অগ্নিগিরি
বীররামপুর গ্রামের আলি নসিব মিয়াঁর সকল দিক দিয়েই আলি নসিব। বাড়ি, গাড়ি ও দাড়ির সমান প্রাচুর্য! ত্রিশাল থানার সমস্ত পাটের পাটোয়ারি তিনি।
বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। কাঁঠাল-কোয়ার মত টকটকে রং। আমস্তক কপালে যেন টাকা ও টাকের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র।
তাঁকে একমাত্র দুঃখ দিয়াছে – নিমকহারাম দাঁত ও চুল। প্রথমটা গেছে পড়ে, দ্বিতীয়টার কতক গেছে উঠে, আর কতক গেছে পেকে। এই বয়সে এই দুর্ভাগ্যের জন্য তাঁর আপশোশের আর অন্ত নাই। মাথার চুলগুলোর অধঃপতন রক্ষা করবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেননি ; কিন্তু কিছুতেই যখন তা রুখতে পারলেন না, তখন এই বলে সান্ত্বনা লাভ করলেন যে, সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডেরও টাক ছিল। তাঁর টাকের কথা উঠলে তিনি হেসে বলতেন যে, টাক বড়োলোকদের মাথাতেই পড়ে – কুলি-মজুরের মাথায় টাক পড়ে না! তা ছাড়া, হিসেব নিকেশ করবার জন্য নি-কেশ মাথারই প্রয়োজন বেশি। কিন্তু টাকের এত সুপারিশ করলেও তিনি মাথা থেকে সহজে টুপি নামাতে চাইতেন না। এ নিয়ে কেউ ঠাট্টা করলে তিনি বলতেন – টাক আর টাকা দুটোকেই লুকিয়ে রাখতে হয়, নইলে লোকে বড়ো নজর দেয়। টাক না হয়ে লুকোলেন, সাদা চুল-দাড়িকে তো লুকোবার আর উপায় নেই। আর উপায় থাকলেও তিনি আর তাতে রাজি নন। একবার কলপ লাগিয়ে তাঁর মুখ এত ভীষণ ফুলে গেছিল, এবং তার সাথে ডাক্তাররা এমন ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল যে, সেইদিন থেকে তিনি তৌবা করে কলপ লাগানো ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু, সাদা চুল-দাড়িতে তাঁর এতটুকু সৌন্দর্যহানি হয়নি। তাঁর গায়ের রং-এর সঙ্গে মিশে তাতে বরং তাঁর চেহারা আরও খোলতাই হয়েছে। এক বুক শ্বেত শ্মশ্রু – যেন শ্বেত বালুচরে শ্বেত মরালী ডানা বিছিয়ে আছে!
এঁরই বাড়িতে থেকে ত্রিশালের মাদ্রাসায় পড়ে – সবুর আখন্দ। নামেও সবুর, কাজেও সবুর! শান্তশিষ্ট গো-বেচারা মানুষটি। উনিশ-কুড়ির বেশি বয়স হবে না, গরিব শরিফ ঘরের ছেলে দেখে আলি নসিব মিয়াঁ তাকে বাড়িতে রেখে তার পড়ার সমস্ত খরচ জোগান।
ছেলেটি অতিমাত্রায় বিনয়াবনত। যাকে বলে – সাত চড়ে রা বেরোয় না। তার হাবভাব যেন সর্বদাই বলছে – ‘আই হ্যাভ দি অনার টু বি সার ইয়োর মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সারভেন্ট’।
আলি নসিব মিয়াঁর পাড়ার ছেলেগুলি অতিমাত্রায় দুরন্ত। বেচারা সবুরকে নিয়ে দিনরাত তারা প্যাঁচা খ্যাঁচরা করে। পথে ঘাটে ঘরে বাইরে তারা সবুরকে সমানে হাসি ঠাট্টা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের জল ছিঁচে উত্যক্ত করে। ছেঁচা জল আর মিছে কথা নাকি গায়ে বড়ো লাগে – কিন্তু সবুর নীরবে এ সব নির্যাতন সয়ে যায়, এক দিনের তরেও বে-সবুর হয়নি।
পাড়ার দুরন্ত ছেলের দলের সর্দার রুস্তম। সে-ই নিত্য নূতন ফন্দি বের করে সবুরকে খ্যাপানোর। ছেলে মহলে সবুরের নাম প্যাঁচা মিয়াঁ। তার কারণ, সবুর স্বভাবতঃই ভীরু নিরীহ ছেলে ; ছেলেদের দলের এই অসহ্য জ্বালাতনের ভয়ে সে পারতপক্ষে তার এঁদো কুঠরি থেকে বাইরে আসে না। বেরুলেই প্যাঁচার পিছনে যেমন করে কাক লাগে, তেমনি করে ছেলেরা লেগে যায়।
সবুর রাগে না বলে ছেলেদের দল ছেড়েও দেয় না। তাদের এই খ্যাপানোর নিত্য নূতন ফন্দি আবিষ্কার দেখে পাড়ার সকলে যে হেসে লুটিয়ে পড়ে, তাতেই তারা যথেষ্ট উৎসাহ লাভ করে।
পাড়ার ছেলেদের অধিকাংশই স্কুলের পড়ুয়া। কাজেই তারা মাদ্রাসা-পড়ুয়া ছেলেদের বোকা মনে করে। তাদের পাড়াতে কোনো মাদ্রাসার ‘তালবিলিম’ (তালেবে এলম বা ছাত্র) জায়গির থাকত না পাড়ার ছেলেগুলির ভয়ে। সবুরের অসীম ধৈর্য! সে এমনি করে তিনটি বছর কাটিয়ে দিয়েছে। আর একটা বছর কাটিয়ে দিলেই তার মাদ্রাসার পড়া শেষ হয়ে যায়।
সবুর বেরোলেই ছেলেরা আরম্ভ করে – ‘প্যাঁচারে, তুমি ডাহ! হুই প্যাঁচা মিয়াঁগো, একডিবার খ্যাচখ্যাচাও গো!’ রুস্তম রুস্তমি কন্ঠে গান ধরে –
ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায় –
যাইতে যাইতে খ্যাচখ্যাচায়।
কাওয়ারা সব লইল পাছ,
প্যাঁচা গিয়া উঠল গাছ।
প্যাঁচার ভাইশতা কোলা ব্যাং
কইল চাচা দাও মোর ঠ্যাং।
প্যাঁচা কয়, বাপ বারিত যাও,
পাস লইছে সব হাপের ছাও
ইঁদুর জবাই কইর্যা খায়,
বোচা নাকে ফ্যাচফ্যাচায়।
ছেলেরা হেসে লুটিয়ে পড়ে। বেচারা সবুর তাড়াতাড়ি তার কুঠরিতে ঢুকে দোর লাগিয়ে দেয়। বাইরে থেকে বেড়ার ফাঁকে মুখ রেখে রুস্তম গায় –
প্যাঁচা, একবার খ্যাচখ্যাচাও
গর্ত থাইক্যা ফুচকি দাও।
মুচকি হাইস্যা কও কথা
প্যাঁচারে মোর খাও মাথা!
সবুর কথা কয় না। নীরবে বই নিয়ে পড়তে বসে। যেন কিছুই হয়নি। রুস্তমি দলও নাছোড়বান্দা। আবার গায় –
মেকুরের ছাও মক্কা যায়,
প্যাঁচায় পড়ে, দেইখ্যা আয়।
হঠাৎ আলি নসিব মিয়াঁকে দেখে ছেলের দল পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। আলি নসিব মিয়াঁ রসিক লোক। তিনি ছেলেদের হাত থেকে সবুরকে বাঁচালেও না হেসে থাকতে পারলেন না। হাসতে হাসতে বাড়ি ঢুকে দেখেন তাঁর একমাত্র সন্তান নূরজাহান কাঁদতে কাঁদতে তার মায়ের কাছে নালিশ করছে – কেন পাড়ার ছেলেরা রোজ রোজ সবুরকে অমন করে জ্বালিয়ে মারবে? তাদের কেউ তো সবুরকে খেতে দেয় না!
তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে রুস্তমিদল গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিল –
প্যাঁচা মিয়াঁ কেতাব পড়ে
হাঁড়ি নড়ে দাড়ি নড়ে!
নূরজাহান রাগে তার বাবার দিকে ফিরেও তাকাল না। তার যত রাগ পড়ল গিয়ে তার বাবার উপরে। তার বাবা তো ইচ্ছা করলেই ওদের ধমকে দিতে পারেন। বেচারা সবুর গরিব, স্কুলে পড়ে না, মাদ্রাসায় পড়ে – এই তো তার অপরাধ। মাদ্রাসায় না পড়ে সে যদি খানায় পড়ত ডোবায় পড়ত – তাতেই বা কার কী ক্ষতি হত। কেন ওরা আদা-জল খেয়ে ওর পিছনে এমন করে লাগবে?
আলি নসিব মিয়াঁ সব বুঝলেন। কিন্তু বুঝেও তিনি কিছুতেই হাসি চাপতে পারলেন না। হেসে ফেলে মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন, ‘কি হইছেরে বেডি? ছেমরাডা প্যাঁচার লাহান বাড়িতে বইয়্যা রইব, একডা কতা কইব না, তাইনাসেন উয়ারে প্যাঁচা কয়।’ নূরজাহান রেগে উত্তর দিল, ‘আপনি আর কইবেন না, আব্বা, হে বেডায় ঘরে বইয়া কাঁদে আর আপনি হাসেন! আমি পোলা অইলে এইদুন একচটকনা দিতাম রুস্তম্যারে আর উই ইবলিশা পোলাপানেরে, যে, ওই হ্যানে পাইর্যা যাইত উৎকা মাইর্যা। উইঠ্যা আর দানাপানি খাইবার অইত না!’ বলেই কেঁদে ফেললে।
আলি নসিব মিয়াঁ মেয়ের মাথায় পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘চুপ দে বেডি, এইবারে ইবলিশের পোলারা আইলে দাবার পইর্যা লইয়া যাইব! মুনশি বেডারে কইয়্যা দিবাম, হে ওই রুস্তম্যারে ধইরা তার কান দুডা এক্কেরে মুতা কইর্যা কাইট্যা হালাইবো!’
নূরজাহান অত্যন্ত খুশি হয়ে উঠল।
সে তাড়াতাড়ি উঠে বলল, ‘আব্বাজান, চা খাইবেন নি?’
আলি নসিব মিয়াঁ হেসে ফেলে বললেন, ‘বেডির বুঝি য়্যাহন চায়ের কথা মনে পল।’
নূরজাহান আলি নসিব মিয়াঁর একমাত্র সন্তান বলে অতিমাত্রায় আদুরে মেয়ে। বয়স পনেরো পেরিয়ে গেছে। অথচ বিয়ে দেবার নাম নেই বাপ-মায়ের। কথা উঠলে বলেন, মনের মতো জামাই না পেলে বিয়ে দেওয়া যায় কী করে! মেয়েকে তো হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দেওয়া যায় না! আসল কথা তা নয়। নূরজাহানের বাপ-মা ভাবতেই পারেন না, ওঁদের ঘরের আলো নূরজাহান অন্য ঘরে চলে গেলে তাঁরা এই আঁধার পুরীতে থাকবেন কী করে! নইলে এত ঐশ্বর্যের একমাত্র উত্তরাধিকারিণীর বরের অভাব হয় না। সন্বন্ধও যে আসে না, এমন নয় ; কিন্তু আলি নসিব মিয়াঁ এমন উদাসীনভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলেন যে, তারা আর বেশি দূর না এগিয়ে সরে পড়ে।
নূরজাহান বাড়িতে থেকে সামান্য লেখাপড়া শিখেছে। এখন সবুরের কাছে উর্দু পড়ে। শরিফ ঘরের এত বড়ো মেয়েকে অনাত্মীয় যুবকের কাছে পড়তে দেওয়া দূরের কথা, কাছেই আসতে দেয় না বাপ মা ; কিন্তু এদিক দিয়ে সবুরের এতই সুনাম ছিল যে, সে নূরজাহানকে পড়ায় জেনেও কোনো লোক এতটুকু কথা উত্থাপন করেনি।
সবুর যতক্ষণ নূরজাহানকে পড়ায় ততক্ষণ একভাবে ঘাড় হেঁট করে বসে থাকে, একটিবারও নূরজাহানের মুখের দিকে ফিরে তাকায় না। বাড়ি ঢোকে মাথা নিচু করে, বেরিয়ে যায় মাথা নিচু করে! নূরজাহান, তার বাবা মা সকলে প্রথম প্রথম হাসত – এখন সয়ে গেছে!
সত্যসত্যই, এই তিন বছর সবুর এই বাড়িতে আছে, এর মধ্যে সে একদিনের জন্যও নূরজাহানের হাত আর পা ছাড়া মুখ দেখেনি।
এ নূরজাহান জাহানের জ্যোতি না হলেও বীররামপুরের জ্যোতি – জোহরা সেতারা, এ সম্বন্ধে কারও মতদ্বৈধ নাই। নূরজাহানের নিজেরও যথেষ্ট গর্ব আছে, মনে মনে তার রূপের সম্বন্ধে।
আগে হত না – এখন কিন্তু নূরজাহানের সে অহংকারে আঘাত লাগে – দুঃখ হয় এই ভেবে যে, তার রূপের কি তা হলে কোনো আকর্ষণই নেই? আজ তিন বছর সে সবুরের কাছে পড়ছে – এত কাছে তবু সে একদিন মুখ তুলে তাকে দেখল না? সবুর তাকে ভালোবাসুক – এমন কথা সে ভাবতেই পারে না, – কিন্তু ভালো না বাসলেও যার রূপের খ্যাতি এ অঞ্চলে – যাকে একটু দেখতে পেলে অন্য যে কোনো যুবক জন্মের জন্য ধন্য হয়ে যায় – তাকে একটিবার একটুক্ষণের জন্যেও চেয়েও দেখল না! তার সতীত্ব কি নারীর সতীত্বের চেয়েও ঠুনকো?
ভাবতে ভাবতে সবুরের উপর তার আক্রোশ বেড়ে ওঠে, মন বিষিয়ে যায়, ভাবে আর তার কাছে পড়বে না! কিন্তু যখন দেখে – নির্দোষ নির্বিরোধ নিরীহ সবুরের উপর রুস্তমি দল ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে, তখন আর থাকতে পারে না। আহা, বেচারার হয়ে কথা কইবার যে কেউ নেই! সে নিজেও যে একটিবার মুখ ফুটে প্রতিবাদ করে না। এ কী পুরুষ মানুষ বাবা! মার, কাট, মুখ দিয়ে কথাটি নেই! এমন মানুষও থাকে দুনিয়াতে!
যত সে এইসব কথা ভাবতে থাকে, তত এই অসহায় মানুষটির ওপর করুণায় নূরজাহানের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে!
সবুর পুরুষ বলতে যে মর্দ-মিনসে বোঝায় – তা তো নয়ই, সুপুরুষও নয়। শ্যামবর্ণ একহারা চেহারা। রূপের মধ্যে তার চোখ দুটি। যেন দুটি ভীরু পাখি। একবার চেয়েই অমনি নত হয়। সে চোখ, তার চাউনি – যেমন ভীরু, তেমনই করুণ, তেমনই অপূর্ব। পুরুষের অত বড়ো অত সুন্দর চোখ সহজে চোখে পড়ে না।
এই তিন বছর সে এই বাড়িতে আছে, কিন্তু কেউ ডেকে জিজ্ঞাসা না করলে – সে অন্য লোক তো দূরের কথা – এই বাড়িরই কারুর সাথে কথা কয়নি। নামাজ পড়ে, কোরান তেলাওত করে, মাদ্রাসা যায়, আসে, পড়ে কিংবা ঘুমোয় – এই তার কাজ। কোনোদিন যদি ভুলক্রমে ভিতর থেকে খাবার না আসে, সে না খেয়েই মাদ্রাসা চলে যায় – চেয়ে খায় না। পেট না ভরলেও দ্বিতীয়বার খাবার চেয়ে নেয় না। তেষ্টা পেলে পুকুরঘাটে গিয়ে জল খেয়ে আসে, বাড়ির লোকের কাছে চায় না।
সবুর এত অসহায় বলেই নূরজাহানের অন্তরের সমস্ত মমতা সমস্ত করুণা ওকে সদাসর্বদা ঘিরে থাকে। সে না থাকলে, বোধ হয় সবুরের খাওয়াই হত না সময়ে। কিন্তু নূরজাহানের এত যে যত্ন, এত যে মমতা এর বিনিময়ে সবুর এতটুকু কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টি দিয়েও তাকে দেখেনি, কিছু বলা তো দূরের কথা। মারলে – কাটলেও অভিযোগ করে না, সোনা-দানা দিলেও কথা কয় না!
২
সেদিন আলি নসিব মিয়াঁর বাড়িতে একজন জবরদস্ত পশ্চিমি মউলবি সাহেব এসেছেন। রাত্রে মউলুদ শরিফ ও ওয়াজ নসিহৎ হবে। মউলবি সাহেবের সেবা-যত্নের ভার পড়েছে সবুরের উপর। বেচারা জীবনে এত বেশি বিব্রত হয়নি। কী করে, সে তার সাধ্যমতো মউলবি সাহেবের খেদমত করতে লাগল।
সবুরকে বাইরে বেরুতে দেখে রুস্তমি দলের একটি দুটি করে ছেলে এসে জুটতে লাগল। তাদের দেখে সবুর বেচারার, ভাসুরকে দেখে ভাদ্র-বউর যেমন অবস্থা হয়, তেমনই অবস্থা হল।
মউলবি সাহেবের পাগড়ির ওজন কত, দাড়ির ওজন কত, শরীরটাই বা কয়টা বাঘে খেয়ে ফুরোতে পারবে না, তাঁর গোঁফ উই-এ না ইঁদুরে খেয়েছে – এইসব গবেষণা নিয়েই রুস্তমিদল মত্ত ছিল ; রুস্তম তখন এসে পৌঁছেনি বলে সবুরকে জ্বালাতন করা শুরু করেনি।
হঠাৎ মউলবি সাহেব বিশুদ্ধ উর্দুতে সবুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, সে কী করে। সবুর বিনীতভাবে বললে সে তালেবে এলম বা ছাত্র। আর যায় কোথায় ! ইউসুফ বলে উঠল ‘প্যাঁচা মিয়াঁ কী কইল, রে ফজল্যা?’ ফজল হেসে গড়িয়ে পড়ে বললে, ‘প্যাঁচা মিয়াঁ কইল, মুই তালবিলিম!’ ততক্ষণে রুস্তম এসে পড়েছে! সে ফজলের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল, ‘কেডা তালবিল্লি! প্যাঁচা মিয়াঁ?’ ছেলেরা হাসতে হাসতে শুয়ে পড়ে রোলারের মতো গড়াতে লাগল! ‘হয়! রুস্তম্যা জোর কইছে রে! তালবিল্লি! – উরে বাপপুরে! ইল্লারে বিল্লা! তালবিল্লি – হি হি হি হা হা হা’ বলে আর হেসে লুটিয়ে পড়ে। কস্তা-পেড়ে হাসি!
বেচারা সবুর ততক্ষণে মউলবি সাহেবের সেবা-টেবা ফেলে তার কামরায় ঢুকে খিল এঁটে দিয়েছে। রুস্তম সঙ্গে সঙ্গে গান বেঁধে গাইতে লাগল –
প্যাঁচা অইল তালবিল্লি,
দেওবন্দ যাইয়া যাইব দিল্লি।
আইয়া করব চিল্লাচিল্লি –
কুত্তার ছাও আর ইল্লিবিল্লি!
মউলবি সাহেব আর থাকতে পারলেন না। আস্তিন গুটিয়ে ছেলেদের তাড়া করে এলেন। ছেলেরা তাঁর বিশিষ্টরূপে শালের মতো বিশাল দেহ দেখে পালিয়ে গেল। কিন্তু যেতে যেতে গেয়ে গেল –
উলু আয়া লাহোর সে
আজ পড়েগা আলেফ বে!
মউলবি সাহেব বিশুদ্ধ উর্দু ছেড়ে দিয়ে ঠেট হিন্দিতে ছেলেদের আদ্যশ্রাদ্ধ করতে লাগলেন।
আলি নসিব মিয়াঁ সব শুনে ছেলেদের ডেকে পাঠালেন। আজ মউলবি সাহেবের সামনে তাদের বেশ করে উত্তম-মধ্যম দেবেন। কিন্তু ছেলেদের একজনকেও খুঁজে পাওয়া গেল না।
ছেলেরা ততক্ষণ তিন চার মাইল দূরে এক বিলের ধারে ব্যাং সংগ্রহের চেষ্টায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। মউলবি সাহেব তাদের তাড়া করায়, তারা বেজায় চটে গিয়ে ঠিক করেছে – আজ মউলবি সাহেবের ওয়াজ পণ্ড করতে হবে। স্থির হয়েছে ; যখন বেশ জমে আসবে ওয়াজ, তখন একজন ছেলে একটা ব্যাং-এর পেট এমন করে টিপবে যে ব্যাংটা ঠিক সাপে ধরা ব্যাং-এর মতো করে চ্যাঁচাবে; ততক্ষণ আর একজন একটা ব্যাং মজলিশের মাঝখানে ছেড়ে দেবে, সেটা যখন লাফাতে থাকবে – তখন অন্য একজন ছেলে চিৎকার করে উঠবে – সাপ! সাপ!
ব্যাস! তাইলেই ওয়াজের দফা ওইখানেই ইতি!
বহু চেষ্টার পর গোটাকতক ব্যাং ধরে নিয়ে যে-যার বাড়ি ফিরল।
আলি নসিব মিয়াঁর বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে বারি বলে উঠল, ‘রুস্তম্যা রে, হালার তালবিল্লি পায়খানায় গিয়াছে। বদনাটা উডাইয়া লইয়া আইমু?’
রুস্তম খুশি হয়ে তখনই হুকুম দিল। বারি আস্তে আস্তে বদনাটি উঠিয়ে এনে পুকুরঘাটে রেখে দিয়ে এল।
একঘণ্টা গেল, দু-ঘণ্টা গেল, সবুর যেমন অবস্থায় গিয়ে বসেছিল তেমনই অবস্থায় বসে রইল পায়খানায়! বেরও হয় না, কাউকে দিয়ে বদনাও চায় না! দূরে আলি নসিব মিয়াঁকে দেখে ছেলের দল যেদিকে পারল পালিয়ে গেল!
আলি নসিব মিয়াঁ ভাবলেন, নিশ্চয় সবুরের কিছু একটা করেছে পাজি ছেলের দল। কিন্তু এসে সবুরকে দেখতে না পেয়ে বাড়িতে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, তারাও কিছু জানে না বললে। ছেলের দল হল্লা করছিল ‘তালবিল্লি’ বলে – এইটুকু তারা জানে।
আর দুই ঘণ্টা অনুসন্ধানের পর সবুরের সন্ধান পাওয়া গেল। সবুর সব বললে। কিন্তু তাতে উলটো ফল হল। আলি নসিব মিয়াঁ তাকেই বকতে লাগলেন – সে কেন বেরিয়ে এসে কারুর কাছে বদনা চাইলে না – এ ব্যাপার শুনে নূরজাহান রাগ করার চেয়ে হাসলেই বেশি! এমনও সোজা মানুষ হয়!
আর একদিন সে হেসেছিল সবুরের দুর্দশায়। সবুর একদিন চুল কাটাচ্ছিল। রুস্তম তা দেখতে পেয়ে পিছন থেকে নাপিতকে ইশারায় একটা টাকার লোভ দেখিয়ে মাঝখানে টিকি রেখে দিতে বলে। সুশীল নাপিতও তা পালন করে। চুল কেটে স্নান করে সবুর যখন বাড়িতে খেতে গেছে, তখন নূরজাহানের চোখে পড়ে প্রথম সে দৃশ্য। নূরজাহানের হাসিতে যে ব্যথা পেয়েছিল সবুর, তা সেদিন নূরজাহানের চোখ এড়ায়নি।
আজ আবার হেসে ফেলেই নূরজাহানের মন ব্যথিত হয়ে উঠল সবুরের সেই দিনের মুখ স্মরণ করে। কী জানি কেন, তার চোখ জলে ভরে উঠল।…
সন্ধ্যায় যখন মউলবি সাহেব ওয়াজ করছেন, এবং ভক্ত শ্রোতাবৃন্দ তাঁর কথা যত বুঝতে না পারছে, তত ভক্তিতে গদ্গদ হয়ে উঠছে – তখন সহসা মজলিশের এক কোনায় অসহায় ভেকের করুণ ক্রন্দন ধ্বনিত হয়ে উঠল! শ্রোতাবৃন্দ চকিত হয়ে উঠল। একটু পরেই দেখা গেল, রক্তাক্ত কলেবর বুঝিবা সেই ভেক-প্রবরই উপবিষ্ট ভক্তবৃন্দের মাথার উপর দিয়ে হাউণ্ড রেস আরম্ভ করে দিল! সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার উঠল – “সাপ! সাপ!’
আর বলতে হল না। নিমেষে যে যেখানে পারল পালিয়ে গেল। মউলবি সাহেব তক্তাপোশে উঠে পড়ে তাঁর জাব্বা জোব্বা ঝাড়তে লাগলেন। আর ওয়াজ হল না সেদিন।…
মউলবি সাহেব যখন খেতে বসেছেন, তখন অদূরে গান শোনা গেল –
‘উলু! বোলো’ কহে সাপ
উলু বোলে – ‘বাপরে রে বাপ।’
‘কাল নসিহত হোগা ফের?’
উলু বোলে – কের কের কের!
লে উঠা লোটা কন্বল
উলু! আপনা ওতন চল!
সহসা মউলবি সাহেবের গলায় মুরগির ঠ্যাং আটকে গেল।আলি নসিব মিয়াঁ নিষ্ফল আক্রোশে ফুলতে লাগলেন।
৩
সেদিন রাস্তা দিয়ে গফরগাঁও-এর জমিদারদের হাতি যাচ্ছিল। নূরজাহান বেড়ার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। বেচারা সবুরও হাতি দেখার লোভ সংবরণ করতে না পেরে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। অদূরে সদলবলে রুস্তম দাঁড়িয়ে ছিল। সে হাতিটার দিকে দেখিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘এরিও তালবিল্লি মিয়াঁ গো! হুই তোমাগ বাছুরডা আইতেছে, ধইরা লইয়াও।’ রাস্তার সকলে হেসে গড়িয়ে পড়ল। রাস্তার একটা মেয়ে বলে উঠল, ‘বিজাত্যার পোলাডা! হাতিডা বাছুর না, বাছুর তুই!’ ভাগ্যিস রুস্তম শুনতে পায়নি।
নূরজাহান তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। সে যত না রাগল ছেলেগুলোর উপর, তার অধিক রেগে উঠল সবুরের উপর। সে প্রতিজ্ঞা করল মনে মনে, আজ তাকে দুটো কথা শুনিয়ে দেবে। এই কী পুরুষ! মেয়েছেলেরও অধম যে!
সেদিন সন্ধ্যায় যখন পড়াতে গেল সবুর, তখন কোনো ভূমিকা না করে নূরজাহান বলে উঠল, ‘আপনি বেডা না? আপনারে লইয়া ইবলিশা পোলাপান যা তা কইব আর আপনি হুইন্যা ল্যাজ গুডাইয়া চইলা আইবেন? আল্লায় আপনারে হাত-মুখ দিছে না।’
সবুর আজ যেন ভুলেই তার ব্যথিত চোখ দুটি নূরজাহানের মুখের উপর তুলে ধরল! কিন্তু চোখ তুলে যে রূপ সে দেখলে, তাতে তার ব্যথা লজ্জা অপমান সব ভুলে গেল সে। দুই চোখে তার অসীম বিস্ময় অনন্ত জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল। এই তুমি! সহসা তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল – ‘নূরজাহান!’
নূরজাহান বিস্ময়-বিমূঢ়ার মতো তার চোখের দিকে চেয়ে ছিল। এ কোন বনের ভীরু হরিণ? অমন হরিণ-চোখ যার, সে কি ভীরু না হয়ে পারে? নূরজাহান কখনও সবুরকে চোখ তুলে চাইতে দেখেনি। সে রাস্তা চলতে কথা কইত – সব সময় চোখ নিচু করে। মানুষের চোখ যে মানুষকে এত সুন্দর করে তুলতে পারে – তা আজ সে প্রথম দেখল।
সবুরের কন্ঠে তার নাম শুনে লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে উঠল। বর্ষারাতের চাঁদকে যেন ইন্দ্রধনুর শোভা ঘিরে ফেলল।
আজ চিরদিনের শান্ত সবুর চঞ্চল মুখর হয়ে উঠেছে। প্রশান্ত মহাসাগরে ঝড় উঠেছে। মৌনী পাহাড় কথা কয় না, কিন্তু সে যেদিন কথা কয়, সেদিন সে হয়ে উঠে অগ্নিগিরি।
সবুরের চোখে মুখে পৌরুষের প্রখর দীপ্তি ফুটে উঠল। সে নূরজাহানের দিকে দীপ্ত চোখে চেয়ে বলে উঠল, ‘ওই পোলাপানেরে যদি জওয়াব দিই, তুমি খুশি হও?’ নূরজাহানও চকচকে চোখ তুলে বলে উঠল, ‘কে জওয়াব দিব? আপনি?’
এ মৃদু বিদ্রুপের উত্তর না দিয়ে সবুর তার দীর্ঘায়ত চোখ দুটির জ্বলন্ত ছাপ নূরজাহানের বুকে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল। নূরজাহান আত্মবিস্মৃতের মতো সেইখানে বসে রইল। তার দুটি সুন্দর চোখ আর ততোধিক সুন্দর চাউনি ছাড়া আর কোনো কিছু মনে রইল না! যে সবুরকে কেউ কখনও চোখ তুলে চাইতে দেখেনি, আজ সে উজ্জ্বলচোখে, দৃপ্তপদে রাস্তায় পায়চারি করছে দেখে সকলে অবাক হয়ে উঠল।
রুস্তমিদল গাঙের পার থেকে বেড়িয়ে সেই পথে ফিরছিল।হঠাৎ ফজল চিৎকার করে উঠল – ‘উইরে তালবিল্লি।’
সবুর ভলো করে আস্তিন গুটিয়ে নিল।
বারি পিছু দিক থেকে সবুরের মাথায় ঠোকর দিয়ে বলে উঠল, ‘প্যাঁচারে, তুমি ডাহো।’
সবুর কিছু না বলে এমন জোরে বারির এক গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলে যে, সে সামলাতে না পেরে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল। সবুরের এ অপ্রত্যাশিত ব্যবহারে দলের সকলে কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
সবুর কথাটি না বলে গম্ভীরভাবে বাড়ির দিকে যেতে লাগল। বারি ততক্ষণে উঠে বসেছে। উঠেই সে চিৎকার করে উঠল – ‘সে হালায় গেল কোই?’
বলতেই সকলের যেন হুঁশ ফিরে এল। মার মার করে সকলে গিয়ে সবুরকে আক্রমণ করলে। সবুরও অসম সাহসে তাদের প্রতি-আক্রমণ করলে। সবুরের গায়ে যে এত শক্তি, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। সে রুস্তমি দলের এক এক জনের টুঁটি ধরে পাশের পুকুরের জলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে লাগল।
আলি নসিব মিয়াঁর এই পুকুরটা নতুন কাটানো হয়েছিল, আর তার মাটিও ছিল অত্যন্ত পিছল। কাজেই যারা পুকুরে পড়তে লাগল গড়িয়ে – তারা বহু চেষ্টাতেও পুকুরের অত্যুচ্চ পাড় বেয়ে সহজে উঠতে পারল না। পা পিছলে বারে বারে জলে পড়তে লাগল গিয়ে। এইরূপে যখন দলের পাঁচ ছয় জন, মায় রুস্তম সর্দার জলে গিয়ে পড়েছে – তখন রুস্তমিদলের আমির তার পকেট থেকে দু-ফলা ছুরিটা বের করে সবুরকে আক্রমণ করল। ভাগ্যক্রমে প্রথম ছুরির আঘাত সবুরের বুকে না লেগে হাতে গিয়ে লাগল। সবুর প্রাণপণে আমিরের হাত মুচড়ে ধরতেই সে ছুরি সমেত উলটে পড়ে গেল এবং আমিরের হাতের ছুরি আমিরেরই বুকে আমূল বিদ্ধ হয়ে গেল। আমির একবার মাত্র ‘উঃ” বলেই অচৈতন্য হয়ে গেল! বাকি যারা যুদ্ধ করছিল – তারা পাড়ায় গিয়ে খবর দিতেই পাড়ার লোক ছুটে এল। আলি নসিব মিয়াঁও এলেন।
সবুর ততক্ষণে তার রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত ক্লান্ত শরীর নিয়েই আমিরকে কোলে তুলে নিয়ে তার বুকের ছুরিটা তুলে ফেলে সেই ক্ষতমুখে হাত চেপে ধরেছে। আর তার হাত বেয়ে ফিনিক দিয়ে রক্ত-ধারা ছুটে চলছে!
আলি নসিব মিয়াঁ তাঁর চক্ষুকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি দুই হাত দিয়ে তাঁর চক্ষু ঢেকে ফেললেন।
একটু পরে ডাক্তার এবং পুলিশ দু-ই এল। আমিরকে নিয়ে ডাক্তারখানায়, সবুরকে নিয়ে গেল থানায়।
সবুরকে থানায় নিয়ে যাবার আগে দারোগাবাবু আলি নসিব মিয়াঁর অনুরোধে তাকে একবার তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সে দারোগাবাবুর কাছে একটুও অতিরঞ্জিত না করে সমস্ত কথা খুলে বললে। তার কথা অবিশ্বাস করতে কারুরই প্রবৃত্তি হল না। দারোগাবাবু বললেন, ‘কেস খুব সিরিয়স নয়, ছেলেটা বেঁচে যাবে। এ কেস আপনারা আপসে মিটিয়ে ফেলুন সাহেব।’
আলি নসিব মিয়াঁ বললেন, আমার কোনো আপত্তি নাই দারোগা সাহেব, আমিরের বাপে কি কেস মিটাইব? তারে তো আপনি জানেন। যারে কয় এক্কেরে বাঙাল!’
দারোগাবাবু বললেন ‘দেখা যাক, এখন তো ওকে থানায় নিয়ে যাই। কী করি, আমাদের কর্তব্য করতেই হবে।’
ততক্ষণে আলি নসিব মিয়াঁর বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেছে। এই খবর শুনেই নূরজাহান মূর্ছিতা হয়ে পড়েছিল। আলি নসিব মিয়াঁ সবুরকে সাথে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, তখন নূরজাহান একেবারে প্রায় সবুরের পায়ের কাছে পড়ে কেঁদে উঠল, ‘কে তোমারে এমনডা করবার কইছিল? কেন এমনডা করলে?’
নূরজাহানের মা সবুরকে তার গুণের জন্য ছেলের মতোই মনে করতেন। তা ছাড়া, তাঁর পুত্র না হওয়ায় পুত্রের প্রতি সঞ্চিত সমস্ত স্নেহ গোপনে সবুরকে ঢেলে দিয়েছিলেন। তিনি সবুরের মাথাটা বুকের উপর চেপে ধরে কেঁদে আলি নসিব মিয়াঁকে বললেন, ‘আমার পোলা এ, আমি দশ হাজার ট্যাহা দিবাম, দারোগাব্যাডারে কন, হে এরে ছ্যাইরা দিয়া যাক।’
সবুর তার রক্তমাখা হাত দিয়ে নূরজাহানকে তুলে বলে উঠল, ‘আমি যাইতেছি ভাই! যাইবার আগে দেহাইয়া গেলাম – আমিও মানুষের পোলা। এ যদি না দেহাইতাম, তুমি আমায় ঘৃণা করতা। খোদায় তোমায় সুখে রাখুন!’ বলেই তার মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বললে ‘আম্মাগো এই তিনডা বছরে আপনি আমায় মায়ের শোক ভুলাইছিলেন।’ আর সে বলতে পারল না – কান্নায় তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল।’
আলি নসিব মিয়াঁর পদধূলি নিয়ে সে নির্বিকারচিত্তে থনায় চলে গেল। দারোগাবাবু কিছুতেই জামিন দিতে রাজি হলেন না। দশ হাজার টাকার বিনিময়েও না, খুনি আসামিকে ছেড়ে দিল তাঁর চাকরি যাবে।
নূরজাহানের কানে কেবল ধ্বনিত হতে লাগল, ‘তুমি আমায় ঘৃণা করতে।’ তার ঘৃণায় সবুরের কী আসত যেত? কেন সে তাকে খুশি করবার জন্য এমন করে ‘মরিয়া হইয়া’ উঠল? সে যদি আজ এমন করে না বলত সবুরকে, তা হলে কখনই সে এমন কাজ করত না। এমন নির্যাতন তো সে তিন বছর ধরে সয়ে আসছে। তারই জন্য আজ সে থানায় গেল। দু-দিন পরে হয়তো তার জেল, দ্বীপান্তর – হয়তো বা তার চেয়ে বেশি – ফাঁসি হয়ে যাবে! ‘উঃ’ বলে আর্তনাদ করে সে মূর্ছিতা হয়ে পড়ল।
আলি নসিব মিয়াঁ যেন আজ এক নতুন জগতের সন্ধান পেলেন। আজ সবুর তার দুঃখ দিয়ে তাঁর সুখের বাকি দিনগুলোকেও মেঘাচ্ছন্ন করে দিয়ে গেল! একবার মনে হল, বুঝি বা দুধ-কলা দিয়ে তিনি সাপ পুষেছিলেন! পরক্ষণেই মনে হল সে সাপ নয়, সাপ নয়! ও নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক ! আর – যদি সাপই হয় – তা হলেও ওর মাথায় মনি আছে ! ও জাত-সাপ।
হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে গেল, তাঁর অনুকম্পায় প্রতিপালিত হলেও বংশ-মর্যাদায় সবুর তাঁদের চেয়েও অনেক উচ্চে। আজ সে দরিদ্র, পিতৃমাতৃহীন নিঃসহায় – কিন্তু একদিন এদেরই বাড়িতে আলি নসিব মিয়াঁর পূর্বপুরুষেরা নওকরি করেছেন। তা ছাড়া এই তিন বছর তিনি সবুরকে যে অন্ন বস্ত্র দিয়েছেন তার বিনিময়ে সে তাঁর কন্যাকে উর্দু ও ফার্সিতে যে কোনো মাদ্রাসার ছেলের চেয়েও পারদর্শিনী করে দিয়ে গেছে। আলি নসিব মিয়াঁ নিজে মাদ্রাসা-পাশ হলেও মেয়ের কাছে তাঁর উর্দু ফারসি সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে ভয় হয়। সে তো এতটুকু ঋণ রাখিয়া যায় নাই। শ্রদ্ধায় প্রীতিতে পুত্রস্নেহে তাঁর বুক ভরে উঠল।… যেমন করে হোক, ওকে বাঁচাতেই হবে!
নিজের জন্য নয়, নিজের চেয়েও প্রিয ওই কন্যার জন্য! আজ তো আর তাঁর মেয়ের মন বুঝতে আর বাকি নেই। অন্যের ঘরে পাঠাবার ভয়ে মেয়ের বিয়ের নামে শিউরে উঠেছেন এতদিন, আজ যদি এই ছেলের হাতে মেয়েকে দেওয়া যায় – মেয়ে সুখী হবে, তাকে পাঠাতেও হবে না অন্য ঘরে। সে-ই তো ঘরের ছেলে হয়ে থাকবে। উচ্চশিক্ষা? মাদ্রাসার শেষ পরীক্ষা তো সে দিয়েইছে – পাশও করবে সে হয়তো সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে। তার পর কলেজে ভর্তি করে দিলেই হবে।
এই ভবিষ্যৎ সুখের কল্পনা করে – আলি নসিব মিয়াঁ অনেকটা শান্ত হলেন এবং মেয়েকেও সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। সে রাত্রে নূরজাহানের আর মূর্ছা হল না, সে ঘুমাতেও পারল না। সমস্ত অন্ধকার ভেদ করে তার চোখে ফুটে উঠতে লাগল – সেই দুটি চোখ, দুটি তারার মতো! প্রভাতি তারা আর সন্ধ্যাতারা।
৪
আমিরকে বাঁচানো গেল না মৃত্যুর হাত থেকে – সবুরকে বাঁচানো গেল না জেলের হাত থেকে।
ময়মনসিংহের হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে পথেই তার মৃত্যু হল। আমিরের পিতা কিছুতেই মিটমাট করতে রাজি হলেন না। তিনি এই বলে নালিশ করলেন যে, তাঁর ইচ্ছা ছিল নূরজাহানের সাথে আমিরের বিয়ে দেন, আর তা জানতে পেরেই সবুর তাকে হত্যা করেছে। তার কারণ, সবুরের সাথে নূরজাহানের গুপ্ত প্রণয় আছে। প্রমাণ-স্বরূপ তিনি বহু সাক্ষী নিয়ে এলেন – যারা ওই দুর্ঘটনার দিন নূরজাহানকে সবুরের পা ধরে কাঁদতে দেখেছে! তা ছাড়া সবুর পড়াবার নাম করে নূরজাহানের সাথে মিলবার যথেষ্ট সুযোগ পেত!
নূরজাহান আর আলি নসিব মিয়াঁ একেবারে মাটির সাথে মিশে গেল। দেশময় টিঁ টিঁ পড়ে গেল। অধিকাংশ লোকেই একথা বিশ্বাস করল।
আলি নসিব মিয়াঁ শত চেষ্টা করেও সবুরকে উকিল দেওয়ার জন্য রাজি করাতে পারলেন না। সে কোর্টে বলল, সে নিজেই আত্মপক্ষ সমর্থন করবে – উকিল বা সাক্ষী কিছুই নিতে চায় না সে। আলি নসিব মিয়াঁর টাকার লোভে বহু উকিল সাধ্যসাধনা করেও সবুরকে টলাতে পারল না। আলি নসিব মিয়াঁ তাঁর স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে তাকে জেলে দেখা করে শেষ চেষ্টা করেছিলেন। তাতেও সফলকাম হননি। নূরজাহানের অনুরোধে সে বলেছিল, অনেক ক্ষতিই তোমাদের করে গেলাম – তার উপরে তোমাদের আরও আর্থিক ক্ষতি করে আমার বোঝা ভারী করে তুলতে চাইনে। আমায় ক্ষমা কোরো নূরজাহান, আমি তোমাদেরে আমার কথা ভুলতে দিতে চাইনে বলেই এই দয়াটুকু চাই!
সে সেশনে সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বিক অকপটে বলে গেল। জজ সব কথা বিশ্বাস করলেন। জুরিরা বিশ্বাস করলেন না। সবুর সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হল। আপিল করল না। সকলে বললে, আপিল করলে সে মুক্তি পাবেই। তার উত্তরে সবুর হেসে বলেছিল যে, সে মুক্তি চায় না – আমিরের যে-টুকু রক্ত তার হাতে লেগেছিল– তা ধুয়ে ফেলতে সাতটা বছরেও যদি সে পারে– সে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবে।
জজ তার রায়ে লিখেছিলেন, আর কাউকে দণ্ড দিতে এত ব্যথা তিনি পাননি জীবনে।
যেদিন বিচার শেষ হয়ে গেল, সেদিন সপরিবারে আলি নসিব মিয়াঁ ময়মনসিংহে ছিলেন।
নূরজাহান তার বাবাকে সেই দিনই ধরে বসে, – তারা সকলে মক্কা যাবে। আলি নসিব মিয়াঁ বহুদিন থেকে হজ করতে যাবেন বলে মনে করে রেখেছিলেন, মাঝে মাঝে বলতেনও সে কথা। নানান কাজে যাওয়া আর হয়ে উঠেনি, মেয়ের কথায় তিনি যেন আশমানের চাঁদ হাতে পেলেন। অত্যন্ত খুশি হয়ে বলে উঠলেন, ‘ঠিক কইছস বেডি, চল আমরা মক্কায় গিয়াই এ সাতটা বছর কাটাইয়া দিই। এ পাপ-পুরীতে আর থাকবাম না! আর আল্লায় যদি বাঁচাইয়া রাহে, ব্যাডা তালবিল্লিরে কইয়া যাইবাম, হে যেন একডিবার আমাদের দেখা দিয়া আইয়ে।’ ‘ব্যাডা তালবিল্লি’ বলেই হো হো করে পাগলের মতো হেসে উঠেই আলি নসিব মিয়াঁ পরক্ষণে শিশুর মতো ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
নূরজাহানের মা প্রতিবাদ করলেন না। তিনি জানতেন, মেয়ের যা কলঙ্ক রটেছে, তাতে তার বিয়ে আর এ দেশে দেওয়া চলবে না। আর, এ মিথ্যা বদনামের ভাগী হয়ে এ দেশে থাকাও চলে না।
ঠিক হল একেবারে সব ঠিকঠাক করে জমি-জায়গা বিক্রি করে শুধু নগদ টাকা নিয়ে চলে যাবেন। আলি নসিব মিয়াঁ সেইদিন স্থানীয় ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সাথে দেখা করে সম্পত্তি বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে এলেন। কথা হল ব্যাঙ্কই এখন টাকা দেবে, পরে তারা সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা তুলে নেবে।
তার পরদিন সকলে জেলে গিয়ে সবুরের সাথে দেখা করলেন। সবুর সব শুনল। তার চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ল। জেলের জামার হাতায় তা মুছে বললে, ‘আব্বা, আম্মা, আমি সাত বছর পরে যাইবাম আপনাদের কাছে– কথা দিতাছি।’
তারপর নূরজাহানের দিকে ফিরে বললে, ‘আল্লায় যদি এই দুনিয়ার দেখবার না দেয়, যে দুনিয়াতেই তুমি যাও আমি খুঁইজ্যা লইবাম।’ অশ্রুতে কন্ঠ নিরুদ্ধ হয়ে গেল, আর সে বলতে পারলে না । নূরজাহান কাঁদতে কাঁদতে সবুরের পায়ের ধুলা নিতে গিয়ে তার দু-ফোঁটা অশ্রু সবুরের পায়ে গড়িয়ে পড়ল! বলল, ‘তাই দোওয়া করো।’
কারাগারের দুয়ার ভীষণ শব্দে বন্ধ হয়ে গেল। সেই দিকে তাকিয়ে নূরজাহানের মনে হল – তার সকল সুখের স্বর্গের দ্বার বুঝিবা চিরদিনের জন্যই রুদ্ধ হয়ে গেল!