা ফিট, অহন হাঁটতে চলতে পারব। আগের মতন।
এবার বিপদে পড়ল শিবা। ফিট হয়ে যাওয়া মানে দুবেলাই দাদার পাশে গিয়ে দাঁড়ানো, সাহায্য করা। তা হলে লালবাগানে সে যাবে কখন? সে সমস্যা সমাধানের জন্য সাহায্য চাইল ননীর।
আর আমি মিথ্যা কইতে পারুম না।ননী ঝাঁঝিয়ে উঠল। তুই অন্য লোক দ্যাখ এবার। তোর জইন্য এত মিথ্যা কথা কইচি যে, তিন-চারডা নরক লাগব আমারে শাস্তি দিতে…তুই কালা সাহেবরে দিয়া কওয়া না, মনে তো হয় নিতুদারে বোঝাইতে পাইরব।
গোমসকে ননী কালাসাহেব বলে, অবশ্য সামনাসামনি নয়। শিবা বিব্রত মুখে বলল, সারের অবস্থা তো বলেছি তোকে। বিনি পয়সায় ওঁর কাছ থেকে ট্রেনিং নিতে আমার লজ্জা করে, নিজেকে বড় সুবিধাবাদী মনে হয়।
মনে হওয়া তো উচিতই। আমি যে কষ্ট কইর্যা রিশকা চালানো শিকচি, সে কি লোককে মাগনায় রিশকায় চড়াইয়া ঘুরামু বইল্যা?
সারের জন্য কিছু একটা করা দরকার। অন্তত ভাল একটা জায়গায় রাখা, ভাল একটু খাওয়ার ব্যবস্থা করা…টাকা-পয়সার থেকেও এটা জরুরি।
তারও আগে তর নিজের কথাটা তুই ভাইব্যা দ্যাখ। নিতুদারে বুঝাইয়া সুঝাইয়া আলুর দমের হাত হইতে নিজেরে কীভাবে রক্ষা কইরবি, আগে সেইডা ঠিক কর। একসময় আমিই তোরে কইছিলাম, তুই যখন প্র্যাকটিশ করবি তোর লইয়া নিতুদার লগে আমি কাম করুম। একবার তো কইতে গেলামও, দ্যাখলাম নিতুদা ব্যাপার অ্যাকদমই পসন্দ করতাচে না। রিশকা ফ্যালাইয়া চা-রুটি-আলুর দম পরের হইয়্যা বেচুম ক্যান? একথার তো জবাব দিতে পাইরল্যাম না। কালা সাহেবরে দিয়া না হইলে অন্য কাউরে দিয়া কওয়া না, তুই নিজেই ক না!
ওরে বাবা! আমার দ্বারা বলাটলা হবে না। আমি তো জানি, কী কষ্ট করে দিনরাত খেটে, একাই দোকানটা দাঁড় করিয়েছে। দোকানে যাব না, এটা বলার মতো পাপ আর হয় না! আরও দুটো খাবার দোকান রয়েছে তাদের সঙ্গে কম্পিট করে বিক্রি বাড়ছে, এইসময় দাদার আরও বেশি করে হেল্পার দরকার। এখন যদি বক্সিংয়ের জন্য।
শিবা চমকে উঠল ননীর মুখের দিকে তাকিয়ে। মেদ মাংসহীন শীর্ণ মুখটা কঠিন হয়ে উঠেছে। ওর চোখ থেকে একটা হলকা বেরিয়ে এল। শিবার বুকের মধ্যে পর পর কে যেন ঘুসি মেরে যাচ্ছে। ঢপ, ঢপ, ঢপ শব্দগুলো কলজের না ঘুসির, সে বুঝতে পারছে না। ননীর মুখে কী একটা কথা যেন ফুটে উঠেছে!
কী কথা! শিবার মনে হল ননী যেন মনে মনে বলছে, এই বক্সিংয়ের জন্যই তুই একদিন দাদাকে, মাকে, আমাকে পূর্বপল্লির সব মানুষকে ত্যাগ করে চলে গেছলি গোরাবাবুর কাছে। সেখানে পেট ভরে ভাল খাওয়া, ভাল জামা-জুতো, ভাল বিছানা, এইসবের লোভে তুই সোনার বকলস পরে কুকুর হয়ে গেছিলিস। গোরাবাবুর কারখানার নিতুদারা ধর্মঘট করেছিল। সেই ধর্মঘট গোরাবাবু সাধুর দলবলকে দিয়ে পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তুই কিনা সেই লোকটারই আশ্রয়ে গিয়েছিলি! বক্সিংয়ের নাম করেই তুই বেইমানি করেছিলি আমাদের সঙ্গে।
অহন বক্সিংয়ের জইন্য,এই বইল্যা চুপ কইরা গেলি ক্যান? ক, কী কইতে চাস, ক?
ননী তুই…তোরা এখনও কি সেসব কথা মনে রেখেছিস?
অহন আমি রিশকা লইয়া বাইরমু, আজেবাজে কথা শোনার মতো সময় নাই। তুই কালাসাহেবরে দিয়াই নিতুদারে কওয়া।ননী একটু বেশিই ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে গেল।
শিবা বুঝল, হঠাৎ পুরনো ব্যাপারটা উঠে আসায় ননী অস্বস্তিতে প্রায় পালিয়েই গেল।
কিন্তু সে পালাতে পারছে না।
.
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য চ্যাম্পিয়ানশিপের ফাইনালে শিবা উঠেছিল পর পর দুটো লড়াইয়ে নক আউট করে। প্রথমটায় এক মিনিট, পরেরটায় কুড়ি সেকেন্ড সময় তার লেগেছিল। বক্সিং মহলে সাড়া পড়ে গেছল। সেবার শিবা ছাড়া আর কেউ নক আউটে একটা লড়াইও জিততে পারেনি। বলাবলির বিষয় হয়ে উঠেছিল তার ক্ষিপ্রতা আর ঘুসির জোর।
ফাইনাল রিংয়ে উঠে লড়াইয়ের আগে নিজের কর্নারে দাঁড়িয়ে শিবা দর্শকদের দিকে চোখ বোলাতে বোলাতে দেখেছিল সাধুকে। অবাক হয়ে গেছল। টকটকে ফরসা গায়ের রং, ধুতি পাঞ্জাবি পরা, সরু সোনালি ফ্রেমের চশমা চোখে দেওয়া, মাথার চুল পাতলা একটি লোকের পেছনে বসে সাধু, সামনে ঝুকে লোকটিকে কিছু বলছে আর তার দিকে তাকাচ্ছে। ঠোঁটে হাসি খেলছে।
প্রথম রাউন্ডেই সুনীল বেরাকে নক আউট করে শিবা বাংলার লাইট ওয়েট চ্যাম্পিয়ান হয়। রিং থেকে নেমে আসতেই বুকে জড়িয়ে ধরে আশ্চর্য ঘটক বলেছিলেন, এভাবে প্রত্যেকটা খেলায় নক আউট, আমি কখনও দেখিনি রে। লালবাগানের ইজ্জত বাড়িয়ে দিলি। ফ্র্যাঙ্ক গো বলেছিল, ঘোটক, তোমাকে যা বলেছিলাম এবার তা মিলিয়ে নাও। ঝুটা কি সাচ্চা, আমি ঠিক চিনতে পারি। তারপর শিবাকে বলেছিল, আই অ্যাম রিয়্যালি প্রাউড টুডে। এবার হার্ড ট্রেনিং ন্যাশনাসের জন্য।
এরই মিনিট পাঁচেক পর এক অচেনা শীর্ণকায় প্রৌঢ় তার কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, তোমার সঙ্গে গোরাবাবু একটু কথা বলতে চান, একবার বাইরে আসবে?
কে গোরাবাবু? শিবা জিজ্ঞেস করে।
গোরাচাঁদ সেন। খেলাধুলোর একজন বড় পেট্রন, অনেক ক্লাবকে টাকা দেন। খুব বড় ব্যবসায়ী, কারখানা আছে তিনটে। তোমার লড়াই ওঁর খুব ভাল লেগেছে তাই কথা বলতে চান।
গোরাবাবুর সঙ্গে শিবার সেই প্রথম সাক্ষাৎ। তাকে একশো টাকার নোট দিয়ে গোরাবাবু বলেছিল, পুরস্কার। তারপর কাজ করবে? তোমার বক্সিংয়ের ক্ষতি হতে পারে এমনও কোনও কাজ নয়। সামান্যই। আমার বাড়িতে থাকবে, খাবে, মাইনেও দেব। এবার তোমার ভাল খাওয়াদাওয়া দরকার, মোটর গ্যারাজে পড়ে থেকে কি ওপরে উঠতে পারবে? এসো আমার বাড়িতে। গোরাবাবু নাম ঠিকানা লেখা কার্ড দিয়েছিল শিবাকে।
শিবার মনে হয়েছিল জীবনটাকে বদলে নেওয়ার একটা সুযোগ তার কাছে এসেছে। এটাকে সে ছাড়বে না। তখন নিতুদের কারখানায় ধর্মঘটের এগারো দিন চলছে। সেই ধর্মঘট ভাঙতে সাধু আর তার দলের ছেলেরা এসেছিল। শিবা খালি হাতেই লোহার চেন আর ছুরির সামনে দাঁড়িয়ে গুণ্ডাদের পালটা মার দেয়।
ঠিক তখনই সেই লোকটার আবির্ভাব হল, যে তাকে বলেছিল, গোরাবাবু তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। ধর্মঘটীদের মধ্যে ছিল শক্তি দাস। সে ফিসফিস করে একজনকে তখন বলে, এটা তো মালিকের সুকতলা প্রিয় হালদার, এখানে যে!।
প্রিয় হালদার ক্ষুব্ধ স্বরে তখন বলেছিল, তুমি এখানে কী করছ শিবাজি! বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ান কিনা মাস্তানি করছে? সকালে এদিকেই আমরা এসেছিলুম, খবর পেলুম তোমায় নাকি গুণ্ডারা ঘিরে ধরে মারছে! শুনেই তো গোরাবাবু ছুটে এসেছেন, গাড়িতে তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। চলো, চলো…এ কী তোমার হাতে কনুইয়ে কাটাছেঁড়া কেন? ভেঙেটেঙে গেলে চিরকালের মতো বক্সিংই যে শেষ হয়ে যাবে।
এই বলে প্রিয় হালদার তাকে টেনে নিয়ে যায়। তখন হাত তুলে শিবা নিতু আর শক্তি দাসকে জানিয়েছিল, সে এখনই আসছে। ওরা বিভ্রান্ত মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুখটা কঠিন করে ফেলে।
কিন্তু শিবা আর আসেনি।
.
এখনও শিবা সেই স্মৃতি থেকে পালাতে পারছে না। সেদিন গোরাবাবুর মোটরে প্রিয় হালদার তুলে নিয়ে যাওয়ার পরই সাধুর দল ফিরে এসে মিনিট তিনেকের মধ্যেই ধর্মঘটীদের মেরে হটিয়ে দেয়, নিতু ও শক্তি দাসকে হাসপাতালে যেতে হয়। এসব কথা কয়েকদিন পর গ্যারাজে ফিরে এসে শিবা জানতে পেরেছিল। দুর্লভ চক্রবর্তী বলেছিল, নিজের দাদাকে গুণ্ডাদের হাতে ফেলে দিয়ে পালাবি, এটা আমরা। কেউ ভাবতে পারিনি। ধর্মঘট ভেঙে গেছে, ওদের আর চাকরি হয়নি। এইসব জামা জুতো পরার লোভেই পালালি?
আমি পালিয়েছি? শিবা চিৎকার করে ছুটে গেছল বাড়িতে। প্লাস্টারে হাত বুক মোড়া নিতু তাকে দেখে বলেছিল আয়, বোস। শিবা বলেছিল, জানতুম না গোরাবাবুই তোমাদের কারখানার মালিক, বিশ্বাস করো দাদা। নিতু ঘাড়টা নাড়তে গিয়ে যন্ত্রণায় কাতরে উঠে বলেছিল, আমি কিছু মনে করিনি।
সেই সময়ই মা চিৎকার করে বলে উঠেছিল, বেরো, বেরো, বেইমান। একটা অন্ধ রাগ হঠাৎই শিবাকে তখন আচ্ছন্ন করে দেয়। সেও পালটা চেঁচিয়ে ওঠে, কীসের বেইমানি? গুণ্ডা ঠেকাবার দায় আমার হতে যাবে কেন? আমি কি ধর্মঘট করতে বলেছি?…আমারও জীবন আছে, সেটা তো কেউ দেখতে আসবে না? নিজেকে নিজেই দেখতে হবে।…সবাই বড় হতে চায়, সেজন্য যে পথই খোলা পাব সেই পথে আমি যাব।
এর পর সে দরজার পাল্লায় একটা ঘুসি বসায়। তাতে পাল্লাটা ফেটে গেছল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হনহনিয়ে যখন সে বটকেষ্টর দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন শচীনকাকু ডেকে একটা মোড়ক তার হাতে দিয়ে বলে, ননী তোর জন্য রেখে গেছে।
শিবা সেটা খুলতেই বেরোয় বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ান হওয়ার মেডেল, সার্টিফিকেট আর বেস্ট বক্সার হওয়ার ট্রফি। এক টুকরো কাগজও ছিল। তাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা, শাবাশ ফাইটার। এবার পাবি সোনার বকলস।
কাগজটা মুঠোয় চটকে শিবা নিজেকে বলেছিল, হ্যাঁ, সোনার বকলসই পরব।
কিন্তু এর পরও দাদা, ননী, শক্তিমামা, সাগরমামি, আশ্চর্যদা,..সবাই তাকে আপন করে কাছে টেনে নিয়েছে। ওরা হয়তো ভুলে যাওয়ার ভান করছে, কিন্তু সে তো ভুলতে পারছে না। দাদাকে দোকানে একা ফেলে রেখে বক্সিংয়ে আবার ফিরে যাওয়ার ইচ্ছার কথা সে বলবে কোন মুখে! তার প্রধান সহায় ননী। কিন্তু সে স্পষ্টই জানিয়ে দিল, অন্য কাউকে দিয়ে বলাও।
গোমসসারকে বললেই রাজি হয়ে যাবেন, কিন্তু দাদা কি ওঁর কথা শুনবে? তবু একবার চেষ্টা করে দেখা যাক, এই ভেবে শিবা লালবাগান জিম-এ যাওয়ার জন্য যখন বাসস্টপে দাঁড়িয়ে, একটা স্কুটার তখন তাকে দেখেই থেমে পড়ল।
হাত নেড়ে সাধু তাকে ডাকছে। ভ্রূ কুঁচকে শিবা স্কুটারের দিকে এগিয়ে গেল।
আবার বক্সিং শুরু করেছিস?
হ্যাঁ।
হলধর বর্ধন টুর্নামেন্টে নামছিস?
কে বলল?
আমি সব খবরই রাখি। গোমস তোকে ট্রেনিং করাচ্ছে, কর, ভাল করে কর। কোনও সরঞ্জামের, কি জিনিসপত্রের যদি দরকার হয় আমাকে বলিস..না, না, আগে যা হয়ে গেছে তা হয়েই গেছে, সেসব কথা আমি মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি। গোরাবাবুর সঙ্গেও আমার আর কোনও সম্পর্ক নেই। ঠিক করেছি, আমি নিজেই এবার বেটিং অর্গানাইজ করব। সাধু হেলমেটটা মাথা থেকে নামিয়ে পেটের পর চেপে ধরে রয়েছে। এবার সেটায় হাত বোলাতে লাগল।
কী অর্গানাইজ করবে? শিবা ভ্রূ কুঁচকে সন্দিগ্ধ গলায় বলল।
গোরাবাবু যা করত, সেটাই। বেটিং করে লোকটা কয়েক লাখ কামিয়েছে। কিন্তু তোর ওপর বাজি ধরে যে চোটটা পেল…যাকগে ওসব কথা—
যাকগে কেন? দাঁত চেপে বলার সঙ্গে সঙ্গে শিবা হাত মুঠো করল।
ন্যাশনালের ফাইনালে রোজারিওর মতো বুড়োর হাতে মার খেলাম, তারপর ইনভিটেশন টুর্নামেন্টেও ওর হাতে ফাস্ট রাউন্ডেই নক আউট হলাম। কেন? লড়াইয়ের আগে ড্রেসিংরুমে কান্তিদা কমলালেবু এনে বলল, গোম পাঠিয়ে দিয়েছে। গোসের নাম শুনে চোখ বুজে সেই কমলা আমি খেলাম, আর তারপরই সব ঝাপসা দেখতে লাগলাম, শরীর ঝিমিয়ে পড়ল। কান্তিদাকে বিষাক্ত কমলা দিয়ে কে পাঠিয়েছিল?
টাকা কামাবার জন্য রোজারিওর ওপর বেট করে, কিন্তু কাজটা আমি করিনি। হ্যাঁ, তুই ঠিকই ধরেছিস, ইঞ্জেকশন করে ওষুধ ঢোকানো কমলা কান্তির হাত দিয়ে আমিই পাঠিয়েছিলাম। স্বচ্ছ চোখে, সরল ভঙ্গিতে সাধু খুবই সাদামাঠা গলায় তার দুষ্কর্মের কথাটা জানাল। আমি শুধু শোধ নিতে চেয়েছিলাম। সাধুর বাঁ হাতটা তার বাঁ চোয়ালের কাছাকাছি উঠে এসেই নেমে গেল। এক চিলতে হাসি শুধু তার ঠোঁটে লেগে রইল।
তা এখন হঠাৎ কী মনে করে? জিনিসপত্তর দেব, ভাল করে ট্রেনিং কর…ব্যাপারটা কী?
এবারের ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে তুই হবি আমার বাজির ঘোড়া। তোকে জিততে হবে, চ্যাম্পিয়ান হতে হবে।
অদ্ভুত তো! গোরাবাবুর হুকুমে সেদিন রিং থেকে কতকগুলো লোক সোজা আমাকে তুলে ওর বাড়িতে নিয়ে গেছল। আমার শরীরে তখন একফোঁটা শক্তিও ছিল না। সেখানে একটা ঘরে দুটো লোক দুদিক থেকে আমায় চেপে ধরেছিল, আর একজন আমায় হেভিব্যাগ বানিয়ে পাঞ্চ করে গেছল। পাঞ্চিং শুরু করার আগে সে বলেছিল, চোয়ালের কথা আমার মনে আছে। আমার গায়ে হাত তোলার সাহস আজ পর্যন্ত কেউ দেখায়নি। তুই এখনও যে বেঁচে আছিস এটাই আশ্চয্যের।…সেই লোকটার বাজির ঘোড়া এখন আমি! আমি তা হলে এখনও বেঁচে আছি! মার খেতে খেতে সেদিন অজ্ঞান হয়ে গেছলাম। ভোরবেলায় বি. টি. রোডের ধারে একটা নালায় আমাকে পড়ে থাকতে দেখে রিকশাওয়ালা তুলে নিয়ে হাসপাতালে দিয়ে আসে। বিছানায় উঠে বসতে চার মাস লেগেছিল আর এই আঙুলটা সিধে হল না। শিবা বাঁ হাতের তর্জনীটা সাধুর চোখের সামনে। তুলে ধরল।
সাধুর ঠোঁট থেকে হাসিটা কিন্তু মুছল না। বাঁকা তর্জনীটা আলতো করে দুআঙুলে ধরে বলল, অপারেশন করে ঠিক করে নে, আমি খরচ দেব।…তোর মাথা গরম হয়ে উঠছে, এখন তোর সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। পরে বলবখন। সাধু হেলমেটটা পরে স্কুটারে স্টার্ট দেওয়ার জন্য কিকার-এ লাথি দিল। ক্লাচ দিয়ে স্কুটারটাকে সাত-আট মিটার চালিয়েই থামিয়ে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে সাধু বলল, জোনাকির ঘটনাটা শোনামাত্রই বুঝে গেছলাম কাজটা কার। পাঁচটা রডের সঙ্গে খালি হাতে একজনই লড়তে পারে। ওরা কিন্তু আমার ছেলে নয়। আর-একটা জিনিসও বুঝে গেছি, আগের শিবা আবার ফিরে এসেছে।…চলি, আবার পরে কথা হবে।
সাধুর বিলীয়মান পিঠ থেকে চোখ সরিয়ে শিবা দেখল বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরা তার দিকে তাকিয়ে। তাদের চোখে চাপা সমীহ আর ভয়।